জেতা মৎস্য গিলে বকে মনুষ্য খায় বাঘ-ভালুকে
রহস্য বোঝে না লোকে কেবল বলে জয়।
দীন দ্বিজদাস, জনপদাবলি, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত
জীবন মানে কেবল নিয়মিত আহার গ্রহণ, তদসাপেক্ষে বর্জ্যত্যাগ ও নিয়মিত প্রজনন ক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া নয়। এরকম স্থূল জীবনকে মহিমা দিতে রুচিতে বাধে। সূক্ষ্মতার ভিতর দিয়েই জীবন মহিমামণ্ডিত হয়ে ওঠে। যে জীবনে খাওয়া-পরা-ভোগের অধিক মগ্নতা নেই, সে জীবন আমাদের কাম্য নয়। সূক্ষ্মতার দিকে তাক করা এই যে প্রত্যাশিত জীবন, এরও অবশ্য গোপন এক নির্ভরতা আছে খাওয়া ক্রিয়াটার ওপর।
একটা বয়সে, কৈশোরে, যখন প্রথম বুঝতে শিখেছিলাম যে, জীবজগৎ সচল থাকার মূলে রয়ে গেছে নিরবচ্ছিন্ন খাদ্যচক্রের ভিতর দিয়ে শক্তির স্থানান্তর প্রক্রিয়া, তখন হঠাৎই একটা পরিবর্তন টের পেয়েছিলাম দেহে-মনে। কেননা তখনই জানতে পেরেছিলাম যে সমস্ত সূক্ষ্মতাই স্থূলতানির্ভর। কিন্তু বরাবরই খানাপিনারূপ স্থূলতা শিল্পের জগৎ থেকে কম-বেশি নির্বাসিত থেকেছে। এই স্থূলতা নিয়ে একটিও সচেতন বাক্য রচনা করেন নি বা আঁচড় কাটেন নি অনেক লেখক-শিল্পী, যেমন রবীন্দ্রনাথ।
আমরা জানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানির মাধ্যমে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে গাছের সবুজ পাতার ক্লোরোফিল গ্লুকোজ নামক চিনি উৎপাদন করে, যে চিনিশক্তি গাছের খাদ্য। গাছের পাতা-ফুল-ফল খেয়ে সেখান থেকে শক্তি আহরণ করে ক্ষুদ্র পতঙ্গকুল। ওই পতঙ্গ যখন জলের ওপরে ভাসে তখন কোনো ক্ষুদ্র মাছ তাকে টুক করে গিলে নেয়। ক্ষুদ্র মাছকে পরে খায় অপেক্ষাকৃত বড়ো কোনো মাছ। ওই বড়ো মাছ হয়ত পরে খাদ্য হয় কোনো বিশাল আকৃতির জলজীব বা মাছের। কোনো মৎস্যশিকারির মধ্যস্থতায় বিশাল মাছটি ধৃত হয়ে চলে আসে মানুষের খাবার টেবিলে। এই মানুষই আবার কখনো-বা বাঘ-ভালুকের খাদ্য হয় কিংবা কোনো জলজীবের। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তার দেহ মাটিতে মিশে যায়। বেঁচে থাকতে মানুষটি যত শক্তি সঞ্চয় করেছিল সব শুষে নেয় মাটি। শিকড়ের মাধ্যমে ওই শক্তি আবার শুষে নেয় বিভিন্ন গাছপালা। বাঁচার প্রয়োজনে গাছপালার গ্লুকোজ উৎপাদন অব্যাহত থাকে।
এই চক্রটি পুরোপুরি উপলব্ধিতে আসার মাধ্যমে সহসাই আমার বোধবুদ্ধিটা একটা দার্শনিক পরিণতিতে চড়ে বসে যেন। প্রাকৃতিক সবকিছুর পরস্পরনির্ভরতা-বিষয়ক এক গূঢ় সত্যের বিশাল দরজা যেন উন্মুক্ত হয়ে যায় আমার সামনে। ভাবনাচিন্তা বিশেষ একটা ব্যাপ্তি পায়। তাহলে ব্যাপার এই, যে, জীবমাত্রই অন্য কারো খাদ্যে পরিণত হবার জন্য নিজেও খাদ্যসন্ধানে ব্যাপৃত থাকে অহর্নিশি!
এই অতিশয় স্থূল ও চক্রক্রমিক খাদ্যগীতির পাশে সুকুমারবৃত্তি নামধেয় ব্যাপারস্যাপার, তথা শিল্পসাহিত্যসংগীতনৃত্যঅভিনয়— এসব কি ওই খাদ্যকল্পেরই অন্য রূপারূপ তবে? গুহাগাত্রে শিকারছবি এঁকে, বর্ণেশব্দে যাপনবিদ্যার তেলনুনছবি ধরে, কর্মের লাগোয়া সুরধুন তুলে, আহরণমুদ্রায় শরীর বিক্ষেপণ করে, যাপনচর্যার বিবিধার্থক রূপায়ণ ছলে মানুষ আসলে কীসের প্রমাণ রক্ষা ও প্রলম্বিত করে এসেছে যুগ যুগ ধরে? এসব কি এক অর্থে খাদ্য হয়ে ওঠা ও খাদ্য খুঁজে ফেরারই নন্দনতারিফ নয়?
বিজ্ঞানীরা ইকোসিস্টেম বা প্রতিবেশব্যবস্থায় জড়ে-জড়ে, জীবে-জীবে এবং জড়ে-জীবে বা জীবে-জড়ে অত্যাবশ্যক সম্পর্কের আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক সকল কিছুই পরস্পরের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয়। কিন্তু শিল্পসাহিত্যসংগীতনৃত্যঅভিনয় প্রাকৃতিক নয়, মনুষ্যসৃষ্ট। এসবে আশ্রিত যে কলার ধারণা তা জড়ও নয়, জীবও নয়। প্রতিবেশব্যবস্থায় এর স্থান তাহলে কোথায়? এতদিন ধরে এর কোনো জবাবই আমার আয়ত্তে ছিল না। সম্প্রতি এর একটি সম্পর্কসূত্র বা বিহিত আমি খুঁজে পেয়েছি বলে মনে হয়, যখন বুঝতে শিখেছি যে, মানুষ তার বিস্তৃত পরিপার্শ্বে ক্রমশই তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর হয়ে উঠতে থাকে। মানুষের চারপাশের আপাত সীমিত যে পরিসর, যাকে মনে হয় যে এইই শেষ, এর সবটা জানা হলেই জানা হয়ে যাবে গোটাটা, তা আসলে ঠিক নয়। বস্তুত দিন দিনই পরিসরটি প্রসারিত হতে থাকে। যত দ্রুত জানাশোনার প্রসার ঘটে, তার চেয়ে দ্রুত প্রসারিত হয় নতুন নতুন পরিসর। তাতে কেবলই বোধ হতে থাকে যে, আমাদের জানাবোঝা অতিশয় তুচ্ছতর। তো, ওই তুচ্ছ আলোর প্রক্ষেপণে একান্তে যা ধরা পড়ে, তাতে মনে হয়, এই যত কলাকাণ্ড এরও নির্দিষ্ট ভোক্তাশ্রেণি থাকে, যারা এগুলো খায়। গলাধঃকরণ করে না বটে তবে খায়, উপভোগ করে। অন্যদের মতো কলাকার নিজেও একজন কলাভোক্তা। তাদের এগুলো আসকালসন্ধ্যার ভোগে লাগে। সেই আবার খাদ্য খুঁজে ফেরা, খাওয়া। খাওয়ার ভিতর দিয়ে জীবনীশক্তি, শৈলীপ্রণোদনা, জীবনসত্য ও আবিষ্কারোচ্ছ্বাস লাভ, অবলম্বন খুঁজে পেয়ে ঝুলে পড়া।
উলটোভাবে বিচিত্ররূপ কলারাও কলাকারকে খায়। অর্থাৎ কলাকারের নিজস্ব অনেককিছুর নিঃশর্ত সমর্পণের মাধ্যমেই কলা সৃজিত হয়, কলাবিদ্যা অর্জিত হয়। কলা একে একে কলাকারের সময় খায়, ঘুম খায়, স্বস্তি খায়, তৃপ্তি খায়, সম্পর্ক ও সামাজিকতা খায়, শান্তি খায়; সবিশেষ দেহটা খায়, একেবারে খেয়ে ফেলে। যেমন কাব্যকলা খেয়েছে জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান, সাবদার সিদ্দিকী, ফাল্গুনী রায়, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুনীল সাইফুল্লাহ, শামীম কবীর, আপন মাহমুদ প্রমুখকে। কলা ও কলাকারের মধ্যকার এই সম্পর্ক জড়-জীব বা জীব-জড়বোধক। অনেকটা উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড চক্রের মতোই যেন। উদ্ভিদ অক্সিজেন দেবে প্রাণী নেবে, প্রাণী কার্বন-ডাই-অক্সাইড দেবে উদ্ভিদ নেবে। এই দেওয়া-নেওয়াই জীবনবায়ুর উদ্গাতা বোধকরি।
