Wednesday, November 30, 2011

স্নান, ঈশ্বর ও অনীশ্বরে


ঈশ্বরের কোনো ধর্ম নেই : মহাত্মা গান্ধী

পড়ছিলাম ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা, কুমার চক্রবর্তীর প্রবন্ধ মায় দর্শনগ্রন্থনানা বিষয়ে আমাদের দেশে সরল চিন্তারই যেখানে প্রকট দৈন্য, সেখানে বিপ্রতীপচিন্তার সাক্ষাৎ কালেভদ্রেই মিলবার কথাযদিও ঈশ্বর বিষয়ে আদি ও অকৃত্রিম মডেলের রেডিমেড চিন্তার কমতি নেইএসবের আর নবায়ন হয় নি, নবায়ন বৈধ নয় বলেএকই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলাসময়কে, সময়ের অর্জনকে ওই বিশেষ চিন্তার সাপেক্ষে সমন্বয় করে দেখবার সুযোগ ও সাহসের অভাবে একটা গৎই কেবল প্যাঁচানো হয়ে চলেছে কালে কালেএহেন গৎপরিসরে এ বিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা বিশেষভাবে আগ্রহজাগানিয়া 

যাকে এ গ্রন্থে ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা বলা হচ্ছে, তারও বেশ বয়স হয়েছে, এ কারণে ঝুঁকি থাকে এখানেও বয়সী গাধাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাবারএ গ্রন্থ পরিসরে তা-ই করা হয়েছে, নাকি খুঁজে দেখা হয়েছে নতুন চিন্তার কোনো জানালা-দরজা, সেটাও বিবেচ্য বটেগ্রন্থের কর্মপ্রবাহ সরল ঈশ্বরবিশ্বাসের বিপরীতে বয়ে চলা চিন্তাপ্রেক্ষিতকে ঝাড়েবংশে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং এসবের সাপেক্ষে নিজস্ব চিন্তার বয়ান হাজির করবার প্রয়াসে পরিকল্পিত, যে কারণে একই যাত্রায় দুই ভিন্ন স্বাদের রেখা উন্মোচিতএই স্বাদ কেমন স্বাদ, তা-ও ক্রমপ্রকাশ্য। 

পরিবার ও সমাজজীবনে সতত উপস্থিত একজন মানুষের নিয়মিতই নানা ধারার কাজ-আকাজ চাই কি কাম-আকামেও যুক্ত হতে হয়! এ নিবন্ধকারেরও তার থেকে মুক্তি নেইএসবের মধ্যেই মাঝে মাঝে বইটির ভেতরে ঢুকি আবার বেরিয়ে যাই, বেরোতে হয় বলে১৬০ পৃষ্ঠার নিরস (ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরসম্পর্কিত কোনো বিষয়ই কোনোকালে সরস ছিল না) জিনিসের মধ্যে জগজ্জীবন ভুলে ডুবে থাকা তো যায় না! যাওয়া সংগতও নয়কিন্তু মুশকিল হলো আমি বেরোলেও মাথা থেকে ঈশ্বরমশাই বোরোন নাএহেন নাছোড় এক অতিথিভার মাথায় নিয়ে ঘুরেফিরে যখন আমি ভীষণভাবে ক্লান্ত, তখন এক গোধূলি-আঞ্জামে চন্দ্রিমার ভাঁজে ভাঁজে হাঁটতে গিয়ে বদখত এক বমনোদ্রেকাকুল অনুভূতির সাথে দেখা হয়ে যায়কোনোভাবেই যখন একে রহিত করা গেল না, তখন উদ্যানের স্বল্পালোয় (এ আলো-স্বল্পতার কারণ সামাজিক নয়, রাজনৈতিক) করা গেল বমনায়োজনদেখতে দেখতে গলগলিয়ে নেমে গেল অনেকানেক ভারলিখিত হলো
ঈশ্বর ব্যাপারটা মোটমাট একটা ডালিমফুলের মতো, দূর থেকে মনোহর লাগে, কাছে গিয়ে নাকে নিলে গন্ধ নেই, কাজেও লাগে না কোনো, হাতে নিয়ে টিপে দিলে কাঁদে না কাটে না, টিকে যায় ঝড়ে ও ঝঞ্ঝায়, একান্ত চাইলে বিনাশও করে ফেলা যায়, তবু ডালিমফুল ও তার ছায়ার মহিমাগান লিখেলিখে জগতের সমস্ত কাগজ ভরে ফেলছে কিছু কবি, লিখছে যশোপ্রার্থীরাও, জগৎভরা ওইসব ট্র্যাশে ভেসে জলবায়ু বদলের কথা ভেবে নাস্তানাবুদ লাগে

ওকে, ওই মনোহর ডালিমফুলকে নষ্ট করতে যদি চাই, ভারা ভারা সময় নষ্ট হয়, উচ্চমূল্য পরিশোধ করেও শেষে বিনিয়োগ মনে হয় অকারণ, যার কোনো ভূমিকাই থাকে না কারো জীবনধারণে, অথচ সময় এখানে বিকোনো যায় বিপুলার্থ দামে, সময় এখানে এক আশ্চর্য সূর্যকুসুম, যার তাপ শক্তিনাচন দেয় পৃথিবীতে, চাকাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনে, কাগজে কাগজে জাগে কলম চুইয়ে নামা কালির মিছিল

যেকোনো অনর্থকে জড়িয়ে মূহ্যমান হয়ে গেলে অর্থের ঢেউ এসে দুয়ারে দাঁড়ায়, যেজন মনের নদী সাঁতরে পার হতে গিয়ে পত্রপাঠ ডুবে মরে, তার সব হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন স্বর্গের হুরেদের হাতপাখা হবে, তার তার বেদনার অশ্রুপ্রবাহ হবে স্বর্গের ঝিরিঝিরি নদী, এইসব বলাবলি ঈশ্বরের বাণীবিতরণের মতো মাংসল কল্পনা বলে মনে হয়

