Sunday, August 16, 2009

আঁতুড়ঘরের নকশামালা, খুঁজে-ফিরে দেখার সাধনবিলাস

শুরুটা কীভাবে করা যায় ? দুপুরে উপোস থাকা দিয়ে ? এ আর নতুন কী! এই যে পেট্রোল পাম্পের থেকে যাত্রা শুরু হলো, গাড়ি নই তবু, আমাদের দিন তো প্রতিদিনই প্রায় এভাবে যায়। বরং গ্যাটগ্যাট করে ঢুকে যাওয়া দিয়ে করি মহিলা কলেজের গেট দিয়ে বিনানুমতিতে। প্রধান ফটকের বিশাল বৃক্ষগণ কিছু মনে করো না, দ্বাররক্ষীকে এই কলা দেখালাম। (মু. মে., ক্ষুধার সন্তান, আজকের বাংলাদেশ সাহিত্য, ১৮ জুন ১৯৯৪)
দুলাল ভাই সুপ্রতিমেসু,
এটা সত্যিই বিড়ম্বনাকর যে আপনাকে নিয়ে মৌসুমী ধান ভানতে গিয়ে নিজের সম্পর্কেই অসময়ে কিছু শীবের গীত গেয়ে নিতে হচ্ছে। নিজের কথা পাঠককে উদ্দেশ্য করে তাঁরাই বলতে পারেন, যাঁরা কৃতবিদ্য, কিছু একটা অর্জন করে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে যাঁরা একটি আইকনে পরিণত হয়েছেন। আমি কস্মিনকালেও সেরকম কেউ নই। প্রয়োজনে বললেও শেষপর্যন্ত পাঠককুলের কাছে আমি যে অপরাধটি করছি, সেটি ভবিষ্যতেও কখনো পুষিয়ে দিতে পারব বলে তাদের আশ্বস্ত করতে পারি না। সুতরাং পাঠক দেবতার কাছে এক্ষণে দশাসই একটা মার্জনা প্রার্থনা করেই বাঞ্ছারামপুরের দিকে কিছুদূর হেঁটে যেতে চাই।

একান্ত নিজের বলে স্বীকৃত কাজকর্ম ব্যতিরেকে আর যা কিছু আমি করি শিল্পকুলঘেঁষা, তা করি সবার জন্যেই, কিন্তু শেষপর্যন্ত তার একটা বড়ো অংশই আগলে রেখে দেই নিজের কাছে। মায়া ত্যাগ করতে পারি না। মা যেমন ত্যাগ করতে পারেন না মেয়ের মায়া। জগতের সবাই অপাত্র তা নয়, কিন্তু মায়ের বুক তবু অজানা আশংকায় কাঁপে, ধুকপুক করে, যদি মেয়ের প্রতি অবিচার হয়! যদি ছেলেপক্ষ মেয়েকে বুঝতে না পারে! ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যাই হোক এই প্রবণতাটি একদিনে অর্জিত নয়। ধীরে অনেক দূর পথ হেঁটে ক্রমে আরোহণ করেছি সেই তীর্থচূড়ায়, যেখান থেকে যখন-তখন পড়ে যাবার আশংকা থাকলেও মরে যাবার একদমই নেই। একসময় বহু হাতছানি ছিল, প্রলোভন ছিল, নামি নি। নিচে পুরো করে পাতা ছিল পাদাসন, ধপাস করলেও জানে মরবার ভয় ছিল না। কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারি নি। পণ্ডশ্রম মানুষ বছরের পর বছর ধরে করে না। সবারই নিজস্ব মঞ্জিল আছে। সেসব মঞ্জিলাভীপ্সা ও ক্লান্তিতে এখন সবাই ভুলে গেছে যে ও তীর্থে কেউ একজন ছিল কোনোকালে!

আমার একক কোনো ব্রহ্মচর্যকাল নেই, গার্হস্থ্য নেই কিংবা নেই বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাস। একের ভিতরে আমি চার আশ্রম, সবকালে। এ আমার এমনই এক মিশ্রতীর্থ, যাত্রীগণের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধ্যানস্থ থাকা যায় দিন-মাস-বছরের পর বছর। সকলেই জানে সূর্যের কাছে ওই তপ্তগ্রহতীর্থে এখন আর কেউ নেই, থাকলেও জীবিত অন্তত নয়। অথচ ক্রমাগত বলাৎকৃত আমার ভাষার বর্ণমালা জানে, কী প্রাণচাঞ্চল্য নিয়েই না আমি গান গেয়ে চলেছি সৃষ্টির, বোষ্টমি সনে-- এককোষী হাইড্রা থেকে অতিকায় তিমির, প্রতীকী বাংলায়।

প্রথম যৌবনের উত্তুঙ্গ প্রকাশ বেদনাকে বারকয় ছুঁয়ে তা ফুরিয়ে যাবার আগেই আমি সংযমের অমোঘ সুড়ঙপথের সন্ধান পেয়ে যাই। সুড়ঙমুখে জমে থাকা রহস্যান্ধকারটি আলতো করে সরিয়ে দিয়েছিলেন নাট্যকার-কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক ফরিদ আহমদ দুলাল, আপনি নিজে। হয়ত আপনি জানতেন না যে, যে পথ আমাকে দেখাচ্ছেন সে পথই একদিন গলাধঃকরণ করবে নবাগত এই পথিককে। হলো বস্তুতপক্ষে তাই। একসময় আপনি দেখলেন, আপনার দৃষ্টিসীমা থেকে ক্রমাষ্পষ্টতার দিকে যেতে যেতে ভরাপ্রাণ একজন মানুষ একটি রেখা এবং তারও পরে একটি বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার মেঠোপথের একেবারে শেষ প্রান্তের জলাজংলার ভিতর। সন্ধ্যা হয় হয় সময়ের লালাভার ভিতরে দাঁড়িয়ে কি তখন আপনি বুঝেছিলেন যে এ বিচ্ছেদ আদৌ সাময়িক নয়, এর ভিত পোতা হয়ে গেছে অন্য কোনো সারগাথায়, দর্শনে ?

ময়মনসিংহ, দুলাল-কৃষ্ণের চিরকালীন রাধা, আধা রাধা আমারও ছিল এক গোপন প্রেমিকা। জীবিকার ঘোড়া দাবড়িয়ে তার থেকে ভৌগোলিকভাবে দূরেই গেড়ে নিতে হয়েছে আমার অধুনাকার ঘাঁটি। ধরে-ছুঁয়ে তারে পরখের অবকাশ আজ কালেভদ্রে মাত্র ঘটে। জ্ঞাতিবিচ্ছেদের এই বিরহবেদনই সেই মূর্তিমান কারণ, যেজন্যে বেসুরো ও কর্কশ এই ভরা শিবগীত, বাস্তবিক ধানভানা কালে।

