Tuesday, October 26, 2010

বাইকু বর্ণমালা

বাইকুজ্বর ও তার আরোগ্যার্থ প্রেসক্রিপশন

হাইকু, বাংলায় যাকে বলা যায় ক্রীড়মান পদ্য, জাপানের এক বিশেষায়িত কাব্যআঙ্গিক। আকৃতির দিক থেকে জানাশোনার মধ্যে এটিই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ছোটো কবিতা। উনিশ শতকের শেষদিকে হক্কু নামে সমধিক পরিচিত এই কাব্যআঙ্গিকের হাইকু নামটি দেন জাপানি লেখক মাসাউকা শিকি (১৮৬৭-১৯০২)। প্রথাগতভাবে একটি উলম্ব লাইনে ১৭ মোরাস (প্রায়-সিলেবল) বিশিষ্ট এই কাব্যআঙ্গিকটি ৫+৭+৫ মাত্রাবিশিষ্ট তিনটি ভাগে বিন্যস্ত হয়ে উপস্থাপিত হতো। পরে লিখনরীতি ও মুদ্রণসুবিধার প্রশ্রয়ে বিশেষ করে ইংরেজিতে তিনটি আলাদা বাক্যে/বাক্যাংশে হাইকুকে আনুভূমিকভাবে সজ্জিত করবার রীতি প্রচলিত হয়। পৃথিবীব্যাপী এখন শেষোক্ত রীতিতেই হাইকু লিখিত হচ্ছে। জাপানি হাইকু অন্তঃমিলবিহীন, পরে ইংরেজিতে যদিও এরকম নিরীক্ষা হয়েছে। তবে জাপানসহ পৃথিবীর সর্বত্রই হাইকু শিরোনামহীন।

চিন্তা যদি তেমন উচ্চতায় উঠে, তাহলে ১৭ মাত্রাই সে ভাব প্রকাশের জন্য যথেষ্ট, হাইকু প্রসঙ্গে এরকম একটা কথা একবার বলেছিলেন জেনতাত্ত্বিক ডি. তেইতারু সোজুকি (১৮৭০-১৯৬৬)। ওই অবস্থাটা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে ভাবি। ধ্যানের বাইরে এ আর কী? হাইকু কাজেই স্তব্ধতার টানেল বেয়ে পৌঁছে যাওয়া ধ্যানমঞ্জিল থেকে উৎসারিত নাচকথা, ধ্বনির চরম ও পরম কম্পন। আর কম্পন তো হলো সংবেদনের দৃশ্যগান, স্থিতির মূর্ছনা।

হাইকুতে অভিজ্ঞতাজনিত আবেগের হট-পাস থাকলেও ব্যক্তিগত ধারণা, বয়ান, ব্যাখ্যা বা এরকম কিছুর ক্ষেত্রে নিষেধের লাল পতাকা টানানো আছে। অর্থাৎ এতে নৈর্ব্যক্তিক চিত্রপ্রতিমা থাকতে পারে, কিন্তু কিছুতেই ব্যক্তিক ভাষ্য জায়গা পায় না। হাইকুতে ধরা পড়ে স্তব্ধতা, রহস্যময়তা, রিক্ততা এবং অতি অবশ্যই নশ্বরতা। বাকসংযম হাইকুর প্রাণ, ভাষাসংহতি তার দেহ; যেজন্য হাইকু হয়ে ওঠে সান্দ্র, মগ্ন এবং জীবন্ত।

হাইকুকে হতে হয় কিগোকিরেজি সমৃদ্ধ। কিগো হচ্ছে ঋতুচিহ্ন, অর্থাৎ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কোন বিশেষ অবস্থায় হাইকুটি রচিত হয়েছে, তার ছাপ। জাপানি সাহিত্যে হাইকুর ঐতিহ্যকে বেগবান করতে কিগো তথা ঋতুনির্দেশক শব্দসম্বলিত একাধিক অভিধান প্রচলিত আছে। জাপানে ঋতু হলো চারটি : গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বসন্ত। এই চার ঋতুর স্মারক শব্দগুলো লেখক-পাঠক উভয়কেই হাইকুর সম্পন্ন প্রতিবেশী হিসেবে গড়ে তোলে। জাপানের তুলনায় আমাদের ঋতু আরো দুটি বেশি হলেও বাংলায় যেহেতু বিস্তৃত কিগো-অভিধান নেই, তাই বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে একে মনে হতেও পারে উন্মূল পারম্পর্যহীন নিরস ভাবচূর্ণ বা এ জাতীয় কিছু। যাহোক, এই কিগো-ঘনিষ্ঠতার কারণে ঐতিহ্যিক হাইকু সাধারণত ঋতুভিত্তিক ও প্রকৃতিঘনিষ্ঠ হয়। তবে ক্রমে জাপানি ও অন্য ভাষার মুক্তক হাইকু এই সীমারেখাকে অতিক্রম করে গেছে। এখন এতে মানবিক কায়কারবারের রেফারেন্সও দুর্লক্ষ্য নয়। অর্থাৎ কিগো প্রশ্নে কমবেশি জাপানি হাইকুতেও ছাড় আছে, ইংরেজিতে এ ছাড় আরো বেশি। এ প্রেক্ষাপটে হাইকুর ক্রমবিস্তার ঘটছে প্রকৃতি ছাড়িয়ে মানুষ ও তার সভ্যতার বিচিত্র আলো-অন্ধকার পথে। এর ভিতর দিয়ে তৈরি হয়েছে হাইকু-সেনরু একাকার অবস্থা।

হাইকুসম্রাট মাৎসো বাশো (১৬৪৪-১৬৯৪) ছাড়াও জাপানের বিখ্যাত হাইকু লেখকদের অধিকাংশই জেনবাদী বলে জেনকবিতা হিসেবে হাইকুর প্রধানত ঋতুবৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠার সমালোচনা করা যায়! জেন বহিরাসক্তি কমিয়ে ভিতর দিকে তাকাতে বলে। এতদসত্ত্বেও, জেনকবিতা হিসেবে হাইকু কেন কেবল বাইরে তাকিয়ে থেকে চোখে ব্যথা বানাবে, সে তো একটা সংগত প্রশ্নই বটে। একে মূলাদর্শের সাথে যোগাযোগহীনতা হিসেবেই বা দেখা হবে না কেন? এ রীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে জাপানের স্থানীয় প্রাসঙ্গিকতার প্রতি অবজ্ঞা না-দেখিয়ে বাংলার কাব্যবাস্তবতায় অন্তর্গত সত্তা খোঁড়ায় মনোযোগী হওয়াও প্রয়োজনীয় বলে বোধ হয়। প্রকৃতির ছবি মনের ছবির চেয়ে সুলভ, সহজগম্য ও দৃশ্যকামযোগ্য। বিপরীতপক্ষে মনের দুর্লভ ছবি যে নিসিসিটি ক্রিয়েট করে তার বোধ্যতার জন্য লাগে ইন্দ্রিয়যৌগের হস্তক্ষেপ। ওর বরং সৃজনের দিকেই যাতায়াত বেশি। ওতে চেনাজানা উপাদানের সমন্বয়ে সহজ সরল উপস্থাপনভঙ্গির নিচেও নানা তল-উপতল-অবতল-প্রতিতল তৈরির সম্ভাবনা থাকে। তাতে বাইরে থেকে এর প্রতি দুর্বোধ্যতা-দুর্ভেদ্যতার অভিযোগ যদি উঠেও, মগ্নতার আশ্রয়ে সারি সারি দরজার চিহ্ন‎ উন্মুক্ত হয়ে যাবার সুযোগও একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায় না। 

কিরেজি হচ্ছে কাটিং ওয়ার্ড বা বিচ্ছিন্ন চমকানো পদ, যা হাইকুর শেষাংশে অবস্থান নিয়ে কবিতায় স্থাপিত ভাবটিকে নাচিয়ে, মুচড়িয়ে নিবিড়ানন্দের সীমায় পৌঁছে দেয়। অবশ্য এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম আছে, যদিও কম। কখনো কখনো, এমনকি বাশোর হাইকুতেও, কিরেজি ওয়ার্ডকে প্রথম বাক্যে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কিরেজিতে কিগো-অংশের সাথে বিরোধাত্মক শব্দ বা শব্দবন্ধ ব্যবহারেরও রীতি আছে। এটি অবচেতনের বাস্তবতা উপলব্ধিতে সহায়তা করে। অন্তর্গত একটা তুলনার সুযোগও এর দ্বারা উন্মোচিত হয়। কিরেজিপ্রশ্নে একটা মত দেখা যায় বীতশোক ভট্টাচার্য অনূদিত ও সম্পাদিত ‘জেন কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ অনূদিত বাশোর বিখ্যাত হাইকু ‘পুরোনো পুকুর/ ব্যাঙের লাফ/ জলের শব্দ’ প্রসঙ্গে লিখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যেভাবে হাইকুটির রূপান্তর ঘটিয়েছেন জেনবাদী তা সমর্থন করবেন না। জেন তত্ত্ব অনুযায়ী জলের শব্দ শেষে নয়, পুরোনো পুকুর ও ব্যাঙের লাফের মাঝখানে আসবে, পরিণতিটি কাজ ও কারণের মাঝখানে থেকে তাদের দ্বিখণ্ডিত করে দেবে।’ কাজ ও কারণকে দ্বিখণ্ডিত করবার কথা বলে এখানে বস্তুতপক্ষে তিনি কিরেজির ব্যবহার নিয়েই কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর এই মতকে অবশ্যগ্রাহ্য ভাববার ক্ষেত্রে দুটো বিপদ আছে বলে ধারণা হয়। ১. বাশোর এই হাইকুটির মতো সকল হাইকুতে সব সময় নাউন-ফ্রেইজ সম্বলিত তিনটি স্বাধীন বাক্য না-ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিণতি চিহ্নি‎ত ফ্রেইজটি মাঝখানে স্থাপন করা অসম্ভব। ২. বাশোর এই হাইকুটির জাপানি মূলেই ব্যাঙের উল্লেখ আছে দ্বিতীয় লাইনে, যে ব্যাঙ জাপানি ঐতিহ্য ও কিগো-অভিধান অনুযায়ী বসন্তকালকে ইঙ্গিত করে। কাজেই ব্যাঙের লাফ শেষে এলে কিগো স্থানান্তরিত হয়ে যায়; যেটা হয় রীতির ব্যতিক্রম মাত্র, সাধারণ রীতির অনুসরণ নয়।  

‘সবচেয়ে কম কথায় সবচেয়ে বেশিভাব সবচেয়ে সহজভাবে প্রকাশ, এই ছিল রাশেলের গদ্যের আদর্শ, হাইকুরও আদর্শ এইটিই’; জেনকবিতা বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন বীতশোক ভট্টাচার্য। এটাই কাজেই প্রধান চ্যালেঞ্জ যে, কত কম শব্দে অর্থময়তা, প্রাসঙ্গিকতা, সাম্প্রতিকতা ও একইসঙ্গে চিরন্তনতা তৈরি করা যায়; দাগিয়ে দেয়া পরিসীমার মধ্যে থেকে অথবা তা টপকে গিয়ে।

চিত্র হলেই যেখানে চলে, সেখানে মাঝেসাঝেই চিত্রকল্পের দিকে চলে যাওয়া ভাবের ট্রেনকে খুব সৃজন-সহায়ক লাগে। সৃজন যদিও একটা বিনাশী প্রক্রিয়া। তাতে যা যা আদিদ্রষ্টব্য আছে আপন সীমায়, তার সেবা নেয়া থেকে দূরে থাকতে হয়, পিপাসা মেটাতে হয় জলবিনে হাওয়া দিয়ে, উপেক্ষার কড়ি গুনে গুনে বিকল্প সৃজনে একসা দাঁড়াতে হয় গিয়ে উদ্ভাবনী চাতালে। এটা এমন এক নদীতীর, সংবেদনের; যার কূল ঘেঁষে কোনোদিন কেউ কোনো রেডিমেড জেলেকে দেখে নি!

ধ্যানকে ঘোরের সাথে গুণ করলে যে ফল সামনে এসে দাঁড়ায়, তার সাথে বসা গেলে মনে হয়, এইবার বুঝি খুঁজে পাওয়া গেল কোনো অসীমের পথ, অনন্ত দরজা। জেন-বৌদ্ধবাদের এই সেই সংগত বাসনা, যার স্তনের দিকে তাকিয়ে অঢেল দুধের আমি সম্ভাবনা দেখি। মনাভিজ্ঞতা, যার ছবি মানে ছবিকল্প শুধু, নিসর্গ ও ক্যামেরা থেকে দূরবাসী, তার সুপ্রাচীন জলপাই গাছতলে কমলা-লাল আর কালচে-সবুজের এক বন্যা বয়ে যায়!

বাংলায় দেখা যায়, একটি নাতিদীর্ঘ সরল বাক্যকে তিন লাইনে বিন্যস্ত করে তাকে হাইকু বলে চালাতে। এটা হাইকু আঙ্গিকের একটা ব্যত্যয়। হাইকুর প্রকৃত সাফল্য এক্ষেত্রে প্রদর্শিত কৃতিত্বের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। হাইকুতে একটি পঙক্তির সঙ্গে অন্য পঙক্তির অন্তর্গত যোগাযোগ থাকবে অবশ্যই, কিন্তু একের ওপরে অন্যের নিঃশর্ত-নির্ভরতা অগ্রহণযোগ্য লাগে। কমপক্ষে কিরেজিকে আলাদা হতেই হবে, কাজ ও কারণের মাঝখানে পরিণতি হয়ে না-হলেও। সেটা দ্বিতীয় বাক্যের শেষে ড্যাস বা সেমিকোলনসুলভ দূরত্ব রচনার মাধ্যমেই হয় বেশি, চিহ্ন ব্যবহার করে বা না-করে যেভাবেই হোক। এটাই সবিশেষ চর্চিত রীতি। তার মানে কিগোঅংশে দু'বাক্যের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগ মেনে নেয়া গেলেও শেষ পঙক্তিস্থ কিরেজির আলাদাত্ব অত্যাবশ্যক। বাক্য/বাক্যাংশকে স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার ক্ষমতা দেয়া না-গেলে ঠিক হাইকু-দক্ষতার ছাপটাই ফেলানো গেল না বলে মনে হয়। এই দুর্বলতা আমি বিশেষভাবে কাটাতে চেষ্টা করেছি। দুয়েকটা ক্ষেত্রে খানিকটা শিথিলতা দেখিয়েছি বলতে গেলে বাক্য ও বাক্যধৃত সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে! এ প্রেম যতটা গোপন, তারচে’ বেশি প্রকাশিত।

রবীন্দ্রনাথ অনূদিত বাশোর বিখ্যাত হাইকুটির একটি ইংরেজি পাঠ এরকম : an ancient pond/ a frog jumps in/ the splash of water। এর জাপানি পাঠটি ৫+৭+৫ করে মোট ১৭ মোরাসের হলেও বাংলায় রবীন্দ্রনাথ এই মাত্রাবিন্যাসটি রক্ষা করেন নি। পূর্বে উল্লিখিত তাঁর অনুবাদের সিলেবলভিত্তিক মাত্রাক্রম ৫+৩+৪, মাত্রাবৃত্তে হিসেবে করলে দাঁড়ায় ৬+৫+৬, আর অক্ষরবৃত্তে ৬+৫+৫। কিন্তু কেন তিনি সেটা করেন নি তা ‘জাপান যাত্রী’তে অনুল্লেখ্য আছে। অন্য কোথাও তিনি এ নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছেন কি না তা আমার জানা নেই। এ অনুবাদঘটনাকে সম্ভবত এরকম একটা স্বীকৃতি হিসেবে আমলে নেয়া যায় যে, ছন্দ অর্থাৎ ব্যাকরণ-শৃঙ্খলাকে কখনো সখনো ভাবগত শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করা সিদ্ধ!

