হাইকু, বাংলায় যাকে বলা যায় ক্রীড়মান পদ্য, জাপানের এক বিশেষায়িত কাব্যআঙ্গিক। আকৃতির দিক থেকে জানাশোনার মধ্যে এটিই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ছোটো কবিতা। উনিশ শতকের শেষদিকে হক্কু নামে সমধিক পরিচিত এই কাব্যআঙ্গিকের হাইকু নামটি দেন জাপানি লেখক মাসাউকা শিকি (১৮৬৭-১৯০২)। প্রথাগতভাবে একটি উলম্ব লাইনে ১৭ মোরাস (প্রায়-সিলেবল) বিশিষ্ট এই কাব্যআঙ্গিকটি ৫+৭+৫ মাত্রাবিশিষ্ট তিনটি ভাগে বিন্যস্ত হয়ে উপস্থাপিত হতো। পরে লিখনরীতি ও মুদ্রণসুবিধার প্রশ্রয়ে বিশেষ করে ইংরেজিতে তিনটি আলাদা বাক্যে/বাক্যাংশে হাইকুকে আনুভূমিকভাবে সজ্জিত করবার রীতি প্রচলিত হয়। পৃথিবীব্যাপী এখন শেষোক্ত রীতিতেই হাইকু লিখিত হচ্ছে। জাপানি হাইকু অন্তঃমিলবিহীন, পরে ইংরেজিতে যদিও এরকম নিরীক্ষা হয়েছে। তবে জাপানসহ পৃথিবীর সর্বত্রই হাইকু শিরোনামহীন।
চিন্তা যদি তেমন উচ্চতায় উঠে, তাহলে ১৭ মাত্রাই সে ভাব প্রকাশের জন্য যথেষ্ট, হাইকু প্রসঙ্গে এরকম একটা কথা একবার বলেছিলেন জেনতাত্ত্বিক ডি. তেইতারু সোজুকি (১৮৭০-১৯৬৬)। ওই অবস্থাটা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে ভাবি। ধ্যানের বাইরে এ আর কী? হাইকু কাজেই স্তব্ধতার টানেল বেয়ে পৌঁছে যাওয়া ধ্যানমঞ্জিল থেকে উৎসারিত নাচকথা, ধ্বনির চরম ও পরম কম্পন। আর কম্পন তো হলো সংবেদনের দৃশ্যগান, স্থিতির মূর্ছনা।
হাইকুতে অভিজ্ঞতাজনিত আবেগের হট-পাস থাকলেও ব্যক্তিগত ধারণা, বয়ান, ব্যাখ্যা বা এরকম কিছুর ক্ষেত্রে নিষেধের লাল পতাকা টানানো আছে। অর্থাৎ এতে নৈর্ব্যক্তিক চিত্রপ্রতিমা থাকতে পারে, কিন্তু কিছুতেই ব্যক্তিক ভাষ্য জায়গা পায় না। হাইকুতে ধরা পড়ে স্তব্ধতা, রহস্যময়তা, রিক্ততা এবং অতি অবশ্যই নশ্বরতা। বাকসংযম হাইকুর প্রাণ, ভাষাসংহতি তার দেহ; যেজন্য হাইকু হয়ে ওঠে সান্দ্র, মগ্ন এবং জীবন্ত।
হাইকুকে হতে হয় কিগো ও কিরেজি সমৃদ্ধ। কিগো হচ্ছে ঋতুচিহ্ন, অর্থাৎ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কোন বিশেষ অবস্থায় হাইকুটি রচিত হয়েছে, তার ছাপ। জাপানি সাহিত্যে হাইকুর ঐতিহ্যকে বেগবান করতে কিগো তথা ঋতুনির্দেশক শব্দসম্বলিত একাধিক অভিধান প্রচলিত আছে। জাপানে ঋতু হলো চারটি : গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বসন্ত। এই চার ঋতুর স্মারক শব্দগুলো লেখক-পাঠক উভয়কেই হাইকুর সম্পন্ন প্রতিবেশী হিসেবে গড়ে তোলে। জাপানের তুলনায় আমাদের ঋতু আরো দুটি বেশি হলেও বাংলায় যেহেতু বিস্তৃত কিগো-অভিধান