"Advertising is legalized lying": H.G. Wells
এ লেখা বিজ্ঞাপন বিষয়ে আমার জ্ঞানপনা জাহিরের চেষ্টাজাত নয়। বাংলাদেশে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও বিজ্ঞাপন কতদূর এগিয়ে গেছে, মুগ্ধতাজনিত কারণে সে বিষয়ক বিস্ময়-সমুদ্রে ভেসে তার কোনো রূপরেখা আঁকবার চেষ্টাও এখানে ধরা নেই। একজন সাধারণ সমাজসদস্য হিসেবে বিজ্ঞাপনকে আমি যেভাবে দেখি, বিজ্ঞাপন যেভাবে আমাকে ও আমার পরিপার্শ্বকে নির্মাণ করে উঠতে চায় লেখাটি তারই একটি স্থিরছবি ধারণ করবার প্রয়াস পেয়েছে মাত্র। এতে রচয়িতার মনে বিজ্ঞাপনের যে ছবি ডুবে-ভাসে তার একাংশের ভাষিক উপস্থাপনচেষ্টার অধিক আর কিছু লভ্য নয়। এর অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা যাঁর, তাঁর এ রচনাপাঠ এখানেই রহিত হওয়া উচিত।আমরা সবাই জানি, বিজ্ঞাপন হলো কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাপন, বিদিতকরণ, জানানো ইত্যাদি, যার মাধ্যমে সাধিত হয় প্রচার। অর্থাৎ বিজ্ঞাপন এক ধরনের প্রচার, যদিও মনে রাখতে হয় যে, প্রচারমাত্রই বিজ্ঞাপন নয়। যে প্রচারের সঙ্গে সরাসরি অর্থযোগ নেই, মুনাফা অর্জন যার অন্বিষ্ট নয়, তা নিছক প্রচার, বিজ্ঞাপন নয়। আজকাল অবশ্য মিডিয়ার বরাতে বিজ্ঞাপন ও প্রচারের প্রভেদও ঘুচতে লেগেছে দেখা যায়। যারা মিডিয়াকে প্রচুর বিজ্ঞাপন দেয়, তারা এর মাধ্যমে তো প্রচারিত হয়ই, আবার তাদের এটা-সেটা নিয়ে মিডিয়া খাতিরবশত নানা সংবাদও প্রচার করে, যাতে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড-এর উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আরো প্রচার পায়। যদিও যে ইভেন্টকে ঘিরে সংবাদ গড়ে ওঠে, তা প্রায়শ সংবাদ হবারই যোগ্যতা রাখে না। অনেকটা প্রায় শালা-দুলাভাইসুলভ সম্পর্কসূত্রে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার কাঁধে ভর করে দেদারসে পক্ষপাতমূলক প্রচারও চালাতে পারে, চালাচ্ছেও। আর আমরা আমপাবলিক এহেন দ্বিপাক্ষিক দহরমমহরমে হরদম বিভ্রান্ত হচ্ছি।
বিজ্ঞাপন হঠাৎ আবির্ভূত আজ বা কালের কোনো প্রপঞ্চ নয়, এর ইতিহাস সুপ্রাচীন। ধারণা করা হয়, যখন থেকে পণ্য বিনিময়ের সূত্রপাত, বিজ্ঞাপনের সূত্রপাত তার সমসাময়িককালেই। মাধ্যম হিসেবে তখন হয়ত ব্যবহৃত হতো মৌখিক ঘোষণা, যে রূপটার প্রায় অবিকলই আমরা অধুনার ফেরিওয়ালাদের মধ্যে দেখি। মৌখিক ঘোষণা থেকে ক্রমশ লিখিত, চিত্রিত ও চলচ্চিত্রিত হয়ে বিজ্ঞাপন আজকের অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ব্রিটানিকা কনসাইজ এনসাইক্লোপিডিয়া মতে, সপ্তদশ শতকে লন্ডনের একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে প্রথম বিজ্ঞাপন ছাপা হয়, অষ্টাদশ শতকে যার বিস্তার ব্যাপকতর হয়। বিজ্ঞাপন ভয়ানক মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে বেশিদিনের কথা নয়। শুরুর দিককার বিজ্ঞাপন নামক নীরিহ প্রপঞ্চটি কোন কোম্পানির কোন পণ্যটি কিনলে লাভজনক হতে পারে সেটা তুলনা করে ওঠবার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করত মাত্র। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক বিজ্ঞাপন সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯২২-এ শুরু হয় বেতার কার্যক্রম, আর তার হাত ধরাধরি করে শুরু হয় বেতার-বিজ্ঞাপনও। ১৯৫০-এ শুরু হয় টেলিভিশন কার্যক্রম, যা মাত্র ১ দশকের মধ্যে সিংহভাগ সচ্ছল মানুষের ঘরে ঘরে জায়গা করে নেয়। এর ভিতর দিয়ে বিজ্ঞাপনও ঢুকে যায় মানুষের শোবার ঘরে। ভিসিআরের উদ্ভাবন বিজ্ঞাপনে আরো গতি ও বিস্তার আনে। ১৯৮০-তে সূচিত ভিসিআর মাত্র একদশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারে প্রবেশাধিকার আদায় করে নেয়। গড়পরতা বছর বিশেকের ব্যবধানে আমাদের দেশের মানুষও রেডিও-টিভি-ভিসিআরের ভোক্তা হয়। আর সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তা হতে শুরু করে এসব মিডিয়ায় প্রচারিত নানা বিজ্ঞাপনেরও। এসব প্রচারমাধ্যমের সহায়তায় নতুন নতুন কলাকৌশলযোগে আধুনিক বিজ্ঞাপন কেবল পণ্য বা সেবাসংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না, সম্ভাব্য ভোক্তাশ্রেণির মনে আকাঙ্ক্ষা ও অভাববোধকে উসকে দিয়ে চাহিদার সঞ্চার করে।
বিজ্ঞাপনের ফলে নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবাগ্রহণকারীরা সংখ্যায় বাড়ে। আর এটা তো খুবই সরল হিসেব যে, পণ্য বা সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়া নানামুখী স্ফীতিরই একটি ইঙ্গিত। যার ফলে উৎপাদক বা সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন এবং মুনাফা বাড়ে, যার জন্য বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত সমুদয় বেগবান তৎপরতা।
মানুষের মন সাধারণত সংরক্ষণশীল। একটা অভ্যাসে স্থিত হলে সহজে তারা তা বদলাতে চায় না। ঘুরেফিরেও ওমুখো হয়ে থাকে। এই স্থিতাবস্থাটায় কৌশলে আঘাত করে সম্ভাব্য ভোক্তাশ্রেণির মনোভূমির দখল নিতেই বিজ্ঞাপনদাতারা মরিয়া তৎপরতা চালায়। তারা চায় আপনি পড়বেন-শুনবেন-দেখবেন, পছন্দ করবেন, পণ্য বা সেবা সম্পর্কে জানবেন এবং ক্রয় করবেন। কাজটা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। তাই ঢালা হয় অঢেল কড়ি। যত কড়ি তত আওয়াজ, তত রঙ, তত ব্যাপ্তি। এতে বারবার নানাভাবে সামনে এসে দাঁড়ায় ব্র্যান্ডনেম। কতক্ষণ না-পড়ে-শুনে-দেখে থাকবেন আপনি? পড়তে-শুনতে-দেখতে আপনাকে হবেই। শুধু পড়া-শোনা-দেখাই বা বলি কেন, বাধ্য হবেন এমনকি মুখস্থ করে ফেলতেও। এটাই পদ্ধতি। একসময় আপনি চাবেন ওই পণ্যের ক্রেতা-গ্রাহক হতে। অবচেতনের ইশারায়ই নির্বাচন করবেন সেই পণ্যটা, যেটার নাম বারবার শোনা, যার একটা কথা বা সুর আপনার ভালো লেগেছিল, যার একজন মডেল আপনার চিত্তসমুদ্রে সন্দেশের ঢিল ছুড়ে মেরেছিল কোনো একদিন।
যেহেতু বিজ্ঞাপন নির্মাতাকে বিদ্যমান বাজারের প্রেক্ষিতে একটি প্রতিযোগিতায় নামতে হয় নতুন একটি পণ্যকে বাজারে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য, তাই বিস্তারিত পরিকল্পনা করেই তাদের মাঠে নামতে হয়। নতুন একটি পণ্যকে বাজারে প্রতিষ্ঠা দিতে এমনকি মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাকেও বদলে দিতে হয়। বিজ্ঞাপন এ কাজ সাফল্যের সঙ্গে করেও থাকে। তখন দেখা যায়, যে পণ্য মানুষের জানাশোনার আওতার মধ্যেই ছিল না, মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই সেটা ছাড়া তাদের আর চলছেই না। এক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের উদাহরণ টানা যায়। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে দেশে কী বিপ্লবটাই না ঘটে গেল! মনোভূমির চর দখলের এই কাজটা অনেক চ্যালেঞ্জিং বলেই বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে চমক দেখাতে হয় আইডিয়ায়, দক্ষতা দেখাতে হয় প্রতিলিপি ও জিঙ্গেল বিন্যাসে। নির্মাণে ছাপ রাখতে হয় সৃজনশীলতার। সবিশেষ, এই সামগ্রিক কর্মকলাপের বেড় দিয়েই তাদের মানুষের মনোহরণ-বাণিজ্যে সাফল্য দেখাতে হয়।
অনেকটা এসব কারণেই, বিজ্ঞাপনকে অনেকে আর্ট অর্থে শিল্প বলতে প্রলুব্ধ হন। কিন্তু এর উদ্দেশ্যের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকালে ওই বলাবলিটায় রহিত হতে হয়, কারণ বিজ্ঞাপন নিতান্তই বাণিজ্যিক, ব্যবসায়িক; যে সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা শিল্পের ব্যাপ্তির সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়। জানা কথা যে, বিজ্ঞাপনের কায়কারবার নানাপ্রকার শিল্পোপাদান নিয়েই। কাব্য, সংগীত, চিত্রকলা বিজ্ঞাপনচিত্রে হামেশাই ব্যবহৃত হয়। আর অভিনয়, নাচ-গান তো এর সঙ্গে ওতপ্রোতই। এর প্রযুক্তি নাটক-সিনেমার, যা সরাসরি শিল্পনামধেয়। এতদসত্ত্বেও, অর্থাৎ শিল্পসহবাসী হয়েও এটি উদ্দেশ্যের দোষে শিল্পকর্ম নয়। অবশ্য ইন্ডাস্ট্রি অর্থে বিজ্ঞাপনজগৎকে বিজ্ঞাপনশিল্প বলবার মতো অবস্থা এখন এদেশেও বিদ্যমান। এ খাতে এখন কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ, লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান। যে কারণে মেধাবী, প্রতিভাবান, সৃজনশীল তরুণ চিত্রনির্মাতা ও লেখকরা এখন এ খাতে স্থিত। যাঁদের হাত অনেক ভালো নাটক-সিনেমা বানাতে কী সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করতে পারত, তাঁদের হাত এখন নিয়ত ব্যস্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনে। অবস্থা এমন পালটে গেছে যে, নাটক-সিনেমা বানিয়ে হাত পাকলে তবেই কেবল বিজ্ঞাপননির্মাতা হিসেবে ডাক বা সাফল্য পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়, একসময় যার উলটোটাই সত্য ছিল।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিজ্ঞাপনের যা কিছু লাভালাভ তা পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও তদসংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা, বিজ্ঞাপননির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও নির্মাণসংশ্লিষ্টজন, বিজ্ঞাপন প্রচারকাজে যুক্ত গণমাধ্যম এবং নির্দিষ্ট পণ্যের বিক্রেতার ভাগেই বর্তায়। এর বাইরে বাদবাকি সমস্ত ভোক্তাশ্রেণিই বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির কড়ি গোনেন। ভোক্তাশ্রেণির দৃষ্টিতে দেখলে নানাভাবে সাধারণের শান্তি বিনষ্ট করাই যেন বিজ্ঞাপনের কাজ। যার কোনো কিছুরই অনটন নেই, বিজ্ঞাপন তাকেও প্রতিমুহূর্তে জানান দেয় যে, তোমার এটা নেই, ওটা নেই। যাদের এটা-ওটা আছে, তাদের চেয়ে তুমি ব্রাত্য, হীন। তার মনের মধ্যে তখন জন্ম নিতে থাকে প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, তাতে