এটুকুই মাত্র আমার বিবেচনা, যে বিবেচনায় আমি বলতে চাই যে কলারও স্থান আছে খাদ্যচক্রে, অতএব ইকোসিস্টেমে। সকল কালের সকল কলার কাজেই অস্তিত্বশীল থাকতে হয়, নতুন নতুন কলাবস্তু ও কলাধারণা সৃজিত হতে হয়। তা না হলে তৈরি হয় ভারসাম্যহীনতার হাহাকার, যে ভারসাম্য কৈলিক ও সাংস্কৃতিক।
এহেন ভারসাম্য রক্ষার্থেই আমি কলাসৃজনে প্রবৃত্ত হই, লিখি— আরো ভেঙে বললে জবাবটি অন্যরকম শোনাবে। সমস্ত বিস্তারণই কেননা আব্রুহীন, সমস্ত স্বচ্ছতাই কেননা রহস্যহীন। আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছি আমি, নানা ছুঁতোয়। দেখেছি যে, জবাব বারবার বদলে গেছে। একই সওয়ালের জবাবে একেক বয়সে দেখেছি একেকরকম উত্তরদান প্রয়াস। এখন মনে হয়— আমার কিছু দৃশ্য, ঘটনা ও কার্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবার থাকে, যারা কারণসমূহের সাথে মিলিত হবার ইচ্ছেয় বহুকাল ধরে অপেক্ষায় আছে। আমার কিছু আনন্দ-বেদনা-ক্রোধ থাকে, যা সহস্রজনের আনন্দ-বেদনা-ক্রোধের থেকে আলাদা অথবা আলাদা নয়, যেসব বিষয়ে অনেকেই কোনোদিন কিছু ভেবে ওঠেন নি। আমার সবসময়ই কিছু কথা বানিয়ে বলবার থাকে, যা সত্যমিথ্যানিরপেক্ষ, লিখবার পরে প্রায়শ যেগুলোকে সত্যের পড়শির মতো মনে হয়। আমার কিছু তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করবার থাকে, যেদিকে মনোযোগদান প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্যে জরুরি বোধকরি। এ ছাড়াও, যাপনযুদ্ধের বিভিন্ন পর্বে জড়-জড়, জীব-জীব এবং জড়-জীবের অনেক সম্পর্ক আমার কাছে নতুন করে প্রতিভাত হয়। ওই আবিষ্কার চিহ্নগুলো আমি ধরে রাখতে চাই, চিন্তার পরবর্তী পরম্পরার কথা ভেবে। আমার লেখনচেষ্টার নেপথ্যে সুপ্ত মূল কারণের বিভাজিত রূপ মূলত এই।
আমি না করলেও এই কাজগুলো অন্য কেউ তার মতো করে করবে। কিন্তু আমার মতো করে করা কেবল আমার পক্ষেই সম্ভব। দেখার ও লেখার প্রত্যেক লেখকেরই কমবেশি স্বতন্ত্র ভঙ্গি থাকে। থাকাটা জরুরিও। আমি দাবি করি যে, আমারও তা আছে। আর আছে বলেই ওই স্বাতন্ত্র্যটুকু বাংলা লেখন-বৈচিত্র্যের ভাণ্ডারে আমি যুক্ত করে যেতে চাই। তাতে বাংলাসাহিত্যের সমৃদ্ধি না এলেও বাংলা ভাষার সম্ভাবনাটি কিছু দৃষ্টান্ত লাভ করবে, নিঃসন্দেহে।
দুই.
এই মর্মে একটি রুশ প্রবাদ আছে যে, “সে কোনো মুক্ত মানুষই নয়, যে কখনো ‘কিছুই না’ করে না”। এই প্রবাদোক্ত ‘কিছুই না’ করা ব্যাপারটা অত সহজ নয়, যেহেতু জীবন মানুষকে সবসময় কোনো-না-কোনো ‘কিছু’র মধ্যেই থাকতে বাধ্য করতে চায়।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে অবশ্য অর্থকরী কাজ না-করাকেই ‘কিছুই না’ করা ভাবা হয়। গার্হস্থ্য ও প্রজনন কর্মভারে পীড়িত আমাদের নারীসমাজ ওই উদ্দেশ্যমূলক ভাবনার প্রত্যক্ষ শিকার। কিন্তু প্রবাদোক্ত ‘কিছুই না’ করা একেবারেই অন্য জিনিস। প্রস্তাবিত ‘কিছুই না’র সঙ্গে লিঙ্গশোষণমূলক ব্যাপারস্যাপারের কোনো সংস্রব নেই, সংস্রব আছে অন্তর্গত মুক্তি ও পূর্ণাবসরের। এই মুক্তি কেবল বাহ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দায় থেকে নয়, বরং ভেতরগত চিন্তনভার থেকেও। ‘কিছুই না’ কাজেই দেহে-মনে পরম এক শূন্যময়তার আর্তিসমগ্রতায় সমর্পিত হওয়া।
চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়াকে আমার মাঝেসাঝে মূর্তিমান এক অভিশাপ বলে মনে হয়। জন্মাতাম যদি কাঠবিড়ালি কিংবা নিদেনপক্ষে ঝুঁটিশালিক হয়ে, একমনে খাদ্যাহরণ ও কামোদযাপনে পার হয়ে যেতে পারত একটা জীবন। কিন্তু মানুষ হয়ে রীতিমতো ফেঁসে গেছি। অভিশাপদগ্ধ এই মনুষ্যজন্ম আমাকে প্রায়ই ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের ভবিষ্যযাপনচিন্তার গর্তের মুখে ঠেলে দেয়। ক্বচিৎ কখনো উৎফুল্ল হলেও প্রায়শই হতাশায় ডুবে যেতে হয়। এর মধ্যেও সৌন্দর্যলিপ্সা জাগে। রক্তমাংসের তাড়নায় ভুগি। তদুপরি কিছু মানুষের কাণ্ডকীর্তিদৃষ্টে জগৎসাধন ব্যাপারে বিবমিষা জাগে। কখনো-বা ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উঠি। আগাগোড়াই নিষ্ফল যদিও।
এই প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রতিটিই দেহ-মনকে সতত ব্যস্ত রাখে। আর নানারূপ অনুভূতির জন্ম হতে থাকে। তাতে বেজায় ভার বোধ হয়। যাপনস্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে ওই ভার মাথা থেকে নামিয়ে ফেলবার দরকার হয়। নইলে স্বস্তি মেলে না।
আমার কবিতা করা, ভেবে দেখেছি, কণ্টকাকীর্ণ বিচিত্র ওই অনুভূতিভার খালাস করে মস্তিষ্ককে খালি করবার প্রয়াস থেকেই জাত। শুরুতে ফেনা ফেনা গাদ ওঠে। গাদ সরে গেলে একসময় ঝিলকে ওঠে পরম শূন্যের কাছাকাছি অঞ্চলে চরে বেড়ানো নিখাদ মেঘপুঞ্জের মতো শ্বেতশুভ্র হাতি-ঘোড়া, পরাহ্ণমনের আলো ঠিকরে পড়লে যাতে লালাভার উচ্ছ্বাস জাগে। ওই মেঘানুভূতিমালার শব্দ-বাক্যকৃত অনুবাদই আমার কবিতা।
কবিতা না-করে অন্য কোনো নিরর্থকতায় সমর্পিত হয়েও এ বাবদে নির্ভার হওয়া যায় না তেমন নয়। হওয়া যায়। হইও। কিন্তু শূন্যময়তার সন্ধানে ‘কিছুই না’ করার দিকে যাত্রার মাধ্যম হিসেবে কবিতাকেই আমার সবচেয়ে মোক্ষম অবলম্বন বলে মনে হয়।
তিন.
