প্লেটো মনে করতেন কাব্য সত্য থেকে তিন ধাপ দূরে অবস্থান করে। সত্য হলো কতগুলো ভাব বা আইডিয়া, আর বস্তুজগৎ তার অনুকরণ বা প্রতিফলন। কাব্যের আদর্শ যেহেতু বস্তুগজগৎ, কাজেই কাব্য অনুকরণের অনুকরণ। প্লেটোর এ মতের প্রতি তাঁর সুযোগ্য শিষ্য অ্যারিস্টটলের ভিন্নমত ছিল। তবে তা এ অর্থে নয় যে, কাব্য অনুকরণ নয়; বরং এ অর্থে যে, কাব্য সত্য থেকে তিন ধাপ দূরের বিষয় নয়। অর্থাৎ এই দুই গ্রিকচিন্তকের মতেই কবিতাকরা বস্তুজগতের অনুকারিতা। এ কথার পুরোটা হয়ত আমরা মানব না এতদিন পরে। কারণ কবিতার আদর্শ কেবল বস্তুজগৎ, এ মতটিই আমাদের সমর্থন পায় না। সে কারণে কথাটি নিসর্গ ও অন্যবিধ দৃশ্যবস্তুর দোষগুণ বর্ণনাকারী কবিতাগুলোর ক্ষেত্রে কিছুটা খাটলেও, মনোভাববর্ণনমূলক কবিতার ক্ষেত্রে অচল। এটা সত্য যে, মানুষ ও মানুষের মনও প্রাকৃতিক বস্তু, কিন্তু মনোভাব প্রাকৃতিক নয়। কাজেই তা নিয়ে লিখিত কবিতা কী করে বস্তুজগতের অনুকারিতা হবে? যদি কিছুর অনুকারিতা একে বলা হয়ই, তবে তা হয়ত ভাবনার অনুকারিতা, যে ভাবনার কোনো বাস্তবিক রূপই নেই। কাজেই নিজস্ব আবেগে চালিত হয়ে নিজ ভাবনার ছকানুযায়ী আমরা যখন কবিতা করি, তখন আমরা কারো অনুকারিতা করি না বস্তুত। কিন্তু মুশকিল হলো, ভাবনার অনুকারিতা করে সেই ভাবনাটা আমরা যখন ভাষায় প্রকাশ করি, তখন তা অবয়ব পায় নানা বস্তুসূচক শব্দের সহায়তায়ই। অর্থাৎ একবার অস্বীকার করেও ঘুরেফিরে আমাদের একভাবে প্লেটো-অ্যারিস্টটলের মতের আশ্রয়েই গিয়ে দাঁড়াতে হয়। সে যাই হোক, এ ধরনের অনুকারিতায় গ্লানি নেই, কারণ এটাই এক্ষেত্রে দাগায়িত সর্বশেষ সীমা। কেননা সকল অর্থপূর্ণ বক্তব্যই শেষপর্যন্ত দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তুর গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। আমাদের উদ্বেগ কাজেই প্রকৃতির অনুকারিতা নিয়ে নয়, বরং মানুষ ও তার কর্মের অনুকারিতা নিয়ে।
ইতোমধ্যে আমরা নিজের ভাবনা নিয়ে গর্বিতভাব ব্যক্ত করেছি। কিন্তু নিজস্ব ভাবনা বলে আমরা যাকে গ্লোরিফাই করতে চাচ্ছি, সেটা কতদূর নিজের তা-ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বটে। ইউরোপের প্রথম সমালোচকরূপে খ্যাত জার্মান নাট্যকার লেসিংয়ের একটা বক্তব্য ছিল এরকম যে, ‘মাসুল না দিয়ে কেউ পাম গাছের তলায় হাঁটতে পারে না’। গ্যাটে তাঁর ইলেকটিভ এফিনিটিজ গ্রন্থে উদ্ধৃতিটি একই অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। এর মানে হলো আমরা প্রতিনিয়ত যা দেখি-শুনি-পড়ি-করি তার কিছু না-কিছু প্রভাব আমাদের ওপর পড়েই, যা আমরা এড়াতে পারি না। এসব প্রভাবের বলেই আমরা চিন্তাভাবনা করি ও আমাদের মধ্যে অনুভূতির জন্ম হয়। ওই অনুভূতিই যদি আমরা লিখি তাহলেও কি বলা যাবে যে, আমরা অনুকারিতা করছি? বলা যাবে, কিন্তু আমরা বলি না ও বলব না। কিন্তু যদি আমরা অন্য কারো ভাবনা, ধারণা, বক্তব্যকে লুটেপুটে নিই, তাহলে সেটা অনুকারিতাই। এক্ষেত্রে আমরা হয়ত নিজেদের ভাবনার অনুকারিতাসূচক ধরনটাকে গ্রহণ করলেও পরের ভাবনার অনুকারিতাসূচক ধরনকে নিয়ে নীতিগতভাবে আপত্তি করব। কখনো কখনো আমরা আইডিয়া চুরির অভিযোগ কোথাও কোথাও নিম্নস্বরে উঠতে শুনেছিও, কিন্তু এ অভিযোগও কোথাও কখনো বড়ো হয়ে উঠেছে বলে শোনা যায় নি। কাজেই শিল্পনির্মাণ প্রশ্নে এটিকেও অগর্হিত আচরণ হিসেবেই গণ্য করা হয়।
