Sunday, November 15, 2009

আনাড়ীর কবিদর্শন

এক দু’পৃষ্ঠার একটি গদ্য লিখে একজন কবির প্রতিবিম্ব ফুটিয়ে তোলা যেন সম্ভব কোনো কাজ, তাও যেই সেই কোনো কবি নন, স্বয়ং বিনয় মজুমদারকে : বাংলা কবিতাঙ্গনে কবিতার শহীদ বলে খ্যাত জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে যিনি অদ্যাবধি শিমুলপুর আলোকিত করে আছেন-- কবিতার পাঠককে আরো কিছু বিস্ময় উপহার দেবার জন্যে। কিন্তু তবু আমরা কলম ধরি। ধরি, হাতেকলমে এটি প্রমাণ করবার জন্যে যে গোটা কয়েক পৃষ্ঠায় একজন লেখকের কোনো চিন্তার, চরিত্রের, প্রকৃতির প্রান্তটিকে স্পর্শ করা যায় মাত্র। দশজন মিলে দশদিক থেকে প্রান্ত স্পর্শ করলে সম্পূর্ণ কবির অনেকখানিই নিকটে পৌঁছা হয়ে যায়, যেতে পারে। এরকম স্পর্শে স্পর্শে কবির স্বর্ণাবয়বটি ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। আর কবির স্পষ্ট হওয়া মোটেই কবির জন্যে নয়, দরকার পাঠকের এবং প্রকারান্তরে আগামী কবিতার জন্যেই। আমরা যখন একজন কবির বিষয়ে কিছু লিখতে উপগত হই, তখন অতসব ভেবে না-নিলেও সাধিত কর্মটি অগোচরে এ ফলাফলটুকুই সম্ভব করে তোলে মাত্র। তবু কাজটি করতেই হয়, ফুল নামধেয় কাঁটার উৎপাত অরণ্যানীতে এত বেড়ে গেছে যে, আদপে যারা ফুল তাদেরকে নানাদিক থেকে দেখে চিনে ফেলা প্রয়োজন-- তাতে ক’টিমাত্র দল, পাপড়ি দৃশ্য নাকি অদৃশ্য, বর্ণিল নাকি বর্ণহীনতাই তার সৌন্দর্য-স্মারক, গন্ধ আছে কি না, থাকলে তার জাতকুল শনাক্তযোগ্য কি না ইত্যাদি। নইলে কাঁটারাও ফুলের পোশাকে সজ্জিত হয়ে ফ্যাশন শোর মতো পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ভ্যাংচাতে থাকবে-- আর প্রকারান্তরে ভুল অভিলক্ষে অভিমুখীনতাকে চিহ্নিত করে বিভ্রান্ত দর্শক কাম উপভোগকর্তা, রক্তপাতের কারণকে রক্তমূল্যে সংগ্রহ করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এজন্যে আমার আপনার ভাবিত হবার কী আছে, যেখানে উপভোগকর্তা নিজেই নিজের জন্যে বিপদ কিনে আনছে? এর জবাব এরকম যে, ভাবিত হবার মূল্যমানের কারণ আছে। কেননা নিষ্ঠ কবিতাকর্মীরা, যারা নিজেরা ফুলোপম গন্ধ বিলাবার জন্যে অনেক কামনাবিলাসিতাকে উপেক্ষার চাবুক কষে সদা প্রস্ফূটিত হয়ে চলেছেন অরণ্যানীছায়ে, প্রকৃত ফুলচিহ্নিতকরণের সূত্রাদি সন্ধানে ব্যর্থ হলে পরবর্তী গন্ধলোভীরাও এদের শনাক্ত করতে পারবে না। তাতে আগাগোড়া ঘাটতিরই সমূহতা বাঙ্ময় হয়ে উঠবে। যে পথে ধাবন কেবলই ঘাটতির নিশ্চয়তা বিধান করছে, সে পথ বাঁয়ে রেখে হাঁটাই কাজের কথা-- কেনই বা অযথা দাঁড়াবে একজন গিয়ে বিষবৃক্ষতলে? তাই--