নেই, তাই বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে একে মনে হতেও পারে উন্মূল পারম্পর্যহীন নিরস ভাবচূর্ণ বা এ জাতীয় কিছু। যাহোক, এই কিগো-ঘনিষ্ঠতার কারণে ঐতিহ্যিক হাইকু সাধারণত ঋতুভিত্তিক ও প্রকৃতিঘনিষ্ঠ হয়। তবে ক্রমে জাপানি ও অন্য ভাষার মুক্তক হাইকু এই সীমারেখাকে অতিক্রম করে গেছে। এখন এতে মানবিক কায়কারবারের রেফারেন্সও দুর্লক্ষ্য নয়। অর্থাৎ কিগো প্রশ্নে কমবেশি জাপানি হাইকুতেও ছাড় আছে, ইংরেজিতে এ ছাড় আরো বেশি। এ প্রেক্ষাপটে হাইকুর ক্রমবিস্তার ঘটছে প্রকৃতি ছাড়িয়ে মানুষ ও তার সভ্যতার বিচিত্র আলো-অন্ধকার পথে। এর ভিতর দিয়ে তৈরি হয়েছে হাইকু-সেনরু একাকার অবস্থা।
হাইকুসম্রাট মাৎসো বাশো (১৬৪৪-১৬৯৪) ছাড়াও জাপানের বিখ্যাত হাইকু লেখকদের অধিকাংশই জেনবাদী বলে জেনকবিতা হিসেবে হাইকুর প্রধানত ঋতুবৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠার সমালোচনা করা যায়! জেন বহিরাসক্তি কমিয়ে ভিতর দিকে তাকাতে বলে। এতদসত্ত্বেও, জেনকবিতা হিসেবে হাইকু কেন কেবল বাইরে তাকিয়ে থেকে চোখে ব্যথা বানাবে, সে তো একটা সংগত প্রশ্নই বটে। একে মূলাদর্শের সাথে যোগাযোগহীনতা হিসেবেই বা দেখা হবে না কেন? এ রীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে জাপানের স্থানীয় প্রাসঙ্গিকতার প্রতি অবজ্ঞা না-দেখিয়ে বাংলার কাব্যবাস্তবতায় অন্তর্গত সত্তা খোঁড়ায় মনোযোগী হওয়াও প্রয়োজনীয় বলে বোধ হয়। প্রকৃতির ছবি মনের ছবির চেয়ে সুলভ, সহজগম্য ও দৃশ্যকামযোগ্য। বিপরীতপক্ষে মনের দুর্লভ ছবি যে নিসিসিটি ক্রিয়েট করে তার বোধ্যতার জন্য লাগে ইন্দ্রিয়যৌগের হস্তক্ষেপ। ওর বরং সৃজনের দিকেই যাতায়াত বেশি। ওতে চেনাজানা উপাদানের সমন্বয়ে সহজ সরল উপস্থাপনভঙ্গির নিচেও নানা তল-উপতল-অবতল-প্রতিতল তৈরির সম্ভাবনা থাকে। তাতে বাইরে থেকে এর প্রতি দুর্বোধ্যতা-দুর্ভেদ্যতার অভিযোগ যদি উঠেও, মগ্নতার আশ্রয়ে সারি সারি দরজার চিহ্ন উন্মুক্ত হয়ে যাবার সুযোগও একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায় না।
কিরেজি হচ্ছে কাটিং ওয়ার্ড বা বিচ্ছিন্ন চমকানো পদ, যা হাইকুর শেষাংশে অবস্থান নিয়ে কবিতায় স্থাপিত ভাবটিকে নাচিয়ে, মুচড়িয়ে নিবিড়ানন্দের সীমায় পৌঁছে দেয়। অবশ্য এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম আছে, যদিও কম। কখনো কখনো, এমনকি বাশোর হাইকুতেও, কিরেজি ওয়ার্ডকে প্রথম বাক্যে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কিরেজিতে