Sunday, November 15, 2009

আনাড়ীর কবিদর্শন

এক দু’পৃষ্ঠার একটি গদ্য লিখে একজন কবির প্রতিবিম্ব ফুটিয়ে তোলা যেন সম্ভব কোনো কাজ, তাও যেই সেই কোনো কবি নন, স্বয়ং বিনয় মজুমদারকে : বাংলা কবিতাঙ্গনে কবিতার শহীদ বলে খ্যাত জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে যিনি অদ্যাবধি শিমুলপুর আলোকিত করে আছেন-- কবিতার পাঠককে আরো কিছু বিস্ময় উপহার দেবার জন্যে। কিন্তু তবু আমরা কলম ধরি। ধরি, হাতেকলমে এটি প্রমাণ করবার জন্যে যে গোটা কয়েক পৃষ্ঠায় একজন লেখকের কোনো চিন্তার, চরিত্রের, প্রকৃতির প্রান্তটিকে স্পর্শ করা যায় মাত্র। দশজন মিলে দশদিক থেকে প্রান্ত স্পর্শ করলে সম্পূর্ণ কবির অনেকখানিই নিকটে পৌঁছা হয়ে যায়, যেতে পারে। এরকম স্পর্শে স্পর্শে কবির স্বর্ণাবয়বটি ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। আর কবির স্পষ্ট হওয়া মোটেই কবির জন্যে নয়, দরকার পাঠকের এবং প্রকারান্তরে আগামী কবিতার জন্যেই। আমরা যখন একজন কবির বিষয়ে কিছু লিখতে উপগত হই, তখন অতসব ভেবে না-নিলেও সাধিত কর্মটি অগোচরে এ ফলাফলটুকুই সম্ভব করে তোলে মাত্র। তবু কাজটি করতেই হয়, ফুল নামধেয় কাঁটার উৎপাত অরণ্যানীতে এত বেড়ে গেছে যে, আদপে যারা ফুল তাদেরকে নানাদিক থেকে দেখে চিনে ফেলা প্রয়োজন-- তাতে ক’টিমাত্র দল, পাপড়ি দৃশ্য নাকি অদৃশ্য, বর্ণিল নাকি বর্ণহীনতাই তার সৌন্দর্য-স্মারক, গন্ধ আছে কি না, থাকলে তার জাতকুল শনাক্তযোগ্য কি না ইত্যাদি। নইলে কাঁটারাও ফুলের পোশাকে সজ্জিত হয়ে ফ্যাশন শোর মতো পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ভ্যাংচাতে থাকবে-- আর প্রকারান্তরে ভুল অভিলক্ষে অভিমুখীনতাকে চিহ্নিত করে বিভ্রান্ত দর্শক কাম উপভোগকর্তা, রক্তপাতের কারণকে রক্তমূল্যে সংগ্রহ করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এজন্যে আমার আপনার ভাবিত হবার কী আছে, যেখানে উপভোগকর্তা নিজেই নিজের জন্যে বিপদ কিনে আনছে? এর জবাব এরকম যে, ভাবিত হবার মূল্যমানের কারণ আছে। কেননা নিষ্ঠ কবিতাকর্মীরা, যারা নিজেরা ফুলোপম গন্ধ বিলাবার জন্যে অনেক কামনাবিলাসিতাকে উপেক্ষার চাবুক কষে সদা প্রস্ফূটিত হয়ে চলেছেন অরণ্যানীছায়ে, প্রকৃত ফুলচিহ্নিতকরণের সূত্রাদি সন্ধানে ব্যর্থ হলে পরবর্তী গন্ধলোভীরাও এদের শনাক্ত করতে পারবে না। তাতে আগাগোড়া ঘাটতিরই সমূহতা বাঙ্ময় হয়ে উঠবে। যে পথে ধাবন কেবলই ঘাটতির নিশ্চয়তা বিধান করছে, সে পথ বাঁয়ে রেখে হাঁটাই কাজের কথা-- কেনই বা অযথা দাঁড়াবে একজন গিয়ে বিষবৃক্ষতলে? তাই--

বিনয় মজুমদারকে

অবশেষে রাত্রিও পেছনে হটে ঘুম যায় চূড়ায় আভাসে
স্ত্রীপুত্রসমেত-- একা শুধু ঢালে শুয়ে পাতাদের
পতন যন্ত্রণাগুলি ছুঁয়ে ছেনে দেখ আর ঘাসের সুগন্ধে
ধোও মুখ-- দূরে পড়ে আছে যারা স্বজন সুহৃদ
পাহাড়ের পদ-সন্নিকটে-- ‘পথ নেই খুঁজে বার কর’ বলে
দলেবলে মেতে আছে নিবিড় বিপ্লবে
তাদের সকাশে দ্রুত জটিল এক সবুজ বার্তাবাণী
পৌঁছে দাও বাতাসে ঝাঁকিয়ে মাথা বিশাল বৃক্ষের...
ফলে দূর বিন্দুসাথে যে পথ রচিত হয় ট্রান্সন্যাচারাল
সে পথ কুসুমরঙা তুমুল প্রবাহে ভাসে
গণের প্রবল চাপে আকাঙ্ক্ষা উত্তাপে
একার বাসনা বীণা পিষে ফেলে
জলের স্বভাবে গলে কলকল ধেয়ে আস নিচে

এবং

খ্যাতিলোভী কবিযশোপ্রার্থীদের

সুবিন্যস্ত আলোময় এহেন নক্ষত্ররাজি দিয়ে আকাশের
নিজের কী লাভ হলো কবে

বাতাসের স্বয়ম্বর নাতনিরা সবে অকৃপণ
আঁচলে পুঁটুলি করে অম্লজান বয়ে এনে
বিনিময়ে কোনোকিছু না চেয়েই
আযৌবন বিলিয়ে গেল বখাটে যুবাদের

ধড়মড় পাড় ভেঙে নদীরই বক্ষ বাড়ে
জলের তা কোনকালে কোন কাজে লাগে

আর শুধু ভাষা শিখে মোচড় আঁকতে শিখে
অনুভূতি গেলে ঢেলে ছাঁচে ফেলে কথা লিখে বিনিময় চাও
যাও তবে যাও
ক্ষণজীবী খ্যাতি পেলে সস্তায়-- আজলায় তুলে নিয়ে
চেটেপুটে খাও

পাশাপাশি এসব ভাবতে হয়, কারণ খ্যাতির কাঙ্ক্ষায় প্রতি মুহূর্তে আকুপাকু করে যেসব কবিযশোপ্রার্থী; সামাজিকতা রক্ষায় তারা বিনয়ের কবিতাকে যতই সেরা বলুক, মর্ম দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে না, পারা সম্ভব নয়। শিল্পের জন্যে ন্যূনতম স্যাক্রিফাইস যে এক জীবনে করতে পারে নি, মানুষ কেন নিকটে কুকুর গেলেও তার কিছুই উড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে না, প্রকৃত সারস তো দূর অস্ত। এই প্রকৃত সারস নিজের ভিতরে ধারণ করতে হলেই একজনকে নানারকম হাতছানি উপেক্ষা করে একাকী এসে দাঁড়াতে হয় সংঘের বিপরীতে। কারণ সংঘ সর্বদা স্বার্থের নিমিত্তে গঠিত হয়, সংঘ সর্বদা সংঘের দিকেই হাঁটাচলা করে, সংঘ নৈঃসঙ্গের পক্ষে কোনো যুক্তি বিস্তার করতে দেয় না। সে সম্ভাবনাটুকুই নস্যাৎ করে দেয় বরং। বিনয় মজুমদার যে অগ্নিমেধা নিয়ে নির্মোহ একাকিত্বকে কেবল কবিতার জন্যে বরণ করে নিয়েছেন, সে মেধা নিয়ে বিষয়ভাবনায় মত্ত হলে বিনয় কর্তৃক উপেক্ষিত সংঘের অনেকেই তার কর্তৃক আহরিতব্য সম্ভাব্য বিষয়ৌজ্জ্বল্যের কাছে মলিনতম হয়ে যেতেন। সংঘহীনতা সত্যের যতটা নিকটে পৌঁছবার সাহস যোগায়, আর কিছু ততটা নয়। যেকোনো হীনতা, তা যদি অন্য কোনো তুমূল ও যথার্থ প্রাপ্তিকে ধরে আনবার জন্য প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে, তবে কেন একজন বিনয় মজুমদার হৈচৈয়ের থেকে লক্ষ যোজন দূরে ‘বিনোদিনী কুঠি’র নিবিড় প্রকোষ্ঠে সেধিয়ে যাবেন না? সেটা যুগপৎ বিনয় এবং বাংলা কবিতার পাঠকের জন্যে ইতিবাচক হয়েছে। তিনি নিজে খ্যাতির কাঙ্ক্ষায় মরিয়া হয়ে যান নি বলে খ্যাতিই এখন তাকে শীতের ওম জোগাচ্ছে চারপাশ থেকে।

শুধু কবিতার জন্যে এই বেঁচে থাকা-- এইভাবে ভাবতে পারা গেলে আপনা-আপনি একটি ধ্যানযোগ ঘটে যায় কবিচিত্তে। এই ধ্যানযোগই কবির বক্তব্যকে পৌঁছে দেয় অভাবিত দার্শনিক উচ্চতায়। কবির আত্মোপলব্ধিই তখন সর্বকালীনতা ও সর্বজনীনতা প্রাপ্ত হয়ে যায়। অমর কবিতার অভীষ্ট বোধকরি সেটাই। এরকম ধ্যানযোগই ঘটেছে বিনয় মজুমদারের ফিরে এসো, চাকা এবং অঘ্রানের অনুভূতিমালার ছত্রান্তরে। এখানে তাঁর পর্যবেক্ষণসমূহ জীবনের এমনি সব বাঁক-কোণ ছেয়ে গেছে যে, ওসব টেক্সট উপলব্ধিযোগ্য সত্যের একেকটি নন্দনভাণ্ডারে রূপ পরিগ্রহ করেছে।

২.
বিনয় মজুমদার কর্তৃক আহরিত সত্যরাশি তুলনারহিত। এই অনুসন্ধেয় সত্যরাশি বলার ভঙ্গির অসাধারণত্বে হয়ে উঠেছে জ্ঞানালোক জারিত একেকটা কাব্য-ধর্মাধ্যায়-- যুগপৎ ব্যক্তির এবং বস্তুর। হতে পারত যে, আহৃত সত্যমালাকে গৌণ করে দিয়ে মেদে মেদে শরীর নির্মাণ করেছেন তিনি কবিতার-- অন্য অনেক কবিপ্রবীণের মতো। কিন্তু যখন হুবহু মুখস্থযোগ্য বাক্য রচনা করতে চাবেন একজন কেউ, তখন পঙক্তিসমূহ এমন হওয়া চাই, যা একজন পাঠক সহজেই তার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন, ব্যক্তির প্রেমানুভূতি যার থৈ সহজেই স্পর্শ করতে পারে। এখানে বিনয় মজুমদার কর্তৃক নির্ধারিত কবিতার সংজ্ঞাটি সামনে আনা যেতে পারে। তাঁর মতে, কবিতা হচ্ছে চিরস্মরণীয় সেই বাক্যসমষ্টি, যা হুবহু মুখস্থ করা যায়; এবং এ-ও তিনি জানিয়ে রাখেন যে, এ সংজ্ঞাটি অমর কবিতার। সেক্ষেত্রে কবিতায় প্রাবাদিক পঙক্তি রচনাও দোষান্যায়ের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে সক্ষম হয়। এখানে বিনয় মজুমদারের ফিরে এসো, চাকার কতিপয় পঙক্তি উৎকলন করা যেতে পারে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক চাইলে এসব আরেকবার পড়ে নিতে পারেন--

...সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা

সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কতো বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ

সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে

মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়

আলোকসম্পাতহেতু বিদ্যুৎ সঞ্চার হয়

সফল জ্যোৎস্না চিরকাল মানুষের প্রেরণাস্বরূপ

জীবনধারণ করা সমীরবিলাসী হওয়া নয়

ঘন অরণ্যের মধ্যে সূর্যের আলোর তীব্র অনটন বুঝে
তরুণ সেগুন গাছ ঋজু আর শাখাহীন, অতি দীর্ঘ হয়;

বৃক্ষ ও প্রাণীরা মিলে বায়ুমণ্ডলকে সুস্থ, স্বাস্থ্যকর রাখে

সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে

বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থুল বলে মনে হয়

                     উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়

বিনিদ্র রাত্রির পরে মাথায় জড়তা আসে, চোখ জ্বলে যায়।

সকল সমুদ্র আর উদ্ভিদজগৎ আর মরুভূমি দিয়ে
প্রবাহিত হওয়া ভিন্ন বাতাসের অন্য কোনো গতিবিধি নেই

প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাগুলি ক্রমে জ্ঞান হয়ে ওঠে

শয়নভঙ্গির মতো আড়ষ্ট স্বকীয় বিকাশ
সকল মানুষ চায়--

বিদেশী চিত্রের মতো আগত, অপরিচিত হলে
কিংবা নক্ষত্রের মতো অতি পরিচিত হলে তবে
আলাপে আগ্রহ আসে;

...গাঙচিলগুলি জাহাজের সঙ্গে-সঙ্গে চলে,
অথবা ফড়িং সেও নৌকার উপরে ভেসে থাকে
ডানা না-নেড়েই এত স্বাভাবিক, সহজ, স্বাধীন

সর্বদা কোনো না কোনো স্থানে, ঝড় হতে থাকে

ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
পুনরায় কেশোদ্গম হবে না;

সূর্যপরিক্রমারত জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে শুধু
ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী;

                                              বাতাসের
নীলাভতা-হেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়

কিছুটা সময় দিলে তবে দুধে সর ভেসে ওঠে

ক্বচিৎ কখনো কোনো ফোঁড়া নিষিদ্ধ হলেও
যে-কারণে তার কাছে অগোচরে হাত চলে যায়

সন্তপ্ত কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝ’রে যায়।

                             প্রাকৃতিক সকল কিছুই
টীকা ও টিপ্পনী মাত্র, পরিচিত গভীর গ্রন্থের

চিৎকার আহ্বান নয়, গান গেয়ে ঘুম ভাঙালেও
অনেকে বিরক্ত হয়;

মুগ্ধ মিলনের কালে সজোরে আঘাতে সম্ভাবিত
ব্যথা থেকে মাংসরাশি, নিতম্বই রক্ষা করে থাকে।

বিনয় মজুমদার কর্তৃক আবিষ্কৃত এইসব প্রাবাদিক সত্যগুচ্ছকে মোটাদাগে চারভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে-- এর বাইরেও আরো অজস্র সূক্ষ্ম বিভাজন সম্ভব তো বটেই। আপাতত এই চারটি গবাক্ষপথে তাকালেও আলোর রঙ বৈচিত্র্যটা অনেকটাই উপলব্ধিতে আসে বলে মনে হয়।

১.    জৈবনিক
২.    প্রাকৃতিক
৩.    জ্যোতির্লৌকিক
৪.    বৈজ্ঞানিক

বলা বাহুল্য যে, তাঁর কর্তৃক আবিষ্কৃত এসব সত্যের চিরন্তনতা সর্বক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও পদ্ধতিগতভাবে লব্ধ জ্ঞান বলে বিজ্ঞান ক্রমপরিবর্তনের পথে সদাই ধাবিত। ফলে জনৈক পর্যবেক্ষকের কাছে আজ যা অসম্ভব বা মিথ্যা-- কাল তাই-ই সম্ভব ও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেতে পারে। বিনয় মজুমদার তাঁর গায়ত্রীকের একটি  কবিতায় জানিয়েছিলেন যে, ‘...আজো মানুষেরা প্রসবের আগে শিশু পুরুষ কি মেয়ে,/ মৃত কি জীবিত হবে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখে না।’ এটি একটি বৈজ্ঞানিক মিথ্যা হিসেবে আজ পরিগণিত। কারণ বিজ্ঞান আজ এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। আবার অঘ্রানের অনুভূতিমালায় বিনয় মজুমদার কিছু জ্যোতির্লৌকিক তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে বিনয় নিজের জবানীতেই তার অসারতার কথা বলেছেন। ওখানে সপ্তর্ষী নক্ষত্রমণ্ডলি অঘ্রান মাসে ওঠে বলা হয়েছে। আসলে ওঠে গ্রীষ্মকালে। এ গ্রন্থেই উল্লিখিত একটি প্রাকৃতিক সত্য-- ‘সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে/ ফোটে শীতাতুর রাতে’-- অথচ বকুল ফুল কখনোই শীতকালে ফোটে না, ফোটে বসন্তকালে। আবার প্রচুর পরিমাণে জৈবনিক ও প্রাকৃতিক যেসব সত্য বিনয় মজুমদার তাঁর রসোত্তীর্ণ প্রবাদপ্রতিম বাক্যে ধারণ করেছেন, তার চিরন্তনতা প্রশ্নাতীত বলে মনে হয়। আসলে সেসবও প্রশ্নাতীত নয়। যেমন, ‘ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে/ পুনরায় কেশোদ্গম হবে না’। প্রকৃতপক্ষে ক্ষতস্থানে প্রচুর পরিমাণে কেশ না-গজালেও ক্ষতের প্রান্ত ঘেষে একটি দুটি দীর্ঘ লোম গজায়। অনেকের দেহই তার প্রমাণ বহন করছে। কিন্তু ‘ঘন অরণ্যের মাঝে সূর্যের আলোর তীব্র অনটন বুঝে/ তরুণ সেগুন গাছ ঋজু আর শাখাহীন অতি ধীর্ঘ হয়’-- আজিও চিরন্তন।

বলে রাখা ভালো যে, কেবল চিরন্তনতার অনুসন্ধানই কবিতার অভীষ্ট হবে এরকম কোনো কথা নেই। সময়ের ব্যাবধানে গায়ত্রীকে থেকে উল্লিখিত কবিতার বৈজ্ঞানিক সত্য আজ মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে-- তাতে কবিতার তেমন যায় আসে নি কিছুই। কবিতার সৌন্দর্যের জায়গায় তা কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়েছে, এমন নয়। কিন্তু যে কবিতার ধরনটিই এমন যে পাঠোত্তরে মনেই হয় তা আমাকে কিছু সত্যের অন্তত রজ্জুটা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে-- সে কবিতার কবির এ ব্যাপারে সতর্ক থাকাই সমীচীন বলে আমার মনে হয়। নইলে পাঠককে অকারণে বিভ্রান্ত করা হয়ে যেতে পারে।

বিনয় মজুমদার জানাচ্ছেন, পাঠক যে কবিতা পড়ে, বারবার যে কবিতার কাছে ফিরে যায়, পড়ে পড়ে মুখস্থ করে ফেলে-- এর পেছনে ভূমিকা রাখে আনন্দ লাভাকাঙ্ক্ষা। কবিতায় রচিত বাক্য পাঠকের কাছে আনন্দপ্রদ হয় বলেই পাঠক বারেবারে কবিতামুখী হয়।

এরূপ বিরহ ভালো; কবিতার প্রথম পাঠের
পরবর্তী কাল যদি নিদ্রিতের মতো থাকা যায়
স্বপ্নাচ্ছন্ন, কাল্পনিক; দীর্ঘকাল পরে পুনরায়
পাঠের সময় যদি শাশ্বত ফুলের মতো স্মিত
রূপ, ঘ্রাণ ঝ’রে পড়ে তাহলে সার্থক সব ব্যথা

এই যে নিদ্রিতের মতো আচ্ছন্ন, বুঁদ হয়ে থাকা তা আনন্দের কারণেই। ‘কবিতা ও আনন্দ’ নামক প্রবন্ধে বিনয় মজুমদার কবিতা থেকে পাঠক কর্তৃক আনন্দ পাবার ১৪টি উপায় শনাক্ত করেছেন। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই চতুর্দশ উপায় বিনয় মজুমদারের নিজের কবিতাকেই ব্যাখ্যা করছে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো বিনয়ের কবিতারই বৈশিষ্ট্য। আবার একইসঙ্গে এগুলো অমর কবিতারও বৈশিষ্ট্য।

বিনয় মজুমদারের মতে, অমর কবিতায় নিম্নোক্ত গুণগুলো থাকা দরকার-- মধুর ঘটনা, অন্যের জীবন কাহিনি জানবার উপকরণ, সত্য, জ্ঞানোপকরণ, দর্শন, জুগুপ্সা, ব্যঞ্জনা, ধাঁধার সমাধান, আবিষ্কার, প্রয়োজনীয়তা, সহজে মনে রাখার মতো বিন্যাস, সারাজীবন ধরে গবেষণার সুযোগ, নীতিকথা এবং রহস্য।

এর সবকটি কিংবা কোনো একটি কিংবা কোনো-কোনোটি একটি কবিতায় উপস্থিত থাকলে সে কবিতা পাঠকের জন্য আনন্দ বিধান করতে সক্ষম এবং সেটি অমর কবিতার দিকে অল্পবিস্তর অগ্রসরমাণ। কবিতায় এই অমরত্বের সন্ধান দেবার জন্যই বিনয় মজুমদার এর ছত্রে ছত্রে উল্লিখিত আনন্দোপকরণসমূহের সুষম বিন্যাস ঘটিয়েছেন। সুতরাং বিনয় মজুমদার ফিরে এসো, চাকা কিংবা অঘ্রানের অনুভূতিমালায় যা দিয়েছেন, পরবর্তী কয়েক পুরুষ ধরে আমরা তাতে আনন্দোপকরণ খুঁজে পাবার জন্যে বারেবারে অবগাহনের আয়োজন করব ও প্রকৃতই অবগাহনের খেলায় মেতে উঠব, প্রায়শই ডুব দিয়ে উঠিয়ে আনব নবতর আরো আরো প্রকৃত মাণিক্যের সন্ধান। আমরা তাঁর কবিতার কাছে ফিরে যাব রথ হয়ে, চাকা হয়ে-- যদিও কেউই আমরা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নই। সে কেবল একজনই ছিলেন, আছেন; কিন্তু বিনয়ের কবিতার কাছে তিনিও কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তে ফিরে ফিরে যান কি না, তা আমরা জানি না।