কবিতা বিষয়ে কিছু লেখা বা বলার চেয়ে একটি কবিতা লেখা বরং অনেক নিরাপদ। অবশ্য এরকম কোনো বাক্য এক্ষেত্রে বলা চলেই না যে এটি ওটির চেয়ে সহজ বা কঠিন, কিংবা ওটির চেয়ে এটি। যিনি যখন যেটা লিখেন, তখন তিনিই কেবল সেটার সারল্য-কাঠিন্য আন্দাজ করতে পারেন, অন্য কেউ নন। আমার কাছে দুটোই সহজ, যখন লিখি। লেখা হয়ে গেলে মনে হয় জব্বর জটিল এক সাঁকো পার হয়ে এলাম বুঝি! কী করে সাধন করলাম এই অসাধ্যকে? নিজেকে বেশ সফল মানুষ মনে হয় তখন। যখন সে লেখা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে যাবার প্রসঙ্গ আসে, অর্থাৎ পঠিত বা মুদ্রিত হবার কথা, তখন আবার অন্যরকম লাগে। মনে হয় এটা হয় নি কিছুই আর ওটা হাস্যকররকম বাজে হয়েছে, ইত্যাদি। দাঁড়াল কী তাহলে? এই কি নয় যে কবিতা বিষয়ে আমি যা ভাবি, কবিতাকর্মী হিসেবে প্রায়শই আমি তা করে উঠতে পারি না, কিংবা, আমার নিজস্ব কবিতাধারণাও ফ্রিকোয়েন্টলি বদলে বদলে যায়! অতএব এটা বলা যায় যে, আমার কবিতা সবসময় আমার পুরোপুরি প্রতিনিধিত্ব করে না। সে হিসেবে কবিতা থেকে আমার শত হস্ত দূরে থাকাই স্বাস্থ্যসম্মত! কিন্তু তবু লিখতে বসে যাই অধরা অদৃশ্যকে ধরতে, যা ধরা গেলে বলা যাবে যে এটি বা এগুলো আমার প্রকৃষ্ট প্রতিনিধি। কিন্তু হায়! প্রান্তরজুড়ে যথেচ্ছ দাপাদাপি করেও অধরা শেষপর্যন্ত অধরাই থেকে যায়।
একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে সর্বত্রই আমি স্বাধীনতার চর্চা করতে ভালোবাসি। লেখালেখিতেও। যখনই স্বাধীনেচ্ছা বিঘ্নিত হবার উপক্রম হয়েছে, তখনই আমার গতিমুখ বদলে নিয়েছি। এখনো তাই করি। সৃজনের প্রয়োজনে কারোর এঁকে দেওয়া নকশামতো কিংবা অগ্রজের পদচ্ছাপ দেখে পা ফেলানো আমার পছন্দ নয়। ওই হাঁটায় অনুকারিতা যতটা আছে, আবিষ্কারানন্দ ততটা নেই। এজন্য কেউই আমাকে শিষ্য ভেবে স্বস্তি পান নি, আমিও পাই নি গুরু ভেবে। নিজের মতো করে দিকবিদিক হাঁটি, মানুষ, লভ্য প্রাণীকুল ও উদ্ভিদের সঙ্গে মেলামেশা করি, দেখি ও শিখি। এই বিরল যাত্রাভিজ্ঞতার ফাঁক-ফোকরগুলো, ইমাজিনেশনের নরম পুডিং লাগিয়ে ভরে তুলে তার সাথে সহনীয় মাত্রায় মনের রং মিশিয়ে নিজের ভাষায় যতটা কুলোয় লিখে ফেলতে চেষ্টা করি। এদের কোনো-কোনোটিকে জন্মক্ষণ থেকেই সম্পন্ন হয়ে উঠতে দেখা যায়, কোনোটিকে খুব নিঃস্ব দেখায়। ঝরঝরে হয়ে উঠতে যতদিন লাগে, ততদিন এদের আগলে থাকি। চুল-নোখ কেটে দেই, জামাকাপড় ও কাজল-সুর্মা পরাই, হাগু-মুতু সাফ করি, গোসল দেই। শেষোক্তদের প্রতি মায়াটা একটু বেশিই জন্মে, এজন্য সঙ্গও বেশি পায় তারা, অটিস্টিক শিশুর মতো।
সকল মানুষেরই বিচিত্র যাপনাভিজ্ঞতা আছে, কল্পন-সক্ষমতা আছে। আছে অনুভূতি প্রকাশের ভাষা ও মনে ছড়ানো বিচিত্র রং। অথচ সবাই কবিতা লিখেন না। কেন লিখেন না? কারণ তারা হয়ত কবিতা জিনিসটা পছন্দই করেন না বা লিখে আনন্দ পান না বা লিখতে পারেন না বা এটাকে নিতান্ত পণ্ডশ্রম মনে করেন, ইত্যাদি। স্পষ্ট যে, আমি কবিতা লিখি ঠিক এসবের উলটো কারণে। কবিতা জিনিসটা আমার খুব পছন্দ, এটি লিখে বিস্তর আনন্দ পাই এবং লিখতে পারিও। কবিতা লেখাকে কখনোই আমার কাছে পণ্ডশ্রম মনে হয় না। এই-ই সার। এর বাইরে ‘কবিতা না-লিখলে আমি বাঁচব না’, ‘আমি তো লিখি না, কবিতাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়’ বা ‘আমার কবিতা দূর আকাশ থেকে নাজেল হয়’, ‘লিখি সমাজ বদলের জন্য’; কবিতা লেখা নিয়ে ইত্যাদি কথাবার্তার সর্বৈব ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয় আমার। এই লৌকিক কাজটিকে যারা অতিলৌকিক বা অলৌকিক মহিমা দিতে চান, তাদের প্রতি একটা বড়োসড়ো সন্দেহ জিইয়ে রেখেই অধরাপ্রান্তরে আমার শিকারাভিযান আমি অব্যাহত রেখে চলেছি।
চার.