ধরা যাক, কবি তাঁর বিভিন্ন পেশার পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা করেন; তাঁদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, চিত্রকর ও ব্যবসায়ী। প্রত্যেকেই তাঁর তাঁর জগৎ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আড্ডায় নানা কথা বলেন, প্রতিক্রিয়া জানান। এসব কথা থেকে এমনসব ক্লু বেরিয়ে আসে বা আসতে পারে, যা জন্ম দিতে পারে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কবিতার বীজ। হয়ত ওই আড্ডায় মিলিত না-হলে, উপর্যুক্ত আড্ডাসঙ্গীরা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলাপ না-করলে, একজন বিশেষ একটি বাক্য উচ্চারণ না-করলে ওই বীজটি খুঁজে পাওয়া যেত না এবং কখনোই লিখিত হতো না বিশেষ একটি কবিতা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় লিখিত কবিতাটিকে আমরা কেউই বলব না অনুকৃত। কারণ কবিতাবীজ আহরণের এ পন্থাটিও দোষের নয়।
অনেকের কাছে শুনেছি, কোনো কোনো কবি-লেখককে তাঁরা বিশেষভাবে রিসোর্সফুল বলে ভাবেন। তাঁদের কবিতা-গল্প-উপন্যাস ও অন্য লেখাপত্র পড়লে বিশেষ বিশেষ কবিতার সম্ভাবনা জাগ্রত হয়। সব অগ্রজ কবি-লেখক পরবর্তী লেখকদের ইন্ধন সরবরাহ করতে পারেন না। কারণ প্রভাবসঞ্চার করবার গুণ সবার থাকে না। সে কারণে বিশেষ বিশেষ কবি-লেখকের জীবন ও কর্ম সাধারণ পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে গৃহীত না-হলেও সতীর্থ লেখকদের কাছে নিত্যচর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। কবিতাবীজ সংগ্রহের এই পন্থাটিও স্বীকৃত ও বহুজনজ্ঞাত। এ ব্যাপারে ফরাসি লেখক ও কূটনীতিক আঁদ্রে মোরোয়ার বিশেষ ওকালতি আছে। তিনি উপদেশ দিয়েছেন, ‘যে সকল বড়ো লেখক মনে ভাবাবেগ সৃষ্টি করেন নবীন লেখক শুধু তাঁদেরই বেছে নেবে এবং তাঁদের গ্রন্থরাজিই সে পুঙ্খানুপুঙ্খ বারবার পাঠ করবে।’ কাজেই এটাকে এমনকি প্রভাব বলে নিন্দা করবারও রেওয়াজ নেই। কিন্তু কাউকে পড়তে গিয়ে তাঁর বিশেষায়িত শব্দরাজি, তাঁর শব্দ ব্যবহারের ধরন, কবিতাকে কবিতা করে তুলবার প্রক্রিয়া, ইত্যাদি সবই যদি আমরা আমাদের কবিতায় কাজে লাগাই বা লাগাবার চেষ্টা করি, তবে আমরা নির্ঘাৎ একটা ঝুঁকির দিকে পা বাড়িয়ে দেবো। এ অবস্থাটাকে নিন্দনীয় ভাববার সুযোগ আছে। সমাজচক্ষু বলবে, আমরা ওখান থেকে চুরি করেছি; ভয়ানক ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত হয়েছি; ইত্যাদি। তাছাড়া আমাদের নিজেদের দিক থেকেও সেটা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারবার মতো ব্যাপার। কারণ এই প্রবণতা আমাদের নিজস্ব স্বর তৈরির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে, আমাদের কবিতার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা তৈরি করবে।