ক্ষয় যত বড়ো হয় একটি পৃষ্ঠায় তত কম শব্দ ধরে, এ হিসেব শব্দ নিয়ে ব্যস্ত থাকা কাজিদের দিনকার কাজ, এসব জ্ঞানেই তারা চাষ করে খেয়ে যায় জগতের মাঠ, ব্রহ্মানাম বা তসবি জপে এইটুকু করে খাওয়া চলে না, এত বড়ো দুনিয়ার সবস্থানে থেকে তিনি না-থাকার ভূত হয়ে ধোঁকা দিয়ে যান, থাকা না-থাকায় ওই ঝুলে দেখি নামটাই দৃশ্য কেবল, এর বেশি স্পর্শ অতিরেক, এর বেশি থাকাটারে মন দিয়ে চোখ দিয়ে বুঝি না

স্বর্গীয় সেবক হয়ে আয়োজন করে যদি দেন তিনি সিগারেট খাওয়া, তবে এই আলাপের রং যায় আনদিকে ঘুরে, কথা বলে জেনে নেয়া যায় তার কোনখানে যাতায়াত বেশি, কোন টোলে পড়াশোনা, কতদূর জগৎ চিনেছে আর বড়ো হয়ে করে খেতে চায় কার দাস হয়ে, কোন হাতিয়ারে তার শুরু হবে নিতি সংগ্রাম

আমার কিছুই নাই এটা যদি তার লাগি হয়ে থাকে, আমার সকলি আছে তার লাগি এটাও তাহলে হোক, যদি সেটা করা রেখে আচানক বাণী দিয়ে ঠেলে দেয় ফাঁকিপুর স্টেশনের দিকে, তার নামে কেন তবে বায়ু গুণে যাবো, কাজ রেখে কাম রেখে আকামের বাঁশি শুনে লোকজন হুঁশ হারায় আনাচে কানাচে

ম্যালাদিন জল দিল নদী, সাগরদুহিতা ভেবে তারে যদি শুরু করি ধূপধূনা দেয়া, তবুও শুকাবে জল, সাগর শুকায়ে যায় এইকথা কবিতায় আছে, এ কারণে মাঝে মাঝে কবিতাকে মনে হয় ঢের বেশি বলের ধারক, যখন যেভাবে চায় সেইখানে সেটাই বানিয়ে নেয় কবি, ঈশ্বর কখনোই এইমতো পারে না দেখাতে করে হাতে ও কলমে, ঐশীপুস্তকগুলো তবু পারে

ঈশ্বরের হাত আছে পা আছে মাথা আছে এরকম কল্পনা করেছে কিছু লোক, যার যত জানাবোঝা দেখাশোনা সেরকম করে ভাবে সকলেই, তবে এরকম কথা কেউ ভাবে নাই তার হাতে কলম আছে কি না, তার হয়ে লেখালেখি করে দিতে লোক রাখা আছে, নিজে তিনি করেছেন এইকথা কোনোদিন প্রমাণ করতে চেয়ে কোনো লোক করে নি সময় ব্যয়, এইখানে এসে যদি ঝেড়ে কাশি : লিখতে পারেন না তিনি, ঝুরঝুরে আস্থা দিয়ে ডালপুরি না-বানিয়ে ধরে এনে দেখাবে কিছু লিখে এজলাসে, মনে হয় কোনোদিনই ইরকম হবি নাই

ঈশ্বর-নামাঙ্কিত তালমিছরি আমি ছোটোকালে খেয়েছি প্রচুর, পরে আর কোনোদিনই করে নি ইচ্ছে ফিরে খেয়ে দেখি, ইচ্ছাবিরুদ্ধ এই মদে ডুবে কী কারণে মাতাল বিভোর হয়ে পথে ঘুরে ট্র্যাশ দিয়ে গিগাবাইট গিগাবাইট স্থান খেয়ে যাব, নিজের তৈরি করা এক কিলোবাইট যদি বিনাকাজে খুন করে রক্ত মাখিয়ে আমি লেজে ও গোবরে করে ক্লিশের পিছনে গিয়ে দাবড়ে বেড়াই, এই দাবড়ানো তবে অটো-আনট্যাগ হবে ডিজিটাল যুগে

ভার্চুয়ালি তারে ছোঁয়া যায়, ধরা যায়, খাওয়া যায়, জানালার ওইপাশে চাই কি ক্রিয়াদের খেলা দেখা যায়, তারে পিডিএফ করা যায়, পাওয়ারপয়েন্ট, রংচঙে প্রেজেন্টেশন প্রোজেকশনে গেলে মনে হয়, এই বুঝি পাশে বসে শুনিতেছে তিরতির বাকধ্বনি, কলের পুতুল যেন কিচিমিচি ছাড়া আর বড়োবেশি রেইচেই করে না

মধ্যখানে ভেঙে যাওয়া মানুষের পাশে যদি না-দাঁড়ায়, ডাল ভেঙে প্রতি ভোরে মেসওয়াকে মেসওয়াকে ঈশ্বরগাছে, আমার কি দন্তরঙ্গি হবে, গোসাঁই বাতাসে হাঁটে, গোসাঁই আগুনে যায়, গোসাঁই বাগানে ফুটে, তরীদের লালপাল ধারে নিয়ে বাতাস মহানে যারা গোসাঁইয়ের পালিয়ে যাওয়াটাকে দেখে নাই, চোখলাল ক্ষুধার্ত মানুষের ধমকের কাছে তারা পুরোটা অলীক