কিগো-অংশের সাথে বিরোধাত্মক শব্দ বা শব্দবন্ধ ব্যবহারেরও রীতি আছে। এটি অবচেতনের বাস্তবতা উপলব্ধিতে সহায়তা করে। অন্তর্গত একটা তুলনার সুযোগও এর দ্বারা উন্মোচিত হয়। কিরেজিপ্রশ্নে একটা মত দেখা যায় বীতশোক ভট্টাচার্য অনূদিত ও সম্পাদিত ‘জেন কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ অনূদিত বাশোর বিখ্যাত হাইকু ‘পুরোনো পুকুর/ ব্যাঙের লাফ/ জলের শব্দ’ প্রসঙ্গে লিখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যেভাবে হাইকুটির রূপান্তর ঘটিয়েছেন জেনবাদী তা সমর্থন করবেন না। জেন তত্ত্ব অনুযায়ী জলের শব্দ শেষে নয়, পুরোনো পুকুর ও ব্যাঙের লাফের মাঝখানে আসবে, পরিণতিটি কাজ ও কারণের মাঝখানে থেকে তাদের দ্বিখণ্ডিত করে দেবে।’ কাজ ও কারণকে দ্বিখণ্ডিত করবার কথা বলে এখানে বস্তুতপক্ষে তিনি কিরেজির ব্যবহার নিয়েই কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর এই মতকে অবশ্যগ্রাহ্য ভাববার ক্ষেত্রে দুটো বিপদ আছে বলে ধারণা হয়। ১. বাশোর এই হাইকুটির মতো সকল হাইকুতে সব সময় নাউন-ফ্রেইজ সম্বলিত তিনটি স্বাধীন বাক্য না-ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিণতি চিহ্নিত ফ্রেইজটি মাঝখানে স্থাপন করা অসম্ভব। ২. বাশোর এই হাইকুটির জাপানি মূলেই ব্যাঙের উল্লেখ আছে দ্বিতীয় লাইনে, যে ব্যাঙ জাপানি ঐতিহ্য ও কিগো-অভিধান অনুযায়ী বসন্তকালকে ইঙ্গিত করে। কাজেই ব্যাঙের লাফ শেষে এলে কিগো স্থানান্তরিত হয়ে যায়; যেটা হয় রীতির ব্যতিক্রম মাত্র, সাধারণ রীতির অনুসরণ নয়।
‘সবচেয়ে কম কথায় সবচেয়ে বেশিভাব সবচেয়ে সহজভাবে প্রকাশ, এই ছিল রাশেলের গদ্যের আদর্শ, হাইকুরও আদর্শ এইটিই’; জেনকবিতা বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন বীতশোক ভট্টাচার্য। এটাই কাজেই প্রধান চ্যালেঞ্জ যে, কত কম শব্দে অর্থময়তা, প্রাসঙ্গিকতা, সাম্প্রতিকতা ও একইসঙ্গে চিরন্তনতা তৈরি করা যায়; দাগিয়ে দেয়া পরিসীমার মধ্যে থেকে অথবা তা টপকে গিয়ে।
চিত্র হলেই যেখানে চলে, সেখানে মাঝেসাঝেই চিত্রকল্পের দিকে চলে যাওয়া ভাবের ট্রেনকে খুব সৃজন-সহায়ক লাগে। সৃজন যদিও একটা বিনাশী প্রক্রিয়া। তাতে যা যা আদিদ্রষ্টব্য আছে আপন সীমায়, তার সেবা নেয়া থেকে দূরে থাকতে হয়, পিপাসা মেটাতে হয় জলবিনে হাওয়া দিয়ে, উপেক্ষার কড়ি গুনে গুনে বিকল্প সৃজনে একসা দাঁড়াতে হয় গিয়ে উদ্ভাবনী চাতালে। এটা এমন এক নদীতীর, সংবেদনের; যার কূল ঘেঁষে কোনোদিন কেউ কোনো রেডিমেড জেলেকে দেখে নি!