কবিতা একইসঙ্গে কবিতাকর্মী ও পাঠকের দিক থেকে একাকিত্ব উদযাপনের অন্যতম ভাষিক শিল্পমাধ্যম। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যেহেতু একা, কাজেই কবিতা অবিকল্প মানব সমাজে।
আবার মানুষ যেহেতু সমাজে বাস করে, কাজেই সে জীব হিসেবে সামাজিক, একজন সামাজিক জীবের প্রয়োজন মোটানোর যোগ্যতায় যে কোনো নিম্নকণ্ঠ ও অন্তর্গত বয়ানঋদ্ধ কবিতাও শেষ বিচারে সামাজিক। এর মানে হলো কবিতামাত্রই সামাজিক কবিতা।
এরূপ বৃহদার্থে কবিতার সামাজিক হওয়া আর সরাসরি সমাজ পরিবর্তনের মানসে লিখিত কবিতার সামাজিক পরিচিতি অবশ্যই আলাদা ব্যাপার; কবিতা দুটোই, কিন্তু সব কবিতা সবার জন্য নয়।
কবিতাকে আমরা দেখেছি নানারকম দায়িত্ব পালন করতে— আত্মসত্তার অনুসন্ধান থেকে শুরু করে জাতীয়তার চেতনা নির্মাণ ও তার মেরামত, সংকট মুহূর্তে সংগ্রামের প্রেরণা ও সাহস সঞ্চারণ, বিপ্লবের ভাষিক প্রণোদনা জোগানো, শত্রুমিত্রজ্ঞান ঝালাইকরণ, লৌকিক পুরাণকে প্রবহমাণ রাখা, অপ্রাপ্তি-বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাণীরূপ প্রণোদনা বিলানো, ভাষাচিন্তার নমুনাগ্রন্থন, বিশৃঙ্খল যাপনের ডায়েরি সংরক্ষণ, মানসপ্রান্তরে সবজিচাষ, পাগলামির ডকুমেন্টেশন, নশ্বরদেহের অধীন অন্তঃকরণের স্বপ্নাদ্য রূপরেখার মমিকরণ, নানামাত্রিক প্রেমের জয়গান ও প্রেমোৎপাদন, প্রকৃতির রূপের নকলনবিশিকরণ, ইত্যাকার কাজবাজ সামলে আমাদের কবিতা ধারণ করেছে বিচিত্র অবয়ব ও বহুবাচনিক মর্মবেদনা।
এসব দায়িত্ব আমাদের নতুন কবিতার জন্য অবশ্যপালনীয় নয়, আমরা হয়ত এর কোনো-কোনোটা করি বা করি না, কোনো-কোনোটা করব বা করব না; কিন্তু স্বীকার করি ও করব যে এর সবকটাই কবিতার কাজ।
অন্য কোনো কোনো শিল্পমাধ্যম এসব দায়িত্বের কোনো-কোনোটা এর চেয়ে ভালোভাবে পালন করতে পারে ও করে, কিন্তু উৎপাদনরীতি ও ব্যবহারে তা আলাদা। কবিতার কায়দা অনেকখানি গেরিলা ধরনের। সমাজচোখকে ফাঁকি দিয়ে এমনসব জায়গায় কবিতা প্রবেশ করে, যেখানে অন্য মাধ্যম যায় না বা যেতে পারে না। কবিতাই আমাদের চিনিয়েছে শিশিরের ঘ্রাণ ও জলের অভিমান, পর্বতের ঋতুস্রাব ও ঘুমের যৌবন, যোনির কূটনীতি ও লিঙ্গনামাজ। এ জানা ভীষণ জানা, এ জ্ঞানকাণ্ডে ভ্রমণ বিষয়সাফল্য দেয় না ঠিক, কিন্তু দেয় সূক্ষ্মতার জগৎমন্দিরে ঢুকে যাপনকে বুঝে নেবার একচ্ছত্র ধ্যানগরিমা।
নিষ্ঠকবির যে শব্দসাধন, যে নৈশঃব্দ্যবাদন, তার উৎপাদন যত তুচ্ছই হোক, কবির কাছে তা অশেষ মূল্যবান; একজীবনে ওই মূল্যমান পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে কখনো উপলব্ধ না-হলেও।
পাঁচ.
আওয়াজবহুল শব্দ দিয়ে নৈঃশব্দ্যকে ধরবার যে কৌশল, যার কোনো বস্তুগত রূপ নেই, তার দিকে ডিঙি বেয়ে যেতে যেতে পথের যেসব বেদনের সাথে দেখা হয়, সেসবের নিরাবয়ব অস্তিত্বের সাথে নিজের বেদনকাশি মিলিয়ে-মিশিয়ে নিলে একটা শান্তি শান্তি অনুভূতি হয়, ওকে পুরোপুরি পাবার জন্যই নিশিবল্কলে একটা নির্ঘুম জীবন ভাব-আঠায় সেঁটে দিয়ে অবিরাম হাল বেয়ে যাওয়া
আশ্চর্য এক প্রাসাদসুখ চূড়ান্তমঞ্জিল ওই ভিখারিপল্লিতে, যারা জানল না অনুভূতিময় ওই যাপনকাহিনি, তাদের দিক থেকে আসা অবজ্ঞার ঢিল গিলে অদৃশ্যকে দৃশ্যের সাথে বাঁধাবাঁধির স্বতোচ্ছল প্রয়াসেই এত সব আয়োজন, যন্ত্রণা-আফিম সেবে ঝিম মেরে থাকা
কী হয় এই বাঁধাবাঁধি দিয়ে, সে প্রশ্নে চোখ কচলালে শত-সহস্র বছর ধরে জীবিত অজস্রাজস্র কথার বাগানে ফোটা ফুলটুল দৃশ্যমানতা পায়, যারা অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে নন্দনশাসন, বিরল সব আবিষ্কার, অবিকল্প সব উপলব্ধি, মিথ্যা দিয়ে লেপাপোছা জীবন ও সমাজসত্য ওই তাকে জড়ো হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে অফুরন্ত বিভা
অত্যাশ্চর্য মনছবি-নির্মিত অনায়াসলব্ধ ওই আনন্দবিতানের সুগন্ধে মগ্ন হয়ে লোভ-মোহ ত্যাগ করে লতাঝাড়ের মতো প্রত্যন্তে বেড়ে ওঠার মোহন মধুরতা আমি টের পেয়ে গেছি, কথার না হবে যদি, কার তবে এসব মহিমা, যেই দিকে ফিরে ফিরে যায় পৃথিবীর বাছাই মানুষ
ছয়.
ব্যক্তিকবির জীবন নিষ্কাশিত হয়ে নেমে আসা অনুভূতিচূর্ণ যদি নানা আভরণের সংস্রবে অথবা সংস্রব বর্জন করে এমন কোনো দশাপ্রাপ্ত হয়, যা কবির অভিজ্ঞতাবাহিত অর্জন ছুঁয়ে বদলে যাওয়া ভাষার সহায়তায় প্রসারিত অর্থের শক্তি নিয়ে মনোহারী সৌন্দর্য অর্জন করে, তবে তাকে আমরা কবিতা বলবার অবকাশ পাই। এই রূপ বা সৌন্দর্যের নতুন হওয়া আবশ্যক হয়, যা অন্য কারো অনুকারবৃত্তির দ্বারা অর্জিত নয়, যা এই প্রথম জন্ম নিল মহাশূন্যতার উদর চিড়ে-ফেড়ে। কবিতা সেই চূড়ান্ত অবস্থা, যা অনুভূতিচূর্ণের মিশেলে অনাস্বাদিতপূর্ব এক আস্বাদআঞ্জাম সংগঠিত করে রাখে, যার নিবিড় সংস্পর্শ পাঠকচিত্তে ঘটায় তীব্র সংক্রমণ, দ্রুত কিংবা ধীরে। এটা আবশ্যিক নয় যে এই সংক্রমণকে সর্বদা মধুরই হতে হয়, তা এমনকি বিষাদ-বেদনা-যন্ত্রণার কিংবা বিস্ময়-স্তব্ধতা-মূর্ছনারও হতে পারে। তবে সবই এর আনন্দপ্রদ।
সন্দেহ কী যে, কবিতা পাঠকমনকে শিক্ষিত করে, সঞ্চারিত করে। কিন্তু এ শিক্ষা কখনোই বেত্রাঘাতোৎপাদিত ও উৎসারিত নয়, বরং স্বতোৎসারিত। এ পরীক্ষা পাসের নিশ্চয়তা দেয় না, এমনকি দেয় না করে-কেটে খাবারও সুযোগ। এ শিক্ষা কেবলই সৌন্দর্য চেনায়, দেয় সৌন্দর্যের ঘোরে বাস করবার গলিঘুপচির সন্ধান। যিনি এ শিক্ষার আস্বাদ জানেন, তিনি বহুপথ হেঁটেও তার কাছে যান, চোখের দিকে চেয়ে চুপটি করে বসে থাকেন, কখনোবা ভাঁজ খুলে দেখেন, চকিতে ওঠেন শব্দ করেও। পাঠকমহান নির্দিষ্ট কবিতার কাছে গিয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন (লোকদেখানো ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিক্রিয়ার কথা আলাদা), তার সম্পূর্ণটা কবিতা বা কবি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তা নির্ধারিত হয় নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থায় নির্দিষ্ট পাঠকের সাথে ওই কবিতার যে যোগাযোগটি স্থাপিত হয়েছে, তাকে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার সাথে কীভাবে মিলিয়ে নিতে পারলেন না-পারলেন তার সাপেক্ষে। এই যোগাযোগটিও আবার নির্ভর করে কোন নির্দিষ্ট ও বিশেষ শ্রেণির শিল্পরূপের প্রতি তাঁর আগ্রহ বা অনাগ্রহ আছে তার ওপর।
প্রশ্নটা তাহলে ঠেকছে গিয়ে সৌন্দর্যে, যা পাঠককে আক্রান্ত করে। সৌন্দর্য ভোক্তার চিত্তাভ্যন্তরভাগে সংঘটিত ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলজাত একটা উপলব্ধি। কোনো শিল্পবস্তু ইন্দ্রিয়-সুখকর হলে এবং বুদ্ধিবৃত্তির খোরাক জোগালে তা ভোক্তার মধ্যে এই উপলব্ধির জন্ম দিতে পারে। সৌন্দর্যের এ ধরনের উপলব্ধি মনোমুগ্ধকর। সৌন্দর্যের অনুভূতিটা জন্মায় এ কারণে যে, এর দ্বারা পাঠক নতুন এক ভাষাসত্যের সামনে দাঁড়ান, যা তাঁকে ভাবায় ও তৃপ্ত করে। এর ফলে ঘটে তাঁর চৈতন্যের বহুস্তরিক উন্মোচন। এ প্রক্রিয়ায় তা আর কেবল আনন্দ থাকে না, ধারণ করে ওঠে আনন্দ ও উপযোগিতার এক সমন্বিত রূপ। যেজন্য মানুষ শিল্পবস্তুর কাছে যায়, বারবার ফিরে ফিরে যায়।
সাত.