ঈশ্বরকে জরুরি ভেবে যদি প্রেমিকার চেয়ে, ঠেলে দেই মগ্নতা ওইদিকে, তবে দেখি বেশিদূর যায় না এগোনো, প্রেমিকা যা দিতে পারে, পারে সেটা ঈশ্বরও, নগদানগদি, যেকোনো মুড অব পেমেন্টে, এরকম কথা আমি শুনি নাই, তার সব বাকি মাল, বাকি ব্যবসায়ী, জগতে কথা আছে প্রচলিত বাকি মানে ফাঁকি’, সমুদয় বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মীসম্প্রদায়ে এই কথা রটে গেছে, এরকম কথা তুমি আতশিকাচের চোখে তাকালেও দেখে যেতে পার, এইমতো প্রেক্ষাপটের চোখে চোখ রেখে তুমি যদি বিষমতা ভাবো, দেখবে কেমন তিনি নিজের প্রভাব দিয়ে তার দিকে জরিপাগ্রহটাকে বেঁধে রাখে, বিপরীতে লাল চোখ গড়ে যায় অলঙ্ঘ প্রাচীর এক নিরুৎসাহ ইটে

নয় একে নয় আর দশ একে দশ গুনে দিন গেলে পরিপাশে গ্লানির পাহাড় জমে, ভয়ের যোনির ঘ্রাণ ভেসে এসে ঘুমের গভীর থেকে ডাক দেয়, পকেটে টিয়া পুষে দূরে দূরে থেকে যাওয়া অন্যায্য বাহানা করা, জগতে এমন ভয় থেকে গেছে, যার ভয়ে ঈশ্বরভয়গুলো পালিয়ে গিয়েছে ফেলে সুনন্দ বাড়ি, ওই খাঁটি তীরে তবু ভয়নদী সাঁতরানো ঈশ্বরাশায়    
এ পর্যায়ে কষে ধমকিয়ে নিজেকে সামাল দেইমনে হয়, একটু বুঝি বেশি হয়ে গেল! বেশি যদি হয় তাকে বেশি ভেবে কম খেলে হতে পারেআমার যা কাজ সেটা পরিবেশনায়, এ পর্যায় মনোযোগ দাবি করে মান রাখা খাদ্যাখাদ্যের আর কিছু থালাবাটি ধোয়া ও মোছায়কম আলোতে সেখানেই স্থির থাকি নিজ মতি নিয়ে

২.
সব শিশুই নাস্তিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করে থাকেজন্মগতভাবে ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই থাকে না-- দার্শনিক ডিহোলবাখের এই মতকে প্রথমত বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেকিন্তু এ গ্রন্থে সংগৃহীত ও পত্রস্থ নানামুখী আলাপোদ্ধৃতি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, এ বাক্যকে বিশ্বাস করা ঝুঁকিমুক্ত নয়জন্মের সময় শিশুর মধ্যে বিশ্বাস যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না অবিশ্বাসওকাজেই এর কোনো একটিকে বড়ো করে দেখাবার কোনো সুযোগ নেইকথা বলা যায় বরং এখানে যে, ধারণাগতভাবে ডান-বাম দুদিকেই শূন্য খাঁ-খাঁ মনোক্যানভাসধারী শিশুদের ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে বিশ্বাস তথা আস্তিকতার ধারণা দেয়া হয়ধারণাকে বিশ্বাসে রূপ দিতে ও চর্চায় আনতে ভয়ঙ্করতা কপচিয়ে নরকজুজু ও অশ্লীলতা মাখিয়ে স্বর্গপ্রলোভন দেখানো হয়এইভাবে একমুখী ক্রিয়ার প্রকোপে আস্তিকতা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ভিত্তি গেড়ে বসেওই গাছের নিচে মিথ্যা বল নিয়ে খেলতে খেলতে শিশুরা বড়ো হয়ে ওঠেএ বিবেচনায় বরং বলা যায় শিশুরা শৈশবে সাধারণত আস্তিকই থাকেযারা ঈশ্বরের সঙ্গে মিশে বাকাবিল্লা হয়ে যান, সংশয়বাদী হয়ে বিভ্রান্তি জপ করেন, অবিশ্বাসী বা নাস্তিক হয়ে দ্যুতি ছড়ান, তারা তা হন স্বেচ্ছায়, পরে, সচেতনভাবেতার মানে দাঁড়ায় এই যে, বিশ্বাসী হওয়া সহজাত সামাজিক প্রবণতা, আর অবিশ্বাসী হওয়া মস্তিষ্কের দোষ বলে অর্জনসাপেক্ষ; এবং কিছুটা অসামাজিকওমজাটা এখানে যে, এতদসত্ত্বেও, ঠিক জন্মমুহূর্তে যে শিশুরা ঈশ্বরহীনও থাকে, এ তথ্য মিথ্যা হয়ে যায় নাতা নইলে শিশুর কাঁধে ঈশ্বরের ভার চাপাতে সমাজসংসারে যে সচেতন কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তার ভূমিকাকে খাটো করে দেখা হয় 
 