রচনাকাল : ২০০০

অনিকেত শামীম সম্পাদিত লোক-এর বিনয় মজুমদার সংখ্যায় ফেব্রুয়ারি ২০০১-এ প্রকাশিত।

Saturday, November 14, 2009

কবিতার গান হয়ে ওঠা

খ. সুরের জগৎ কথার থেকে পৃথক।
গ. তবু এমন কথা আছে যাকে সাজালে সুরের রাজ্যে সহজে যাওয়া যায়।

কথা ও সুর : ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

আধুনিক বাংলা গান বিষয়ে আমি এখানে কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ লিখতে উদ্যত হই নি, কিংবা স্রেফ সাইম রানার গান বিষয়েও কোনো প্রবন্ধ লিখবার কোশেশ এটা নয়। এই লেখার অভিমুখ নিতান্তই অগভীর, কেবল আজকের গীতবৈঠকে গীত হবার জন্য তাঁর দশটি নির্বাচিত কবিতাকে ঘিরেই এর আবর্তন। ফলে এর প্রতি কোনো ধরনের অত্যাশা পোষণ হতাশার কারণ হতে পারে।

এই নিবন্ধকারের জানা আছে যে, সাইম রানা একজন কবি। আমি নিজেও কবিতার প্রতিবেশী বলে বিষয়টা অনেকটা কাছে থেকেই জানা। কিন্তু রানা যে একজন সংগীত সাধকও, সেটা আমি জানি না অথবা খুবই দূর থেকে জানি। কারণ কখনোই তাঁর কণ্ঠে সুরে বাঁধা কোনো কথা শুনবার সৌভাগ্য আমার হয় নি। আজই মাত্র আমার সামনে তেমন একটা সুযোগ অবারিত হতে যাচ্ছে। আমার কৌতূহলটা তাই সেখানেই বেশি। লিরিকগুলো আগে দেখা-পড়া থাকায় হয়ত এই এপিসোডটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য হবে, কেননা প্রায়-ন্যাংটো, উলোঝুলো ও ভাব-বক্তব্যের ভারবাহী কথার শরীরে সুর চাপালে সৌন্দর্য কীভাবে পূর্ণতা পায় বা লুপ্ত হয়, কীভাবে ডানে-বামে মোড় নেয় তা মিলিয়ে নিয়ে নিজের জানাবোঝাটায় কিছু হয়ত যোগ করার সুযোগ তৈরি হবে।

আজকের গীতবৈঠকের সংকলনে মুদ্রিত সাইম রানার কবিতাগুলো আমি বারকয় পড়েছি। এগুলোকে কবিতাই বলছি, কারণ সুর লাগবার আগ পর্যন্ত এগুলো তাই-ই, গান নয়। প্রথমবারের পড়াটা ছিল, যাকে বলে চোখ বুলানো, কোথাও ধাঁধিয়ে যাবার মতো কিছু ঠেকে যায় কি না তার অন্বেষণ। ঠেকে নি। কেমন সব চেনা চেনা শব্দ-বাক্য, চেনা ছবি, চেনা ফ্রেইজ। সপ্তাহখানেক সংকলনটা অবহেলায় পড়ে থাকে। ছুঁই না, ছোঁবার টান অনুভব করি না বলে। শুক্রবার যখন বেশ ঘনিয়ে আসতে থাকে, তখন ভেতর থেকে ক্রমশ নাগরিক হয়ে ওঠা আমার মনটা তাড়া দেয়, সেটা এই বলে যে, তুমি এই মর্মে আয়োজকদের কথা দিয়েছ, কবিতাগুলো সম্পর্কে একটা মিতভাষ্য অন্তত উপস্থাপন করবে। আমি আতঙ্কিত বোধ করি। তবে সেটা সহজেই কাটিয়ে ওঠা যায়। এক রাতে অন্য সব কাজকে লজিক্যালি গৌণ ঠাওরিয়ে সংকলনটা নিয়ে ফের বসা হয়। একটা একটা করে কবিতা পড়ি আর চোখ বন্ধ করে মাথার ভিতর কবিতাটাকে খেলাতে চাই। খেলে তো খেলে না। তারপর আবার পড়ি, কখনো বা আবার। দেখি যে ভিতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম হচ্ছে। এক দুই শব্দে লেখাটার পাশেই ওই প্রতিক্রিয়াগুলো লিখে ফেলি। দশটি লেখাই যখন পড়া শেষ হয়, তখন ভিতরে একটা সমন্বিত চাপ তৈরি হয়, যা দশটি লেখার ভিত্তিতে সামগ্রিক একটা প্রতিক্রিয়াও উগরে দিতে চায়। একটা নোটখাতায় তাও টুকে ফেলি।

এরও তিন ঘণ্টা পরে বসি কম্পিউটারে। পটভূমি রচনার পর থমকে যাই, কীভাবে এগোবো সেটা ভেবে। সহসা সিদ্ধান্ত নেই যেভাবে চিন্তা এগিয়েছে সেভাবেই না হয় হোক লেখাটা। অর্থাৎ, পাঠোত্তরে প্রতিটা কবিতার পাশে প্রথম জন্ম নেয়া যে প্রতিক্রিয়াটি লেখা হয়েছিল তাই-ই একে একে বিন্যস্ত করি। লিখি--
  1. লড়াই-সংগ্রাম ছাপিয়ে ওঠা ক্লিশে এক আশা
  2. এবারও ভোর হয়, কোকিলেরা গেয়ে ওঠে পুরাতন ব্যথা ভুলে
  3. যা কিছুকেই তিনি মহান বলে ভাবেন, মহিমান্বিত করতে চান, তা-সবকেই তিনি বিশালতার উপমায় উপমায়িত করেন
  4. শিশুসুলভ সরল আবেগ উসকে ওঠে, দীর্ঘ জীবনের আকুতি প্রকাশ পায় শিশির প্রতীকে
  5. দুঃখমোচনের সাংগীতিক প্রেসক্রিপশন, যেখানে আবারো উঁকি দেয় আশা নামের ফুলঝুরি
  6. নদী-নৌকায় মাখামাখি ভাঙাগড়ার জীবনচিত্রে মূর্ত বাংলার রূপ
  7. ‘তুমি আসবে বলে’, ‘তুমি হাসবে বলে’-- এই জাতীয় ফ্রেইজ লিখতে অসতর্কতাজনিত একটা সাহস লাগে
  8. (...)। (সেসব কবিতাই গানের জন্য উৎকৃষ্ট, যাকে গদ্যে রূপ দেয়া যায় না।)
  9. অতিকে স্পর্শ করা খোলা কল্পনার উৎকর্ষ
  10. চিরছবির সংকলন। নীরবে কেয়াগাছের পাতা নড়ছে, ঋতু বদলাচ্ছে, এসব ঘটনার বয়স কখনোই বাড়ে না। কিন্তু মানুষের বয়স বাড়ে, আর বয়স বাড়া মানে ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়া-- মৃত্যুতে।   
এবার নোটখাতার দিকে তাকাই। সেখানে লেখা আছে, সাইম রানার এসব কবিতায় নতুন বোধ বা ছবির আবিষ্কার কই? কেবল পৃথিবীর নিয়ম রেখাকে ঘোড়ার ক্ষুরের মতো করে দেখা, কিংবা চোখের ভিতর পায়রার জল খেয়ে আশা মেটানো, কিংবা আয়ুর গ্লাসে মৃত্যু রাখা, কিংবা মেঘের বিছানায় হরিদ্রা কন্যার বেশে প্রভাতের ঘুমিয়ে থাকা, কিংবা জলের তারের কাঁপনে মেঘলা কুমারীর কেশে তান বাজানো-- এমন কয়েকটি জায়গা ছাড়া বাকি সব চিরচর্চিত বিষয়, বলনকেতায়ও যেসব প্রায় অনতুন। অর্থাৎ যেসব ছবি বা ছবিকল্প এখানে আঁকা হয়েছে, সেসব খুবই চেনা, তা সে গ্রামীণ বা নগর যে বাস্তবতা থেকেই নেয়া হোক বা যে বাস্তব ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই কল্পনা করা হোক। লক্ষণীয় যে, গ্রামীণ ছবির উপস্থিতি বেশি হলেও সাইম রানার ভাব মূর্ত করবার ভঙ্গিটা অতিশয় নাগরিক বলে পুরো গ্রামীণ প্রেক্ষাপট ছুঁয়ে থেকেও তাঁর কবিতা লোককবিতা হয়ে ওঠে না বা বলতে পারি লোকগানের আত্মীয় হয়ে ওঠে না।

সাকুল্যে আমার পর্যবেক্ষণ এটুকুই। কিন্তু গীত হবার জন্য লিখিত কোনো কবিতাগুচ্ছ, অর্থাৎ লিরিক বা গীতিকবিতা সম্পর্কে এই-ই কি কখনো শেষ কথা হতে পারে, না হওয়া উচিত? যেখানে বলা হয় যে ‘সুরের জগৎ কথার থেকে পৃথক’, সেখানে এসব কথা তো শেষপর্যন্ত গীতঘনিষ্ঠ, সংগীতবান্ধব কোনো সম্ভাবনার কথা শোনায় না। এই টেক্সট কি সেসব সম্ভাবনা রহিত? অবশ্যই নয়। বরং সেদিক থেকে দেখলে এ ধরনের টেক্সটই প্রার্থিত। কীভাবে? আমাদের সংগীতচিন্তায় সামনের সারিতে বিবেচ্য বিশিষ্টজন ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কথা ও সুর’ প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ‘শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতায় দুর্বোধ্য কথার বদলে পুরাতন ও পরিচিত কথারই প্রয়োগ দেখা যায়।’ কেন এমন হয় বা হতে হয়? কারণ কবিতা বুঝতেই যদি বেগ পেতে হয়, তবে সেটা উৎকৃষ্ট গীতিকবিতা হবার যোগ্যতা হারায়। এক্ষেত্রে তাঁর চূড়ান্ত কথা হলো, ‘যে শব্দ যত পরিমাণে অর্থ কিংবা বস্তুকে অতিক্রম করবার শক্তি ধারণ করে সেই শব্দ তত পরিমাণে গীতে সহায়ক, এবং সেইপ্রকার শব্দবাহী, শব্দবিন্যস্ত কবিতাই ততটা পরিমাণে সুর রচনার উপযুক্ত বাহন।’ কবিতাগুলো আমাদের পড়া আছে বলে আমরা কিছুটা জানি আবার সুরের সহযোগ পেয়ে কবিতার কথাগুলো কীভাবে এক্ষেত্রে উতরেছে তা আমরা এখনো জানি না বলে আপাতত এরকম একটি সিদ্ধান্তে দাঁড়ানোই সংগত যে, রানা হয়ত এই কবিতাগুলোর কথা এমনভাবেই সাজিয়েছেন, যার ভিতর দিয়ে সুরের রাজ্যে সহজে যাওয়া যায়।

সাইম রানা তাঁর সংগীতকর্মে সব্যসাচী। নিজেই তিনি গীতিকার-সুরকার এবং গায়ক। ফলে তাঁর সুরারোপের কৌশলকে, তাঁর গায়কীকে আলোচ্য গীতিকবিতাসমূহের পাশে রেখে কথা না বলে কেবল লিরিক নিয়ে শব্দে শব্দে আমরা যত কথাই সাজাই না কেন, তা সর্বার্থে অসম্পূর্ণতাকেই মূর্ত করে তুলবে। সুতরাং একটি অবশ্য-অসম্পূর্ণতাকে বেশিক্ষণ জাপটে ধরে না থেকে বরং কান পাতা যাক সেই কোনো জাদুতে, যা ব্যবহারিক জীবনের ভাবগুলির তুলনায় স্বভাবগতভাবেই অস্পষ্ট অথচ জীবনকে ছাপিয়ে থাকার ধর্মে যা আচ্ছন্ন।

৭ মার্চ ২০০৮
গীতবৈঠক, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র

শাদাপৃষ্ঠা ভরাটকরণ প্রকল্পের অধীনে দেয়া কবিতাময় ছিন্ন-সন্তরণ

ক্ষণজন্মা ও স্পর্শকাতর ভাববস্তুর উৎকৃষ্ট অনুবাদ হচ্ছে কবিতা। যখন তখন এ ভাবের উদয় যেমন হয় না, যখন তখন চাইলেই এর অনুবাদও করা যায় না।

হয় না, কারণ, নির্দিষ্ট কবিব্যক্তিটির জৈবনিক নানা স্থূলক্রিয়ায় সময় ক্ষেপণ করতে হয়; কবি তাই অনুভূতির সূক্ষ্মতা সর্বদা বহনসক্ষম হন না। ভোঁতা অনুভূতিযোগে স্পর্শকাতরতা আঁচ করা কীভাবে সম্ভব! এ সময়কালে কবি অনুপস্থিত থাকেন ভাবদেশের স্বতোক্রিয়া নিরীক্ষণের কাজে। আর যায় না, কারণ, কবিতার ভাষা, যাতে সম্পন্ন করতে হয় অনুবাদক্রিয়া; তা সর্বক্ষণ দখলে থাকে না কোনো কবির। যেকোনো ভাষায় ভাবের যেকোনো প্রকাশই যেহেতু কবিতা নয়-- কাজেই কবিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হয় অনুবাদযোগ্য ভাষা। যিনি কবি, সূক্ষ্ম ভাবোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট কবিতাভাষাও এসে ধরা দেয় তাকে। এজন্যে আলাদা কোনো প্রয়াস অদরকারি। একটি কবিতা লিখবার পূর্বশর্ত তাই ক্ষণোদয়া ভাবের মৌলিক বিন্দুটিকে সূক্ষ্ম অনুভূতির জারকরসে সিক্ত করে, ততধিক সূক্ষ্ম যত্নে ভাষার আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারা এবং আনুষঙ্গিক ব্যঞ্জন সহযোগে শব্দসুতোয় তা গেঁথে ফেলবার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠা।

কল্পনা কবিতার শ্বাসযন্ত্র বা ফুসফুস। এর দীনতা হাঁপানি রোগীর মতো অসুস্থ কবিতার জন্ম দেয়। কল্পনার চারুদেহে ভর করেই কবিতা হিসেবে দাঁড়িয়ে ওঠে বলবার কথাবস্তু; যার শিকড় প্রোথিত অকল্পনায়, বাস্তবে। এই অকল্পিত বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশেলটা যত সমসত্ত্ব হয় কবিতার অর্জনমান হয় ততটা উৎকৃষ্টতর। মিশ্রণটি অসমসত্ত্ব হলেও ভালো কবিতা হওয়া সম্ভব, যদি থাকে কবিব্যক্তির উচ্চাঙ্গের পরিমিতি-জ্ঞান।

কল্পনা করবার ক্ষমতা আসে অভিজ্ঞতা থেকে। আর অভিজ্ঞতা আসে দেখা-শোনা-পড়া ইত্যাদির ভিতর দিয়ে। অভিজ্ঞতা হলো এক ধরনের ছাপ, যা মস্তিষ্কে কমবেশি স্থায়ী হয়। তার আলোকেই গড়ে ওঠে নানা কল্পিত ধারণা। কোনো কল্পনাই সুতরাং অভিজ্ঞতার বাইরের কোনো শূন্য জায়গা থেকে বেড়ে ওঠবার ফুরসৎ পায় না। মানুষ ঈশ্বর কল্পনা করেছে তার অভিজ্ঞতা থেকেই। মানবীয় সেই গুণসমূহই ঈশ্বর ধারণার ওপর আরোপ করা হয়েছে, যা উৎকৃষ্ট; যার কোনো কোনোটি মানুষের মধ্যে বর্তমান থাকলে আমরা সেই মানুষকে মহৎ, অসীম ও অলৌকিক গুণসম্পন্ন বলে জ্ঞান করি।

কল্পনা ক্ষমতা যার যত বেশি, তিনি ততবড়ো শিল্পী; আর উৎকৃষ্ট ও বিচিত্র কল্পনা করতে পারেন তিনিই, যিনি বিচিত্র অভিজ্ঞতার অধিকারী। কিন্তু আরো কথা থাকে-- এই যে অভিজ্ঞতা, যা কবির কল্পনা করবার পরিধিকে বাড়িয়ে দেয়, তা কবিতায় প্রযুক্ত হতে পারে কেবল তখন, যখন তা পরিশুদ্ধ হয়ে আসে অনুভূতিদেশ থেকে। এর অন্যথা হলে হয়ত পদ্য সৃজন সম্ভব, কিন্তু কবিতা অবশ্যই নয়।

ছন্দ কবিতার জন্য জরুরি; কিন্তু ধ্বনিময়তা সৃষ্টি হওয়া তার চেয়েও জরুরি। প্রচলিত কোনো ছন্দের ধারে-কাছে না-গিয়েও উৎকৃষ্ট কবিতা সৃজন সম্ভব। আবার ছন্দের সফল প্রয়োগেও একটি কবিতার সৃজন সম্ভব নাও হতে পারে। নেপথ্যে ভূমিকা রাখে এই ধ্বনির কারিশমা, ধ্বনি-আবহ সৃষ্টি হওয়া না-হওয়া। যুগপৎ ছন্দসাফল্য এবং ধ্বনিগত সাম্য সৃষ্টি হলে তা সবচে’ উত্তম। এ রকমটা অত ঘন ঘন হয় না। হওয়া সম্ভবও নয়। কদাচিৎ এমনটি ঘটে, যে কারণে ভালো কবিতা কদাচিৎ লিখিত হয়। যিনি ভালো কবি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন, তাঁর হাতেও সব সময় ভালো কবিতা এজন্যেই লিখিত হয় না। অন্যদিকে কোনোই স্বীকৃতি নেই, এমন কবির হাতেও সৃষ্টি হতে পারে একটি মহৎ কবিতা।

অনেকদিন থেকে যিনি কবিতা লিখেন, তিনি কবিতার বহিরাবয়বের এমন একটি ছাঁচ রপ্ত করে ফেলেন যে, চাইলেই তিনি কিছু শব্দকে ওই নির্দিষ্ট ছাঁচের মধ্যে ফেলে একটা অর্থবোধকতা সৃষ্টি করতে পারেন। খেটেখুটে তাকে অলঙ্কৃত করে তুলতে পারেন। হাতুড়ি-বাটালি-কাঠ পেলে যেকোনো কাঠমিস্ত্রি মানসিক যেকোনো অবস্থায় যেমন একটি চেয়ার বা টেবিল বানিয়ে ফেলতে পারেন, এ-ও অনেকটা তেমনি। কখনো কখনো প্রায় কবিমাত্রই এরকম কবিতামতো রচনা লিখে ফেলেন বটে-- কিন্তু সবসময় কবি বুঝতে পারেন না যে সেটি নির্জীব চেয়ার-টেবিল হয়েছে, না কবিতা। সেটা সম্ভব হলে চারপাশে কবিতামতো ব্যর্থ রচনার সংখ্যাধিক্য অবশ্যই চোখে পড়তো না। এটি বুঝতে পারার জন্য যে ধ্যান যোগ হতে হয়, তার অভাব না-ঘটলে চেয়ার-টেবিল নয় কবিতাই সৃজন সম্ভব। যিনি কবি তিনি কখনো কখনো কথিত এই ধ্যানময়তা থেকে চ্যুত হয়ে যান বটে, আবার ধ্যানমগ্নও তিনি হতে পারেন। তবে অকবি ধ্যানস্থের ভান করলেও ধ্যান তাতে ধ্যানস্থ হবার সুযোগ পায় না।

শেষপর্যন্ত একটি কবিতায় কী লিখিত হবে, কবি নিজেও তা জানেন না। একটি শব্দ, একটি বাক্য লিখিত হয়ে যাবার পর সেই শব্দ এবং বাক্যই চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে নিয়ে আসে আরেকটি শব্দ এবং বাক্যকে। এভাবে চলতে চলতে একসময় কবিতাটি সম্পূর্ণতা পায়। তখন শব্দ আরেকটি শব্দকে, বাক্য আরেকটি বাক্যকে ওই কবিতাটিতে আর প্রবিষ্ট হবার সুযোগ দেয় না, প্রয়োজন থাকে না বলে শেষ শব্দটি সম্পূর্ণ প্রবেশ পথ জুড়ে বসে থাকে। খতম হয় কবিতা কবিতা খেলা। এই যে একটি সম্পূর্ণ কবিতার সৃজিত হয়ে যাওয়া, পরিপূর্ণ ধ্যান যোগ হলে কখনো কখনো কবি ঠাহরও করতে পারেন না, কখন কীভাবে তাঁর দ্বারা অসাধ্যটি সাধিত হয়ে গেল। কবিতার এই সৃজিত হবার প্রক্রিয়ায় কবির অবচেতন মন এমনভাবে কাজ করতে থাকে যে, মস্তিষ্কের নির্দেশ পাবার পূর্বেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিখিত হয়ে যায় একেকটি শব্দ বা বাক্য। কখনো বা সম্পূর্ণ কবিতাটিই। অলৌকিকতা বলে কিছু নেই, কিন্তু মনে হয় এটি সংঘটিত হলো কোনো অলৌকিক প্রক্রিয়ায়ই। কবিতার জন্ম মুহূর্তটি এমন বলেই তাতে বাসা বাঁধতে পারে এত এত রহস্যের ঘনঘোর।