ধ্যানকে ঘোরের সাথে গুণ করলে যে ফল সামনে এসে দাঁড়ায়, তার সাথে বসা গেলে মনে হয়, এইবার বুঝি খুঁজে পাওয়া গেল কোনো অসীমের পথ, অনন্ত দরজা। জেন-বৌদ্ধবাদের এই সেই সংগত বাসনা, যার স্তনের দিকে তাকিয়ে অঢেল দুধের আমি সম্ভাবনা দেখি। মনাভিজ্ঞতা, যার ছবি মানে ছবিকল্প শুধু, নিসর্গ ও ক্যামেরা থেকে দূরবাসী, তার সুপ্রাচীন জলপাই গাছতলে কমলা-লাল আর কালচে-সবুজের এক বন্যা বয়ে যায়!
বাংলায় দেখা যায়, একটি নাতিদীর্ঘ সরল বাক্যকে তিন লাইনে বিন্যস্ত করে তাকে হাইকু বলে চালাতে। এটা হাইকু আঙ্গিকের একটা ব্যত্যয়। হাইকুর প্রকৃত সাফল্য এক্ষেত্রে প্রদর্শিত কৃতিত্বের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। হাইকুতে একটি পঙক্তির সঙ্গে অন্য পঙক্তির অন্তর্গত যোগাযোগ থাকবে অবশ্যই, কিন্তু একের ওপরে অন্যের নিঃশর্ত-নির্ভরতা অগ্রহণযোগ্য লাগে। কমপক্ষে কিরেজিকে আলাদা হতেই হবে, কাজ ও কারণের মাঝখানে পরিণতি হয়ে না-হলেও। সেটা দ্বিতীয় বাক্যের শেষে ড্যাস বা সেমিকোলনসুলভ দূরত্ব রচনার মাধ্যমেই হয় বেশি, চিহ্ন ব্যবহার করে বা না-করে যেভাবেই হোক। এটাই সবিশেষ চর্চিত রীতি। তার মানে কিগোঅংশে দু'বাক্যের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগ মেনে নেয়া গেলেও শেষ পঙক্তিস্থ কিরেজির আলাদাত্ব অত্যাবশ্যক। বাক্য/বাক্যাংশকে স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার ক্ষমতা দেয়া না-গেলে ঠিক হাইকু-দক্ষতার ছাপটাই ফেলানো গেল না বলে মনে হয়। এই দুর্বলতা আমি বিশেষভাবে কাটাতে চেষ্টা করেছি। দুয়েকটা ক্ষেত্রে খানিকটা শিথিলতা দেখিয়েছি বলতে গেলে বাক্য ও বাক্যধৃত সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে! এ প্রেম যতটা গোপন, তারচে’ বেশি প্রকাশিত।
রবীন্দ্রনাথ অনূদিত বাশোর বিখ্যাত হাইকুটির একটি ইংরেজি পাঠ এরকম : an ancient pond/ a frog jumps in/ the splash of water। এর জাপানি পাঠটি ৫+৭+৫ করে মোট ১৭ মোরাসের হলেও বাংলায় রবীন্দ্রনাথ এই মাত্রাবিন্যাসটি রক্ষা করেন নি। পূর্বে উল্লিখিত তাঁর অনুবাদের সিলেবলভিত্তিক মাত্রাক্রম ৫+৩+৪, মাত্রাবৃত্তে হিসেবে করলে দাঁড়ায় ৬+৫+৬, আর অক্ষরবৃত্তে ৬+৫+৫। কিন্তু কেন তিনি সেটা করেন নি তা ‘জাপান যাত্রী’তে অনুল্লেখ্য আছে। অন্য কোথাও তিনি এ নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছেন কি না তা আমার জানা নেই। এ অনুবাদঘটনাকে সম্ভবত এরকম একটা স্বীকৃতি হিসেবে আমলে নেয়া যায় যে, ছন্দ অর্থাৎ ব্যাকরণ-শৃঙ্খলাকে কখনো সখনো ভাবগত শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করা সিদ্ধ!