তো, মানুষ কেন অবিশ্বাস বা নাস্তিক্য অর্জন করে বা করার প্রয়োজন বোধ করে? উত্তরটা ইঙ্গিত করবে হয়ত জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজে না-পাওয়াকেআবার সেটা হয় কতকটা এ সমাজ তাকে প্রয়োজন বোধ করায় বলেওকীভাবে? এ ব্যাপারে বাস্তব গল্প হাজির করা যায়, কবি শেলী এক চিঠিতে তাঁর একটি উপলব্ধির কথা বলেছিলেন : পরমেশ্বরের মহান প্রকাশ হিসেবে খ্রিষ্টধর্মের যাথার্থ্য সম্পর্কে বালকমনেই আমার সন্দেহের উদ্রেক হয়খ্রিষ্টীয়বাদ আবির্ভূত হয়েছে গ্রিক ও রোমের প্রতিভাবানদের জ্ঞান ও গুণাবলির নির্যাস থেকে, অথচ সক্রেটিস ও সিসেরো ধ্বংস হবে আর আধুনিক ইংল্যান্ডের হীন-পশ্চাৎগামীরা পরজীবন লাভ করবে, কীভাবে? তারিক আলী তাঁর ক্লাস অব ফান্ডামেন্টালিজম গ্রন্থে বলেন : যখন পরিবারের সদস্যরা ঈশ্বরের ভয়ে ভীত হয়ে তাঁকে বলতেন যে, এ কাজ করলে বা না-করলে ঈশ্বর তাঁকে শাস্তি দেবেন এবং বাস্তবে দেখা যায় যে শাস্তি আসে না, তখন তাঁর মনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে সন্দেহের জন্ম হতে থাকেএই দুটো ক্ষেত্রেই জিজ্ঞাসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেঅধিকন্তু, দ্বিতীয় ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবার ও সমাজ মিথ্যাচার করে তাঁকে ওই পথে ঠেলে দিয়েছেএসব ঘটনা এ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে নানারকম বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দৃষ্টান্ত হাজির করতে গিয়ে। 

আমরা জানি, গ্রন্থটিও জানাচ্ছে যে, ঈশ্বরে অবিশ্বাস মানেই নাস্তিকতা নয়সংশয়বাদ ও অজ্ঞেয়বাদ থেকে নাস্তিকতার একটা দূরত্ব আছে, তা যত ক্ষীণ বা দীর্ঘতরই হোক, যে দূরত্ব চিহ্নিত হয় ধারণাগত অবস্থান দ্বারাধরা হয় সংশয়বাদ নাস্তিক্যবাদের পূর্বাবস্থা তথা ঝুলন্ত অবস্থা, আর অজ্ঞেয়বাদ যৌক্তিক প্রমাণ ছাড়া যেকোনো কিছুকে বিশ্বাসে অনাগ্রহীএকই তীর্থের এরা যেন ভিন্ন ভিন্ন ঘাটএই দুই ঘাটেই মানুষের ওঠানামা আছে, দূর থেকে তাকিয়ে থাকা আছে, ঘাটদ্বয়ের নামে প্রমাদ গোনা আছেএইসব মিলিয়ে জগৎসাধন, যেখানে ধারণাগতভাবে কোনো না-কোনো আঙ্গিকে আছে তার নাছোড় উপস্থিতি, হ্যাঁ-এ কিংবা না-এজগৎমানসকে ভাবিয়ে মারার এ যেন এক অনাবশ্যক ফাঁদ, যত্রতত্র পাতা!

আস্তিকতার গতিপ্রকৃতি বর্ণনা এ গ্রন্থের বিষয় নয়, তবে বিশ্বাসীরা অবিশ্বাসীকে কীভাবে দেখেন ও মূল্যায়ন করেন অংশত তার ছবিও এখানে লভ্যএতে লাভ হয়েছেকারণ এ ছবি নিরীশ্বরতা বা নাস্তিকতাকে দেখবার সমাজভঙ্গিকে সংজ্ঞায়িত করেলন্ডন ম্যাগাজিনের একটি জনপ্রিয় রচনায় একজন আস্তিক জগতে সত্যিকারার্থে কোনো নাস্তিক আছে কি না সে সংশয় থেকে লিখেন : অনুধ্যানী নাস্তিক, আমি মনে করি অসম্ভব; নাস্তিক হিসেবে যারা নিজেদের চিন্তা করে তাদের অধিকাংশই তাদের অলসতার জন্যেই এরকম ভেবে বসে, কারণ তারা এ ব্যাপারে সময় ও যুক্তি দেয় না নিজেদেরতারা যে এরকম তার কারণ তাদের ভাবের চাপল্য, চিন্তার ফলাফল নয় এই নাস্তিকতাকিংবা এখানে টমাস ব্রাউটনের কথাও বলা যায়, যিনি বলেছেন : সন্দেহ করার জায়গা আছে যে, আসলেই এমন চিন্তাশীল মানুষ আছেন কি না যারা ঈশ্বরে অবিশ্বাস বিষয়ে সত্যিকার অর্থেই নিজেদের যৌক্তিক করেছেনএ সবই নানারূপ যুক্তি ও পালটা যুক্তির অনুশীলনকোনো স্বতঃসিদ্ধ বা অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত নয়, বস্তুততবে এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে নাস্তিকদের নিজেদের আরো শাণিত করে তুলবার প্রয়োজনীয়তাটা অন্তত এহেন তর্কপ্রেক্ষিতে সামনে চলে আসেনইলে বিশ্বাসের শিকড় উপড়ানোর তাদের সাধনপথ কানাগলিতে পথ হারিয়ে বসবে। 

এসব বাদানুবাদ আজকের নয়হাজার হাজার বছর আগেরএর পরেও এরকম লক্ষ লক্ষ বাদানুবাদ হয়েছে, যদিও সেসবের উপস্থিতি এখানে নেইথাকা সম্ভবও নয়যাই হোক, এ পরিসরে যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, আস্তিকতার সাথে নাস্তিকতার বা নাস্তিকতার সাথে আস্তিকতার সঙ্গমে কোনোদিনই কোনো অর্গাজম হয় নি! নিরানন্দময় ঝগড়া বিবাদ হয়েছেমুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়েছেমারামারি কাটাকাটি হয়েছেতত্রাচ, মীমাংসা হয় নিঈশ্বর নিয়ে চিন্তা করে কথা বলে বিতর্কে মেতে যুদ্ধবিগ্রহে ডুবে মানবসমাজ হাজার হাজার বছরে এত শক্তিক্ষয় করেছে যে, এই শক্তি একটি অভিন্ন লক্ষ্যে প্রয়োগ করা হলে, কে জানে, মানুষ এতদিনে অনার্জিত অনেক কিছুর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে নিতে পারত! 