বছর কয় আগে প্রথম আলো সাময়িকীতে শাহীন মমতাজের একটা কবিতার বইয়ের আলোচনায় তাঁর কবিতার ভূয়সী প্রশংসা শেষে আলোচক সাজ্জাদ শরিফকে বলতে শুনেছিলাম, শাহীনের এখন উচিত উৎপল কুমার বসুর হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজের মতো করে হাঁটা বা এ জাতীয় একটা কথা। এখানে সাজ্জাদ শরিফ সম্ভবত এটাই পরিষ্কার করতে চেয়েছেন যে, এ ধরনের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়া যাবে কবির বেড়ে ওঠবার লগ্নে, কিন্তু এক সময় তার থেকে বেরিয়ে নিজের স্বর তৈরি করবার দিকে মনোযোগ দেয়া জরুরি, নইলে রহিত হয়ে যাবে তাঁর স্বতন্ত্র লেখক হিসেবে বেড়ে ওঠা। এ প্রশ্নে আঁদ্রে মোরোয়ার স্বরও প্রায় একইরকম; তিনি বলেন, ‘অন্যের রচনা-শৈলীর সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হবার পর নবীন লেখক নিজস্ব রচনা-শৈলী গড়ে তুলবেন’।
প্রভাবের পক্ষে বিশ্বখ্যাত ফরাসি-লেখক অঁদ্রে জিদেরও ব্যাপক ওকালতি আছে। তিনি ‘সাহিত্যে প্রভাব’ নামে একবার একটা দীর্ঘ বক্তৃতাই দিয়েছিলেন, যাতে তিনি সব ধরনের প্রভাবেরই পক্ষ নিয়েছিলেন। প্রভাব যে লেখকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই প্রতিপাদন করেছিলেন তিনি তাঁর বক্তৃতায়। তখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে আমরা মেধাস্বত্ব বা ন্যায়ের প্রশ্নে সীমাটা টানব কোথায়? একটা সীমা নিশ্চয়ই কোথাও-না-কোথাও থেকে যাওয়া সংগত, তা নইলে চিরকালই আমাদের অঁদ্রে জিদ বা আঁদ্রে মোরোয়াই লিখে যেতে হবে, নতুন কিছু কেউ লিখবেন না।
অঁদ্রে জিদ বলেন, ‘প্রভাবকে ভয় করে যাঁরা দূরে বসে থাকেন তাঁরা আত্মার দৈন্যকেই তুলে ধরেন। তাঁদের মাঝে নতুন কিছু খোঁজা বৃথা।’ এবং তিনি জানান, ‘মহামান্য ব্যক্তিদের আমরা প্রভাবের ভয়ে শঙ্কিত হতে দেখি না বরং প্রভাব সংগ্রহের অদম্য আগ্রহ তাঁদের কাছে অনেকটা বাঁচার আগ্রহের মতোই।’ শুনলে শিহরণ জাগে! উদাহরণ হিসেবে যে মহজ্জনের নাম তিনি সামনে আনেন তা শুনে ভিমড়ি খাবার জোগাড় হয়। এঁদের মধ্যে আছেন মিকেলেঞ্জেলো, মঁতেন, রাসিন, গ্যাটে, গোগোলের মতো শিল্পী-সাহিত্যিক। তখন মনে হয়, আমাদের হয়ত এরকম করে ভাবাই সংগত যে, মহৎদের কথা আলাদা! মহজ্জন প্রভাবকে মহৎ উপায়ে কাজে লাগাতে জানেন, মৌমাছির মতো নানা ফুল থেকে একটু একটু করে মধু আহরণ করে মধুভারে টইটম্বুর মৌচাক বানিয়ে তোলেন। আমরা অতটা পরিশ্রম করতে পারি না বা করতে রাজি হই না, বরং শর্টকাট রাস্তা খুঁজি। এই শর্টকাটওয়ালাদের কথাও তিনি বলেছেন বটে তাঁর বক্তৃতায়। জানিয়েছেন, ‘প্রভাব ভালো-মন্দ দু’রকমেরই হতে পারে।...প্রভাবের ভালোমন্দ নির্ধারিত হয় যিনি প্রভাবিত হন তাঁর ভালো-মন্দের আপেক্ষিকতায়।’ আমরাও কাজেই এই আপেক্ষিকতায় দাঁড়িয়েই আমাদের আলাপ বিস্তৃত করবার প্রয়াস করব। কারণ আমরা সাধারণ। আমরা সমুদ্রজল ছুঁতে জানি, কিন্তু গা না-ভিজিয়ে সে জলে অন্তর সিক্ত করে নেয়া আমরা শিখি নি।
