Thursday, June 26, 2014

যুগপৎ পাঠকের মন ও চেতনার পড়শি

পৃথিবীর সর্বশেষ কবি
প্রথমগ্রন্থ তিন রমণীর ক্কাসিদার সূচনা কবিতা ‘প্রার্থনায় নম্র হও পাবে’র ছত্রান্তরে খোন্দকার আশরাফ হোসেন একদা ঘোষণা করেছিলেন, ‘পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি, অহংকার আমার কবিতা’। এই উচ্চারণ তাঁর পাঠকেরা মনে রেখেছেন। কিন্তু এই উচ্চকিত ঘোষণার কথা ভুলে ইতোমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন কথিত এই খাতামুন শায়ের; রেখে গেছেন ৯টি কাব্যগ্রন্থজুড়ে তাঁর বিস্তৃত শায়েরি। তাঁকে সর্বশেষ কবি হিসেবে আমাদের মানা না-মানা কোনো জরুরি বিবেচনা নয়, কারণ এ ধরনের কথার আক্ষরিক কোনো ওজন থাকে না, আমরা জানি। তবে ওই পঙক্তিসুপ্ত ইঙ্গিতকে যদি আমরা মান্য করতে চাই, তাহলে যেসব ধারণায় উপনীত হওয়া যায়, তা হলো : ১. তাঁর আগে বাংলা ও অন্য ভাষায় কবি ছিলেন, ২. বাংলা ও অন্য ভাষায় তাঁর পূবসূরি কবিদের অবদান অনস্বীকার্য, ৩. তাঁর কবিতায় সবিশেষ তারুণ্যের স্ফূরণ ঘটেছে, ইত্যাদি।

লক্ষণীয়, নতুনভাবে উত্থান ঘটে যাঁদের, লেখায় বা বলায় তাঁদের কেউ কেউ ঢালাওভাবে পূর্বসূরি কবি ও তাঁদের কাব্য-অবদানকে অস্বীকার করেন। নিদেনপক্ষে তাঁদের সিংহভাগকে হেয় করে দেখেন এবং এই ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে চান তাঁদের নিজেদের কাব্যকর্মকে। ‘কেন লিখেন’ ধরনের প্রশ্নের মুখেও কারো কারো কণ্ঠে এমন কথা ধ্বনিত হতে আমরা শুনি যে, মৃতপ্রায় কবিতাসম্ভারে নবপ্রাণ সঞ্চার করার প্রয়োজনেই তাঁরা লিখে থাকেন। এটা এক ধরনের অহংকার। নববিকশিত ও বিকাশমানদের কণ্ঠে ধ্বনিত এ ধরনের অহংভাষণকে পাঠকদের একাংশ সহজভাবে মেনে নেন। নিয়ে আশায় থাকেন নতুন সৃষ্টির। তাঁরা সবাই হতাশ করেন তা নয়। সবাই মুখ রাখতে পারেন তা-ও নয়।

এঁদের অবস্থানের থেকে নিরাপদ দূরে এক উলটোপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেন যা বলেছেন, সেটাও নিঃসন্দেহে অহংকারই। তবে এ অহংকারে পুরানোমাত্রকে অস্বীকার করা হয় নি, বরং সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। এই প্রকাশে তাঁর কাব্যপ্রবণতারই একটি শর্তের বয়ান নিহিত রয়ে গেছে। প্রাচীন রত্নসম্ভারের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেই তিনি নিজের কবিসত্তাকে গড়ে তুলেছেন। কবিতার ঐতিহ্যপরম্পরাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেজন্য প্রায়ই তাঁর কণ্ঠে বেজে উঠেছেন পূর্বসূরিরা, খণ্ডে ও সর্বাংশে। একে ঘাড় কাত করে নিন্দামন্দ করবার প্রয়াস একটা কাঁচা কাজ। সাহিত্যের ইতিহাসে এই দেওয়া-নেওয়া স্বীকৃত। সেতুসম্ভব এই যাত্রাকেই মূলের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলা বলে ধরা হয়। যেমন সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর শুরুর কবিতা ‘বেহুলা বাংলাদেশ’-এর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে স্বরে ও সরগমে আমাদের গায়ে এসে জীবনবাবুর ‘অন্ধকার’-এর আঁচ লাগতে পারে। ‘সবুজ বিষয়ক’ কবিতার পঙক্তি ‘আমার স্বদেশে সুখ্যাতি আছে সবুজের’ স্বরেও বেজে উঠতে পারে আরেক পূর্বকবির ধ্বনি। ওই স্বরে ইনিও এখানে যেন বাংলার কিংবদন্তীর কথাই বলছেন নিজস্ব ভাষায়।