ঐতিহ্যবাহী জাপানি হাইকুর মাত্রার হিসেব সিলেবিক (স্বরমাত্রিক) হলেও বাংলা স্বরবৃত্ত ছন্দ হাইকুর জন্য বিশেষ উপযোগী নয়। এটি স্বভাব ও ঐতিহ্যগতভাবে বিশেষ চটপটে, যেজন্য হাইকুর অবশ্যম্ভাবী গাম্ভীর্য এর দ্বারা রক্ষিত হওয়া মুশকিলের। কাজেই এর রক্ষা হতে পারে অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তে। আবার অক্ষরবৃত্তে জোড়ে জোড় আর বেজোড়ে বেজোড় গাঁথবার যে সাধারণ বিধিটা কবিতাকর্মী ও কবিতাপাঠকের মাথায় গেঁথে আছে, তাতে তাঁদের রক্ষণশীল মন এর ৫+৭+৫ বিন্যাস ঠিক সইতে পারে না। কাজেই শেষ ভরসা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, যাতে ৫ ও ৭ মাত্রার পর্ববিন্যাস আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। মাত্রাবৃত্তে বাশোর এই হাইকুটির উল্লিখিত ইংরেজি পাঠের হয়ত এরকম একটি অনুবাদও করা যায় : ‘প্রাচীন দিঘি/ লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ/ জলোল্লাস’। কিন্তু বলতে কী, মূলের সাথে মাত্রাগত সমন্বয় রক্ষা করে চললেও ভাবগত নৈকট্য রবীন্দ্রনাথের রূপান্তরে ঠিকঠাক ধরা পড়ে যে প্রত্নগাম্ভীর্য সৃষ্টি করেছে, এটিতে তা ধরা পড়ে নি। তবে কবিতায় স্থাপিত গাম্ভীর্যের (প্রাচীন দিঘি) আকস্মিক স্খলনটা (লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ) এখানে একটু বেশিই মূর্ত হয়েছে, সম্ভবত।

বাংলাভাষায় ইতোমধ্যে অনেকেই হাইকু অনুবাদ করেছেন ও মৌলিক হাইকু লিখেছেন। এসব কাজ যতদূর চোখে পড়েছে, তাতে বলা যায় যে, তা কোনোই সাধারণ রীতির ভিতর দিয়ে এগোয় নি। এটাই স্বাভাবিক মনে হয়। কারণ হাইকু নিয়ে এ যাবৎ মান্য কোনো কাজ বাংলায় হয়ে ওঠে নি, যাকে পরবর্তী হাইকু লেখকগণ সমীহ করতে পারেন। কাজেই সব মিলিয়ে বাংলা হাইকুরাজ্যে এ যাবৎ বিশৃঙ্খলারই জয়জয়কার। এই প্রেক্ষাপটে আমার মনও এবারের জন্য বিশৃঙ্খলার জটে আটকে গেল। এ রাজ্যে অল্পস্বল্প বিহারের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে নানা ছন্দমাত্রায় লিখে ফেলা গেল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হাইকুমতো রচনা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো হাইকু দিয়ে একটা বর্ণমালা সাজিয়ে ফেলা গেলে কেমন হয়, যাতে বর্তমান বাংলাভাষার ৫০টি বর্ণের প্রতিটির জন্য একটি করে মোট ৫০টি হাইকু যুক্ত হবে, যেগুলোর শুরু হবে ওই নির্দিষ্ট বর্ণ দিয়ে! মুশকিল এই যে, বাংলা বর্ণমালার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ উভয় অংশেরই কিছু বর্ণ আছে, যেগুলো দিয়ে কোনো বাংলা শব্দই শুরু হয় না। এ সীমাবদ্ধতার একটা সহজ উত্তরণসূত্রও খুঁজে নেয়া গেল, যে, প্রথম পঙক্তির প্রথম শব্দের প্রথম অক্ষর না-হোক, অন্তত প্রথম শব্দে নির্দিষ্ট বর্ণটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলেই পাস নম্বর বুঝে নেয়া হবে। এভাবে গোছাতে গিয়ে মাথায় একটা বদবুদ্ধিও খেলে গেল। ভাবলাম যে, যেহেতু পরিকল্পনার আওতায় প্রতিটি বর্ণ ধরে আলাদা আলাদা এন্ট্রি রাখবার সিদ্ধান্ত পাকা হয়েছে, কাজেই এখানে বাংলা বর্ণমালার সব বর্ণেরই সমান গুরুত্ব পাওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যায়, সব বর্ণকে সমান মূল্য দেবার এই অভিপ্রায়কে পুরোপুরি সম্মান দেখাতে গেলে বাংলা ভাষার তিন ছন্দের (স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত) কোনো চালেই এগোনো যায় না। তিনটি ছন্দের মধ্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দটা সাধারণভাবে অক্ষরাণুসারী হলেও অসাধারণত (শব্দের শুরু ও শব্দমধ্যস্থ বদ্ধস্বরের ক্ষেত্রে) ওরও ব্যতিক্রম আছে। কাজেই এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় মনে হলো ৫+৭+৫-এর হিসেবটা বর্ণমাত্রিকভাবে করা। অর্থাৎ কড় গুনে ১৭টা বর্ণ দিয়ে ৫+৭+৫ বিন্যাসে লিখবার চেষ্টা করা। বর্ণমাত্রিকতা অবশ্য ব্যতিক্রম বিবেচনায় না-নেয়া অক্ষরবৃত্তই। এতদসত্ত্বেও, এখানে আমি সচেতনভাবে ‘বর্ণমাত্রিক’ কথাটিই বলব বলে ঠিক করেছি, যেহেতু বর্ণকেই একক ধরে আমার এই সন্নিষ্ঠ যাত্রা। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, বর্ণমাত্রিকতা আমার বাতিঘর হলেও রচিত কোনো-কোনো হাইকু ৫+৭+৫ চালে একইসঙ্গে মাত্রাবৃত্তে উত্তীর্ণ, কোনোটা-বা স্বরবৃত্তে, আবার কোনোটা-বা অক্ষরবৃত্তে। অবশ্য এসব অর্জন বরাবরই উপজাত।

যাহোক, বর্ণমাত্রিক চালে কাজ করতে শুরু করে ধরা পড়ল যে, বাংলা বর্ণমালার শেষ বর্ণ আনুনাসিকতার পতাকাবাহী চন্দ্রবিন্দুকে এক মাত্রার মূল্য দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, সেটা চাওয়াটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। তাছাড়া যুক্তবর্ণকে একাধিক মাত্রামূল্য না-দেয়াও আমার জন্য নিরাপদ ভেবে নিয়েছি, সংগতও।

এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকে অনেকদূর অগ্রসর হয়ে মনে হলো, যেহেতু ছন্দবিনয়ী ও ছন্দশাসিতরা এরকম করে কখনো গাঁথেন নি কথা, যেহেতু এই মাত্রাবিন্যাস আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকৃত হয় নি, কাজেই এখানে এমন কিছু শব্দবন্ধ তৈরি হতে পারে, যা পুরোপুরি আনকোরা, কবিতায়। অন্তত হবার কথা, যুক্তির গণিতে। একজন সৃজনমগ্ন লেখক হিসেবে আমি কেন সেদিকেই হাঁটব না, যেখানে আমাকে, আমার পঙক্তিকে, আমার কাজকে চেনা যাবে নতুন করে? নিয়ম ভাঙার ঘুপচি সড়ক ফেলে আমি কেন সদরপথের পথিক হবো, যেদিকে ঘিঞ্জি গগন, খুঁজেপেতে শ্বাস ফেলতে যে পথের তারাদের হয় প্রাণপাত হবার জোগাড়?

রচিত বাক্যগুলো যদি স্বাধীন শক্তি ধরে, সৌন্দর্য যদি ভর করে আসে ফুলের বুকে বসা পাপড়ির মতো, কণ্ঠ যদি ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি করে, চিন্তার দরজা যদি দেয় এটি খুলে, চিরন্তন কোনো ছবির শিংয়ে এ যদি বেঁধে দিতে পারে কোনো রঙিন পতাকা, একে তবে শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে কেন গণ্য করা হবে শুধু? প্রশংসা কেন শুধু নিয়মানুবর্তী অনুকারকের জন্যই প্রাসঙ্গিক হবে? বিশৃঙ্খলা যদি নতুন আনন্দকে খুঁজে এনে দিতে পারে, তা যদি ইন্ধন জুগিয়ে নিয়ে বসিয়ে দিতে পারে ধ্যানের পাটিতে, সেক্ষেত্রে শৃঙ্খলানাম্নী আঁটসাঁট তনু হরিণীর নিতম্বের দিকে তাকিয়ে চিরকাল হস্তমৈথুন করে যাবার মতো বৃথাকর্ম আর হয় না!

হাইকুকে কেবল অভিজ্ঞতার মুহূর্ত বয়ান করবার কথা বলেন অনেক তাত্ত্বিক। কিন্তু ও যদি সমগ্রতাও ধরে কোনো বিষয়ের, ও যদি বিস্তৃত হয়ে আসে বড়ো কোনো ক্যানভাস জুড়ে, তবে কি ওর ওজু নষ্ট হয়ে যায়? যদি যায়ও, তবে কি ওর জন্য হারাম যেকোনোরকম কাব্যনামাজ? হয় হোক, এরকম কুফুরি কালাম পড়ে কারো যদি ধর্মচ্যুতি ঘটে যায়, তবে যাক তাও। তখন যদি নাখোশ পাঠক বলেন, এগুলো হাইকু না বাইকু, তাতে কী আর এমন যায়-আসে? মূলকথা হলো মানে ধরা, আরোসত্যের ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো সৌন্দর্যকে গ্রেফতার করা; সে যদি হয় তো এ ঝুঁকি মাথায় নিয়েও কিছু পথ দাপটের সাথে হেঁটে যেতে ভয় পাব কেন? বাংলা হাইকুকে শেষাবধি আমি যদি বাইকুই বলি, তারেই বা বাধা দেবেন কেন খোলামন সুবুদ্ধি পাঠক? পাঠকের কি অনুকারকের নামে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনই কাজ? নইলে কেন তাঁরা নতুনের দিকে তাকিয়ে, তার আনন্দধারায় নেয়ে হেসে উঠবেন না একবার? তাঁরও তো নবানন্দ চাই, নতুন করে চিনে ওঠা গিরিগুহা চাই, অথবা অন্য কিছু। সেটা যদি এইখানে মেলে এসে শৃঙ্খলাপাড়ার থেকে দূরে, এই ছাতিমতলায়, তবে শরৎকে অযথা কেন দু’পায়ে ঠেলেন?

পাঠক আসুন, বাইকুজ্বরে কিছুকাল ভুগি। দেখি ওর লেজ বা কানের আগার দিকে চুপ করে বসে আছে কিনা কোনো সুগন্ধী আরক, বিরল খরগোশ।

অক্টোবর ২০১০

বাইকুস্বর

অ.   
অনৃতভাষ
রংচঙে বদন
সত্যে প্রহার   

আ.
আয়নাসুখ
হ্রদের দীর্ঘ তীর
চলন্ত ভোর   

ই.
ইস্পাত লিখে
হাঁপর ও ছেনাতে
লোহার কবি   

ঈ.
ঈতিপ্রহর
শকুন ওড়া দিন
ভাবের লয়   

উ.       
উড়ন্ত দিন
বাঁশি রোরুদ্যমান
খাঁখাঁ প্রান্তর   

ঈ.
ঊষার স্তন
কাঁপছে থিরিথিরি
নিমের গাছ   

ঋ.
ঋতার মন
ফলদ বারোমাস
প্রণয় খেত       

এ.   
একলা মাঘ
ঝলসানো তাওয়া
ভাষার রুটি   

ঐ.
ঐহিক সব
ভালো ও মন্দ ফল
বাকি কুয়াশা   

ও.
ও-কার ছাড়া
মনের চোখে দেখা
যোগবিহীন   

ঔ.
ঔষধদ্বেষ
বুকের মধ্যে চাপা
মৃত্যুমোহন   
 
বাইকুব্যঞ্জন


ক.
কাশের দেশ
শরৎ ফুটে আছে
দুর্গাদেবীর   

খ.
খুঁড়ছো গুহা
সৃজন্নদীর বুক
বাঁচার ছল   

গ.
গান গাইছে
পাড় ভাঙছে বলে
বুকের নদী   

ঘ.
ঘণ্টা হয়েছে
ছিদ্র নিচের দিকে
পয়সা ঢালা   

ঙ.
পঙক্তিবীথি
খলবলানো ছবি
কবির কৃতি

চ.
চৈত্রভাষণ
বর্ষায় দেয়া দোষ
আলটপকা   

ছ.
ছাতিম ফুল
ফুটল অন্ধকারে
বিভূঁই মন   

জ.
জনক লাল
জননী নীলরঙা
দুনিয়াদারি   

ঝ.
ঝড়ের শেষ
ধ্বস্ত পাখির বাসা
নীরব গান   

ঞ.
ভূঁইঞা বারো
সুনাম কিনেছিল
দেশপ্রেমিক

ট.
টোপর পরা
কিমাকার অদ্ভুত
ভয়ের যোনি   

ঠ.
ঠান্ডা হাওয়া
চুপসে দিয়ে গেছে
প্রায়াপিজম   

ড.
ডোবার নেশা
টিলায় বিচরণ
রতিকাঞ্চন   

ঢ.
ঢালপ্রহরা
বর্ম বেঁচে থাকার
জীবনপুর   

ণ.
ণ-ত্ব বিধান
ঠেলছ অকারণ
প্রমিত বোধ

ত.
তিয়াস বাঁচে
জোছনা অবসান
বুকের বাড়ি   

থ.

থরকম্পন
স্থিতির আহাজারি
চিন্তার্বিদ্যুৎ   

দ.
দখিন দেশ
প্রজন্ম ফুল ছিঁড়ে
হিংস্র বায়ু   

ধ.
ধ্যানগম্ভীর
স্তম্ভিত জলাধার
হত্যা স্মারক   

ন.
নটের হাসি
নটীর নদীতীর
ঝাঁপের নেশা

প.
পেছন হলো
নিজের দিকে ফেরা
নস্টালজিয়া   

ফ.
ফল পেকেছে
সুগন্ধ টের পেল
ছায়ার মাছি   

ব.
বাস্তবতার
যোনি বিদীর্ণ মেঘ
সন্ধ্যা বিরূপ   

ভ.
ভাটির টান
সময় যাচ্ছে মরে
কদম ফুল    

ম.

মন বিবাদ
ঝড়ঝঞ্ঝার হাসি
গুমোট ঘর

য.
যতির নিচে
লুকিয়ে থাকে জল
প্রবহমাণ   

র.
রোদনবাঁশি
হুল ফুটানো বায়ু
মরণদ্বার   

ল.
লুণ্ঠিত সুখ
জীবন পরিক্রমা
বিদ্রোহ স্বর    

শ.

শালের বন
বদনসুখী মৃগ
অতীত প্রায়   

ষ.
ষড়ঙ্গ-ধূপ
পুড়ছে সন্ধ্যা রাত
পূজার্থী মন

স.
সোনার চাঁদ
চিত্রভাষের ঢিল
জলের ছটা   

হ.
হাঁড়ির শব্দ
স্থগিত বহুকাল
ঘরের ভয়   

ড়.
পড়া ফরজ
ভাদ্রে উঠেছে জেগে
বাইকুমালা   

ঢ়.
রূঢ় বৈশাখ
লুটছে স্বাধীনতা
সাম্রাজ্যবাদ   

য়.
পায়ের নিচে
বইছে কুলকুলু
তেলের নদী

ৎ.   
হঠাৎ ঝড়
ফুঁসল রাতে নদী
ফুলশয্যায়   

ং.
বাংলা ভাষা
শস্যবহুল মাঠ
বিচিত্র সুর   

ঃ.
নৈঃশব্দ্যের
অন্ধগলির শেষ
ধ্যানের বাড়ি   

ঁ.
বাঁধ ভঙ্গুর
বানের লুটোপুটি
জলউদ্বাস্তু

রাশেল মাহমুদ সম্পাদিত বাউণ্ডুলে-তে ২০১১-এ প্রকাশিত

কবিতার বিষয় ও চঞ্চল আশরাফের কবিতার জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট বিষয়োপাদান

কবিতার কি নির্দিষ্ট কোনো থিম বা বিষয় হয়? এর জবাব যুগপৎ ‘হয়’ এবং ‘হয় না’। মোটাঅর্থে সব কবিতারই কোনো-না-কোনো বিষয় শনাক্ত করা যায়, চাইলে। কোনো-কোনো কবিতা আক্ষরিকভাবেই নির্দিষ্ট একটা বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে, কোনোটার-বা একটা কোনো বিষয়কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ওসবে বিভিন্ন বিষয়ের চূর্ণ-চূর্ণ রেণু এসে মিশে থাকে আলগোছে, অবলীলায়। সব মিলিয়ে এমন এক জটিল বিষয়ভাবনার ওগুলো জন্ম দেয় বা এমন একটা বিষয়রূপ ওসব কবিতা ধারণ করে, যাকে ওই-ওই খণ্ড উপাদানের নামে আর ডাকা যায় না। ডাকতে-চিনতে হয় অন্য কোনো নামে; দুই অণু হাইড্রোজেন এক অণু অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে গেলে যেমন তাকে হাইড্রোজেন বা অক্সিজেন না-বলে পানি নামে ডাকতে হয়। এরকম প্রেক্ষিতে কবিতার কোনো বিষয় হয় না বলাও একভাবে সত্য বলাই; যদিও কবিতা বিষয়নির্দিষ্ট, এই মতটিই সর্বাপেক্ষা চর্চিত। চঞ্চল আশরাফ নিজেও এরকম করে ভাবেন বলে জানি (‘কিভাবে লিখছি-র পাশাপাশি কী লিখছিও বড় কথা’ : চাবিশব্দই যখন কবিতার প্রধান সহায়)।

আমরা দেখি, ভাষাগত উপাদানসহযোগে কবিতা অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়, স্বপ্নকে ভাষা দেয়, মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে মত দেয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়, পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে, গল্প বলে। ইত্যাকার কাজবাজের এই অসম্পূর্ণ তালিকাটি কবির দিক থেকে। পাঠকের দিক থেকে দেখলে এ কাজগুলোর একটি বা কোনো-কোনেটির প্রভাবে পাঠকের মধ্যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ যে ক্রিয়া-বিক্রিয়া সংঘটিত হয়, তা-ও কবিতারই দ্বিতীয় ধাপের কাজ। আনন্দ পাওয়া বা তাড়িত, উদ্বুদ্ধ, বিষাদগ্রস্ত ও বিরক্ত হওয়া ইত্যাদি এ পর্যায়ে সংঘটিত কাজ। এটা পাঠকের ওপরে কবিতার তাৎক্ষণিক বা সরাসরি প্রভাব। তৃতীয় একটা ধাপও আছে কবিতার কাজের, যেটা ধীরগতিতে সম্পন্ন হয়। কবিতার দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়িত্বশীল প্রভাব বলা যায় একে। ব্যক্তিপাঠককে ছাড়িয়ে যখন আমরা বৃহত্তর সমাজে কোনো-কোনো মহৎ কবির কর্ম ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব দেখি, তখন এ পর্যায়ের কাজ ঠিকঠাক বুঝতে পারা যায়। এরকম ক্ষেত্রে আমরা নাম করতে পারি সমাজসদস্যদের মানসগঠন, রুচিগঠন, বাচনসৌন্দর্য সৃজন, প্রবাদসত্য হিসেবে পথ দেখানো ইত্যাদির। তিন ধাপে এই যত কাজকাজ এখানে চিহ্নি‎ত হলো কবিতার, কবিতা যদি সম্পূর্ণভাবে বিষয়রিক্ত বা রহিত হতো, তাহলে এর কোনোটাই প্রায় সম্ভব হতো না বলা যায়।