যিনি স্বভাষা বা বিভাষা শুদ্ধরূপে পড়তে-লিখতে-বলতে পারেন, তিনিই পাঠক নন। অন্তত কবিতার পাঠক তো ননই। কবিতার পাঠকের চালিত হতে হয় নির্দিষ্ট কবিতাটির সৃজন-প্রক্রিয়ার অধীনে আচ্ছন্নের মতো। যে গুণপনা থাকতে হয় কবির, তা কবিতার পাঠকেরও। যিনি এতসব গুণের অধিকারী, তিনি কবিতা না-লিখলেও কবি। হয়ত তিনি লিখেন না, কিন্তু লিখতে পারতেন। এরকম লোকের সংখ্যা প্রকৃতই কম, যিনি কবি নন অথচ কবিতার পাঠক। শেষপর্যন্ত কবিতার পাঠক কবিরাই। কবিই বাঁচিয়ে রাখেন কবিকে। আসলে একজন কবিতাকর্মীর সারাজীবন কবিতা লেখা, কবিতার পাঠক হয়ে ওঠবারই এক দীর্ঘমেয়াদি কষ্টকর পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারা মানেই কবি হয়ে ওঠা। যিনি কবি হয়ে উঠলেন কিন্তু পাঠক হয়ে উঠলেন না-- তার কোর্স অসম্পূর্ণ। কোর্স সমাপনীর কোনো সনদ তার কখনোই জুটবে না। তিনি সারাজীবন অধমই রয়ে যাবেন। একজন সম্পূর্ণ পাঠক, একজন অসম্পূর্ণ কবির চেয়ে উত্তম।

রচনাকাল : ২০০০

Sunday, August 16, 2009

বালখিল্যকথন

কবিতা হলো কবির জীবনের একটা পরিস্রাবিত দ্রবণ, পরিপার্শ্বের তাপে গলা, যে-দ্রবণে মিশে এসে সমুদয় ভালোমন্দ অর্জনের ভাঁপ, ক্লেদ-গ্লাণিসহ। এসবের ভিতর দিয়ে যাওয়া, ডান-বাম দেখে, পাশ দিয়ে কে যায় না-যায় তার তল্লাশ জারি রেখে। যেসব জিনিসকে মানুষ উপেক্ষা করে আসে, যেসবকে রেখে আসে পরে কাজে দেবে ভেবে, সেসবের দূরাভাও থাকে। প্রান্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পানির মতো প্রয়োজনীয়তা সকল, সেসবকে যথাসম্মান দিয়েও বর্জ্যপ্রায় পরিত্যাজ্য বস্তু ও বস্তুভাবনার চরাচর চুঁইয়ে নেমে আসা অবিরল জলের দিকেও মাঝেসাঝে তাকাতে হয় ফিরে। কাকে নিতে হবে কাকে রাখতে হবে এসব ঠিক করে দেয় মেজাজ, যেটা সমাজঘটনা দিয়ে মোড়া। যে সুবিধা, যে অসুবিধা বিরাজ করে ভূয়ে, যখন যাপন করেন কবি, কবিতায় তার নিঃশ্বাসধ্বনিটাই বাজে। মানুষ দেখে দেখে শেখা মহাকালবোধ, এইখানে চুপিসারে এসে মেশে।

ভয়ের রক্তচক্ষুকে যুক্তির আঙুল দেখিয়ে থামিয়ে রাখা, অথচ ভেসে থাকা গোপন এক ভীতিভাবে। সভ্যতার নিঠুরাবেশে যতসব হুংকার দিকপাশে বাজে, নাতিদূরে ঘোরঘাটে খেলে ওঠে যতসব সন্তরণ লীলা, এসবেরও আঁচ রাখতে হয়, কোথায় কোথায় ভীতি সেই কথা সামনে না-এনে। ঘোর সেই পাললিক পরিসর নেচে ওঠে ধ্যানমগ্নতায়। পাঠককে গ্রস্ত করে ঘোর, আনে সম্মোহন। শুকনো পাতার সাথে উড়ে উড়ে ঝরে পড়ে পালকের আগে। মেঘসম্ভব গাম্ভীর্য ভেঙে বৃষ্টিধারা বয়।

বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমির বেদনা রোদের আঁচে তাতিয়ে নিয়েও বড়োসড়ো অভিযোগ কাঁধে নেয়া, তার ভার। ঘরের ভয় ও পথের ভয় আলাদা-আলাদা, ওইসব হাতের চউলে নিয়ে দেখা। সামনে তাকিয়ে দেখা কারা কারা পথে নেমে গেছে, লাল-নীল। নানাদিকে হাত উঠিয়ে থাকা। পথ বন্ধ হয়ে থাকে পুরো, বড়ো নির্যাতন সয়ে তবু ওর দিকে যেতে হয়। আমোদে-আহ্লাদে যাওয়া দরকার যেইদিকে, সেদিকের প্রেমকুঁড়ি গাছ, তার ডালপাতা মূলটুল স্থান করে নেয় যথারীতি। সব করে নিতে হয় নিজেই প্রস্তুত। যারা অপেক্ষা করে থাকে যত্নের, কত তারা ধরে মিছে সত্য, তুলে আনতে হয় ওরে ধরে, তারপর শুরু হয় বাগানবিলাস। অধিগত নয় যেটা, তাকে ঘিরে অপচয় বাড়ে, তবে এরও নিগূঢ় আঁচড় থাকে মিলেমিশে, যদিও দরকারি এর থেকে দূরে বাস করা, নিজের মতো করে, ঘাড়টাকে যথারীতি ত্যাড়া করে রূপার কপাটে দিয়ে খিল।

হয়ত শোনা গেল ধনচে শিশুর কোলাহল, একপাশে থেকে যেতে পারে কোনো প্রেমময় কথার ঝিলিকও। তাকানো দরকার নেই জেনেও তাকানোর মরশুমে চোখে চোখে গেঁথে নেয়া জিওল ভাবনা। খটখট-ঘটঘট হয়তবা দূরে ঠেলে রেখে যায় সবিশেষ কামভাব, অবদমনের কোনো দমনচেষ্টায় বুঝি থরে থরে সাজানো থাকে এইসব কর্মের ডালা। যে ধ্যানে পৌঁছা যায় না, সে ধ্যানের ভিতর দিয়ে আসা মনে মনে। সেরকম ধ্যানের মায়ায় বুঝি লাল চেলি ভুলে গিয়ে অকুল-আশার গলে মালা দেয়া। অজ্ঞতা ছায়ার মতো লেড়েল্যাপ্টে থাকে, বোধকরি থাকতেও হয়। এই সবকিছু মিলেমিশে বিচিত্র রূপগুণ নিয়ে যেটা আসে, সেটাই কেবল হয় মহাকালমুখী, কোনো-না-কোনোভাবে।

২.

এই-ই সব, যেন এই-ই সব। যদি হয়ও তা, এ ধারার তরল বর্ণনার চেয়ে তা করে ওঠা কঠিন। আর শুধু করে ওঠাই বা বলি কেন? বলাটাই বা সহজ হবে কী প্রকারে, যে বলা প্রকৃত বলা? যদিও প্রকৃতটা বলা এক্ষেত্রে নিতান্তই অসম্ভব, কারণ কবিতা শিল্প। শিল্পের কীভাবে এমন সংজ্ঞা হতে পারে যা সর্বজনীন? স্বপ্রণীত সংজ্ঞাযোগে ধারকাছ দিয়ে হয়ত যাওয়া যায় তার, কিন্তু শতভাগ ঠিক ঠিক জায়গাটা শনাক্ত করা যায় না এর। আমরা তবু চিনতে চাই একে স্ব স্ব অভিজ্ঞতা ও জানাবোঝা দিয়ে। বুঝতে চাই যে, কোনপথে হাঁটলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় ও হাঁটার ভঙ্গিটা ঠিক কী হলে রচিত কবিতায় ভর করে এসে সুন্দর।

স্থান-কাল-পাত্রভেদে সর্ববাদীসম্মত সংজ্ঞাহীন সুন্দরের মান ও মানে বদলে যায়। সুতরাং একজন কেউ যখন সুন্দরকে চিনাতে যান, কবিতার সুন্দর, তখন তা প্রধানত হয় ওই কথকেরই মতো। আর যাঁরা যাঁরা নির্দিষ্ট কথকের মতো করে ভাবেন, বা দেখেন কথকের ভাবনার মধ্যে তাঁর/তাঁদের ভাবনার কোনো খোরাক আছে সামনে এগোবার, বা ধরা যাক এমন কেউ যিনি ঠিক উলটো করে ভাবেন বা ভাবতে চান কথকের চেয়ে; কথককে ছাড়া আর কেবল তাঁর তাঁর কাছে এসব বলাবলির কোনো মানে থাকলে থেকেও যেতে পারে।

৩.

‘ভাষাই বড়ো ব্যর্থতা ব্যর্থ লেখকের’— এ কথায় মনেপ্রাণে আস্থা না-রাখবার কোনো কারণ ঘটে নি এখনো। লক্ষ করলে দেখা যায় যে, কোনো কোনো লেখক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা অনেক অর্থপূর্ণভাবে বলেছেন, কিন্তু ভাষাগত বিশেষত্ব ও বাগসংহতি না-থাকায় তা পাঠককে ছুঁতে পারে না। কবিতায় ভাষার ব্যবহার হতে হয় অব্যর্থ ও যথাযথ। যোগাযোগসহজতা তার একমাত্র বিবেচনা নয়। বিবেচনায় থাকে উচ্চারণসহজতা, প্রত্যাশিত গাম্ভীর্য সৃষ্টির লক্ষ্য ও অর্থ প্রসারণ চেষ্টাও। অবিবেচকের মতো অবান্তর শব্দনিক্ষেপ কবিতাকে সিদ্ধির কূলে পৌঁছতে দেয় না, বরং চরে আটকিয়ে দেয়। পুরো কবিতার শব্দবিন্যাস সামঞ্জস্য ও সংগতিপূর্ণ হওয়া লাগে। তবেই কেবল তা সংগীতের দিকে এগিয়ে যায়।

ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। ভাষার এই পরিবর্তনের গতিটা কোনদিকে সেটা আন্দাজ করা গেলে সবচে’ সুবিধা। যেহেতু একজন কবিতাকর্মী আজকের জন্যই কবিতা লিখেন না, বরং লিখেন আগামীর জন্য, কাজেই আগামীতে ভাষার যে সম্ভাব্য রূপটি দাঁড়াতে যাচ্ছে তা যদি কেউ ঠিকঠাক ধরে উঠতে পারেন, তাহলে তিনিই আগামী সময়ে বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। একজন কবির কবিতা যতদিন প্রাসঙ্গিক ততদিনই তিনি পঠিত হন, এবং ততদিনই তিনি জীবিত। ততদিনই তাঁর লেখার নব নব দরোজা উন্মোচনের সম্ভাবনা থেকে যায়। আর্কাইভড হওয়া একজন লেখকের কোনো চূড়ান্ত সাফল্য নয়, প্রত্যাশাও নয়।

লেখককে প্রাসঙ্গিক রাখে কেবল ভাষা নয়, তাঁর বক্তব্যও। নিহিত বক্তব্যকেও সমকালোত্তরণের স্পর্ধা রাখতে হয়। যা আজ লেখা হলো তা আজ তো সমকালীনই, কিন্তু কাল যদি তা পশ্চাৎপদ বিবেচিত হয়, তবে তা ভাষায় প্রাসঙ্গিক হলেও সার্বিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। আজকের বার্তাকে যদি তাবৎ ক্ষমতাযোগে মহাকালের করে তোলা যায়, তবে সেটা প্রসঙ্গ হয় আগামীদিনের। এজন্য ভাবনাচিন্তায় আধুনিক হতে হয়, বিজ্ঞাননিষ্ঠ হতে হয়, নতুনকে গ্রহণ করবার মানসিকতাসম্পন্ন হতে হয়, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে হয়। এ হলে ছোঁয়া যায় চিরসমকাল। অর্থাৎ কবির মহাকালকে লক্ষ্যে রেখে শব্দচয়ন, শব্দসজ্জা ও বাক্য নির্মাণ করতে হয়। এটা যে যত ভালো করতে পারেন, তিনি তত বেশিদিন বেঁচে থাকেন। এ বাঁচা শারীরিকভাবে নয়, পাঠকের মধ্যে নান্দনিকভাবে বাঁচা।

পাঠকদের একটা অংশের সঙ্গে কবির যে দূরত্ব তৈরি হয়, তার একটা কারণ মহাকালকে অভীষ্ট ভাবা। এটা সংগতও। এ অবস্থা কারো ক্ষেত্রে খুবই প্রকট আকার ধারণ করে, কারো ক্ষেত্রে অপ্রকট। কিন্তু এ কখনো নয় যে, পাঠকঅপ্রিয় কবিমাত্রই মহাকালের সওদাপাতিতে ব্যস্ত। পাঠকঅপ্রিয়দের একটা বড়ো অংশই অল্পপ্রাণ কবি অথবা অকবি। পাঠকপ্রিয়দের মধ্যে এ সংখ্যা আরো বেশি।

৪.

একটা বহুশ্রুত প্রবাদ আছে আমাদের সংস্কৃতিতে, ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’ বা ‘বউকে মেরে ঝিকে..’,। এই প্রবাদোপরিতলে যে ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, কবিতায় প্রতীক ওই কাজটিই করে। যে বস্তুকে বা যাকে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে তার কথা না-বলে বর্ণিত বস্তু বা ভাব বা ঘটনার বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঠিকঠাক ঘটে এমন কিছু দ্বারা মূলকে প্রতিস্থাপিত করাই প্রতীকায়ন। আড়াল সৃষ্টির জন্য এবং সৌন্দর্য নির্মাণের জন্য এটির দরকার হয়। শিল্পে প্রতীকের ব্যবহার খুব প্রচলিত ঘটনা। সঠিক প্রতীক ব্যবহার করতে পারা বিষয় ও বিষয়সংশ্লিষ্ট জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। প্রতীককে হতে হয় সুপ্রযোজ্য। একটি প্রতীকের অযথার্থ ব্যবহার একটি কবিতাকে মাঠে মেরে ফেলতে পারে। সব পাঠক সব প্রতীককে ঠিকঠাক ধরতে পারবেন সেরকম ভেবে ওঠা অসংগত। কিন্তু নিবিড় পাঠে তা অধিকাংশ অভিজ্ঞ পাঠকের কাছে গ্রাহ্য হয়ে ওঠা উচিত। ব্যবহার যথার্থ হলে তা না-হবারও কারণ খুব থাকে না। অবশ্য কবি যে অর্থে প্রতীকটি ব্যবহার করেছেন ঠিক সেটাই না-বুঝে পাঠক অন্য কিছুকে বুঝলে মহাভারত ক্ষণিকের জন্যও অশুদ্ধ হয় না, যেহেতু পাঠকই কবিতার ‘মানে’কে জন্ম দেন তাঁর তাঁর মতো করে। কবিতার অর্থ পাঠকভেদে বদলে যেতে পারে, এটাই কবিতার শক্তি। এমনকি বলা চলে স্থিত মানের রচনা কোনো কবিতাই নয়। সেটাই কবিতা, যে টেক্সটের মানে পাঠে পাঠে বদলায়। এটা দূর করবার চেষ্টা কবিতার কবিতাত্ব নিয়ে খানিক সংশয়কে বরং উদ্বেলিত করা।

কবির সময়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অনেক কারণ থাকে, যা তাঁকে আড়াল সৃষ্টি করতে বাধ্য করে। এ তাঁর নিজ অস্তিত্ব রক্ষার্থে তো বটেই, শিল্পের কৌমার্য রক্ষার্থেও দরকার। কবির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক নানা ঘটনার দ্রষ্টা হয়ে উঠতে হয়। আর এসবের ভিত্তিতে সামাজিক মানুষ হিসেবে তিনি নানা প্রেরণাও লাভ করেন, আবেগাপ্লুুত হন। কিন্তু খুব সরাসরি তিনি তা বলতে পারেন না। বললে তাঁর উপরে নানা খড়্গ নেমে আসার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া শিল্প হিসেবে কবিতার সব কথা সবভাবে গ্রহণ করবার সক্ষমতা নেই, এটা মনে রাখতে হয়। এত অনর্থক ভার বইতে পারে না কবিতা। যে কারণে কবিকে বক্তব্য আড়াল করতে নানা প্রতীকের আশ্রয় নিতে হয়।

ভাষা সংকেতও আদতে প্রতীক। ভাষার প্রতিটি শব্দ এক বা একাধিক বস্তুর প্রতীক। কলিম খান অবশ্য বলেন, বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডারের সবচে’ বড়ো সম্ভার সংস্কৃত ভাষা ছিল ক্রিয়াভিত্তিক। তৎসম শব্দসমূহের মাধ্যমে এ গুণ বাংলা ভাষায় স্বতঃস্থানান্তরিত। ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এর মূল অর্থ হয় ধাতুর। নির্দিষ্ট ধাতু থেকে উদ্ভূত সমস্ত শব্দের অর্থই নিয়ন্ত্রণ করে ধাতুর অর্থ। শব্দব্যাখ্যান কর্মের যে ছবি সামনে আনে, সেই কর্মের বৈশিষ্ট্যই নির্ধারণ করে শব্দটির গঠন কী হবে। এ মতে শব্দের অর্থ বাইরে থেকে আরোপিত নয়, ভিতর থেকে উৎসারিত। পরে মুনাফালক্ষ্যী বিনিময়কে শব্দার্থজাত ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে অধিক লাভজনক করবার জন্য শব্দকে সুনির্দিষ্ট মানেবাহী করে তুলতে কিছু শব্দের অর্থকে সুনির্দিষ্ট করে ফেলা হয়। যে কারণে কোনো-কোনো শব্দের ধাতুমূলগত অর্থ অজস্র হলেও শোনামাত্র কেবল এক-দুটি প্রাণী, বস্তু বা বিষয়কে বোঝায়। এটা স্বাভাবিকভাবে অজস্র অর্থ হওয়াকে আস্বাভাবিকভাবে সীমিত পরিসরে বেঁধে ফেলানো। এর মানে প্রসারিত অর্থকে সংকুচিত করে ফেলা, যেভাবে আমাদের বাংলা ভাষাও, অন্যসব ভাষার মতো প্রতীকী ভাষা হয়ে উঠেছে। সব ভাষাই সময়ের সাথে বদলে যায়, ভিতরে ও বাইরে। সংকুচিত হয় প্রসারিতও হয়। এর অনেকগুলো কারণ থাকে, কলিম খান মুনাফালক্ষ্যী বহির্দেশিয় বেণিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কারণটিকে নেতিবাচকভাবে দেখেছেন। সংকোচনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন।

অমুনাফালক্ষ্যী শিল্পসৃজনের প্রয়োজনেও যে শব্দের অর্থ কালে কালে বদলে যায়, এটাকে তিনি সংকোচনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন নি। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ নামক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে অভিধানকে ভিত্তি করে কলিম খানের ক্রিয়াভিত্তিক ভাষাতত্ত্ব দাঁড়িয়েছে, সেটি সংকলনকাল পর্যন্ত বিভিন্ন মুদ্রিত দলিলে যে সমস্ত অর্থে যেভাবে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার একটা যথাসম্ভব ভালো ডকুমেন্টেশন, সেখানে সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের উদাহরণসহ প্রাপ্ত অর্থসমূহ নথিভুক্ত হয়েছে। ভাষাসংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরেই শব্দের মানে বদলায়, নতুন মানে সংস্থাপিত হয়; এবং শুধু লিখিতভাবে নয় এটা হয় মৌখিকভাবেও। সচল ভাষামাত্রেরই ক্ষেত্রে এরকমটা ঘটে। ভাষা যত বিচিত্র কাজে ব্যবহৃত হয়, তত বিচিত্র হয় এর জগৎ, সমৃদ্ধি। সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম সবচে’ বড়ো সেক্টর, যেখানে এই কাজটা হয় সবচে’ বেশি। এখানে প্রতিনিয়ত শব্দের মানে নড়েচড়ে যায়, প্রসারিত হয়। প্রসারণার্থে শব্দের এই প্রয়োগেরও সাহিত্যে প্রতীকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার কথা, যে ধরনের প্রতীকের ব্যবহার রচনাকে কবিতা করে তোলে। একজন কবিতাকর্মী একইসঙ্গে ভাষাকর্মী। তাঁর একটা কাজ এ-ও যে তিনি ভাষাকে সম্প্রসারিত করেন। ভাষার সম্প্রসারণ ব্যবহারিকভাবে ঘটাতে গিয়ে তিনি একটি কবিতা করলেন এরকম নয়, বরং কবিতা করতে-করতে একইসঙ্গে ভাষাকে সম্প্রসারিত করছেন। কবিতাটি যখন শিল্প হয়ে ওঠে, তখন এই ভাষাকৃতিটা উপজাত।

শব্দে নতুন প্রাণসঞ্চারের এই কাজটি কবিতাকর্মীর একটি মুখ্য কাজ। শব্দ যদি নতুনভাবে খেলে ওঠে, অর্থটা যদি একটু মুচড়ে যায়, তাহলে পাঠক নড়েচড়ে বসে। ক্লিশে মানেযুক্ত করে ক্লিশে শব্দের ব্যবহার মৃত রূপকের ব্যবহার, যা আবার প্রতীকও। কবিতায় পাঠক মৃত রূপকের রাশি-রাশি লাশ দেখতে পছন্দ করেন না।

মিথ হিসেবে খ্যাত লৌকিক পুরাণ বা পৌরাণিক লোকশ্র“তিকেও প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। পৌরাণিক একেকটি চরিত্র বা ঘটনা অতীতের একটা চরিত্র বা ঘটনার গল্পকে ছোট শব্দশরীরের মধ্যে ধরে রাখে। গোটা কবিতায় একটি শব্দ হয়ে ব্যবহৃত হলেও ওর অনেক দীর্ঘ অদৃশ্য ফুটনোট থাকে। শব্দটি ওই ফুটনোটের প্রতীক। একজন কবি অবিকল অর্থেই শব্দটি কবিতায় ব্যবহার করলে ধরতে হবে তিনি মৃত রূপক বা ক্লিশে প্রতীক ব্যবহার করলেন। মিথের এরকম ব্যবহার গতিশীল নয়, নয় প্রগতিশীলও। হাজির করতে হয় এর নতুন বয়ান। পুরোপুরি অথবা অংশত, যেটা প্রাসঙ্গিক। ধরা যাক দেবী দুর্গাকে দশ হাতে কাজ করা গার্হস্থ্যকর্মী সক্রিয় নারীর রূপে দেখা হলো। এ প্রয়োগটিকে পাঠক আরো দূর পর্যন্ত কল্পনা করে নিতে পারবেন, যে, এতকিছুর পরও একজন গার্হস্থ্যকর্মী নারী ‘কর্মী’ স্বীকৃতিটা পর্যন্ত অর্জন করতে পারে না এবং এর জন্য কোনো অর্থমূল্য দাবি করতে পারে না। কাজগুলো অনর্থক না-হয়েও না-অর্থক হওয়ার কারণে এই যে পুরুষতান্ত্রিক বঞ্চনা, এটা তখন হয়ে যেতে পারে ওই নির্দিষ্ট প্রয়োগের একটা তাৎপর্যপূর্ণ আলোকপাত। মিথের এই মুক্তিটা কবিতায় প্রার্থিত।

৫.