বিশ্ব কবিতার সুপরিসর শস্যপ্রান্তরে তাঁর বিচরণের একাংশ পেশাতাড়িত, একাংশ নিঃসন্দেহে নেশাতাড়িত। কবি হবেন বলে। ওই বিচরণের ছাপও তাঁর কবিতায় দুর্নিরীক্ষ্য নয়। এ কথার প্রমাণ হাজির করতে তাঁর কবিতাসংগ্রহ ঘেঁটে বিস্তর নজির হাজির করবার দরকার নেই। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য এ প্রবণতার নিন্দা করা নয়। আমরা কেবল দেখাতে চাই যে, বাংলা কবিতার মতো বিশ্বকবিতার প্রাচুর্যময় ঐতিহ্যের প্রতিও তিনি উদ্বাহু ও সশ্রদ্ধ এবং ওই প্রাচুর্যের প্রতি এক ধরনের উত্তরাধিকারবোধও তাঁর ছিল। লক্ষ করলে আমরা দেখব, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর বইয়ের কয়েকটি কবিতার নামকরণও কিছু সুবিখ্যাত বিশ্বকবিতার কথা মনে রেখে করা; যেমন, টি. এস. এলিয়টের ‘দি লাভ সঙ অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রুক’-এর স্মরণে তাঁর ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’, কোলরিজের ‘দি রাইম অব দা অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’ স্মরণে তাঁর ‘বুড়ো নাবিকের প্রেমগীতি’। তিনি কবিতা লিখেছেন শেক্সপিয়ার, কীটস, জীবনানন্দ, প্রমুখকে নিয়ে। এসব তাঁর সর্বব্যাপী বিহার ও পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধারই প্রকাশ।

বিহারের এই আওতা তাঁর কবিতার জগৎকে দিয়েছে অসামান্য ব্যাপ্তি। সৌন্দর্যকে চিনিয়েছে গভীর থেকে, শিখিয়েছে শাসন করবার কলাকৌশল। দখলিস্বত্ব দিয়েছে বাংলা কবিতার একখণ্ড ফসলি ভূমির। বেদনার এই যে, লব্ধ ভূমির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে ওঠবার আগেই কর্মময় জীবনে সমাপ্তি টানতে হয়েছে বাংলা কবিতার এই সুদক্ষ চাষিকে।

তারুণ্যের সাথে আমরণ সহবাস
এ তো গেল দেশ-বিদেশের পূর্বসূরিদের কথা। সমসাময়িক ও পরবর্তী সময়ের কবিতা ও কবিদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্রটি কেমন ছিল, তাও খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে। এ খোঁজ নেবার আমাদের সহজ উপায় আছে দুটি : ১. তাঁর বিস্তৃত কাব্যসমুদ্রে জাল ফেলা, এবং ২. তারুণ্যগর্বী কবিদের সাথে তাঁর সাহিত্যিক-যোগাযোগের ধরনটি পর্যবেক্ষণ করা। প্রথমটি ক্রমপ্রকাশ্য। শিকারে নামলেই আমরা দেখব তাঁর কাব্যসমুদ্রে কেবল ঝকমক করছে তারামাছ, যা কেবল তারুণ্যকেই মানায়। ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ কুয়াশার মুশায়েরায় পাওয়া যায়, ‘মেলার হট্টগোলের মধ্যে আমি বসে বাজাই আমার এস্রাজ/ তোমার কানেই পৌঁছায় না’ কিংবা ‘আমি পাতার ঠোঙায় ঝরাফুল নিয়ে তোমার পেছনে দৌড়াই/ তুমি ততক্ষণে পেরিয়ে গিয়েছো নক্ষত্রবীথিকা’। এমন প্রেমকাতর পঙক্তি কি ৬৩ বছরের প্রৌঢ়ের মুখে মানায়, যদি না ভেতরবাড়িতে তারুণ্যের জ্বলজ্বলে আগুন থাকে? আমাদের মনে হয়, এমন পঙক্তি তখনই লিখে ওঠা যায়, যখন কবিতারাজ্যের তরুণ থেকে তরুণতর প্রতিনিধির সাম্প্রতিকতম কবিতাটিরও খোঁজ রাখা যায়; যে খোঁজ তিনি রাখতে পেরেছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়।