কবিতার একটা ডিভাইস বা অলংকার আছে পরোক্ষ উদ্ধৃতি বা উল্লিখন নামে। পৃথিবীর অনেক খ্যাত-বিখ্যাত কবিই এ অলংকার ব্যবহার করেছেন, যেজন্য তাঁরা নিন্দিত হন নি। ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত কবি এলিয়টের কবিতায় দেশ-বিদেশের বিস্তর ক্লাসিকসার ব্যবহৃত হয়েছিল। বাংলা কবিতার তিরিশের দশক থেকে যে আধুনিকতার সূচনা তাতে এলিয়টসহ প্রধান প্রধান ইউরোপীয় কবির সুস্পষ্ট প্রভাব কাজ করেছে। শুধু বাংলা কবিতা নয়, জানা যায়, অন্যত্রও এলিয়টের প্রভাব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। মার্কিন কবি স্ট্যানলি ক্যুনিটজ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রায় তিন দশক এমন কোনো তরুণ কবি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল যার পেছনে তাঁর (এলিয়টের) কণ্ঠস্বর শোনা যেত না। বিশের ও তিরিশের দশকে খ্যাতি অথবা শ্রোতা জোটাতে হলে এলিয়টকে অনুসরণ করতেই হতো।’ এরকম অবস্থায় দেশি বা বিদেশি উৎসের দ্বারা প্রভাবিত হওয়াকে দোষারূপ করবার কোনো সুযোগ থাকে না। বিদেশি শিল্পউৎস থেকে প্রভাব সঞ্চয় করাকে যে দোষারূপ করা যাবে না, তা এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁর সহিত্যবিচার নামক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ‘সাহিত্যবিচারকালে বিদেশী প্রভাবের বা বিদেশী প্রকৃতির খোঁটা দিয়ে বর্ণসংকরতা বা ব্রাত্যতার তর্ক যেন না তোলা হয়।’ তবে এটা উল্লেখযোগ্য যে, একই প্রবন্ধে তিনি প্রভাবের ভালোমন্দ তথা দোষগুণের সীমাটাও আমাদের জন্য স্পষ্ট করে রেখেছেন। বলেছেন, ‘অনুকরণই চুরি, স্বীকরণ চুরি নয়। মানুষের সমস্ত বড়ো বড়ো সভ্যতা এই স্বীকরণশক্তির প্রভাবেই পূর্ণ মাহাত্ম্যলাভ করেছে।’ অর্থাৎ আমাদের স্বীকরণের অনুমতি আছে, অনুকরণের নেই। স্বীকরণের বিস্তর নমুনা আছে তাঁর নিজের রচনাকর্মেও। ইউরোপ-আমেরিকার সোনার খনি তো বটেই, সংস্কৃত ও প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের রত্নরাজি থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য (সুফি-বাউল-বৈষ্ণব) দর্শন ও কবিতার ভাঁড়ার পর্যন্ত ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণস্থল।