বিষয়ের এই থাকা না-থাকা, কিংবা যদি বলি দানাবাঁধা স্পষ্ট-সরল বিষয় থাকা বা চূর্ণ-চূর্ণ বিষয়রেণু থাকা-- এসবেরও নানা জাতভেদ ভাবা যেতে পারে। বাকি সব জাতভেদের ভাবনা আপাতত তোলা থাক, এ মুহূর্তে অন্তত এটা বলাই যায় যে, কোনো-কোনো বিষয় হতে পারে সমসাময়িকতা-সর্বস্ব, কোনোটা-বা চিরকালীন; কোনো-কোনোটা হতে পারে নিছক ব্যক্তিক, কোনোটা-বা নৈর্ব্যক্তিক বা সর্বজনীন। স্বীকার্য যে, কবিতার তথা শিল্পের বিষয় হিসেবে এই দুটি ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়োক্তের স্থান সর্বাগ্রগণ্য। এই সেই কারণ, যেজন্য কবিতাকে ব্যক্তিক সীমার বাইরে নিয়ে যাওয়া ও সমসাময়িক অভিজ্ঞতাকে চিরকালীন সাধারণ সত্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবার জন্য সমসাময়িক কোনো ব্যক্তিক ঘটনা থেকে তাড়িত হয়ে রচিত কবিতার কবিকেও চেষ্টা জারি রাখতে হয়। এ না-হলে সে কবিতার গ্রহণযোগ্যতা যেমন প্রশ্নাতীত হয় না, তেমনি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে তা প্রাসঙ্গিকতাও হারিয়ে ফেলে। চঞ্চল আশরাফের কবিতা পড়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, শিল্প তথা কবিতাযাত্রার এই প্রাথমিক পালনীয় শর্তটি তিনি জানেন শুধু নন, চর্চা করবার যোগ্যতাও রাখেন।

জীবজগৎ ও জড়জগৎ উভয়েরই কিছু সাধারণ গতিপ্রকৃতি থাকে, যা হাজার হাজার বছর ধরে অবিকল আছে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষ এসব গতিপ্রকৃতি নিজেদের অভিজ্ঞতায় গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার লব্ধ এই জানাবোঝাকে পর্যবেক্ষণের সীমা থেকে টেনে তুলে পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছে। বিজ্ঞানের এই সত্যগুলোর সাপেক্ষে কবিতা যখন তার নিজ বৈশিষ্ট্যযোগে কবিতার সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তখন সে কবিতার বেঁচে থাকার একটা অন্তত শর্ত পূরণ করা হয়ে যায়। এই শর্ত চঞ্চল আশরাফ প্রায়ই পূরণ করেছেন, তাঁর কবিতায়। এ অর্জনকে শ্রেণীকরণ করতে চাইলে আমরা দেখি তাঁর ঝোঁক জীবজগতের তিনটি বিশেষ পর্যায়েই ক্রিয়াশীল-- জন্মপ্রক্রিয়া, যাপনশৈলীসন্ধান ও বিলয়ঘটনা। আর এর সাথে জড় ও জীবপ্রকৃতির নানা উপাদান মিলেমিশে গেছে, যখন-যেটুকু-যেভাবে তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

দেখা যায়, এই তিনের মধ্যে যাপনশৈলীসন্ধানের কাজটিই করেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কবি, সব ভাষায়ই। করেন সংগত কারণেই। কারণ এই পর্যায়টিই সবচেয়ে বেশি ব্যাপ্ত, পরিচিত, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সহজগম্য। কমবেশি জন্মপ্রক্রিয়া ও বিলয়ঘটনাও কারো কারো প্রিয়। এ দুটোর বৈচিত্র্য কম, কিন্তু চিরন্তনতার বৈশিষ্ট্যে এরাই প্রথম সারির। এ দুয়ের মধ্যে আবার বিলয় বা মৃত্যুঘটনার নানামাত্রিক প্রকাশ সামাজিকভাবে যতটা গ্রহণযোগ্য, জন্মপ্রক্রিয়ার প্রকাশ ততটা নয়। অথচ জীবমাত্রের কাছে ওটাই বেশি প্রার্থিত, আর মৃত্যুকে এড়াবার চেষ্টায় তারা সদা তৎপর। জন্ম না-বলে আমরা যখন জন্মপ্রক্রিয়া বা জননপ্রক্রিয়া বা প্রজননপ্রক্রিয়া বলি, তখন তা কেবল জন্মঘটনাটিই নয়, প্রকাশিত হয় এর সঙ্গে সম্পর্কিত ক্রিয়াসমূহও। এর অন্তর্ভুক্ত সমুদয় যৌনকল্পনা, যৌনাভূতি, যৌনক্রিয়া, যৌনানন্দ প্রভৃতি। সভ্যতা কর্তৃক শেখানো আড়ালচারিতা এবং ধর্মবাহিত ও সামাজিক সংস্কারজনিত নৈতিকতা জন্মঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ইত্যাকার বিষয়াদির প্রকাশ এবং এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত জীবাদির সমুদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গোপন বিষয় বলে সাব্যস্ত করেছে। অথচ এটার উল্লেখ বাহুল্য হবে না যে, জীবমাত্র এবং সুনির্দিষ্টভাবে মানুষমাত্র তা সে নারী কিংবা পুরুষ যেই হোক, আনন্দার্থে যৌনাচারকে পছন্দ করে এবং প্রজননার্থে যৌনকর্মকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান করে। যা মানুষ পছন্দ করে, প্রত্যাশা করে, প্রয়োজনীয় জ্ঞান করে অথচ চাহিবামাত্র তার চর্চা করতে পারে না, তখন এই বাস্তবতাটিই সৃষ্টি করে অবদমন। জন্মপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত অবদমনকে আমরা যদি বিশেষভাবে শনাক্ত করতে চাই, তাহলে তাকে আমরা বলতে পারি যৌন অবদমন। এই যৌন অবদমন মানুষের মধ্যে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, তা মানুষভেদে নানারকম ফল দেয়। এই মানুষটি যদি হন কবি, তবে তাঁর কবিতায় এর প্রকাশ থাকবে, অন্তত বলা যায় যে, থাকতে পারে। কবিতা নির্মাণের শৈলীকলা ভালোভাবে আত্মীকৃত না-হলে এসবের কামগন্ধী অশ্লীল অপকৃষ্ট রচনা হয়ে ওঠবার আশঙ্কা থাকে, আর জানা থাকলে তা হতে পারে শৃঙ্গাররসসম্ভূত উৎকৃষ্ট কবিতা।

যৌন অবদমন বা কোনো ধরনের যৌনবিকার চঞ্চল আশরাফকে শাসন করে কি না তা নিশ্চিত করে বলার কোনো সুযোগ নেই। এটা প্রতিপন্ন করা এ বাক্য বিবৃত করার জন্য জরুরিও নয় যে, চঞ্চল আশরাফের কবিতায় আমরা জন্মপ্রক্রিয়ার অধীন বিস্তৃত এলাকার আওতায় পড়ে এমন বিষয়োপাদানের বিস্তর প্রয়োগ দেখতে পাই। বলাই বাহুল্য যে, সবসময় তা মুখ্য বিষয়রূপে নয়, পার্শ্ববিষয় হিসেবে বা বিষয়চূর্ণরূপেও তারা বিরাজমান। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ চোখ নেই দৃশ্য নেই (১৯৯৩) থেকে শুরু করে অসমাপ্ত শিরদাঁড়া (১৯৯৬) এবং ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে (২০০২) হয়ে শেষ কাব্যগ্রন্থ গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো (২০০৮) পর্যন্ত এসবের সমূহ বিস্তার। চঞ্চল আশরাফের কবিতার এ ধরনের বিষয়োপাদানের প্রয়োগগত শ্রেণীকরণ ও তদ্বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের উদ্দেশ্যেই এ লেখা পরিকল্পিত।

আলোচনার সুবিধার্থে আমরা জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলিকে কয়েক ভাগে ভাগ করে দেখব। ভাগাভাগি বা খণ্ডীকরণ আক্ষরিকভাবেই বৃহদ্ধারণাকে ক্ষুদ্র পরিসরে এনে দাঁড় করায়, কাজেই তা বিষয় সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা দেয় না। এই বিবৃতি যেমন সত্য, তেমনি এ-ও মিথ্যা নয় যে, বিষয়বস্তুকে খণ্ড খণ্ড করে তারপর তাতে দক্ষতার সাথে আলো প্রক্ষেপণ করা গেলে এমন কিছু সূক্ষ্ম ব্যাপার বড়ো হয়ে সামনে চলে আসে যে, ওসব বিষয়বস্তুর পূর্ণ অবয়বের ওপরে আলো ফেললে প্রায় দেখাই যায় না। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেখা-জানা একসঙ্গে করে পরে সামগ্রিক সিদ্ধান্ত টানা যায়। এই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্তে পৌঁছা চিন্তারাজ্যে স্বীকৃতও।

এখানে কথিত জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলিকে আমরা দেখব মোটাদাগে তিনভাগ করে-- ১. জননসত্য, ২. কামসত্য ও ৩. যৌনঅপরাধ হিসেবে। প্রতিপাদ্য বিষয়ের এই তিনটি রূপই চঞ্চল আশরাফের কবিতায় লভ্য, অন্তত আমার চোখে। উদাহরণ দেখা যাক।

১. জননসত্য

ক.
একটি টিকটিকি
ছুটে গেল আরেকটি টিকটিকির দিকে
একটি মোরগ প্রকাশ্য দুপুরে
উপগত হলো আরেক মুরগিশরীরে

একটি পাখির ঠোঁট
সংযুক্ত হলো আরেকটি পাখির ঠোঁটে
একটি কুকুর দুর্দান্ত দুপুরে
দখল করল একটি কুকুরীর গুহ্যদেশ

এক নিঃসঙ্গ বিধবা
এইসব দৃশ্য পাহারা দিতে দিতে
স্বর্গে চলে যায়
(‘বিধবা ও পশুপাখি’, চোখ নেই দৃশ্য নেই)

খ.
মানুষের অসমাপ্ত শিরদাঁড়া বেঁকে যায় শিশ্নক্ষমতা তার যখন বাজায়
শেষ ঘণ্টাধ্বনি
(‘চক্র’, অসমাপ্ত শিরদাঁড়া)

গ.
ঠোঁটে ছিলো স্তন, প্রসবের পরের উষ্ণতা, ও-তো শিশুদেহ
আনন্দের উপজাত প্রাণ, শয্যার মত্ততা থেকে কোন পুরুষ কখনো
তার নারীকে বলেনি : আজ তোর গর্ভদিন, প্রত্যাশিত প্রাণের সূচনা
ঘটে যাক
(‘কবি’, ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে)

ঘ.
উঠোনের কোনে শৌচকর্ম শেষ করে এক নারী
তাকালো আমার দিকে; যেন খুব যৌন-অপরাধ হয়ে গেল--
তার গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা দেখে ফিরে আসি...
(‘সুইসাইড-নোট ৩, গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো)

নিঃসঙ্গ বিধবার বেদনাকে মূর্ত করতে গিয়ে প্রথম উদ্ধৃতিতে বিভিন্ন প্রাণীর প্রজননদৃশ্য এঁকে চঞ্চল জগতে প্রাণের চিরপ্রবহমানতাকেই চিত্রিত করে ফেলেছেন। দ্বিতীয় উদ্ধৃতির শিশ্নক্ষমতা দিয়ে সকল ধরনের সক্ষমতাকেই বোঝায়, যার মধ্যে জন্মদান-সক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট। এক্ষেত্রে অক্ষমতা, এক অর্থে প্রাণপ্রবাহেরই লয়। সংগত কারণে এই পঙক্তি জননসত্যের অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় উদ্ধৃতিতে চিত্রিত শিশুর মুখে মাতৃস্তন, মা-শিশুর মধ্যকার এক চিরন্তন সত্যছবি, যতই শিশুজন্ম মা-বাবার মধ্যকার আনন্দের উপজাত হোক (শিশুজন্ম কেবল মা-বাবার আনন্দের উপজাত কি না, এ নিয়ে দোসরা বাগবিস্তারের অবকাশ আছে; তবে এ মুহূর্তে তাতে নিরস্ত হওয়া গেল)। শেষ উদ্ধৃতিতে গ্রামবাংলার পয়ঃব্যবস্থার একটা বিশ্বস্ত ছবি ধরা পড়েছে। শৌচকর্মের দৃশ্য দেখা সন্তানসম্ভবা নারীর দৃষ্টিতে যৌন-অপরাধ হোক বা না-হোক, গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনাটি এখানে প্রাণের পক্ষে এক ব্যাপক জয়ধ্বনি। কবিতায় কিংবা অন্য যেকোনো লেখায় জন্মপ্রক্রিয়ার এ ধরনের চিত্রায়ণ চিরসম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়ায়, ধরে সর্বজনীনতার শক্তিও, সম্ভবত। 

২. কামসত্য

ক.
আমি মৃত্যুর সঙ্গে শয্যায় গেলাম
সে তার স্তনের শীর্ষ মুখে পুরে দিয়ে
বিলি কাটল আমার চুলে
গিটারে অভ্যস্ত আমার আঙুল
ঘুরে বেড়ালো তার নিতম্বে ও গ্রীবায়
মৃত্যুর মাংশও বেজে উঠল গিটারের মতো
...
আমার যৌনদৃশ্যে উত্তেজিত সেই নারী
বেশ আগে ব্যস্ত ছিল মসৃণ হস্তমৈথুনে
কী সুন্দর, স্বর্গসম্মত ছবি! 
(‘মৃত্যুমৈথুন, চোখ নেই দৃশ্য নেই)

খ.
আমাদের যৌনান্ধ জাগরণ শেষে হয়ে গেছে : যৌথ লাম্পট্য, মূর্খতা
দিগম্বর হাওয়ায় রেখে শরীরের ভর
...
ঘুমের ভেতর কেন জেগে ওঠে লাল থাম, ছুরি, দাঁত, মৃত্যু
বেশ্যার বিশ্রস্ত পাঠশালা
(‘দাম্পত্য’, অসমাপ্ত শিরদাঁড়া)

গ.
তুমি কি রেখেছ মনে
যৌবনের প্রথম প্রদোষে
এক এলোমেলো উদাসীন অন্ধকারে
দশটি আঙুল
উত্তাপের অলিগলি ঘুরে, হেঁটে হেঁটে
খুঁজেছিল স্তন আর নিতম্বের গোপন উপমা
তোমার শরীরে, সারারাত
(‘বিস্মৃতি’, ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে)

ঘ.
কে ধরেছে কার অঙ্গ, এটা কি মনীষা কৈরালার হাত? মৌলবির
ছেলে রাতে স্বপ্নে দেখেছে তাকে, ঘুম থেকে ছুটি নিয়ে সে ছুটেছে
তারকার দিকে;
...
গোছলের আগে সে বসেছে ওই তারকার ছবি নিয়ে, যার ওমে
ঘুম টুটে গেল তার; আর সুখের বিনিদ্র ফোঁটা ঝকমকিয়ে উঠছে
নীরবতায় রেখে-আসা রাতের আকাশে
(‘মাস্টার্বেশন’, গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো)

‘মৃত্যুমৈথুন’-এ নারীরূপী মৃত্যুর সঙ্গে কামলীলার যে বিবরণ হাজির করা হয়েছে, সেখানে জড়তুল্য মৃত্যুর জীবিতের মতো আচরণ করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু দ্রষ্টব্য নেই। এই পারসনিফিকেশনকে অজাচারের দিকেও খানিকটা অবনত বলে মনে হয়। ‘দাম্পত্য’ বিগত হয়ে যাওয়া যৌনান্ধ জাগরণকালের বর্ণনা করে নিজেও যৌনান্ধ আসলে। ‘বিস্মৃতি’ কামোন্মাদ এক যুবকের কামসর্বস্ব নৈশঘটনার সরাসরি বিবরণ। কৈশোরকালীন এক যৌননিরীক্ষার নাম ‘মাস্টার্বেশন’; এরকম একটি নিরীক্ষাক্রিয়ারই আনুপূর্বিক বয়ান রয়েছে এ নামের কবিতায়। কবিতায় কামসত্যের প্রয়োগ প্রকীতায়িত হলে অনেক শোভন হয়। চঞ্চল মাঝেমধ্যেই প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে কথা বলেন নি তা নয়, তবে সরাসরি বলাতেই তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য লক্ষ করা গেছে বেশি। এ জাতীয় প্রয়োগ তাঁর কবিতায় সবচেয়ে বেশি।   