আমাদের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় উপায়টি অবলম্বনের জন্য প্রায় কোনো পরিশ্রমই দরকার হয় না। কেবল এই তথ্যটি জানলেই চলে যে, সত্তরের কবিতার স্লোগানমুখরতা ডিঙিয়ে আশির তৎকালীন তারুণ্যস্পর্ধী নিরীক্ষাকে স্বাগত জানাতে, তরুণপ্রাণের নবতর কাব্যপ্রয়াস ও কাব্যচিন্তনকে জায়গা করে দিতে তিনি ১৯৮৫-তে ‘একবিংশ’ নামক কবিতা ও নন্দনভাবনার কাগজটি সম্পাদনা করতে লেগেছিলেন। বিংশ শতকের শেষপাদেই কোনো কাগজের নাম ‘একবিংশ’ রাখতে পারেন তো স্বপ্নময় তরুণপ্রাণই! শুরু থেকে একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জারি রেখে কাগজটির ২৭টি সংখ্যার গৌরবদীপ্ত প্রকাশ সুসম্পন্ন করে গেছেন তিনি, যার সর্বশেষ সংখ্যাটি বেরোয় মাত্র ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। নিজের শেষ সময়ে, তাঁর ৬৩ বছর বয়সে, প্রকাশিত সর্বশেষ সংখ্যা ‘একবিংশ’-এও পুষ্পিত হয়েছে অন্য অনেকের সঙ্গে দ্বিতীয় দশকের কবিদের কবিতা, যে বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়েছিল কাগজটির সূচনা সংখ্যাতেই। সূচনা সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, “‘একবিংশ’ কেবল নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকদের জন্য নির্দিষ্ট। যারা অপ্রতিষ্ঠিত, যৌবনাবেগে টলমল, প্রতিভাবান, উদার অভিনিবিষ্ট, শ্রমী এবং নির্ভয়, আমরা তাদের জন্য পাটাতন নির্মাণ করতে চাই। কবিতা, শুধু কবিতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ক প্রবন্ধ, কবিতালোচনা, কাব্যগ্রন্থ ও কাব্য বিষয়কগ্রন্থ সমালোচনা প্রতি সংখ্যা একবিংশ-র সূচীতে থাকবে।”

তাঁর এই তারুণ্যঘনিষ্ঠতা এবং নিজের মধ্যে বাস করা স্পর্ধাকে তিনি সযত্নে লালন করতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত, সর্বশেষ সংখ্যা ‘একবিংশ’-এর সম্পাদকীয় থেকে কয়েক লাইন তুলে দিলেই তা বোধগম্য হবে বলে আশা করা যায় : ‘একবিংশ আবার বের হলো বেশ কিছুকাল গড়িমসি ক’রে। সম্পাদকের এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার কথা, তবু ক্ষমাপ্রার্থনা তাঁর ধর্ম নয়। পাঠকরা আমাদের ভালোবাসার মানুষ, তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দরকার করে না। একবিংশ খেয়ালখুশির রঙধনু; হরেক বর্ষণের পরই রঙধনু আশা করা বৃথা।’

চাইলে আরো পড়া যেতে পারে : ‘আমাদের ঢোল নেই, তাই ক্লান্তিও নেই। ঐ যে খেয়ালখুশি, ওটা যতক্ষণ থাকবে, যতক্ষণ প্রকাশ করার, কবিতাকে সঙ্গ দেয়ার, নতুনদের সঙ্গ পাবার খুশিটা মনে ওম ছড়াবে, ততক্ষণ একবিংশ-র যাত্রা স্তব্ধ হবে না। ... একবিংশ ২৭ বের হলো একঝাঁক তরুণ কবির কবিতা নিয়ে। এই সময়কার কবিতার তরুণতম প্রতিনিধি তাঁরা। তাঁদের উচ্চারণগুলো বুকে ধরতে পেরে একবিংশ গর্বিত।’

শেষ সময় পর্যন্তও যে এই সদাতরুণ ব্যক্তিত্ব নিজের কবিতাকে সতেজ রাখতে পেরেছিলেন, এই হয়ত তার গোপন ধন্বন্তরি!  

