Tuesday, August 4, 2020

অন্য প্রেম

মানবসমাজে প্রেমানুভূতি চিরন্তন। দাদা-দাদিতে ফুরিয়ে গেলে গজিয়ে ওঠে নাতি-নাতনিতে। জগতে জন্ম-মৃত্যু দুটোই যুগপৎ ক্রিয়াশীল থাকা সত্ত্বেও মানুষ বাড়ছে। সংগত কারণে বাড়ছে প্রেমাধারও। কবিতার কারবার যেহেতু অনুভূতির আধার ওই মানুষকে ঘিরে, প্রেমের কবিতা কাজেই লিখিত-পঠিত হবে মানুষের অস্তিত্ব নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত। আর প্রেমকে যে মূঢ়কুল কেবল নারী-পুরুষের কামজ লক্ষণ হিসেবেই দেখে, তারা জীবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, দেশপ্রেম, বাৎসল্যপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেমসহ তাবৎ প্রেমবৈচিত্র্যের অস্তিত্বকে অস্বীকারের মাধ্যমে জগৎকে খণ্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করবার প্রয়াস পায়। এদের উদ্দেশ্যমূলক অভিপ্রায়কে সন্দেহ করুন!

স্বার্থান্ধ রাজনীতি ও ধর্মান্ধতার কূট ইন্ধনে সম্প্রতি জগৎব্যাপে মানুষের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতা উসকে ওঠায় পৃথিবী ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর এই রোগমুক্তির কার্যকর দাওয়াই হতে পারে অসহিষ্ণুতার নিচে চাপা পড়া মানুষের প্রেমবোধকে উসকে দেওয়া এবং মানুষে-মানুষে ভালোবাসার মহিমাকে উচ্চে তুলে ধরা। এই শুভ ব্রতে প্রেমের কবিতা হোমিওপ্যাথির মতো ধীর কিন্তু টেকসই অবদান রাখলেও রাখতে পারে বলে মনে হয়!

Monday, August 3, 2020

অসমাপ্ত ঘোড়ায় চড়ে তোমার দিকে যাওয়া

তোমার দিকে যাবার পথে আকাশপ্রমাণ বাধা, মেঘ যেমন পর্বতচূড়ায় বাড়ি খেয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে, আমিও তেমনি তোমার আপেলবনের সান্নিধ্যে এসে ঝরে গেছি কুয়াশাপ্রতিম, বামে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্র ও ডানে নরকের খোলা দ্বার, তিন পায়ে দাঁড়ানো আমার জেনসাইকেল চোখ টিপে হাসে, চিন্তামগ্ন আমি ঘাসের উপরে বসে একমনে চিবুতে থাকি এলাচের দানা

তোমার প্রতি আসক্ত অনেকেরই আছে ট্রেকিংয়ের ছল, যেকোনো বিপদ আলগোছে সামলাতে তারা সুসজ্জিত থাকে, আমি প্রায় নাবালক শিশু এক তাদের প্রেক্ষিতে, না আছে শাস্ত্রজ্ঞান না অভিজ্ঞতা, মঞ্জিলে পৌঁছাব এমন প্রতিজ্ঞা আমার শুধু মনোবলজাত

রাত নেমে এলে তাঁবু খাটাই তোমার আপেলবাগানে, জেনসাইকেল আমাকে বন্ধুসঙ্গ দেয়, মন গিয়ে থেমে থাকে সুজিত সরকারে :

‘কিছুই চাওয়ার নেই
কিছুই পাওয়ার নেই

জয় নেই
পরাজয় নেই

শুধু হয়ে-ওঠার আনন্দ
হয়ে-ওঠার আনন্দ’