২. আবিষ্কারের ঘোর

দু’টি কবিতামতো রচনা, কৈশোরকালীন কাব্যনির্মাণ চেষ্টার স্মারক, সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আপনার হাতেই কোনোরূপ সম্পাদনা ব্যতিরেকে প্রকাশ পেয়েছিল লেটার মেশিনে ছাপা ময়মনসিংহের অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের বাংলাদেশ-এ। কোনো দৈনিক সংবাদপত্রে ওটি আমার প্রথম নাম ছাপা, তা তার ভূগোল যত ছোটই হোক, তা তার সার্কুলেশন যত কমই হোক। এ যে কী এক উচ্ছ্বাসের সাথে আপনি আমার সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন, তা আপনি জানতেন না বলেই ধারণা করি। আমি জেনেছি, এরপর থেকে রৌদ্রের দুপুরগুলোর অন্যরকম সঙ্গ পেয়ে পেয়ে, রাতগুলোকে পেয়ে ঘাসের শয্যায়। খুব বিচ্ছিরি রকম আনন্দকর ছিল ওই অনুভূতি! কাজেই ঘাসপাতাকাদামোড়িত গ্রামীণ শিল্পশালা ফেলে রেখে কোনোভাবে সকালের নাস্তাটা পেটে পুরে বা না পুরে গোটাকয় খুচরো টাকা জুটিয়ে কিলোদশেক দূরের দেওখোলা থেকে নতুনভাবে চেনা শহর ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে বাসে ঝুলে পড়তাম প্রতিদিন। কাজ যাকে বলে তেমন কিছুই থাকত না আমার, তবে কর্ম থাকত রথ-দেখা, কলা-বেচা সমেত। সে ছিল নিতান্ত এক গ্রাম্য কিশোরের শহরাবিষ্কার ও কবিতাদেবীর চরণ খুঁজে বেড়ানো।

গ্রামদেশ দেখা-চেনা-জানা-বোঝা একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছবার পর শহরের রূপমহিমা দেখবার সে ছিল এক দেহধ্বংসী নৈমিত্তিক মহড়া! ভরা রোদে তার নানা গলিঘুপচি, সার্কিটপাড়া, মতিমটর্স, ব্রহ্মপুত্র তীর, জয়নুল সংগ্রহশালা, গোলকিবাড়ি কবরখানা, টাউনহল, মুসলিম ইনস্টিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরি, শ্মশানঘাট, রেলব্রিজ, এগ্রোফার্ম, বোটানিক্যাল গার্ডেন, রেলস্টেশন, ওভারব্রিজ, তাজমহল রেস্তোরাঁ, আলেকজান্ড্রা ক্যাসল, শশী লজ, বুড়াপীরের মাজার, বিপিন পার্ক, কেন্দ্রীয় ডাকঘর, আরএমএস, কোরায়শী প্রাঙ্গণ, আজিজ প্রিন্টার্স, জগদ্বন্ধু আশ্রম প্রভৃতি স্পটগুলো যাত্রাতাঁতে সেলাই করে করে প্রয়োজনীয় মানুষিক ও মানবিক বিরতি সহযোগে ফেরার ছিল সেই কাল। বাঁকে বাঁকে বিচিত্র সব মানুষ, অতিমানুষ এবং তাদের অনন্য সাহচর্য। এক বিস্ময়কর বহুবাচনিকতার সাথে তখন আমার নিত্য মোলাকাত। তাই জন্যে একা হয়েও একা নই। নতুন কোনো স্থানেও মানুষ বেশিদিন একা থাকতে পারে না, সঙ্গী জুটে যায়। আমারও জুটে গিয়েছিল। যদিও সঙ্গলগ্ন হয়েও চূড়ান্ত বিবেচনায় মানুষ মূলত একাই। না, হাসবার কিছু নেই, কবিতা এরূপ সাধনেও মেলে, আমাদের মিলেছে আপনি জানেন, এ বয়সে যদিও আর সম্ভব নয় পাওয়া।

আশিক, রোকন, শতাব্দী ও আমি, গ্রাম থেকে আসা আমরা বড়ো বেপরোয়া ছিলাম। ছিলাম খানিকটা আধাখেচড়া অনিকেত, না-গেঁয়ো না-শহুরে। দূরাগত আরো যারা ছিল স্বজাতির, মাসুম, হাদিউল, শামীম-- ওদের কলেজ হোস্টেল ছিল। শহরে নিজেদের অথবা ভাড়া করা বাড়ি ছিল মোস্তাক, মশিউর, স্বাধীনসহ অনেকের। আকুয়ায় পোড়োবাড়ির শ্রী নিয়ে দাঁড়ানো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বাড়ি ছিল বাচ্চু (শামসুল ফয়েজ) ভাইয়েরও। কিন্তু বোহেমিয়ান কবি বাচ্চু ভাইয়ের ঘরে ফেরা ছিল এক বিরল ঘটনা। ঘর থেকেও ঘরহীন এই মানুষটির সঙ্গে সঙ্গত কারণেই আমাদের বনিবনাটা একটু বেশি হয়ে ওঠে। তাঁর সাহচর্যে আমরা তখন ভিতর দিক থেকে তরতর করে বেড়ে উঠছি। নামধাম শুনছি-জানছি ভুবনখ্যাত কবিদের, পঙক্তিও। সিনিয়রদের মধ্যে তাঁকেই কেবল কবি মনে হচ্ছে তখন। বয়সের দূরত্ব কবে ঘুচে গেছে তাঁর সাথে, যা ইচ্ছে বলা-কওয়া যায়, যেখানে যাব ভাবি সঙ্গে পাওয়া যায়। এই একসঙ্গে গাঁজা খাচ্ছি তো এই যৌনকর্মীপরিবৃত স্টেশন প্লাটফরমে বস্তাসদৃশ একশিরাওয়ালা তারালাল সুইপারের সাথে বসে বসে গল্প করছি আর চা পিয়োচ্ছি। হঠাৎ হাসছি, চিৎকার করছি। জোর পায়ে রেলপথ ধরে এগোতে এগোতে গলা ফাটিয়ে গেয়ে উঠছি কোনো গান বা কবিতা। পথে হয়ত দেখা হয়ে গেল আমূল আওলাভাই আওলাদ হোসেন, সদা ঘোরগ্রস্ত মাহমুদ আল মামুন কিংবা বিদিশাগ্রস্ত তপন বর্মণের সাথে। ভর দুপুরে ঘুপচিপথে আপনার সাথে দেখা হওয়ার চান্স ছিল না মোটেই। আপনি চলতেন সদর রাস্তা ধরে, তা-ও যখন তখন নয়। আপনার সাথে দেখা করতে বিশৃঙ্খলার অতল থেকে উঠে, বাতিরকলের মোড়ে, শৃঙ্খলার দিকে কিছুদূর হেঁটে যেতে হতো। মাঝেসাঝে সদলবলে বা একা একা সেদিকেও যেতাম আমরা। বহিরাঙিনার কাঁঠালিচাঁপা, ভিতরাঙিনার সদাশীতল নলকূপ, দোয়েলকূজিত শান্তস্নিগ্ধ ছায়ার টানে, নিষ্ঠ কর্মকর্তা আপনার কর্মস্থলে, ঠিক মধ্যাহ্নবিরতিকালে, রোদেপোড়া আমরা কজন সহসাই হাজির হয়ে যেতাম। আশ্চর্য যে, কখনো উপদ্রব ভাবেন নি মুখের ওপর। মনে মনে ভাবতেন কি না জানি না আমরা। সবসময় যে আপনি সময় দিতে পারতেন তা নয়, কখনো কখনো অপেক্ষার কড়ি গুণতে হতো। এ সময়টা অবশ্য অন্যভাবে মহিমাময় করে তোলা যেত বর্ণে-শব্দে-বাক্যে, বইয়ের গন্ধে। আমরা সেটা করতামও। লাইব্রেরির শান্ত-শীতল কক্ষগুলো সবসময়ই উদার হয়। গ্রন্থের আদর চিরকালই অনন্য উত্তাপে ভরা।