দেশ ও মানুষের মুখের দিকে চেয়ে
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ যে, তাঁর নন্দনভাবনাটি গড়ে উঠেছে কেবল ভাষা-শব্দ-ছন্দকে ঘিরে নয়, বরং মানুষ, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার বোধ থেকেও। এ বোধ থেকে তিনি তাঁর গোটা কবিজীবনেও চ্যুত হন নি। এই অবস্থানে থেকে ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও যখনই বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের গায়ে স্বাধীনতা ও দেশবিরোধীদের চক্রান্তের কলুষ লেগেছে, তখনই তিনি জেগে উঠে জানান দিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে তাঁর বিশেষ স্পর্শকাতরতা রয়েছে। তাঁর কবিতায় সে বোধের প্রত্যক্ষ রূপায়ণও ঘটেছে। যেখানে তিনি রোমান্টিক হয়ে উঠেছেন, শব্দ-ছন্দের ঘোড়ায় চড়ে বেড়িয়েছেন, সেখানেও তিনি দেশেরই একজন চেনামানুষ হয়ে থেকেছেন। কবি তাঁর ভেতরে গজিয়ে ওঠা গাছপালাকে লুকাতে পারেন না। নানা আঙ্গিকে সেসবের ডালপালা উঁকি দেয় পঙক্তিতে-পঙক্তিতে, শব্দে-শব্দে এবং শব্দ ও বাক্যের ফাঁকে। ফলত, তাঁর কবিতাভুবনে ভ্রমণে বেরোলে যেকোনো ভ্রামণিক উপলব্ধি করতে পারবেন যে, আপন অনুভবের কলসি কাত করে ঢেলে দিয়েছেন তিনি তাঁর কাব্যসমুদয়ে; এবং তা অবহেলায় নয়, প্রেমে-ভালোবাসায়। দেশের বেদনায় কেঁদেছেন, উদ্বেলিত হয়েছেন, হতাশ্বাস ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কখনোই উল্লসিত হন নি। দেশকে যখন অন্তরে ধারণ করা যায়, তখন তার প্রতি প্রেম বোঝাতে উচ্ছ্বসিত হওয়া লাগে না। সন্তানের মন্দে উদ্বিগ্ন হওয়াই যেমন তাদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ, তেমনি স্বাভাবিক মেজাজে থেকে নন্দনচিন্তা ও নন্দনপ্রয়াসের মত্ততায়ই দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রমাণিত হয়েছে। উদাহরণ-কণ্টকিত করে এ বক্তব্যের প্রমাণ হাজির করা জরুরি নয়। যেখানে তাকালেই নমুনা, সেখান আঙুল উঁচিয়ে বলার দরকার নেই যে, এদিকে বা ওদিকে তাকান। চট করে যেতে চাইলে জীবনের সমান চুমুক-এর ‘স্বাপ্নিকের মৃত্যু’, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘বেহুলা বাংলাদেশ’ ও ‘কালপূর্ণিয়া’, প্রভৃতি কবিতা পড়ে দেখা যেতে পারে। তবে এখানে এটা বলাই যথার্থ হবে যে, এমনকি তাঁর বর্ষাও দেশবিরহিত কিছু নয়।

কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার মতো গৌরবের একজন ভাগিদার। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং তাঁর সতীর্থ যোদ্ধাদের বীরকাহিনির ধারাক্রম বর্ণনা করেও তিনি কিছু কবিতা লিখেছেন, যেগুলো বাংলা কবিতার অমূল্য সম্পদ। পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘বাউসী ব্রীজ ৭১’, ‘সাহেবালি যুদ্ধে গিয়েছিলো’, ‘নোটনের জন্য শোক’; জন্মবাউল-এর ‘বধ্যভূমি থেকে’ এই ধারার কবিতা। তাঁর অন্য অনেক কবিতার মতো এসব কবিতায়ও এক ধরনের গল্পময়তা আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্ণনার গুণে এগুলো কবিতাই। যেমন সাহেবালির বর্ণনায় কবি বলছেন ‘কার চুল চরের ঝাউয়ের মতো অন্ধকারে ওড়ে?’; নোটনের বর্ণনায় পুথিকিতাবের সৌন্দর্য মাখিয়ে লিখছেন, ‘কাশেম ফিরবে বলে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে মেহেন্দি সখিনা’।

যমুনাপর্ব গ্রন্থের ‘নূরজাহান’ সিলেটে পাথর ছুড়ে মারার জঘন্য ফতোয়ার শিকার কৃষককন্যা নূরজাহানকে নিয়ে লেখা কবিতাটি একটি মাইলফলক। এখানে কোনো সাংবাদিকসুলভ ট্রিটমেন্ট লভ্য নয়। বরং বিষয়বস্তুর অন্তর্গূঢ় শক্তির সাথে শব্দপ্রতীকের সুষম মিশ্রণে এখানে তিনি তৈরি করেছেন অনন্য এক স্পর্শকাতরতা। বলেছেন, ‘ঐ মেয়ে একদিন আবাবিল হবে’। প্রকৃতই নূরজাহান তা হোক বা না হোক, তাঁর এই অভিপ্রায়টি পাঠককে এক টুকরো স্বস্তি দেয়, ফতোয়াবাজদের জনপ্রত্যাশিত ভয়ানক পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করে।

এসব বৈশিষ্ট্য পাঠকসমাজে তাঁকে এমন এক কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যিনি মানুষ ও তাদের আপামর সুখ-দুঃখঘেঁষা।

শব্দছবির মহারাজ
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের শব্দছবি আঁকার বাহাদুরি মনোমুগ্ধকর। প্রায়-কবিতায়ই তাঁর এত ছবি এদিক-ওদিক নানা দিক থেকে দেখা ও আঁকা যে, দেখতে দেখতে মনে হয় তিনি শব্দছবির মহারাজ। ছবির, শব্দছবির, কল্পছবির এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার যেন তাঁর কবিতা। এক জীবনে এত কল্পছবি এঁকে ওঠবার সক্ষমতা পাঠকের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। ৬৩ বছরের জীবনটার একটা বড়ো অংশ যে তিনি ব্যস্ত থেকেছেন নন্দনঘোরেই, বিষয়বাসনায় নয়, এসব দক্ষতা তা ভাবতে প্ররোচিত করে।
 