হয়ে-ওঠার আনন্দ সন্ধানে তাকাই পথের গুরুর মুখে, জেনসাইকেলে, মূর্ত হয় এক সম্পন্ন ইশারা, সেইমতো মনকে নিবিষ্ট করি চিত্তমন্দিরে, ত্রস্ত আঁকতে বসি প্রাণান্ত ঘোড়া, কিন্তু চোখে আনন্দ অনুভূত হয় না, মনোযোগে বুঝতে চাই হয়ে উঠল কি না, দেখি হয় নি, ঝুলে ও থমকে আছে অসমাপ্ত লাফ

যাবার উপায় নেই, বুঝি বিষাদই আমার একাস্ত আপন আজ তীর্থ থেকে দূরে, সমুদ্র পাড়ির হিম্মত নেই জলযান ছাড়া, ডানে পাহাড় রেখে সমুদ্র ডিঙিয়ে তোমার কাছে যাওয়া তাই হবে না আমার, শূন্য সম্ভাবনার ওপরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সাঁতার জানলেই কখনো সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়া যায় না

জানি অপরাধ ও পাপপঙ্কিলতার ভেতর দিয়ে তোমাকে জয় করা সম্ভব, চাইলেই হয়, ডানে হাঁ হয়ে আছে নরকের দ্বার, ওদিক দিয়ে ঢুকলেই সদরপথে বিদ্যমান সঙ্কটের পাহাড়কে উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু আমার মন তেমন চায় না, পাপের মৌচাকে যতই মধু থাক পূর্ণতৃপ্তি নেই, জয়াকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে যেহেতু তুমি

আমার ভরসা কাজেই সোজাপথ, আপেলবনের ভেতর দিয়ে ক্রমোন্নত পাহাড়ের দিকে রথ টেনে নেয়া, বাঘ-ভালুকের বুনোসন্ত্রাসকে গণনার বাইরে রাখা, সাপখোপের ফণাকে দু’পায়ে দুমড়িয়ে যাওয়া, চুতরা পাতার স্পর্শকে অবজ্ঞা করা আর গোলাপকাঁটাকে করা নিতান্ত তুচ্ছজ্ঞান, এই বুঝি অবিকল্প নিদানের পথ

না, জেনসাইকেল পরামর্শ দিলো ঘোড়ার শরণ নিতে

ঘোড়া তো অসমাপ্ত আমার

মনে রেখো যে পাহাড়ও প্রকৃত অর্থে সমাপ্ত নয়, দিনে দিনে ওরও কিছু বাড়ে-কমে, বাড়ে-কমে মানুষের সঙ্কট সম্ভাবনাও

তা বলে অসমাপ্ত ঘোড়ায় দীর্ঘ যাত্রা করতে ভরসা পাই না যে

চলতে শুরু করলেই মানিয়ে নেবার ক্ষমতা অর্জন করে নেবে ঘোড়া, হয়ে-উঠবে ক্রমে, ওটাই ভরসা তোমার

এসব কারণে জেনসাইকেলকে মাঝে মাঝে আমার দার্শনিক গুরু বলে মনে হয়, গুরুবাক্য যথাদ্রুত শিরোধার্য করি আর অসমাপ্ত ঘোড়ায় চড়ে বহুদূর এগিয়ে চলে পথ, আপেলবাগান পেছনে ফেলে ধোপদুরস্ত সবুজ জামা পরা বিচিত্র মুখাকৃতির অজস্রাজস্র গাছপালার সাথে খাতিরার্তি করে নাভিবন পাড়ি দিয়ে পথ ঠেকে গেল খাঁড়ির সমুখে

বড়ো বিপদের সামনে পড়লে ধীরেসুস্থে ভেবে নেয়া ভালো, ধ্যানস্থ পাখিরা যেমন বিরক্ত হলে উড়ে গিয়ে খানিকদূরে নিরাপদে বসে, আমিও তেমনি উঠে তোমার দিকে মুখ করে বসে স্বার্থাস্বার্থ গোছাতে লাগি কাগজে-কলমে, খালি পেটে জল খেয়ে শুরু করি লেখাকাজ, নরকের দ্বার ডানে খোলা থেকে যায়