আমাদের উদ্বেগ এখানে যে, এটুকু স্বীকৃতিকে নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করে আমরা অনেকেই পরোক্ষ উদ্ধৃতি বা উল্লিখন নামক ডিভাইসটির যথেচ্ছ অপব্যবহার করে একে চুরির লাইসেন্স হিসেবে কাজে লাগাতে প্রয়াসী হয়েছি। এজন্য কখনো কখনো মনে হয়, ডিভাইসটি কেবল তাঁদের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত, যাঁরা দায়বদ্ধ কবি হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃত হয়েছেন। নতুনদের হাতে এই অস্ত্র বিপদ ডেকে আনতে পারে। এঁদের মধ্যে যাঁরা অসৎ, যাঁরা সস্তা খ্যাতি চান, তাঁরা এ সুযোগটিকে একটি ভয়ংকরতার দিকে নিয়ে যেতে উদগ্রীব হন, হতে পারেন। এই স্বীকৃতির সুযোগে অনেকে বিপুল পাঠ দিয়ে সমস্ত ক্লাসিক কবিতার মনের কথাগুলো টুকে নিয়ে নিজের কাব্যজগৎ ভরিয়ে তুলতে পারেন ও তোলেন। তাঁদের কবিতা কবিতায় অভ্যস্ত পাঠকের ভালো লাগে। কারণ পাঠকের স্মৃতিতে উতরে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসিক কবিতার যে স্বরটা আলতোভাবে লেগে থাকে, সেটাই ধ্বনিত হয়ে ওঠে ওই ওই কবিতাপাঠে। এঁরা যতটা কবি, তারচে’ বেশি কারিগর বা ক্রাফটসম্যান। ক্রাফটসম্যানশিপের কাজটি এঁরা মনোযোগ দিয়ে করেন এঁদের কবিতায়। নানা জায়গা থেকে কাঠখড় আহরণ করে সুনিপুণ দ্রষ্টব্যবস্তু তৈরি করে লোকজনের সামনে হাজির করেন নিজ নিজ সৃষ্টবস্তু হিসেবে। ডিসকভারিই তখন হাজির হয় ইনভেনশন হিসেবে। দীর্ঘ ঐতিহ্যের সমর্থনে এটিও কবিতার ক্ষেত্রে নিন্দিত হয় না বিশেষ। কিন্তু অধিকাংশ কবি কি এই-ই করে যাবেন জীবনভর? এঁরা কি ইনভেন্ট করে দেখাবেন না কিছু? আমরা জানি, সেটা করার কিছু ঝুঁকি আছে। কবিতাপাঠকদের কাছে তা সম্পূর্ণত অচেনা লাগবে, দ্রুত জনপ্রিয় হবে না। বাহবা পাবার যে রুচি কবির তৈরি হয়েছে, তাঁর সে রুচি আহত হবে। কিন্তু তা হলেও পুরানোকে ভেঙে খাওয়ার চাইতে নতুন কিছু তৈরি করাই আমাদের কবিতার জন্য বেশি জরুরি মনে হয়, আজ; যখন সিংহভাগ কবিই কৈয়ের তেলে কৈ মাছ ভাজার প্রবণতায় আবিষ্ট হয়ে আছেন।
কবিদের মধ্যে একটা দল আছে, যাঁরা পাঠককে ফাঁকি দিতে গিয়ে নিজেদেরই ফাঁকি দিয়ে ফেলেন। এঁদের কৌশল একটু ভিন্ন। এঁরা কম জনপ্রিয়, কম পঠিত কবির কবিতাকে সম্পূর্ণত বা অংশত মেরে দিয়ে বালিতে মাথা গুঁজে থাকেন। ধরা পড়ে গেলে পরোক্ষ উল্লেখ বা উপলব্ধির ঐক্যের দোহাই দেন। দিয়ে পার পান অথবা পান না। কিন্তু প্লাজিয়ারিজম বা তস্করবৃত্তি কেন অলংকারের বরাতে মাফ হয়ে যাবে? কখনো কখনো দেখা যায়, এঁরা দ্রুত একটা খ্যাতি-পরিচিতি পান, আবার হঠাৎ চুরিতথ্য আবিষ্কৃত হয়ে গেলে নিন্দিত-ভর্ৎসিতও হন, পাঠক হারান। জানা কথা যে, এঁরা প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘদিন ধরে কবিতার কাজ করতে আসেন না। তাঁদের সাময়িক বিশেষ মিশন থাকে। মিশনে সফল হবার জন্য এঁরা ওই পন্থা নেন। এঁরা বস্তুত কিছু সৃজন করতে আসেন না, সৃজিত বাগানে লুণ্ঠনযজ্ঞ পরিচালনা করে নিজ নিজ সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়াতে চান মাত্র।