এ দুয়ে মীমাংসা নেই, কোনোদিন হবেও নাকোনো পক্ষই চূড়ান্তভাবে তাদের মতকে প্রমাণ করতে পারে না, ঈশ্বর এমন এক ধাঁধাদুইই লড়াই করে নিজেদের বিশ্বাসের (অবিশ্বাসও এক ধরনের বিশ্বাস) বলে, কিছুতেই নিজ অবস্থান থেকে সরে আসা যাবে না এরকম দৃঢ়তায়এর কোনো মধ্যবিন্দু নেইবড়োজোর আছে কেবল তুমিও থাকো আমিও থাকিজাতীয় একটা পারস্পরিক বোঝাপড়াআত্মিক মিলন নয় এটা, এক ধরনের সামাজিক সহাবস্থান-সহায়ক চুক্তিখ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মুক্তসম্ভাবনা-সম্বলিত মানবজাতির সর্বোচ্চ সভ্য এলাকা, বলেছেন গিবন, তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার-এতখন এখানে নাকি দেখা গিয়েছিল সহনশীলতার সর্বজনীন উদ্দীপ্ততাকারণ নানা মত ও বিশ্বাসের অপূর্ব এক সহাবস্থান দেখা গিয়েছিল সেসময়ধর্মাধর্মযুক্ত বা বিযুক্ত হয়ে যেকোনোভাবেই হোক এরকম একটা সমাজ এক জীবনে অস্তিত্বশীল দেখবার বড়ো সাধ হয়!

ঈশ্বরের থাকা না-থাকা বিষয়ক দার্শনিক বিতর্কের কোনো সুরাহা না-হোক, চর্চার সংস্কৃতি এ বিষয়ে আমাদের নানা পথ দেখিয়ে চলেছেসখ্য অসম্ভব জানিয়ে একেক পথ চলে গেছে একেক দিকেএরকম একটা পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে উপলব্ধ হয় যে, শিল্প ও যান্ত্রিকতানির্ভর আধুনিক মানুষের একটা বড়ো অংশের জীবন থেকে ধর্ম ব্যাপারটা অনিবার্যক্রমে উধাও হয়ে যাচ্ছেব্যাপারটা এখন আর ঈশ্বরের থাকা না-থাকায়ও থেমে নেই, বরং ধর্মের থাকা না-থাকা পর্যন্ত ভিড়ে গেছে তরীঅধিকন্তু, ধর্মের থাকা না-থাকাতেও বস্তুত কিছু আসছে যাচ্ছে না এসব মানুষের, ইহজাগতিক যাপন পরিসরে তারা এর কোনো অনিবার্যতাই খুঁজে পাচ্ছে না কোনোভাবেএ প্রেক্ষাপটে যৌক্তিকভাবে মনে হয় যে,
ক্রমহ্রাসমান ঈশ্বর ধারণা দিনে দিনে এক ফোঁটা স্বর্গীয় জলের রূপে টলমলাচ্ছে রৌদ্রালোকিত দিনের উদ্বাহু কচুপাতায়

পড়ে গেলে শুষে খাবে মাটি, থেকে গেলে শুকাবে উত্তাপে তার ভিটামাটিসহ, তৃতীয় কোনো উদয়পথ খোলা নেই সমূহ নেতিসম্ভাবনা থেকে তার সুরক্ষা পাবার

একবিংশই ঈশ্বরের চূড়ান্ত বিলয় শতক
৩.
আলোচ্য গ্রন্থে প্রথম পর্বের প্রবন্ধগুলোয় (ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা, ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা : সক্রাতিসপূর্ব সময়, ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা : সক্রাতিস-এর সময়, ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা : হেলেনীয় যুগ, ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা : রোমক-কাল) ঈশ্বরাবিশ্বাসসংক্রান্ত বিভিন্ন মতবাদ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার পাশাপাশি পৃথিবীতে প্রচলিত প্রধান ধর্মসমূহ এবং প্রধান প্রধান ধর্ম ও দর্শনতাত্ত্বিকগণ এতদবিষয়ে কবে কোথায় কী মত দিয়েছেন তার একটি সার সংকলনের চেষ্টা করা হয়েছেলক্ষণীয়, এতদপ্রক্রিয়ায় লেখকের ব্যবহার্য চশমাটি ছিল পাশ্চাত্য থেকে ধার করা, একইভাবে তাঁর দেখার ভঙ্গিটিও ছিল পাশ্চাত্যানুরক্তযে কারণে পৃথিবীর নাস্তিক্যবাদী চিন্তাসমূহের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রাচ্যচিন্তার জন্য একটি বিশেষায়িত প্রবন্ধ রচনার প্রয়োজনও মনে করেন নি তিনিকেবল সূচনা প্রবন্ধটিতে পাশ্চাত্যাচ্ছন্নতার ফাঁকে হাই তোলা বা আড়মোড়া ভাঙার জন্য পজ দেবার মতো করে দুবার মাত্র প্রাচ্যচিন্তায় হেলান দিয়েছেনবলা যায়, এ-ও করেছেন খুব শ্রদ্ধা নিয়ে নয়যেমন চার্বাক দর্শন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হচ্ছে : চার্বাক দর্শনও বস্তুতান্ত্রিক ঈশ্বরবিরোধী দর্শন, এপিকিউরাসীয় দর্শনের সাথে এর মিল রয়েছে যা পার্থিব সুখবাদী নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলঅথচ শ্রদ্ধা ও সচেতনতার সাথে এই অংশ লিখলে তাঁকে বাক্যটা ঘুরিয়ে বলতে হতো যে, এপিকিউরাসীয় দর্শনে চার্বাক দর্শনের প্রভাব শনাক্ত করা যায়কারণ ধারণা করা হয় চার্বাক মতের প্রবক্তা বৃহস্পতির জীবৎকাল খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ শতাব্দী, বিপরীতে গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস জীবিত ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০ পর্যন্ত