৩. যৌনঅপরাধ

ক.
বিয়ের আগে তিনি সন্তান চাইলেন;
তার প্রেমিকা গর্ভবতী হলো।
(‘বিলাসিতা’, চোখ নেই দৃশ্য নেই)

খ.
জানালার শিক ধ’রে দাঁড়িয়েছে বিবাহিত নিঃসঙ্গ মেয়েটি
কুয়াশা জানে না
নির্ঘুম শয্যায় ছিলো তার ধর্ষকের অভিষেক, আঙুল ও মাংশময় ছুরি
(‘ঘড়িতে সকাল সাতটা তখন’, অসমাপ্ত শিরদাঁড়া)

গ.
কতকাল রতিক্রিয়া নেই কারো সাথে
পুতুলের মুখোশে সুন্দর মাগিরা
কোথায় গেল? উদ্যান-দরজা থেকে ধরে
নিয়ে এলাম বিশ্বস্ত ঘরে, শাড়ির সমস্ত প্যাঁচ
খুলে দেখি : তার বুক থেকে পালিয়েছে স্তন, সেখানে
রয়েছে ঝুলে মৃত ঠোঁট, বহু পুরুষের
...
মৈথুন অসম্ভব বুঝে ছুটে যাই অরক্ষিত নারীগৃহে
ধর্ষণের কথা ভাবি... 
(‘প্রেক্ষিত’, ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে)

ঘ.
একদিন ছাদে শাড়ি মেলে-দেওয়া বিষণ্ন মহিলাকে
জড়িয়ে ধরেছিলাম স্বপ্নের ভেতর
(‘স্মৃতিচারণ’, গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো)

সামাজিক, নৈতিক ও আইনগত দিক থেকে বিয়ের আগে সন্তান ধারণ আমাদের সমাজে অপরাধ। ‘বিলাসিতা’য় এ অপরাধটি স্বীকৃতি পেয়েছে। বিবাহিত নারী যে তাঁর/তাঁদের স্বামীর হাতেও ধর্ষিত হতে পারেন, ‘ঘড়িতে সকাল সাতটা তখন’ থেকে নেয়া এ উদ্ধৃতি তার স্মারক হয়ে গেছে। একটি বিশিষ্ট যৌনঅপরাধ বিষয়ক এ বর্ণনা এ কবিতার প্রেক্ষিতে যদিও নির্দোষ। বহুগামিতার অপরাধে ভাড়া করা যৌনকর্মীর প্রতি উপেক্ষা দেখানোয় ‘প্রেক্ষিত’ কবিতার পুরুষটি পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে যৌনকর্মী ভাড়া করতে পারে, সে নিজে একগামী তো নয়! কিন্তু একথা সে বেমালুম ভুলে গিয়ে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের জন্য মনে শক্তি সঞ্চয় করে। ছাদে শাড়ি মেলে দেয়ারত নারী বিষণœ হোন কি প্রসন্ন হোন তাঁকে জাপটে ধরা সংগত কর্ম নয়, যতক্ষণ না এ কাজে তাঁর সম্মতি থাকছে। ‘স্মৃতিচারণ’টা স্বপ্নে হলেও কাগজপত্রে ঘটা এই ঘটনাটি অপরাধই। যৌনঘটনার এ ধরনের প্রয়োগ প্রায়ই ঝুঁকিমুক্ত হয় না।

এখানে চঞ্চল আশরাফের চারটি কবিতাগ্রন্থ থেকে জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের কিছুমাত্র প্রয়োগের নমুনা তুলে ধরা হলো। বস্তুতপক্ষে এটিকে তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয়োপাদান (বিষয়খণ্ড ও বিষয়চূর্ণকেও ধর্তব্যের মধ্যে এনে) হিসেবেই খুঁজে পাওয়া যায়; এবং অ্যালার্মিং যে, কবি হিসেবে চঞ্চল আশরাফের যতই পরিণতি আসছে, এ প্রবণতা যেন তাঁর মধ্যে ততই বাড়ছে। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থটি প্রায় কণ্টকিত হয়ে আছে এ ধরনের উপাদানে, যা সংখ্যাগত দিক থেকেও আগের তিনটি গ্রন্থ থেকে বেশি বলে মনে হয়। তিনপর্বে উদ্ধৃত তিনটি করে কবিতা ছাড়াও তাঁর প্রতিটি গ্রন্থেই প্রতিপাদ্যের আওতাভুক্ত উপকরণ-সম্বলিত আরো অনেক কবিতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত একটা তালিকার খসড়া করতে চাইলে তা এরকম দাঁড়াতে পারে-- চোখ নেই দৃশ্য নেই গ্রন্থের পঠিত দশটি কবিতার মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের স্বপ্নবৃত্তান্ত; ভয়; রক্তলিপি; বিবাহ; অসমাপ্ত শিরদাঁড়ার ভারতবর্ষ; বিবাহ; বিজনক; বন্ধ্যা নারীর গান; দাহ; বিচ্ছিন্ন শরীরের গান, বিচ্ছিন্ন রাতে; অন্তিমতার গান; শিরোনামহীন কবিতা : মৃত মানুষের ছায়া ও রৌদ্রের রোদনভুক্ত ৫টি কবিতা; ও-মুদ্রা রহস্যে মেশের দৈহিক বৃষ্টিযাপন; নিমজ্জন চিত্র; নিমজ্জন চিত্র-২; আত্মগান, ভ্রমণ কাহিনী; নির্ঘুম; অভিসার; ইতিহাস; অনিদ্রারোগীর গান; পূর্বরাগ; অবৈধ; মুখ; বিপতœীক; কোলাহলে আদিগন্ত ঢেকে যায়; খেলা; চাবুক; সম্পর্কমন্থন; রেললাইন শুধু রেললাইন... এবং গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলোর শিকার; খেলা; স্ট্র্যাপ; ধর্ষণ; ঝুলন্ত খিলান; বিজ্ঞাপন; অভিভাবিকা; প্রাপ্তবয়স্কের ডায়েরি; বৃষ্টিতীর; আষাঢ়ের একটি কবিতা; ছাতার তলা থেকে দু’ছত্র; নারীর ভেতরে কাঁপে; সুইসাইড-নোট; সুইসাইড-নোট ৪, ঘুমন্ত নারীর দিকে; বহুগামিতার বীজ; পাতা; চিঠি নয় ও তুলনার অন্ধকার। তালিকাভুক্ত এসব কবিতায় কোনো-না-কোনোভাবে এরকম বিষয়োপাদানের প্রয়োগ শনাক্ত করা যায়। এ ধরনের কোনো কোনো পঙক্তির প্রতি তাঁর আসক্তি এতই তীব্র যে, একই বইয়ের একাধিক কবিতায়ও প্রায় অবিকল রূপে তা হাজির হয়ে গেছে। যেমন ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে গ্রন্থের ‘অবৈধ’ কবিতার এই পঙক্তি-- ‘সঙ্গমের পর তুমি গোসল করেছ, চুম্বনের পর গেছ বেসিনের দিকে’, একই গ্রন্থের ‘সম্পর্কমন্থন’ কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘তুমি তো সঙ্গমের পর/গোসল করেছ, চুম্বনের পর দৌড়ে গেছ বহুদিন বেসিনের দিকে...’ হিসেবে।

কবিতায় যৌনপ্রসঙ্গের ব্যবহার কমবেশি প্রায় সব কবির লেখায়ই মেলে, যাঁদের কেউ সরাসরি এরূপ প্রসঙ্গের অবতারণা করেন, কেউ-বা রূপকের ছলে ও প্রতীকের ছায়া তৈরি করে পরোক্ষভাবে। কবির মেজাজই ঠিক করে দেয় প্রয়োগটি ঠিক কীরকম হবে বা হওয়া উচিত। কবিতার মৌলাভীষ্টও হয়ত এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আমরা দেখি, কারো কারো কবিতায় এসব উপাদানের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। আমরা আল মাহমুদের কবিতায়, বিশেষ করে নারীদেহ প্রসঙ্গে, এ ধরনের ব্যাপক প্রয়োগ দেখি। যৌনউপাদানের তুলকালাম ব্যবহার পাই হাংরী কবিদের কবিতায়। আমাদের কোনো কোনো গণ্যকবি কবিতায় যৌনতার নানামাত্রিক প্রকাশ নিয়ে আলাদা বই করে বিশিষ্টতার দাবিদার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে নাম করা যায় বিনয় মজুমদার ও নির্মলেন্দু গুণের। বিনয় মজুমদারের বাল্মিকীর কবিতা (১৯৭৬) এবং নির্মলেন্দু গুণের বাৎসায়ন (২০০০) ও কামকানন (২০০৭) এ ধরনের বিশেষায়িত গ্রন্থ। কামকাব্যে এ দুজনের কুশলতা নানা বিতর্কের যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি এসব কাব্য ব্যাপকভাবে পঠিতও হয়েছে। সুতরাং আমি কিছুতেই এরকম কোনো কথা এখানে বলার প্রয়াস করব না যে, যৌনবিষয়াদি নিয়ে কাব্যরচনা করা মন্দ কিছু। যৌনতা জীবজগতের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ, যা না-থাকলে জীবনপ্রবাহ থেমে যেত। এ কারণে কবিতায় যৌনানুষঙ্গের উপস্থিতিও অনিবার্যই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। সুতরাং এর উপস্থিতির যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলার চেয়ে উপস্থিতির ধরন নিয়ে কথা বলাই অধিকতর সংগত। এখানে আনাড়ির মতো করে হলেও কমবেশি সে চেষ্টাটাই শুরু করা হয়েছে। এখানকার এ শ্রেণীকরণ যদি চঞ্চল আশরাফকে তাঁর প্রয়োগকৃত কথিত জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি অন্যের চোখ দিয়ে দেখবার কোনো সুযোগ করে দিতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে ধারণা করি, তিনি তাঁর পরবর্তী কবিতাযাত্রায় এসব অনুষঙ্গ হাজির করা ও প্রয়োগসাফল্য দেখানোর স্বতরিকায় খানিক পুনর্বিবেচনা আরোপ করবেন-- এই বিবৃতি দূরসীমায় বসবাসরত নৈতিক ও বৈয়াকরণিক খবরদারির লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো অসহিষ্ণু ধর্মবেত্তা বা উজ্জ্বল অ্যাকাডেমিশিয়ানের মূল্যবান উপদেশ নয়, বরং নিকটসীমায় বিহাররত সতীর্থ ও সুলভ এক কবিতাকর্মী-পাঠকের খসড়া ভাবনার উপসংহার মাত্র।

চরৈবেতি!

চরৈবেতি!

অনিকেত শামীম সম্পাদিত লোক-এর চঞ্চল আশরাফ সংখ্যায় প্রকাশিত

এক যাত্রা একুশ বন্দরে

একুশজন কবির একুশটি কবিতা পড়ে, কবিনামহীন, রীতিমতো ফাঁপরে পড়ে গেছি যেন। আমরা সাধারণত কপালে কবিনামের তিলক পরেই কবিতা পড়ে অভ্যস্ত। সে অভ্যস্ততাটা একটু ঝাঁকি খায় নাম জানা না-থাকলে। অবশ্য এটা না-মেনে উপায় নেই যে, নামপ্রভাবটা পাঠ ও মূল্যায়নের ওপরে যে শাসন জারি রাখে, এ প্রক্রিয়ায় সেটা কাটিয়ে ওঠবার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। চিন্তাটা যে আমার কাছে পুরোপুরি নতুন, তা নয়। আমরা কজন একবার এরকম করে ভেবেছিলাম, ছিয়ানব্বইয়ে। শতাব্দী কাদেরের সম্পাদনায় ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘বিবিধ’-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় কবিনাম ব্যতিরেকে বেশ কয়েকজনের কবিতা ছাপা হয়েছিল, সম্পাদকীয় আভাসসহ। ভাবা ও বলা হয়েছিল যে, পত্রালাপের মাধ্যমে লেখাগুলো সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া প্রাপ্ত হওয়া যাবে তা কবিনামসহ পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হবে। যাতে নামপ্রভাবের ঊর্ধ্বে খাঁটি মতটুকু, প্রতিটি লেখার, হাজির করা যায়। কিন্তু প্রকল্পটা উৎসাহ ও প্রশ্রয় যতটা পেয়েছিল, নিরুৎসাহ ও নিন্দা পেয়েছিল তার চেয়ে ঢের বেশি। তীব্র আক্রমণের মুখেও পড়তে হয়েছিল, মুদ্রিত বর্ষীয়ানদের দ্বারা। তাছাড়া, চিঠিপত্রের ওপরে যতটা ভরসা করা গিয়েছিল, ততটা আশ্বস্ত করে নি তা। জেলাপর্যায়েও ততদিনে পত্রপ্রথায় ভাটা পড়তে লেগেছে। ‘বিবিধ’-এর ওই উদ্যোগেও কাজেই তখনই ভাটা পড়ে। ওর শেষকৃত্যও আর সম্পন্ন করা যায় নি। ‘গোলাঘর’-এর এ সংক্রান্ত আয়োজন সে বিবেচনায় অনেক পরিণত ও স্বস্তিদায়ক। অনিশ্চিত আশ্বাস না-দিয়ে নগদানগদি একটা সংগঠিত মত কবিতাগুলোর সঙ্গে হাজির করবার চেষ্টা আছে এখানে। তদুপরি, আলোচক হিসেবে আমার এই কবিতাগুলো নামহীন পড়তে হলেও পাঠক ও লেখকগণ এখানে নামসহই লেখাগুলো পড়তে পারবেন। তত্ত্বীয়ভাবে তাই ব্যাপারটা আমার কাছে মোটের ওপর মন-সহনীয়। 

কিন্তু ব্যবহারিকভাবে দেখলে এ আয়োজনের মন্দ দিকও শনাক্ত করা যায়। প্রথমত, কবিতাগুলো সম্পর্কে এতে মাত্র একজন পাঠকের বিবেচনারই প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে, যা হাজির করা হবে একটা প্রতিনিধিত্বশীল মত হিসেবে, সম্ভাব্য মতের মেধাগত খামতিটুকুসহ। এক অর্থে এটা উন্মুক্তভাবে কবিতাগুলো উপভোগে বৃহত্তর পাঠকের সামনে একটা বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে; এমনকি কারো কারো বিরক্তিও উৎপাদন করতে পারে। অন্য অর্থে, এটা মোটেই কোনো সমস্যা নয়, বরং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখাগুলোর মেরিট যাচাই করবার ব্যাপারে পাঠকদের এটি প্রণোদিতও করতে পারে। সেটা কবিতাগুলোর জন্যেই ভালো। তাছাড়া, শিল্পমত বস্তুতপক্ষে ব্যক্তিকই হয়। নির্দ্বিধায় এরকম ব্যক্তিক মতপ্রকাশের পক্ষে দাঁড়ানো যায়। কেবল এ কিস্তির আয়োজনে আমার যা একটু সংশয় থেকে যাচ্ছে, সেটা নিজে মতপ্রদানকারীর দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বলে। দুজন হলে কী হতো, তিনজন? দেখা যেত যে, মতগুলো বদলে যাচ্ছে, জনে জনে। এর চেয়ে বেশি সংখ্যক হলেও বদলাতো নিশ্চিত। এই বদলটাই সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যের। প্রতি ক্ষেত্রেই মতপ্রদানকারীর জানাবোঝা, বিষয় সম্পর্কে দখল, শিল্পবস্তু আস্বাদনের (এখানে কবিতা পড়বার) পূর্ব অভিজ্ঞতা, দেখবার ও বলবার দক্ষতা, প্রকাশকৌশল ইত্যাদি একটা বিশেষ মতের জন্ম দিতে পারত, যেটা অতি অবশ্যই হতো অন্যটি থেকে আলাদা। ব্যাপারটা বেশ উত্তেজনাকর, সন্দেহ নেই। পাশাপাশি আমার পক্ষ থেকে উদ্বেগটা এখানে যে, যতই আমাকে কবিতাগুলো কবিনামহীন করে পড়তে দেয়া হোক না কেন, মতপ্রদানকারী হিসেবে আমার বেনামে কথা বলবার কোনো সুযোগ এখানে নেই! বেনামি আলোচকের মতগ্রহণ করবার মতো ঔদার্য্য শিল্পীমাত্রের না-ও থাকতে পারে। কাজেই, বক্তব্যের দায়টা মতপ্রদানকারী হিসেবে পুরোপুরি আমার কাঁধেই বর্তাবে। এটা একটা নিয়ন্ত্রণ কাঠি, নৈরাজ্য ঠেকাবার। যা খুশি বলবার কোনো সুযোগ এখানে নেই, বলবার দরকারও নেই অবশ্য।