বিনয় মজুমদারকে

অবশেষে রাত্রিও পেছনে হটে ঘুম যায় চূড়ায় আভাসে
স্ত্রীপুত্রসমেত-- একা শুধু ঢালে শুয়ে পাতাদের
পতন যন্ত্রণাগুলি ছুঁয়ে ছেনে দেখ আর ঘাসের সুগন্ধে
ধোও মুখ-- দূরে পড়ে আছে যারা স্বজন সুহৃদ
পাহাড়ের পদ-সন্নিকটে-- ‘পথ নেই খুঁজে বার কর’ বলে
দলেবলে মেতে আছে নিবিড় বিপ্লবে
তাদের সকাশে দ্রুত জটিল এক সবুজ বার্তাবাণী
পৌঁছে দাও বাতাসে ঝাঁকিয়ে মাথা বিশাল বৃক্ষের...
ফলে দূর বিন্দুসাথে যে পথ রচিত হয় ট্রান্সন্যাচারাল
সে পথ কুসুমরঙা তুমুল প্রবাহে ভাসে
গণের প্রবল চাপে আকাঙ্ক্ষা উত্তাপে
একার বাসনা বীণা পিষে ফেলে
জলের স্বভাবে গলে কলকল ধেয়ে আস নিচে

এবং

খ্যাতিলোভী কবিযশোপ্রার্থীদের

সুবিন্যস্ত আলোময় এহেন নক্ষত্ররাজি দিয়ে আকাশের
নিজের কী লাভ হলো কবে

বাতাসের স্বয়ম্বর নাতনিরা সবে অকৃপণ
আঁচলে পুঁটুলি করে অম্লজান বয়ে এনে
বিনিময়ে কোনোকিছু না চেয়েই
আযৌবন বিলিয়ে গেল বখাটে যুবাদের

ধড়মড় পাড় ভেঙে নদীরই বক্ষ বাড়ে
জলের তা কোনকালে কোন কাজে লাগে

আর শুধু ভাষা শিখে মোচড় আঁকতে শিখে
অনুভূতি গেলে ঢেলে ছাঁচে ফেলে কথা লিখে বিনিময় চাও
যাও তবে যাও
ক্ষণজীবী খ্যাতি পেলে সস্তায়-- আজলায় তুলে নিয়ে
চেটেপুটে খাও

পাশাপাশি এসব ভাবতে হয়, কারণ খ্যাতির কাঙ্ক্ষায় প্রতি মুহূর্তে আকুপাকু করে যেসব কবিযশোপ্রার্থী; সামাজিকতা রক্ষায় তারা বিনয়ের কবিতাকে যতই সেরা বলুক, মর্ম দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে না, পারা সম্ভব নয়। শিল্পের জন্যে ন্যূনতম স্যাক্রিফাইস যে এক জীবনে করতে পারে নি, মানুষ কেন নিকটে কুকুর গেলেও তার কিছুই উড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে না, প্রকৃত সারস তো দূর অস্ত। এই প্রকৃত সারস নিজের ভিতরে ধারণ করতে হলেই একজনকে নানারকম হাতছানি উপেক্ষা করে একাকী এসে দাঁড়াতে হয় সংঘের বিপরীতে। কারণ সংঘ সর্বদা স্বার্থের নিমিত্তে গঠিত হয়, সংঘ সর্বদা সংঘের দিকেই হাঁটাচলা করে, সংঘ নৈঃসঙ্গের পক্ষে কোনো যুক্তি বিস্তার করতে দেয় না। সে সম্ভাবনাটুকুই নস্যাৎ করে দেয় বরং। বিনয় মজুমদার যে অগ্নিমেধা নিয়ে নির্মোহ একাকিত্বকে কেবল কবিতার জন্যে বরণ করে নিয়েছেন, সে মেধা নিয়ে বিষয়ভাবনায় মত্ত হলে বিনয় কর্তৃক উপেক্ষিত সংঘের অনেকেই তার কর্তৃক আহরিতব্য সম্ভাব্য বিষয়ৌজ্জ্বল্যের কাছে মলিনতম হয়ে যেতেন। সংঘহীনতা সত্যের যতটা নিকটে পৌঁছবার সাহস যোগায়, আর কিছু ততটা নয়। যেকোনো হীনতা, তা যদি অন্য কোনো তুমূল ও যথার্থ প্রাপ্তিকে ধরে আনবার জন্য প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে, তবে কেন একজন বিনয় মজুমদার হৈচৈয়ের থেকে লক্ষ যোজন দূরে ‘বিনোদিনী কুঠি’র নিবিড় প্রকোষ্ঠে সেধিয়ে যাবেন না? সেটা যুগপৎ বিনয় এবং বাংলা কবিতার পাঠকের জন্যে ইতিবাচক হয়েছে। তিনি নিজে খ্যাতির কাঙ্ক্ষায় মরিয়া হয়ে যান নি বলে খ্যাতিই এখন তাকে শীতের ওম জোগাচ্ছে চারপাশ থেকে।