ঐতিহ্যবাহী জাপানি হাইকুর মাত্রার হিসেব সিলেবিক (স্বরমাত্রিক) হলেও বাংলা স্বরবৃত্ত ছন্দ হাইকুর জন্য বিশেষ উপযোগী নয়। এটি স্বভাব ও ঐতিহ্যগতভাবে বিশেষ চটপটে, যেজন্য হাইকুর অবশ্যম্ভাবী গাম্ভীর্য এর দ্বারা রক্ষিত হওয়া মুশকিলের। কাজেই এর রক্ষা হতে পারে অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তে। আবার অক্ষরবৃত্তে জোড়ে জোড় আর বেজোড়ে বেজোড় গাঁথবার যে সাধারণ বিধিটা কবিতাকর্মী ও কবিতাপাঠকের মাথায় গেঁথে আছে, তাতে তাঁদের রক্ষণশীল মন এর ৫+৭+৫ বিন্যাস ঠিক সইতে পারে না। কাজেই শেষ ভরসা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, যাতে ৫ ও ৭ মাত্রার পর্ববিন্যাস আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। মাত্রাবৃত্তে বাশোর এই হাইকুটির উল্লিখিত ইংরেজি পাঠের হয়ত এরকম একটি অনুবাদও করা যায় : ‘প্রাচীন দিঘি/ লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ/ জলোল্লাস’। কিন্তু বলতে কী, মূলের সাথে মাত্রাগত সমন্বয় রক্ষা করে চললেও ভাবগত নৈকট্য রবীন্দ্রনাথের রূপান্তরে ঠিকঠাক ধরা পড়ে যে প্রত্নগাম্ভীর্য সৃষ্টি করেছে, এটিতে তা ধরা পড়ে নি। তবে কবিতায় স্থাপিত গাম্ভীর্যের (প্রাচীন দিঘি) আকস্মিক স্খলনটা (লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ) এখানে একটু বেশিই মূর্ত হয়েছে, সম্ভবত।
বাংলাভাষায় ইতোমধ্যে অনেকেই হাইকু অনুবাদ করেছেন ও মৌলিক হাইকু লিখেছেন। এসব কাজ যতদূর চোখে পড়েছে, তাতে বলা যায় যে, তা কোনোই সাধারণ রীতির ভিতর দিয়ে এগোয় নি। এটাই স্বাভাবিক মনে হয়। কারণ হাইকু নিয়ে এ যাবৎ মান্য কোনো কাজ বাংলায় হয়ে ওঠে নি, যাকে পরবর্তী হাইকু লেখকগণ সমীহ করতে পারেন। কাজেই সব মিলিয়ে বাংলা হাইকুরাজ্যে এ যাবৎ বিশৃঙ্খলারই জয়জয়কার। এই প্রেক্ষাপটে আমার মনও এবারের জন্য বিশৃঙ্খলার জটে আটকে গেল। এ রাজ্যে অল্পস্বল্প বিহারের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে নানা ছন্দমাত্রায় লিখে ফেলা গেল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হাইকুমতো রচনা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো হাইকু দিয়ে একটা বর্ণমালা সাজিয়ে ফেলা গেলে কেমন হয়, যাতে বর্তমান বাংলাভাষার ৫০টি বর্ণের প্রতিটির জন্য একটি করে মোট ৫০টি হাইকু যুক্ত হবে, যেগুলোর শুরু হবে ওই নির্দিষ্ট বর্ণ দিয়ে! মুশকিল এই যে, বাংলা বর্ণমালার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ উভয় অংশেরই কিছু বর্ণ আছে, যেগুলো দিয়ে কোনো বাংলা শব্দই শুরু হয় না। এ সীমাবদ্ধতার একটা সহজ উত্তরণসূত্রও খুঁজে নেয়া গেল, যে, প্রথম পঙক্তির প্রথম শব্দের প্রথম অক্ষর না-হোক, অন্তত প্রথম শব্দে