তবু, এ ধরনের বিবেচনার অনেকেই বিরোধিতা করেন। তাঁরা মনে করেন, শিল্পকর্মের সঙ্গে শিল্পীকে (এখানে কবিতার সঙ্গে কবিকে) মিলিয়ে দেখলেই কেবল শিল্পবস্তুর প্রকৃত উৎকর্ষ/অপকর্ষ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। শিল্পীবিহীন শিল্পকর্ম যেহেতু অসম্ভব, কাজেই শিল্পীসম্পর্ক বিচ্যুত করে করা শিল্পালোচনাও সম্পূর্ণাঙ্গ নয়। লোকশিল্পকর্ম বিষয়ক আলোচনায় এ বিষয়ক অনুরক্তি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ধরা যাক কোনো একটা লোকগানের কথা, যার একক স্রষ্টার কথা জানা যায় না। এক্ষেত্রে গোটা একটা জনপদকে, তথা ওই নির্দিষ্ট জনপদের সকল মানুষকেই গানটির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ স্রষ্টা হিসেবে ভাবা হয়। এ মতের মোটকথা হলো স্রষ্টা একজন লাগবে, কাল্পনিক হলেও! নামপ্রভাবের সীমাবদ্ধতাসহই এ মত শিল্পকর্মকে দেখতে চায়। সেরকম করে দেখা অবশ্য মোটেই রহিত হচ্ছে না, একবার নামহীন করে দেখলেও। মুদ্রিত হবার পরে সে সুযোগটা অবারিতই থাকছে। তখনকার প্রেক্ষিতে, প্রথমবার মতপ্রদানকারী হিসেবে আমার বিবেচনাকে যাঁরা পুনর্বিবেচনা করবেন, তাঁদের ও আমার মধ্যকার সুবিধা-অসুবিধার পার্থক্যটা আমলে নেবার মতো। কারণ পরবর্তী বিবেচকগণ এটিসহ সকল লেখাকেই নামযুক্ত অবস্থায় পাবেন। এক্ষেত্রে তাঁদের মতের সাথে যুক্ত হবে লেখকদের নামের ওজন ও তাঁর তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক; নিদেনপক্ষে তাঁদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কিত অর্জিত ধারণা ও মিথ। ফলে তৈরি হবে প্রচুর ভিন্নমত। যদিও প্রতিবারই তা হবে ব্যক্তিরই মত। কিছু মত কিয়দংশে অন্যমতের কাছাকাছি হলেও তা সর্বক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরই মত। শিল্পবস্তুর গুণপনা মাপবার বাটখারা হিসেবে সংখ্যাগুরুর মতকে বিবেচনা করবার রেওয়াজ কোথাও নেই বলেই জানি। এটা মাপকাঠি হতে পারে মাত্র জনপ্রিয়তা মাপবার।  

এইসব ভেবে তাকিয়ে আছি সাদা স্ক্রিনের দিকে। এরকম পরিসরে, কী আমার লিখবার আছে কবিতাগুলো নিয়ে, যা পাঠযোগ্য! আমি কি মিশে যেতে পেরেছি এখানকার সব উচ্চারণের সাথে? আমি কি চিনেছি আলোচ্য কবিতাসমূহে অঙ্কিত সব পথঘাট? চিনি নি। আরো বারকয় হেঁটে এলেও ওপথ ধরে, হয়ত ঠিক পুরোটা চেনা হবে না, বলাই বাহুল্য। এজন্যেও উদাস এই  দৃষ্টিক্ষেপ, সম্ভবত। আবার এ-ও তো ঠিক যে, প্রথম যাত্রায়ই এখানকার কোনো কোনো পঙক্তির পাখসাটে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। ভেতর থেকে জেগে উঠেছে এক অসংজ্ঞায়িত ভালোলাগাবোধ। অচেনা সুন্দরীর প্রতি কি মুগ্ধতা জাগতে নেই? খুবই আছে। কিন্তু মুশকিল হলো, মুগ্ধতা মুগ্ধতাই, মুগ্ধতার প্রকাশ কখনো সমালোচনা নামধেয় নয়। এ খুবই যুক্তিনিরপেক্ষ। সমালোচনাকে হতে হয় যুক্তিপূর্ণ (এবং কমবেশি সর্বজনীন!)। তাছাড়া আমি মুগ্ধতা প্রকাশে নয়, সমালোচনার জন্যেই অনুরোধ্য। ‘ভালো লাগল’, ‘অসাধারণ’, ‘চমৎকার’-- এগুলো মুগ্ধতার ভাষা, সমালোচনার নয়। সমালোচনার প্রশ্নে ভালোলাগা-মন্দলাগাকে সংজ্ঞায়িত করতে হয়, যথাযথভাবে। অন্তত মুগ্ধতা কিংবা বিরক্তি কর্তৃক উৎপাদিত অনুভূতির দিকে তাক করা একটা ‘কেন?’ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে হয়। সন্দেহ নেই, কাজটা বিশেষভাবে কঠিন। পাশাপাশি এক্ষেত্রে নিজের অযোগ্যতাটাও একটা বড়ো বাধা। এটা লুকোবার কোনো সুযোগ নেই, কেননা এ স্বয়ম্প্রকাশিত। কাজেই নির্মোহ ভঙ্গিতে কবিতার সত্য খুঁজে, নিজের জানাবোঝা যদি কিছু থাকে তার সাপেক্ষে কবিতাগুলোর রঙরেখাবলি ও ইঙ্গিতের বোধসঞ্চারণ শক্তির মাত্রা নির্ণয় করে বোধগম্য ছবি আঁকবার প্রয়াস করাই মূল কাজ, এখানে। এ লক্ষ্যে কবিতাগুলোর ভিতর দিয়ে সংজ্ঞা-সন্ধানার্থে সংঘটিতব্য আমার পরবর্তী প্রব্রজ্যাগুলোর গুণ-মানই ঠিক করে দেবে আমার দেখন-লেখন-অঙ্কনের ভালোমন্দ। পাঠক ও লেখকদের মধ্যকার যাঁরা আখেরে আমার এই ইন্টারপ্রিটেশনকে নিতেই পারবেন না, তাঁদের কাছে দশাসই একটা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে কবিতাগুলোর চোখে চোখ রেখে বরং শুরুই করা যাক আমার ভাবনাচিন্তাকথার সংক্ষেপন--

১.
সন্ধ্যা ও রাতের মাঝখানে কী আর এমন ফারাক, সময়ের? বিকেল ও সন্ধ্যার মাঝখানটাকে আমরা গোধূলি বলে চিনি, কিন্তু সন্ধ্যা ও রাতের মাঝখানটা এতই অবিশেষ যে, একে আলাদাভাবে নামায়িত পর্যন্ত করা হয় নি বাংলা ভাষায়। তবে আরবি ভাষায় ‘এশা’ নামক একটা ক্ষণ আছে, যা দিয়ে রাত্রির প্রথমভাগকে বোঝায়। অর্থাৎ এশা হলো সন্ধ্যা ও রাতের মাঝখানকার সেই অসংজ্ঞায়িত ক্ষণ, যাকে এ লেখায় বিশেষায়িত করে তোলা হয়েছে। স্বল্পকাল ব্যাপ্ত এক একাকী বেদনার অনুভূতি গভীর মগ্নতার আশ্রয়ে ডালপালা মেলে শোক-শোক একটা বিস্তার আদায় করে নিয়েছে এখানে। এ লেখার মুখ শোকভারাতুর হয়েও অতিশয় দীপ্র, উজ্জ্বল। প্রায়ই চোখ কেড়ে নেয় ক্যামেরার উপযোগী অতি পরিচিত বস্তুগত উপাদান। তৎসত্ত্বেও, এখানে শাসন যদি কোনো কিছুর থেকে থাকে তো তা মনের, চোখের নয়। চোখ এখানে জন্ম দিয়ে গেছে কেবলই ভ্রম, যা কিনা প্রার্থিতই, কবিতায়। আর এ ভ্রমকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে শব্দ ও বাক্যে রচিত পরিবেশ, তার আনুকূল্য। 

২.
কবিতার বিষয় হিসেবে মৃত্যু, মৃত্যুসম্ভাবনা, মৃত্যুচিন্তা, মৃত্যুশোক প্রভৃতি যুগপৎ ক্লিশে ও চিরপ্রাসঙ্গিক। এই দোলাচলের মধ্যেও যুগে যুগে দেশে দেশে এই রঙে রেঙেছে সহস্র কবিতা, রাঙবে আরোও। প্রচুর সম্ভাবনা যুক্ত হয়েও প্রতিবারই এ বিষয়ক কবিতাকে হাঁটতে হয়েছে ও হয় ঝুঁকিসীমায় পা ফেলে-ফেলে। প্রতিদিন প্রাসঙ্গিক বলে প্রতিবারই তাকে গৎ-এর বাইরে নতুনভাবে মূর্ত হতে হয়, বলনকেতা ও শৈলীসৌকর্যে। হলুদ প্রেতছায়াকে এসব বিবেচনায় ঝুঁকি-সন্নিহিত কেবল হা-হুতাশই মনে হতে পারত, যদি না মৃত্যুসন্ধিক্ষণে চিরপথিকের প্রতি জীবিতদের নিষ্ঠুর আচরণের চিরন্তনতাটা এখানে অঙ্কিত হতো। এই বিশেষ কারণে রচনাটি কিছু স্পর্শকাতরতা ধরলেও সামগ্রিক কথাবস্ত্রের মলিনতা একে উজ্জ্বল রচনা হয়ে ওঠবার অবকাশ দেয় নি।

৩.
আপাতসরল, কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে এক বন্ধুর পথে যাত্রা করতে হয় দ্বন্দ্ব-এর পাঠককে। বাঘ ও হরিণের চিরবৈরী একটা সম্পর্কের ফাঁদ পাতা এ ভুবনে ক্ষণে ক্ষণেই বড়ো বড়ো খাদের সামনে গিয়ে দুশ্চিন্তিত হয়ে দাঁড়াতে হয়, যে খাদগুলো হয়ত প্রাকৃতিক (স্বতঃস্ফূর্ত) নয়, বানানো। একটা বিভ্রমে ঠেলে দেবার আনন্দ থেকে উৎসারিত কূটস্পৃহাজাত। প্রথমে মনে হয় লম্ফযোগ্য নৈকট্য আছে, কিন্তু পরক্ষণে বোঝা যায় যে, তা নয়। অথচ লক্ষণীয় যে, একটি খাদ থেকে অন্য খাদের দূরত্ব ঘিরে রচিত যে পথ (বাক্য), তার প্রায় প্রতিটিই সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সুমিত স্বভাব। যেজন্য এই প্রায়অবোধ্য ভ্রমণাভিজ্ঞতা নিয়েও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে এর দিকে কাতর অভিব্যক্তিসহ তাকিয়ে থাকাতেও যেন একটা সুখ-সুখ অনুভূতি হয়।

৪.
একদা প্রাণচঞ্চল অধুনা উজাড় হয়ে যাওয়া একটা বসতবাড়ির এক/দুই পুরুষ দীর্ঘ একটি গল্পের আনুপূর্বিক বয়ান ধৃত হয়েছে শূন্য ভিটেয়। খাঁ-খাঁ সেই শূন্যতাকে যে ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে, তা ক্লিশে ও গাদ্যিক। শব্দের অমিতব্যয়-প্রবণতাকে এখানে মাঝেমধ্যেই দাঁত বের করে হাসতে দেখা যায়! এ লেখা না-বলা দিয়ে প্রায় কিছুই বোঝাতে চায় না, যে কারণে শব্দের অধিক কোনো শব্দহীনতা কিংবা নৈঃশব্দ্য এর ভিতরবাড়ি তো দূর অস্ত বাহির বাড়িতেও স্থান পায় নি। কষ্ট বলে কষ্ট বোঝানো যে কবিতা নির্মাণের জন্য কোনো উৎকৃষ্ট পন্থা নয়, এ জানাবোঝার একটা বেআমল এ লেখায় উৎকটভাবে বাঙ্ময়।

৫.
বিপ্লববাসনারঞ্জিত বাংলাদেশ গর্ভবতী হচ্ছে-তে মানুষের চেয়ে মানুষের চুরচুর স্বপ্ন ও সম্ভাবনাই বড়ো হয়ে ওঠে। কবি স্বয়ং একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী হয়ে সশরীরে উপস্থিত এখানে, যিনি মানুষকে কমিউনিকেট করেন বিপ্লব উসকে দেবার মন্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে; যে বিপ্লব, ধারণা করা হয়েছে, দুদিন আগে-পরে নিশ্চিত করবে কথিত সমাজ বদল! বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিদৃষ্টে বাস্তবত এটাকে যত দূরভাষই মনে হোক, অতিশয় নিচুস্বরে লেখাটির শরীর জুড়ে একটা আস্থা রোপণ করে রাখা আছে দেখা যায়। এই সরল আস্থাটি আলোচ্য কবিতার একটা শক্তি হিসেবেই উপস্থিত, যেন। 

৬.
শব্দ অথবা বাক্য নামক রচনাটি কবিতাযজ্ঞ ও তার যজ্ঞাস্ত্র বা উপচার নিয়ে। যজ্ঞাস্ত্র হলেই যে যজ্ঞ হয় না, বরং তার জন্য যে লাগে বিস্তৃত প্রয়োগধারণা ও শাসন, এসব নিয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী এ রচনার সংসার। কবিতায় মিথ্যার (কল্পনার) চিরপ্রবেশাধিকার স্বীকৃত, কিন্তু ওরও মাত্রাগত ব্যাপারস্যাপার নিয়ে কবিকে ভাবিত হতে হয়। ওই ভাবনার একটা রূপরেখাও এ লেখায় ধৃত হয়ে আছে, সতর্কভাবে। একটা চিরক্লিশে দিয়ে শুরু হয়ে ক্রমশ কবিতাটি কবির কাছ থেকে নিজস্ব রূপরং আদায় করে নিয়ে আনন্দপ্রসাদ বিতরণে মেতেছে, দেখা যায়। 

৭.
আত্মসত্তার একটা বিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে শুরু হওয়া সিজোফ্রেনিয়া জানান দেয় যে, তা নতুন সম্ভাবনার দিকেই ধাবিত। ওই ধাবনপর্যায়ে সঠিক পথ নির্বাচনের যোগ্যতা ও চেতনাও রহিত হয় না পথিকের। উল্লিখনের মাধ্যমে যে দার্শনিক সত্যকে হাজির করা হয় এখানে, তা ওই সচেতনতারই পরিচায়ক। এতদসত্ত্বেও, একটা গ্রহণান্ধকার আর দহনছাইয়ের মুখোমুখি হতে হয় তাকে; আর শেষ পরিণতিতে সমীপবর্তী হতে হয় সুফিসুলভ আধ্যাত্মিকতার। এভাবে, একটা অ্যাম্বিগিউয়িটি বা কূটব্যঞ্জনা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এতে, যা রহস্য সৃজন করে লেখাটিকে কবিতার দিকে নিয়ে গেছে আর পাঠকের জন্য রেখে গেছে ছেঁড়া ছেঁড়া ধাঁধার জোগান।

৮.
একটা সমর্পিত ঢঙে ছন্দ ও আঙ্গিক সচেতনতার সুফল নিয়ে বিকশিত হয়েছে তুমি যদি। দেশ, জাতীয় চেতনা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, প্রেম-কাম একাকার হয়ে গেছে ছোট্ট এ লেখাটিতে। এ লেখার ‘তুমি’ কাজেই কোনো গৎ-এর পাল্লায় পড়ে নি, বরং তা ধারণ করেছে বিবিধ ব্যঞ্জনা, যদিও নামটি প্রথমে সে আশঙ্কাই জাগায়। চিত্রময়তা নয়, বরং চিত্রকল্পে ঋদ্ধ এ কবিতাটির সৃজনসৌন্দর্য ও সুমিতি মনোযোগ কাড়ে।

৯.
ভাবছন্দে জীবনাভিজ্ঞতার একটা সরল বয়ানে একজন ক্রীতদাস ও একটি গাধার কাহিনীতে জীবনের তাৎপর্য সন্ধানের প্রয়াস লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। অর্থ, কীর্তি, যশ, সচ্ছলতার অধিক রক্তের ভিতরে যে আরো এক বিপন্ন বিস্ময় খেলা করার কথা বলেছিলেন একদা জীবনানন্দ দাশ, এখানেও যেন সেই আর্তিটি একভাবে ধ্বনিত-রণিত। এ লেখার নায়ক (!) সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে সফল হবার পরও মানসিকভাবে ব্যর্থ হিসেবে চিত্রিত, যা নিয়ে মূর্ত হয়েছে হাহাকার। অতিশয়োক্তির অধিক অলংকারহীন, প্রায়-নিরাভরণ ঢঙে অনেকটা লোকজ্ঞানের স্ফূর্তি নিয়ে অভিজ্ঞতারা উপস্থিত হয়েছে এখানে। জীবনের অনেকটা পথ পেরোবার পর স্বমূল্যায়ন ছলে পেছন ফিরে দেখার এক শিল্পীত দুঃসাহস এটি; যার ভিতর দিয়ে জীবনদর্শনটা স্পষ্ট রূপ পেয়েছে। কবিতাটি একটি অবশ্যম্ভাবী বিষণ্নতার জন্ম দেয়, যা ধারণ করে আছে তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষাও।

১০.
সম্পাদক-এ ব্যঙ্গচ্ছলে শিল্পসাহিত্য জগতে বিদ্যমান গোষ্ঠীবাদী কূট/অপ রাজনীতির আনুপূর্ব তুলে আনা হয়েছে। ক্ষমতার আসন কব্জা করে চাটুকার পরিবৃত হয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে ব্যাঙকে সাপ ও বেড়ালকে বাঘ করে দেখানো, অতি উচ্চম্মন্যতা, অ্যাজেন্সি বিক্রি, সম্মান ও খেতাব আদায় এবং মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা দেবার যে সংস্কৃতি সাহিত্যের আড়তদারদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই, তার একটা ভাষিক ডকুমেন্টেশন এই রচনা। পুরো লেখাটি ১৪ মাত্রার পয়ারে রচিত, তবে দ্বাত্রিংশতিতম লাইনের ‘কী যে’র ২ মাত্রা নিতান্তই অনর্থক ব্যতিক্রম। পুথির সুরে পড়া যায় লেখাটি। যমক অলংকারের একটা অসামান্য ব্যবহার লক্ষণীয় এখানে (এইমতো ভাবে আর ভাবে থাকে খুব)। একাধটা (হ্রী ও সিঁড়ি) বাদ দিয়ে কবিতাটির অন্তঃমিলগুলোর প্রায় সবই উৎরে গেছে।