শুধু কবিতার জন্যে এই বেঁচে থাকা-- এইভাবে ভাবতে পারা গেলে আপনা-আপনি একটি ধ্যানযোগ ঘটে যায় কবিচিত্তে। এই ধ্যানযোগই কবির বক্তব্যকে পৌঁছে দেয় অভাবিত দার্শনিক উচ্চতায়। কবির আত্মোপলব্ধিই তখন সর্বকালীনতা ও সর্বজনীনতা প্রাপ্ত হয়ে যায়। অমর কবিতার অভীষ্ট বোধকরি সেটাই। এরকম ধ্যানযোগই ঘটেছে বিনয় মজুমদারের ফিরে এসো, চাকা এবং অঘ্রানের অনুভূতিমালার ছত্রান্তরে। এখানে তাঁর পর্যবেক্ষণসমূহ জীবনের এমনি সব বাঁক-কোণ ছেয়ে গেছে যে, ওসব টেক্সট উপলব্ধিযোগ্য সত্যের একেকটি নন্দনভাণ্ডারে রূপ পরিগ্রহ করেছে।

২.
বিনয় মজুমদার কর্তৃক আহরিত সত্যরাশি তুলনারহিত। এই অনুসন্ধেয় সত্যরাশি বলার ভঙ্গির অসাধারণত্বে হয়ে উঠেছে জ্ঞানালোক জারিত একেকটা কাব্য-ধর্মাধ্যায়-- যুগপৎ ব্যক্তির এবং বস্তুর। হতে পারত যে, আহৃত সত্যমালাকে গৌণ করে দিয়ে মেদে মেদে শরীর নির্মাণ করেছেন তিনি কবিতার-- অন্য অনেক কবিপ্রবীণের মতো। কিন্তু যখন হুবহু মুখস্থযোগ্য বাক্য রচনা করতে চাবেন একজন কেউ, তখন পঙক্তিসমূহ এমন হওয়া চাই, যা একজন পাঠক সহজেই তার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন, ব্যক্তির প্রেমানুভূতি যার থৈ সহজেই স্পর্শ করতে পারে। এখানে বিনয় মজুমদার কর্তৃক নির্ধারিত কবিতার সংজ্ঞাটি সামনে আনা যেতে পারে। তাঁর মতে, কবিতা হচ্ছে চিরস্মরণীয় সেই বাক্যসমষ্টি, যা হুবহু মুখস্থ করা যায়; এবং এ-ও তিনি জানিয়ে রাখেন যে, এ সংজ্ঞাটি অমর কবিতার। সেক্ষেত্রে কবিতায় প্রাবাদিক পঙক্তি রচনাও দোষান্যায়ের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে সক্ষম হয়। এখানে বিনয় মজুমদারের ফিরে এসো, চাকার কতিপয় পঙক্তি উৎকলন করা যেতে পারে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক চাইলে এসব আরেকবার পড়ে নিতে পারেন--

...সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা

সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কতো বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ

সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে

মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়

আলোকসম্পাতহেতু বিদ্যুৎ সঞ্চার হয়

সফল জ্যোৎস্না চিরকাল মানুষের প্রেরণাস্বরূপ

জীবনধারণ করা সমীরবিলাসী হওয়া নয়

ঘন অরণ্যের মধ্যে সূর্যের আলোর তীব্র অনটন বুঝে
তরুণ সেগুন গাছ ঋজু আর শাখাহীন, অতি দীর্ঘ হয়;

বৃক্ষ ও প্রাণীরা মিলে বায়ুমণ্ডলকে সুস্থ, স্বাস্থ্যকর রাখে

সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে

বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থুল বলে মনে হয়

                     উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়

বিনিদ্র রাত্রির পরে মাথায় জড়তা আসে, চোখ জ্বলে যায়।

সকল সমুদ্র আর উদ্ভিদজগৎ আর মরুভূমি দিয়ে
প্রবাহিত হওয়া ভিন্ন বাতাসের অন্য কোনো গতিবিধি নেই

প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাগুলি ক্রমে জ্ঞান হয়ে ওঠে

শয়নভঙ্গির মতো আড়ষ্ট স্বকীয় বিকাশ
সকল মানুষ চায়--

বিদেশী চিত্রের মতো আগত, অপরিচিত হলে
কিংবা নক্ষত্রের মতো অতি পরিচিত হলে তবে
আলাপে আগ্রহ আসে;

...গাঙচিলগুলি জাহাজের সঙ্গে-সঙ্গে চলে,
অথবা ফড়িং সেও নৌকার উপরে ভেসে থাকে
ডানা না-নেড়েই এত স্বাভাবিক, সহজ, স্বাধীন

সর্বদা কোনো না কোনো স্থানে, ঝড় হতে থাকে

ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
পুনরায় কেশোদ্গম হবে না;