সূচনাপ্রবন্ধে বৌদ্ধধর্মকে তিনি এর অবস্থানগত জায়গা থেকে মূল্যায়ন করেন এইভাবে, যে, প্রাচীন ভারতে নাস্তিকতার কয়েকটি মাত্রিকতা পরিলক্ষিত হয় : বেদ-এ অবিশ্বাস পরলোকে অবিশ্বাস ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসএর মধ্যে অনেকে ছিলেন বেদ ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী কিন্তু পরলোকে বিশ্বাসী আর এই ধারারই উৎকর্ষ ও বিকাশ পরিলক্ষিত হয় বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদে যেখানে ঈশ্বরহীন এক ধর্মের অনুপম উত্থান পরিদৃষ্ট হয় যা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্যপৃথিবী প্রথমবার বিস্ময়ে দেখল এক ধর্ম যা ঈশ্বরহীন বা ঈশ্বর-বিমুখএই মূল্যায়ন ঠিক এর পরই উলটে যায়চার্বাক-মূল্যায়নের মতো একইরকম দায়সারাভাবে তিনি জানান দেন : ভারতবর্ষে এই নাস্তিকতার ধারা ব্যাপক হয় নি, বৌদ্ধরাও পরবর্তীকালে ঈশ্বরমুখী হয়ে গেছেঅথচ কথাটা সত্য নয়গৌতম বুদ্ধের প্রয়াণের পর বৌদ্ধবাদের কোনো কোনো স্কুল ভক্তিবাদী হয়ে উঠলেও বেশিরভাগ স্কুল এখনো আদি নিরীশ্বরতারই চর্চা করেএই ভক্তিও কোনো ঈশ্বর বা দেবতার প্রতি নিবেদিত নয়, বরং মানুষেরই প্রতিকাজেই ঈশ্বরমুখী কথাটা এখানে সত্যকে ছাড়িয়ে যেতে ইন্ধন দেয়তাছাড়া মূল্যায়নটা ওইখানে এসে থেমে গেলে ভারতবর্ষে বৌদ্ধবাদের বিকাশ রহিত হওয়ার পেছনের রাজনৈতিক কারণগুলোকে আড়াল করা হয় এবং এটাও আড়াল হয়ে থাকে যে, প্রাচ্যের অনেক দেশে ব্যাপকভাবে এবং পাশ্চাত্যের কোনো কোনো দেশে নানারূপে এখনো বৌদ্ধ দর্শনের চর্চা জারি আছেগ্রন্থকার পরে নিরীশ্বরতাপ্রশ্নে বৌদ্ধ মতবাদের সাথে হিন্দুত্ববাদের তুলনা করে বলছেন : একটি বিষয় তাত্ত্বিকভাবে হলেও যুক্তিতে টিকে গেছে যে, হিন্দুত্বে নাস্তিক্য দূষণীয় নয় বরং গীতার জ্ঞানমার্গের দর্শনে আশ্রিতপৃথিবীর জীবন্ত কোনো ধর্মেই এ সুযোগ নেই শুধু হিন্দুধর্ম ছাড়া, একমাত্র একজন হিন্দু বললেও বলতে পারেন যে তিনি নাস্তিকহিন্দুত্বে নাস্তিক্য দূষণীয় কি না সে আলাপ এখানে থাককিন্তু পৃথিবীর জীবন্ত কোনো ধর্মেই এ সুযোগ নেই শুধু হিন্দুধর্ম ছাড়া, একমাত্র একজন হিন্দু বললেও বলতে পারেন যে তিনি নাস্তিক-- এই কথাটা কীভাবে সঠিক, যেখানে তিনি কিছুক্ষণ আগেই বৌদ্ধধর্মকে নাস্তিক্যপ্রশ্নে পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য বলে শনাক্ত করলেন? তবে কি তিনি বলতে চান যে, বৌদ্ধবাদ ভারতে প্রায়-প্রত্নবস্তু হয়ে গেছে বলে এবং ১৯৫১ সালের হিসেবে ৫২০ মিলিয়ন অনুসারীর বিবেচনায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধর্ম আজ তার অবস্থানচ্যুত হয়েছে বলে সারা পৃথিবীতেই এটা অচর্চিত? তা তো নয়সরাসরি অনুসারীদৃষ্টে এখনো এর অবস্থান জীবিত ধর্মগুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থানেতাছাড়া বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক মিশ্রণ ঢুকে গেছে তাওবাদ, কনফুসিয়বাদ, শিন্টো, পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী ধর্ম, শামানিজম ও সর্বপ্রাণবাদেএতদাঞ্চল ও ইউরোপের কিয়দংশে জেনবাদও তো বৌদ্ধধর্মের একটা স্কুল হিসেবেই চর্চিত হয়লেখকের উল্লিখিত মন্তব্যটা আরেকটা প্রশ্নেও যে ঠিক নয়, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো বিশিষ্ট বৌদ্ধ নাস্তিককে সামনে আনলেই সেটা প্রমাণিত হয়, যিনি বুদ্ধের প্রতীত্যসমুৎপাদ দর্শনের ভেলায় চড়েই মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে উপনীত হতে পেরেছিলেন 
সত্য থাকেন যুক্তি নামের রোদে, তার থেকে বিচ্ছুরিত আলোমালা, দিকনির্ণায়কহীন মুক্ত কাঠে গড়া চিন্তারূপ নৌকার গলুই, প্রতিবারই নিয়ে যায় আনকোরা পথে 
৪.
গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে মোট চারটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে : মরমি সত্তার গান, ভাবনার অন্তর, শূন্যতার চিত্রকল্প ও ভাবনাবিন্দুনামগুলো সাক্ষ্য দেয় এগুলো এমন কিছু দেবার জন্য প্রস্তুত, প্রথমপর্বে যার সাক্ষাৎ মেলে নিআগের পর্বের প্রবন্ধগুলো যেখানে তথ্যভার বইছে বেশি, এ পর্ব হয়ত বইবে অন্তরাগুনসে আগুন কমবেশি আছে এখানেকিন্তু এ প্রসঙ্গিত আলাপেও লেখকচৈতন্য বিশিষ্টজন ও মতের চিন্তার জালে এমনভাবে বন্দি যে, ওসবের ফাঁকে নিজস্ব চিন্তা পাখা মেলবার পরিসর ও অবকাশ কমই পেয়েছে, মনে হয়এটা আরো একটা কারণে হয়ে থাকতে পারে, তা হলো প্রবণতা, অন্য কারো কাঁধে ভর না-দিয়ে দাঁড়াবার অনাগ্রহ; যদিও এটা এখানে স্বতঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার সক্ষমতা এ লেখক ধারণ করেনফলত, বলাই যায় যে, পাঠক প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ হয় নি 