একে একে আমি গুণতে থাকি বাধা, প্রথমে যার নাম মনে পড়ে তারে কাম বলে চেনে সব কৌতূহলীজন, তার অসংখ্য হাত-পা, সবই কমবেশি কর্মতৎপর, একনিষ্ঠকে তুষ্ট করা সহজে সম্ভব, তার প্রাপ্যতার জ্ঞান আসে একই উৎস থেকে, ওদের দখলে আছে জগৎ দেখার চিরায়ত ভঙ্গি, কিন্তু অজস্র চোখের মালিক এ জগতে কখনো তুষ্ট হয় না, একদিকে ফিতা ফেলে ওরা কোনো মীমাংসা বোঝে না, অজস্রচোখারা চিরকাল অতৃপ্ত, দুঃখী ও অবদমিত

কামকৃষ্ণ হাওয়া যখন বইতে লাগে, পৃথিবীর বিপুলায়ন গাছপালাকে মৃদু কাঁপতে দেখা যায় মানুষের বেদনার প্রতি সংহতির প্রকাশরূপে, জগতে জেনেছি দুঃখবাদীর সংখ্যাই বেশি, গাছেরা পুরোটা আর বৃহদাংশ মানুষ যারা অজস্রচোখা

বাতাসের সাথে যেসব কথা হয় দেবদারু গাছের, তা সব তোমার কানে কখনো পৌঁছাবে কি না জানি না, তবু মনে হয় গাছের গোপন গুহায় নিবেদিত রয়েছে তাহারা, তোমাকে নিবিড় চেয়ে না-পাওয়ার কারণটা আত্মঅধিগত

ঘটিবাটি নিয়ে আমি বসে গেছি জানো বহু আগে, একবার বসে গেলে অধিকাংশই ফিরে আর ওঠে না দেখেছি, ‘ওঠে না’রা উঠতে পারে না, পুরো ধরা খাওয়া, এদের ছাড়াও যারা উঠে আসে তাদেরও জীবনে পোহাতে হয় বিচিত্র ধস, বয়ে যেতে হয় বড়ো শিকলের ভার

এ হলো সংসার, এমন বাঁধনে বাঁধে, যারে তুমি পারবে না ছিঁড়ে যেতে, যাবে যদি আসবেও ফিরে ফিরে, অনেক দরকারি ওকে সাথে রাখা, দরকারি মাঝে মধ্যে খিড়কি বানানো তাতে, আসতে যাতে পারে ঘরে বিপুলা বাতাস, যখন খিড়কি নেই তখন আঁধার সবই, এসময় মনে হয় তুমিই প্রধান বাধা তার কাছে পৌঁছে যাবার

প্রফুল্ল হাওয়ার সাথে তোমার বিরল ভ্রম নাচ করে মিশে যায় জাদুবিদ্যা হয়ে
নিনাভ ঘোরের কাছে মানুষের পৌঁছে না মেকি ইতিহাস
শিরায় রোদের ঘ্রাণ, পাখালিপ্রণীত গান শুনে শুনে তিথিসব পার হই শিল্পরোদনে
শিল্প আর যাতনার রোরুদ্য মিলন আমি গতজন্মের ঝিলপাড়ে এসেছি ফেলিয়া

আমি রুক্মবতী লিখি নি, তরজা বাঁধি নি, জানি না তোটক, আমার যাবার পথে ছন্দ ওঠে স্বতঃমঞ্জুরিয়া
মনোকর্ণের কখনো কোনো হয় না সনদ, তবু সে অনেক শোনে, অনেকটা বোঝাবুঝি খুঁজেখেটে পাঠায় মগজে

সে কারণে মনে পড়া প্রলম্বিত হয় :

‘বিশাল অশ্বত্থ গাছ
পিছনে
মস্ত সাদা বাড়ি

জ্যোৎস্নায়
দেয়ালে
অপরূপ ছায়ার আলপনা

মালিক জানেন না
তিনি ভিতরে থাকেন
পথিক বিভোর হয়ে দেখে’