কবিতা প্রতিবেদন নয়; প্রতিবেদন তথ্যজ্ঞাপক আর কবিতা অনুভূতিজ্ঞাপক। মহান পাঠক কবির দেওয়া তথ্য নয়, অনুভূতি দ্বারা সঞ্চারিত হন। অর্থাৎ, কবিতায় পাঠক খোঁজেন অনুভূতিজ জাত্যর্থ, নিজে চাঙ্গা হয়ে ওঠবার জন্য। অনুভূতির ভার বহন করাই কাব্যভাষার কাজ, কাব্যভাষার এজন্য প্রতিবেদনের ভাষা থেকে দূরবর্তী হতে হয়। কবিতায় শব্দ নতুন ব্যঞ্জনায় জেগে ওঠে, পাঠমাত্র পাঠকের মনে এর জন্ম হয়। নবজাত এই ব্যঞ্জনার প্রণোদনায়ই অর্থফাটল ভরাট করে নেন পাঠক। ফাটল কেন থাকে? প্রতিবেদনের পরম্পরা অনুসৃত হয় না বলে। এ ভাষায় ব্যক্তি-বস্তু এক পাতে বসে অভেদ রচনা করে, অচিন্তিতভাবে রূপকায়িত হয়ে লাভ করে ধ্বনির আদর আর চিন্তিতভাবে উপমায়িত হয়ে বইয়ে দেয় শুশ্রূষার মতো বাণী। ব্যক্তিগত মূল্যায়নের সরাসরি অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়েই ভাষা সেখানে এরকম রূপ পায়। এটা হয় অনুভূতিরই তাড়ায়। পাঠকের মনে আবার এটি অনুভূতি জাগাবারও দায়িত্ব পালন করে। কখনো কখনো বস্তু ও ধারণায় এমনকি প্রাণসঞ্চারও ঘটে। পাথরও বাউল হয়, ভয় জোরে কেশে ওঠে।
সংবাদপত্রের পাতায় তো আমরা হামেশাই দেখি ব্যাঙের ছাতার মতো মাদ্রাসাকে গজিয়ে উঠতে, বাজারে আগুন লাগতে। এ-ও তো রূপকই। তাহলে রূপকপ্রশ্নে প্রতিবেদন আর কবিতায় পার্থক্য রইল কই? আছে পার্থক্য। যে রূপক মরে যায় নি, সংবাদপত্র সে রূপক ব্যবহার করতে পারে না। সংবাদপত্রের প্রধান দায় বক্তব্যকে সহজে বোধগম্য করা। সংবাদপত্রের ভাষায় তাই ফাটল শোভন নয়, অনুভূতিজ্ঞাপন তার কাজ নয়, তার কাজ তথ্যজ্ঞাপন। কবিতা যে রূপকের জন্ম দেয়, তার কাজ বোধগম্য হওয়া শুধু নয়, বোধকে প্রসারতা দেওয়া ও উসকানি সরবরাহ করা। কবিতার রূপক সার্থক হলে একসময় সেটা মরে যায়। সংবাদপত্রও তখন পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি করে দেখতে পারে। কবিতার রূপক এ প্রক্রিয়ায়ই ক্লিশে হতে হতে মরে গিয়ে সংবাদপত্রের ভাষা হবার যোগ্যতা অর্জন করে। ঠিক এ কারণেই সংবাদপত্র যখন সাহিত্যের দায় সামলায়, তখনো মরা রূপককেই তা মহিমান্বিত করে বেশি।
ব্রাত্যজনের ভাষায় উপমা-রূপকের যথেচ্ছ ব্যবহার আছে। যেসব ভাষাকে আমরা অশ্লীল বলে অভিযুক্ত করি, সেসব ভাষায় শক্তিশালী সব রূপকের উপস্থিতি থাকে। যিনি অকথ্য গালি খান তিনি যে দ্রুত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বা পালটা গালি দেন, এটা প্রমাণ করে যে, ওই নির্দিষ্ট প্রয়োগটা খুব দ্রুত শ্রোতাকে স্পর্শ করেছে এবং তার মনে পালটা অনুভূতির উদ্রেক করেছে। এটা রূপকেরই শক্তি। সাধারণ মানুষের মুখের কথা তাই কবির জন্য ব্যাপক অনুধ্যানের বিষয় হয়ে ওঠে। কবির কেন হবে শুধু? সকল লেখকেরই, সকল ভাষাকর্মীরই হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তীব্র আক্রমণাত্মক রূপকাশ্রয়ী গালাগালির ঘটনাগুলো যখন ঘটে তখন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চারপাশে ভিড় করে ওঠে। কী বলে না-বলে তা তারা মন দিয়ে শোনে। কেন শোনে এসব? কারণ এ ভাষা দারুণভাবে বোধ্য, অর্থময়, নাটকীয় অভিব্যক্তিসম্পন্ন ও দ্রুত সঞ্চারণশীল। মানুষের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা মন্দাগুন এ ঘটনায় চাড়া দিয়ে ওঠে। তাই জন্যে সেটা হয় আনন্দময়, সম্ভবত।
অধুনা বিকশিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলা ভাষায় নোটানোটি শুরু হয়েছে বেশিদিন নয়। তারও আগে শুরু হয়েছে বাংলা ব্লগ। এসব মাধ্যমে ছদ্মনিক নিয়ে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের এমন এক চূড়ান্ত অবস্থা মাঝেমধ্যে দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে যে, তা বস্তির গালিকর্মকেও ছাড়িয়ে যায়। দেখা যায় যে, যেসব পোস্টে এ ধরনের কাণ্ড ঘটে সেসবের পাঠক বেড়ে যায়। হিট সংখ্যা হয় অনেক বেশি। ব্লগে হিট গণনা করা গেলেও ফেসবুকে সেটা করা যায় না। তবে এখানেও যে বিস্তর মানুষের আগমন ঘটে তা কতকটা বোঝা যায় কমেন্টের বহর দেখে। ফেসবুকে এসব ছদ্মনিকের গালিবাজি প্রতিরোধের জন্য একাধিকবার আন্দোলন গড়ে তুলবার চেষ্টা করেও বিশেষ সাফল্য পাওয়া যায় নি। বাকস্বাধীনতা ও স্বরবৈচিত্র্যের পক্ষে ভোট দিয়ে অনেককেই এখানে প্রকাশ্যে বলতে শোনা গেছে যে, তাঁরা নিকদের কথাবার্তা এমনকি পছন্দই করেন। ফলাফল থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা কখনোই যাবে না যে, নিকসমর্থকদের প্রত্যেকেরই গোপনে একাধটা নিক আছে। তাঁদের আকর্ষণের একটা কারণ নিকসমূহের রূপকবহুল ভাষাও। যাঁরা এসব প্রশ্নে চুপ করে থাকেন, ধারণা হয় তাঁদের মনেও হয়ত নিকদের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থনই প্রকাশ পায়। তা নইলে কথিত নিকদের বন্ধুতালিকা থেকে মুছে দেবার ব্যাপারে তাঁরা অনাগ্রহ প্রদর্শন করবেন কেন? এঁদের সবাই তো আর আক্রান্তের শত্রু নন যে, শত্রুর পরাস্ত হওয়া দেখে তাঁরা আনন্দ নেবেন। আনন্দ আসলে তাঁরা নেনই, তবে সে আনন্দটি আসে ভাষা থেকে, রূপকের ব্যবহার থেকে। আমরা আমাদের পাঠক জীবনে এমন অনেক গদ্যরচনার আস্বাদ নিয়েছি, যাকে আমরা বলেছি কাব্যগুণসমৃদ্ধ। এই বিশেষণ প্রয়োগের প্রধান কারণ সে ভাষার পরতে পরতে বস্তুত জেগে উঠেছে সপ্রাণ বাদ্যি, রূপকের ঢাক।
আট.