প্রথমে দ্বিতীয় চিন্তায় মুদ্রিত পরে গ্রন্থিত আপনার ‘কাব্যাক্রান্ত কতিপয়’-এর নদী এবং নদীর কাছের ‘হাশেম’, একাকীর ‘সবুজ’, অন্তর্গত সংঘাত-এর ‘কবি’, তবুও সহবাস-এর ‘এক’-- এদের সাথে আমাদের এক দারুণ মিল আবিষ্কার করে আমরা পরবর্তীকালে চমকিত হয়েছি। চরিত্রগুলো সর্বদা আপনার ভিতরে বাস করে অথবা কখনো বাস করেছে, এ কারণেই আমাদের ভিতরকার জ্বালাও-পোড়াও বোধটা বরাবরই স্পর্শ করতে পারতেন আপনি, দিতেন সে বোধের বিকাশের জন্যে যথেচ্ছ পৃষ্ঠপোষকতাও। আমরা কখনোই ভুলতে পারব না মধ্যাহ্ন সাক্ষাতে প্রাপ্ত প্রসাদরাজির কথা। সাক্ষাতের খানিক পরই সালাদসহ গরম গরম পুরি-সিঙারা হতো। নতুন কবিতা হতো-- আপনার, বাচ্চু ভাইয়ের, আশিকের, রোকনের (অবশ্যই) ও আমাদের (যার যার ট্যাঁকে থাকত)। অভ্যাগতরা সংখ্যায় কম হলে বাসা থেকে আপনার একার জন্যে আসা টিফিন ক্যারিয়ারেই চলত যৌথহাতের ওঠানামা। কবিতাপাঠ যেমন তেমন, খাওয়াটা একটা লয়প্রাপ্তি, বুঝেছি কখনো। আলস্য পেয়ে যেত। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, না-খেলেই কাব্যোৎপাদন ভালো হয়। ঘোর ভালো জমে। (দারিদ্র্য মহান করে তোলে একরকম বয়ান কি এই সুপ্ত কারণেও রেখেছিলেন নজরুল?) যেদিন বন্দোবস্ত হতো না, সেদিন দুপুরে আমরা বহিরাগতরা না-খেয়ে না-দেয়ে, পথের ধারের শুধু টিউকল-নির্ভর। তবু গতি থাকত, পায়ের এবং কল্পনার। নিত্য কবিতার ওই দিনগুলিতে ক্ষুৎকাতর আমরা কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের বুনো বেগুনের স্বাদও নিয়েছি।
কাণ্ডটা দেখ পার্কের ট্যাপটার, যেটা ডাস্টবিন ঘেঁষে, হঠাৎই উথলে উঠেছে প্রেমে। আহা টিউকল, বলবি তো জীবিত আছিস, পেটের পুরোটাই তো প্রায় খালি, যাবার আগে হ্যাঁ ঠিক খেয়ে যাব, পচা বেড়ালের যতই গন্ধ আসুক বিটকেলে, কেননা কষ্টেসৃষ্টে হলেও জলটাই মেলে বিনে পয়সায়। (প্রাগুক্ত)
কিংবা
আমাদের যেখানে সাইনবোর্ড হয়েছে একটা, আশেপাশে তার পেকে আছে অজস্র বনবেগুন, মানুষ যেগুলোকে অখাদ্য সাব্যস্ত করেছে। ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে’ বলে বলে হাতে রক্ত ঝরিয়ে হলেও টকটকে লালরঙ বুনোফলে পেট পুরে, ক্ষুধাকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে যে দিলাম, এটা শহরের এখানেই সম্ভব হলো কেবল এই নার্সারিটার কাছে। (প্রাগুক্ত)
কিন্তু কথা অন্যখানে, তখন আপনি আমাদের মন উপচিয়ে ভালোবাসছেন, যখন তখন আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, চেয়ে নিয়ে একের পর এক কবিতা ছাপছেন। এদিকে আমাদের বিস্তর পাখা গজাচ্ছে। আজকের বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আমরা অনেকেই তখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুদ্রিত, দেশের বাইরেও। বিশেষ করে বৃহস্পতি-শুক্রবারগুলো ঢাকাই দৈনিকের নতুন কালির গন্ধমাখা আমাদের তাজা লেখাগুলোর আবেগাবেশে মৌ মৌ হয়ে থাকত। কী দারুণ উষ্ণতা! এভাবে ক্রমশই আমরা কবিতার দিকে গ্রস্ত হয়ে পড়ি। নিজেদের সীমানাকে একটি বিশিষ্টতার আঁচড় দিয়ে দেগে আমরা আমাদেরই বিশেষ ভেবে বসি। একে অহংকারের মতো হয়ত মনে হয় কিন্তু এ সে হয়েও ও না, অন্যকিছু। প্রথম যৌবনের উত্তুঙ্গতা। ভাবুন তো একবার, আমরা উলুকঝুলুক উড়ছি আর আপনার কবিতার ব্যাপারে রীতিমতো নীরব থাকছি অথবা তীব্র উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করছি। একেই বলে যার খাই-পরি, তারেই আবার ল্যাঙ মারি। আপনি হয়ত এর সবই বুঝতেন। বুঝতেন বলেই স্বভাবসুলভ মহত্ত্বে এবং ‘শিল্পজগতের সমসাময়িক বিবেচনাকে গণনায় নিতে নেই’ ধরে নিয়ে এই নীরবতাকে থোরাই কেয়ার করতেন। আবার এ-ও হতে পারে আপনি কখনোই বুঝতেন না। কারণ চারদিক থেকেই আপনার একটা প্রতিষ্ঠা ছিল। প্রতিষ্ঠিতদের চোখের উপরে একটা অদৃশ্য রঙিন চশমা সেঁটে থাকে। এই আবরণের মধ্যস্থতায় প্রায়শ তাঁরা অপ্রতিষ্ঠিতদের মূল্যায়নের সার-অংশ উচ্ছ্বাসের আড়াল থেকে আলাদা করে নিতে পারেন না।