জন্ম হয় চাহিদার। আর এই চাহিদাই তাকে চুবিয়ে মারে অতৃপ্তির লাভাস্রোতে। এই অতৃপ্তি থেকে বাঁচতে তাকে অপ্রয়োজনেও অর্থ ঢালতে হয়। এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে সাধারণের চোখ-কানকে বিজ্ঞাপনের দ্বারা অনবরত পীড়িত হতে হয়। বিজ্ঞাপন ব্যাপক শব্দ ও দৃশ্যদূষণ ঘটায়। বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড-ব্যানারের বাধা এড়িয়ে সহজে মুক্ত আকাশ দেখবার সাধ্য শহরে অন্তত কারো হয় না আর। বিজ্ঞাপনে এখন ঢেকে থাকে চোখসমেত আমাদের বিস্তারিত মুখ। টিভি-রেডিওতে কান পাতা যায় না বিজ্ঞাপনের উচ্চণ্ড আওয়াজে। টিভির সামনে বসে বিরতিহীন বিজ্ঞাপনের ফাঁকে দর্শকদের একাধটু অন্যকিছু দেখতে-টেখতে হয়। দর্শক যেন টাকা দিয়ে টিভি কেনেন কেবল বিজ্ঞাপন দেখবার জন্যই। দয়া করে বোনাস হিসেবে চ্যানেলগুলো একটু নাচ-গান, নাটক-সিনেমা, সংবাদ-কথিকা দেখিয়ে তাদের ধন্য করে।
অবিশ্বাস্য লাগলেও আমাদের দেখতে হচ্ছে, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের মতো পত্রিকার কোনো একদিনের পুরো মলাট কোনো বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি হয়ে যেতে, যেটা সাংবাদিকতার দৃষ্টিতেও অত্যন্ত গর্হিত ব্যাপার। এতদিন টিভিতে আমরা ৫ মিনিট বিজ্ঞাপনের পরে ৭ মিনিট সংবাদ দেখতাম। এখন যতক্ষণ সংবাদ, ততক্ষণই বিজ্ঞাপন। নতুন কায়দা বেরিয়েছে। তাতে বিজ্ঞাপন ঢুকে গেছে সকল প্রান্তে, সকল ক্রান্তিতে। শিরোনাম এবং বিরতিটুকুও বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রি হয়ে গেছে সংবাদের বিভিন্ন বিভাগ-উপবিভাগ।
সংবাদকে যত স্লটে ভাগ করা যায়, ততই যেহেতু লাভ, সেজন্য ভাগ করা যায় না যা তাও ভাগ হয়ে গেছে। অর্থ সংবাদ থেকে বাণিজ্য সংবাদকেও আলাদা করা হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপনে বিরক্ত দর্শক এতদিন বিজ্ঞাপন শুরু হলে অন্য চ্যানেলে গিয়ে বিজ্ঞাপনের বিড়ম্বনা থেকে নিজেদের চোখ-কানকে রক্ষা করতেন, এখন আর সে সুযোগ নেই। এক গবেষণা তথ্য জানান দেয় যে, প্রায় ৩০ শতাংশ টেলিভিশন দর্শক সজ্ঞানে বিজ্ঞাপন এড়িয়ে চলার মানসিকতা রাখেন। এই তথ্যসূত্রে বিজ্ঞাপনসংশ্লিষ্টরা হয়ত বাকি ৩০ শতাংশ দর্শককেও কাবু করবার ফন্দি এঁটেছে। এখন বটমস্ক্রিনের নিউজস্ক্রল এলাকাও একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিকিয়ে দেয়া হয়েছে। তার মানে সংবাদ প্রচারকালে যতক্ষণ স্ক্রিনে চোখ রাখা হবে, ততক্ষণই প্রত্যেকে বিজ্ঞাপন দেখতে বাধ্য হবেন। অর্থাৎ আমার-আপনার জন্য পালাবার আর পথ নেই। সংবাদপত্র, টেলিভিশন কেউই আর সে সুযোগ দেবে না আমাদের। বিলবোর্ড-ব্যানারও আর দেবে না সাধ করে আকাশ দেখবার সুযোগ। আমরা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি বিজ্ঞাপন দেখা না-দেখা বিষয়ক আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা। এখন একমাত্র পত্রিকা না-পড়া, টিভি না-দেখা, ঘর থেকে বাইরে না-বেরোনোর সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতাটাই কেবল অবশিষ্ট আছে আমাদের। কিন্তু এ-ও কি সম্ভব কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে?