নির্দিষ্ট বর্ণটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলেই পাস নম্বর বুঝে নেয়া হবে। এভাবে গোছাতে গিয়ে মাথায় একটা বদবুদ্ধিও খেলে গেল। ভাবলাম যে, যেহেতু পরিকল্পনার আওতায় প্রতিটি বর্ণ ধরে আলাদা আলাদা এন্ট্রি রাখবার সিদ্ধান্ত পাকা হয়েছে, কাজেই এখানে বাংলা বর্ণমালার সব বর্ণেরই সমান গুরুত্ব পাওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যায়, সব বর্ণকে সমান মূল্য দেবার এই অভিপ্রায়কে পুরোপুরি সম্মান দেখাতে গেলে বাংলা ভাষার তিন ছন্দের (স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত) কোনো চালেই এগোনো যায় না। তিনটি ছন্দের মধ্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দটা সাধারণভাবে অক্ষরাণুসারী হলেও অসাধারণত (শব্দের শুরু ও শব্দমধ্যস্থ বদ্ধস্বরের ক্ষেত্রে) ওরও ব্যতিক্রম আছে। কাজেই এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় মনে হলো ৫+৭+৫-এর হিসেবটা বর্ণমাত্রিকভাবে করা। অর্থাৎ কড় গুনে ১৭টা বর্ণ দিয়ে ৫+৭+৫ বিন্যাসে লিখবার চেষ্টা করা। বর্ণমাত্রিকতা অবশ্য ব্যতিক্রম বিবেচনায় না-নেয়া অক্ষরবৃত্তই। এতদসত্ত্বেও, এখানে আমি সচেতনভাবে ‘বর্ণমাত্রিক’ কথাটিই বলব বলে ঠিক করেছি, যেহেতু বর্ণকেই একক ধরে আমার এই সন্নিষ্ঠ যাত্রা। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, বর্ণমাত্রিকতা আমার বাতিঘর হলেও রচিত কোনো-কোনো হাইকু ৫+৭+৫ চালে একইসঙ্গে মাত্রাবৃত্তে উত্তীর্ণ, কোনোটা-বা স্বরবৃত্তে, আবার কোনোটা-বা অক্ষরবৃত্তে। অবশ্য এসব অর্জন বরাবরই উপজাত।
যাহোক, বর্ণমাত্রিক চালে কাজ করতে শুরু করে ধরা পড়ল যে, বাংলা বর্ণমালার শেষ বর্ণ আনুনাসিকতার পতাকাবাহী চন্দ্রবিন্দুকে এক মাত্রার মূল্য দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, সেটা চাওয়াটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। তাছাড়া যুক্তবর্ণকে একাধিক মাত্রামূল্য না-দেয়াও আমার জন্য নিরাপদ ভেবে নিয়েছি, সংগতও।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকে অনেকদূর অগ্রসর হয়ে মনে হলো, যেহেতু ছন্দবিনয়ী ও ছন্দশাসিতরা এরকম করে কখনো গাঁথেন নি কথা, যেহেতু এই মাত্রাবিন্যাস আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকৃত হয় নি, কাজেই এখানে এমন কিছু শব্দবন্ধ তৈরি হতে পারে, যা পুরোপুরি আনকোরা, কবিতায়। অন্তত হবার কথা, যুক্তির গণিতে। একজন সৃজনমগ্ন লেখক হিসেবে আমি কেন সেদিকেই হাঁটব না, যেখানে আমাকে, আমার পঙক্তিকে, আমার কাজকে চেনা যাবে নতুন করে? নিয়ম ভাঙার ঘুপচি সড়ক ফেলে আমি কেন সদরপথের পথিক হবো, যেদিকে ঘিঞ্জি গগন, খুঁজেপেতে শ্বাস ফেলতে যে পথের তারাদের হয় প্রাণপাত হবার জোগাড়?