মরমি সত্তার গান মরমিবাদকে চিড়েফেঁড়ে দেখবার চেষ্টাআনুষ্ঠানিক ধর্মাচারপরিপন্থী, ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব বিষয়ে গোঁড়ামিহীন, আধ্যাত্মিক এই বিশেষ গোষ্ঠীর বিস্তার ভালোভাবে উঠে এসেছে এ প্রবন্ধেপ্রশ্ন উঠতে পারে মরমিরা তো নিরীশ্বর নয়, এ গ্রন্থে মরমিবাদ কেন? উত্তর হলো মরমিবাদ এক ধরনের আস্তিকতা হলেও এটি ঈশ্বরবিষয়ক সরল চিন্তার বিপরীতে এক ধরনের বিপ্রতীপচিন্তাইমরমিদের একটা অংশ ঈশ্বরমুখী হলেও আরেকটা অংশ ধর্মনিরপেক্ষএ কারণে নিরীশ্বরবাদী মতের সাথেও এর আত্মীয়তা আছেএ মতে স্রষ্টাকে স্বাধীন হাতে টিপেগড়ে নেবার সুযোগ রয়েছে, যেটা প্রথাগত ধর্মসমূহে সম্পূর্ণত অসম্ভবনাস্তিকরা মরমি দার্শনিকদের সঙ্গে এবং মরমমিরাও নাস্তিকদের সঙ্গে একই চাতালের নিচে নির্বিঘ্নে ওঠাবসা করতে পারেনতাদের মধ্যে যে যোগ সেটা বান্ধবতার, শত্রতার নয়কারণ মরমি মতে, দূর বাতিঘর ধরে কোনো পথচলা নেই, সাধারণত অন্তরমুখী হয় এর ঘোর অভিযাত্রা

মরমি চিন্তার পাশাপাশি এ প্রবন্ধে মরমি কবিতাকেও চিনতে ও চিনাতে চাওয়া হয়েছেভক্তিমূলক গান ও কবিতা থেকে মরমি কবিতার পার্থক্যটাও স্পষ্ট হয়েছে এখানেবলা হয়েছে : ধর্মীয় কবিতায় কূটাভাস নেই, নেই প্রতীকায়ন; কিন্তু মরমি কবিতায় কূটাভাস আছে, প্রতীকায়ন আছে, রূপকার্থ আছেএই কূটাভাস হলো প্রকাশের অসম্ভাব্যতা, আর যদিও তা অসম্ভব তবুও তাকে ধরার আর্তিএই প্যারাডক্সই মরমি কবিতার পাওয়ার স্টেশন    

এ প্রবন্ধের ভাষা যত্নে গড়া, অতএব সৌন্দর্যময়; এবং এ কারণেই অনেকাংশে দুরারোহ্য, দুর্ভেদ্যদমস্বল্পতার কারণে অনেক পাঠকের উপলব্ধি-সক্ষমতার বাইরে থেকে যাবে এর কিয়দংশ বোধব্যাপ্তিযেমন : এই আলোর অন্বেষণ, এই অসীমের অনুধ্যান, এই শাশ্বতের স্বতঃস্ফূর্ত সমীকরণ সমস্ত ব্যক্তিতা ও প্রতিস্বকে আত্মসাৎ করে অবশেষে স্বজ্ঞাদীর্ণ এক দিব্যাবস্থায়, এক সত্যোর্ধ্ব সত্যে এসে হাজির হয়েছে; মানুষ অজানা ও অসীমের সন্তান হিসেবে এই বিরাটকেই অধিশ্রিত করবে-- এই তার সুনির্দিষ্ট নিয়তি 

