Friday, March 25, 2011

কবিগানের বিলুপ্তি ও কবিয়াল মদন সরকার

(কবিগানের) প্রচলন উইঠ্যা পড়ছে। আগে দল আছিল্। দলের সঙ্গে দোহার থাকত। ঢুলি থাকত। দুই কবি দুই পক্ষে থাইক্যা কথা কাডাকাডি করতাম। কবি গাইতাম। এইডা হইলো কবিগান। দুইপক্ষে থাইক্যা কাডাকাডি করতাম আর কি। এইডা বাক্যযুদ্ধ। আমি কইতাম আমার কথা, হে কইত তার কথা। শ্রোতাগণে বিচার করত যে কার কথাডা দামী, আর কারডা কমদামী। শ্রোতাগণ বিচারক।
(সিংহের বাংলার কবিয়াল মদন সরকারের অন্তরঙ্গ বয়ান, হাওর জনপদের গীতরঙ্গ : অন্তরঙ্গ আলোয়, কামালউদ্দিন কবির) 
শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উপযোগী করে পরিবেশিত কার্যত জনবিচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিকতাহীন কাব্যধারাটিকে বাংলা কবিতার মূলধারা বলে আখ্যায়িত করবার রেওয়াজটি সম্প্রতি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ লালন-হাসন-বিজয়-জালাল-করিম'এর মতো গুরুত্বপূর্ণ লোকপ্রসিদ্ধ কবিগণ কথিত মূলধারার আওতায় কবি হিসেবেই গণ্য হন না। তথ্য-প্রমাণ সহযোগে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন বাংলার প্রগতিশীল প্রবীণ চিন্তক যতীন সরকার। তিনি ইতিহাস ঘেঁটে দেখিয়েছেন যে, বাংলার গ্রামীণ কৃষিজীবী ও অন্যান্য বৃত্তিজীবীদের মধ্য থেকে উঠে আসা কবি, বাংলার নব্বই শতাংশ মানুষ যাঁদের সাহিত্যের উপভোক্তা, তাঁরাই বাংলা সাহিত্যের মূলধারাটিকে সতত প্রবাহিত রেখেছেন। গণমানুষের প্রিয় এই ধারাটিই বাংলা কবিতার বা সাহিত্যের মূলধারা। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতি ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই মনে করি। কারণ কবিতার এ ধারাটিই বাংলা কাব্যঐতিহ্যের পরম্পরাবাহিত এবং এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শত-সহস্র গণমানুষসংশ্লিষ্ট কবি তাঁদের কাব্য রচনা ও পরিবেশনার ধারা অব্যাহত রেখেছেন, যাঁদের খোঁজখবর আমরা খুব কমই রাখি ও রাখবার মানসিকতা ধারণ করি। এর বিপরীতে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রচলিত কাব্যধারাটি বাংলা কবিতার হাজার বছরের ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কচ্ছিন্ন। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের এই ছেদ আর ঘুচবে না ধারণা করেও লোকধারা বলে পরিচিত ধারাটিকেই বাংলা কবিতার মূলধারা বলে চিনিয়ে দেবার এই যতীন সরকারীয় প্রয়াসটি বাংলার সিংহভাগ স্বল্পশিক্ষিত ও শিক্ষাবঞ্চিত কাব্যামোদী জনতার কাব্যরুচির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন বলে গণ্য করা সংগত। আমি অন্তত বিষয়টাকে সেভাবে দেখতে প্রস্তুত।

এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, বাংলা কবিতার কলাকৈবল্যবাদী ইউরোপবাহিত ধারাটি রীতিমতো পাঠকবিচ্ছিন্ন। এ কবিতার ভোক্তারা (এখানে কেবল পাঠক) সংখ্যায় খুবই সীমিত। শিক্ষিতদের যে অংশের নিয়মিত পাঠাভ্যাস আছে, তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশই মাত্র এসব কবিতার খোঁজখবর রাখেন ও পড়েন। সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলা যায়, শিক্ষিত পাঠকশ্রেণির মধ্যকার কেবল কবি, কবিতাকর্মী ও কবিযশোপ্রার্থীরাই এসব কবিতার পাঠক! এ ধারার একজন নগণ্য কবিতাকর্মী হিসেবে যখন কথিত লোকধারার একজন কবির জনপ্রিয়তার বহর সম্পর্কে ধারণা পাই, তখন নিজের জনবিচ্ছিন্নতার পরিসর আন্দাজ করে নিজেকে খুব দীনহীন ও অকর্মা মনে হয়। আমি যে ধরনের কবিতা করি, তা কোটি-কোটি মানুষকে স্পর্শ করবার সক্ষমতা ধরে না। তা বিষয় ও ভাষার কারণে যেমন, তেমনি পরিবেশন রীতি ও মাধ্যমের কারণেও। পরিবেশন রীতি ও মাধ্যম বদলে মৎলিখিত কাব্যকর্ম গীত হবার বন্দোবস্ত করা হলেও নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আমি গণমানুষের কাছে ততটা গ্রহণযোগ্য হবো না, যতটা আজও গৃহীত হন নেত্রকোনার বাউলকবি জালাল উদ্দীন খাঁ। তিনি হন কারণ তিনি সিংহভাগ গ্রামজনতার আঁতের খবর জানতেন, তাদের ভালো-লাগা মন্দ-লাগা জানতেন, তাদের ভাবনাচিন্তা-দর্শন ও জীবন-জীবিকাকে জানতেন ও সে সবই তাঁর কবিতায় মূর্ত করে তুলতেন। আমার জায়গায় এখানে যদি নেত্রকোনায় জন্ম নেয়া লব্ধপ্রতিষ্ঠ আধুনিক কবি নির্মলেন্দু গুণকে রেখে ভাবা যায়, তাঁর জনপ্রিয়তাও জালাল উদ্দীন খাঁর জনপ্রিয়তার ধারকাছ দিয়ে যাবে না ধারণা করি; যদিও নির্মলেন্দু গুণ দেশে-বিদেশে ষাটের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হিসেবে বন্দিত।

দুই.
গণসাহায্য সংস্থায় চাকুরিসূত্রে শুরুতে গণনাট্য ও পরে পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালিত লোকসংস্কৃতি বিভাগে যুক্ততার সুবাদে বিশেষ করে নেত্রকোনা জেলার আনাচকানাচ ভ্রমণ করে ওই এলাকায় বিরাজিত বিভিন্ন লোকআঙ্গিক ও তার শিল্পীদের সংস্পর্শে আসবার একটা ঈর্ষণীয় সুযোগ আমি লাভ করেছিলাম চাকুরি জীবনের সূচনায়ই; যা আমার অন্তর্জগৎকে একটা বিশেষ আকৃতি দিয়েছিল বলে ধারণা করি। তখন যাঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছিল, তাঁদের মধ্যে বর্ষীয়ান যে শিল্পীর সংস্পর্শ আমার কাছে এখন সবচেয়ে মূল্যবান বলে প্রতিভাত হয় তিনি কবিয়াল মদনমোহন আচার্য তথা মদন সরকার; এ কারণে যে, অতিসম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন এবং তাঁর প্রয়াণঘটনার মাধ্যমে এ অঞ্চলে বিরাজিত শত শত বছরের পরম্পরাবাহিত কাব্যআঙ্গিক কবিগানের সমস্ত প্রবহমাণতা স্তব্ধ হয়ে গেছে। নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণকারী সমসাময়িক কবি মাহবুব কবির তাঁর মদন সরকার নামক কবিতায় তাঁকে ‘বাংলার শেষ কবিয়াল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হয়ত তিনি তা নন। ভাটি অঞ্চলে না হোক, বাংলার অন্য অঞ্চলে কোনো কোনো কবিয়াল এখনো জীবিত আছেন, কিন্তু এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত আমার জীবনে আর কখনোই গ্রামীণ পরিবেশে আয়োজিত লাইভ কবির-লড়াই দেখবার সৌভাগ্য হবে না। হলেও প্রায় পনেরো বছর পরের ইন্দ্রিয়াদিতে সেই প্রাণ-চমকানো আস্বাদ হয়ত আর ফিরে পাব না কোনোভাবেই!

সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। সেবার এক শীত বিকেলে নেত্রকোনা গিয়েই শুনতে পাই কবির লড়াই অনুষ্ঠিত হবার কথা, যেখানে মদন সরকার অন্য আরেকজন কবির সঙ্গে (খুব সম্ভব তিনি ছিলেন পূর্বধলার আবুল হোসেন, বিশ্বস্ত সূত্রে জানি ইনিও যুগটাক আগে প্রয়াত হয়েছেন) লড়বেন। নেত্রকোনার সিংহের বাংলা ইউনিয়নস্থ সহিলপুর গ্রামে তাঁর নিজ বাড়িতে গিয়ে মদন সরকারের সঙ্গে আগেই সাক্ষাৎ করে এসেছি। কিন্তু নেপথ্যে ঢোল-কাঁসির বাদনযোজনার প্রেক্ষাপটে তাঁর গায়ন-নাচন এর আগে প্রত্যক্ষ করি নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি তখন প্রায়-সার্বক্ষণিক কবিতাকর্মী, নিয়মিত অজস্রাজস্র কবিতার খসড়া করে চলেছি, তার কোনোটা কবিতা-পদবাচ্য হচ্ছে কি না তখনো জানি না (বস্তুতপক্ষে জানি না তা আজও!)। বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই টানল আমাকে। ৮০ সিসি হোন্ডা হাঁকিয়ে একে-তাকে জিজ্ঞেস করে সন্ধ্যার অব্যবহিত পরে শহর থেকে কিলোদশেক দূরের অচেনা তল্লাটে গিয়ে আমি হাজির। জায়গাটার নাম আজ আর মনে নেই। আসরটা বসেছিল একটা বহুল-ব্যবহৃত কাঁচা রাস্তার পাশে, যেখানে একটি মাত্র কাষ্ঠল বৃক্ষ ছিল, ছিল গোটা দুই মাত্র মুদি দোকান। ওখানেই গোটা দুই চৌকি পেতে ও তার ওপরে চাদোয়া খাটিয়ে মঞ্চ বানানো হয়েছে। আশপাশে কোনো জনবসতি নেই, কিন্তু ওই আসরকে ঘিরে ততক্ষণে জায়গাটা লোকারণ্যে পরিণত হয়েছে কুয়াশা মাথায় নিয়েও। রাত সাতটা-আটটা নাগাদ শুরু হলো আসর। বন্দনা, আগমনীর পর ওখানে লহর-খেউড় ছিল কি না মনে নেই। তবে কিছু সময় ধরে টপ্পা-পাঁচালি ধাঁচের একক গান পরিবেশিত হবার কথা মনে আছে। এর পরই রামায়ণ-মহাভারতের জগতে সেঁধিয়ে গেলেন তাঁরা দুজন। উপস্থিত দর্শকজনতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছেন এই অভিকরণ। ফাঁকে ফাঁকে সমবেত হাততালি দিয়ে উঠছেন ও মুখে নানারকম আওয়াজ করে হর্ষোৎফুল্লতা প্রকাশ করছেন। বুঝলাম, কবিগানের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমে আসতে থাকলেও তা এখনো ঠিক তলানিতে গিয়ে ঠেকে নি। পাশাপাশি আমার মুগ্ধতাও অনিঃশেষ মনে হলো। প্রথমত, রামায়ণ-মহাভারতের শত শত চরিত্রের কে কার বাপ-মা-বোন-স্ত্রী-সন্তান ইত্যাদি বিষয়ে দারুণ স্বচ্ছতার কারণে মুহূর্তমাত্র ভাবনা না করে তাঁরা তুমুল বাচনস্ফূর্তি দেখাচ্ছেন; দ্বিতীয়ত, ব্যবহারিকভাবে কবিতার অন্তঃমিল ব্যাপারটার সহজতা প্রতিপাদন করছেন; তৃতীয়ত, এমনিতে বয়সের ভারে দুজনই ন্যুব্জ হলেও লড়াইয়ের মঞ্চে গায়ন-নাচনে তাঁরা অনেক সহজ-স্বাভাবিকই থাকছেন।