তিন রমণীর ক্কাসিদা-র ‘উন্মথিত নাভিমূলে জেগে ওঠে মেঘনার চর’ (‘দুর্বোধ্য নায়ক’), পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘পড়ে আছি রাজপথে ঈশ্বরের রুগ্ণ বীর্য’ (নুলো ভিখিরির গান); জীবনের সমান চুমুক-এর ‘কে যেন বিপুল ঠ্যাং ফাঁক করে আকাশ উঠোনে/ ছপছপ জলস্রাবে ডুবিয়ে ভাসিয়ে দিল/ প্রান্তর’ (হনন) বা ‘শুকনো বালির কুকুরছানারা এসে চুমু খাচ্ছে গোড়ালিতে’ (বেলাভূমিতে শেষবেলায়) বা ‘একসারি ভল্লুকের মতো ধীর পায়ে এগোচ্ছে কুয়াশা’ (নকটার্নগুচ্ছ ১); যমুনাপর্ব-এর ‘হুইসেল বাজাচ্ছে বাতাস, শালাকো পাকাড় লো--/ দৌড়ুচ্ছে বেদম ঝরাপাতা, প্রেমপত্র ঠোঙার শহর’ (চাদরের স্বৈরাচার); জন্মবাউল-এর ‘সবুজ গদ্যের বিরামচিহ্নের মতো/ জেগে আছে খোড়ো বাস্তুকলা’ (জীবনানন্দের চিল) বা ‘সকাল যখন পুচ্ছ নাচাতে নাচাতে যায় ইশকুলে’ (নীল সোয়েটার)-- আমাদের বিশেষভাবে চমকিত করে। ভাষাকে, ঘটনাকে, ঘটনার বর্ণনাকে কবিতা করে তুলবার এই সুপরিচিত কৌশলটি তিনি বেশ দক্ষতার সাথে রপ্ত করে উঠেছিলেন।

কোনো কোনো শব্দছবি তাঁর এতই ভালোলাগা ও নিজস্ব যে, ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর কবিতা থেকে কবিতায়, বই থেকে বইয়ে; যেমন তিনি যে ‘তারাদের হল্কায়ে জেকের’ শুনেন সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘তাসের খেলা’য়, তাই আবার শোনেন ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’তে। আবার ওই ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’তে যেমন দেখেন ‘শূন্য/ রাজপথে ফিগার স্কেটিং করে বাদামের খোসা’, তেমনি ‘কবিতা কোলাজ’-এর ‘অদ্ভুত’জুড়েও দেখতে পান ‘প্রান্তরের এপার থেকে ওপারে/ ফিগার-স্কেটিং করছে মেঘ’। হলকায়ে জেকেরের প্রসঙ্গ উঠে আসতে দেখি অন্য গ্রন্থগুলোতেও। যমুনাপর্ব-এ পাই : ‘আলখাল্লায় আবৃত বুজুর্গরা/ ঝিমায় আর অস্ফুট হলকায়ে জেকের গায়’ (হরতাল ৯৬); জন্মবাউল-এ পাই, ‘হলকায়ে জেকের গেয়ে ভরে তোলে কোর্টের প্রাঙ্গণ’ (শেক্সপিয়ারের দস্তানা)। এদিকে একই আলখাল্লাকে তিনি কত ঢঙে কত বিচিত্রভাবেই না ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়! জীবনের সমান চুমুক-এ পাই, ‘মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না/ না নিসর্গ না ঈশ্বরের দিগন্ত-প্রসারী আলখাল্লা/ না নদী না জন্মভূমি’ (মানুষ) বা ‘কেবল তারার উঠোনে/ জমা হচ্ছে দীর্ঘ আলখাল্লা-পরা অন্ধকার, শ্মশ্রুময় পুরুষেরা/ একাকার’ (নকটার্নগুচ্ছ ১)। এই শব্দছবির মহারাজের হাতে কবিতামাত্র রঙচঙে ও বর্ণিল হয়ে উঠেছে, তা যখন তিনি দেশের জন্য কেজো কবিতা লিখেছেন তখনো।