আবেগ কবিতার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ একটা অদৃশ্য ঘটনা যে একে ছাড়া শিল্পসৃষ্টি, বিশেষ করে কবিতা লেখা অসম্ভবপ্রায়। অবশ্য আবেগ ব্যতিরেকেও কবিতামতো দেখতে রচনা তৈরি করা সম্ভব, যেটা অতি অবশ্যই হয় যান্ত্রিক, অতএব কবিতা নয়। এ ধরনের রচনা তৈরিকে পেশাদার কাঠমিস্ত্রির একের পর এক টেবিল-চেয়ার বানানোর সাথে মিলিয়ে দেখা যায়। যতক্ষণ ব্যবহারোপযোগী কাঠ আছে, হাতুড়ি-বাটালি আছে, বাইস আছে, ততক্ষণ কাঠমিস্ত্রি অবিরাম বা সবিরাম চেয়ার-টেবিল বানিয়ে যেতে পারেন। একটি চেয়ার ও টেবিলের শিল্পকর্ম হয়ে ওঠবারও অবকাশ থাকে, কিন্তু পেশাদারি উন্মাদনায় ভেতরের টান ছাড়া নির্মিত চেয়ার-টেবিল তা হয় না। একইরকমভাবে একজন কবিতাকর্মীকে কাগজ-কলম-পরিসর দিলে যখন-তখনই তিনি ছন্দোবদ্ধ কবিতামতো লেখা তৈরি করতে পারেন, কিন্তু সেটা পেশাদারি উপায়ে তৈরি চেয়ার-টেবিলের মতোই যান্ত্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্যমার্কা একটা ঘটনা হয়ে উঠতে পারে। পেশাদার ঔপন্যাসিকদের হাতে যেরকম ফল ফলতে থাকে অবিরাম। তাঁরা হলেন বারোমাসী ফলগাছ। বছরে হরদিনই সেসব গাছে ফল থাকে।

সত্যিকার কবিতা রচিত হতে গেলে তার মধ্যে আবেগের পরিমিত প্রকাশ ঘটতে হয়। এই প্রকাশ ঘটায় আবার ইন্সপিরেশন বা প্রেরণা। দাঁড়ালো তাহলে এই যে, যে-প্রেরণার গুত্তো খেয়ে বিষাদ, ক্রোধ বা আনন্দ জাতীয় আবেগ উসকে উঠবে, তার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সৃজিত মানেযুক্ত রচনার কবিতাবস্তু হয়ে ওঠবার অবকাশ থাকে। অর্থাৎ আবেগ যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনি অত্যাবশ্যক তার সুনিয়ন্ত্রণ। ধরা যাক, কোনো কারণে অত্যধিক ক্রোধ সঞ্চারিত হলো মনে। ঠিক তৎক্ষণাৎ একটি কবিতা রচনায় উপগত হলে এটির কবিতা হয়ে ওঠবার সম্ভাবনা লোপ পায়। ক্রোধটাকে সামগ্রিকতার ওপরে দাঁড়াবার জন্য সময় দিতে হয়, তাতে তা আর ব্যক্তিগত ক্রোধ থাকে না, হয়ে ওঠে সর্বজনীন, সাধারণ। এই সর্বজনীন ক্রোধ যদি কোনো একটি রচনা উৎপাদনের নেপথ্যে ভূমিকা রাখে, তবে তার মাধ্যমে সৃজিত রচনাটি কবিতা হলেও হতে পারে, এমনকি খুলে যেতে পারে তার সর্বজনীন হয়ে ওঠবার সম্ভাবনাও। চীনা একটি প্রবাদ আছে এরকম যে, রাগান্বিত অবস্থায় কখনো চিঠির জবাব দিতে নেই। কেন? ওই একই কারণে। নইলে যাকে জবাব লেখা হচ্ছে, তার প্রতি অবিচার হয়ে যাবার সম্ভাবনা শয়ে প্রায় শ’। রাগ প্রশমিত হয়ে যখন ব্যাপারটা সূক্ষ্ম ক্রোধানুভূতিতে রূপান্তিত হয়, তখন তার পক্ষে সম্ভব সামগ্রিক অবস্থার মূল্যায়ন করা ও মত স্থাপন করা। ওই প্রাবাদিক সত্যটা কাজেই এখানেও নিহিত।

কবিতায় তাৎক্ষণিকতার এই বিপদাপদ সম্পর্কে কবিমাত্রেরই সচেতন থাকা আবশ্যক জ্ঞান হয়। এর মানে কি এই যে সুতীব্র উন্মাদনার ভিতরে আনন্দ, বেদনা বা অন্য কোনো অনুভূতির কথা লেখাই যাবে না? না, তা নয়, একদমই নয়। লেখা যাবে। কারো কারো হাতে এভাবেও উৎকৃষ্ট রচনা বেরিয়ে আসা সম্ভব বৈকি, তবে এতে নিকৃষ্ট রচনা তৈরি হবার ঝুঁকিই বেশি থাকে বলে মনে হয়। সুতীব্র উন্মাদনাজাত রচনার খসড়াকে কবিতায় রূপ দেবার জন্য অনেক কাল ফেলে রাখাই সঙ্গত। এটা কতদিন, তার কোনো সুস্পষ্ট সীমা নেই। তবে এরকম বলা যায়, যতদিন ওই নির্দিষ্ট অনুভূতি, যা নেপথ্য কাণ্ডারি হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল, তা একটা সামগ্রিকতার ওপরে না-দাঁড়ায়, ততদিন। নির্দিষ্ট সময় পর ওই খসড়ার একটা নিরাবেগ সম্পাদনা-শাসন দরকার হয়। ঝেড়ে ফেলতে হয় তাবৎ উৎকট অবস্থা, একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। দেখতে হয়, ওই টেক্সটে কোনো কিছুই যেন ময়লা দাঁত বের করে হাসতে না-থাকে। যেন ভদ্র জনসমাগমের ভিতর দিয়ে নিবস্ত্র হয়ে হাঁটতে শুরু করার মতো কোনো ঘটনার ওটা জন্ম দিয়ে না-বসে। এক্ষেত্রে অবশ্য একটা বিপদসংঘটনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বুদ্ধির সাথে অনুভূতির একটা তুমুল ঝগড়ার মোকাবেলা করতে হতে পারে সম্পাদনাকালে। এই ঝগড়ার মীমাংসাটা কে কীভাবে করবেন তা নির্ভর করে তাঁর কাব্যরুচি, মেজাজ, বিশ্বাস ইত্যাদির ওপর। সবচে’ ভালো সম্ভবত বুদ্ধি বা অনুভূতি কারো একার হাতেই পূর্ণ শাসনভার ছেড়ে না-দিয়ে দুয়ের একটা বিবাহসম্পর্কে আস্থা রাখা।

৬.

ইমাজিনেশন হলো সংবেদন ও ধারণার মনছবি আঁকবার সামর্থ্য, যা ওই বিশেষ মুহূর্তে শ্রবণ-দর্শন বা অন্য কোনো ইন্দ্রিয় দ্বারা ধারণযোগ্য নয়। এটি তৈরি হয় বুদ্ধি ও আবেগের সংমিশ্রণে। ছবিমাত্রকেই ছবিকল্প ভাববার একটা রেওয়াজ আছে আমাদের মধ্যে। একটিও দৃশ্য বা শ্র“তিকল্প নেই এমন কবিতাও ইমেজারিতে ঋদ্ধ বলে প্রশংসিত হতে দেখা যায় হামেশা। আমরা এত যে দিলখুশ হই সহজনের প্রতি, ঘেন্না লাগে। আর অন্যদিকে চলতেই থাকে ‘যারে দেখতে নারি’র চলনকে চিরকাল বাঁকা ঠাওরানো দাপুটে বাসনার বজ্জাতি।

মন কীভাবে এসব ছবি তৈরি করে? কল্পনা দিয়ে ভেবে শব্দ দিয়ে ধরাধরির মাধ্যমে। কল্পনার সীমাটা কী? সীমা প্রায় নেই। কারণ যা পূর্বাভিজ্ঞতায় নেই এমন কিছুই মনের চোখ দিয়ে দেখা দরকার হয় ইমেজারি নির্মাণের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে শতভাগ মুক্তি দরকার হয় কল্পনার। অথবা হতে পারে পূর্বে অংশত বা অন্য আঙ্গিকে অভিজ্ঞতায় ছিল। এক্ষেত্রে রকমফের থাকছে মাত্রায়।

তো, এই মাত্রার স্বাধীনতা ভোগ কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে কি না সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। যাঁকে চরম স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে তিনি সেই স্বাধীনতাটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছেন কি না সেটা একটা সংগত বিবেচনা। অবাধ স্বাধীনতা ভোগের অধিকার লাভ করা মাত্র আমি যদি হাতিগুচ্ছকে তুড়িতে উড়িয়ে দেই আকাশে আকাশে, নদীকে পুড়িয়ে দেই মাছের যৌনতাসহ, যেহেতু কাজটা যথার্থেই সংঘটিত হওয়ার দরকার হচ্ছে না, শব্দ-বাক্যের কারসাজিতেই ঘটিয়ে দেয়া যাচ্ছে সব; দোষ কি আছে তাতে? আছে। এটা ফ্রি পেয়ে মাথার বাঁ’পাশে বাড়তি আরেকটা মাথা জুড়ে নেয়ার মতো ব্যাপার। পাঠকচিত্ত কতটা স্বস্তি পাবেন এহেন ভোগচর্চায়? এজন্য মাঝেমাঝে মনে হয়, সীমা বোধকরি এরও আছে কোথাও। যাই কল্পনা করি না কেন মানব ধারণায় তাকে সম্ভব মনে হতে হয়, অন্তত পরোক্ষে, তাহলেই কেবল সেখানে সৌন্দর্য ভর করবার ফুরসৎ পায়, অন্যথায় সৃষ্টি হয় অসামঞ্জস্যতা, যা কবিতার এক নম্বরের শত্রু।

যেখানে মনছবির প্রশ্ন, সেখানে মনই গুরু। যার মন যেরকম ছবির জন্ম দিতে সক্ষম, তিনি তেমনি আঁকবেন। পাগলামি বা উন্মত্ততার ব্যাপারটাও এখানে উল্লেখ্য। পাগলামি অনেক উৎকৃষ্ট মনছবি আঁকতে পারে, আবার এ বৈশিষ্ট্য প্রলাপেও নিপতিত হতে পারে। যিনি পাগল বা উন্মাদ, তাঁর সামনে কোনো সীমারেখা বেঁধে দেয়া যায় না, সেটা সম্ভবও নয়। মনছবি আঁকবার ওই বিশিষ্ট সময়ে তাঁর মন-মস্তিষ্ক যে অবস্থায় বিরাজ করছে, সে অবস্থারই উৎপাদন সামনে আনবেন তিনি। ওটা কদ্দূর মানুষের পারসেপশনের আওতার মধ্যে থাকল না-থাকল, সেটা পরে বিবেচ্য। তবে হ্যাঁ, একটা মাত্রার সূক্ষ্ম উন্মাদনা ভালো মনছবি আঁকবার জন্য খুবই দরকারি বিবেচ্য হতে পারে। এ অবস্থা যুক্তিশৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, স্বাভাবিক অবস্থা যে সুযোগটা মোটেই দিতে চায় না।

ঢাকা, জুন ২০০৯

মৃত্যুর আগে : জীবন খুঁজিয়া ফেরে জীবনের তল

আরো অনেক পরে জীবনানন্দ দাশ ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতায় যে বোধের প্রকাশ করেছিলেন ‘মানুষ মরে গেলে তবুও মানব থেকে যায়’, ধূসর পাণ্ডুলিপির ‘মৃত্যুর আগে’ শেষ হয়েছে মূলত সেই খবর দিয়ে। সবকিছু ফুরিয়ে যাবে কিন্তু রয়ে যাবে মানুষ... তার জন্যে আলোও রয়ে যাবে। রোদকে যদি জীবন বলে ধরে নিই আমাদের, তাদের জন্যে স্থির আলো আছে জীবনধারণের : যা কখনোই যাবে না নিভে।

‘মৃত্যুর আগে’ কাজেই নিশ্চিত মৃত্যুর ভীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখায়। মায়া বেড়ে যায় দেখা সব ছবির প্রতি। যেগুলো আবারও দেখার মতো, বারেবারে যে সৌন্দর্য ছুঁয়ে দেবার মতো। ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়ে রবীন্দ্রনাথ বইটিতে মুদ্রিত ১৭টি কবিতা ব্যাপারে সাধারণ যে মন্তব্য করেছিলেন তার দু’টো ব্যাপ্তিসম্পন্ন শব্দ বা শব্দবন্ধ কারো নজর এড়িয়ে যায় না : ‘চিত্ররূপময়’তা ও ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি এ বইতে।

দূর থেকে কবিতাটির দিকে যদি তাকানো যায় তবে মনে হবে বিশাল এক আটচল্লিশ কুঠুরীর আটতলা, প্রায় সমান খাপে যার শরীর বাঁধা। বাইশ থাম প্রতিটায় বলা যেত, কিন্তু নিচের দিকের তিন অষ্টাংশে শক্তি বাড়িয়ে নিতে প্রতিটিতে ছাব্বিশ থাম-- অথচ অদ্ভুত এই, এ স্থাপত্যে যাহা শেষে নির্মিত তাহাই মূল, যাকে বলে ফাউন্ডেশন-- ইটের তৈরি ভবনের থেকে এর পার্থক্যটা ঠিক এ জায়গায় নির্দিষ্ট।

দ্বিতীয় পাঠ

ইহা কবিতা, ইহা খাপে পুষে রাখে জীবনের গল্পসমুদয়...
ইহা কল্যাণী, আনন্দ-অদ্ভুত রঙে পুড়ে পুড়ে
সংশয়ায়িত স্তব্ধ-ঘুমে
গানেদের দেশে দেশে নির্জলে ওঠে বিকশিয়া

তাকিয়ে দেখার আনন্দ বলে একে
ভরা বাট যেন কোনো ঘোড়দৌড় মাঠ
টইটম্বুর রসে ভরা চিত্রে বিচিত্র
যাতে মাখা আছে রাশি রাশি কল্পব্যঞ্জন

এ-ও তো রূপময় বিদ্যুৎ
ঝিলিকে ঝিলিকে শুধু ঝিলকায়ে চলা
গোটা ঝিলপারে মহাধুম
জ্যোৎস্নায় সবুজের গোধুমের বনে...
ধূসর আজ ধূসরিম আরো ফিকে কুয়াশায়
কলকল গ্লানির জলধি

প্রাণ তবু গতিমান

স্থাপত্যিক নকশা করেও যদি কাজটি শুরু করা হয়ে থাকে (যদিও কবিতা কখনো এইভাবে শুরু হয় না) তবে তাতে থাম বা ইটের ব্যবহার হবার কথা ছিল (২২x৪৮)=১০৫৬টি। কিন্তু ব্যবহৃত হয়েছে সর্বমোট ১০৬৮টি। এরকম হয়েছে তিনটি কুঠুরিতে ৪টি করে ইট বেশি ব্যবহৃত হওয়ায়। এর কারণ আমরা চিহ্নিত করতে পারি কম করেও দুটো। ১. বাইশ ইটে কুঠুরি তিনটি নির্মাণে নির্মাতার অক্ষমতা। ২. কোনো সূক্ষ্ম অর্জনকে সম্ভব করতে নিজের পরিকল্পনাকে অবলীলায় ভেঙে ফেলা।

প্রথমোক্ত সম্ভাবনাটিকে আমরা শুরুতেই বাতিল করে দেব। যার শক্তিমত্তার সামনে আমরা প্রতি-মুহূর্তে থমকে দাঁড়াই; বিস্ময়াঘাতে হই ক্ষতবিক্ষত; তাকে অক্ষম বলে খাটো করাটা ঔদ্ধত্যের শামিল।

স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া তিনটি অবস্থাকে এবার একটু কাছ থেকে নিরিখ যাক--
১. যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল
২. পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর
৩. ধূসর মৃত্যুর মুখ ;-- একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো-- সোনা ছিলো যাহা
তৃতীয় পাঠ

জীবনানন্দের পাঠকমাত্র বুঝবেন যে, এই তিনটি কুঠুরিই ২২ ইটের ব্যবহারে নির্মাণ করা যেত ; এবং তা জীবনানন্দীয় ঢঙ বজায় রেখেই। আর এটা করার যৌক্তিকতাটাও সহজানুমেয়।

আটচল্লিশজনের কাতারে তিনজন বেয়াড়াকে কে আর সুচোখে দেখে। তাহলে? এই স্খলনের ব্যাপারটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় বা করা উচিত? তবে কি সত্যিই আটতলা এই ভবনের নিচের দিককার তিনতলার বিশেষভাবে নির্মিত কুঠুরিত্রয় আলাদা কোনো ব্যঞ্জনা ধারণ করে রেখেছে?

উপরদিককার পাঁচতলায় এত সরলভাবে ইট বিছানো হয়েছে যে, সাধারণ একজন আবাসিকের পক্ষেও তার গতি প্রকৃতি বোঝা সম্ভব। কিন্তু নিম্নদিকের তিনতলা, যে তিনটিতে তিনটি বিশেষ কুঠুরি সন্নিবেশিত, সেখানকার ইটের শয্যা অতটা সবুজ সহজ নয়; যেকোনো চোখের-দেখার হাত সেই মায়াবীর প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে জানবে না। উত্তর খুঁজবে, কিন্তু পাবে না। তখন তাকে নিরুত্তরেই খুঁজে নিতে হবে শান্তি।

মৃত্যুর ঠিক আগে মুমূর্ষু, মৃতপ্রায়, মরমর একটা অবস্থা থাকলেও বস্তুতপক্ষে জীবনই থাকে। জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’র ও আ-পাদ (উড়ে গেছে কাক) মস্তক (আমরা হেঁটেছি যারা) চিত্রময় জীবন। এবং তা স্তব্ধ নয়, স্থির নয়-- অস্থির এবং গতিশীল। চঞ্চল। যেন জীবন খুঁজিয়া ফেরে জীবনের তল। এমনকি বাস্তবত যার প্রাণ নেই-- তার ভেতরেও এখানে প্রাণানুভূতি বাঙ্ময় হয়ে আছে।
১. ... যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ...
...মাঠ, চাঁদ কারোরই তো আমরা প্রাণ জানি না কিন্তু এ বাক্য প্রাণ দিয়েছে দুয়েরেই।
২. খড়ের চালের’ পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার ;--
কার? তা আমরা জানতে চাই না। আমরা বরং দিব্যানুমান করি যে ইহা খড়ের চালেরই ডানা।
৩. হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা
--কে ভাবতে পারে যে এখানে আলোও জীবন্ত নয়?
৪. চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দুবেলা--
--কী বিস্ময়কর প্রাণই না ঝলকাচ্ছে এখানে জলতরঙ্গে; এবং তার সাথে সাথে চালে, যার গন্ধ (তাও আবার ধূসর, গন্ধেরও বর্ণ বিভাজন জীবনান্দকে ছাড়া কে কবে করেছে এমন?) জলকে তরঙ্গায়িত করে দিনে দু’বেলা।
৫. মিনারের মতো মেঘ সোনালী চিলেরে তার জানালায় ডাকে--
--মেঘ যেখানে বিশেষ্য, ক্রিয়া সেখানে ডাক; অথচ এ বজ্রপাতরূপী হুঙ্কার নয়, ভালোবাসার ইশারা-- যা কেবল প্রাণেই শোভন।
৬. নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বারবার তীরটিরে মাখে
অথবা
নির্জন মাঠের ভীড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে ;
--যেখানে কোনো জনই নেই, সেখানে কেমন দেখাও হচ্ছে মাখাও হচ্ছে। যেন কোনো টিনেজারের প্রসাধনপর্ব। অদ্ভুত সব প্রাণময়তা, অপ্রাণে।

চতুর্থ পাঠ

এটি যদি একটি নির্মাণ, ভবন বা বাড়ি যাই বলি, তবে তার নিচের তিন অষ্টাংশের আঠারোটি কক্ষ দখলে রেখেছে বাড়িওয়ালা, যেখানে গোটা ভবনের সব মেইন সুইচ-- তা সে পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ যা কিছুরই হোক। উপরের পাঁচতলার ত্রিশটি কক্ষে নীরিহ ভদ্রলোক ভাড়াটিয়ারা থাকে। সবার উপরে চিলেকোঠা মতো একটা জায়গা, যা ভবনটির অতি নির্মাণ, অন্য দশটি বাড়ির ভিড়ে আলাদা হবার চিহ্ন; যাকে কখনো আলাদা একটি তলা হিসেবে গণ্যই করা যায় না-- ঠিক সেখানেই চুপিসারে বাস করে মৃত্যু, ম্রিয়মাণ অতি। যার চোখ ও মুখের আকৃতি দেখেই বোঝা যায়-- এ তল্লাটে সে বেশ সুবিধে করতে পারছে না। এখানের ভাড়াটিয়ারা যতটা জীবনবাদী তাতে মৃত্যুর চিলেকোঠাবাস বন্ধই হয়ে যেত-- যদি না বাড়িওয়ালার ছেলেপুলেদের সাথে তার অল্পবিস্তর বন্ধুত্ব থাকত।