কী করে সম্ভব, ভাবি আমি।

নেপথ্যে মুখস্থবিদ্যার একটা মহিমা আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন একপাক্ষিক গায়ন নয়, সতত জারি করাই আছে যুদ্ধ, তখন তো আর কেবল মুখস্থ জ্ঞান ঝাড়লে হয় না। প্রতি মুহূর্তে নতুন করে পদ বাঁধতে হচ্ছে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার জন্য পদবন্ধাকারেই আরেকটা প্রশ্ন ছুড়তে হচ্ছে। এই সহজাত কবিত্বে তাঁদের প্রতি যারপরনাই শ্রদ্ধাবিনত হতে হলো। মনে হলো, এ ক্ষমতা অপরিসীম। বাক্যে-বাক্যে, কখনো তা সম্ভব না হলে অবশ্যই পরের বাক্যের সাথে একটা বলপ্রয়োগহীন অন্তঃমিল থাকছেই। সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য হলো এর স্ফূর্তিটা। পরে জেনেছি এসব কবিতার সবই তাঁরা তৎক্ষণাৎ বানান না, এর কিছু কিছু আগেই তৈরি করা, সময়মতো যা উপস্থাপন করেন মাত্র। তবে উপস্থাপিত সব পদই যে তা নয়, সেটা বোঝা যায় তাৎক্ষণিকভাবে উত্থাপিত প্রশ্নের সাথে সংগতি স্থাপনের উপযোগিতা দেখে। এসবে যথেষ্টই পারঙ্গম মনে হলো তাঁদের, যে স্ফূর্তি নবীন কবিতাকর্মী আমার তখনো নেই (এখনো কি আর আছে!)।

ওই রাতের পরে দীর্ঘদিন মদন সরকারের সঙ্গে আমার আর সরাসরি সাক্ষাৎ করবার কোনো সুযোগ তৈরি হয় নি। পরবর্তী সময়ে চাকুরিসূত্রে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস)-এর সঙ্গে যুক্ততার সুবাদে তারও বছর পাঁচেক পরে তাঁকে মোক্তারপাড়া মাঠে বিএনপিএস আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসবের মঞ্চে আবিষ্কার করি। কিন্তু সেবার আর তাঁর সঙ্গে লড়াই করবার জন্য অন্য কবি নেই, তিনি ততদিনে প্রয়াত। মদন সরকারও ‘কুঁজো হতে হতে চাকা হয়ে গেছেন’। সেবার তাঁর পরিবেশনা ছিল মঞ্চে স্থাপিত একটা চেয়ারে আসীন হয়ে ছন্দোবদ্ধ কিছু পদ আওড়ানো। এ যেন এ সরকারের, কবির, অতীত সমৃদ্ধিরই এক ধরনের চারণ মাত্র। স্মৃতি থেকে চেনাকথার স্তোত্রবৎ ওই আবৃত্তি দর্শকশ্রোতা খুব-যে সম্মানের সাথে গ্রহণ করছে তা মনে হলো না। যেটুকু করছে, বুঝতে পারি তা বস্তুতপক্ষে একেই গ্রহণ নয় কেবল, বরং এর সমৃদ্ধ ইতিহাসকেও গ্রহণ। পেছনে কাজ করছে দর্শকশ্রোতার প্রিয় কবির লড়াই প্রত্যক্ষ করবার পূর্ব-অভিজ্ঞতা, নিদেনপক্ষে এ সংক্রান্ত মিথ। পরিবেশনায় কোনো বিশেষত্ব অবশিষ্ট নেই বলে পরবর্তী সময়ে আয়োজিত বিএনপিএস-এর লোকসংস্কৃতি উৎসবগুলোতে তিনি আর আমন্ত্রিত হতেন না, দেখেছি। এ যেন কবিগান আঙ্গিকটি এ এলাকায় দিন দিন কীভাবে ফুরিয়ে যাচ্ছিল, তারই একটি ধারাক্রম।