ভালো কবিতার ব্যাখ্যা পরিবর্তনশীল। পাঠকভেদে এর অর্থ তো আলাদা-আলাদাভাবে খোলেই, এমনকি একজন পাঠকের কাছেও উপর্যুপরি পাঠে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ধরা দেয়। যে কবিতার এ সম্ভাবনা আছে সে কবিতা বহুজনকে ছুঁতে পারে। গুমরমুক্ত ও একটিমাত্র সরল অর্থে ধরা দেওয়া একরৈখিক কবিতা হীনপ্রায়। কবিতায় অর্থের এই অস্থিরতা রহস্যময়তা সৃষ্টি করে করা সম্ভব। সময়ের জীবনছন্দ ধরে শব্দকে বাঁধাধরা পরিভাষার আওতা থেকে বের করে এনে দ্ব্যর্থক বা অনেকার্থক মানে জাগিয়ে তুলতে পারলে এ সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে সূচিত হতে পারে। এর জন্য উল্লম্ফন কার্যকর নয়, নন্দনগহ্বর তক বড়োজোর পাঠক নিতে রাজি হন। বাক্যের ওপর নিরর্থকতা বা অনর্থকতার ভার চাপাতে চাইলে ফাঁকি সৃষ্টি হয়, রহস্য নয়। অদূর এমনকি সুদূর চেষ্টায় হলেও শব্দ-বাক্যের নাগাল মিলতে হয়, তা নইলে কবির সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। যাই হোক, এরকম কবিতার মানে কোনো একটি স্থির নির্দিষ্ট পাটাতনে দাঁড়ানো থাকে না, বলাই বাহুল্য।
সাধারণীকৃত বক্তব্যের ক্ষেত্রেও কবিতার মানে নানাদিকে খুলবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। একইসঙ্গে গাছের-মাছের, জীবন্মাত্রের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে সাধারণীকরণ। প্রতীকের ব্যবহারও কবিতাকে অনেকার্থকতা দিতে পারে। প্রতীক বস্তুটি বাইরে একটা মানে ধরলেও ভিতরে আরেক বা অনেক। প্রাথমিক পাঠে এর বহির্বাটির খোঁজ পাওয়া যায়। অগ্রসর পাঠে আস্তে আস্তে নিহিতার্থের দরজা খোলে। এক ধরনের পাঠক বাইরের মানেটা নিয়ে তৃপ্ত থাকে। কিন্তু সবাইকে ওই মানে তৃপ্ত করতে পারে না। গুমর বুনে রাখা গেলে তা অগ্রসর পাঠকের খোরাক হতে পারে। ব্যাজস্তুতি-ব্যাজনিন্দাও এ শ্রেণির পাঠকের আগ্রহের আওতায় স্থান পেতে পারে।
নয়.
কবিতা সময়ের জীবনছন্দ টের পায়। জীবন যে মাপে এগোয়, সময় যেভাবে হাঁটে, কবিতাকেও সেভাবে হাঁটতে হয়। তা নইলে সময়ের কবিতা লিখিত হয় না। একজন কবি সমসময়ে যাপনধর্ম পালন করে পঞ্চাশ বা একশ’ বছর আগের কবিতা লিখুন, তা চান না পাঠক। এটা শুধু বিষয়ের বা শব্দার্থেরও মামলা নয়, মামলা ছন্দেরও। প্রতিদিন কবিতায় যুক্ত হচ্ছে নতুন বিষয়, শব্দে যুক্ত হচ্ছে নতুন মানে, ছন্দ কেন পুরোনোটাই থাকবে? নতুন মোড়কে পুরোনো জিনিস যেমন প্রার্থিত নয়, তেমনি নয় পুরোনো মোড়কে নতুন জিনিসও। কাজেই ভেঙেচুরে ওর বারোটা বাজিয়ে দিতে হয় যে কোনোভাবে।
ছন্দের ব্যাপারে একটা কথা প্রায়ই ওঠে, যে, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দকে ভালো করে জানলেন না বুঝলেন না তিনি ছন্দ ভাঙবার অধিকার পাবেন কোন বিবেচনায়? খুবই সংগত কথা। জেনে ভাঙাই ভালো। কিন্তু যিনি ওটা ভালো করে জানবার-বুঝবার তাড়নাই বোধ করলেন না ভিতর থেকে, ভাবলেন একটা শৃঙ্খল, তাঁকে ব্রাত্য চিহ্নিত করবার অধিকারও কেউ রাখেন না।
প্রয়োগের উদাহরণসহ ভালো করে প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দ শেখা সপ্তাহখানেকের মামলা মাত্র। নিজে প্রয়োগে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠতে মোটমাট আরো তিন মাস। একজন লেখক তাঁর লেখক জীবনে কাড়ি-কাড়ি জটিল বইয়ের এদিক দিয়ে ঢুকে সম্পন্ন হয়ে যদি ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন, তাঁর কাছে এক সপ্তাহের ওই কথিত আয়োজনটা যে গুরুত্বপূর্ণই মনে হলো না, এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখাও জরুরি বৈকি। কবিতা বস্তুত মুক্তি চায়। তা এমনকি বিখ্যাত কবিতাবলিঘনিষ্ঠ কাব্যিক ঐতিহ্য, তার আবহ, শব্দরুচি, বাক্যগঠনশৈলী, বিষয়ভাবনা থেকে শুরু করে তাত্ত্বিক ভার, আভরণের ঘটা, ছন্দ সবকিছু থেকেই। এই মুক্তির মন্ত্রে যিনি বুঝেশুনে দীক্ষা নেন, তাঁর কাছে খোঁয়াড়প্রতিম একটা আয়োজনকে অপ্রয়োজনীয় মনে হতেই পারে।
প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দের নিটোল ব্যবহারে শাসিত অনেক কবিতার দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকালে দমবন্ধকর অনুভূতি হয়। মনে হয় ওখানকার শব্দেরা, বাক্যেরা যেন মাত্রাতিরিক্ত শাসন সয়ে রীতিমতো কাঁচুমাচু হয়ে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছে না। বনসাই বনসাই একটা চেহারা। এ অবস্থা থেকে যত দ্রুত বেরোনো যাবে ততই মঙ্গল।
একটা কথা বলা হয় যে, ছন্দ কবিতাকে স্মৃতিতে রক্ষিত হতে সাহায্য করে। সে তো করেই। কিন্তু এ বিবৃতি কি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক তিন প্রবীণ ছন্দের বেলায়ই প্রযোজ্য? যিনি এই ছন্দগুলোর খড়্গের নিচে গলা বাড়িয়ে রাখেন না, তিনিও কি কবিতা ছন্দেই লিখেন না এক ধরনের? কবিতা হতে হলে টেক্সটের মধ্যে ভাষার যে সামঞ্জস্য তৈরি হতে হয়, গতি অব্যাহত রাখতে হয়, পাঠস্বাচ্ছন্দ্য স্থাপিত হতে হয়, এ কি কোনো ছন্দ তৈরি করে না? জীবনছন্দ কি ছন্দ নয়?