প্রেম যাকে নিঃস্ব করেছে সে বোঝে প্রেমের গান, সেই গায় সবচেয়ে দরদের সাথে, মাঝে মাঝে মনে হয় প্রেমও এক বাধার প্রাচীর, প্রেমের বায়বযানে চড়া ছাড়া কখনো পৌঁছে না কেউ সাফল্যমঞ্জিলে, অর্থাৎ প্রেমে যে পড়তে হয় এটাই প্রেমের বাধা

সমাজ সর্বদা সামনে দাঁড়ায় তার কাছে পৌঁছার পথে, এ কথায় অতিরঞ্জন নেই, কিছু লোক থেকে যায় তবু সমাজে সমাজে, যারা বল দেয়, প্রশ্রয় উঁচিয়ে রাখে, আঙুল তুলে দেয় সমর্থন, সমাজকে তখন কিছু কঁচুকাটা করা যায়, দরকারও, মানুষের দায় আছে সমাজকে মুচড়িয়ে কিছু প্রথা হাড়মা’স খুলে ছুড়ে ফেলা

অনেক এগোল মানুষ, মাঝে মাঝে তবু মনে হয় এগিয়ে যাওয়ায় কিছু মেকি রয়ে গেছে, কিছু কিছু নমুনায় জগৎকে মনে হয় হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা এক বিন্দুতে

আমি যে ভীষণা নদী প্রতারণা মাঝে মাঝে বুকজুড়ে চৈত্র জাগায় এবং কি ভালোবাসাহীনতার প্রবাহিত করে রাখে অগ্নিউত্তাপও

দূর থেকে কুহুবার্তা আসে অবেলার কোকিল মারফত আমার এই চৈত্রমন্দিরে, সাহস করে খাঁড়িপথে ঝাঁপ দেয় ঘোড়া, পিছলে পড়ে গিয়ে আরো দূর কামখাদে, এখানেও প্রেম এসে হাত বাড়িয়ে তোলে, ফিরিয়ে আনে সূচনাবিন্দুতে

এবারে তীর ঘেঁষে এগোতে চায় ঘোড়া, ওখানে বৃক্ষবিরোধ হয়ে আগলে থাকা সংসার, মূলে যার অনেক উইং

ঘোড়ার বিশ্রাম নেই, লাফিয়ে পার হতে চাইল সে প্রেম, পারল না মায়া রয়ে গেল, পথজুড়ে সমাজের জাল, ছিঁড়ল আধেক তবু সবটুকু ছেঁড়াই হলো না, যতক্ষণ সব জাল ছিঁড়ে নাই, ততক্ষণ ছিঁড়াছিঁড়ি অসমাপ্ত ঘোড়া

মনে হয় পৃথিবীর সকল নদীর জল ঘোলা, সকল ক্ষণই থাকে বিপুলা ক্ষণের ভিড়ে নানারূপ স্মৃতির মাজার হয়ে

একে একে পথ খুঁজে ঘোড়া, একটু একটু করে সম্পূর্ণতা বাড়ে, পায়ে ফুটে নানাবিধ ফুল, পাকে ও চক্রে পড়ে খাঁড়ির সমুখদেশে রাতদিন কাটে, চলা তবু থামে না তাহার

‘কবিতা লিখি
কবিতা লিখে যাই

হয়ে-ওঠার আনন্দ
আহা
হয়ে-ওঠার আনন্দ’

শেষে মনে হয়, অসমাপ্ত একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে তোমার দিকে যে যাত্রা শুরু হলো তার শেষ ইমনকল্যাণে