বলছিলাম সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিকিয়ে যাওয়ার কথা। এটা কেবল আমাদের দেশের বাস্তবতা না। পৃথিবীর অনেক দেশেই বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমের আয়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তাই সন্দেহ হয় যে, বিজ্ঞাপনদাতারাই হয়ত পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে গণমাধ্যমের গতিপ্রকৃতি। প্রশ্ন জাগে, বিজ্ঞাপনের ওপর সিংহভাগ নির্ভরশীল গণমাধ্যমসমূহ কতদূর সাহস রাখে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচারের? এটা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হবার উপক্রম। একাধটু যা হয়, তা নিছক শত্রুতাবশত। ‘ক’ নামক প্রতিষ্ঠান যখন ‘খ’ নামক সংবাদমাধ্যমকে বিজ্ঞাপন দেয় না, তখন ‘খ’ নামক সংবাদমাধ্যম তক্কেতক্কে থাকে ‘ক’কে নাজেহাল করবার জন্য। এই-ই একমাত্র শর্ত, যখন ‘খ’, ‘ক’কে ছিলিয়ে লবণ লাগিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কারণ তো স্পষ্ট, জেদ উসুল করা। ভাবখানা এমন যে, আমাদের বিজ্ঞাপন দাও না, দেখো তোমাদের কেমন ডোবানো ডুবাই! এই হলো ঘটনা! তো, এ সংস্কৃতিতে কার লাভ? ওই দু’পক্ষেরই মাত্র। বাকি সবাই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা জানতে পারি না সমাজ-রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা, যেটা জানাবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দেদারসে কড়ি কামিয়ে চলেছে গণমাধ্যমগুলো। নির্দিষ্ট কোনো সত্য চেপে যাওয়ায় বা হালকাভাবে জানানোয় বা উলটো করে দেখানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রও।
পণ্যের গুণে না-হলেও কোটি কোটি টাকা মূলধন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের দাপটে ইতোমধ্যে দেশের ছোটোপুঁজির ক্ষুদ্রশিল্পের রীতিমতো বারোটা বেজে গেছে। ‘সবলের কাছে দুর্বল হেরে যাবে’, প্রকৃতিবিজ্ঞানের এই সূত্রে যত সত্যই উচ্চারিত হোক না কেন, পুঁজির বাঘ যখন অকাতরে টপাটপ হরিণ-খরগোশ গিলে যেতে থাকে, যখন মাৎস্যন্যায়ে ছেয়ে যায় বাণিজ্যিক খাত। তখন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়, তা নানা অস্থিরতার জন্ম দেয়। ব্যবসায়িক অসততা ও নকল পণ্য উৎপাদনের যে ব্যাপকতা এখন দেশের বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর সর্বঘনিষ্ঠ কারণটি কে জানে হয়ত ওই অস্থিরতায়ই লুকিয়ে আছে! শুধু তাই নয়, আমার ধারণা বাজারমূল্য বৃদ্ধিতেও বিজ্ঞাপনবাহুল্যের বিশেষ ভূমিকা আছে। উৎপাদকগোষ্ঠীর একটা ফাঁকিবাজি হিসেব আছে, যা দেখিয়ে জানানো হয় যে বিজ্ঞাপন পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে না, বরং উৎপাদন বাড়ে বলে পণ্যমূল্য কমে। আসলে এর সবৈব মিথ্যা। কারণ ক্রেতাদের সামনে এমন কোনো উদাহরণ নেই যে, দীর্ঘদিন বিজ্ঞাপিত হবার পর পণ্যের ব্যাপক বাজার তৈরি হলে শুরুর চেয়ে কম মূল্যে কোনো নির্দিষ্ট পণ্য ক্রয় করা যায়। ধরা যাক পণ্যটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী, আর এর উৎপাদক ইউনিলিভার। সারাদেশের সবকটা চ্যানেলে, সবকটা পত্রিকায় শত শত ঘণ্টা