তরুণ কবিদের মধ্যে অল্প কয়েকজন সদস্যসম্বলিত একটি গোষ্ঠী বাংলা প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দ তো বটেই, এমনকি সংস্কৃত ও বৈদিক ছন্দেও কবিতা লিখছেন এবং ছন্দে না-লিখলে কবিতা কবিতা হয়ে উঠবে না বলছেন। এর বিপরীতে অন্য আরেকদল ছন্দকে অপ্রয়োজনীয় বলে সম্পূর্ণ বর্জন করবার পক্ষে উচ্চকিত ভাষণ দিচ্ছেন এবং ছন্দে লিখলে কেবল ছড়ামাত্র হয়ে উঠতে পারে বলে দাবি করছেন। সাময়িক বিরতি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এঁরা প্রায়ই বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক ছাপিয়ে রীতিমতো বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ব্যক্তিগত সম্পর্কে ইতি টানেন। আমার কাছে এই দুই দলের কার্যকলাপকেই আপত্তিকর মনে হয়, দুই দলের সদস্যদের মধ্যেই গোঁড়া মৌলবাদী বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি দেখতে পাই।
জানা কথা যে, শিল্প-সাহিত্যে কোনো সর্বজনীন মত নেই, থাকা সংগতও নয়। ফলে নিজ নিজ শিল্পরুচির অনুকূলে নিজের কাজটি করবার পাশাপাশি অন্যের শিল্পরুচির প্রতি শ্রদ্ধা থাকাটাও আবশ্যক। অনেকরকম লেখায় কবিতাঙ্গন বর্ণিল হয়ে উঠলে কার কেন কীভাবে সমস্যা তৈরি হয় তা বোঝা মুশকিল। ক্ষুদ্র একটি লেখকসমাজের ভাবনাবৈচিত্র্যকে যাঁরা মেনে নিতে পারেন না, তাঁরা বাংলার বহুত্ববাদী সমাজচরিত্রের হাজার বছরের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখায় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে তো মনে হয় না। এসব লেখক দিয়ে আমরা কী করব আখেরে?
সবিশেষ, আমাদের দরকার উৎকৃষ্ট কবিতা। কবিতাটি কোন প্রক্রিয়ায় হয়ে উঠল, শৃঙ্খলের ভিতরে থেকে নাকি বাইরে এসে, সেটার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। কিন্তু শৃঙ্খল ছিল বলে মুক্তির পক্ষে কিংবা মুক্ত ছিল বলে শৃঙ্খলের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তরবারি শানানো অবশ্যই বন্ধ হওয়া দরকার।
দশ.
একজন কবিতাকর্মী হিসেবে আমি মৌলিক কবিতাই লিখতে চাই। কিন্তু মৌলিক কবিতা বলতে আমি যা বুঝি, বাস্তবিক অর্থে ওটা একটা ঘোড়ার আণ্ডা! যেদিকেই তাকানো যায়, দেখি কেবল ক্রাফটসম্যানশিপের বাহাদুরি, অন্যের জানালা দিয়ে আকাশ দেখার কেরামতি। যেন এই-ই হতে হয়, যেন এই-ই একমাত্র পথ, অবিকল্প। কেউ ট্রুকপি বানায়, কেউ শব্দ ধরে ঝুলে পড়ে, কেউ ছন্দ ধরে লাফায়। ঝুলতে ঝুলতে, লাফাতে লাফাতে যেখানে গিয়ে পৌঁছায়, তা আসলে অন্য কারো যতনে গড়ে তোলা বাড়ির আঙিনা বা অন্য কারো হাসিল করা চাষভূমি; অকর্ষিত কোনো প্রান্তর নয়।
এই-ই চলছে দিকে দিকে। এই চলার চলনদার যারা, দলেবলে ভারী বলে এরা সদাপট বিচরণ করে। উচ্চকণ্ঠে কথা বলে। বাণীশাসন চালায়। ঘটনাক্রমে এই বাণীবিদরা উজ্জ্বল, চলনে-বলনে ও দেখায়। এদের চেকনাই কাজেই নবাগতকে দুর্দান্ত আকর্ষণ করে। নবাগত হারিয়ে যায় চেনা ও অচেনার মিশ্রণ দিয়ে বানানো আণ্ডার ভোজে। এরা তখন জানপ্রাণ দিয়ে নামে বাণীবিদদের শিখিয়ে-পড়িয়ে দেওয়া কথা প্রচারে।
এই আণ্ডাবাজরা সাহেবি সমাজের লোক, মাটি ও মানুষঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতাহীনতায় নিরক্ত, পাণ্ডুরোগে ভোগা পাঠক। এরা পাঠ করে উপভোগের জন্য নয়, ছাঁচের সন্ধানে। পছন্দসই ছাঁচ পেলে পুরোনো কথা ফেলে নতুন কথা ঠেসে দেয়। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে অচেনা বানাবার, আসলে হয় না। আগের বাড়ির পালানে যেখানে লিচু গাছ ছিল, সেখানে রেইনট্রি গাছ লাগায়; যেখানে ইঁদারা ছিল সেখানে নলকূপ বসায়। এ ছাড়া, নতুন পোশাকের ভিতরে আর সব একই থাকে। যে কারণে পড়তে গেলে নস্টালজিক লাগে, কেমন যেন একটা চেনা স্বাদ, আবার চেনাও নয় অবস্থা। এই চেনা-অচেনার মিশ্রণ ব্যাপারটা মাধুর্যের এক ঘোর তৈরি করে, ওই ঘোরই করে সম্মোহিত। অল্পপ্রাণ পাঠক তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার ওপরে। ভাবে, এটাই হয়ত চিরন্তন মাধুর্যপুরীতে পৌঁছুবার অবিকল্প সিঁড়ি!