জুলফিকার নিউটন নামের একজন কবিযশোপ্রার্থী ১৯৮৪ সালে হারানো অর্কিড নামে একটি কবিতার বই-ই প্রকাশ করে ফেলেন, যে বইয়ের সম্পূর্ণ প্রায়-একটি কবিতাও তাঁর নিজের লেখা ছিল না; ছিল প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্র, দিনেশ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ কবিদের লেখা। পরের বছর এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণও বেরিয়েছিল। ধরা পড়ার পর তিনি আর কবিতা না-লিখে অন্যত্র গর্ত খুঁড়তে শুরু করেন। ইতোমধ্যে তথ্য-প্রমাণযোগে স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি নিজের অনুবাদ বলে একের পর এক যেসব বই বাজারে ছেড়েছেন ও ছাড়ছেন, ওগুলোর প্রতিটিও আগে করা অন্য কারো অনুবাদ নতুন করে কম্পোজ করে বই বানিয়ে ফেলানো মাত্র। ওসবে প্রায় কিছুই নতুন নেই, কেবল প্রশংসা করে কবীর চৌধুরীর লেখা একটা করে ভূমিকা/ফ্ল্যাপ ছাড়া (কবীর চৌধুরী প্রয়াত হওয়ায় ভবিষ্যতে এই লোক কিছুটা ভূমিকা-সংকটে পড়বেন বলে মনে হয়!)। এমনকি তিনি ভারতীয় বিখ্যাত লেখকদের প্রবন্ধগ্রন্থও একটু এদিক-ওদিক করে নিজের বই হিসেবে ছেপে দিয়েছেন।
ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব থেকে গত দশকে প্রকাশিত একটা প্রকাশনায় গাউসুর রহমানের একটা কবিতা ছাপা হয়, যেটি তরুণ কবিতাকর্মী শাহিন লতিফের বিশেষ ভালো লাগায় পড়তে পড়তে সে ওটা মুখস্থই করে ফেলে। কয়েক মাস পরে ঢাকার পল্টন থেকে একগাদা পুরানো দেশ পত্রিকা কিনে ময়মনসিংহে ফেরার পথে গাড়িতে বসেই লতিফ পত্রিকাগুলোর পাতা উলটাচ্ছিল। হঠাৎ বিকাশ গায়েনের একটা কবিতায় তার চোখ আটকে যায়, যেটা ও আগে কোথাও পড়েছে বলে মনে হয়। কীভাবে সম্ভব? ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে যে, গাউসুর রহমানের নামে যে কবিতাটা লতিফ প্রেসক্লাব-প্রকাশনায় পড়েছিল, সেটির সাথে এর একটা মিল থাকলেও থাকতে পারে। বাসায় গিয়ে দুটো কবিতা মিলিয়ে লতিফ তার সন্দেহ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এরপর শহরে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে গেলে গাউসুর রহমান জানান, তিনি কবিতাটা দেশ-এ ছাপতে পাঠিয়েছিলেন। ওখান থেকেই এটা চুরি হয়েছে। কিন্তু তিনি যাই বলুন, ওখানকার সবাই নানা কারণে বুঝে নিয়েছিল যে, গাউসুর রহমানই বিকাশ গায়েনের কবিতাটায় হাত চালিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এখানে কে কারটা মেরেছেন, আমরা তা বিশেষভাবে তলিয়ে দেখতে যাই নি। কাজেই সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিতও নই। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে, যে-ই মারুন, কাজটা ছিল নিন্দনীয়।