কবিতা বিষয়ক নোট

ইতিউতি ভাবনার উপজাত অনুভূতিরাজি যখন চিত্তমণ্ডলে লাগাতার ভাঙচুর চালাতে থাকে, তখন মনোপুলিশ লাগিয়ে গুম করে না দিয়ে সেসব অনুভূতিকে কথায়, রঙে বা সুরে মুক্তি দিলে নিদারুণ অস্বস্তি থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। কার্যত আমি রঙান্ধ ও অসুর, তাই কথার আশ্রয়েই তার যথাসাধ্য প্রকাশ ঘটাই। কখনো কখনো দেখি কিয়দংশ প্রকাশে অবলীলায় ভর করে আছে রঙের ছোপছাপ ও সুরের পাখসাট। তখন বিস্ময়াহত আমি ওই প্রকাশবস্তুকে আহ্লাদ করে কবিতা নামে ডাকতে উদ্যত হই, কানা ছেলের নামও যেমন হয় পদ্মলোচন!

কবিতা হিসেবে ওসব হয়ত যথেষ্ট নিম্নমানের। তৎসত্ত্বেও, ষষ্ঠেন্দ্রিয়ধারী ইহবাদী ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমার ওসব অনুভূতিরও একটা সহজ তাৎপর্য আছে, ওখানে মূর্ত সাধ-আহ্লাদেরও একটা স্বপ্নমূল্য আছে। সে কারণে নামায়নের দুঃসাহস-সম্বলিত বিশেষায়িত ওইসব প্রকাশকে আমি সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে নিয়ত প্রশ্রয় দিয়ে চলি। পরিপার্শ্বের গণতন্ত্রহীনতা মনদেশের গণতন্ত্রচর্চায় কোনোই প্রভাব রাখতে পারে না।

তবে মাঝে মাঝে ভাবি, কবিতা লিখতে এসে এত যে তেল-পানি খরচ করেছি, না যদি লিখতাম তো কী হতো ওই অব্যয়িত তেল ও পানিতে? খরচ না হওয়া ওই তেল-পানি কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে একখানে মিশে গিয়ে হয়ত কোনো বিতিকিচ্ছিরি চেহারা পেত, যাদের আলাদা করবার সমুদয় প্রয়াস পর্যবসিত হতো সকরুণ নিষ্ফলতায়। অবশ্য, পানিতে তেল মেশানোর চাইতে লবণ মেশানো যে অধিকতর সুবিধাজনক, এই বোধ, হয়ত কবিতা লিখি বলেই জাগে!

একটা আকামা জিনিসের পেছনে ছুটে জীবনকে তামা তামা করে, কার্যত, যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তার কোনো নগদ অর্থ বা বিনিময়মূল্য এই মরপৃথিবীতে নেই, যেখানে অর্থহীনতাকে এ সমাজ ভালো চোখে কখনো দেখে না। সমাজের সমুদয় বিবেচনা অর্থ ও বিনিময়মূল্যে নির্ধারিত হয়। এরপরও, এই নিরর্থকতা ও অর্থহীনতার পেছনে ছোটার সহজ তাৎপর্য হলো, কিছুমাত্র হলেও আমি সমাজবিরোধী। কবিমাত্রই বোধহয় তাই। সমাজ যখন যেখানে যেভাবে আছে তাকে বরমাল্য প্রদানকারীরা কখনো কবি নয় বা হলেও হাফকবি! এ আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি। বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যের প্রতি পূর্ণ আস্থা সত্ত্বেও এ বাক্যে ইমান আনা যায়। আমার সে ইমান আছে।

সমাজের চোখ হলো কবি বা শিল্পী নয় এমন সব মানুষের চোখ, তারা যেভাবে যা দেখে, কবি কখনো সেভাবে দেখে না। কবির আলাদা করে দেখাটাই তার সমাজবিরোধিতা। এ বিরোধিতা সমাজকে বদলে দেয় না বটে, তবে বিদ্যমান সমাজ্জলে সকারণ কিছু ঢিল ছোড়ে, যার ঢেউ সমাজের কাছে অস্বস্তিকর ঠেকে। ওই বিরোধিতাটা এক ধরনের সফট বিপ্লব, ধীরস্থির, কিন্তু পয়জনাস।