মৌলিক কবিতা তত্ত্বীয়ভাবে কবিতা নির্মাণের এহেন সংস্কৃতি থেকে দূরে সদভিজ্ঞতাজাত, নতুন। যে অভিজ্ঞতা কবি নিজে ছুঁয়েছেন, অর্জন করেছেন, তা-ই সে কবিতার ভিত। কবিতা কমবেশি বানানো জিনিস সন্দেহ নেই, কিন্তু এর গভীরে কাজ করা অভিজ্ঞতাটা ধার করা হলে মুশকিল। যখন প্রত্যক্ষ সদভিজ্ঞতা কবিতা রচনার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে, তখন সে কবিতার মৌলিক হয়ে ওঠবার সম্ভাবনা প্রভূত, যদি অন্তত চালাকি করে কোনো ছাঁচ এনে ওর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। এরকম কবিতা পাঠকের কাছে মূলতক অচেনা লাগে, চাই কি অপ্রিয়ও। পাঠকের যাপনের নস্টালজিয়াবোধ জাগিয়ে তুলবার মালমশলা তাতে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সজ্ঞানে সেখানে চাপানো থাকে না পুরোনো কবিতার রূপরসগন্ধ। এসব বৈশিষ্ট্য ধরে বলেই কবিতা মৌলিক হয়ে ওঠে বা ওঠবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আমাদের যাপনের সাথে যুক্ত জলমাটিহাওয়ার সিংহভাগই এখনো অকর্ষিত, অন্তত কবিতায়। আধুনিক কবিতা নামের বিদেশাগত শৈলী ও শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে কোমরবেঁধে তাকিয়ে না-থাকলে চোখমাত্র খুঁজে পেতে পারে সেই অকর্ষিত অঞ্চল। বর্তমানে জীবনানন্দ পাঠকমাত্রের কাছে প্রিয়তর (তাঁর কবিতা বিদেশি শিল্পচিন্তাপ্রসূত হলেও), তা বলে আমাদের জীবনানন্দ হবার দরকার নেই। জসীমউদদীন আমাদের আত্মীয় (তাঁর কবিতা বাংলার লোকবেদনাপ্রসূত বলেও), তা বলে আমাদের জসীমউদদীন হবারও দরকার নেই। আমরা হবো আমাদের মতো। আধুনিক শিল্পচিন্তা আমাদের শত্রু নিশ্চয়ই নয়, লোকবেদনাও ফেলনা বিষয় নয়। আমাদের দুটোই দরকার। কিন্তু মুখস্থ শিল্পচিন্তাকে থাপ্পড় কষানোরও দরকার আছে, লোকবেদনা বলতে কেবল গ্রামীণ শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের জীবনযন্ত্রণা ভাবাকে ভোলার প্রয়োজন আছে। গ্রাম-শহর সর্বাংশের মানুষই মানুষ, সবাই কবিতা। এইসব কবিতাকে জানতে বুঝতে চাই সউদ্ভাবিত শিল্পচিন্তা, যেটা অন্য কারো নয়, কেবল নিজের। সেটা কেমন হবে, যতক্ষণ করে ওঠা না হবে ততক্ষণ কেউ জানবে না। আগে জেনে শিখে ছাঁচ তৈরি করে করা দরকারি নয় এটা। করতে করতে হবে। কীভাবে হলো তা নথিভুক্ত হবে পরে। এই পথে যেতে যেতে কখনো এমন কোনো প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছা যেতে পারে যেখানে আগে কেউ পৌঁছে নি কবিতা কারণে।
সেজন্য ছন্দ এবং অছন্দেরও নতুন ধরন দরকার। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত : চিরকাল এই তিনটি ছন্দই মাড়াতে হবে তার কোনো মানে নেই। জগতের সবকিছু বদলে যাচ্ছে, ছন্দও বদলানো চাই। ছন্দ বানাতে হবে, মানে ছন্দের নতুন চাল। তা যদি না হয়, তবে কথা বলার আনকোরা নতুন তাল-লয়।
বিষয়টা যতটা লেখকের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার, ততটা অন্যের বলে দেবার ব্যাপার নয়। লেখক নিজেই জানবেন তিনি আসলে কী লিখছেন। কপি করা খাপে কথা ঠেসে দিচ্ছেন নাকি নিজের অবিকল্প অভিজ্ঞতাকে নিজের মতো করে গেঁথে তুলছেন। মৌলিক কবিতা তিনি কখনো লিখেন না, যিনি মনে করেন মৌলিক কবিতা লেখা অসম্ভব। মৌলিক কবিতা তিনি কখনো লিখেন না, যিনি প্রতিনিয়ত হাততালির বাসনায় কাতর হয়ে থাকেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন কবি শতভাগ মৌলিক কবিতা লিখতে পারেন কি না। আমি যে বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি কবি-লেখকদের শত-সহস্র লেখা পড়ছি, দেশি-বিদেশি সিনেমা উপভোগ করছি, চিত্রকর্মে বুঁদ হয়ে থাকছি, নাচ-গান দেখছি-শুনছি, এগুলোর কোনো ভালোমন্দ অভিক্ষেপ কি আমার মধ্যে পড়ে না? যদি পড়ে তবে তার কি কোনো প্রভাব নেই আমার কবিতায়? নিশ্চয়ই আছে। না-থেকে পারেই না, যদি জার্মান নাট্যকার লেসিংয়ের এই বক্তব্যটি সত্য হয় যে, ‘মাসুল না-দিয়ে কেউ পাম গাছের তলায় হাঁটতে পারে না’। গ্যাটে তাঁর ‘ইলেকটিভ এফিনিটিজ’ গ্রন্থে উদ্ধৃতিটি একই অর্থে ব্যবহার করেছিলেন জেনে বাক্যটির নিহিত গুরুত্ব আরো গুরুত্ব লাভ করে। এর মানে হলো, কিছু প্রভাব আছে যেগুলোকে বলা যায় স্বতঃপ্রভাব। এগুলো এড়ানো অসম্ভব।
কবিতার জন্ম হয় নিজস্ব আনন্দ-বেদনার থেকে। এটা যতক্ষণ নিজস্ব ততক্ষণ তা সৎ। ভুল বুঝবার অবকাশ দূর করতে বলা দরকার যে অন্যের আনন্দ-বেদনাও নিজের হতে পারে, দেশের আনন্দ-বেদনাও নিজের হতে পারে, যদি তা কবিকে ভেতর থেকে স্পর্শ করে। যতক্ষণ স্পর্শ করে না, ততক্ষণ অন্যের আনন্দ-বেদনা নিজের আনন্দ-বেদনা হয় না। এরকম অবস্থায় ওই বিষয়ে লেখা কবিতা খুব জলো ও খেলো, ওপরভাসা ও হাস্যকর হয়। দেশের কবিতা, বিশেষ করে অধিকাংশ দেশের গান প্রায়ই হয় ওপরভাসা, মিথ্যা-আবেগে ঠাসা। ওগুলো নীতিকথা হিসেবে, শিক্ষার্থীপাঠ হিসেবে ভালো জিনিস, কিন্তু কবিতা হিসেবে সাধারণত প্রায়ই হয় নিকৃষ্ট। দেশের কবিতা কখনোই সদাবেগ দ্বারা লিখিত হয় না বা লেখা হতে পারে না, তা নয়। ষাটের দশকে, মুক্তিযুদ্ধকালে সেরকম সময় ছিল আমাদের। এখন যেরকম সময় বিরাজ করে ফিলিস্তিনে।
নিজস্ব আনন্দ-বেদনার সৌকর্যময় ভাষিক প্রকাশকেই আমরা কবিতা বলি। এ হয় আত্মাজারিত সদোচ্চারণ। এর প্রকাশবাসনা মানুষের সহজাত। অন্তর্গত একটা তাড়না মানুষকে খোঁচায় প্রকাশসক্ষম হতে। প্রকাশবাসনা থাকলেও প্রকাশসক্ষমতা সবার থাকে না। যার থাকে তিনি কবি হবার দিকে হাঁটেন, যার থাকে না তিনি শুয়ে-বসে থাকেন!
এ আলাপের ভিত আরো মজবুত হতে পারত, যদি কথিত মৌলিক ও অমৌলিক কবিতার উদাহরণ হাজির করে কথা বলা যেত। সেটা করা যেত না তা না, কিন্তু করা হয় নি। করা হয় নি কারণ পাঠকের জন্য সেটাও অন্যজনের স্থাপিত বাতিঘরের দিকে তাকিয়ে জগজ্জীবনকে উপলব্ধি করা হতো। এ আলাপের অভীষ্ট কোনো বিতর্কের মাঠে রণসজ্জায় হাজির হওয়া নয়, বরং ভিতরপ্রদেশে এক সদাকাঙ্ক্ষার জাগরণ, যা খুঁজে দেখবে সম্ভাবনাময় চাষযোগ্য আত্মগত অকর্ষিত ভূমি, যার যে কোনো অবস্থায় মৌলিক হবার সম্ভাবনা শতভাগ। ক্রাফটসম্যানশিপের বর্তমান রমরমা সময়ে যা হয়ে উঠতে পারে মৌলিক কবিতার এক ক্রমাগ্রসরমান বিপ্লবী মিছিল।
মনজুর কাদের সম্পাদিত 'কঙ্কাল'-এ প্রকাশিত, ২০১৯