সূর্যপরিক্রমারত জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে শুধু
ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী;

                                              বাতাসের
নীলাভতা-হেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়

কিছুটা সময় দিলে তবে দুধে সর ভেসে ওঠে

ক্বচিৎ কখনো কোনো ফোঁড়া নিষিদ্ধ হলেও
যে-কারণে তার কাছে অগোচরে হাত চলে যায়

সন্তপ্ত কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝ’রে যায়।

                             প্রাকৃতিক সকল কিছুই
টীকা ও টিপ্পনী মাত্র, পরিচিত গভীর গ্রন্থের

চিৎকার আহ্বান নয়, গান গেয়ে ঘুম ভাঙালেও
অনেকে বিরক্ত হয়;

মুগ্ধ মিলনের কালে সজোরে আঘাতে সম্ভাবিত
ব্যথা থেকে মাংসরাশি, নিতম্বই রক্ষা করে থাকে।

বিনয় মজুমদার কর্তৃক আবিষ্কৃত এইসব প্রাবাদিক সত্যগুচ্ছকে মোটাদাগে চারভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে-- এর বাইরেও আরো অজস্র সূক্ষ্ম বিভাজন সম্ভব তো বটেই। আপাতত এই চারটি গবাক্ষপথে তাকালেও আলোর রঙ বৈচিত্র্যটা অনেকটাই উপলব্ধিতে আসে বলে মনে হয়।

১.    জৈবনিক
২.    প্রাকৃতিক
৩.    জ্যোতির্লৌকিক
৪.    বৈজ্ঞানিক

বলা বাহুল্য যে, তাঁর কর্তৃক আবিষ্কৃত এসব সত্যের চিরন্তনতা সর্বক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও পদ্ধতিগতভাবে লব্ধ জ্ঞান বলে বিজ্ঞান ক্রমপরিবর্তনের পথে সদাই ধাবিত। ফলে জনৈক পর্যবেক্ষকের কাছে আজ যা অসম্ভব বা মিথ্যা-- কাল তাই-ই সম্ভব ও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেতে পারে। বিনয় মজুমদার তাঁর গায়ত্রীকের একটি  কবিতায় জানিয়েছিলেন যে, ‘...আজো মানুষেরা প্রসবের আগে শিশু পুরুষ কি মেয়ে,/ মৃত কি জীবিত হবে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখে না।’ এটি একটি বৈজ্ঞানিক মিথ্যা হিসেবে আজ পরিগণিত। কারণ বিজ্ঞান আজ এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। আবার অঘ্রানের অনুভূতিমালায় বিনয় মজুমদার কিছু জ্যোতির্লৌকিক তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে বিনয় নিজের জবানীতেই তার অসারতার কথা বলেছেন। ওখানে সপ্তর্ষী নক্ষত্রমণ্ডলি অঘ্রান মাসে ওঠে বলা হয়েছে। আসলে ওঠে গ্রীষ্মকালে। এ গ্রন্থেই উল্লিখিত একটি প্রাকৃতিক সত্য-- ‘সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে/ ফোটে শীতাতুর রাতে’-- অথচ বকুল ফুল কখনোই শীতকালে ফোটে না, ফোটে বসন্তকালে। আবার প্রচুর পরিমাণে জৈবনিক ও প্রাকৃতিক যেসব সত্য বিনয় মজুমদার তাঁর রসোত্তীর্ণ প্রবাদপ্রতিম বাক্যে ধারণ করেছেন, তার চিরন্তনতা প্রশ্নাতীত বলে মনে হয়। আসলে সেসবও প্রশ্নাতীত নয়। যেমন, ‘ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে/ পুনরায় কেশোদ্গম হবে না’। প্রকৃতপক্ষে ক্ষতস্থানে প্রচুর পরিমাণে কেশ না-গজালেও ক্ষতের প্রান্ত ঘেষে একটি দুটি দীর্ঘ লোম গজায়। অনেকের দেহই তার প্রমাণ বহন করছে। কিন্তু ‘ঘন অরণ্যের মাঝে সূর্যের আলোর তীব্র অনটন বুঝে/ তরুণ সেগুন গাছ ঋজু আর শাখাহীন অতি ধীর্ঘ হয়’-- আজিও চিরন্তন।

