Sunday, August 16, 2009

ইতিউতি প্রবাহনা

কবিতা সর্বংসহা এটা মানি, তা সবকিছুই ধারণ করতে পারে, কিন্তু যিনি কবি তার একটা নিজস্ব ঢং দাঁড়িয়ে যায়, আর একেক ঢং একেক ধরনের বক্তব্য ও শব্দকে বেশি ডিমান্ড করে, ফলে কবির যতো কথা বলার থাকে তা তিনি বিশেষ ঢং দাঁড়িয়ে যাওয়া তাঁর কবিতায় বলে নাও ওঠতে পারেন, তখন জরুরি হয়ে পড়ে কবিতার ঢং বদল করা অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে কাজ করা। প্রত্যেক কবিরই কবিতার নিজস্ব ঢং দরকারী। একবার নিজস্ব ঢং বা স্বর আবিষ্কার করবার পর কেউ সেটা বর্জন করতে নাও চাইতে পারেন। তখন বিকল্প পথ থাকে, মাধ্যম পরিবর্তন। এই পরিবর্তন মানে চিরদিনের জন্যে পরিবর্তন নয়। একটি মাধ্যম ছেড়ে অন্য মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে আর কোনোদিনই তিনি ছেড়ে আসা মাধ্যমে কাজ করবেন না তা নয়। অবশ্য নতুন করে শুরু করা মাধ্যমটিতে যদি কেউ দেখেন যে পূর্বের মাধ্যমের চাইতে ভালো ফল উঠছে তবে তিনি ফিরে না-এলেও তেমন কোনো ক্ষতি নেই। বরং ফিরে না-আসাই উচিত। কবি হয়েও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যে কারণে ফিল্ম তৈরি করেন, রবীন্দ্রনাথ শত শত ছবি আঁকেন, অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারটা আলাদা, এ ভদ্রলোকের জন্মই হয়েছিলো সব মাধ্যমে কাজ করবার জন্যে, একটা কোনো বিশেষ মাধ্যমে নয়। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সর্বোচ্চ ফল পেয়েছেন।

হ্যাঁ আমার ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা ঘটে, এবং প্রায়শই, প্রতিদিন কতো কিছুই যে বলবার থাকে আমার, কিন্তু কোনো একটা সময়ে আমার ভেতরে যত বোধ কাজ করে, তার সবই একটা কোনো মাধ্যমে পুরে দিতে পারি না আমি, প্রয়োজন হয়ে পড়ে অন্য মাধ্যমের, কিন্তু অত প্রতিভা কোথায় আমার, আমি তো প্রতিভাহীন, তবু এ রকম ভাবি যে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী, ওরা তো পারে, আঁকিবুকি করতে করতে যদিই বা হয়ে যায় কিছু, আমি জানি চাইলেই সবাই সবটা পারে না, বিশ্বসাহিত্যে ক’জন আর সব্যসাচী আছেন। রবীন্দ্রনাথ কী আর ঘরে ঘরে, কালে কালে জন্মান, জন্মান যে না এটাও আমি জানি, জেনেও চেষ্টা করি করে উঠতে, আমি কালজয়ী হতে পারলাম কি না এ বিচার করে কাজ করলে চলে না, আগে তো কাজ তারপর জয় পরাজয়, ফলে আমি ওটা মেনে কাজ করে যেতে চাই প্রচুর, পাঁচটা করব হয়ত একটিতেও সফল হবো না, হয়ত একটিতে হবো, হয়ত দু’টিতে... হয়ত বা সবকটিতে, আশা করতে দোষ নাই, আমি যদি আশাই করি যে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বা সজনীকান্ত হবো, তাহলে তো আর রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দকে ছোঁয়া যাবে না, আশা এরকম যে আমি রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ থেকে বড়ো হবো, তাহলে অন্তত...