১১.
একটি ক্ষুরধার সন্দেহকে মিথ্যা করে দিয়ে জন্মপ্রাপ্ত একটি দেশের (এখানে বাংলাদেশ) ইতিহাসের নানা আলো-আঁধারি, উত্থান-পতনের সঙ্গে মিলেমিশে একজন মানুষের জন্ম থেকে শৈশব-কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য যাপনের ক্রমবর্ণনার মাধ্যমে পরিণতি পেয়েছে অঙ্গার। যার মাধ্যমে মানুষটি হয়ে উঠেছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার দ্রষ্টা, ইতিহাসের সাক্ষী। এই একজন মানুষের বিলয় মানে যেন ইতিহাসেরই এক ধরনের প্রয়াণ। এই বোধটিরই দারুণ কাব্যিক উপস্থাপন দিয়ে শেষ হয়েছে কবিতাটি-- ‘আমার মৃত্যু পৃথিবীর শেষতম/সত্যের অঙ্গার...’। এই সরল ও বাহ্য অর্থের পাশাপাশি লেখাটির এই নিহিতার্থ সরবরাহ করবার ক্ষমতাও মনে আসে যে, এখানে উপস্থিত ‘আমি’টি আসলে একজন কোনো মানুষ নয়, বরং দেশই স্বয়ং। এই ব্যঞ্জনা লেখাটির কবিতাত্ব প্রগাঢ় করেছে বলে মনে হয়।

১২.
যমজের দ্বন্দ্ব-সখ্য নামক দ্বিধাময় এই রচনায় জীবন ও মরণ এবং এ দুয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে কবির ভাবনা বিকশিত হয়েছে। রচনাটিতে এ উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে যে, মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ, ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ; কারণ তারা আজঅবধি মৃত্যুর গভীর রহস্যটা উন্মোচন করতে পারে নি। এমনকি প্রকৃতিজগতের আর সব বিস্ময়ও এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। লেখাটির ‘খ’ অংশে এরূপ দার্শনিকতা মূর্ত হয়েছে যে, এই দুই সত্য পরস্পরের মধ্যে একটা সংঘাতপূর্ণ অবস্থানেই টিকে রইল, সমঝোতার দিকে না-এগিয়ে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, জীবন ও মরণের ‘একসঙ্গে তিষ্ঠনোর ইতিহাস’টিই একটি উৎকৃষ্ট সমঝোতা। কিন্তু এ প্রশ্নে একের প্রভাবের কাছে অন্যের পরাভূত হয়ে যাবার মতো ভারসাম্যহীন একটা অবস্থার প্রতিই যেন এ লেখার সমর্থন। সমঝোতা মানে কি এই-ই হওয়া উচিত, কখনো, অন্তত জীবন-মরণ প্রশ্নে? লেখাটি পড়ে প্রসঙ্গত এসব ভাবনা জাগে মনে। লেখাটির বাক্যবিন্যাসে পরীক্ষানিরীক্ষার ছাপ স্পষ্ট, যদিও এর প্রাসঙ্গিকতা মোটমাট অপ্রতীয়মানই থাকে।

১৩.
খুব নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, তোবড়ানো কাগজটির মধ্যে কী এমন বস্তু ছিল, যাকে ডেন্টিস্টের চেম্বারে নামক রচনার মূলরহস্য হিসেবে দানাবাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। সে কি একটি বিকল আধভাঙা দাঁত? একটি ভুল প্রেসক্রিপশন? কিন্তু যা কিছুই হোক, তার সঙ্গে মেয়েটির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। কারণ মেয়েটি এখানে নার্ভাস, যে নোখে দাঁত খুটছে (দাঁতের ডাক্তারের সামনে দাঁতের এহেন অপব্যবহারটা কৌতূহলোদ্দীপক; যদিও এটা স্পষ্ট যে, ছবিটা ব্যবহৃত হয়েছে উদ্বেগ বোঝাতে)। কিন্তু এ দুটো সম্ভাবনার কোনোটির ক্ষেত্রেই মেয়েটির নার্ভাস হবার কথা নয়। কিংবা কালো কাকেরও এজন্য বিপন্ন হবার কোনো কারণ নেই, যদি কালো কাককে ডেন্টিস্টের প্রতীক ভেবে নেই। এসব আলামত শেষপর্যন্ত ‘আমি’ প্রতীকে উপস্থিত সামাজিক মানুষটির দৃষ্টিতে ওখানে একটি অপকর্ম (!) সংঘটনেরই ইঙ্গিত পাওয়া যায়; যে রহস্য তোবড়ানো কাগজটিতে একটি ব্যবহৃত ‘...’-এর অস্তিত্ব কল্পনা করতে প্ররোচিত করে। কিন্তু কবিতার রহস্যোদ্ঘাটনের প্রশ্নে একজন যাকে স্পষ্ট সমাধান ভাবেন, অন্যজনের তা ভাবা মোটেই বাধ্যতামূলক কিছু নয়। এই যে নিরাময়হীন একটি জটিল সমস্যা তৈরি হয়েছে কবিতাটিতে, সেটি এর অন্যতম শক্তি। অবশ্য এ শক্তি কতটা মানবসহায়, কল্যাণবোধ-উসকানিয়া, শিল্পবোধ-জাগরুক; সে বিবেচনা বাকিই থেকে যায়।

১৪.
বৃষ্টি বন্দনা অথবা তার চোখে জল রচনাটিকে একটি প্রেমের কবিতা লিখবার প্রয়াস হিসেবে পাঠ করা যায়। একটা বিশেষ বৃষ্টির বর্ণনা আছে লেখাটিতে, যা নির্দিষ্ট প্রেমিকার হাত ভিজিয়ে দিয়েছে। লেখাসূত্রে প্রকাশ পায় যে, সে বৃষ্টি এমনকি শহরে বান পর্যন্ত ডেকে এনেছে। এটিকে শেষপর্যন্ত একটি অতিবয়ান হিসেবেই পাঠ করতে হয়, যেহেতু শেষ বিকেলের সবুজ ঘাস আনন্দেরই কারণ হয়েছে। এখানে হাত ভিজানোর কাজটি কি অশ্র“র নাকি প্রকৃতই বৃষ্টির, আর বৃষ্টির হলে ওই বৃষ্টি প্রেমিকার চোখের জল মুছে দিয়েছিল কি না-- এই অবিশেষ প্রশ্নরহস্য সৃজন পর্যন্ত এ লেখার দৌড়, যা বিশেষ কোনো সম্পন্ন বোধের সামনে নিয়ে পাঠককে দাঁড় করায় না। খুব ছোট আয়তনের এ লেখায় ছয়-ছয়টি বাক্যের শেষে ‘ছিল’ ক্রিয়ার বিশেষত্বহীন সাধারণ প্রয়োগ লেখাটির একটি উল্লেখযোগ্যরকম দুর্বল দিক।  

১৫.
বাংলাদেশে এটিএম বুথ ব্যাপারটা একটা সাম্প্রতিক প্রপঞ্চ। তবে ইতোমধ্যে এটিএম কার্ডকে স্ট্যাটাস সিম্বল বা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে চিনে নিয়েছে সবাই, অন্তত শিক্ষিত শহুরেজন। লেখাটিতে এটিএম বুথকে বহুগামী বারবণিতার মতো করে আঁকা হয়েছে, যাতে বস্তুতে সঞ্চারিত হয়েছে উচ্ছল এক প্রাণ। যার সক্ষমতা আছে (এখানে সক্ষমতা মানে কার্ড থাকা, আর কার্ড থাকা মানে অর্থের নিশ্চয়তা থাকা), এটিএম বুথ বাছবিচারহীনভাবে তার সাথেই শোয়! কাজেই ‘কারো কোনো স্পর্শে তার নেই অসম্মতি’ খুবই যথার্থ চিত্রায়ণ। কিন্তু একই লেখায় একই বস্তুকে লেখক উলটো চরিত্রটিও দিয়েছেন : ‘স্পর্শে হয়ত দেন অনেক তবে মুখ চিনে-চিনে’। স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধিতা এটি। কবি কি এখানে ‘মুখ থাকে না ছিনে...’র মতো অন্তঃমিলের প্ররোচনার শিকার হয়েছেন? হবেনও বা।

১৬.
পাঠ-এর অনুজ্ঞাজ্ঞাপক বাক্যশাসন যে পাঠপ্রবর্তনের কথা বলে, তা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহের বিবেচনায় ধর্মদ্রোহ, যা মারেফাত বা ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বের দিকে প্রসারিত। সুনির্দিষ্টভাবে ‘আয়নাল হক’ বা ‘আমিই সত্য’ ধারণাটি মরমি সুফি মতাদর্শ এবং ভারতবর্ষীয় সহজিয়া ও বাউল মতবাদ দ্বারা চর্চিত। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ মতাদর্শের বিশেষ কদর আছে। লেখাটি স্বচেষ্টায়, প্রকৃতিপাঠের মাধ্যমে ওই নির্দিষ্ট ভাবনা-বিশ্বাসের দিকে যাত্রায় প্রণোদিত করতে চায়। এটি বলতে চায় যে, প্রকৃতিকে উপর্যুপরি পাঠের ভিতর দিয়ে মানুষের পক্ষে এমন ধারণায় উন্নীত হওয়া সম্ভব, যেদিকে গেলে ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ’না করার দরকারই হয় না। বর্তমান সময়ে মনসুর হাল্লাজের মতো শরিয়তবিরোধী বিপ্লবী সুফির উপস্থিতির প্রাসঙ্গিকতা দেখানো হয়েছে লেখাটিতে, যখন শরিয়তী ভুলব্যাখ্যা ইসলামকে আত্মসত্তা বিকাশের পন্থা হিসেবে দেখবার পরিবর্তে আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে পরিণত করে তুলবার দিকে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। লেখাটির বিষয়গত অভিপ্রায় স্পষ্ট; পাশাপাশি কবিতার দাবি যে এখানে খানিকটা উপেক্ষণীয় থেকেছে তা-ও কমবেশি স্পষ্ট।

১৭.
বলার ধরনে মনে হয় যে, তখনও মানুষ ছিল পৃথিবীতে কোনও জাতিসংঘ ছিল না নামক রচনায় একটা গল্প থেকে গেলেও যেতে পারে; কিন্তু না, থকথকে কোনো গল্প এখানে নেই, আছে কিছু ছিন্নসূত্র মাত্র, মহা থেকে সমকালের। বিষয়গতভাবে লেখাটির বৃহৎ বিস্তার, ভূগোলে ও চিন্তায়। ভিড় করে আছে চূর্ণ চূর্ণ অজস্র চোখ, পুরাণ থেকে সাম্প্রত বেদনা পর্যন্ত। সব মিলিয়ে লেখাটি বিশ্বায়ন, পণ্যায়ন, সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে চায়। ব্যাজস্তুতি বা সূক্ষ্মব্যঙ্গচ্ছলে কবি বলেন যদিও যে, ‘মানবতা নস্যিমাত্র, নাকে গুঁজে নিদ্রা যেতে পার’। আসলে তিনি উলটোটাই বোঝাতে চান, তা নইলে এই লেখনপ্রয়াস দরকারিই হতো না। অক্ষরবৃত্ত চালে এগিয়েছে কবিতাটি, আরো সুনির্দিষ্টভাবে এটির যতি নির্দিষ্ট চৌদ্দ ও আঠার মাত্রার পয়ারে, কিন্তু পঙক্তিবিন্যাসের ঝোঁক মহা-মহাপয়ারের দিকে। এখানে ‘টোডাকন্যা’দের পোশাক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত ‘বসন-প্রহরা’ শব্দবন্ধটা অব্যর্থ, কিন্তু তথ্য হিসেবে দেখলে একটু বিভ্রান্ত হতে হয়। দক্ষিণ ভারতের নীলগিরির বাসিন্দা টোডা নারীরা বরাবরই তাদের শরীর ঢেকে রাখে, এক কাপড়ে যদিও। অবশ্য স্বীকার্য যে, কবিতা বস্তুটা মোটেই তথ্যের জন্যে নয়।

১৮.
উত্তীর্ণ কবিতাগুলো প্রায়ই জন্মায় বিষণ্নতার বাড়ি-- প্রচলিত এই ধারণার দিকে আবারও সমীহের সাথে ফিরে তাকাতে হয় মা কবিতাটি পড়ে। যেরকম ঘোরে গ্রস্ত হলে একটি লেখাকে মগ্নতার শিলালিপি নামে ডাকা যায়, যে বিস্তৃত রহস্য সৃজিত হলে তাকে আবিষ্কারে সে লেখার দিকে বারেবারে ফিরে আসতে হয়, এ লেখা যেন সেরকমই এক শাসন কায়েম করে রেখেছে তার শরীরে। অথচ বিষয়ে এ মৃত্যুবার্তাবাহী, হারানোর মর্মধারী। বিষাদলাগোয়া কবিতাপাগল এক স্বজনের নিতান্ত কবিতাগ্রস্ততার প্রমাণ লভ্য এখানে, যে গ্রস্ততার বলে এখানে পানীয় জল, অশ্রু এমনকি প্রয়াত মা স্বয়ং কবিতারই অন্য নাম হয়ে উঠেছে। লেখাটিতে ব্যবহৃত ‘আলোর ছোবল’, ‘মেঘলিপ্ত সম্ভাবনা’, ‘জলমর্ম’, ‘গার্হস্থ্য-বন’ শব্দবন্ধগুলোর প্রতিটিই যথাযথ ও প্রয়োগসফল। বায়েজিদ বোস্তামির মিথটিও এখানে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। আগাগোড়াই কবিতাটির গতি স্বচ্ছন্দ্য, কেবল ‘এছাড়া স্বীকার করছি... এখানে খারিজ হয়ে যায় নি’ অংশ বাদে। স্রেফ শব্দবিন্যাসগত কারণে এ অংশের গতি শ্লথ, গদ্যের দিকে ঈষৎ হেলানো।

১৯.
চোখ মেলো নামক লেখাটি সামাজিক-লৈঙ্গিক রাজনীতি বিষয়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষ ও নারীর মধ্যকার বাঘ-হরিণমার্কা বিষম সম্পর্কটিই এতে চিত্রিত হয়ে উঠেছে। ভোগলিপ্সায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত পুরুষসমাজ যাপন-পরিসরের সর্বত্র থাবা বিস্তার করে আছে। ভোগপ্রশ্নে তারা সদাই প্রস্তুত। এ এমনই এক প্রস্তুতি যেখানে শিকার ধরায় কোনো বাছবিচার নেই। প্রচলিত সমাজের এ এক ব্যাধি, সকলেই জানে। এখানে দাঁড়িয়ে লেখক নারীসমাজকে ‘ভীতু নারী’ বলে সম্বোধন করে আগের বিবৃতিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। ভয় পাইয়ে দেবার সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখে, যাকে ঘিরে এ ভয়ংকর আয়োজন তাকে ‘ভীত’ ভাবা সত্যের অপলাপ মাত্র। লেখাটি শেষ হয় বক্তৃতামঞ্চের উপদেশের মতো-- ‘সুতরাং আর দেরি নয় জেগে উঠো নারী’ বলে, যার সঙ্গে যুক্ত আছে ‘ঘুমন্ত অগ্নিগিরির মতো’ ক্লিশে উপমা। অবশ্য ‘৭১-এর বাঙালি জাতি’র জেগে ওঠাকে এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও যথাযথ বলে মনে হয়। লেখাটিতে পুরাণের ব্যবহার সুন্দর হয়েছে। 

২০.
নৈমিত্তিক ঘটনাবলি নিয়ে মানুষের মধ্যে সাধারণত বিশেষ কোনো সন্দেহ, সংশয়, প্রশ্ন ইত্যাদি থাকে না। কিন্তু যা দৈবাৎ, মাঝেমধ্যে, কখনোসখনো সংঘটিত হয়, তা নিয়ে মানুষের কৌতূহল সহজাত। মানুষ সর্বদা যদি এই প্রশ্নটিকেই সামনে এনেছে যে, যা অনিয়মিতভাবে ঘটে, তাই-ই যদি নিয়মিত ঘটত তবে কি মানুষ তাকে সন্দেহ করত? আসলে প্রশ্নে থেমে থাকে নি লেখাটি-- জিজ্ঞাসাহীন জোড়াপ্রশ্নে একটা চোরা জবাবের অস্তিত্বও পাঞ্চ করা আছে যে, ‘করত না’। সেক্ষেত্রে এখন যা পাপ বলে চিহ্নি‎ত, তাকে কেউ পাপ বলে মনে করত না, কিংবা পুণ্যকে পুণ্য। এই সত্যটি প্রতিষ্ঠার অধিক এ লেখায় আর কোনো ব্যঞ্জনা সহজলভ্য নয় মনে হলো। মুক্তক অক্ষরবৃত্তে রচিত এ লেখার আভাসাত্মক অলংকারের প্রয়োগ দৃষ্টি কাড়ে।