রচিত বাক্যগুলো যদি স্বাধীন শক্তি ধরে, সৌন্দর্য যদি ভর করে আসে ফুলের বুকে বসা পাপড়ির মতো, কণ্ঠ যদি ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি করে, চিন্তার দরজা যদি দেয় এটি খুলে, চিরন্তন কোনো ছবির শিংয়ে এ যদি বেঁধে দিতে পারে কোনো রঙিন পতাকা, একে তবে শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে কেন গণ্য করা হবে শুধু? প্রশংসা কেন শুধু নিয়মানুবর্তী অনুকারকের জন্যই প্রাসঙ্গিক হবে? বিশৃঙ্খলা যদি নতুন আনন্দকে খুঁজে এনে দিতে পারে, তা যদি ইন্ধন জুগিয়ে নিয়ে বসিয়ে দিতে পারে ধ্যানের পাটিতে, সেক্ষেত্রে শৃঙ্খলানাম্নী আঁটসাঁট তনু হরিণীর নিতম্বের দিকে তাকিয়ে চিরকাল হস্তমৈথুন করে যাবার মতো বৃথাকর্ম আর হয় না!
হাইকুকে কেবল অভিজ্ঞতার মুহূর্ত বয়ান করবার কথা বলেন অনেক তাত্ত্বিক। কিন্তু ও যদি সমগ্রতাও ধরে কোনো বিষয়ের, ও যদি বিস্তৃত হয়ে আসে বড়ো কোনো ক্যানভাস জুড়ে, তবে কি ওর ওজু নষ্ট হয়ে যায়? যদি যায়ও, তবে কি ওর জন্য হারাম যেকোনোরকম কাব্যনামাজ? হয় হোক, এরকম কুফুরি কালাম পড়ে কারো যদি ধর্মচ্যুতি ঘটে যায়, তবে যাক তাও। তখন যদি নাখোশ পাঠক বলেন, এগুলো হাইকু না বাইকু, তাতে কী আর এমন যায়-আসে? মূলকথা হলো মানে ধরা, আরোসত্যের ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো সৌন্দর্যকে গ্রেফতার করা; সে যদি হয় তো এ ঝুঁকি মাথায় নিয়েও কিছু পথ দাপটের সাথে হেঁটে যেতে ভয় পাব কেন? বাংলা হাইকুকে শেষাবধি আমি যদি বাইকুই বলি, তারেই বা বাধা দেবেন কেন খোলামন সুবুদ্ধি পাঠক? পাঠকের কি অনুকারকের নামে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনই কাজ? নইলে কেন তাঁরা নতুনের দিকে তাকিয়ে, তার আনন্দধারায় নেয়ে হেসে উঠবেন না একবার? তাঁরও তো নবানন্দ চাই, নতুন করে চিনে ওঠা গিরিগুহা চাই, অথবা অন্য কিছু। সেটা যদি এইখানে মেলে এসে শৃঙ্খলাপাড়ার থেকে দূরে, এই ছাতিমতলায়, তবে শরৎকে অযথা কেন দু’পায়ে ঠেলেন?
পাঠক আসুন, বাইকুজ্বরে কিছুকাল ভুগি। দেখি ওর লেজ বা কানের আগার দিকে চুপ করে বসে আছে কিনা কোনো সুগন্ধী আরক, বিরল খরগোশ।
অক্টোবর ২০১০
বাইকুস্বর
অ.
অনৃতভাষ
রংচঙে বদন
সত্যে প্রহার
আ.
আয়নাসুখ
হ্রদের দীর্ঘ তীর
চলন্ত ভোর
ই.
ইস্পাত লিখে
হাঁপর ও ছেনাতে
লোহার কবি
ঈ.
ঈতিপ্রহর
শকুন ওড়া দিন
ভাবের লয়
উ.
উড়ন্ত দিন
বাঁশি রোরুদ্যমান
খাঁখাঁ প্রান্তর
ঈ.
ঊষার স্তন
কাঁপছে থিরিথিরি
নিমের গাছ
ঋ.
ঋতার মন
ফলদ বারোমাস
প্রণয় খেত
এ.
একলা মাঘ
ঝলসানো তাওয়া
ভাষার রুটি
ঐ.
ঐহিক সব
ভালো ও মন্দ ফল
বাকি কুয়াশা
ও.
ও-কার ছাড়া
মনের চোখে দেখা
যোগবিহীন
ঔ.
ঔষধদ্বেষ
বুকের মধ্যে চাপা
মৃত্যুমোহন
বাইকুব্যঞ্জন
ক.
কাশের দেশ
শরৎ ফুটে আছে
দুর্গাদেবীর
খ.