রবীন্দ্রনাথের মতো কখনো কখনো আমিও চেয়েছি যে ছবি আঁকি, কেননা তাঁর মতো আমিও তো পাণ্ডুলিপি কাটাকুটি করি, তিনি যদি পাণ্ডুলিপি কাটাকুটি করতে গিয়ে এতবড়ো শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, আমি কেনো পারব না, এই সাহসেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি ছবি আঁকবার চেষ্টার দিকে কিন্তু সে চেষ্টায় ব্যত্যয় ঘটাতে লেগেছেন রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ শোভন সোম, সম্প্রতি তিনি গ্যালারী-২১ এ আয়োজিত এক সেমিনারে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানালেন যে, আদৌ রবীন্দ্রনাথ পাণ্ডুলিপি কাটাকুটি করতে গিয়ে ছবি আঁকা শুরু করেন নি, একটা প্রচার এইমতো রয়েছে যে, লিখতে গিয়ে বুড়ো বয়সে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেছেন, কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো এই যে ভাষা-সাহিত্য শিক্ষার পাশাপাশি সেই শৈশব-কৈশোরেই রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শিখেছেন নিজ গৃহে, অথচ আমি শৈশবে তো দূরের কথা কৈশোরেও কোনো চিত্রশিল্পীকে সচক্ষে দেখি নি, এ হিসেবে দেখলে আমার হতাশ হবার যথেষ্ট কারণ আছে, তাছাড়া আর যে কাজেই পটু হোক আমার হাত, অন্তত ছবিতে সে পটু নয়, একথা এতদিনে বুঝে গেছি, তবু গোয়ার্তুমির বশেই এখনো দু’একবার চেষ্টা করি না তা নয়। একেবারে হতাশ আমি হতে জানি না, রবার্ট ব্রুসের ওই গল্পটা আমি জানি, এজন্যে বারবার চেষ্টা করি, করে যাব, কারো মন না-পাওয়া গেলেও ঘৃণাটা তো পাওয়া যাবে, এটাও তো একধরনের পাওয়া, যাকে ভালোবাসবো তার আঘাতটাও ভালোবাসতে হবে এবং লুফে নিতে হবে, এরকম যারা বিশ্বাস করে আমি সে দলেরই লোক, আমার কাজেই একটা কিছু হবে, হতেই হবে, একবার তো চিঠিতে এক বান্ধবীকে কল্পনার নারীমুখ এঁকে পাঠিয়েছিলাম, পাঠানোর পর সে নিয়ে যে আমি কত লজ্জায় পড়েছিলাম তা বলে বোঝানো যাবে না, ওকথা মনে হলে এখনো আমি রীতিমতো ঘেমে যাই, চিঠিতে সে বান্ধবীও প্যাঁচিয়ে ঘুরিয়ে একথা বলতে ছাড়ে নি।

আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে চিঠি আঁকতাম আমি, ছবিও লিখতাম। কিন্তু সে এখন আমার নিকটাঙিনায়ই থাকে বলে তার কাছে চিঠি আর পাঠাতে হচ্ছে না। সুযোগ পেলে ওকে কখনো ওগুলো দেখাব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি মনে মনে। কিন্তু তবু এসব ছবিকে ছবি বলবার স্পর্ধা আমার হয় নি। আর তাছাড়া দেখাবার দরকারই বা কী! অজস্র ছবি আঁকব আর ছিঁড়ে ফেলে দেব। শিল্পের পণ্য হয়ে ওঠবার বিরুদ্ধে গোপনেই ইনস্টলেশন করে যাব। আমি কবিতা নিয়েও তো কতবার ভেবেছি এরকম। লিখব আর ছিঁড়ে ফেলে দেব। এ যাবৎ ছিঁড়েছিও কি কম! তবু যে পরিমাণ কবিতার পাণ্ডুলিপি জমেছে, এসব শেষ পর্যন্ত নষ্ট না করে উপায় তো নেই। না-হয় গোটা জীবনে একটা বা দু’টো কাব্যগ্রন্থ হলো আমার। এত কবিতার স্থান সংকুলান তো আর দু’টো বইতেই হয়ে যাবে না। এগুলো অগ্রন্থিত অবস্থায় রেখে আমি যদি মরে যাই তো আমার ছেলেকে বড়ো ধরনের বিপদে ফেলা হবে। এ যুগে যেখানে নিজের দায় মেটানোই কষ্টকর, সেখানে মৃত বাপের সৎকার করবার ঝক্কিটা ওর উপর কেন রেখে যাব। তাছাড়া ছেলের সারাজীবন বসে খাবার মতো পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ তো আর আমি রেখে যেতে পারব না। তখন ছেলেটার জীবনটা হয়ে উঠবে দুঃসহ। লোকজন বলবে এমন তাগড়া ছেলে বাপের জন্য কিছুই করল না। অথচ একবার ভেবে দেখবে না যে ওর সামর্থ্য সেটা ওকে করতে দিচ্ছে কি না। আমার একমাত্র ছেলেকে আমি যথাসম্ভব ভালোবাসি। ওর জন্যে আমি কোনো যন্ত্রণা রেখে যাব না যতদূর ভাবি।