৩. বীক্ষণবার

আপনি জানেন, বীক্ষণময় শুক্রবারগুলো ছিল উৎসবের দিন আমাদের, সচল-অচল সব ধরনের লেখকের। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই প্রস্তুতি চলত, পরদিন কোন কোন লেখা পড়া যায় সে নিয়ে। রাত জেগে নতুন করে কিছু লিখবার চেষ্টা, না-হলে পুরোনো খসড়াকে ভাঙা আবেগের তুলি দিয়ে নতুন করে ঘষেমেজে সারিয়ে তোলা। বীক্ষণ ছিল ময়মনসিংহের নবীন-প্রবীণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক মিলনমেলা, আজও। অনিবার্য কারণে একদিন না-আসা গেলে সাংঘাতিক খারাপ লাগত। মনে হতো আমাকে বাদ দিয়ে সাহিত্যের খেয়া হয়ত পৌঁছে যাচ্ছে সিদ্ধির ঠিক ওপারে। মনে এতদবিবেচনা একবার ঠাঁই পাবার পর থেকে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ (মসাস)-এর সর্বাপেক্ষা কার্যকর প্রকল্প বীক্ষণ-এ আমরা ছিলাম খুব নিয়মিত। তখন বীক্ষণ বসত সি. কে. ঘোষ রোডে অবস্থিত অনুগ্রহে পাওয়া প্রেসক্লাবের একটি কক্ষে। এখানে এসে সাহিত্যের জন্যে বিনাশ্রম, সিকিশ্রম, আধাশ্রম, পৌনেশ্রম, পূর্ণশ্রম-- সব ধরনের সাহিত্যসংস্রবপুষ্ট লোকজনেরই চেহারা দেখেছি সামনাসামনি। ময়মনসিংহে লভ্য তাবৎ ঘরানার লেখকেরই আনাগোনা ছিল একে ঘিরে, হয়ত এখনো আছে। পূর্বনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কবিতা-গল্প-ছড়া পাঠ শেষে বীক্ষণের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত হলেও তরুণতর আমাদের অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কখনো কখনো পরদিন সকাল পর্যন্তও গড়াত, মনে পড়ে। বিষয় ও ভূগোলে সেসব অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে থামবে আমরা কেউই পূর্ব থেকে জানতাম না কিছু। প্রেসক্লাব ছেড়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট হয়ে বীক্ষণ ব্রহ্মপুত্র তীরের কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য মহারাজের বাগানবাড়ির তপোবনপ্রায় পুণ্যচ্ছায়ারাশি ঘেঁষা মসাস-এর নিজস্ব ডেরায় স্থানান্তরিত হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই আমাদের দেহমনগাছে নতুন নতুন ডালপাতা ছড়াল। মসাস-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বীক্ষণের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক আপনার বিশেষ নজর থাকত আমাদের প্রতি। সংগঠনের আগামী সময়ের সৈনিক হিসেবে আমাদের তৈরি করবার একটা চেষ্টা আপনার মধ্যে ক্রিয়াশীল দেখেছি বরাবর। আপনার পরামর্শ ও নির্দেশ আমরা মেনে চলতেই চেষ্টা করতাম। এক দু’বার করে আমরা অনেকে আহ্বায়ক হিসেবে বীক্ষণের হালও ধরেছি। কিন্তু নবিশ সংগঠক হিসেবে আমাদের অনেকেরই ব্যর্থতা ছিল, ছিল সংগঠক হবার ব্যাপারে অনাগ্রহও। কারো কারো চাওয়াও ছিল না যে বীক্ষণ ভায়া হয়ে একদিন মসাস-এর বড়ো সংগঠক হব, বরং আমাদের স্বপ্ন ছিল ভালো কিছু লিখবার। কেউ কেউ সংগঠক হয়েও অঢেল লিখতে পারেন, আপনি যেমন। আমাদের কারো কারো মনে হতো, এ কাজটা সবার নয়, আমাদের জন্ম হয়েছে শুধু লিখবারই জন্যে। যে কারণে সংগঠনের নকশা অনুযায়ী পরিচালিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেও ভিতর দিক থেকে আমরা অনেকেই ছিলাম সংগঠনবিরোধী। ফাঁক খুঁজতাম কী করে প্রতিষ্ঠানের মাপ দেয়া সীমার বাইরে পা রাখা যায়, স্বাধীনভাবে সমমনাদের সাথে বেহিসেবী সময় যাপন করা যায়। বীক্ষণের দ্বিতীয়ার্ধে অনুষ্ঠিত স্বরচিত রচনার পাঠপর্ব আমাদের দারুণভাবে আকর্ষণ করলেও প্রথমভাগের আলোচনা সবসময় ভালো লাগত না ওর প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র এবং বিষয় নির্বাচনজনিত বদ্ধতার কারণে। ওখানে এমনকি ঈদানুষ্ঠানের তাৎপর্য, দুর্গাদেবীর মাহাত্ত্ব্য-- এসব বিষয়েও আলোচনা হতো। যতদূর খবর রাখি আজও হয়। একইসঙ্গে মক্কা-মদিনা-গয়া-কাশী-কপিলাবাস্তু-লুম্বিনী-বেথেলহেম-নাজারেথের ছবি ওখানে আঁকা হতো যতটা প্রতিষ্ঠানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্যে ততটা সাহিত্যিক প্রয়োজনে নয়, আমরা বুঝতাম। এসব আমাদের কখনোই টানত না, আজও তরুণদের টানে না। তার মানে এ নয় যে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি না। আমরা ভিতর দিক থেকে বেড়ে ওঠবার জন্যে আরো প্রাসঙ্গিক, ব্যবহারিক ও গতিশীল আলোচনা করবার ও শুনবার জন্যে সদা মুখিয়ে থাকতাম। সেসব আলোচনার কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপছবি থাকত না, কিন্তু প্রাণমূলে রস থাকত। আনুষ্ঠানিকতায় আমরা যারা অনেকটাই অপ্রস্তুত ও নীরব, ব্রহ্মপুত্র ধোয়া সাহেব কোয়ার্টার পার্কে গিয়ে বসলে আমরা সেখানে সবাই সরব। আমাদের এই আকর্ষণ সবকিছুকে ছাপিয়ে যেত।

আপনাকে মনেপ্রাণে সদাতরুণ বলেই জানি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও বেশি। তরুণ মসাস কর্মকর্তা গ্রন্থপ্রিয় আহমদ সাইফ, সুনন্দন ইয়াজদানী কোরায়শী, স্বরশিল্পী আমজাদ দোলনও। কিন্তু সর্বোপরি আপনারা ছিলেন মুরুব্বি, সাংগঠনিক জন। মাঝে মধ্যে বীক্ষণ শেষে আপনারাও বসতেন পার্কে, কিছুক্ষণ। নদীর জল ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে চুল ওড়াতে ওড়াতে ওখানে চা-সিঙারা, বাদাম-চানাচুর ইত্যাদি হতো। কিন্তু মত্তআড্ডা যাকে বলে সেটা জমত না বস্তুত। আমাদের কাছে আপনারা ছিলেন স্থানীয় অভিভাবক। আমাদের পুরোমাত্রায় খুলে যাওয়া সম্ভব হতো কাজেই আপনারা পিঠটান দেবার পর। তখন ভালো করে ভেবে দেখি নি, কিন্তু এতদিনে ওসব জমায়েতকে রোদে মেঘে কোলাকুলি বলে মনে হয়, মুহূর্ত-স্ফূরিত।

নব্বইয়ের দশকের শুরুর কয়েক বছরে বীক্ষণে তরুণ ও তরুণতরদের এক অপ্রতিহত জোয়ার ছিল। লেখালেখিতেও বেশি সরব ছিলেন ওই তরুণরাই, সবসময়ই যা হয়। শাহীদা হোসেন রীনা, আশিক আকবর, আহমেদ শফিক, আশিক সালাম, আহমদ শাহাবুদ্দিন, চয়ন বিকাশ ভদ্র, তাসাদ্দুক ফাহিম, অমল রজক, তোফায়েল তফাজ্জল, সালাহউদ্দিন পাঠান, আবদুল মতিন, সরকার আজিজ, পলাশ চৌধুরী, তাসলিমা রহমান, আশরাফ রোকন, দিলীপ সেন, মোস্তাক বিবাগী, মোহাম্মদ ইয়াকুব, নাজমা মমতাজ, রীনা পণ্ডিত, হাদিউল ইসলাম, মাসুম মোকাররম, শামীম পারভেজ, মশিউর রহমান খান, শতাব্দী কাদের, রওশন ঝুনু, মিনহাজ উদ্দিন শপথ, সমুদ্র সেলিম, মামুন মাহবুব, জুয়েল কবীর, ওসমান গণি, মনো জসীম, ধনেশ পণ্ডিত, তন্দ্রা সরকার, রাজিয়া সুলতানা, মার্জিয়া সুলতানা নীলিমা, হিশাম আল মহান্নাভ, ফাতেমা নার্গিস বীণা, রোকসানা বিলকিস, অনিন্দ্য জসীম, স্বাধীন চৌধুরী, মামুন মোয়াজ্জেম, আলী ইউসুফ, শাবিহ মাহমুদ, শাহিন লতিফ, গনী আদম, সফেদ ফরাজী, বিল্লাল মেহদী, অতনু তিয়াস, চন্দন সাহা রায়, সিদ্ধার্থ টিপুসহ আরো অজস্রজন আমরা। পার্ক বা সংগ্রহশালার বিকল্প-বীক্ষণ শুরু হতো এ তালিকার একটা গুরুঅংশকে নিয়ে। ওখানে আমরা থাকতাম পুরোমাত্রায় ব্যবহারিক, কবিতাকেই ভালো করে চিনবার-জানবার চেষ্টায় মত্ত। নানাজনের মুদ্রিত-অমুদ্রিত কবিতা থেকে পাঠ, তার ভালোমন্দের নিবিড় পর্যালোচনা, বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠের অভিব্যক্তি শেয়ার, ইত্যাদিতে মত্ত থাকতাম আমরা। কবিতা বিষয়ে নানারকম কর্মশালাও হতো ওখানে। পাঁচ-দশজন মিলে বারোয়ারি কবিতাও লিখেছি আমরা। প্রতিজন এক দু’লাইন করে লিখে একটি কবিতার পূর্ণ রূপ দেবার সেসব চেষ্টা যুগপৎ আনন্দদায়ক এবং শিক্ষণীয় ছিল। ক্রমশ কমতে কমতে জমায়েত দু’তিনজনে এসে ঠেকলে আমরা অন্য মঞ্জিলমুখী হতাম। তারওপরে হতাম একা। হায় একা হওয়া আমাদের, বিরল ভাবনা।