খুঁড়ছো গুহা
সৃজন্নদীর বুক
বাঁচার ছল
গ.
গান গাইছে
পাড় ভাঙছে বলে
বুকের নদী
ঘ.
ঘণ্টা হয়েছে
ছিদ্র নিচের দিকে
পয়সা ঢালা
ঙ.
পঙক্তিবীথি
খলবলানো ছবি
কবির কৃতি
চ.
চৈত্রভাষণ
বর্ষায় দেয়া দোষ
আলটপকা
ছ.
ছাতিম ফুল
ফুটল অন্ধকারে
বিভূঁই মন
জ.
জনক লাল
জননী নীলরঙা
দুনিয়াদারি
ঝ.
ঝড়ের শেষ
ধ্বস্ত পাখির বাসা
নীরব গান
ঞ.
ভূঁইঞা বারো
সুনাম কিনেছিল
দেশপ্রেমিক
ট.
টোপর পরা
কিমাকার অদ্ভুত
ভয়ের যোনি
ঠ.
ঠান্ডা হাওয়া
চুপসে দিয়ে গেছে
প্রায়াপিজম
ড.
ডোবার নেশা
টিলায় বিচরণ
রতিকাঞ্চন
ঢ.
ঢালপ্রহরা
বর্ম বেঁচে থাকার
জীবনপুর
ণ.
ণ-ত্ব বিধান
ঠেলছ অকারণ
প্রমিত বোধ
ত.
তিয়াস বাঁচে
জোছনা অবসান
বুকের বাড়ি
থ.
থরকম্পন
স্থিতির আহাজারি
চিন্তার্বিদ্যুৎ
দ.
দখিন দেশ
প্রজন্ম ফুল ছিঁড়ে
হিংস্র বায়ু
ধ.
ধ্যানগম্ভীর
স্তম্ভিত জলাধার
হত্যা স্মারক
ন.
নটের হাসি
নটীর নদীতীর
ঝাঁপের নেশা
প.
পেছন হলো
নিজের দিকে ফেরা
নস্টালজিয়া
ফ.
ফল পেকেছে
সুগন্ধ টের পেল
ছায়ার মাছি
ব.
বাস্তবতার
যোনি বিদীর্ণ মেঘ
সন্ধ্যা বিরূপ
ভ.
ভাটির টান
সময় যাচ্ছে মরে
কদম ফুল
ম.
মন বিবাদ
ঝড়ঝঞ্ঝার হাসি
গুমোট ঘর
য.
যতির নিচে
লুকিয়ে থাকে জল
প্রবহমাণ
র.
রোদনবাঁশি
হুল ফুটানো বায়ু
মরণদ্বার
ল.
লুণ্ঠিত সুখ
জীবন পরিক্রমা
বিদ্রোহ স্বর
শ.
শালের বন
বদনসুখী মৃগ
অতীত প্রায়
ষ.
ষড়ঙ্গ-ধূপ
পুড়ছে সন্ধ্যা রাত
পূজার্থী মন
স.
সোনার চাঁদ
চিত্রভাষের ঢিল
জলের ছটা
হ.
হাঁড়ির শব্দ
স্থগিত বহুকাল
ঘরের ভয়
ড়.
পড়া ফরজ
ভাদ্রে উঠেছে জেগে
বাইকুমালা
ঢ়.
রূঢ় বৈশাখ
লুটছে স্বাধীনতা
সাম্রাজ্যবাদ
য়.
পায়ের নিচে
বইছে কুলকুলু
তেলের নদী
ৎ.
হঠাৎ ঝড়
ফুঁসল রাতে নদী
ফুলশয্যায়
ং.
বাংলা ভাষা
শস্যবহুল মাঠ
বিচিত্র সুর
ঃ.
নৈঃশব্দ্যের
অন্ধগলির শেষ
ধ্যানের বাড়ি
ঁ.
বাঁধ ভঙ্গুর
বানের লুটোপুটি
জলউদ্বাস্তু
রাশেল মাহমুদ সম্পাদিত বাউণ্ডুলে-তে ২০১১-এ প্রকাশিত