নারী নয়, রমণীখচিত
এটা এক অদ্ভুত আবিষ্কার যে, ‘নারী’ খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায় ব্যাপকভাবে উপস্থিত; তবে তা যতটা ‘নারী’রূপে হাজির, তার চেয়ে কম নয় ‘রমণী’ভঙ্গিতেও। অর্থাৎ তাঁর কবিতাবিশ্ব রমণীখচিত। কেন এমন? আমরা বলতে পারি না। ‘রমণী’ না থেকে যদি ‘নারী’ই উপস্থিত থাকতেন বেশি, তা-ও প্রশ্ন করা যেত, কেন এমন? তার জবাবও হতো হয়ত এই যে, আমরা জানি না। তবে ‘রমণী’স্থলে ‘নারী’ হলে আমরা যেভাবে খুশি হতে পারতাম, ‘নারী’স্থলে ‘রমণী’ থাকায় আমরা সেভাবে খানিক অখুশি। কারণ শব্দগতভাবে ‘রমণী’ ‘নারী’র যে রূপ হাজির করে, তা রমণঘনিষ্ঠ, ভোগলগ্ন। নারীর প্রকৃত মাহাত্ম্য তার রমণগুণে স্পষ্ট হয় না, হয় নারীত্বগুণে। আমরা দেখি, তিন রমণীর ক্কাসিদার ‘এলিয়েন’ কবিতায় তিনি ‘রমণী’র আমাদের জানা সংজ্ঞাই লিখেছেন, ‘রমণযোগ্যা বলে রমণী যার নাম’। তবু তাঁর কবিতা থেকে কবিতায় রমণীর সসন্দেহ উপস্থিতি : ‘দেখেছি রমণীকুল শুভ্রবেশ, করতলে জন্মান্তর-পথ/ বুক জুড়ে ধাপাল সন্তান নয়, সদ্য কেনা শাড়ির মোড়ক/ মধ্যরাত যেই নারী খুলে দেয় কারো কাছে অজানা সড়ক/ দিবাভাগে তার মুখে কি সলজ্জ পবিত্র শপথ!’ (‘সুখ তুমি সঙ্গে যাবে’, তিন রমণীর ক্কাসিদা)। পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘ফেব্রুয়ারিতে জনৈক বাগান মালিক’ কবিতায় পাই ‘আমাদের রমণীরা কোনো কালে ধর্ষিতা হয়েছে কিনা/ তাদের ভ্রূভঙ্গি দেখে হাসির ফোয়ারা দেখে/ ভুলেও পড়ে না মনে’। কেন তিনি আশা করেন যে, জীবনের সমস্ত আনন্দ-হাসি বিসর্জন দিয়ে ধর্ষিতা তার ধর্ষণের লক্ষণকে সারাজীবন কপালে ধারণ করেই ফিরবেন? করেন কারণ তিনি ভাবেন ধর্ষণকে উদযাপন করাও সম্ভব! ‘কেননা মৃত্যু আর ধর্ষণ/ ঠেকাতে না পারা গেলে উদযাপনই ভালো’ (‘আগন্তুক’, যমুনাপর্ব)। পাঠক হিসেবে আমরা বেশ আহতই হই, তাঁর এমন নারীচিত্রণে।

তবে হ্যাঁ, চোখ রাখলে দেখা যায় তাঁর রমণীরা ক্রমশ নারী হয়ে উঠেছে পরের কবিতাগুলোয়। কিন্তু তবু, অক্ষরবৃত্তে তিনমাত্রার যে চাহিদা তাঁর থেকে গিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন কখনো কখনো রমণীর নিকট-আমেজেরই জন্ম দিয়েছে; যেমন যমুনাপর্ব-এর ‘ওড টু জনাব কীটস’-এ তিনি বলছেন, ‘বিয়োবার দেরি নেই যে-সুন্দরীর’। এখানে তিনি প্রসবের কলোক্যুয়াল ‘বিয়ানো’ দিয়ে প্রসবঘটনাকে তাচ্ছিল্য করার পাশাপাশি নারীকে রমণী নয়, একেবারে সুন্দরীতে নিয়ে ঠেকিয়েছেন! এটা ঠিক যে সুন্দরী নারীরাও প্রসব করেন। তবে আমরা কী করে ভুলে যাব যে, প্রসবঘটনা এমন ঘটনা যেখানে সুন্দরী বা অসুন্দরী হওয়া কোনো আলাদা গুরুত্ব বহন করে না?