উল্লিখিতদের অনেকেই আজ আর লেখালেখির সঙ্গে নেই, অনেকেই ক্রমশ নিভে গেছেন অথবা নিভতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু যুগপূর্বকালে এদের সবার ভিতরেই কমবেশি সৃজন-আগুন ছিল। ওই অন্তর্গত অগ্নির সম্মিলিত উত্তাপ আমরা সকলেই অনুভব করতাম সমভাবে, সংবিধানবিহীন আমাদের সংঘপ্রয়াসে।

৪. নটনটীকলা

নামত ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের প্রকল্প সংখ্যা ছিল অনেক, চর্মচক্ষে যার বেশ কটিরই আমরা কোনো কার্যক্রম দেখি নি। বীক্ষণের পর সক্রিয় প্রকল্পকটির আরেকটি ছিল নাট্যপ্রকল্প। এই প্রকল্প আমার অন্য আরেক নেশা ও অভ্যস্ততাকে অর্থময়তা দিয়েছে। এসেছি সাহিত্য করতে, সাহিত্যের পাশাপাশি অভিনয়ে যুক্ত হতে পারা এক ভ্রমণে দুই সওদা। বীক্ষণের যারা, তারা সবাই এ প্রকল্পকে অওন করে নি। না-করতেই পারে। আগ্রহ ও দক্ষতা যার যেমন, তার তেমনই ভালোমন্দ লাগা, আপনপর ভেদ। প্রয়োজনেই এখানে অন্য সেট-আপ। আপনার মাধ্যমে অভিনয় ও অন্যান্য নাট্যকলাকৌশলের সাথে দীর্ঘদিন থেকে যুক্ত অনেকেই এ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। আমাদের সময়ে আমরা পেয়েছি নাট্যঅন্তপ্রাণ এমএম ফেরদৌসী, সালেহউদ্দিন আহমেদ, এলআর বাবুল, ফেরদৌস হীরা, শাহাদাত হোসেন খান, মোতাহার হোসেন বাচ্চু, সারোয়ার চৌধুরী প্রমুখকে। এঁদের মতো বিশিষ্টদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে পারা, সে এক বড়ো প্রাপ্তি ছিল আমার।

এখানেই সংস্পর্শে আসি আনোয়ারা সুলতানা, নাজনীন পাপ্পু, সাইফুল এহসান জহির, আকলিমা রহমান, শবনম জামান, শম্পাসহ আরো অনেকের। রহস্যময় আলো-আঁধারিতে স্বচ্ছন্দ নটনটীদের এ একেবারেই অন্য আরেক জগৎ। কলেজ ক্যাম্পাস ও উপজেলার অডিয়েন্সের সাথে আগে অল্পবিস্তর পরিচয় থাকলেও জেলা শহরের অডিয়েন্সের সামনে নট হিসেবে মঞ্চে অবতীর্ণ হবার অভিজ্ঞতা আমার আপনারই দেয়া। এ হয়েছিল বলেই যেকোনো অডিয়েন্সকেই আমার ভয় পেতে হয় নি পরে। প্রকল্পটি নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তর কথা হতো হলের ভিতরে ও বাইরে। এর একটি কারণ এরকম ছিল যে, মসাস-এর নাট্যপ্রকল্পে আপনার নাটক ছাড়া আর কারো নাটক কখনো অভিনীত হতো না। আমার অভিজ্ঞতায় অন্তত তা নেই। যদিও নির্দেশক হিসেবে অন্যদের অংশগ্রহণকে ওখানে স্বাগতই জানানো হতো। অনেকে বলতেন, প্রকল্পটি আছে কেবল নাট্যকার ফরিদ আহমদ দুলালের নাটকের ল্যাবরেটরি হবার জন্যে। স্পষ্ট ও সঙ্গত এই মন্তব্যের সাথে আমিও সহমত পোষণ করতে বাধ্য হতাম, কিন্তু কাজও করতাম। ভালো লাগত বলে।

পরবর্তী সময়ে নাট্যকর্মের সাথে পেশা ও নেশাগত কারণে ঘটা অবিপুল সংস্রবের মাধ্যমে ক্রমশ বুঝেছি মসাস-এর নাট্যক্রিয়া ছিল বড়ো ছকে বাঁধা, পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে খানিক দূরে। দৃশ্যকাব্যের আরিস্টটল প্রদত্ত তত্ত্বের এক ঢিলেঢালা অনুসরণ প্রচেষ্টা ছিল ওর আদি-মধ্য-অন্ত জুড়ে। ভরত কথিত আঙ্গিক, বাচিক, আহার্য ও স্বাত্ত্বিক অভিনয়ের সীমাকে খানিক বাঁকা-সোজা করে ওর পথচলা। ঘোষণা দিয়ে না-হলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এ সীমা অতিক্রম করাকে ওখানে যেন এক শিল্পপাপ বলে ভাবা হতো। অথচ শিল্প বরাবর তাদেরই দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে বলে জানি, যারা বেচারীর পেছন দিক দিয়ে যুগ্ম-আঙুল চালায়। শিল্পদেবী গৎ পছন্দ করে না, একদম না। নিত্য নতুনের আকাঙ্ক্ষায় তার ধ্রুপদী সংজ্ঞাকে যে যথেচ্ছ বলাৎকার করতে পারে, মাঝে মধ্যে তার দিকে দাঁত কিড়মিড় করে তাকালেও বস্তুতপক্ষে তার শয্যাপাশই শিল্পদেবীর সবচেয়ে বেশি কাম্য। এ বিবৃতি সকল শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দেবীর সুবিস্তৃত জীবনীর অংশত ঘেঁটে সাধারণীকরণের মাধ্যমে পাওয়া এই সারই পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে আমার শিল্পদর্শন।