মদন সরকারের পদ-সন্নিকটে বসা আমি (মুজিব মেহদী)
সর্বশেষ ২০১০-এর মে মাসের কোনো একদিন বিএনপিএস-এর দুজন সহকর্মী ও জনসংবেদী স্থানীয় কয়েকজন সংবাদকর্মীসহ সহিলপুরে মদন সরকারের বাড়িতে যাই তাঁকে ও তাঁর নতুন করে গোছানো ঘর দেখতে। দিনকয় আগে একটা ঝড় এসে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ব্যাধি ও বার্ধক্যে ভীষণভাবে পীড়িত মদন সরকারের ঘরটা বিছানাপত্রসহ উড়িয়ে নিয়ে যায়, বছর ছয়েক আগে বিএনপিএস ওই ঘরটি করে দিয়েছিল। ঝড়ের কোনো মানবিক বোধ নেই জানি, তার কাছে আমরা তা আশাও করি না। তবু মন বারবারই তার প্রতি একটা অভিযোগ উত্থাপন করতে চায়; এজন্য যে, ঝড়ের ছোবল দরিদ্র ও বিপন্নকেই বরাবর বেশি করে ক্ষতবিক্ষত করে! এ যেন প্রকৃতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিধিবদ্ধ হয়ে থাকা একটা বৈষম্যই! ঝড়ের এ আচরণের বিরুদ্ধে মানুষের কোনো কিছু করবার নেই। এক্ষেত্রে কেবল ক্ষত নিরাময়েই হয়ত কিছু একটা করবার থাকে। বিএনপিএস এবারও ওরকম কিছু একটাই করতে চেয়েছে। বাস্তুহারা মদন সরকারের ছোটো টিনের দোচালা ঘরটি নতুন করে গড়ে দিয়েছে, দিয়েছে বিছানাপত্রও। আমরা গিয়ে দেখি, নিজের ঘরের সামনে একটা হাতলবিহীন চেয়ারে খালি গা সরকার সামনের দিকে ৬০ ডিগ্রি কোণ তৈরি করে ঝুঁকে আছেন। বলিরেখার আধিক্যে কুঞ্চিত তাঁর মুখাবয়ব, তার মধ্যেও একটা সুদূর বিপন্নতার ম্লান ছায়া এসে পড়েছে। কোনোদিকেই যেন আর কোনো আশা-ভরসা নেই, নেই কোনো স্বপ্নও। ঘরটা পাওয়ায় খুশি হয়েছেন কি না তা জানতে চাইলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেও অভিব্যক্তিতে তেমন কোনো প্রসন্নতার ছাপ পড়তে দেখা গেল না। যেন এ জগৎ-সংসারের প্রতি তাঁর আর বিশেষ টানই অবশিষ্ট নেই, কাজেই ঘর থাকা না থাকা তাঁর কাছে প্রায় সমান কথা; যেন এখনো টিকে আছেন বলেই এর সংসর্গে লগ্ন তিনি! আমরা তাঁকে বেশিক্ষণ বিরক্ত না করে ফিরে এলাম। ক্যামেরা-রেকর্ডারসমেত বাহারি পোশাকধারী শহুরে কতিপয় নারী-পুরুষের এই আসা-যাওয়ায় তাঁর কোনো বিকার লক্ষ করলাম না কোথাও। এই-ই স্বাভাবিক মনে হলো। বয়সের এমন একটা পরিণতিতে পৌঁছে গেছেন তিনি, যেখানে পৌঁছালে আর মিছে মায়ায় কোনো হাতছানিতে উল্লসিত হবার কিছুই থাকে না বস্তুত। থাকে নি মদন সরকারেরও। প্রকৃতই যে থাকে নি, তা বোঝা গেল মাসকয় পরেই তাঁর ধরাধাম ত্যাগ করে চলে যাওয়ায়।