সম্প্রতি তরুণ কবি শিমুল সালাহদ্দিনের নামে ফেসবুকে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে যে, তাঁর ‘তোকে অনু, তোকে’ নামক দীর্ঘকবিতাটিতে প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত কবি সুমন গুণের অন্যমনস্ক ও রূপবান নামক বইয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। অভিযোগকারী শিমুলের কবিতার পাশে সুমন গুণের কবিতার উল্লেখ করার পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষয়, শব্দ ও বাক্যে দূরান্বয়ী সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। কালেকটিভ আনকনশাসনেসের কথা তুলে শিমুল তাঁর ওপর অর্পিত সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং জানান তিনি কখনো সুমন গুণের কবিতা পড়েন নি পর্যন্ত। উপলব্ধির ঐক্য দুটো ভিন্ন ভূগোলে অবস্থিত দুজন শিল্পীর শিল্পকর্মে কোনোভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে না, এরকম বলবার কোনো সুযোগ নেই। এমনটি হামেশাই ঘটে; কিন্তু এক্ষেত্রে কোনটা ঘটেছে, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না।
উল্লিখিত তিনটা ঘটনাই পরস্পর থেকে আলাদা। তিনটিকেই আমরা অপরাধ হিসেবে নিলেও স্বীকার্য যে, একটি আরেকটির সমগোত্রীয় নয়। শিমুলেরটিকে যেখানে অপরাধ হিসেবে না-নিলেও চলে, সেখানে নিউটনেরটা অমার্জনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এবার অন্যরকম একটি ঘটনার কথা বলা যাক : আমাদের এক কবিবন্ধু বিস্তর পাঠ করত। পাঠে পাঠে যে চিত্র-সৌন্দর্যময় বিরল শব্দের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হতো, তাকে সে পিক আপ করত ও সেই শব্দকে কসাইয়ের দোকানে খাসির উরু ঝুলিয়ে রাখার মতো করে নাকের ডগায় কিছুদিন ঝুলিয়ে রেখে ভাবতে থাকত। ঝুলতে ঝুলতে ওই শব্দদোলনটি একসময় একটি স্বাধীন কবিতার দিকে যাওয়া-আসা শুরু করত। আমরা মানি, কোনো ভাষার কোনো শব্দই কোনো লেখকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এমনকি নিজে শব্দ তৈরি করে নিলেও তা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয় না। তৈরি করা শব্দটি যখন অন্যেরা ব্যবহার করে, তখনই বোঝা যায় যে ওই বিশেষ শব্দটি ভাষায় কার্যকর জায়গা পেল। অন্যথায় মৃত সন্তান প্রসবের মতো ব্যাপার হয়ে ওই জন্ম বেদনাই বাড়ায়। কাজেই আমাদের বন্ধুর এই কবিতাভিযানকে দোষ দেবার কোনো সুযোগ নেই। খুবই নিরাপদভাবে প্রভাবিত হবার একটা শৈলী এটা। কিন্তু বন্ধুটি যখন পূর্বে পাঠ করতে গিয়ে তাড়িত হয়েছিল, এমন কোনো কবিতাপঙক্তি একসময় নিজের পঙক্তি হিসেবেই লিখে বসতে থাকল, একই অর্থে একই লক্ষ্যে কেবল শব্দবিন্যাস ১০-১৫ শতাংশ আলাদা করে, তখন আমাদের কাছে তাঁকে বিশেষভাবে অনিরাপদ মনে হয়েছিল। তখন তাঁকে একথা বলা প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল যে, সাবধান হও বন্ধু, সাবধান হও।
আমরা অঁদ্রে জিদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আঁদ্রে মোরোয়ার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়ানো অবস্থায় জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারকে এ ব্যাপারে আমাদের মতোই উদ্বিগ্ন দেখতে পাই। ‘গ্রন্থরচনা ও রচনা-রীতি’ নামক প্রবন্ধে তিনি লেখকের শ্রেণিভেদ করতে গিয়ে এক ধরনের লেখকের কথা বলেন, ‘যাঁহারা লিখিবার পূর্বে নিজেরা কোনো চিন্তা করে নাই; হয়, কবে কি দেখিয়াছে বা শুনিয়াছে তাহাই ব্যাখ্যান করে, নয়, সরাসরি অপর লেখকের লেখা হইতে তাহাদের চিন্তা সংগ্রহ করে।...ইঁহারা, নিজেদের চিন্তার খোরাক বা প্রেরণার জন্য অপরের চিন্তার উপরে নির্ভর করেন। এইজন্য ইঁহারা কখনও পরের প্রভাব এড়াইতে পারেন না, ইঁহাদের রচনা সম্পূর্ণ মৌলিক হইতে পারে না।’