বলে রাখা ভালো যে, কেবল চিরন্তনতার অনুসন্ধানই কবিতার অভীষ্ট হবে এরকম কোনো কথা নেই। সময়ের ব্যাবধানে গায়ত্রীকে থেকে উল্লিখিত কবিতার বৈজ্ঞানিক সত্য আজ মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে-- তাতে কবিতার তেমন যায় আসে নি কিছুই। কবিতার সৌন্দর্যের জায়গায় তা কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়েছে, এমন নয়। কিন্তু যে কবিতার ধরনটিই এমন যে পাঠোত্তরে মনেই হয় তা আমাকে কিছু সত্যের অন্তত রজ্জুটা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে-- সে কবিতার কবির এ ব্যাপারে সতর্ক থাকাই সমীচীন বলে আমার মনে হয়। নইলে পাঠককে অকারণে বিভ্রান্ত করা হয়ে যেতে পারে।

বিনয় মজুমদার জানাচ্ছেন, পাঠক যে কবিতা পড়ে, বারবার যে কবিতার কাছে ফিরে যায়, পড়ে পড়ে মুখস্থ করে ফেলে-- এর পেছনে ভূমিকা রাখে আনন্দ লাভাকাঙ্ক্ষা। কবিতায় রচিত বাক্য পাঠকের কাছে আনন্দপ্রদ হয় বলেই পাঠক বারেবারে কবিতামুখী হয়।

এরূপ বিরহ ভালো; কবিতার প্রথম পাঠের
পরবর্তী কাল যদি নিদ্রিতের মতো থাকা যায়
স্বপ্নাচ্ছন্ন, কাল্পনিক; দীর্ঘকাল পরে পুনরায়
পাঠের সময় যদি শাশ্বত ফুলের মতো স্মিত
রূপ, ঘ্রাণ ঝ’রে পড়ে তাহলে সার্থক সব ব্যথা

এই যে নিদ্রিতের মতো আচ্ছন্ন, বুঁদ হয়ে থাকা তা আনন্দের কারণেই। ‘কবিতা ও আনন্দ’ নামক প্রবন্ধে বিনয় মজুমদার কবিতা থেকে পাঠক কর্তৃক আনন্দ পাবার ১৪টি উপায় শনাক্ত করেছেন। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই চতুর্দশ উপায় বিনয় মজুমদারের নিজের কবিতাকেই ব্যাখ্যা করছে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো বিনয়ের কবিতারই বৈশিষ্ট্য। আবার একইসঙ্গে এগুলো অমর কবিতারও বৈশিষ্ট্য।

বিনয় মজুমদারের মতে, অমর কবিতায় নিম্নোক্ত গুণগুলো থাকা দরকার-- মধুর ঘটনা, অন্যের জীবন কাহিনি জানবার উপকরণ, সত্য, জ্ঞানোপকরণ, দর্শন, জুগুপ্সা, ব্যঞ্জনা, ধাঁধার সমাধান, আবিষ্কার, প্রয়োজনীয়তা, সহজে মনে রাখার মতো বিন্যাস, সারাজীবন ধরে গবেষণার সুযোগ, নীতিকথা এবং রহস্য।

এর সবকটি কিংবা কোনো একটি কিংবা কোনো-কোনোটি একটি কবিতায় উপস্থিত থাকলে সে কবিতা পাঠকের জন্য আনন্দ বিধান করতে সক্ষম এবং সেটি অমর কবিতার দিকে অল্পবিস্তর অগ্রসরমাণ। কবিতায় এই অমরত্বের সন্ধান দেবার জন্যই বিনয় মজুমদার এর ছত্রে ছত্রে উল্লিখিত আনন্দোপকরণসমূহের সুষম বিন্যাস ঘটিয়েছেন। সুতরাং বিনয় মজুমদার ফিরে এসো, চাকা কিংবা অঘ্রানের অনুভূতিমালায় যা দিয়েছেন, পরবর্তী কয়েক পুরুষ ধরে আমরা তাতে আনন্দোপকরণ খুঁজে পাবার জন্যে বারেবারে অবগাহনের আয়োজন করব ও প্রকৃতই অবগাহনের খেলায় মেতে উঠব, প্রায়শই ডুব দিয়ে উঠিয়ে আনব নবতর আরো আরো প্রকৃত মাণিক্যের সন্ধান। আমরা তাঁর কবিতার কাছে ফিরে যাব রথ হয়ে, চাকা হয়ে-- যদিও কেউই আমরা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নই। সে কেবল একজনই ছিলেন, আছেন; কিন্তু বিনয়ের কবিতার কাছে তিনিও কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তে ফিরে ফিরে যান কি না, তা আমরা জানি না।

রচনাকাল : ২০০০

অনিকেত শামীম সম্পাদিত লোক-এর বিনয় মজুমদার সংখ্যায় ফেব্রুয়ারি ২০০১-এ প্রকাশিত।

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...