যাহোক, সেবার আপনার ‘কোঁচ’ নাটকের মহড়া চলছিল। ওরই এক বানগ্রস্ত চরিত্র রূপায়ণের ছবক নিচ্ছিলাম আমি। মহড়া শেষে আপনি আমার হাতে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত কিছু লিটল ম্যাগাজিন ধরিয়ে দিয়ে সংক্ষেপে সেসবের ওপর আলোচনা লিখে মসাস-এর তৎকালীন সহ-সভাপ্রধানদের একজন ও দ্বিতীয় চিন্তার সম্পাদক জনাব ইফফাত আরার কাছে পৌঁছাতে বলেছিলেন। সম্পাদক মহোদয় ওগুলো রিভিউ করিয়ে দেবার জন্যে আপনাকে অনুরোধ করেছিলেন। আপনি নতুন কাউকে এ কাজের জন্যে তৈরি করতে চাচ্ছিলেন। আপনি সাংগঠনিক গুরুজন, আমার প্রথম সম্পাদক, অতএব আপনার আদেশ শিরোধার্য এটা মনে করে যতটা না, তার চেয়ে বেশি ওই কাগজগুলোর ভিতরে সুপ্ত আগুনের উত্তাপ আহরণের স্বাভাবিক কৌতূহলেই দায়িত্বটি মাথা পেতে নেই। কালক্রমে মাথার ভার ওই বস্তুরাজির ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিই আমূল মাথাটিই। জনান্তিকে বলি, এটি ছিল পূর্বকথিত সেই সুড়ঙ, যাতে প্রবিষ্ট হয়ে খুঁজে পাই অন্য এক তীব্র আলোর জগৎ। যা আমাকে সাহিত্যপাড়ার এক ইঁচড়ে পাকায় পরিণত করে তবে ছাড়ে অথবা আজও যা ছাড়ে নি। এই জানালা দিয়ে আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখবার একটি ফুটো পেয়ে যাই, যে ফুটো পথে পেঁচা-প্রান্ত-সংবেদের সংস্রবপুষ্ট ক্যাম্বিসধারী আশিকের ছোলা মাথার পাশে ওরকম আরো আরো মুখাবয়ব ভেসে ওঠে। আশিককে প্রথমবার দেখেই মনে হয়েছিল, এঁর সংস্রবে যাওয়া গেলে আখেরে কোথাও ভরদুপুরে অথবা অপরাহ্ণে কবিতার সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। অবশ্য পরে সেটা হয়েওছিল নিরুদ্দেশ ভ্রমণকালে। সেটা বিনা টিকিটে, ফাঁকা পকেটে, মেইল ট্রেনে চড়ে জামালপুর ভ্রমণের তিনদিনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সময়, যদিও যাত্রাপথে পিয়ারপুরের এক শটিবনের কাছে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া প্রেমের ঠিকানা।

৫. বিকল্প জানালা

আপনার মনে না-ও থাকতে পারে যে, আলোচনাটি লিখবার কাজ দিনকয়ের ব্যবধানে শেষ করে এনে সরাসরি সম্পাদকের দপ্তরে না পৌঁছিয়ে আপনাকে দিলে আপনিই ওটি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। লেখাটি রাইসুল মুসাফির ছদ্মনামে দ্বিতীয় চিন্তার ১৯৯২-এর প্রথম দিকে প্রকাশিত কোনো এক সংখ্যায় ছাপা হয়। ওটি ছিল জীবনের প্রথম কোনো সাহিত্যপত্র, সাহিত্য বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন তথা সাহিত্যকর্ম বিষয়ে প্রকাশোদ্দেশ্যে আলোচনা লিখবার আমার কম্প্রহস্ত প্রয়াস। পরে কপি সংগ্রহের জন্যে সেনবাড়ি রোডে অবস্থিত শান্ত-নির্জন এল প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি ইফফাত ম্যানসনে গেলে এর প্রবীণ সম্পাদক ইফফাত আরার সাথে মুখোমুখি পরিচয় ঘটে। লেখাটির প্রশংসা, উষ্ণ ব্যবহার এবং পরবর্তী সংখ্যার জন্যে লিটল ম্যাগাজিন আলোচনা লিখবার অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়া ছিল রাইসুল মুসাফির এবং প্রকারান্তরে মুজিব মেহদীর জন্যে বড়োসড়ো এক প্রশ্রয়। পরে আরো যাতায়াতে ক্রমশ ওই কাগজটির সঙ্গে আমার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায় মাসিক হাজার টাকা রফায়। একজন বোহেমিয়ান সাহিত্যগৃধ্নুর জন্যে এটি ছিল এক শাপে বর।

যাহোক, সে সময় দ্বিতীয় চিন্তা সম্পাদকের দেশমুদ্রণ নামে কুটিরশিল্পসদৃশ স্বল্পায়োজনের এক লেটারপ্রেস ছিল বাড়ির চৌহদ্দিতেই। এর যা সম্ভাব্য উৎপাদন নিজেদেরই ব্যবহারে লাগত। কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছিল না দেশমুদ্রণের। দ্বিতীয় চিন্তা ছাড়াও বিভিন্ন ফাঁকে-অবসরে এখানে আর যা যা কাজ হতো যেমন অনন্যা সাহিত্য পরিষদের অনিয়মিত প্রকাশনা ‘মৃত্তিকা’, বীক্ষণের নিয়মিত মাসিক ভাঁজপত্র ‘বীক্ষণ’, সাহিত্য সংসদের প্রকাশনা ‘স্বরচিত’ ও অন্যান্য বিভিন্ন অনিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থাদি ; সেসবের মুদ্রণ খরচ বাবদও প্রায়ই কোনো মূল্য পরিশোধের বালাই ছিল না। এককথায় দেশমুদ্রণের পুরো সেট-আপটিই ছিল সাহিত্যের জন্যে নিবেদিত। ছিমছাম দ্বিতল ইফফাত ম্যানসনের প্যাটার্নিক ইংরেজি এল-এর ছোটবাহুর লগ্ন হয়ে বড়োবাহুর সমান্তরাল দৈর্ঘ্য নিয়ে অস্তিত্বশীল টিনের একচালা প্রেসঘরটিই এরপর থেকে হয়ে ওঠে আমার প্রতিদিনকার অফিস। নটা পাঁচটা নয়, যতটা খুশি থেকে যতটা বাসি। ক্রমাগত স্নানে স্নানে স্নাতকোত্তর হবার ইচ্ছেয় তখনো আমার ছাত্রত্ব সচল। কিন্তু প্রেসাফিসের ছোট্ট টেবিলে ক্লাসের বই কখনো প্রবেশাধিকার পায় নি। চৌদিকে মুখ ব্যাদান করা সাহিত্যপ্রয়াস যত, চুরি-ধার-ক্রয় মাধ্যমে আহরিত নতুন-পুরানো বইপত্তর, ও-টেবিলে খোলা হয়, বন্ধ হয়। বিচিত্র সব বইয়ের ঘ্রাণে তখন আমরা দিশেহারা। ওখানকার দায়িত্বের মধ্যে ছিল দ্বিতীয় চিন্তা সম্পাদনায় সহযোগিতা দেয়া-- লেখা সংগ্রহ ও প্রস্তুত করা এবং প্রেসের তিনজন লোককে কাজে লাগিয়ে যথাসম্ভব মুদ্রণবিভ্রাট মুক্ত অবস্থায় দ্বিতীয় চিন্তার প্রকাশ নিশ্চিত করা। এজন্যে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ যথা কাগজ-কালির যোগান দেয়া, লেখক-প্রদায়ক এবং নিয়মিত-অনিয়মিত পাঠকদের উদ্দেশ্যে পত্রিকার বুকপোস্ট প্রেরণ করা ইত্যাদি। সম্পাদক মহোদয় কাগজটির পেছনে যে টাকা ব্যয় করতেন তার এক দশমাংশও ফেরত পেতেন না। মাত্র গোটাকয় সটাক গ্রাহক ছিলেন বলে জানতাম। প্রায় পুরোটাই যেত বিনামূল্যে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন লেখক ও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের দপ্তর হতো এসব বুকপোস্টের অভিমুখ। ফেরত যেটা আসত সেটাও অর্থমূল্যহীন কিন্তু অমূল্য সব লিটল ম্যাগাজিন। অ্যাসাইন্ড ওয়ার্কের আওতায়ই রাইসুল মুসাফিরকে এসব কাগজের আগাগোড়া পড়তে হতো, পরের সংখ্যার জন্যে সমালোচনা লিখতে। রাখাল সর্দারকে নিকট উদ্যানের গল্পসল্প লিখতে বিভিন্ন দিকের খোঁজখবর রাখতে হতো। দ্বিতীয়োক্ত কাজে সচেষ্ট থাকত স্বরিত ইমন (আশরাফ রোকন) ও আকাশ রেহমান (মশিউর রহমান খান)ও। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের চোখ-কান খুলে গেল বিস্তর। বাংলাভাষায় লেখালেখি করেন এমন সিংহভাগ তরুণ-তরুণীর চলন-বলন-কৌশল এবং রাগী-তেজি ও প্রথাকে অস্বীকার করবার স্পর্ধাধারীদের সাথে আন্তরিক এক দহরম-মহরমও তৈরি হয়ে গেল। নিয়মিত পত্রালাপের ভিতর দিয়ে সেসব সম্পর্ক আবেগায়িতও হয়ে উঠল কোনো কোনো দিকে।