এইরূপ অমৌলিক রচনার প্রাদুর্ভাব থেকে আমরা মুক্তি চাই। দিকে দিকে তেমন রচনার প্রাচুর্য তৈরি হোক, যা পাঠকদের অভ্যস্ততায় নেই। প্রথমে নাক সিঁটকালেও পড়তে পড়তে পাঠকগণ একসময় ওই নতুনে অবগাহন করবেনই করবেন, দুদিন আগে কিংবা পরে, যদি রচনায় কোনো সারবস্তু থেকে থাকে। সাহিত্যের সুস্বাস্থ্যের জন্য এটাই বিশেষভাবে মঙ্গলজনক। অর্থাৎ অন্যের গোলাঘরে হামলা না-চালিয়ে নিজের অন্তর খুঁড়বার শক্তি, রুচি ও সাহসে বলীয়ান লেখক দরকার আমাদের। অবশ্য বলে রাখা ভালো যে, এ দিয়ে কিছুতেই আমরা পাঠাভ্যাস রহিত হতে বলছি না। পাঠ আরো বাড়লেই বরং মৌলিকত্বের সম্ভাবনা বাড়বে। দরকার নিজের কাছে সৎ কলমচি, যার কাছে স্বীকরণমাত্র গ্রহণীয়, অনুকরণ কিংবা চুরি নয়। স্বীকরণ শক্তির তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহারে সক্ষম ব্যক্তিদের আমরা দোষারোপ করব না, তবে স্বপ্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে নতুন আকাশ-মাটি গড়ে তুলবেন যেসব লেখক তাদের বেশি করে সম্মানিত করব। সেরকম লেখকের আধিক্য আমাদের মনে আশা জাগাক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য লাভ করুক শ্লাঘনীয় মহিমা।
দাঁড়াবার জায়গা
- কাব্যতত্ত্ব : এরিস্টটল, শিশিরকুমার দাশ অনূদিত, প্যাপিরাস ১৯৭৭, কলকাতা
- সাহিত্যে প্রভাব, অঁদ্রে জিদ, তিনটি ফরাসি প্রবন্ধ, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ সম্পাদিত ও অনূদিত, পড়–য়া ২০০৭, ঢাকা
- লেখকের শিল্প-কৌশল, আঁদ্রে মোরোয়া, লেখার শিল্প লেখকের সংকল্প, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম ও হামীম কামরুল হক সংকলিত ও সম্পাদিত, সংবেদ ২০১১, ঢাকা
- গ্রন্থরচনা ও রচনা-রীতি, আর্থার শোপেনহাওয়ার, লেখার শিল্প লেখকের সংকল্প, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম ও হামীম কামরুল হক সংকলিত ও সম্পাদিত, সংবেদ ২০১১, ঢাকা
- সাহিত্যবিচার, সাহিত্যের পথে, রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড), ঐতিহ্য ২০০৪, ঢাকা
- সাহিত্যে কুম্ভীলকবৃত্তি, দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে, রেজাউল করিম সুমন, আর্টস বিডিনিউজ২৪ডটকম ২০০৮, ঢাকা
- ইঙ্গ-মার্কিন কবিতায় আধুনিকবাদ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, একবিংশ, ২৫ বছর পূর্তি সংখ্যা, ফেব্র“য়ারি ২০১০, ঢাকা
- কবিতাপ্রেমীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হোন, কৃশ অ্যাডামসের নোট, ফেসবুক ২০১০