বিজ্ঞাপন প্রচার করে, দু’তিন মাস সময় ধরে অনুষ্ঠিত সুন্দরী বা মডেল আহরণ জাতীয় অনুষ্ঠানের স্পন্সর হয়ে, লক্ষ লক্ষ টাকা মাসোহারা দিয়ে কর্মকর্তা পুষে বছরে এরা উৎপাদন খরচের অধিক যে পরিমাণ টাকা বাড়তি ব্যয় করে, সন্দেহ কী যে, সে টাকা উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ করেই এরা পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে! আমাদের জানামতে, তাদের টাকার গাছ নেই, তারা বাণিজ্য করতে নেমেছে, সমাজসেবা করতে নয়। বাণিজ্যের শর্তানুযায়ী তারা যা বিনিয়োগ করবে, তা মুনাফাসহ উঠিয়ে নেবে। এ নিয়মের ওখানেও ব্যত্যয় ঘটবার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ বিজ্ঞাপন ও স্পন্সরশিপের কোটি কোটি টাকা আমাকে-আপনাকে তথা ভোক্তাশ্রেণিকেই গুণতে হয়। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, এরা পণ্যের গায়ে যে মূল্য লিখে সে মূল্য নিয়ে কোনো মহল থেকেই কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠে না। মাস পরে দশ টাকা বাড়লে তা নিয়েও না। মিডিয়া তাদের পুকুরচুরি নিয়েও কখনো টু-শব্দটি করতে আগ্রহী নয়। এর কারণ আগেই বলা হয়েছে। অন্যদিকে পিঁয়াজ-রসুনের দোকানি কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়ালে তা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক হৈচৈ হয়। কারণ এরা বিজ্ঞাপন দেয় না। এবার ধরা যাক, পিঁয়াজ-রসুনের দোকানির বাসায় একটা ১৪ ইঞ্চি রঙিন কংকা টিভি আছে। কাজের ফাঁকে তার দুই মেয়ে টিভি অনুষ্ঠান দেখে। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দেখে তাদেরও ফর্সা হবার ইচ্ছে হলো। মেয়েরা একটা ক্রিম কিনবার বায়না জানালে দোকানি মুখ ঝামটা দিলেও মেয়েদের মায়ের সুপারিশে শেষপর্যন্ত তাকে রাজি হতে হলো, এটা মনে করে যে, যদি ঠিকই ওরা একটু ফর্সা হয় তো বিয়ে দিতে সুবিধে হবে! ষাট টাকা দিয়ে তাকে মাঝারি সাইজের একটা টিউব কিনতে হলো। তো, এই যে অতিরিক্ত ষাট টাকা অকারণে খরচ হলো, এই টাকাটা ওঠাবার জন্য ওইদিন যদি কোনো কোনো ক্রেতার কাছে দোকানি পিঁয়াজের দাম কেজিতে দুই টাকা বেশি হাঁকে, তাহলে দোষটা কার? ইউনিলিভারের নয়? ঘটনাটা যে এরকম করেই সবসময় ঘটে তা নয়। তবে দিব্যি দিয়ে বলা যায় যে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে এরকম একটা বৃত্তীয় কারণসূত্রও নিহিত আছে, যার একটা বড়ো ফ্যাক্টর বিজ্ঞাপনবাহুল্য।
অনেকে বলেন, বিজ্ঞাপনের একটা বড়ো সমস্যা এর বাড়িয়ে বলবার প্রবণতা। যেটা যা নয়, সেটাকে সে অভিধা দেয়া। আমাদের বিজ্ঞাপন দিনকয়ের ব্যবধানে টাক মাথায় চুল গজিয়ে বয়স কমিয়ে দেয়, বদখত মেদভুড়ি কমিয়ে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়, শ্যামলা ত্বক ফর্সা করে সাফল্য এনে দেয়, ব্রন-মেছতার দাগ মুছে রমণীয় করে দেয়, শারীরিক উচ্চতা বাড়িয়ে সুদর্শন বানিয়ে দেয়, ফাটা সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে অটুট করে দেয়, ভালোবাসা গাঢ় করে মধুময় করে দেয়! এসব বিবৃতিতে কার্যত কোনো সত্যই নিহিত নেই, বরং যা রীতিমতো প্রতারণার পর্যায়ে গণ্য হবার যোগ্য। কিন্তু এরা হরদমই এসব বিবৃত করে যাচ্ছে। দেশের কোথাও কেউ নেই এসব দেখভাল করবার। থাকলে এরকম মিথ্যা দিনের পর দিন উচ্চ ভলিউমে বলা-কওয়া সম্ভব হতো না। মিথ্যা বলা, বাড়িয়ে বলা এক্ষেত্রে একরকম রেওয়াজেই পরিণত হয়ে গেছে যেন। আমাদের দেশের কোনো কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে স্পর্শকাতর ‘হালাল’ শব্দটাও ব্যবহার করতে শোনা যায়। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে এভাবে বাণিজ্য করবার মতো জঘন্য ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সম্ভব বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে সবই সম্ভব। এমনকি ইউরোপ আমেরিকায় প্রত্যাখ্যাত কোনো কোনো বিজ্ঞাপনও এদেশে দেদারসে চলছে, যেমন হরলিকস। এজন্য কারো কোনোরূপ প্রশ্নের মুখেই পড়তে হচ্ছে না। হয়ত পড়তে হবেও না কখনো। এসব দেখে শুনে আমার নিজস্ব কিছু বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। গড়পরতা সব বিজ্ঞাপনের দিকে আঙুল তুলে আমি বলতে পারি, ‘এটা বিজ্ঞাপন, এর ৪০ ভাগকে মাত্র সত্য হিসেবে নিও, বাকি ৪০ ভাগ প্রোপাগান্ডা আর বাদবাকি ২০ ভাগ মিথ্যা’-- এরকম একটা বিশ্বাস নিয়েই হয়ত আমাকে বাঁচতে হবে, যতদিন না কেউ বিশ্বাসযোগ্য কোনো জরিপতথ্য দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারছেন। এজন্যই আমি ব্যক্তিগতভাবে বিজ্ঞাপনবাহুল্যে কুখ্যাত(!) কোনো পণ্য ক্রয়েই বিশেষ আগ্রহ বোধ করি না, যার ক্রয়োপযোগী অন্য বিকল্প আছে।
পাশ্চাত্যের আরেক গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ৩০ শতাংশ দর্শক টিভিতে প্রচারিত অন্য অনুষ্ঠানাদির চাইতে বিজ্ঞাপন বেশি উপভোগ করে। কেন করে? কী এমন উপাদান বিজ্ঞাপনে রয়েছে, যা টিভিতে প্রচারিত অন্য অনুষ্ঠানগুলোতে নেই? এর উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলে হয়ত সমাজে বিজ্ঞাপন কেমন প্রভাব রাখে তার একটা হদিশ করা যেত। অবশ্য এ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের লিঙ্গভিত্তিক তথ্য সহজলভ্য নয়, যেটা লভ্য হলে আরো কিছু দিকেরও সুরাহা হতো। তবু কি অনুমান একদমই করা যায় না, অন্তত স্বচক্ষে কিছু বিজ্ঞাপনচিত্র দেখবার অভিজ্ঞতা থেকে? যায়। এর কারণ সম্ভবত কাম্য নারী/পুরুষের আকর্ষণীয় উপস্থাপনা, যা তরুণ-তরুণীকে সুযোগ করে দেয় ‘ব্র্যান্ডের বাঁদী’কে ঘিরে ফ্যান্টাসিতে মেতে ওঠবার। সকলেই জানেন, বিজ্ঞাপন নারীর শরীরী সৌন্দর্য ও যৌনতাকে পুঁজি করে তাকে পুরুষের কাম্যবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে, তা তাকে যে ধরনের চরিত্রেই হাজির করা হোক না কেন। এমনকি বিজ্ঞাপনের ‘মা’কেও দর্শকের কাছে প্রকৃত ‘মা’ মনে হয় না, শরীরী নারীই মনে হয়। ওর উপস্থাপনাটাই এমন হয় যে, তাতে মায়ের অনুভূতি ঠিকঠাক খোলে না। পণ্যের রংয়ে রঙিন করে বিজ্ঞাপনে নারীমডেলকে পণ্যের কায়দায় যেভাবে নাড়াচাড়া করা হয়, তাতে পুরুষ নারীকে একটা নাড়াচাড়ার বস্তু হিসেবেই ভেবে নিতে পারে আলবত। এসব মডেলের মধ্যে নারীদর্শকও মজে যায় শুনেছি। তাদের কাছে মডেলনারী হয়ে ওঠে অনুকরণীয় আদর্শ, আর মডেলপুরুষ হয়ে ওঠে কাম্যজন!