কখনো বলার কথাগুলোকে কাগজে উগরে লক্ষ করেছি যে, লেখাটিকে একটি গল্প বলেও ফেলা যেতে পারে, প্রচলিত গল্পধারণার সাথে যদিও তার খুব একটা মিল গড়ে ওঠে নি, তা না উঠুক, শিল্পের কি কোনো সর্বজন মান্য সংজ্ঞা আছে না কি যে ওই ছাঁচে পা ফেলে সামনে এগুতে হবে? এখন আমি যেটাকে গল্প বলব তা এখনকার পাঠকরা না-ও গ্রহণ করতে পারেন, যেটাকে গল্প বলব না সেটাকে কেউ হয়ত বলবেন চমৎকার গল্প। শিল্প-সাহিত্যে এটাই রেওয়াজ। ‘চন্দ্রাবতীর কয়েকজন সন্তান’-এ মুদ্রিত আমার কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দুলাল ভাই (ফরিদ আহমদ দুলাল) ওতে গল্প আবিষ্কার করেছেন। পরবর্তীসময়ে আরেক আলোচক (মাসুদুল হক), যিনি ‘চন্দ্রাবতী..’ পড়েছিলেন, তিনিও দুলাল ভাই-এর মূল্যায়নটি ওখানে কোট করে দিলেন। দ্বিতীয়োক্ত আলোচক অবশ্য নিজের আবিষ্কারও যোগ করেছেন। হ্যাঁ, ওই কবিতায় একধরনের গল্প তো আছেই, গল্পের মুখ-হাত-পা, ঝলক। তিনি তা আবিষ্কার করতে পেরেছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। তা বলছিলাম গল্প-অগল্প ব্যাপারে। এই যে, কোনো কোনো লেখা লিখে মনে হয় এটা গল্প, গল্পের মতো যা দেখায় না আদৌ, আমি যদি কোনোভাবে সিদ্ধি পেয়ে যাই তবে এসব নিয়ে প্রচুর কাড়াকাড়ি হবে। তখন লোকজন তর্ক করবে আমাকে উদ্ধৃত করে, বলবে যে, মুজিব মেহদী বলেছেন কবিতা এরকম, গল্প এরকম ইত্যাদি। আমার বক্তব্য হলো এই যে, কবিতায় কিছু কথা আমি ঠিক বলতে পারছিলাম না, যাকে অন্তত আমি কবিতা বলি। কিংবা ব্যাপারটা আদৌ সেরকমও না। আমার কিছু কথা বলা দরকার হয়েছিল, কাগজে কলমে আমি তা বলেছি এবং বলার পর লক্ষ করেছি যে, এটি আমার কবিতা নয়, এটিকে আমি বলব গল্প। এখানে এই কথাটি সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক শোনাবে না যে, আমার গদ্যভাষা পদ্যভাষার দূরত্বটা হাজার মাইলের নয়। তারা যে এক বাপেরই বীর্যজাত তা তাদের নাক-মুখ-ত্বক দেখে প্রায় বুঝেই ফেলা যায়। সে কারণে কখনো কখনো তো এমনও ভেবে বসি যে, আমি যা লিখছি তা কবিতাও না গল্পও না, অন্যকিছু। অথবা স্রেফ রচনা বা লেখা। গল্প বা কবিতার প্রধান ভূমিকা হলো তা পাঠকের অনুভূতির জায়গাটা ছুঁয়ে দেবে, এ কাজটা যদি আমার লেখা সম্পন্ন করতে পারে তবেই হয়। তার চরিত্র বিভাজনটা সেক্ষেত্রে অতটা দরকার মনে করি না আমি। আমার লেখা বেঁচে থাকলে পরবর্তী পাঠক-আলোচকগণ এসবের নাম দেবেন, ছাঁচে ফেলবেন। কোনো ছাঁচের সঙ্গে না-মিললে বলবেন ওসব ছিল মৌলিক ও নতুন কোনো রচনা।