২১.
উত্তম পুরুষে বর্ণিত বঙ্গোপসাগরের প্রতি রচনার কথক আত্মসমালোচনামুখর ও সমর্পিত, তবে এ সমর্পণ সম্ভবত ঈশ্বরের প্রতি নয়। একটা সরল, নির্বিরোধ, স্বাধীন জীবনের প্রত্যাশা মার খাওয়ায় মায়ের প্রতীক সমুদ্রকে সাক্ষী মেনে মৃত স্বপ্নবৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়েছে এতে। একটা শান্ত, নম্র ও বিষাদাত্মক স্বর দখল করে আছে গোটা লেখাটিকে। উল্লিখন (লোকগান থেকে-- হরি নামে সুর বেঁধে দাও হে একতারায়; পুরাণ থেকে-- সুলেমানী তরবারি, শাঁখা ও সধবার মিথ), ব্যক্তিত্বারোপণ (রোদ এসে জিরোবে তার পত্রপল্লবে), চিত্রকল্প (প্রাণ কেন পড়ে যাচ্ছে মুঠো উছলে), রূপক (তবু কেন স্লেজ টানা কুকুর হয়ে উঠছি) অলংকারের সফল ব্যবহার দেখা যায় কবিতাটিতে।


লজ্জার মাথা খেয়ে বলি, আমার এই আলোকপাত, এখানে, একদমই ভাসা ভাসা। বোকামির নমুনায় ভরা হাস্যকর প্রচেষ্টাও হয়ত বলা যাবে একে। সেক্ষেত্রে একে ওরকমভাবেই গ্রহণ করে সক্ষমতা-উজ্জ্বল আরো এক বা একাধিক ভাষ্য এর পাশে তৈরি হোক। সব মিলিয়ে তখন কবিতাগুলো সম্পর্কে একটা পরিণত পাঠ প্রস্তুত হবার অবকাশই তৈরি হবে। তাই হোক, বরং তাই হোক।

শওকত হোসেন সম্পাদিত গোলাঘর-এ প্রকাশিত

Saturday, July 31, 2010

মিথ্যার রাজ্যে ভ্রমণোত্তরে বিশেষ এক জ্ঞাপন

"Advertising is legalized lying": H.G. Wells
এ লেখা বিজ্ঞাপন বিষয়ে আমার জ্ঞানপনা জাহিরের চেষ্টাজাত নয়। বাংলাদেশে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও বিজ্ঞাপন কতদূর এগিয়ে গেছে, মুগ্ধতাজনিত কারণে সে বিষয়ক বিস্ময়-সমুদ্রে ভেসে তার কোনো রূপরেখা আঁকবার চেষ্টাও এখানে ধরা নেই। একজন সাধারণ সমাজসদস্য হিসেবে বিজ্ঞাপনকে আমি যেভাবে দেখি, বিজ্ঞাপন যেভাবে আমাকে ও আমার পরিপার্শ্বকে নির্মাণ করে উঠতে চায় লেখাটি তারই একটি স্থিরছবি ধারণ করবার প্রয়াস পেয়েছে মাত্র। এতে রচয়িতার মনে বিজ্ঞাপনের যে ছবি ডুবে-ভাসে তার একাংশের ভাষিক উপস্থাপনচেষ্টার অধিক আর কিছু লভ্য নয়। এর অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা যাঁর, তাঁর এ রচনাপাঠ এখানেই রহিত হওয়া উচিত।

আমরা সবাই জানি, বিজ্ঞাপন হলো কোনো পণ্য বা সেবা সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাপন, বিদিতকরণ, জানানো ইত্যাদি, যার মাধ্যমে সাধিত হয় প্রচার। অর্থাৎ বিজ্ঞাপন এক ধরনের প্রচার, যদিও মনে রাখতে হয় যে, প্রচারমাত্রই বিজ্ঞাপন নয়। যে প্রচারের সঙ্গে সরাসরি অর্থযোগ নেই, মুনাফা অর্জন যার অন্বিষ্ট নয়, তা নিছক প্রচার, বিজ্ঞাপন নয়। আজকাল অবশ্য মিডিয়ার বরাতে বিজ্ঞাপন ও প্রচারের প্রভেদও ঘুচতে লেগেছে দেখা যায়। যারা মিডিয়াকে প্রচুর বিজ্ঞাপন দেয়, তারা এর মাধ্যমে তো প্রচারিত হয়ই, আবার তাদের এটা-সেটা নিয়ে মিডিয়া খাতিরবশত নানা সংবাদও প্রচার করে, যাতে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড-এর উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আরো প্রচার পায়। যদিও যে ইভেন্টকে ঘিরে সংবাদ গড়ে ওঠে, তা প্রায়শ সংবাদ হবারই যোগ্যতা রাখে না। অনেকটা প্রায় শালা-দুলাভাইসুলভ সম্পর্কসূত্রে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার কাঁধে ভর করে দেদারসে পক্ষপাতমূলক প্রচারও চালাতে পারে, চালাচ্ছেও। আর আমরা আমপাবলিক এহেন দ্বিপাক্ষিক দহরমমহরমে হরদম বিভ্রান্ত হচ্ছি।

বিজ্ঞাপন হঠাৎ আবির্ভূত আজ বা কালের কোনো প্রপঞ্চ নয়, এর ইতিহাস সুপ্রাচীন। ধারণা করা হয়, যখন থেকে পণ্য বিনিময়ের সূত্রপাত, বিজ্ঞাপনের সূত্রপাত তার সমসাময়িককালেই। মাধ্যম হিসেবে তখন হয়ত ব্যবহৃত হতো মৌখিক ঘোষণা, যে রূপটার প্রায় অবিকলই আমরা অধুনার ফেরিওয়ালাদের মধ্যে দেখি। মৌখিক ঘোষণা থেকে ক্রমশ লিখিত, চিত্রিত ও চলচ্চিত্রিত হয়ে বিজ্ঞাপন আজকের অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ব্রিটানিকা কনসাইজ এনসাইক্লোপিডিয়া মতে, সপ্তদশ শতকে লন্ডনের একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে প্রথম বিজ্ঞাপন ছাপা হয়, অষ্টাদশ শতকে যার বিস্তার ব্যাপকতর হয়। বিজ্ঞাপন ভয়ানক মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে বেশিদিনের কথা নয়। শুরুর দিককার বিজ্ঞাপন নামক নীরিহ প্রপঞ্চটি কোন কোম্পানির কোন পণ্যটি কিনলে লাভজনক হতে পারে সেটা তুলনা করে ওঠবার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করত মাত্র। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক বিজ্ঞাপন সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯২২-এ শুরু হয় বেতার কার্যক্রম, আর তার হাত ধরাধরি করে শুরু হয় বেতার-বিজ্ঞাপনও। ১৯৫০-এ শুরু হয় টেলিভিশন কার্যক্রম, যা মাত্র ১ দশকের মধ্যে সিংহভাগ সচ্ছল মানুষের ঘরে ঘরে জায়গা করে নেয়। এর ভিতর দিয়ে বিজ্ঞাপনও ঢুকে যায় মানুষের শোবার ঘরে। ভিসিআরের উদ্ভাবন বিজ্ঞাপনে আরো গতি ও বিস্তার আনে। ১৯৮০-তে সূচিত ভিসিআর মাত্র একদশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারে প্রবেশাধিকার আদায় করে নেয়। গড়পরতা বছর বিশেকের ব্যবধানে আমাদের দেশের মানুষও রেডিও-টিভি-ভিসিআরের ভোক্তা হয়। আর সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তা হতে শুরু করে এসব মিডিয়ায় প্রচারিত নানা বিজ্ঞাপনেরও। এসব প্রচারমাধ্যমের সহায়তায় নতুন নতুন কলাকৌশলযোগে আধুনিক বিজ্ঞাপন কেবল পণ্য বা সেবাসংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না, সম্ভাব্য ভোক্তাশ্রেণির মনে আকাঙ্ক্ষা ও অভাববোধকে উসকে দিয়ে চাহিদার সঞ্চার করে।

বিজ্ঞাপনের ফলে নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবাগ্রহণকারীরা সংখ্যায় বাড়ে। আর এটা তো খুবই সরল হিসেব যে, পণ্য বা সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়া নানামুখী স্ফীতিরই একটি ইঙ্গিত। যার ফলে উৎপাদক বা সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন এবং মুনাফা বাড়ে, যার জন্য বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত সমুদয় বেগবান তৎপরতা।

মানুষের মন সাধারণত সংরক্ষণশীল। একটা অভ্যাসে স্থিত হলে সহজে তারা তা বদলাতে চায় না। ঘুরেফিরেও ওমুখো হয়ে থাকে। এই স্থিতাবস্থাটায় কৌশলে আঘাত করে সম্ভাব্য ভোক্তাশ্রেণির মনোভূমির দখল নিতেই বিজ্ঞাপনদাতারা মরিয়া তৎপরতা চালায়। তারা চায় আপনি পড়বেন-শুনবেন-দেখবেন, পছন্দ করবেন, পণ্য বা সেবা সম্পর্কে জানবেন এবং ক্রয় করবেন। কাজটা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। তাই ঢালা হয় অঢেল কড়ি। যত কড়ি তত আওয়াজ, তত রঙ, তত ব্যাপ্তি। এতে বারবার নানাভাবে সামনে এসে দাঁড়ায় ব্র্যান্ডনেম। কতক্ষণ না-পড়ে-শুনে-দেখে থাকবেন আপনি? পড়তে-শুনতে-দেখতে আপনাকে হবেই। শুধু পড়া-শোনা-দেখাই বা বলি কেন, বাধ্য হবেন এমনকি মুখস্থ করে ফেলতেও। এটাই পদ্ধতি। একসময় আপনি চাবেন ওই পণ্যের ক্রেতা-গ্রাহক হতে। অবচেতনের ইশারায়ই নির্বাচন করবেন সেই পণ্যটা, যেটার নাম বারবার শোনা, যার একটা কথা বা সুর আপনার ভালো লেগেছিল, যার একজন মডেল আপনার চিত্তসমুদ্রে সন্দেশের ঢিল ছুড়ে মেরেছিল কোনো একদিন।    

যেহেতু বিজ্ঞাপন নির্মাতাকে বিদ্যমান বাজারের প্রেক্ষিতে একটি প্রতিযোগিতায় নামতে হয় নতুন একটি পণ্যকে বাজারে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য, তাই বিস্তারিত পরিকল্পনা করেই তাদের মাঠে নামতে হয়। নতুন একটি পণ্যকে বাজারে প্রতিষ্ঠা দিতে এমনকি মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাকেও বদলে দিতে হয়। বিজ্ঞাপন এ কাজ সাফল্যের সঙ্গে করেও থাকে। তখন দেখা যায়, যে পণ্য মানুষের জানাশোনার আওতার মধ্যেই ছিল না, মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই সেটা ছাড়া তাদের আর চলছেই না। এক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের উদাহরণ টানা যায়। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে দেশে কী বিপ্লবটাই না ঘটে গেল! মনোভূমির চর দখলের এই কাজটা অনেক চ্যালেঞ্জিং বলেই বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে চমক দেখাতে হয় আইডিয়ায়, দক্ষতা দেখাতে হয় প্রতিলিপি ও জিঙ্গেল বিন্যাসে। নির্মাণে ছাপ রাখতে হয় সৃজনশীলতার। সবিশেষ, এই সামগ্রিক কর্মকলাপের বেড় দিয়েই তাদের মানুষের মনোহরণ-বাণিজ্যে সাফল্য দেখাতে হয়।

অনেকটা এসব কারণেই, বিজ্ঞাপনকে অনেকে আর্ট অর্থে শিল্প বলতে প্রলুব্ধ হন। কিন্তু এর উদ্দেশ্যের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকালে ওই বলাবলিটায় রহিত হতে হয়, কারণ বিজ্ঞাপন নিতান্তই বাণিজ্যিক, ব্যবসায়িক; যে সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা শিল্পের ব্যাপ্তির সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়। জানা কথা যে, বিজ্ঞাপনের কায়কারবার নানাপ্রকার শিল্পোপাদান নিয়েই। কাব্য, সংগীত, চিত্রকলা বিজ্ঞাপনচিত্রে হামেশাই ব্যবহৃত হয়। আর অভিনয়, নাচ-গান তো এর সঙ্গে ওতপ্রোতই। এর প্রযুক্তি নাটক-সিনেমার, যা সরাসরি শিল্পনামধেয়। এতদসত্ত্বেও, অর্থাৎ শিল্পসহবাসী হয়েও এটি উদ্দেশ্যের দোষে শিল্পকর্ম নয়। অবশ্য ইন্ডাস্ট্রি অর্থে বিজ্ঞাপনজগৎকে বিজ্ঞাপনশিল্প বলবার মতো অবস্থা এখন এদেশেও বিদ্যমান। এ খাতে এখন কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ, লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান। যে কারণে মেধাবী, প্রতিভাবান, সৃজনশীল তরুণ চিত্রনির্মাতা ও লেখকরা এখন এ খাতে স্থিত। যাঁদের হাত অনেক ভালো নাটক-সিনেমা বানাতে কী সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করতে পারত, তাঁদের হাত এখন নিয়ত ব্যস্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনে। অবস্থা এমন পালটে গেছে যে, নাটক-সিনেমা বানিয়ে হাত পাকলে তবেই কেবল বিজ্ঞাপননির্মাতা হিসেবে ডাক বা সাফল্য পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়, একসময় যার উলটোটাই সত্য ছিল।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিজ্ঞাপনের যা কিছু লাভালাভ তা পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও তদসংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা, বিজ্ঞাপননির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও নির্মাণসংশ্লিষ্টজন, বিজ্ঞাপন প্রচারকাজে যুক্ত গণমাধ্যম এবং নির্দিষ্ট পণ্যের বিক্রেতার ভাগেই বর্তায়। এর বাইরে বাদবাকি সমস্ত ভোক্তাশ্রেণিই বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির কড়ি গোনেন। ভোক্তাশ্রেণির দৃষ্টিতে দেখলে নানাভাবে সাধারণের শান্তি বিনষ্ট করাই যেন বিজ্ঞাপনের কাজ। যার কোনো কিছুরই অনটন নেই, বিজ্ঞাপন তাকেও প্রতিমুহূর্তে জানান দেয় যে, তোমার এটা নেই, ওটা নেই। যাদের এটা-ওটা আছে, তাদের চেয়ে তুমি ব্রাত্য, হীন। তার মনের মধ্যে তখন জন্ম নিতে থাকে প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, তাতে জন্ম হয় চাহিদার। আর এই চাহিদাই তাকে চুবিয়ে মারে অতৃপ্তির লাভাস্রোতে। এই অতৃপ্তি থেকে বাঁচতে তাকে অপ্রয়োজনেও অর্থ ঢালতে হয়। এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে সাধারণের চোখ-কানকে বিজ্ঞাপনের দ্বারা অনবরত পীড়িত হতে হয়। বিজ্ঞাপন ব্যাপক শব্দ ও দৃশ্যদূষণ ঘটায়। বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড-ব্যানারের বাধা এড়িয়ে সহজে মুক্ত আকাশ দেখবার সাধ্য শহরে অন্তত কারো হয় না আর। বিজ্ঞাপনে এখন ঢেকে থাকে চোখসমেত আমাদের বিস্তারিত মুখ। টিভি-রেডিওতে কান পাতা যায় না বিজ্ঞাপনের উচ্চণ্ড আওয়াজে। টিভির সামনে বসে বিরতিহীন বিজ্ঞাপনের ফাঁকে দর্শকদের একাধটু অন্যকিছু দেখতে-টেখতে হয়। দর্শক যেন টাকা দিয়ে টিভি কেনেন কেবল বিজ্ঞাপন দেখবার জন্যই। দয়া করে বোনাস হিসেবে চ্যানেলগুলো একটু নাচ-গান, নাটক-সিনেমা, সংবাদ-কথিকা দেখিয়ে তাদের ধন্য করে।

অবিশ্বাস্য লাগলেও আমাদের দেখতে হচ্ছে, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের মতো পত্রিকার কোনো একদিনের পুরো মলাট কোনো বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি হয়ে যেতে, যেটা সাংবাদিকতার দৃষ্টিতেও অত্যন্ত গর্হিত ব্যাপার। এতদিন টিভিতে আমরা ৫ মিনিট বিজ্ঞাপনের পরে ৭ মিনিট সংবাদ দেখতাম। এখন যতক্ষণ সংবাদ, ততক্ষণই বিজ্ঞাপন। নতুন কায়দা বেরিয়েছে। তাতে বিজ্ঞাপন ঢুকে গেছে সকল প্রান্তে, সকল ক্রান্তিতে। শিরোনাম এবং বিরতিটুকুও বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রি হয়ে গেছে সংবাদের বিভিন্ন বিভাগ-উপবিভাগ।

সংবাদকে যত স্লটে ভাগ করা যায়, ততই যেহেতু লাভ, সেজন্য ভাগ করা যায় না যা তাও ভাগ হয়ে গেছে। অর্থ সংবাদ থেকে বাণিজ্য সংবাদকেও আলাদা করা হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপনে বিরক্ত দর্শক এতদিন বিজ্ঞাপন শুরু হলে অন্য চ্যানেলে গিয়ে বিজ্ঞাপনের বিড়ম্বনা থেকে নিজেদের চোখ-কানকে রক্ষা করতেন, এখন আর সে সুযোগ নেই। এক গবেষণা তথ্য জানান দেয় যে, প্রায় ৩০ শতাংশ টেলিভিশন দর্শক সজ্ঞানে বিজ্ঞাপন এড়িয়ে চলার মানসিকতা রাখেন। এই তথ্যসূত্রে বিজ্ঞাপনসংশ্লিষ্টরা হয়ত বাকি ৩০ শতাংশ দর্শককেও কাবু করবার ফন্দি এঁটেছে। এখন বটমস্ক্রিনের নিউজস্ক্রল এলাকাও একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিকিয়ে দেয়া হয়েছে। তার মানে সংবাদ প্রচারকালে যতক্ষণ স্ক্রিনে চোখ রাখা হবে, ততক্ষণই প্রত্যেকে বিজ্ঞাপন দেখতে বাধ্য হবেন। অর্থাৎ আমার-আপনার জন্য পালাবার আর পথ নেই। সংবাদপত্র, টেলিভিশন কেউই আর সে সুযোগ দেবে না আমাদের। বিলবোর্ড-ব্যানারও আর দেবে না সাধ করে আকাশ দেখবার সুযোগ। আমরা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি বিজ্ঞাপন দেখা না-দেখা বিষয়ক আমাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা। এখন একমাত্র পত্রিকা না-পড়া, টিভি না-দেখা, ঘর থেকে বাইরে না-বেরোনোর সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতাটাই কেবল অবশিষ্ট আছে আমাদের। কিন্তু এ-ও কি সম্ভব কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে?