পেকে ওঠা বিষফোঁড়ায় কণ্টকাঘাত : কিছু পুঁজ, কিছু দুর্গন্ধ

বিনয়ভূষণ আর নয়

মানুষ হিসেবে যিনি বেশ বিনয়ী ও সজ্জন-- এই সমাজব্যবস্থায় হঠাৎ করেই তিনি নিজেকে বড়ো ধরনের সমস্যাগ্রস্ত বলে আবিষ্কার করে বসতে পারেন। তখন যারা তাকে এতদিন বিনয়ী বলে প্রশংসা করেছিলেন, তাদেরকেই সমস্ত সর্বনাশের মূল বলে মনে হতে পারে। এসব ইতিউতি প্রশংসার প্রভাবে মানুষের ক্ষেত্রে বিনয় একটি বিরল গুণ মনে করে বেচারা বিনয়ীরা অস্ত্রহীন ঢুকে পড়েন শ্বাপদসংকুল জনারণ্যে। পরে তিনি বুঝতে পারেন, বাহ্য বেশভূষায় একটু আলাদাত্ব থাকলেও ‘জন’ ও ‘শ্বাপদ’ অনেক সময়ই প্রায় অবিকল গুণপনা রাখে; কথা বলে, হাগে-মুতে একই কায়দায়। বানরদেরও যে ময়ুরপুচ্ছ থাকতে পারে, ভালো মানুষ হয়ে সেটা সবসময় বুঝতে পারা যায় না বস্তুত।

এ প্রজাতির বানরেরা, সুযোগ পেলেই জনের ছদ্মাবরণে নিকটে এসে দশাসই পোদ মেরে ফার্লংখানি দূরে দাঁড়িয়ে যেভাবে দাঁত কেলায়, তাতে পোদাঞ্চল প্রতিরোধে সবিশেষ ব্যবস্থা সম্পন্ন করে অস্ত্রভাণ্ডারকে সহজোন্মোচনযোগ্য উপায়ে ঢেকে সদাপ্রস্তুত হয়ে থাকা ছাড়া বেচারা বিনয়ীদের এখন আর কোনো গত্যন্তর নেই-প্রায়। প্রয়োজন হলেই যাতে জিপার টেনে পোদাভীপ্সায় কাতরদের চোখমুখ লক্ষ্য করে জোরসে মুতে নষ্টজলের বান নামিয়ে দেয়া যায়, সেরকম রেডিমেড ব্যবস্থা সম্পন্ন করে রাখাটাই এখন জরুরি। নইলে এ ভবসংসার বেচারাদের কাছে অসহনীয়রকম তিক্ত অভিজ্ঞতায় দীর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

ছোটোকাগজ বিক্রির পয়সা ঠকান যেসব পুস্তক ব্যবসায়ী প্রকৃতপক্ষে তারা সাহিত্যের শত্রু। মনে রাখা জরুরি যে, সাহিত্যকে ভালোবেসে তারা এ ব্যবসায় আসেন নি, তারা এমনকি জুত বুঝলে চামড়ার ব্যবসাও করবেন। লেখকদের মধ্যেও এরকম গোবেচারা আছেন, থাকেন। পুরানো খোলস ঝেড়ে তাদের এখন নতুন করে জেগে ওঠবার কাল আসন্ন। এ না-হলে লেখালেখি করতে এসে নিজে তো বটেই বাপদাদা চৌদ্দগোষ্ঠীসহ ভুল করেছে-- এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে খাতা-কলমের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে এফডিসিতে গিয়ে এক্সট্রা হবার জন্য চেষ্টা করাটাই তাদের শেষোদ্ধারের একমাত্র পথ হয়ে যেতে পারে। যে লেখালেখির জন্য সমতল ও সহজহাঁট্য বহু রাস্তা রেখে বেচারা দীর্ঘদিন বন্ধুর পথে পদচারণা করেছে, যার জন্য নিজের ও নিকটজনের কাড়ি কাড়ি বঞ্চনাকে মাথা পেতে নিতে হয়েছে, তাকে পরিত্যাগ করে কেনই বা একজন হাতে পেরেক ঠুকতে যাবে? পর্বতচূড়ায় উঠে আকাশ না-ছুঁয়ে একজন নামবে কেন-- ও স্থান তো কারো বাপের একার নয়! কেউ কেউ অবশ্য সব স্থানকেই নিজের বা তার বাপের বলে মনে করে। পা ফাঁক করে বেদখল দিয়ে রাখে অন্যের হাঁটবার সমস্ত পথ, কিংবা গোপনে পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখে।

সাহেব কহেন...

বাংলাদেশে যৌনকর্মীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন আছে, আছে ভিখিরির-- নেই কেবল লেখকের। সেজন্য যারা সাহিত্যের খেদমত করে খান-দান, তারা বনে গেছেন দেবতাস্য দেবতা। তাদের যখন যা ইচ্ছে, তারা তা-ই করেন। করেন, করতে পারেন বলেই। ট্রেড ইউনিয়ন না-থাকলে কারখানাভ্যন্তরে শ্রমিকগণ যেভাবে মালিক-কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ব্যবহৃত হতে বাধ্য হন, লেখদের শক্তসমর্থ মেরুদণ্ড কিংবা ঐক্য কিংবা আন্দোলন কোনোটাই না-থাকায় তারাও দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক ও তথাকথিত ছোটোকাগজের সম্পাদক কর্তৃক যখন-তখন যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহৃত হন। কোনো কোনো লেখকের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় যে এভাবে ব্যবহৃত হতে পারায় তারা বরং পুলকই অনুভব করেন। যেন ব্যবহৃত হবার জন্যেই তাদের জন্ম ও যাত্রা। যেন চোখেমুখে মোসাহেবি একটা ভাব ঝুলিয়ে দেহরক্ষীর মতো সর্বক্ষণ সাহিত্য সম্পাদকের লেজে ঝুলে থাকাটাই লেখক জীবনের চরম ও পরম সার্থকতা।

এবার একটু খুলে দেখি চলুন

অনেক আগে (৩০ মে ১৯৯৭) লেখা চেয়ে দ্রোণাচার্য সম্পাদকের পাঠানো এক চিঠির জবাবে একটি কবিতার খসড়া করেছিলাম, শেষপর্যন্ত সেটি ডাকে দেয়া হয় নি। পরবর্তী সময়েও কোনো কাগজে ওটি ছাপার কথা ভাবি নি। লেখাটি লিখতে পেরেই মনের ঝাল অনেকখানি মিটে গিয়েছিল। সুতরাং চুপ মেরে গিয়েছিলাম। ঘন ঘন যখন একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে এবং যখন এ বিষয় নিয়ে একটি লেখা লিখব বলেই মনস্থির করেছি, তখন মনে হচ্ছে চলতি প্রেক্ষিতের সাথে সম্পর্কসূত্র বিবেচনা করে ওই লেখাটিকে এখানে অস্ত্র হিসেবে ছুড়ে দেয়াও যেতে পারে।
একটি ঠোঁটকাটা কবিতা কিংবা শিমুল আজাদের কাছে খোলা চিঠি

শিমুল আজাদ আপনাকে জবাবি লিখছি
শিমুল আজাদ আপনাকে কুশল জানাচ্ছি
শিমুল আজাদ দ্রোনাচার্যে লেখা পাঠাচ্ছি

শিমুল
আজাদ
লেখালেখিতে আপনার চরিত্র কী
দ্রোনাচার্যের উদ্দেশ্য কী
রক্তাক্ত প্রজন্মের মেনিফেস্টোটা কী
এসব আমাদের
(আমার
অন্যদের
দ্রোনাচার্যের লেখকদের...)
জানা থাকা দরকার
জানাবেন

দ্রোণাচার্য আমার ভালো লাগে না
--উহা লাল কালিতে ছাপা হয়
--উহা বিজ্ঞাপনের ব্যবসা করে
--উহা বাজারিদের লেখা ছাপে
(আশিক-মোস্তাক-শুভঙ্কর এরা কী ভাবেন)

শিমুল
আজাদ
আপনি গ্রাফিত্তিতে যান আবার টিভিতেও
আপনি লিটল ম্যাগে যান আবার দৈনিকেও
আপনি টুপি পরেন আবার পৈতাও

যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা আপনি
যেদিকে স্বার্থ সেদিকে ঝোল আপনি
যেদিকে প্রসাদ সেদিকে পুরোহিত আপনি
আপনার কাগজে আমি পুষ্পিত হতে চাই না

আপনি বিবরের লেখা নিয়ে দ্রোনাচার্যে ছাপেন
লেখকগণ তা জানেন না
আপনি দ্রোণাচার্যকে প্রজন্মের মুখপত্র বানান
লেখকগণ তা জানেন না
আপনি লেখকগণকে ব্যবহার করেন
তারা তা জানেন না

আমি নিয়মিত লিখে থাকি
তবু দ্রোণাচার্যের জন্য আমার কোনো লেখা নেই
আমার প্রচুর অপ্রকাশিত লেখা আছে
তবু দ্রোণাচার্যের জন্য আমার কোনো লেখা নেই
অপ্রকাশের ভার আমি সইতে পারি না
তবু দ্রোণাচার্যের জন্য আমার কোনো লেখা নেই

আমাকে মাফ করবেন আর এ কবিতাটা দ্রোণাচার্যে ছাপবেন
আমাকে মাফ করবেন আর এ কবিতাটা দ্রোণাচার্যে ছাপবেন

লক্ষ করুন

লেখাটির যেখানে যেখানে শিমুল আজাদ নামটি আছে সেখানে সেখানে শহিদুল ইসলাম কিংবা শামীম রেজা কিংবা জামিল আকতার বীনু কিংবা অন্য কোনো নাম এবং যেখানে যেখানে দ্রোণাচার্য আছে সেখানে সেখানে দৈনিক যুগান্তরের শুক্রবারের সাময়িকী কিংবা দৈনিক আজকের কাগজের সুবর্ণরেখা কিংবা কথকতা কিংবা অন্য কোনো পত্রিকার নাম পড়লে প্রতিক্ষেত্রেই এটি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। এই লেখাটির প্রাসঙ্গিকতাকে আমরা উসকে দিতে চাই দিকে দিকে, আমাদের এবং অন্যদের জন্য।

নিজের দিকে ঝোল টানা

মানুষের জীবনটা হলো ক্রমশুদ্ধাভিযান। যারা গোড়া মতাদর্শ নিয়ে বিশুদ্ধ ছোটোকাগজের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে লেখালেখি শুরু করেছেন এবং সময়-সুযোগে ফাল দিয়ে বড়োকাগজের ডালে ডালে বাদুড় হয়ে ঝুলে পড়েছেন, তাদের থেকে কারো কারো গমনপথটা ঠিক বিপরীত দিকে প্রসারিত। এরা যেখান থেকে চ্যুত হয়েছেন, অন্য একজন সেখানে আসীন হবার চেষ্টাটাই চালিয়ে যেতে পারেন দেহেমনে। একের পরিত্যক্তটা অন্যের কাম্য হতেও পারে। এখানে কোনো অপমান লুকিয়ে আছে মনে করার কারণ নেই। এটা মনে হয় শুদ্ধাশুদ্ধি ধারণায় পার্থক্যের কারণে। আমাদের এবং আমাদের যৎপরোনাস্তি লেখালেখির জন্য স্বল্পায়োজনের এ দীর্ঘ যাত্রাপথটিই যথোপযুক্ত ও সঠিক। আপাতক্ষুদ্র এ টেকসই পথপরিসরে ব্যাপক স্বাধীনৌজ্জ্বল্য জ্বলজ্বলায়মান। নির্মোহতায় ব্যাপ্ত যে শুদ্ধিসম্ভাবনা, মোহগ্রস্ততায় হতে পারে তার বিপুল বিনাশ।

যারা দমবন্ধকর বিশাল প্রান্তর থেকে শ্বাসস্বস্তিপ্রদ ছোট্ট আঙিনায় এসে দাঁড়ান বা দাঁড়াতে চান, যারা ঝকমারির বিপরীতে ভালোবেসে সৃষ্টি করে নেন স্বয়ম্ভূ আড়াল-- উভয় মতাদর্শীয়রাই তাদেরকে জানতে-বুঝতে বরাবর ভুল করেন। তারা প্রায়শই অন্যদের স্বজন হিসেবে পরিগণিত হন না কিংবা অন্যরা তাদের, যদিও একই ধরনের চাষবাসে নিমগ্ন বলে আনেকের সাথেই মোলাকাত হয় পথেপ্রান্তরে। সমসময়ের লেখক হয়েও অন্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হয় যে কারণে টক-ঝাল-মিষ্টি, ‘পথে হলো দেখা’ জাতীয়।

অভিজ্ঞতা, আতংক এবং সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ

একজন নিষ্কলূষ কিশোরীকে পতিতা বানাবার জন্য আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘৃণ্যপ্রয়াস যেরকম বিরামহীন, মুক্তবাণিজ্যের যুগে সবাইকে বাজারি লেখক বানাবার জন্যও কতিপয় সম্পাদকের সেরকম চেষ্টার কমতি নেই, লক্ষ করি। পূর্বাদর্শচ্যুতদেরও গোপনে এতে ইন্ধন ও সহযোগিতা থাকে। কে না জানে এসব অন্যায়। নারীর অধিকার যেমন মানবাধিকার, লেখকাধিকারও তেমনি। অথচ অনেক লেখকই সে অধিকার লঙ্ঘনের শিকার। এখন এসব অধিকারলঙ্ঘনৈতিহ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোটা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেটা এজন্যে যে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করবার মানসিকতাসম্পন্ন সম্পাদকের চ্যালারা এরপর এমনকি নিজেরাই একখানা যাচ্ছেতাই লেখা লিখে অন্য কারো নামে ছাপিয়ে রাখবে বাজারমাৎ কোনো কাগজে। পাঠকগণ একদিন হয়ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করবেন যে গল্পকার সেলিম মোরশেদ কিংবা কাজল শাহনেওয়াজ কিংবা তপন বড়ুয়া কিংবা কামরুল হুদা পথিক কিংবা সরকার আশরাফ কিংবা রোকন রহমান কিংবা রবিউল করিম কিংবা শেখ লুৎফরের নামে কোনো গল্প অথবা ফারুক সিদ্দিকী কিংবা শোয়েব শাহরিয়ার কিংবা আহমাদ মিনহাজের নামে কোনো প্রবন্ধ হাজারটা ভুল বাক্যে সমাচ্ছন্ন হয়ে আজকের কাগজের অপরিচ্ছন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে ফুটে রয়েছে। অথবা হয়ত দেখা যাবে যে শান্তনু চৌধুরী কিংবা স্বদেশ বন্ধু সরকার কিংবা শোয়েব শাদাব কিংবা বিষ্ণু বিশ্বাস কিংবা শরিফ শাহরিয়ার কিংবা আহমেদ নকীব কিংবা শাহেদ শাফায়েত কিংবা ঈশান জয়দ্রথ কিংবা আশিক আকবর কিংবা মজনু শাহ কিংবা মোস্তাক আহমাদ দীন কিংবা জ্যাকি ইসলাম কিংবা মাসুদ আশরাফ কিংবা সুহৃদ শহীদুল্লাহর নামে কোনো কবিতামতো লেখা আনন্দ নগর, একদিন প্রতিদিন, ইসলাম ও জীবন এবং অজস্র বিজ্ঞাপনে ল্যাপ্টানো যুগান্তর সাময়িকীতে মুদ্রণপ্রমাদসহ শোভা পাচ্ছে। এমনকি এ-ও অবিশ্বাস্য নয় যে এরা প্রয়াত কবি সাবদার সিদ্দিকী কিংবা শামীম কবীরের ভাবমূর্তিকেও বাজারকাষ্ঠে বলি দিয়ে বসতে পারেন। এ আতংক এখন রাত পোহাতে একবার, দিন ফুরাতে আরেকবার জাগে। কারণ উল্লিখিতগণ শ্রেণীতে সংখ্যালঘু। বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিতে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বসেছে বলেই এ ভীতিটা এখন বেশি করে পাত্তা পাচ্ছে।

লেখকের অনুমোদন ব্যতিরেকে তার কোনো রচনা ছেপে দেবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা এখন আমরা লিখেই জানাচ্ছি, পরে প্রয়োজনে চিৎকার করে জানাব। এ ইস্যুতে সমর্থন থাকলে অন্যেরাও আমাদের এ চ্যাঁচনযজ্ঞে শামিল হবেন, না থাকলে হবেন না। সেক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প নীতিপন্থা ‘একলা চলো রে’।

আরো একটি গণবেদনা

কাগজের নাম উত্তরপুরুষ। সম্পাদক হামিদ রায়হান। জানুয়ারি ২০০২-এ প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছে। প্রত্যেকেই মানবেন যে শুধু কবিতা বিষয়ক গদ্য কাগজের বিশেষ প্রয়োজন আছে, যেরকম কাগজের সংখ্যা আমাদের দেশে শূন্যের কোঠায় পরিগণিত। কবিতা বিষয়ক গদ্যের কাগজ করবার কথা নিজে অনেক ভেবেছি, করতে পারি নি। শেষপর্যন্ত অন্যের হাতে যদিও বা হলো-- আশান্বিত হবার কোনো কারণ ঘটে নি। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, এ কাগজটি কোনো জাতেই পড়ে না।

এটি বাদ দিয়ে কাগজটিতে কোনো শিক্ষণীয় ছিল না যে, কোনো আলোচনায় লেখকের বিনানুমতিতে তার কোনো রচনা অংশত বা সম্পূর্ণত উদ্ধৃত করার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা জরুরি। যারা বইয়ে এরকম ঘোষণা যুক্ত করে দেন তারা ভালোই করেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতাটি এক্ষেত্রে খুব তিক্ত।

উত্তরপুরুষ-এ মুদ্রিত একটি লেখায় আমার রূপকথা নামধেয় একটি কবিতা অংশত উদ্ধৃত হয়েছে (কবিতা-- প্রসঙ্গ কিংবা অনুষঙ্গ, সমকালীন কিংবা দূরকালীন : মাহবুব হাসান), যে কবিতাটি আমার সবেধন গ্রন্থ মমি উপত্যকাভুক্ত। কবিতাটির ওপর ওখানে কী মন্তব্য করা হয়েছে, সে ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। আমার বলার হলো এই যে, ওই উদ্ধৃতাংশের প্রশ্রয়ে ব্যাপক প্রমাদ সংঘটনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কবিতা রূপকথাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়েছে, যে অধিকার কোনো সম্পাদকের থাকতে নেই। উদ্ধৃতিতে কবিতার পঙক্তি ও স্পেসবিন্যাসেও সম্পাদক বেশ সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছেন। প্রমাদ সংঘটনের মাধ্যমে ‘ঘুমমত্ত’কে ‘ঘুমন্ত’ বললে না হয় অর্থগত কোনো বিভ্রাট ঘটে না কিন্তু যদি ‘ঘাসস্থান’কে ‘বাসস্থান’, ‘শুলে’কে ‘শুনে’ এবং ‘রোদন’কে ‘রোপন’ (আসলে হবে রোপণ) লেখা হয়, তখন সে কবিতায় কিছুই থাকে না বস্তুত। বরং কবি শুদ্ধ বাক্য রচনা করতে পারেন কি না এ নিয়েই সংশয় তৈরি হয়। এসবের ভিতর দিয়ে বুঝে-না-বুঝে লেখকের বিশেষ ক্ষতি করা হয় বলেই আমাদের মনে হয়।

মুদ্রিত হবার পর প্রমাদের আধিক্য দেখে কাগজ সামনে নিয়ে কেঁদে ফেলবার ইচ্ছা আমার মতো আরো অনেক লেখকেরই জেগেছে-- আমি জানি। ছররা গুলির মাধ্যমে নির্বিচারে পাখিহত্যা করে শিকারির যেরকম আনন্দ, লেখকদের এভাবে যন্ত্রণা দিয়ে কোনো কোনো সম্পাদক সেরকম আহ্লাদই বোধ করেন মনে হয়। বিপরীতে লেখকগণ কষ্টে জর্জরিত হয়ে গোপনে কাঁইকুঁই করেন। গোপনে করেন এজন্যে যে সমাজে তাদের সাপোর্ট নেই-প্রায়, তারা অনেকের চোখেই না-জাত, কুত্তার বাচ্চা আর সম্পাদকরা তাদের মা-বাপ। এ অবস্থা ঘুচানো যেতে পারে কেবল লেখকদের মধ্যে কোনো চলমান আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা গেলে। প্রয়োজনই যেকোনো আবিষ্কারের নেপথ্য সূচনাবিন্দু। প্রয়োজন যখন দেখা দিয়েছে, আজ-কাল-পরশু সেটা হবে আশা করি।

এ ধরনের ঘটনার শিকার আমরা হামেশাই হই। এখানে ভূতপূর্ব গুণধরের মতো ‘এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না, এবারই প্রথম তুমি’ বলবার কোনোই জো নেই। যে কারণে কোথাও কোনো প্রান্তরে পুষ্পিত হবার অফার এলেই আগে জেনে বুঝে দেখা দরকার-- প্রান্তরটা কেমন প্রশস্ত ও খোলামেলা, মাটিটা কেমন ধাঁচের, চাষীরা কেমন, কেন্দ্রীয় চাষী বপনপ্রণালি ঠিক বোঝে কি না ইত্যাদি। এ তো গেল স্বেচ্ছায় নিজের লেখা ছাপতে দেবার পূর্ব বিবেচনা কিন্তু কেউ কারো লেখা ভুলভাবে উদ্ধৃত করলে সেটা ঠেকানো কী করে? এখানে তো কাগজ সম্পর্কে প্রাক জরিপের কোনো অবকাশই থাকে না। সম্পাদকগণ কি এক্ষেত্রে লেখকদেরকে কোর্টাভিমুখে চালিত করতে চান নাকি? কপিরাইট আইন বলে কি এদেশে কিছুই নেই?