উল্লিখিত ৩০ শতাংশের মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞাপনের জেন্ডার নির্মাণ কৌশলের পুরোপুরি অনুকূলে। বিজ্ঞাপন যেভাবে হাসতে বলে এরা সেভাবে হাসে, যেভাবে সাজতে বলে সেভাবে সাজে। এমনকি যেভাবে তাকাতে বলে বিপরীতলিঙ্গীর প্রতি, সেভাবে এরা তাকায়ও। এসবের ভিতর দিয়ে পুনঃসামাজিকীকৃত হয় নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ক সমাজে বিদ্যমান চিরাচরিত একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে নারী কেবল নাচে-গায়, সাজে-রাঁধে, সেবা-সহায়তা করে, কাপড় কাচে, হাঁড়ি-বাসন মাজে, বাচ্চা লালনপালন করে। বিজ্ঞাপনে নারী কমই বিমান চালায় বা অফিস পরিচালনা করে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পণ্যের ঘনিষ্ঠ পরিচয় উপস্থাপন করবার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন নারীর এহেন স্টেরিওটাইপড চেহারাছিরিও সমাজে জ্ঞাপন করে যেতে থাকে অবিরাম, যা নারী-পুরুষের মধ্যে সমতাপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নের যাবতীয় উদ্যোগের বিপরীতে বিরামহীনভাবে নেতিঢেউ প্রবাহিত করে যেতে থাকে। এ কারণেও বটে, অনেকে ঝেড়ে কেশে বলেন, বিজ্ঞাপন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনবরত ছড়িয়ে যাচ্ছে মনন কলুষ। এ দৃষ্টিতে একে দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি প্রকল্পের অধিক কিছু ভাবা যায় না বস্তুত।
সম্প্রতি নির্মিত কোনো কোনো বিজ্ঞাপনে নারীর এই স্টেরিওটাইপড ইমেজ ভেঙে বাইরে বেরোবার চেষ্টা করা হচ্ছে দেখে ভালো লাগে। রান্নাঘরে পুরুষকেও পাঠানো হচ্ছে দেখে হতাশা কিছু কমে। কিন্তু এই ভালো লাগা স্থায়ী হয় না রাঁধুনি মা দিবস বা পন্ডস নারী দিবস জাতীয় প্রোমোশনাল প্যাকেজ কিংবা ইউনিলিভার/স্কয়ারের পয়সায় ঢাকঢোল পিটিয়ে সুন্দরীর হাট বসানোর কথা ভেবে। শেষপর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে এরা আমাদের? বড়ো অসহায় লাগে, কেবলই অসহায় লাগে। আধিপত্যশীল এই বিজ্ঞাপনের দাপটের কাছে অসহায়তা বোধ করাই সম্ভবত আমাদের পরম নিয়তি। যেমনটি মূর্ত হয়ে উঠেছে শঙ্খ ঘোষের সুবিখ্যাত কবিতা মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনেও। আমাদের ব্যক্তিগত কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই, যেখানে ঢুকে যায় নি বিজ্ঞাপনের আগ্রাসী দাপুটে হাত। কবিতাটি পাঠশেষে একটা নিরাময়অযোগ্য বিপন্নতাবোধের জন্ম হয়। ক্ষুব্ধতাও জাগে মনে, কিন্তু বিপ্লবের বাসনা জাগবার ফুরসৎ হয় না। কার বিরুদ্ধে বিপ্লব? বিশ্বায়ন? বাজার? পুঁজি? অসম্ভব লাগে প্রায়। তবু চলুন আরো একবার বিপন্ন হবারই চেষ্টা হোক, যদি কোনো নিরাময় চিন্তা বেরিয়ে আসে কোনোদিক থেকে! বলা তো যায় না কিছু!
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুসে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।
কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।
মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।
(শঙ্খ ঘোষ, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)
ম. হাসান সম্পাদিত 'দ'-এ সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রকাশিত