এখানেও আমি একা নই। একে একে লেখকবন্ধুদের সবারই ডেস্টিনেশন লিস্টে সেনবাড়ি রোড-দেশমুদ্রণ যুক্ত হয়ে গেল। আসতেন আপনিও। প্রধানত দোতলায় সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে হলেও নিচতলায় আমাদের সাক্ষাৎ দিতে ভুলতেন না কখনো। কিছুদিনের মধ্যে অনেক নতুন মুখেরও আনাগোনা শুরু হলো। পরিচিতির সীমা অতিক্রম করে তাদের কেউ কেউ বন্ধুত্বের আসনও দখল করে নিল। সবাই মিলে কাজ সামলাই, আড্ডা দিই, বিড়ি-চুরুট ফুকি, যথেচ্ছ চেঁচাই, প্রেম করি, সাহিত্য মারাই এবং একসময় দলবেঁধে রেলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বোহেমিয়ানপুরের দিকে মনস্থ হই। জগৎ-জীবন জানবার-বুঝবার ওইসব এলোমেলোমিকে এখন যুগপৎ মহান এবং মহান-নয় বলে মনে হয়। ওই যাপনবিদ্যা পরে অনেক কাজে দিয়েছে, দিয়েছে ক্লান্তিও। ওই কয়েক বছরে লিটল ম্যাগাজিন এবং পত্রমাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সমসাময়িক লেখকদের সাথে যে যোগ তৈরি হয় তারই সাজশে দ্বিতীয় চিন্তায় পত্রস্থ হন বন্ধুজন হাফিজ রশিদ খান, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, হেনরী স্বপন, মোস্তাক আহমাদ দীন, ঈষৎ মৃত্তিক (পরে টোকন ঠাকুর), জফির সেতু, মাহবুব লীলেন, পাঁশু প্রাপণ, আকমল হোসেন নিপু, মারুফুল আলম, সৈকত হাবীব, আহমেদ কায়সার, ফজলুর রহমান বাবুল, সৌমিত্র দেব, রজব বকশী, সৌমিত্র দেব, সাদী তাইফ, মাসুদুল হক, রবিউল করিম, জাফর আহমদ রাশেদ, আহমেদ বাদল প্রমুখ। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখেন দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য, কল্যাণ ভট্টাচার্য্য, মানস কুমার চিনি, তৈমুর খান, সুবীর সরকার, ইমদাদুল হোসেন, রুহুল আমিন প্রমুখ। দ্বিতীয় চিন্তায় কখনো লিখেন নি, কিন্তু কর্ম কিংবা ভ্রমণ সুবাদে ময়মনসিংহ এলে অবশ্যই আমাদের খোঁজখবর করতেন এবং বিকাশলক্ষ্যী প্রণোদনা বিলিয়ে যেতেন সর্বকবি রাজা হাসান, স্বদেশ বন্ধু সরকার, জুয়েল মাজহার, আলমগীর রেজা চৌধুরী প্রমুখ। ক্রমশ আমরা তরুণ লিখিয়ে আড্ডারুরা ছড়িয়ে পড়ি বাংলাভাষাভাষী বিভিন্ন প্রান্তে, দেশ বিদেশের ছোটকাগজের ভূঁই ফুড়ে। সংবাদপত্রে সাহিত্য করা আমাদের ক্রমশ অপছন্দ হতে থাকে। আমাদের অহংকার আরো বাড়ে। যত্রতত্র ফুটতে তখন আমাদের ঘোর আপত্তি। টলটলে (আর্সেনিকমুক্ত) স্বচ্ছজলের নিষ্কলূষ পুষ্করিণী না হলে সে জলে আমাদের পদ্ম হতে রুচি হয় না। সিনিয়রদের মনে হতে থাকে রক্ষণশীল, ঘরকুনো, দূরের দ্বীপ। কিন্তু এ দূরত্ব ছিল নিছক সাহিত্যিক, মানসিক মোটেই নয়। সিনিয়রদের সাহিত্যসংস্পর্শ বর্জিত আমরা ছিলাম না তাই বলে। শোনা-পড়া দুইই চলত। তাঁদের সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নের চেষ্টাও আমরা করেছি নিয়মিত। আপনার ‘লাবণ্য ছুঁয়েছি তোমাকে’ ও ‘জলের গহীনে রোদ’ বিষয়ে লিখেছি আজকের বাংলাদেশ ও দ্বিতীয় চিন্তায়। লিখেছি ময়মনসিংহের কথাসাহিত্যিক হারুন অর রশীদ, কবি সাব্বির রেজা, কবি সোহরাব পাশা, সাহিত্যিক-সম্পাদক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর বই নিয়েও। অবশ্য এসবের পেছনে মূল্যায়ন চেষ্টারও অধিক নিজেকে তৈরি করবার প্রয়োজনটিই কাজ করেছে বেশি। সেসব লেখায় নিজের রুচির সঙ্গে যায় নি বলে অনেক বিরূপ কথাও বলেছি। কিন্তু তা বলে কখনো মুখে কালি ছিটিয়ে দেন নি। এ ধরনের সমর্থনগুলোই একটু একটু করে যুগিয়ে গেছে অমিত সাহস। আমরা যথেচ্ছ চড়ে বেড়িয়েছি সুবিস্তৃত সাহিত্যসংস্কৃতি মাঠে, তাজা ঘাস খাবার ও খাওয়াবার মনোলোভে। আজও আমরা অনেকেই চড়ে বেড়াচ্ছি, সে শক্তি-সাহস-প্রণোদনা অনেকটাই যে প্রথম যৌবনে ময়মনসিংহে লাভ করেছিলাম, সে ব্যাপারে মনে আজ আর সন্দেহমাত্র নেই।