বলছিলাম সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিকিয়ে যাওয়ার কথা। এটা কেবল আমাদের দেশের বাস্তবতা না। পৃথিবীর অনেক দেশেই বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমের আয়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তাই সন্দেহ হয় যে, বিজ্ঞাপনদাতারাই হয়ত পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে গণমাধ্যমের গতিপ্রকৃতি। প্রশ্ন জাগে, বিজ্ঞাপনের ওপর সিংহভাগ নির্ভরশীল গণমাধ্যমসমূহ কতদূর সাহস রাখে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচারের? এটা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হবার উপক্রম। একাধটু যা হয়, তা নিছক শত্রুতাবশত। ‘ক’ নামক প্রতিষ্ঠান যখন ‘খ’ নামক সংবাদমাধ্যমকে বিজ্ঞাপন দেয় না, তখন ‘খ’ নামক সংবাদমাধ্যম তক্কেতক্কে থাকে ‘ক’কে নাজেহাল করবার জন্য। এই-ই একমাত্র শর্ত, যখন ‘খ’, ‘ক’কে ছিলিয়ে লবণ লাগিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কারণ তো স্পষ্ট, জেদ উসুল করা। ভাবখানা এমন যে, আমাদের বিজ্ঞাপন দাও না, দেখো তোমাদের কেমন ডোবানো ডুবাই! এই হলো ঘটনা! তো, এ সংস্কৃতিতে কার লাভ? ওই দু’পক্ষেরই মাত্র। বাকি সবাই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা জানতে পারি না সমাজ-রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা, যেটা জানাবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দেদারসে কড়ি কামিয়ে চলেছে গণমাধ্যমগুলো। নির্দিষ্ট কোনো সত্য চেপে যাওয়ায় বা হালকাভাবে জানানোয় বা উলটো করে দেখানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রও।

পণ্যের গুণে না-হলেও কোটি কোটি টাকা মূলধন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের দাপটে ইতোমধ্যে দেশের ছোটোপুঁজির ক্ষুদ্রশিল্পের রীতিমতো বারোটা বেজে গেছে। ‘সবলের কাছে দুর্বল হেরে যাবে’, প্রকৃতিবিজ্ঞানের এই সূত্রে যত সত্যই উচ্চারিত হোক না কেন, পুঁজির বাঘ যখন অকাতরে টপাটপ হরিণ-খরগোশ গিলে যেতে থাকে, যখন মাৎস্যন্যায়ে ছেয়ে যায় বাণিজ্যিক খাত। তখন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়, তা নানা অস্থিরতার জন্ম দেয়। ব্যবসায়িক অসততা ও নকল পণ্য উৎপাদনের যে ব্যাপকতা এখন দেশের বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর সর্বঘনিষ্ঠ কারণটি কে জানে হয়ত ওই অস্থিরতায়ই লুকিয়ে আছে! শুধু তাই নয়, আমার ধারণা বাজারমূল্য বৃদ্ধিতেও বিজ্ঞাপনবাহুল্যের বিশেষ ভূমিকা আছে। উৎপাদকগোষ্ঠীর একটা ফাঁকিবাজি হিসেব আছে, যা দেখিয়ে জানানো হয় যে বিজ্ঞাপন পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে না, বরং উৎপাদন বাড়ে বলে পণ্যমূল্য কমে। আসলে এর সবৈব মিথ্যা। কারণ ক্রেতাদের সামনে এমন কোনো উদাহরণ নেই যে, দীর্ঘদিন বিজ্ঞাপিত হবার পর পণ্যের ব্যাপক বাজার তৈরি হলে শুরুর চেয়ে কম মূল্যে কোনো নির্দিষ্ট পণ্য ক্রয় করা যায়। ধরা যাক পণ্যটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী, আর এর উৎপাদক ইউনিলিভার। সারাদেশের সবকটা চ্যানেলে, সবকটা পত্রিকায় শত শত ঘণ্টা বিজ্ঞাপন প্রচার করে, দু’তিন মাস সময় ধরে অনুষ্ঠিত সুন্দরী বা মডেল আহরণ জাতীয় অনুষ্ঠানের স্পন্সর হয়ে, লক্ষ লক্ষ টাকা মাসোহারা দিয়ে কর্মকর্তা পুষে বছরে এরা উৎপাদন খরচের অধিক যে পরিমাণ টাকা বাড়তি ব্যয় করে, সন্দেহ কী যে, সে টাকা উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ করেই এরা পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে! আমাদের জানামতে, তাদের টাকার গাছ নেই, তারা বাণিজ্য করতে নেমেছে, সমাজসেবা করতে নয়। বাণিজ্যের শর্তানুযায়ী তারা যা বিনিয়োগ করবে, তা মুনাফাসহ উঠিয়ে নেবে। এ নিয়মের ওখানেও ব্যত্যয় ঘটবার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ বিজ্ঞাপন ও স্পন্সরশিপের কোটি কোটি টাকা আমাকে-আপনাকে তথা ভোক্তাশ্রেণিকেই গুণতে হয়। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, এরা পণ্যের গায়ে যে মূল্য লিখে সে মূল্য নিয়ে কোনো মহল থেকেই কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠে না। মাস পরে দশ টাকা বাড়লে তা নিয়েও না। মিডিয়া তাদের পুকুরচুরি নিয়েও কখনো টু-শব্দটি করতে আগ্রহী নয়। এর কারণ আগেই বলা হয়েছে। অন্যদিকে পিঁয়াজ-রসুনের দোকানি কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়ালে তা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক হৈচৈ হয়। কারণ এরা বিজ্ঞাপন দেয় না। এবার ধরা যাক, পিঁয়াজ-রসুনের দোকানির বাসায় একটা ১৪ ইঞ্চি রঙিন কংকা টিভি আছে। কাজের ফাঁকে তার দুই মেয়ে টিভি অনুষ্ঠান দেখে। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দেখে তাদেরও ফর্সা হবার ইচ্ছে হলো। মেয়েরা একটা ক্রিম কিনবার বায়না জানালে দোকানি মুখ ঝামটা দিলেও মেয়েদের মায়ের সুপারিশে শেষপর্যন্ত তাকে রাজি হতে হলো, এটা মনে করে যে, যদি ঠিকই ওরা একটু ফর্সা হয় তো বিয়ে দিতে সুবিধে হবে! ষাট টাকা দিয়ে তাকে মাঝারি সাইজের একটা টিউব কিনতে হলো। তো, এই যে অতিরিক্ত ষাট টাকা অকারণে খরচ হলো, এই টাকাটা ওঠাবার জন্য ওইদিন যদি কোনো কোনো ক্রেতার কাছে দোকানি পিঁয়াজের দাম কেজিতে দুই টাকা বেশি হাঁকে, তাহলে দোষটা কার? ইউনিলিভারের নয়? ঘটনাটা যে এরকম করেই সবসময় ঘটে তা নয়। তবে দিব্যি দিয়ে বলা যায় যে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে এরকম একটা বৃত্তীয় কারণসূত্রও নিহিত আছে, যার একটা বড়ো ফ্যাক্টর বিজ্ঞাপনবাহুল্য।

অনেকে বলেন, বিজ্ঞাপনের একটা বড়ো সমস্যা এর বাড়িয়ে বলবার প্রবণতা। যেটা যা নয়, সেটাকে সে অভিধা দেয়া। আমাদের বিজ্ঞাপন দিনকয়ের ব্যবধানে টাক মাথায় চুল গজিয়ে বয়স কমিয়ে দেয়, বদখত মেদভুড়ি কমিয়ে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়, শ্যামলা ত্বক ফর্সা করে সাফল্য এনে দেয়, ব্রন-মেছতার দাগ মুছে রমণীয় করে দেয়, শারীরিক উচ্চতা বাড়িয়ে সুদর্শন বানিয়ে দেয়, ফাটা সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে অটুট করে দেয়, ভালোবাসা গাঢ় করে মধুময় করে দেয়! এসব বিবৃতিতে কার্যত কোনো সত্যই নিহিত নেই, বরং যা রীতিমতো প্রতারণার পর্যায়ে গণ্য হবার যোগ্য। কিন্তু এরা হরদমই এসব বিবৃত করে যাচ্ছে। দেশের কোথাও কেউ নেই এসব দেখভাল করবার। থাকলে এরকম মিথ্যা দিনের পর দিন উচ্চ ভলিউমে বলা-কওয়া সম্ভব হতো না। মিথ্যা বলা, বাড়িয়ে বলা এক্ষেত্রে একরকম রেওয়াজেই পরিণত হয়ে গেছে যেন। আমাদের দেশের কোনো কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে স্পর্শকাতর ‘হালাল’ শব্দটাও ব্যবহার করতে শোনা যায়। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে এভাবে বাণিজ্য করবার মতো জঘন্য ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সম্ভব বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে সবই সম্ভব। এমনকি ইউরোপ আমেরিকায় প্রত্যাখ্যাত কোনো কোনো বিজ্ঞাপনও এদেশে দেদারসে চলছে, যেমন হরলিকস। এজন্য কারো কোনোরূপ প্রশ্নের মুখেই পড়তে হচ্ছে না। হয়ত পড়তে হবেও না কখনো। এসব দেখে শুনে আমার নিজস্ব কিছু বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। গড়পরতা সব বিজ্ঞাপনের দিকে আঙুল তুলে আমি বলতে পারি, ‘এটা বিজ্ঞাপন, এর ৪০ ভাগকে মাত্র সত্য হিসেবে নিও, বাকি ৪০ ভাগ প্রোপাগান্ডা আর বাদবাকি ২০ ভাগ মিথ্যা’-- এরকম একটা বিশ্বাস নিয়েই হয়ত আমাকে বাঁচতে হবে, যতদিন না কেউ বিশ্বাসযোগ্য কোনো জরিপতথ্য দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারছেন। এজন্যই আমি ব্যক্তিগতভাবে বিজ্ঞাপনবাহুল্যে কুখ্যাত(!) কোনো পণ্য ক্রয়েই বিশেষ আগ্রহ বোধ করি না, যার ক্রয়োপযোগী অন্য বিকল্প আছে।

পাশ্চাত্যের আরেক গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ৩০ শতাংশ দর্শক টিভিতে প্রচারিত অন্য অনুষ্ঠানাদির চাইতে বিজ্ঞাপন বেশি উপভোগ করে। কেন করে? কী এমন উপাদান বিজ্ঞাপনে রয়েছে, যা টিভিতে প্রচারিত অন্য অনুষ্ঠানগুলোতে নেই? এর উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলে হয়ত সমাজে বিজ্ঞাপন কেমন প্রভাব রাখে তার একটা হদিশ করা যেত। অবশ্য এ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের লিঙ্গভিত্তিক তথ্য সহজলভ্য নয়, যেটা লভ্য হলে আরো কিছু দিকেরও সুরাহা হতো। তবু কি অনুমান একদমই করা যায় না, অন্তত স্বচক্ষে কিছু বিজ্ঞাপনচিত্র দেখবার অভিজ্ঞতা থেকে? যায়। এর কারণ সম্ভবত কাম্য নারী/পুরুষের আকর্ষণীয় উপস্থাপনা, যা তরুণ-তরুণীকে সুযোগ করে দেয় ‘ব্র্যান্ডের বাঁদী’কে ঘিরে ফ্যান্টাসিতে মেতে ওঠবার। সকলেই জানেন, বিজ্ঞাপন নারীর শরীরী সৌন্দর্য ও যৌনতাকে পুঁজি করে তাকে পুরুষের কাম্যবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে, তা তাকে যে ধরনের চরিত্রেই হাজির করা হোক না কেন। এমনকি বিজ্ঞাপনের ‘মা’কেও দর্শকের কাছে প্রকৃত ‘মা’ মনে হয় না, শরীরী নারীই মনে হয়। ওর উপস্থাপনাটাই এমন হয় যে, তাতে মায়ের অনুভূতি ঠিকঠাক খোলে না। পণ্যের রংয়ে রঙিন করে বিজ্ঞাপনে নারীমডেলকে পণ্যের কায়দায় যেভাবে নাড়াচাড়া করা হয়, তাতে পুরুষ নারীকে একটা নাড়াচাড়ার বস্তু হিসেবেই ভেবে নিতে পারে আলবত। এসব মডেলের মধ্যে নারীদর্শকও মজে যায় শুনেছি। তাদের কাছে মডেলনারী হয়ে ওঠে অনুকরণীয় আদর্শ, আর মডেলপুরুষ হয়ে ওঠে কাম্যজন!

উল্লিখিত ৩০ শতাংশের মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞাপনের জেন্ডার নির্মাণ কৌশলের পুরোপুরি অনুকূলে। বিজ্ঞাপন যেভাবে হাসতে বলে এরা সেভাবে হাসে, যেভাবে সাজতে বলে সেভাবে সাজে। এমনকি যেভাবে তাকাতে বলে বিপরীতলিঙ্গীর প্রতি, সেভাবে এরা তাকায়ও। এসবের ভিতর দিয়ে পুনঃসামাজিকীকৃত হয় নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ক সমাজে বিদ্যমান চিরাচরিত একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে নারী কেবল নাচে-গায়, সাজে-রাঁধে, সেবা-সহায়তা করে, কাপড় কাচে, হাঁড়ি-বাসন মাজে, বাচ্চা লালনপালন করে। বিজ্ঞাপনে নারী কমই বিমান চালায় বা অফিস পরিচালনা করে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পণ্যের ঘনিষ্ঠ পরিচয় উপস্থাপন করবার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন নারীর এহেন স্টেরিওটাইপড চেহারাছিরিও সমাজে জ্ঞাপন করে যেতে থাকে অবিরাম, যা নারী-পুরুষের মধ্যে সমতাপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নের যাবতীয় উদ্যোগের বিপরীতে বিরামহীনভাবে নেতিঢেউ প্রবাহিত করে যেতে থাকে। এ কারণেও বটে, অনেকে ঝেড়ে কেশে বলেন, বিজ্ঞাপন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনবরত ছড়িয়ে যাচ্ছে মনন কলুষ। এ দৃষ্টিতে একে দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি প্রকল্পের অধিক কিছু ভাবা যায় না বস্তুত।

সম্প্রতি নির্মিত কোনো কোনো বিজ্ঞাপনে নারীর এই স্টেরিওটাইপড ইমেজ ভেঙে বাইরে বেরোবার চেষ্টা করা হচ্ছে দেখে ভালো লাগে। রান্নাঘরে পুরুষকেও পাঠানো হচ্ছে দেখে হতাশা কিছু কমে। কিন্তু এই ভালো লাগা স্থায়ী হয় না রাঁধুনি মা দিবস বা পন্ডস নারী দিবস জাতীয় প্রোমোশনাল প্যাকেজ কিংবা ইউনিলিভার/স্কয়ারের পয়সায় ঢাকঢোল পিটিয়ে সুন্দরীর হাট বসানোর কথা ভেবে। শেষপর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে এরা আমাদের? বড়ো অসহায় লাগে, কেবলই অসহায় লাগে। আধিপত্যশীল এই বিজ্ঞাপনের দাপটের কাছে অসহায়তা বোধ করাই সম্ভবত আমাদের পরম নিয়তি। যেমনটি মূর্ত হয়ে উঠেছে শঙ্খ ঘোষের সুবিখ্যাত কবিতা মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনেও। আমাদের ব্যক্তিগত কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই, যেখানে ঢুকে যায় নি বিজ্ঞাপনের আগ্রাসী দাপুটে হাত। কবিতাটি পাঠশেষে একটা নিরাময়অযোগ্য বিপন্নতাবোধের জন্ম হয়। ক্ষুব্ধতাও জাগে মনে, কিন্তু বিপ্লবের বাসনা জাগবার ফুরসৎ হয় না। কার বিরুদ্ধে বিপ্লব? বিশ্বায়ন? বাজার? পুঁজি? অসম্ভব লাগে প্রায়। তবু চলুন আরো একবার বিপন্ন হবারই চেষ্টা হোক, যদি কোনো নিরাময় চিন্তা বেরিয়ে আসে কোনোদিক থেকে! বলা তো যায় না কিছু!

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুসে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।

কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!

বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।

মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।


(শঙ্খ ঘোষ, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)


ম. হাসান সম্পাদিত 'দ'-এ সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রকাশিত

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...