লোকায়ত বাগভঙ্গিতে ছন্দচিচিত্রা
খোন্দকার আশরাফ হোসেন আমূল বাঙালি কবি। বাংলাকে তাঁর কবিতায় নিবিড়ভাবে পাওয়া যায়। লোকমানসের অন্তরস্পর্শ করবার মতো বিষয় ও ভাষা তাঁর মধ্যে বরাবরই কম-বেশি লক্ষণীয় হলেও সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর থেকে পরের কয়েকটি গ্রন্থে লোকায়ত বাগভঙ্গিটা তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এ সময় থেকে তাঁর মধ্যে সুফি দর্শনের সরল-গভীর রূপটিও জায়গা করে নেয়।
 
তিন রমণীর ক্কাসিদা-র ‘চতুষ্পদ দর্শন’, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘বৌমাছ’, ‘যাত্রা’, ‘ধানরমণী’, যমুনাপর্ব-এর ‘কৈবর্ত্যপুরাণ’সহ অনেকানেক কবিতায় বাংলার মাঠঘাটের বিশ্বস্ত ছবি, বাঙালিয়ানার সুবাস মাখিয়ে রেখেছেন তিনি। গ্রিক ও সেমেটিক পুরাণের পাশাপাশি বাংলার লোকপুরাণেরও ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায় তাঁর কবিতায়। বাংলার লৌকিক পুরাণের অনেক চরিত্র তাঁর কবিতায় স্বরূপে হাজির হয়েছে। যমুনাপর্ব-এর ‘বাসন্তীকথা’, জন্মবাউল-এর ‘সদানন্দের পদাবলী’তে পদাবলীর ঢঙে আধুনিক চিন্তাচেতনতাকে স্থাপন করে তিনি উত্তরাধুনিক সময় যাপনের ছবি এঁকেও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পয়ারের বিভিন্ন দোলা সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে এসব কবিতায়।

তিনি প্রধানত বিচিত্রমাত্রিক অক্ষরবৃত্তেই তাঁর কাব্যালাপ সেরেছেন। তবে অন্যান্য ছন্দে লেখা কবিতাও তাঁর ভাণ্ডারে লভ্য। মাঝে মাঝে স্বরবৃত্তের ঘোড়ায় চড়েও পরিকল্পিত ভ্রমণ সেরেছেন তিনি। যেমন পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘আত্মপক্ষ’, ‘পরকীয়া দুয়ার খোলো’, জীবনের সমান চুমুক-এর ‘ঝাপুই খেলা’, অংশত ‘শ্রাবণযাপন’ সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘ঘৃণার ঘুঙুর’, অংশত ‘চিকিৎসা’, ‘কবিতা কোলাজ’-এর ‘পদাবলী’পথে যেতে আমরা নেচে উঠি, নাচতে নাচতে ফের থামি আত্মতুষ্ট হয়ে। মাত্রাবৃত্তের চমৎকার দোলাও তৈরি করেছেন পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘নীল সাবানের প্রেম’, জীবনের সমান চুমুক-এর ‘কসাই’, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘বুড়ো নাবিকের প্রেমগীতি’ প্রভৃতি কবিতায়। কারো কারো কাছে তাঁর এমন ছন্দবিচিত্রাও মনোযোগ দিয়ে কাছ থেকে দেখবার জিনিস বলে মনে হতে পারে।

উপসংহার নয়, যাত্রার শুরু
কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের জীবন ফুরিয়েছে, শুরু হয়েছে তাঁর কবিতার জীবন। কর্মীষ্ঠ মানুষের, তথা শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানীর জীবন কেবল তাঁদের দৈহিক জীবনলগ্ন নয়, কর্মলগ্নও। ফলে তাঁরা চলে গেলেও তাঁরা যে কর্ম রেখে যান, তা যদি মানুষের মধ্যে বাঁচে, তবে তার মাধ্যমে তাঁরা নিজেরাও বেঁচে থাকেন।

আমরা নিশ্চিত করতে পারি না যে, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কাব্যকর্ম পাঠকের মধ্যে বেঁচে থাকবেই। এসব ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। পাঠকের বিবেচনাই এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে যদিও, তবে তার প্রেক্ষাপটে কাজ করে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত। প্রতিকূল প্রেক্ষিতের কারণে যেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী-কবিও সাময়িকভাবে বিস্মৃত হয়ে যেতে পারেন, তেমনি আবার অনুকূল প্রেক্ষিতে দীর্ঘ বিস্মৃতির পরও কেউ কেউ নতুন করে ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে শুরু করতে পারেন। আমরা এর সম্ভাব্যতাকে কিছুটা বাজিয়ে দেখতে পারি মাত্র, যদিও তাঁর এক সম্পন্ন ধমক সয়ে, যে, ‘আমাকে বুঝতে চাও এ সাহস কবে থেকে হলো?’ (‘দুর্বোধ্য নায়ক’, তিন রমণীর ক্কাসিদা)!