আমি ভেবে দেখেছি যে একজন লেখকের কথা বলবার সর্বশেষ আশ্রয় হলো চিঠি, যা অন্য কোথাও বলা যায় না, তা চিঠিতে বলা সম্ভব। প্রচুর চিঠি আমি লিখেছি জীবনে এবং আরো লিখতে চাই। লক্ষ্য পত্র-সাহিত্যে উত্তরণ। এজন্যে যে, লক্ষ্যটা এতবড়ো না-হলে অর্জনটা হয়ে যাবে যথেষ্ট ছোট। অতটা ছোট অর্জন আমার চাই না। কিন্তু চিঠির একটি সীমাবদ্ধতা হলো এই যে, এটি একাকী সাধনযোগ্য নয়। দুলাল ভাইয়ের একধরনের চিঠি আছে শুনেছি, যা তিনি নিজের কাছে লিখেন। এ ধরনের একটি চিঠি আমরা (আমি আর পলাশ চৌধুরী) ছেপেওছিলাম অবয়ব-এ। এরকম আমি পারি না। জিজ্ঞাসা না-হলে উত্তর আসে না আমার। অন্তত প্ররোচনাটা লাগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে। অন্যদের কাছে লিখলে ওর যে জবাব পাওয়া যায়, তাই-ই আর একটি চিঠি লেখতে ইন্ধন দেয় আমাকে। পত্রসাহিত্য রচনা করে ওঠবার জন্যে এমন অনুঘটক দরকার আমার। একজীবনে কতজন তেমন পত্রবন্ধু খুঁজে পাওয়া যায়, যাদের সঙ্গে জমে ওঠতে পারে শিল্পিত বিনিময় কথা বা তর্কমালা? মোস্তাক আহমাদ দীন আমার তেমন একজন পত্রবন্ধু। বেঁচে থাকলে ওর কাছে আমি অজস্র চিঠি লিখব। কিছুদিন আমি যাচ্ছি না ওর সঙ্গেও দীর্ঘ কোনো কথামালায়। আমি অর্ধেক মরে গেছি বলে। জানি, আমি আবার বেঁচে উঠব, তখন আবার শুরু হবে কথালাপ, শিল্পালাপ।

জন্মগতভাবে আমি একটি উপন্যাসের বীজ বহন করছি হাড়ে হাড়ে। যা হবে খুবই মৌলিক ও ডিমান্ডেবল। কিন্তু এটির জন্যে আমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। ঠিক কতদিন পর আমি ওটি রচনা করে উঠতে পারব তা নির্ভর করছে আমি ও আমার চারপাশে সংঘটিত বিষয়-সংশ্লিষ্ট ঘটনা-প্রবাহের ওপর। ওটি লিখে ওঠবার আগে যদি আমি সত্যি সত্যি মৃত্যুবরণ করি তবে বাংলা উপন্যাস-সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এ অর্থে যে ওটি হবে উপন্যাস হিসেবে খুবই নতুন। আমি না-লিখলেও আরো আরো নতুন বিষয় নিয়ে লিখিত হবে উপন্যাস। তবে আমি যেটি লিখব বলে ঠিক করেছি, সেটি অন্য কেউ লিখবেন না কোনোদিনই। এমনকি লিখতে পারেবেনও না। অন্যজনের মতো যেমন আমি পারি না, তেমনি আমার মতোও পারবেন না অন্য কেউ। একজন কখনো আরেকজনের বিকল্প নয়।

দিনপঞ্জি লিখি আমি গদ্যে ও পদ্যে। রাত জেগে জেগে। সততার সাথে বলি যে, ওটি কেবলই আমার জন্যে। যা আমার আয়না, যাতে আমার যাপিত মুহূর্তগুলি শব্দবন্দি। কোনোদিন যে কথা আমি অন্য কোথাও বলে নাও ওঠতে পারি, তাই-ই এখানে বলা থাকছে। মহাকাল যেগুলো পড়বে গুরুত্ব দিয়ে, পড়তেই হবে। হা আমার কষ্টাক্রান্ত লেখক-জীবন! হা আমার প্রিয়তম প্রতিদিন! এগুলো যদি মহাকাল পড়বে না তো আমাকে খুঁজে পাবে কোথায়! এত বিশ্বস্ত কথন আর কোথাও নেই জগতে, ডায়েরি যতটা বিশ্বাসের সীমানা ছুঁয়ে লতিয়ে ওঠে কাগজভূমিতে। (খসড়া)

৫ ডিসেম্বর ’৯৬, গোলকিবাড়ি রোড

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...