৬. চন্দ্রাবতী প্রসঙ্গ

বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার পাতুয়ারি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বাংলাভাষার কবিকুলভুক্ত প্রথম পোড়খাওয়া শিল্পসফল নারী ষোড়শ শতকের চন্দ্রাবতী আমাদের অহংকার। দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকাভুক্ত ‘দস্যু কেনারামের পালা’, ‘মলুয়া’ (মতান্তর আছে) পালার রচয়িতা এই কবি। মনসা-ভাসান (১৫৭৫)-এর লেখক দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চিরকুমারী চন্দ্রাবতী এছাড়াও বাংলা রামায়ণ ও মনসা দেবীর গান রচনা করেছিলেন। তাঁর জীবন-প্রেম-সাধনা নিয়ে মৈমনসিংহ গীতিকায়ই ‘চন্দ্রাবতী’ নামে নয়ানচাঁদ ঘোষ কর্তৃক সতের শতকে রচিত ৩৫৪ ছত্রবিশিষ্ট আরেকটি পালা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই মহজ্জীবন সম্পর্কে কমবেশি জেনে আমরা তরুণরা নিজেদের তাঁর সন্তান ভেবে গৌরব বোধ করলাম। শিবপূজক চন্দ্রাবতীর স্থাপত্যস্মারক ফুলেশ্বরী তীরের মঠ আমাদের অনেকেরই এখনো দেখা বাকি। তবু আমরা ঠিক করলাম, আমাদের গৌরববোধটিরও একটি স্থায়ী ভাষিকস্মারক স্থাপন করা যেতে পারে। এই মর্মে আমরা তরুণ কবিতাকর্মীরা একমত হলাম যে, আমাদের বিভিন্নজনের কবিতাগুচ্ছ সমন্বয়ে একটি প্রকাশনা হবে, যার মোড়কনাম হবে ‘চন্দ্রাবতীর কয়েকজন সন্তান’ অথবা ‘চন্দ্রাবতীর সন্তানেরা’।

দ্বিতীয়োক্ত নামটি নেয়া হলে দাবি করা হয় কেবল আমরাই সেই গৌরবের অংশীদার। তাই আমরা প্রথমোক্ত নামটি নিলাম। সিদ্ধান্ত হলো কবিতাগুচ্ছ ছাড়াও এতে থাকবে গ্রন্থে অন্তর্ভুক্তদের পোর্ট্রেট ও তাঁদের কবিতা বিষয়ক একটি নিবন্ধ। ঠিক হলো চিত্রশিল্পী দিলীপ তালুকদার পোর্ট্রেট আঁকবেন এবং বাচ্চু ভাই নিবন্ধ লিখবেন। আমাদের তাবৎ প্রস্তুতি সম্পন্ন, কিন্তু বাচ্চু ভাই লেখাটা দিচ্ছেন না। তাঁর নিষ্পৃহতায় আমাদের উদ্যোগটি ভেস্তে যেতে বসল। আমরা পরিকল্পনামতো গ্রন্থটি করবার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। তাই বাচ্চু ভাইয়ের আশা ছেড়ে শরণ নিলাম দুলাল ভাই আপনার। আপনি অভয় দিলেন। দিনকয়ের ব্যবধানে ‘বারো কবির কাব্যভুবন : একটি পরিক্রমা’ শিরোনামযুক্ত নাতিদীর্ঘ একটি গদ্য আপনি লিখে উঠলেন। শেষপর্যন্ত ওই লেখাটিসহ ১৯৯৭-এর ফেব্রুয়ারিতে কিশোরগঞ্জের শিল্পী আবদুস সালামের গ্রাফিক্সসম্বলিত হয়ে শাহীদুল ইসলাম বিজুর তত্ত্বাবধানে শাহবাগের বইপাড়া থেকে বারো তরুণের কাব্যপ্রয়াস ‘চন্দ্রাবতীর কয়েকজন সন্তান’ প্রকাশিত হয়। আপনার কাছে আমাদের এরকম ঋণ অজস্র, শোধ করা যাবে না। প্রতিদানের আশায় আপনি সেসব করেনও নি আশা করি।

৭. ভূগোলের যেখানে ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ আপনার শহর, একান্তই আপনার। একথা উপলব্ধিতে আসে আপনার সঙ্গে পথে বেরোলে। সাহিত্য ও এর বাইরের জগতের কত মানুষ যে আপনাকে চিনেন-জানেন, সম্মান-শ্রদ্ধা করেন তার ইয়ত্তা নেই। ধারণা করি, আপনার সম্পূর্ণ পরিচিতিটা ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের কর্মকর্তা, প্রগতিশীল সংস্কৃতি আন্দোলনের কর্মী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কর্মকর্তা, ইত্যাদি অভিধা এবং সাহিত্যকর্মী পরিচয়টির মিশেল দেয়া রূপ। ওই গোটা পরিচিতির কত শতাংশ সাহিত্যকর্মীর (নাট্যকার, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ইত্যাদি) তা মাপবার সহজ সুযোগ নেই, মাপা অবশ্যকরণীয়ও নয়। একজন সক্রিয় সামাজিক মানুষ হয়ে উঠতে হলে কেবল একনিষ্ঠ সাহিত্যকর্মী হলেই চলে না। সমাজ জীবনের আরো নানা প্রয়োজন সামনে এসে দাঁড়ায়, সেসবে সাড়া দিতে হয়, দেন অনেকেই। আপনিও তাদের একজন, সেজন্যে আপনি ধন্যবাদার্হ্য। কিন্তু সবাই জানেন এবং মানেন যে, সাহিত্যকর্মী পরিচয়টিই এর মধ্যে গৌরবে উৎকর্ষপূর্ণ অর্থাৎ সেরা। আপনার বিবেচনাও অন্যরকম হবার কথা নয়। সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে এখানে একটি প্রশ্ন করবার খুব শখ হয় যে, আপনার কি কখনো হিসেব করে দেখতে ইচ্ছে করে না যে নিজের কৃত বিচিত্র ধরনের সাহিত্যপ্রয়াস বাংলাভাষাভাষী সাহিত্যপাঠকের কতভাগের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারা গেছে বা পাঠকের স্বতঃস্ফূর্ত তৎপরতায় আপনা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ? অর্থাৎ আপনার সাহিত্যকর্মী পরিচয়ের ভূগোলটি কতটা প্রসারিত হতে পেরেছে ? মাত্র দেড় দশকের সাহিত্যসংস্রবপুষ্ট আমি, এ প্রশ্ন আমাকে এখনই করতে শুরু করেছি। এর যথার্থ জবাব কখনোই পাওয়া যায় না, কিন্তু প্রশ্নটা নিজের কাছে জারি রাখা গেলে আখেরে বেশ লাভ হয়। আমার মনে হয়, এই কৌতূহলটি আপনার মধ্যে জাগ্রত হলে আপনিও উপকৃত হবেন। প্রকারান্তরে উপকৃত হবে আপনার সাহিত্যকর্মও। এই পথ ধরে ওই সরল জিজ্ঞাসাটিরও যে একটি আপাত সজ্জবাব কখনো মিলে যাবে না, এরকম ধারণা করা আমার কাছে ধ্যানযোগসংঘটনপরিপন্থী বলেই মনে হয়।
পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে নবাববিড়ি টাউন হলের মোড়ে, জানতে চায় কেমন আছ গোল্ডলীফ এবং অতিচেনা শহর ? বেলা দু’টা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা-- এই পরিসরে সড়ক দুর্ঘটনায় এখানে নিহতের সংখ্যা কত ? (প্রাগুক্ত)

1 comment:

চয়ন বিকাশ ভদ্র said...

মুজিব , খুঁজতে খুঁজতে তোমার লেখাটা পেয়ে গেলাম । অনেক ভালো লাগলো । ফিরে গিয়েছিলাম নব্বই দশকের সেই স্মৃতিময় দিনগুলিতে । অনেকের সাথে যোগাযোগ হয় । অনেকের কথা মনে পড়ে ।

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...