এই অধ্যাত্ম অভিনিবেশ, এই সমূহ সুরভি, দ্বীপে দ্বীপে জ্বালিয়ে চলেছে বহু অন্তরদীপ--    
অন্তরতীর্থে করেন তিনি বসবাস, এই সুফিগৌরব লাল ঘাসফড়িংয়ের মনে দোলা দিয়ে গেল, শরিয়তি কঞ্চির ওপরে বসতে গিয়ে ওর যে সমস্যা হলো তার কথা জানতেন কবিবর মনসুর হাল্লাজ, মরুবক্ষ বিদীর্ণ করে আনাল হক নামে যার তরী ভেসেছিল

যুগের মুকুট খুলে দেখানোই যায় যে, যুক্তিঅস্ত্রসহ মুতাজিলাদের জন্ম সম্ভব হয়েছিল এক অনুদার ও বদ্ধ জীবনপথে

এ যুগের মুসাফির ঘোরের প্রকোপে জ্বলে রহস্যকবিতারূপে পথে পথে ডিম পেড়ে যান
৫.
শেষাংশের ভাবনার অন্তর প্রবন্ধটি অনেকটা মুক্তপুনর্জন্ম, জ্ঞান ইত্যাদি প্রসঙ্গ এখানে আলোচিত হয়েছেতবে নিজে বলার চেয়ে এতদবিষয়ে অন্যে কী বলেছেন সে দিকেই যেন লেখকের বেশি ঝোঁকশূন্যতার চিত্রকল্প স্রষ্টার অভ্যুদয় বিষয়ে যতœবানপ্রসঙ্গক্রমে এখানে এসেছে ইহুদিবাদ, তাওবাদ, কনফুসিয়বাদ, শিন্টো, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের এতদবিষয়ক দৃষ্টিকোণভাবনাবিন্দুর যেন কোনো বেড়া নেইআলোকপ্রাপ্তি, পৃথিবী ও প্রাণের উৎপত্তি, ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন, মৃত্যু ও মৃত্যুউত্তর সৎকার রীতি, মৃত্যুসংক্রান্ত বিশ্বাস, পরলোকবিশ্বাস, ইহুদিবাদ ও খ্রিষ্টবাদের শাস্ত্রাবলি ও সে সংক্রান্ত মিথ, গ্রীকদর্শন এবং গ্রীক, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার কবিতা ইত্যাদির ভেতরে আলোক প্রক্ষেপিত হয়েছে এখানেপ্রকৃতার্থে ভাবনাবিন্দু প্রবন্ধে ভাবনার কোনো কেন্দ্রবিন্দু নেই, যেন বহুরৈখিক কবিতাআর প্রবন্ধ হিসেবে এখানেই এর খামতিযে কারণে এর বিরুদ্ধে অসংলগ্নতাদোষে দুষ্টতার অভিযোগ তোলা যায়মনে হয়, বিভিন্ন সময়ে ধর্মদর্শন, ধর্ম ও তার নানা কৃত্য, বিজ্ঞান, কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়নকালে পরে কাজে লাগবে ধারণায় যেসব নোট গ্রহণ করা হয়েছিল, সে সমুদয় মালমশলা সৎকারের জন্য এই প্রবন্ধটিকে একটা বড়ো বিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছেএর পাঠ এ কারণে সবিশেষ ক্লান্তিউদ্রেককর

বেন সিরার পুস্তকের নির্দেশ : তোমাদের নিকট যা কঠিন মনে হবে তার অন্বেষণ ¾করো না, যা তোমাদের বলা হয়েছে তাই করোগোপন বিষয়ে তোমাদের কোনো কাজ নেই এই ইহুদি মতটিতে ব্যক্ত অবস্থানেই স্ব স্ব প্রান্তে দাঁড়ায় প্রতিটা ঐশীধর্ম ও তার অনুসারীরাএখানে প্রশ্ন করা নিষেধ, জাগা প্রশ্ন সবার অগোচরে এখানে কফ-থুথুর মতো গিলে ফেলতে হয়সজ্ঞান চৈতন্যধারী মানুষেরা এই কফ-থুথু গিলে গিলে জীবন পার করে দেবেন নাকি ইমানুয়েল কান্ট কথিত আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি হয়ে উঠবেন, যারা কোনো ঐশীগ্রন্থের উন্মাদনাকে পরিত্যাগ করে নিজস্ব আহরণ ও অভিজ্ঞতার দ্বারা নিজেরাই হয়ে ওঠেন স্ব-অভিভাবক, তা মানুষ নিজেই ঠিক করে নেবেনসচেতন মানুষকে সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য এ গ্রন্থ সমদুয় তথ্য জোগান দিতে পারে না বটে, তবে দুইপ্রান্তের টানাহ্যাঁচড়ার দিব্যদর্শন ঘটাতে সাহায্য করে, যা হয়ত নিবিষ্ট পাঠককে দাঁড়াবার জমি খুঁজতে বেরোবার জন্য চিন্তাসূত্র উপহার দিতে সক্ষমআগামী পৃথিবীর রূপচেহারার ওপর এসব চিন্তার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। 
বিকোবো আশায় আজ উঠেছি বাজারে, ক্রেতা নেই ফাঁকা পথ, মাঝরাত কড়া নাড়ে দাঁড়ায়ে দুয়ারে
রাগরক্ত গায়ে নিতে শরীর পেতেছি, বাঁচাতে তোমার দেয়া ক্ষীণ প্রাণ, ক্রেতা দাও ক্রেতা দাও, নইলে নিজেই বলো আছি
নভেম্বর ২০১১

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...