সিকদার আমিনুল হককে একটি উপদেশ

যে কাগজ ভাষার শুদ্ধ ও সঠিক প্রয়োগের ব্যাপারে নিজেরাই শ্রদ্ধাশীল নয় এবং অতি প্রায়শই যেখানে ভুল বাক্যের দেখা মেলে-- সেখানে অন্য কারো লেখা বাক্য ভুল প্রমাণ করতে যাওয়ার ফল হিতে বিপরীত হয়।

শিঁরদাড়ার প্রথম সংখ্যায় মুদ্রিত

খ্যাপা হাওয়ার ঢেউ উঠেছে চিরব্যথার বনে

শুদ্ধাভিযান একটা তপস্যা, প্রার্থনাতুল্য নৈমিত্তিক ক্রিয়া। সদ্যপ্রয়াত সংস্কৃতিসর্বজ্ঞজন ওয়াহিদুল হক আজীবন এই শুদ্ধাভিযানেই ব্রতী ছিলেন। সে অভিযানের উচ্চতা ছিল গান, সুর, উচ্চারণ, আচরণ, ক্রিয়া থেকে শুরু করে মানুষ হওয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত এবং যার ভূগোল ব্যাপ্ত ছিল আপন থেকে পর অবধি। অর্থাৎ নিজে শুদ্ধ হবার সাধনাই শেষ নয়, শুদ্ধ মানুষ বানানোও তাঁর জীবনাভীষ্টের অন্তর্গত ছিল। সারা বাংলার প্রতিটি প্রান্ত ছিল তাঁর সম্ভাব্য মানুষ খোঁজার ক্ষেত্র এবং সেই ক্ষেত্রের সম্ভাবনাময় অঙ্কুরগুলোকে অ্যাকোম্পানিমেন্ট সাপোর্ট বা সহগ সহায়তা দিয়ে, চিটা নয়, ধাপে ধাপে সোনার ফসল বানিয়ে তোলা ছিল তাঁর সাধনা। এহেন জাতশুদ্ধ ভ্রামণিক সাধকজন সম্পর্কে একজন অশুদ্ধাচারী জীবমাত্রের কিছু বলবার চেষ্টাকে তাঁর স্বহস্তে বানানো হাজার হাজার নারী-পুরুষ (মানুষ) কীভাবে গ্রহণ করবেন, তা ভেবে আমি সংশয়ান্বিত। কিন্তু যেহেতু তাঁর বিহনে হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষের মতো আমারও মনের বনে খ্যাপা হাওয়ার চিরব্যথার ঢেউ গেয়ে উঠেছে, তাই কিছু না বলাটা ব্যক্তি আমার জন্যে প্রশান্তিদায়ক নয়। এই সহেতু-প্রচেষ্টা কেবল এজন্যেই।

কিন্তু কী বলব আমি তাঁকে নিয়ে ? এটা, যে, তাঁর নিবিড় সংস্পর্শ পেয়ে এক জীবনে শুদ্ধ হওয়া হলো না আমার ? এটা, যে, তাঁর লেখায়-বলায় অনুভূতি প্রকাশে বাংলাভাষার উচ্চাঙ্গের ক্ষমতা প্রকাশিত ও প্রমাণিত হয়েছে ? এটা, যে, শুধু বেঁচে থেকে নয়, মরেও তিনি মানুষের কাজে লেগেছেন ? কিংবা এটা, যে, তাঁর মৃত্যুর পরের আনুষঙ্গিক ক্রিয়াদি, ‘ইসলাম’ রাষ্ট্রধর্ম ঘোষিত একটি দেশে চরম এক বিপ্লবের প্রতিধ্বনি ?

ঢাকা শহরে, নিকটে অবস্থানসূত্রে, যতটা তাঁর সংস্পর্শে যাওয়া জরুরি ছিল, ততটা যাওয়া আমার হয় নি। কিন্তু যতটা তাঁকে পাওয়া হয়েছে, তার মূল্যও অপরিসীম। যদিও সে পাওয়া, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমার শুদ্ধ হবার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। এক জীবনে এই অপ্রাপ্তি নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে।

আমরা দেখেছি, যত না তিনি লিখতেন, বলতেন তার চে’ অনেক বেশি, বলতে হতো বলে। আর এই বলা এতটাই শুদ্ধ উচ্চারণে এবং মৌলিক কেতায় যে, শ্রোতারা তা অমৃতের মতোই গিলত। আমিও গিলেছি আর ভেবেছি, মানুষ এক জীবনে এমন অজস্র গুণ লাভ করেন কীভাবে ? বাকপটু মানুষ ম্যালাই আছে আমাদের চারপাশে। তাঁরা এমনকি সম্মোহনও জানেন। তবে বলতে একদমই দ্বিধা নেই যে, তাদের অনেকে বাকসর্বস্ব। বাকে অর্থসারত্ব আছে এমন বাকপটু মানুষ আমাদের চারপাশে খুবই কম। ভাবি, অন্তত সারগর্ভ তাঁর সব আনুষ্ঠানিক কথামালারও যদি লৈখিক রূপ থাকত, কালপরম্পরায় উপকৃত হতে পারত বাঙালি জাতি। ৭৪ বছরের কর্মময় জীবনে তাঁর মাত্র তিনটি গ্রন্থ-- গানের ভিতর দিয়ে, চেতনাধারায় এসো এবং সংস্কৃতি জাগরণের প্রথম সূর্য ; এবং একটিমাত্র অ্যালবাম-- সকল কাঁটা ধন্য করে। অথচ তাঁর অর্ধেকমাত্র বয়সে কারো কারো ডজন দুয়েক গ্রন্থেরও রেকর্ড আছে আমাদের দেশে। এত কম লিখতেন কেন তিনি? লেখার চেয়ে বলায় স্বাচ্ছন্দ্য বেশি পেতেন বলে? এ প্রশ্নের প্রকৃত জবাবটি কী তা তাঁর মুখ থেকে জানার সুযোগ আমাদের আর নেই। আমরা এখন ধারণা করতে পারি মাত্র।

দৈনিক জনকণ্ঠ ও ভোরের কাগজে তিনি যে কলামগুলো লিখেছেন, অচিরেই আমরা সেগুলোরও গ্রন্থরূপ হয়ত দেখব-- কিন্তু বলতেই হবে যে, এসবের ভিতর দিয়ে তাঁর জানাশোনার এক রত্তিও আমরা ধরে রাখতে পারি নি ভবিষ্যতের জন্য। আমাদের প্রকাশকরা যদি কেবল ব্যবসায়কেই বড়ো করে না দেখতেন, তবে তাঁকে দিয়ে তাদের মাধ্যমে আরো কিছু লিখিয়ে নেয়া হয়ত সম্ভব ছিল। কোন বিষয়ে তাঁর বিশেষায়িত জ্ঞান না ছিল ? ভাষা (বাংলা ও ইংরেজি), সাহিত্য, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, শিল্পতত্ত্ব, চারুকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, দর্শন, নিসর্গ, রাজনীতি, ইত্যাদি ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয় ; এবং এসব বিষয়ে তাঁর প্রভূত পাণ্ডিত্য ছিল বলে সর্বজনে একটা স্বীকৃতিও আছে। অথচ এই জানাশোনার সিংহভাগই আমরা ২৭ জানুয়ারি ২০০৭-এর অপরাহ্ণ বেলায় চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। তাঁকে আরো প্রয়োজন ছিল বাঙালি সংস্কৃতির, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের, সংগীত ও থিয়েটারের, নির্যাতিত ও নিপীড়িতের, মানুষ-আধামানুষ-ঊনমানুষের। কাজেই এই প্রয়াণ, আমাদের, বাঙালি জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি।

ব্যাপক জানাশোনার ছাপ থাকত তাঁর প্রতিবার বলায়, প্রতিটি লেখায়। বলতেই হবে, ভাষার অতিশয় মজবুত কিন্তু স্বচ্ছ এক নিজস্ব গাঁথুনি আছে তাঁর প্রতিটি গদ্যের। ওই গদ্যের স্তরে স্তরে অর্থ স্থাপন করা। আর অর্থগুণেই বিশেষ মনোযোগ দাবি করে সেসব লেখা। কিন্তু তাঁর লেখা বিষয়ে অলস ও অমনোযোগী পাঠকের অনেক নিন্দামন্দও স্বকর্ণে শুনতে হয়েছে আমার। তাদের অভিযোগের মূল প্রতিপাদ্য হলো বুঝতে না পারা। ওই একই ধরনের অভিযোগ আমার নিজের লেখা নিয়েও অনেকে করে থাকেন। কাজেই আমাকে সেসব অভিযোগের প্রতিবাদ করতে হয়েছে প্রেমবশত যেমন, তেমনি আত্মরক্ষার্থেও। ওয়াহিদুল হকের গদ্যে আমি বরাবরই বিশেষভাবে মুগ্ধ। ওই মুগ্ধতা, আমার চর্চার ঘর-গেরস্থিতেও হয়ত জায়গা করে নিয়েছে। হতে পারে তাঁর গদ্যরচনার বিরল মুন্সিয়ানার কোনো প্রভাব আমার গদ্যশৈলী সঙ্গোপনে ধারণ করে থাকবে।

আমরা সবাই জানি, তাঁকে ধর্মীয় রীতিতে দাফন করবার সুযোগ তিনি নিজেই রেখে যান নি। চোখ দু’টো মৃত্যুর পরপরই চলে গিয়েছিল সন্ধানীর চক্ষু ব্যাংকে, তাঁর ইচ্ছেমতো। দেহটাও, তাঁরই ইচ্ছেয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে নিবেদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাবতে কেমন লাগে, যে, সদাভ্রাম্যমাণ তাঁর বহুদর্শী চক্ষুদ্বয় অন্য কাউকে আলো বিলাবে, দেখতে পারার ক্ষমতা যার রহিত অথবা রহিত হবার উপক্রম! ওই চোখ কি তাঁর দেখা বাংলাদেশের রূপছায়া ধরে রেখেছে কোথাও? এবং এহেন দেখাদেখির ভিতর দিয়ে দর্শনজাত যে জ্ঞান, তাও কি ওই চক্ষুদ্বয়ে কোনো-না-কোনোভাবে সংস্থিত আছে?

চিকিৎসাবিজ্ঞান এরকম বলে না, কিন্তু কবিকল্পনায় এরকম ভাবতে ভালো লাগে যে, সেই একজন কেউ, অথবা দু’জন, যে বা যারা তাঁর চক্ষু পরবেন, তারা তাঁর মতোই অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবেন। করুন, সেটা বাংলাদেশের জন্যে খুবই দরকারি।

আমরা দেখেছি, মৃতের সৎকারে ধর্মীয় যাবতীয় আচারকে উপেক্ষা করে কেবল কবিতা ও গানে গানে তাঁর প্রতি বিদায়াঞ্জলি নিবেদিত হয়েছে। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম এমন একটি দেশে এটি সত্যিকারার্থেই একটা বিপ্লব। আমাদের জানামতে, এটি এ ধরনের দ্বিতীয় বিপ্লব। ২৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৯৯-এ প্রয়াত প্রগতিশীল প্রাজ্ঞজন ড. আহমদ শরীফের বেলায়ও অনুরূপ ইতিহাস স্থাপিত হয়েছিল। মাত্র গতবছর সংঘটিত একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুঘটনার পরবর্তী ক্রিয়াদিতেও আমরা একটি নীরব বিপ্লব দেখেছিলাম, এই ঢাকায়ই। নারীনেত্রী নাসরীন হকের জানাজায়। তাঁর বেলায় জানাজা হয়েছিল ইসলামি কেতায়, কিন্তু একই জানাজায় পুরুষের পাশাপাশি অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও। বাংলাদেশে এরকম ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলা জানা যায় না। ওয়াহিদুল হকের কোনো জানাজাই হয় নি, যেমন হয় নি আহমদ শরীফের বেলায়। মৃতের শিয়রে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভিনদেশী ভাষায় পারাপারের মন্ত্রপাঠের জন্যে কাউকেই ওখানে ডাকা হয় নি। তার বদলে একের পর এক নিবেদন করা হয়েছে তাঁর প্রিয় যত রবীন্দ্রসংগীত, জাতীয়সংগীত তক এবং কবিতা। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রানুরাগী সংগীতান্তঃপ্রাণ-- একাধারে শিল্পী, শিক্ষক, পরিচালক এবং বিশেষজ্ঞ। তাঁর শবদেহকে ঘিরে এই আয়োজন কাজেই যথোপযুক্ত। তাঁর আত্মা (যদি থেকে থাকে কোথাও) এতেই শান্তি পেয়েছে, ধারণা করি। বিষয়টি এদেশের প্রেক্ষিতে অনেক বড়ো করে দেখবার ও দেখাবার আছে। এ কারণে যে, হাইব্রিড কায়দায় ধর্মান্ধতার বিষ অজস্রাজস্র মানুষকে আক্রান্ত করলেও এদেশে এখনো এরকম মানুষ অনেক আছেন, যাঁরা ধর্মাচারের চেয়ে বড়ো করে জাতিত্বকে দেখেন, দেখে স্বস্তি পান এবং তাকে উচ্চে তুলে ধরেন। বারডেমের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সামনে, ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে, শহীদ মিনারে, প্রেসক্লাবে এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত শোকসভাসমূহে-- সেসব মুখেরই দেখা মিলেছে। এঁরাই একদিন ধর্মীয় মৌলবাদকে ঠেকাবে। ধর্মান্ধতার বিকাশের বিরুদ্ধে এঁরাই সেই শক্ত দেয়াল। বাহ্যিক সাম্প্রদায়িক রূপচেহারাধারী এদেশ যে আদৌ সাম্প্রদায়িকতাসর্বস্ব নয়, এ ঘটনা তারই সাক্ষ্য হয়ে রইল।

আমরা যারা নতুনতর, তারা আজকাল রবীন্দ্রনাথকে পড়া-শোনা-দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি অথবা কখনোই আমরা চেষ্টা করি নি আমূল রবীন্দ্রনাথকে জানবার-বুঝবার-- প্রগতিবাদিতার আমাদের নানাবিধ ভান আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কর্মকে চর্চা, আমরা জানি, শেষ বয়সেও তিনি ছাড়েন নি। যতদিন গেছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তিনি আরো বেশি করে আসক্ত হয়েছেন। তাঁর যে জীবনদৃষ্টি তার অনেকটাই রবীন্দ্রনাথ-উৎসারিত, অনেকে বলেন। রবীন্দ্রনাথের গানকে, গানের মহিমাকে সকল প্রাণে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টার তাঁর অন্ত ছিল না। ছায়ানটের অন্যতম কাণ্ডারি তিনি ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকের রবীন্দ্রবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে অন্য অনেকের সঙ্গে যে লড়াই করেছিলেন, সে লড়াই রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীতের শুদ্ধতার প্রশ্নে, কাজী নজরুল ইসলামকে অবিকৃতভাবে চর্চার প্রশ্নে, বাঙালি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে তিনি জারি রেখেছিলেন আমরণ।

রবীন্দ্রনাথের গান শুদ্ধ করে তিনি নিজে গাইতেন যেমন, চাইতেন অন্য সকলেও তাই করুক। ছায়ানটের মাধ্যমে তো বটেই, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের মাধ্যমেও এই শুদ্ধতার মন্ত্র তিনি ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন দেশময়। আজ জয়পুরহাট তো কাল তিনি ফরিদপুরে, পরশু কুমিল্লায় তো তরশু ময়মনসিংহে। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও তিনি কারো আহ্বান ফেলেন নি কখনো। যেখানেই সম্ভাবনাময় সংগীতানুরাগী পেয়েছেন, সেখানেই তাকে হাত ধরে দীক্ষা দিয়েছেন শুদ্ধতার অভিযানে। এ প্রসঙ্গে তাঁর প্রতি একটি নিন্দাপ্রস্তাব উত্থাপনেরও সুযোগ আছে। সেটি এই যে, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কর্মাদর্শ বিষয়ে তিনি বরাবরই খুব গোঁড়া ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলা ও ভাবাদর্শের কোনো ধরনের নেতিবাচক মূল্যায়ন তিনি একদমই বরদাশত করতেন না বা করতে পারতেন না। কারো কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের নির্দিষ্ট স্বরলিপি অনুযায়ী সুর-তাল-লয়ের কোনো খেলাপ হলে, গায়কীতে অর্থানুগ প্রাণ প্রতিষ্ঠা না পেলে কখনোই তাকে ছেড়ে কথা বলতেন না তিনি। আমাদের চারপাশের প্রতিজন মানুষ আলাদা সময়সংস্কৃতি ও পরিপার্শ্বে বেড়ে ওঠেন। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় তাই মানুষে মানুষে বিশেষ ফারাক থাকে। জনে জনে এজন্য রুচি, বিবেচনা ও সৃজনাভীষ্টও আলাদা। সুতরাং এটি ভাবা একান্তই গোঁড়ামি যে, সবাই বিনাপ্রশ্নে সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে যথাযথভাবে নিতে পারবেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নে সবাই তাঁর মতো করে ভাববেন এটা আশা করা অসঙ্গত। কিন্তু তিনি, ওয়াহিদুল হক, সারাজীবন ধরে রবীন্দ্রনাথকে চর্চা করে, সবটা বুঝে বা না বুঝে, তাঁর জানাটাকেই প্রকৃত জানা ভেবে, সর্বদাই একটি অধিকার বোধ থেকে কথা বলতেন। তর্কে-বিতর্কে কারো মন্তব্য তাঁর থেকে অন্যরকম হলে সবার সামনে না হোক আলাদা ডেকে নিয়ে হলেও তিনি এ মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করতে ছাড়তেন না যে, কতটুকু পড়েছ-শুনেছ তুমি তাঁকে (রবীন্দ্রনাথকে)?

সারাদেশে বিভিন্ন বয়েসি যে হাজার হাজার শিষ্যসাবুদ ও ছাত্রছাত্রী রয়ে গেছে তাঁর, তাদের মাধ্যমে তিনি অনেকদিন বাঁচবেন। বাঁচবেন ছায়ানট দিয়ে, বাঁচবেন কণ্ঠশীলন, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ব্রতচারী সমিতি, নালন্দা, শিশুতীর্থ, আনন্দধ্বনি, প্রভৃতি সংগঠন দিয়ে। সংগঠন গড়া ও নিবিড় পরিচর্যা দিয়ে তাকে স্বাস্থ্যবান করে তোলার অসাধারণ এক গুণপনা ছিল তাঁর। আর এর মূল লক্ষ্যই ছিল শুদ্ধ মানুষ গড়া। সে চেষ্টা যে তাঁর বৃথা যায় নি, বাঙালি সংস্কৃতি আন্দোলনে ওয়াহিদুল হক সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের তাৎপর্যপূর্ণ অব্যাহত কর্মকাণ্ডই তার সাক্ষ্য দেয়।

নগরজীবনের খাঁচায় বদ্ধ বাঙালি এতদিনে ভুলে যেতে পারত তার সংস্কৃতির অনেককিছুই। এই মহানের কর্মকাণ্ড অতটা ব্যাপ্ত না হলে পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের অবশ্য আয়োজন, বসন্ত উৎসব, বর্ষা উৎসব ইত্যাদি থেকে শুরু করে রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পর্যন্ত যাবতীয় আয়োজনের কী হতো কে জানে! এখানে তাঁর সহকর্মী অন্য কাণ্ডারিদের মোটেই খাটো করে দেখা হচ্ছে না, তাঁরাও সমানভাবে স্মরিত-বরিত। তবে ওয়াহিদুল হকের যুক্ততা এসব কর্মকাণ্ডে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে, সন্দেহ নেই। নাগরিক বাঙালিকে বাংলার রূপ-রস-গন্ধ উপহার দিয়ে তিনি বাঙালিত্বকেই বড়ো করে তুলে ধরতে চেয়েছেন সবার ওপরে। বাঙালি যে সংস্কৃতিহীন দীনমাত্র নয়, তার মূল যে ছড়িয়ে আছে এ ভূমির অনেক গভীরে, তাই যেন প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করে যাচ্ছে এসব কাণ্ডকীর্তি।

আমরা সবাই জানি, মুক্তিযুদ্ধে কালচারাল ফ্রন্টের সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের অন্যতম তিনি। একাত্তরে সেই যে তিনি শত্রু চিনেছিলেন, তাদের আর কখনো মিত্র বলে জানেন নি। চিনতে ভুল করেন নি নব্য শত্রুদেরও। এদের বিরুদ্ধে অক্লান্ত যুদ্ধ করে গেছেন লেখায়-বলায়। যাকে শত্রু বলে জানতেন, তার/তাদের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই খুব কঠোর থেকেছেন। লক্ষণীয় যে, সাংবাদিক-কলামিস্ট ওয়াহিদুল হকের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু যে বা যারা ছিল, আমরা দেখেছি, তারা অতি প্রায়শই দেশ ও দশের শত্রু। অর্থাৎ তাঁর এই কলমযুদ্ধ নিছক মনের ঝাল মেটানো ছিল না, ছিল দেশের জন্য লড়াই।

ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষে তাঁর অবস্থানে তিনি বরাবরই অটল ছিলেন। দেশের যেকোনো স্থানে যখনই কোনো সাম্প্রদায়িক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে কোনো সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ, অচিরেই তিনি তার প্রতিকারের পথ খুঁজেছেন, কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন, অন্যদের সাথে সে স্থানে গিয়ে নির্যাতিতের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এটি কম বড়ো কথা নয়! বিভিন্ন সময়ে এদেশে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে, অমানুষদের সেসব নিন্দনীয় কর্মকে ঠেকাবার জন্যে একদল মানুষ যদি সর্বদাই সক্রিয় না থাকত, তাহলে ধারণা করি, এতদিনে মুসলমানের বাইরে অন্য কোনো জাতি-ধর্মের মানুষ এদেশে নির্বীজ হয়ে যেতে পারত। ভাগ্যিস তাঁরা ছিলেন। আজও তাঁরা আছেন। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একজন ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুতে ওই দলের একজন মানুষ মাত্র কমে গেলেন। তাঁর গড়ে তোলা শুদ্ধ-আধাশুদ্ধ-ঊনশুদ্ধ মানুষের সবাই ওই মানবিকজনদের সারিতে যুক্ত হয়ে অমানুষদের কর্মকাণ্ড ঠেকাতে আরো বড়ো দেয়াল গড়ে তুললে গুরু ওয়াহিদুল হকের প্রতি তাদের যথাশ্রদ্ধাই প্রকাশ পাবে বলে মনে করি।