কবিতায় সমাজবিরোধিতার ঘটনাটা শৈল্পিকভাবে ঘটানো যায় ইমাজিনেশনের সহায়তায়; এর আরো উৎকট পন্থা আছে, যা বলা এখানে বাহুল্য। ইমাজিনেশন হলো সংবেদন ও ধারণার মনছবি আঁকবার সামর্থ্য, যার সবটা কোনো বিশেষ মুহূর্তে শ্রবণ-দর্শন বা অন্য কোনো একক ইন্দ্রিয় দ্বারা ধারণযোগ্য নয়। এটি তৈরি হয় বুদ্ধি ও আবেগের সংমিশ্রণে, যার পূর্বশর্ত হলো পূর্ণ স্বাধীনতা। তো, কবিদের এই অবাধ স্বাধীনতা ভোগ কবিতায় কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে কি না সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন। যাকে চরম স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সে সেই স্বাধীনতাটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছে কি না তা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বটে। স্বাধীনতার মানে যে যথেচ্ছাচার নয়, এ শিক্ষার এখতিয়ার কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একার নয়; এটি কবিতাসহ শিল্পপাড়ারও আওতাধীন বিষয়।

দেখি যে, অধুনার কবিদের একাংশ চিত্রমাত্রকেই চিত্রকল্প ভাবছে। আরেকদল কল্পনাকে এতটাই অবাধে চরতে দিচ্ছে যে, কাঁটাতার ডিঙিয়ে তারা পায়ে হেঁটে সাগর পাড়ি দিয়ে ফেলছে। চিত্রকল্পের নামে হাতিগুচ্ছকে তুড়িতে উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে আকাশে, নদীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে মাছের যৌনতাসহ; যেহেতু কাজটা যথার্থেই সংঘটিত হবার দরকার হচ্ছে না, শব্দ-বাক্যের কারসাজিতেই ঘটিয়ে দেওয়া যাচ্ছে সব। এই প্রবণতাকে অনেকটা ফ্রি পেয়ে মাথার বাঁ’পাশে বাড়তি আরেকটা মাথা জুড়ে নেওয়ার মতো ব্যাপার বলে মনে হয়।

পাগলামি অনেক সময় উৎকৃষ্ট মনছবি আঁকতে পারে, তবে সেসব ছবির সিংহভাগ যে অসংলগ্ন চিন্তায় ঠেস দেওয়া থাকে প্রায়শ তার কোনো জাতকুল থাকে না। এসব চিন্তা মানুষের পারসেপশনের আওতার মধ্যেই যেন আর থাকতে চাইছে না। হামেশাই ডিঙিয়ে যাচ্ছে বোধ্যতার সীমা-পরিসীমা। কিন্তু এরও সীমা আছে, থাকা উচিত। তা নইলে কথিত কবিতাকে উপলব্ধিতে নিতে অসমর্থ পাঠককে পশ্চাৎপদ ঠাওরে গালি দিয়েও আখেরে পার পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। যা-ই কল্পনা করি না কেন, মানব ধারণায় তাকে সম্ভব মনে হতে হয়। অন্তত দূরান্বয়ী হলেও একটা সম্পর্কসেতু কোথাও থাকতে হয় আবিষ্কার করে ওঠবার জন্য। তাহলেই কেবল সেখানে সৌন্দর্য ভর করবার ফুরসত পায়, অন্যথায় সৃষ্টি হয় সামঞ্জস্যহীন প্রগলভতা। মনে রাখতে হয় যে, প্রলাপোক্তিসর্বস্বতা কবিতার এক নম্বরের শত্রু।

আমার মনে হয়, উত্তুঙ্গ কল্পনা যাতে কোনোভাবেই প্রলাপে পর্যবসিত হয়ে না যায়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করে উঠতে পারাই আমাদের একাংশ সাম্প্রতিক কবির জন্য এখন বড়ো রকমের চ্যালেঞ্জ।

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...