তিন.
লিখিত ইতিহাসসূত্রে দেখা যায়, গ্রামীণ সহজ-সরল জনমানস, এমনকি কলকাতার শহুরেরাও কবিগানকে খুব আপন করে নিয়েছিল। উইকিপিডিয়া মতে, ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে যখন বাংলা কাব্যের ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক উপাদানগুলো ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছিল এবং যখন বাংলা কাব্য বৈষ্ণব কাব্যধারা থেকে বেরোতে চাইছিল, তখনই ঘটে কবিগানের প্রকৃত বিকাশ। ড. সুকুমার সেনের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকাল পর্যন্ত কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে নব্য কবিগান ও পাঁচালি গান এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, সাহিত্যের অন্যান্য ধারার অস্তিত্বই প্রায় বিপন্ন হয়ে যেতে লেগেছিল। পরবর্তীকালে কলকাতায় এর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও গ্রামাঞ্চলে তা অব্যাহত ছিল। জানা যায়, অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে কেবল বীরভূম জেলায়ই তিনশ’র মতো খ্যাতনামা কবিয়াল ছিলেন। প্রামাণ্য তথ্য সাক্ষ্য দেয়, কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয় পূর্ববঙ্গেও কবিগানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ড. দীনেশচন্দ্র সিংহের ‘পূর্ববঙ্গের কবিগান’ নামক গ্রন্থে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৫২ জন কবিয়াল, কবিগান রচয়িতা ও পৃষ্ঠপোষকের নাম পাওয়া যায়। তিনি জানান, ‘পূর্ববঙ্গের প্রায় আটটি জেলায় এমন কোনো বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল না, হিন্দু অধ্যুষিত এমন পাড়া ছিল না, যেখানে কোন না কোন সময় কবির ঢোল কাঁসি না বেজেছে। কবিগান ছাড়া কোন উৎসব অনুষ্ঠানই পূর্ণাঙ্গ হতো না। বহু বনেদি বাড়ি ও পরিবারে কবিগান বার্ষিক পারিবারিক উৎসবরূপে অনুষ্ঠিত হতো’। এ গ্রন্থসূত্রে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিখ্যাত কবিগানের আসরগুলো অনুষ্ঠিত হবার কথা জানা যায় ধলা (জমিদার বাড়ি), বালীপাড়া, লাইট্যামারী, মসুয়া, কিশোরগঞ্জ কোর্ট, হোসেনপুর (জগৎকিশোর মহারাজার কাচারী), মুক্তাগাছা রাজবাড়ি, সরিষাবাড়ি, কুষ্ঠিয়া সেনবাড়ি, রাম অমৃতগঞ্জ, বাজিতপুর, কটিয়াদি, মঠখোলা, নেত্রকোনা, আঠারবাড়ি, গৌরীপুর, সুসঙ্গ, সুগুন্দিয়া, চন্দনকান্দী, রামেশ্বরপুর ইত্যাদি স্থানে।  

দেখা যায়, প্রায়-সর্বত্রই কবিগানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জমিদার ও সম্পন্ন হিন্দু ভদ্রলোকগণ। এই পৃষ্ঠপোষকদের একাংশের হাতে আবার কবিগান তার স্বমর্যাদাও হারায়। যতীন সরকার তাঁর সম্পাদিত ‘জালালগীতিকা সমগ্র’-এ জানান, “মূলধারার কবিতার যে একটি বিশেষ প্রকরণ কবিগান, সেই প্রকরণটি আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতায় মারাত্মক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তখনকার নতুন নগরে উদ্ভূত ‘হঠাৎ নবাব’রাই সে-সময়ে কবিগানের পৃষ্ঠপোষকরূপে মঞ্চাবতীর্ণ হন। পৃষ্ঠপোষকদের অসুস্থ চেতনা ও অশ্লীল জীবনাচরণ থেকেই কবিগানে অসুস্থতা ও অশ্লীলতার সঞ্চার ঘটে। তবে এই বিকৃতমতি পৃষ্ঠপোষকদের আওতা যেখানে প্রসারিত হতে পারে নি, নগরসীমার বাইরে অবস্থিত সেই সনাতনী গ্রামগুলোতে-- বিশেষ করে সে-সময়কার পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে-- কবিগান তার সুস্থতা ও শ্লীলতা বহুল পরিমাণেই বজায় রাখতে পেরেছে। শুধু বজায় রাখতে পারাই নয়, এই ধারাটিকে আরো বলিষ্ঠ করে তুলেছে।”