থিয়েটারওয়ালায় মুদ্রিত

জীবনানন্দের পাঠকপ্রিয়তা প্রসঙ্গে

সময়ের সবাইকে ছাড়িয়ে জীবনানন্দ দাশের যে চূড়াস্পর্শী উত্থান আজ পাঠকমাত্রেরই কাছে স্বীকৃত, সেটা নিজের করে পাওয়া তাঁর জন্যে মোটেই অনায়াসসাধ্য ছিল না বলে মনে করি। অপরিমেয় প্রতিভার রোশনাই ঝলকিত তিনি এমন একজন সৃজনকর্মী, যাঁর হৃদয়ে কল্পনা এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা ছিল এবং তার পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে বয়ে আসা সভ্যতার যাবতীয় সুনন্দনপ্রভা আর তার সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ সাহায্য করেছিল। এর মাধ্যমে যে ধন তিনি আহরণ করেছিলেন তা অবশ্যই শ্রমলব্ধ। কারণ বিগত শতাব্দীর কিংবা সমসময়ের বিশুদ্ধ কাব্যবিকীরণ দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত হতে গেলে উচ্চতর বিচারবোধ-সম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী কারো যে শ্রম সন্নিপাত করতে হয়, তা যেকোনো রকম শ্রমধারণার সাহায্যে ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। অবশ্য এই অব্যাখ্যাত শ্রমযোগ হলে যে-কেউই যে তা পারবে না, তা-ও তো উল্লিখিত আছে তাঁর সুবিখ্যাত প্রবন্ধ ‘কবিতার কথা’তেই। সেজন্য হৃদয়ে থাকতে হবে কল্পনা আর কল্পনার ভিতরে গিয়ে ছাপ ফেলতে হবে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তার। কেবল খটখটে চিন্তার ব্যায়াম কবিতা নয়, জীবনানন্দ তা-ও পরিষ্কার করেই বলে রেখেছেন।

সেটা ছিল এমন এক সময়, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশাল এক মহীরুহের ন্যায় প্রতিভাত হচ্ছিল তরুণ-অতরুণ উভয়তের কাছেই। বিশ্বজয়ী এই রবীমহানের ছায়ায় কোনো প্রশান্তি ছিল না, এটা এখনকার প্রেক্ষিতে যেমন সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় নি; পায় নি তখনো। কিন্তু রবীন্দ্রসাহিত্যের অতলান্তিক বোধোৎসারী বিশালায়তনের যে প্রবাহস্রোত, তার থেকে বাইরে এসে আরো আরো নতুন স্রোতোপথ তখন আবিষ্কৃত হওয়ার দরকার ছিল। কেবলি একমুখে প্রবাহিত হওয়া, একই পথে বারবার, জলের যেমন ধর্ম নয়; নতুন করে কিছু যাঁরা সৃজন করতে আসেন, নয় তাদেরও। নতুন যা আসে, আসে ঝড়ের মতোই। দুমড়ে মুচড়ে দিতে আসে সবকিছুকে। যা অগ্রহণযোগ্য তা তো বটেই, যা গ্রহণযোগ্য তারও গায়ে তখন লেগে যায় এমন কিছু ঝাঁকি; মনে হতে পারে যে এ বুঝি বিশালের প্রতিও এক অশ্রদ্ধা বা অবমাননা। কিন্তু যিনি বিশাল তিনি তাঁর স্ববিশালতা দিয়েই বুঝতে সক্ষম হন যে, এ এমনই এক সত্য, যা তাঁর নিজের জন্যে আপাত অশনিমতো বোধ হলেও, প্রার্থিত এবং ইতিবাচক। নতুনের বচনাচারে যে চমক থাকতে পারে, তাকে তো রবীন্দ্রভাবনাও নবতর প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ফলে তাঁর জন্যে তখন যা করবার ছিল, তা হলো এই নতুনতরদের স্বাগত জানানো এবং নিজের সৃজনক্ষমতার প্রকাশ যথারীতি অব্যাহত রাখা। মহত্তম রবীন্দ্রনাথ তাই করেছেন। সবসময় যে নতুনের সবটাকেই গ্রহণ করেছেন এমন নয়। তেমনটা না-হওয়াই যৌক্তিক।

যাঁরা এলেন নবরূপে, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই কম বেশি সশ্রদ্ধ ছিলেন বিশাল এই মহীরুহের প্রতি। কেউ কেউ একাধটু ইয়ে ধরনের ছিলেন বৈকি! যাঁরা নিজেরা এখন ক্রমশই মলিনতার দিকে ধাবিত। কী নির্মম এক সত্য এ! অথচ বিস্ময়কর মনে হয় যে, যিনি আজ কবিতাপাঠক মাত্রেরই কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রতি সেই জীবনানন্দের শ্রদ্ধার গভীরতা ছিল অন্যদের চেয়ে কিছুমাত্রায় বেশি। স্বতন্ত্র একটা জগৎ গড়বার পাশাপাশি তিনি এই প্রবীণ বটবৃক্ষকে খুব যত্নের সাথেই নিরিখ করছিলেন। তাঁকে নিয়ে লিখছিলেন একের পর এক রচনা। ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে তাঁর রয়েছে ছয়-ছয়টি কবিতা এবং তিন-তিনটি প্রবন্ধ। সংখ্যাটা অনেকের কাছে বেশ বাড়াবাড়ি রকমেরও মনে হতে পারে। কিন্তু এই-ই ছিল সত্য, যেখানে নতুন ও আধুনিকদের প্রধান চেষ্টাটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের ছায়াপ্রভাব থেকে বাইরে বের হয়ে আসা এবং প্রাণভরে শ্বাস নেয়া, নতুন পথ নির্মাণ করা। কিন্তু নতুন পথ নির্মাণ করতে হবে বলেই পুরানো পথ-মাত্রকেই ঘৃণায়-উপেক্ষায় সর্বদা এড়িয়ে যেতে হবে, স্পষ্টতই এর কোনো মানে নেই। খুঁজে পান নি জীবনানন্দ দাশও। নিজের পথ নিজে ঠিকই গড়ে নিচ্ছিলেন এবং পুরানো পথের দিকে তাকিয়েও দেখছিলেন কেমনভাবে সেই এগিয়ে যাওয়া। কেমন সেসব একেকটা চারু-পদচ্ছাপ। কারণ তাঁর নতুন পথের শেষ, আকাশমুখী কোনো অনির্দিষ্ট গন্তব্যে তিনি খুঁজতে চান নি। রবীন্দ্রনাথ নামটিকে আলো-করা যে কাব্যবিকীরণ, নিজে বেড়ে ওঠবার জন্যে তার নৈকট্যও অত্যাবশ্যক জ্ঞান করেছিলেন তিনি। ক্রমশ মানবান্তকরণের সেই যে গভীর থেকে গভীরতর দেশে জীবনানন্দের ক্রমপ্রবেশপ্রেষণা সে কি কোনোভাবে রবীন্দ্রনাথের থেকেই খুঁজে পাওয়া? কবিতা, রবীন্দ্রনাথের, আজো পঠিত হয়। যদিও তাঁর কবিতার পাঠক ক্রমহ্রাসমান অবশ্যই। দূরত্ব তাঁর সঙ্গে আমাদের নানাভাবেই বাড়ছে বৈকি। কিন্তু তবু, তাঁকে, এখনো পাঠকপ্রিয় না-বলে রক্ষে তো নেই। জীবনানন্দের পাঠক ক্রমবর্ধমান। আজ অবস্থাটি এরকম একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, কারো মালিকানায় তাঁর সমগ্র বা সংগ্রহ জাতীয় কিছু না-থাকা লজ্জারই ব্যাপার বলে মনে করা হয়। একজন কারো কবিতা এতবেশি সংখ্যক পাঠক পড়েন, এটা বুঝি এই উত্তর-আধুনিককালে জীবনানন্দই প্রমাণ করলেন। কী দুর্দান্তরকম জনপ্রিয়তা তাঁর, উচ্চতর-নিম্নতর সবরকম কবিতা-পাঠকের কাছে!

সুধীন দত্তকে এখন ক’জন পড়েন, আর ক’জন জীবনানন্দকে? এ সংক্রান্ত একটি তুলনায় গেলে বিশাল এক ফারাক পরিলক্ষিত হবে-- এটা আমরা জানি। সুধীন্দ্রনাথ ভালো কবি নন, এটা প্রমাণ করবার জন্যে আমরা এখানে প্রয়াস করছি না। তাঁর অতি অল্পসংখ্যক নেতিবোধ-জর্জরিত দুর্ভেদ্য-দুর্গ-সদৃশ কবিতার বিরুদ্ধে সমকালে যে কাঠিন্যের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, আজ তাঁকে সেভাবে দেখবার অবকাশ অনেকটাই কমে গেছে। পরবর্তী সময়ে আমরা নতুনতর আরো দুর্ভেদ্য কবিতাকে ভেদ করবার প্রয়াস করে করে এমনতর অভিজ্ঞ হয়েছি যে, ওগুলোকে এখন আহামরিরকম প্রস্তর-কঠিন আর বোধ হয় না। কিন্তু কথা সেখানেও নয়, আমরা বলতে চাই যে মানবান্তকরণের যে জায়গাটি স্পর্শ করলে পাঠকের মনোপরিসরে প্রায় চিরস্থায়ী একটি জায়গা তৈরি হয়ে যায়-- সে স্থানটিকে নিশ্চয়ই সুধীন্দ্রনাথের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ বেশি করে চিনতে পেরেছিলেন। এই যে আত্মীয়তা, এটিকে শনাক্তকরণের জন্যে আমাদের তাকাতে হবে সে কোন সম-সাধারণ গুণপনার দিকে, যা আমরা সুধীন্দ্রনাথ দত্তে বা বুদ্ধদেব বসুতে বা বিষ্ণু দেতে বা অমিয় চক্রবর্তীতে পাই না? আজ এমন একটি প্রশ্নের জায়গায় উপনীত না-হয়ে আমাদের আর চলছে না। আমরা যাঁরা আরো আরো নতুন পথ খুঁজে হন্যে হচ্ছি সামনে এগোবো বলে, এ মিলনবিন্দুটি চেনা থাকলে তা কথিত ওই পথসন্ধানীদের জন্যেই মঙ্গলকর হবে না শুধু, হবে আগামী সময়ের কবিতা-পাঠক এবং কবিতারও। কিন্তু কে এই ভারতীয় কাব্যবেদনের আকুপাংচার-সদৃশ প্রকৃত মৌলবিন্দুটিকে চিহ্নিত করে দেবেন, যে-বিন্দুটিতে নিহিত আছে প্রবলভাবে জনপ্রিয় হবার কারণসমুদয়; যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে আগামী সময়ের কাব্যকার্যমালা? একজন কেউ অন্তত যদি মন থেকে বলতেন যে ‘আমি’, বড়ো আশান্বিত হওয়া যেত।

ইতিউতি প্রবাহনা

কবিতা সর্বংসহা এটা মানি, তা সবকিছুই ধারণ করতে পারে, কিন্তু যিনি কবি তার একটা নিজস্ব ঢং দাঁড়িয়ে যায়, আর একেক ঢং একেক ধরনের বক্তব্য ও শব্দকে বেশি ডিমান্ড করে, ফলে কবির যতো কথা বলার থাকে তা তিনি বিশেষ ঢং দাঁড়িয়ে যাওয়া তাঁর কবিতায় বলে নাও ওঠতে পারেন, তখন জরুরি হয়ে পড়ে কবিতার ঢং বদল করা অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে কাজ করা। প্রত্যেক কবিরই কবিতার নিজস্ব ঢং দরকারী। একবার নিজস্ব ঢং বা স্বর আবিষ্কার করবার পর কেউ সেটা বর্জন করতে নাও চাইতে পারেন। তখন বিকল্প পথ থাকে, মাধ্যম পরিবর্তন। এই পরিবর্তন মানে চিরদিনের জন্যে পরিবর্তন নয়। একটি মাধ্যম ছেড়ে অন্য মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে আর কোনোদিনই তিনি ছেড়ে আসা মাধ্যমে কাজ করবেন না তা নয়। অবশ্য নতুন করে শুরু করা মাধ্যমটিতে যদি কেউ দেখেন যে পূর্বের মাধ্যমের চাইতে ভালো ফল উঠছে তবে তিনি ফিরে না-এলেও তেমন কোনো ক্ষতি নেই। বরং ফিরে না-আসাই উচিত। কবি হয়েও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যে কারণে ফিল্ম তৈরি করেন, রবীন্দ্রনাথ শত শত ছবি আঁকেন, অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারটা আলাদা, এ ভদ্রলোকের জন্মই হয়েছিলো সব মাধ্যমে কাজ করবার জন্যে, একটা কোনো বিশেষ মাধ্যমে নয়। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সর্বোচ্চ ফল পেয়েছেন।

হ্যাঁ আমার ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা ঘটে, এবং প্রায়শই, প্রতিদিন কতো কিছুই যে বলবার থাকে আমার, কিন্তু কোনো একটা সময়ে আমার ভেতরে যত বোধ কাজ করে, তার সবই একটা কোনো মাধ্যমে পুরে দিতে পারি না আমি, প্রয়োজন হয়ে পড়ে অন্য মাধ্যমের, কিন্তু অত প্রতিভা কোথায় আমার, আমি তো প্রতিভাহীন, তবু এ রকম ভাবি যে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী, ওরা তো পারে, আঁকিবুকি করতে করতে যদিই বা হয়ে যায় কিছু, আমি জানি চাইলেই সবাই সবটা পারে না, বিশ্বসাহিত্যে ক’জন আর সব্যসাচী আছেন। রবীন্দ্রনাথ কী আর ঘরে ঘরে, কালে কালে জন্মান, জন্মান যে না এটাও আমি জানি, জেনেও চেষ্টা করি করে উঠতে, আমি কালজয়ী হতে পারলাম কি না এ বিচার করে কাজ করলে চলে না, আগে তো কাজ তারপর জয় পরাজয়, ফলে আমি ওটা মেনে কাজ করে যেতে চাই প্রচুর, পাঁচটা করব হয়ত একটিতেও সফল হবো না, হয়ত একটিতে হবো, হয়ত দু’টিতে... হয়ত বা সবকটিতে, আশা করতে দোষ নাই, আমি যদি আশাই করি যে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বা সজনীকান্ত হবো, তাহলে তো আর রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দকে ছোঁয়া যাবে না, আশা এরকম যে আমি রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ থেকে বড়ো হবো, তাহলে অন্তত...

রবীন্দ্রনাথের মতো কখনো কখনো আমিও চেয়েছি যে ছবি আঁকি, কেননা তাঁর মতো আমিও তো পাণ্ডুলিপি কাটাকুটি করি, তিনি যদি পাণ্ডুলিপি কাটাকুটি করতে গিয়ে এতবড়ো শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, আমি কেনো পারব না, এই সাহসেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি ছবি আঁকবার চেষ্টার দিকে কিন্তু সে চেষ্টায় ব্যত্যয় ঘটাতে লেগেছেন রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ শোভন সোম, সম্প্রতি তিনি গ্যালারী-২১ এ আয়োজিত এক সেমিনারে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানালেন যে, আদৌ রবীন্দ্রনাথ পাণ্ডুলিপি কাটাকুটি করতে গিয়ে ছবি আঁকা শুরু করেন নি, একটা প্রচার এইমতো রয়েছে যে, লিখতে গিয়ে বুড়ো বয়সে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেছেন, কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো এই যে ভাষা-সাহিত্য শিক্ষার পাশাপাশি সেই শৈশব-কৈশোরেই রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শিখেছেন নিজ গৃহে, অথচ আমি শৈশবে তো দূরের কথা কৈশোরেও কোনো চিত্রশিল্পীকে সচক্ষে দেখি নি, এ হিসেবে দেখলে আমার হতাশ হবার যথেষ্ট কারণ আছে, তাছাড়া আর যে কাজেই পটু হোক আমার হাত, অন্তত ছবিতে সে পটু নয়, একথা এতদিনে বুঝে গেছি, তবু গোয়ার্তুমির বশেই এখনো দু’একবার চেষ্টা করি না তা নয়। একেবারে হতাশ আমি হতে জানি না, রবার্ট ব্রুসের ওই গল্পটা আমি জানি, এজন্যে বারবার চেষ্টা করি, করে যাব, কারো মন না-পাওয়া গেলেও ঘৃণাটা তো পাওয়া যাবে, এটাও তো একধরনের পাওয়া, যাকে ভালোবাসবো তার আঘাতটাও ভালোবাসতে হবে এবং লুফে নিতে হবে, এরকম যারা বিশ্বাস করে আমি সে দলেরই লোক, আমার কাজেই একটা কিছু হবে, হতেই হবে, একবার তো চিঠিতে এক বান্ধবীকে কল্পনার নারীমুখ এঁকে পাঠিয়েছিলাম, পাঠানোর পর সে নিয়ে যে আমি কত লজ্জায় পড়েছিলাম তা বলে বোঝানো যাবে না, ওকথা মনে হলে এখনো আমি রীতিমতো ঘেমে যাই, চিঠিতে সে বান্ধবীও প্যাঁচিয়ে ঘুরিয়ে একথা বলতে ছাড়ে নি।

আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে চিঠি আঁকতাম আমি, ছবিও লিখতাম। কিন্তু সে এখন আমার নিকটাঙিনায়ই থাকে বলে তার কাছে চিঠি আর পাঠাতে হচ্ছে না। সুযোগ পেলে ওকে কখনো ওগুলো দেখাব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি মনে মনে। কিন্তু তবু এসব ছবিকে ছবি বলবার স্পর্ধা আমার হয় নি। আর তাছাড়া দেখাবার দরকারই বা কী! অজস্র ছবি আঁকব আর ছিঁড়ে ফেলে দেব। শিল্পের পণ্য হয়ে ওঠবার বিরুদ্ধে গোপনেই ইনস্টলেশন করে যাব। আমি কবিতা নিয়েও তো কতবার ভেবেছি এরকম। লিখব আর ছিঁড়ে ফেলে দেব। এ যাবৎ ছিঁড়েছিও কি কম! তবু যে পরিমাণ কবিতার পাণ্ডুলিপি জমেছে, এসব শেষ পর্যন্ত নষ্ট না করে উপায় তো নেই। না-হয় গোটা জীবনে একটা বা দু’টো কাব্যগ্রন্থ হলো আমার। এত কবিতার স্থান সংকুলান তো আর দু’টো বইতেই হয়ে যাবে না। এগুলো অগ্রন্থিত অবস্থায় রেখে আমি যদি মরে যাই তো আমার ছেলেকে বড়ো ধরনের বিপদে ফেলা হবে। এ যুগে যেখানে নিজের দায় মেটানোই কষ্টকর, সেখানে মৃত বাপের সৎকার করবার ঝক্কিটা ওর উপর কেন রেখে যাব। তাছাড়া ছেলের সারাজীবন বসে খাবার মতো পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ তো আর আমি রেখে যেতে পারব না। তখন ছেলেটার জীবনটা হয়ে উঠবে দুঃসহ। লোকজন বলবে এমন তাগড়া ছেলে বাপের জন্য কিছুই করল না। অথচ একবার ভেবে দেখবে না যে ওর সামর্থ্য সেটা ওকে করতে দিচ্ছে কি না। আমার একমাত্র ছেলেকে আমি যথাসম্ভব ভালোবাসি। ওর জন্যে আমি কোনো যন্ত্রণা রেখে যাব না যতদূর ভাবি।

কখনো বলার কথাগুলোকে কাগজে উগরে লক্ষ করেছি যে, লেখাটিকে একটি গল্প বলেও ফেলা যেতে পারে, প্রচলিত গল্পধারণার সাথে যদিও তার খুব একটা মিল গড়ে ওঠে নি, তা না উঠুক, শিল্পের কি কোনো সর্বজন মান্য সংজ্ঞা আছে না কি যে ওই ছাঁচে পা ফেলে সামনে এগুতে হবে? এখন আমি যেটাকে গল্প বলব তা এখনকার পাঠকরা না-ও গ্রহণ করতে পারেন, যেটাকে গল্প বলব না সেটাকে কেউ হয়ত বলবেন চমৎকার গল্প। শিল্প-সাহিত্যে এটাই রেওয়াজ। ‘চন্দ্রাবতীর কয়েকজন সন্তান’-এ মুদ্রিত আমার কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দুলাল ভাই (ফরিদ আহমদ দুলাল) ওতে গল্প আবিষ্কার করেছেন। পরবর্তীসময়ে আরেক আলোচক (মাসুদুল হক), যিনি ‘চন্দ্রাবতী..’ পড়েছিলেন, তিনিও দুলাল ভাই-এর মূল্যায়নটি ওখানে কোট করে দিলেন। দ্বিতীয়োক্ত আলোচক অবশ্য নিজের আবিষ্কারও যোগ করেছেন। হ্যাঁ, ওই কবিতায় একধরনের গল্প তো আছেই, গল্পের মুখ-হাত-পা, ঝলক। তিনি তা আবিষ্কার করতে পেরেছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। তা বলছিলাম গল্প-অগল্প ব্যাপারে। এই যে, কোনো কোনো লেখা লিখে মনে হয় এটা গল্প, গল্পের মতো যা দেখায় না আদৌ, আমি যদি কোনোভাবে সিদ্ধি পেয়ে যাই তবে এসব নিয়ে প্রচুর কাড়াকাড়ি হবে। তখন লোকজন তর্ক করবে আমাকে উদ্ধৃত করে, বলবে যে, মুজিব মেহদী বলেছেন কবিতা এরকম, গল্প এরকম ইত্যাদি। আমার বক্তব্য হলো এই যে, কবিতায় কিছু কথা আমি ঠিক বলতে পারছিলাম না, যাকে অন্তত আমি কবিতা বলি। কিংবা ব্যাপারটা আদৌ সেরকমও না। আমার কিছু কথা বলা দরকার হয়েছিল, কাগজে কলমে আমি তা বলেছি এবং বলার পর লক্ষ করেছি যে, এটি আমার কবিতা নয়, এটিকে আমি বলব গল্প। এখানে এই কথাটি সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক শোনাবে না যে, আমার গদ্যভাষা পদ্যভাষার দূরত্বটা হাজার মাইলের নয়। তারা যে এক বাপেরই বীর্যজাত তা তাদের নাক-মুখ-ত্বক দেখে প্রায় বুঝেই ফেলা যায়। সে কারণে কখনো কখনো তো এমনও ভেবে বসি যে, আমি যা লিখছি তা কবিতাও না গল্পও না, অন্যকিছু। অথবা স্রেফ রচনা বা লেখা। গল্প বা কবিতার প্রধান ভূমিকা হলো তা পাঠকের অনুভূতির জায়গাটা ছুঁয়ে দেবে, এ কাজটা যদি আমার লেখা সম্পন্ন করতে পারে তবেই হয়। তার চরিত্র বিভাজনটা সেক্ষেত্রে অতটা দরকার মনে করি না আমি। আমার লেখা বেঁচে থাকলে পরবর্তী পাঠক-আলোচকগণ এসবের নাম দেবেন, ছাঁচে ফেলবেন। কোনো ছাঁচের সঙ্গে না-মিললে বলবেন ওসব ছিল মৌলিক ও নতুন কোনো রচনা।