আমাদের উপলব্ধি এমন যে, যেসব কবিতা কোনো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত নয়, যেসব কবিতা মানুষের নীরবতাকে, একাকিত্বকে, যাপনবিস্ময়কে শব্দ ও ধ্বনিরূপ দেয় মাত্র, তাদের কাছে পাঠকেরা উদ্দেশ্যহীনভাবে যায়। গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবেই মগ্ন হয়ে থাকে। কিন্তু যেসব কবিতা উদ্দেশ্যতাড়িতভাবে লিখিত হয়, সেসবের কাছে উপলক্ষ নিয়ে যেতে হয়, পাঠকেরা সেভাবেই যান। খোন্দকার আশরাফ হোসেনে সমানভাবে দু’রকম কবিতাই লভ্য, কোনোটাই কম বা বেশি নয়।

যেসব কবিতার কাছে যেতে প্রয়োজনতাড়িত হওয়া লাগে, গিয়ে প্রয়োজন মিটলে সটকে পড়তে হয়। আবার প্রয়োজন অনুভূত হবার আগে আর ও-মুখো হওয়া যেখানে হয়ে ওঠে না, সে ধরনের কবিতা একইসঙ্গে অমূল্য ও মূল্যহীন। যুতসই প্রয়োজনে লাগে এমন বস্তুরাজির ওপর সমাজ অপরিসীম মূল্য আরোপ করে থাকে। বৈষয়িক সমাজ বিষয়ভাবনার বাইরে আর সবকিছুকে অর্থহীন গণ্য করে, ফেলনা ভাবে; এবং তার সমুদয় পক্ষপাত জারি রাখে প্রয়োজনীয় বস্তুর প্রতি। এভাবে কেজো লেখাগুলো অমূল্য হয়ে যায়। আবার জৈবনিক প্রয়োজনে বিষয়ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকা মানুষ মাঝে মাঝে অবৈষয়িক হয়ে উঠতে চায়। মানুষমাত্রের মধ্যেই কমবেশি এ চাওয়া থাকে। যাদের মধ্যে বেশিমাত্রায় থাকে, তাদের মধ্যে যাঁরা কবিতালগ্ন, কবিতাপ্রেমিক, তাঁরা তাঁদের অবৈষয়িকতাকে মহিমান্বিত করা যায় এমন ধারার কবিতা খুঁজে ফেরেন। এ অনুসন্ধানক্রিয়া কখনোই এ ধরনের কবিতার কাছে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। কাজেই তাঁদের কাছে এ ধারার কবিতা একেবারেই মূল্যহীন। সে অনুযায়ী এ ধরনের পাঠকের তাঁর কেজো কবিতার কাছে যাবার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু তিনি এ ধারার পাঠকের উপযোগী কেবল শব্দে-ছন্দে ঘোরাচ্ছন্ন কবিতার চর্চাও করেছেন, অর্থাৎ তাঁর ভাণ্ডারে যেহেতু এদের প্রসাদও লভ্য, কাজেই ধারণা করা যায়, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতা, আখেরে, দুই মেরুর মানুষেরই যাতায়াতবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ আমাদের বিবেচনায়, পাঠক পরিসরে তাঁর টিকে থাকার সম্ভাবনা, প্রকটতর।

যাই হোক, কোনোরূপ ভালোমন্দের উদাহরণ হিসেবে নয়, কোনো পাদটীকা যুক্ত না-করেই, এমনি এমনি, তাঁর ছোট্ট একটি কবিতা পড়ে আমরা আমাদের এ কিস্তির কথাবার্তা শেষ করতে চাই। ‘ভূয়োদর্শন’ নামের এই কবিতাটি তাঁর জন্মবাউল বই থেকে নেয়া :

দুঃখ হলো এক গিটার যে বাদকের আঙুল কেটে
নিজের তারের ধার পরীক্ষা করে;
সুখ এমন বাড়িঅলা, ঘর খালি নেই তবু টু লেট
নামায় না; দুঃসময় এমন বিরাট গেট
যার ভেতর দিয়ে দেখা যায় বন্ধুর আসল মুখ;
আর প্রেম হলো এমন বালিশ, মাঝেমধ্যে
যাকে খাওয়াতে হয় রোদের আদর, না হলে
দুর্গন্ধ ছোটে; আর বিরহ একটি ফেলে-যাওয়া সুটকেস
যার চাবি চলে গেছে মালিকের সাথে, ডুপ্লিকেট নেই।

বৌ হলো আপনার পুরনো অ্যাকাউন্ট, প্রতিবার
টাকা উঠাতে ঝামেলা হয়, কেননা স্বাক্ষর মেলে না; আর
আপনার সন্তানেরা? আপনার কবরের দূরত্বমাপক :
এমন পথিকের পায়ের ছাপ যাকে বাঘে নিয়ে গেছে॥

রচনাকাল : অক্টোবর ২০১৩।  সরকার আশরাফ সম্পাদিত 'নিসর্গ'-এর খোন্দকার আশরাফ হোসেন সংখ্যায় ফেব্রুয়ারি ২০১৪-এ প্রকাশিত।

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...