তার মানে অশ্লীলতার ভয়াবহ দূষণ কলকাতার মতো পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত কবিগানকে ছোবল দিতে পারে নি। কিন্তু এর পরও এখানে, বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে, বিংশ শতাব্দী ফুরাতে না ফুরাতেই যে কবিগান বিলুপ্তির শেষ পাদে চলে এল তার কারণ কী? এ ধরনের অনুসন্ধান হয়ত যতীন সরকারের মতো বিদ্বজ্জন বৃহৎ প্রেক্ষাপটে করে দেখবেন। তবু, আমরা এখানে মোটাদাগে কয়েকটা সম্ভাব্য কারণ খুঁজে দেখবার চেষ্টা হয়ত করতে পারি। আমার ধারণা, প্রধানত পৃষ্ঠপোষকতার অভাব কবিগানের বিলুপ্তিতে একটা বড়ো ভূমিকা রেখেছে। জমিদারি প্রথার বিলোপ এই পৃষ্ঠপোষকতাহীনতাকে প্রভাবিত করেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর বাইরের সম্পন্ন পরিবারগুলোও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখলেন না বা রাখতে পারলেন না কেন? এসব ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়ত মাঠ পর্যায়ে বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন। তবে ধারণা করা যায়, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানো এবং তার হাত ধরে ঘরে ঘরে টেলিভিশন পৌঁছে যাওয়া গ্রামজনতার বিনোদনের উপায়ে একটা ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর ভিতর দিয়ে শান্তিস্বস্তিপ্রদ জীবনে অভ্যস্ত অল্পে সন্তুষ্ট গ্রামজনতার মধ্যে পণ্যসংস্কৃতির হাতছানি ও নিয়ত অভাববোধ পুরোপুরি গেড়ে বসে। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসায় কৃষিকর্ম থেকে শুরু করে গ্রামসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পেশাসমূহের মাধ্যমে জীবনধারণে অসন্তুষ্টি ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এসব পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবীভাবে মানুষের অভ্যাস ও রুচিতেও চিড় ধরায়। কিন্তু ভোক্তাশ্রেণির জীবনের এই পরিবর্তন-সম্বলিত বাণী কবিগান ধারণ করতে ব্যর্থ হয় নতুন নতুন কবি এ লাইনে আগ্রহী হয়ে না ওঠায় ও নতুন নতুন কবিগান রচিত না হওয়ায়। অর্থাৎ পরিবর্তিত জীবনের ছবি ধারণ করতে না পারায় কবিগান তার উপযোগিতা হারায়, যেখানে বাউলগান তার উপযোগিতা ঠিকই ধরে রাখতে পেরেছে। মানুষের ব্যবহারিক জীবনে যে জিনিসের উপযোগিতা থাকবে না, তা অজনপ্রিয় হয়ে পড়বে এবং ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এটাই নিয়ম। কবিগানের বিলুপ্তি এ পথ বেয়েই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এভাবে ক্রান্তিতে উপনীত কোনো লোকআঙ্গিককে টিকিয়ে রাখবার চেষ্টায় পোস্তা করে বিশেষ ফল হয় না। তাতে একটা খরখরে কাঠামোই কেবল কাত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, যার ভিতরে প্রাণপ্রবাহ একদমই থাকে না।

এরকম অবস্থায়, তাঁর দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের সমাপ্তি টেনে, ৯৩ বছর বয়সে কবিয়াল মদন সরকার চলে গিয়ে রক্ষাই পেয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকতেও জীবনের শেষদিকে আমরা যেমন তাঁকে তাঁর প্রাপ্য কবিসুলভ সম্মান-মর্যাদা আর দিয়ে যেতে পারছিলাম না, তেমনি ভবিষ্যতেও যে দিতে পারতাম না তা হলপ করেই বলে দেয়া যায়!

লেখাটি নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিতব্য মদন সরকার স্মারক গ্রন্থের জন্য প্রণীত

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...