আমি ভেবে দেখেছি যে একজন লেখকের কথা বলবার সর্বশেষ আশ্রয় হলো চিঠি, যা অন্য কোথাও বলা যায় না, তা চিঠিতে বলা সম্ভব। প্রচুর চিঠি আমি লিখেছি জীবনে এবং আরো লিখতে চাই। লক্ষ্য পত্র-সাহিত্যে উত্তরণ। এজন্যে যে, লক্ষ্যটা এতবড়ো না-হলে অর্জনটা হয়ে যাবে যথেষ্ট ছোট। অতটা ছোট অর্জন আমার চাই না। কিন্তু চিঠির একটি সীমাবদ্ধতা হলো এই যে, এটি একাকী সাধনযোগ্য নয়। দুলাল ভাইয়ের একধরনের চিঠি আছে শুনেছি, যা তিনি নিজের কাছে লিখেন। এ ধরনের একটি চিঠি আমরা (আমি আর পলাশ চৌধুরী) ছেপেওছিলাম অবয়ব-এ। এরকম আমি পারি না। জিজ্ঞাসা না-হলে উত্তর আসে না আমার। অন্তত প্ররোচনাটা লাগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে। অন্যদের কাছে লিখলে ওর যে জবাব পাওয়া যায়, তাই-ই আর একটি চিঠি লেখতে ইন্ধন দেয় আমাকে। পত্রসাহিত্য রচনা করে ওঠবার জন্যে এমন অনুঘটক দরকার আমার। একজীবনে কতজন তেমন পত্রবন্ধু খুঁজে পাওয়া যায়, যাদের সঙ্গে জমে ওঠতে পারে শিল্পিত বিনিময় কথা বা তর্কমালা? মোস্তাক আহমাদ দীন আমার তেমন একজন পত্রবন্ধু। বেঁচে থাকলে ওর কাছে আমি অজস্র চিঠি লিখব। কিছুদিন আমি যাচ্ছি না ওর সঙ্গেও দীর্ঘ কোনো কথামালায়। আমি অর্ধেক মরে গেছি বলে। জানি, আমি আবার বেঁচে উঠব, তখন আবার শুরু হবে কথালাপ, শিল্পালাপ।

জন্মগতভাবে আমি একটি উপন্যাসের বীজ বহন করছি হাড়ে হাড়ে। যা হবে খুবই মৌলিক ও ডিমান্ডেবল। কিন্তু এটির জন্যে আমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। ঠিক কতদিন পর আমি ওটি রচনা করে উঠতে পারব তা নির্ভর করছে আমি ও আমার চারপাশে সংঘটিত বিষয়-সংশ্লিষ্ট ঘটনা-প্রবাহের ওপর। ওটি লিখে ওঠবার আগে যদি আমি সত্যি সত্যি মৃত্যুবরণ করি তবে বাংলা উপন্যাস-সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এ অর্থে যে ওটি হবে উপন্যাস হিসেবে খুবই নতুন। আমি না-লিখলেও আরো আরো নতুন বিষয় নিয়ে লিখিত হবে উপন্যাস। তবে আমি যেটি লিখব বলে ঠিক করেছি, সেটি অন্য কেউ লিখবেন না কোনোদিনই। এমনকি লিখতে পারেবেনও না। অন্যজনের মতো যেমন আমি পারি না, তেমনি আমার মতোও পারবেন না অন্য কেউ। একজন কখনো আরেকজনের বিকল্প নয়।

দিনপঞ্জি লিখি আমি গদ্যে ও পদ্যে। রাত জেগে জেগে। সততার সাথে বলি যে, ওটি কেবলই আমার জন্যে। যা আমার আয়না, যাতে আমার যাপিত মুহূর্তগুলি শব্দবন্দি। কোনোদিন যে কথা আমি অন্য কোথাও বলে নাও ওঠতে পারি, তাই-ই এখানে বলা থাকছে। মহাকাল যেগুলো পড়বে গুরুত্ব দিয়ে, পড়তেই হবে। হা আমার কষ্টাক্রান্ত লেখক-জীবন! হা আমার প্রিয়তম প্রতিদিন! এগুলো যদি মহাকাল পড়বে না তো আমাকে খুঁজে পাবে কোথায়! এত বিশ্বস্ত কথন আর কোথাও নেই জগতে, ডায়েরি যতটা বিশ্বাসের সীমানা ছুঁয়ে লতিয়ে ওঠে কাগজভূমিতে। (খসড়া)

৫ ডিসেম্বর ’৯৬, গোলকিবাড়ি রোড

ছোটতুচ্ছ প্রেমগুলো বড়োর বেদনা

আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাব দুটোই করতে পারি
দুঃস্বপ্নের পিচুটি পরিষ্কার আর তৃষ্ণা মেটাবার জন্যে
ব্যবহার করতে পারি জল দু’রকমভাবে-- শোক ও শান্তিতে
ব্যবহার করতে পারি মদ দু’রকমভাবে-- আমি

আমি মানুষ একজন, ফাল্গুনী রায়
প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু আমি লিখি। আমাকে মানে আমার জীবন ও পরিপার্শ্বকে। তোমাকে মানে তোমার জীবন ও পরিপার্শ্বকে। তাকে মানে তার জীবন ও পরিপার্শ্বকে। অর্থাৎ কি না আমার-তোমার ও তার আনন্দ-হতাশা-বিষাদ এবং সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের স্বপ্নমালা, সৌন্দর্যকে আমি যেমনভাবে বুঝি, তেমন শৈলীপ্রণোদনার সযত্ন-প্রলেপ দিয়ে আবছা করে জাগিয়ে তুলি। আমাদের বেঁচে থাকাকে, বেঁচে থাকার সংগ্রামকে আমি মনের আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে যাই। ছুঁয়ে আনন্দ পাই। আপন বোধ করি। এই আমি-তুমি ও তারা মিলিয়ে ছোট ছোট যাদেরকে আমি লিখি, এদের বাইরে যারা থাকে তারা বড়ো। শ্রেণিগতভাবে তারা আমার স্বগোত্রীয় নয়। এদের আনন্দ-হতাশা-বিষাদ বা স্বপ্ন আমার লেখার ছাঁচে এঁটে ওঠে না কিংবা এঁটে ওঠার মতো হলেও আমার অক্ষমতা বা অনাগ্রহের কারণে আঁটানো হয়ে ওঠে না। তারা দৃশ্যত ও অদৃশ্যত আমার পর। জাগ্রত অবস্থায় পর, এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায়ও। তারা আমার দুঃখ বোঝে না বা আনন্দ। আমার অভিমান বোঝে না বা অবসাদ। আমার যৌনতা বোঝে না বা শৃঙ্গারলিপি। এমন না-বোঝাবুঝির মনোদূরত্বে তারা যতই দামি কার্পেট পেতে রাখুক তাদের দুয়ারে যেতে আমি ভরসা পাই না। যতই পিঠ চাপড়ে দিক আহ্লাদে গদগদ হয়ে বর্তে যাই না। সেটা পারি না কারণ সন্দেহ আমার পিছু ছাড়ে না। আশংকা হয়, পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে একসময় ওরা হাত মারবে আমার মধ্যপ্রদেশে। শ্রেণিআক্রোশে গালিয়ে দিবে আমার অণ্ডকোষজোড়া। তাই আমি শত্রুজ্ঞানে ওদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকি। থেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

তো, এই আমার দাঁড়াবার বা বসবার জায়গা কই ? ছোটদের আঙিনা। এই আঙিনার ডালিমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে বা পিঁড়ি পেতে বসে মনোহর্ষে ভালো লাগা কথা বলে সময় পার করে দেয়ায় স্বস্তি আছে। দীর্ঘদিনের চেনাপরিচয় থেকে জেনেছি-বুঝেছি যে এরা আমাকে বসিয়ে রেখে অযথা বগল চুলকায় না কিংবা আমি ওদের। এরা আধাকথা মুখে থাকতে থাকতে মুখ বন্ধ করে দেয় না কিংবা আমি ওদের। শ্রেণিগতভাবে আমরা এক বলে এরা সবিশেষ আমাকে আপন ভাবে, আমিও ওদের। এরা আমাকে আমার মতো করে মূল্য দেয়, সম্মান করে, আমিও ওদের। ছোটদের এ’পাড়ায় এরকম জামাই আদরে ডাগর হতে হতে আমি ও’পাড়ার বড়োদের হেয়জ্ঞান করতে শিখে গেছি। ওরা আমার নাম কেটে দিলে আমার একটা পশমও কাঁপে না। ওরা আমার এদিক-ওদিক বিচরণের ইতিহাস ইরেজ করে দিলেও আমি নেই হয়ে যাই না। ওরা আমার এপিটাফ রচনা করে ফেললেও আদপে আমি মরে যাই না। আমার এই সহ্যক্ষমতাকে ওরা হয়ত ডরায় অথবা ডরায় না। আমার এই টিকে থাকার শক্তিকে ওরা হয়ত সম্মান করে অথবা করে না। আমার পত্রপুষ্পবিকাশ ওরা হয়ত তাকিয়ে দেখে অথবা দেখে না। তবে আমার বর্ধনকে অতিবর্ধন, আমার বলনকে অতিবলন, আমার নির্মাণকে অতিনির্মাণ বলে ওরা হামেশাই গাল পাড়ে। এসব অভিধা মুখস্থ করিয়ে ওরা পাছে ফেউ লাগিয়ে দেয়। আমি শব্দ করে হাসি। হেসে হারানো স্বাস্থ্য উদ্ধার করি।

আমি আমার মতো করে লিখে যাই। লিখতেই থাকি ঘোরের মধ্যে থেকে। স্বজনের গতিবিধিকে সন্দেহ না করে। কিন্তু দিন সবসময় একরকম করে যায় না কারো। দেখি, ছোটদের আঙিনাও আর ছোটদের থাকছে না। পুঁজির আগ্রাসনে ফুলেফেঁপে উঠছে। কাত হয়ে যাচ্ছে বড়োদের দিকে। আঙিনায় বাড়ছে ক্রমশ বড়োদের আনাগোনা। এসব দৃশ্যে অস্বস্তি হতে থাকে। কষ্টে আরো মগ্ন হয়ে যাই। কিছুদিন চোখবন্ধ করে থেকে আবার তাকাই। প্রলয় বন্ধ হয় না। দেখি, মোহের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সব ছোটদের ঘর। বড়ো হবার কাতর স্বপ্ন তাদের চোখেমুখে। অন্তত বড়োবাড়ির সিঁড়ি বাওয়ার শখ, আমূল অন্তঃকরণে। ধামা ধরার প্রাণান্ত চেষ্টা। মনোকষ্টে পালান দিয়ে হাঁটি। দেখি, ছোটদের ভেষজ উদ্যান জুড়ে বড়োদের অ্যাকেশিয়া-ইউক্যালিপটাসের চাষ। দেখি, আঙিনায় ধরে না সাইজের বড়ো এক পালের গোদাকে বাইরে থেকে আমন্ত্রণ করে এনে ওরা সিংহাসনে বসাচ্ছে। তার উপরে ছিটিয়ে দিচ্ছে বাংলার সমস্ত সুগন্ধি ফুল। বাদন সহযোগে নিবেদন করা হচ্ছে স্বভাষার সমুদয় বামপন্থী বিশেষণ। অসবর্ণ সম্পর্কের ওটা জের।

বাণিজ্যএষণা তাদের বড়ো হয়ে ওঠে। ছোটত্বের লেবাসে ওদের আর আনন্দ হয় না। তাই বড়োর পায়ের নিচে সহসা আছড়ে পড়ে। লোল ঝরায়। আমার চোখ এ-ও দেখে যে, বড়োর অট্টালিকাপাশে রাতারাতি ছোটচালা গড়ে উঠছে। যেটা বড়ো ঘরের ছোটঘর, কোনাকাঞ্চিতে। কুলির পানি মুখে নিয়ে বড়োবাড়ি থেকে লোকজন নেমে এসে ফেলছে ওখানে। চালাঘর থেকেও যায় কেউ কেউ। চা-পান খায়, গলা খাঁকারি দেয়, হাগুমুতু করে। দু’য়ে মিলে প্রকৃতই যারা ছোট, তাদের পাছামারার ফন্দিফিকির করে। তালেলয়ে মিলে গেলে মারেও সারেগামা সুর তুলে। আসলে জাত মারে। জাত মেরে নববৈশাখে পান্তা খাওয়ার মতো আনন্দ হয় ওদের। আবার এ-ও দেখি, জাতে ছোট কিন্তু বড়োর মতো কেরদানি করে। চলন-বলনগুলো শিখে নেয় বড়োদের থেকে। ফতোয়ার দোকানদারি শুরু করে। বলে, এভাবে বাঁচা অশৈল্পিক কিংবা ওভাবে মরা। বলে, গজ-ফিতা দিয়ে মেপে লিখে নিয়ে আস কিছু গোবরগোল ফিকশন। আহারে অপ্রতিষ্ঠান! মুক্তহাওয়ার সংকট সম্ভাবনায় ভেন্টিলেশনহীন দালানে ঢুকি না। আর আঙিনায় এসে দেখি, পাইপ দিয়ে মাপা বাতাস আসছে দালানের ভিতর থেকে। দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। নিঃশব্দ আর্তনাদ করতে করতে ফিরে আসি নিজস্ব তাঁবুতে।

চিরকাল তাঁবুবাসী আমি, যাযাবর। বসাবসি যত পরের চালার নিচে। কী হবে এবার, ভেবে, জনাকয় মিলে নিজেরাই খাটিয়ে নেই চালা। দারুণ খায়েশে। চার রাতের অধিক জমে না সহবাস। আমার বিরুদ্ধে ওরা পরকীয়ার অভিযোগ তুলে চালা থেকে মাঝরাতে বের করে দেয়। আমি রিঅ্যাক্ট করি। বলি যে, কী করে ফেরত পাব সঞ্চিত ভালোবাসাটুকু ? মুখ ঝামটা মারে রোষে নিজকিয়া। আত্মকলহ ভেবে রণেভঙ্গ দেই। শেষে নাকমুখ বাঁধা লালচোখ কিছু অবদমিত মানুষের সাথে ওরা মজমা জমায়। গানবাজনা করে। আঙিনার আলোয় না দ্বাররুদ্ধ ঘরে। বাইরে কোনো আওয়াজ আসে না। দিনকয় বাদে দেখা যায়, ওরা উন্নতি করেছে। থানইটের জন্ম দিয়েছে এক অশেষ কোশেশে। যাতে গতি নেই, স্থির। এরপর থেকে দেখা-কথা সবই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মড়া সম্পর্কের মুখাগ্নি করে আবার ফিরে আসি সরল তাঁবুয়।

মাঝে মাঝে পথে বেরোই আজো। আলপথ ধরে হাঁটি। আঙিনাওয়ালা ছোট ছোট চালা খুঁজি খেতখামারের পাশে। কখনো চালারাই আমাকে হাত-ইশারা করে ডাকে। আমি সাড়া দেই, বসি। শেয়ার করে বিড়ি খাই। তখন আমার এমন আনন্দ লাগে যে মনে হয় একা হয়ে যাই নি এখনো। তুচ্ছের তুচ্ছ হাঁচি-কাশিকে প্রশ্রয় দেবার মতো তুচ্ছাধার এ জগৎ নিত্যই জন্মিয়ে চলেছে। আমি তো এদেরই ভাই-বেরাদর। কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ। কাঁচা বা পাকা। কিন্তু আমার বহুগামী পুরুষস্বভাব! এ স্বভাব লুকিয়ে রেখে একগামিতার পোশাক পরে ভান-কসরৎ করাটা তো আমারে সাজে না। খুঁজে খুঁজে ফাঁকা স্থানে সহসা আঁচল ধরি গতিপত্রের। বিপুলা বাতাস। পরকীয়ায় মজে যাই তার। চুটিয়ে নতুন লিখি। পুরানোকে করি নতুন করে। করে করে আবিষ্কারানন্দে আমি অঘুমা হয়ে যাই। দেখি অন্য আরেক মজা, তুলতুলে। এখানে শ্বাস-প্রশ্বাস এত মুক্ত যে মাঝে মাঝে ধুলোবালি ঢুকে যায় নাকে, জীবাণুও। কিছুই ভাবি না আমি এতে। জানি যে বাতাসের সাথে কিছু ধুলোময়লা বিল্টইন থাকে।

ছোট ছোট চালা আর আঙিনার প্রেম নিয়ে নাকেমুখে ধুলোর উৎপাত সয়েই আমি যথেচ্ছ বেঁচে যেতে চাই। জানি রে, আমার জীবন যাবে এ হেন তুচ্ছপ্রেমে!

ধানমণ্ডি, ৩ ডিসেম্বর ২০০৭

আঁতুড়ঘরের নকশামালা, খুঁজে-ফিরে দেখার সাধনবিলাস

শুরুটা কীভাবে করা যায় ? দুপুরে উপোস থাকা দিয়ে ? এ আর নতুন কী! এই যে পেট্রোল পাম্পের থেকে যাত্রা শুরু হলো, গাড়ি নই তবু, আমাদের দিন তো প্রতিদিনই প্রায় এভাবে যায়। বরং গ্যাটগ্যাট করে ঢুকে যাওয়া দিয়ে করি মহিলা কলেজের গেট দিয়ে বিনানুমতিতে। প্রধান ফটকের বিশাল বৃক্ষগণ কিছু মনে করো না, দ্বাররক্ষীকে এই কলা দেখালাম। (মু. মে., ক্ষুধার সন্তান, আজকের বাংলাদেশ সাহিত্য, ১৮ জুন ১৯৯৪)
দুলাল ভাই সুপ্রতিমেসু,
এটা সত্যিই বিড়ম্বনাকর যে আপনাকে নিয়ে মৌসুমী ধান ভানতে গিয়ে নিজের সম্পর্কেই অসময়ে কিছু শীবের গীত গেয়ে নিতে হচ্ছে। নিজের কথা পাঠককে উদ্দেশ্য করে তাঁরাই বলতে পারেন, যাঁরা কৃতবিদ্য, কিছু একটা অর্জন করে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে যাঁরা একটি আইকনে পরিণত হয়েছেন। আমি কস্মিনকালেও সেরকম কেউ নই। প্রয়োজনে বললেও শেষপর্যন্ত পাঠককুলের কাছে আমি যে অপরাধটি করছি, সেটি ভবিষ্যতেও কখনো পুষিয়ে দিতে পারব বলে তাদের আশ্বস্ত করতে পারি না। সুতরাং পাঠক দেবতার কাছে এক্ষণে দশাসই একটা মার্জনা প্রার্থনা করেই বাঞ্ছারামপুরের দিকে কিছুদূর হেঁটে যেতে চাই।

একান্ত নিজের বলে স্বীকৃত কাজকর্ম ব্যতিরেকে আর যা কিছু আমি করি শিল্পকুলঘেঁষা, তা করি সবার জন্যেই, কিন্তু শেষপর্যন্ত তার একটা বড়ো অংশই আগলে রেখে দেই নিজের কাছে। মায়া ত্যাগ করতে পারি না। মা যেমন ত্যাগ করতে পারেন না মেয়ের মায়া। জগতের সবাই অপাত্র তা নয়, কিন্তু মায়ের বুক তবু অজানা আশংকায় কাঁপে, ধুকপুক করে, যদি মেয়ের প্রতি অবিচার হয়! যদি ছেলেপক্ষ মেয়েকে বুঝতে না পারে! ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যাই হোক এই প্রবণতাটি একদিনে অর্জিত নয়। ধীরে অনেক দূর পথ হেঁটে ক্রমে আরোহণ করেছি সেই তীর্থচূড়ায়, যেখান থেকে যখন-তখন পড়ে যাবার আশংকা থাকলেও মরে যাবার একদমই নেই। একসময় বহু হাতছানি ছিল, প্রলোভন ছিল, নামি নি। নিচে পুরো করে পাতা ছিল পাদাসন, ধপাস করলেও জানে মরবার ভয় ছিল না। কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারি নি। পণ্ডশ্রম মানুষ বছরের পর বছর ধরে করে না। সবারই নিজস্ব মঞ্জিল আছে। সেসব মঞ্জিলাভীপ্সা ও ক্লান্তিতে এখন সবাই ভুলে গেছে যে ও তীর্থে কেউ একজন ছিল কোনোকালে!

আমার একক কোনো ব্রহ্মচর্যকাল নেই, গার্হস্থ্য নেই কিংবা নেই বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাস। একের ভিতরে আমি চার আশ্রম, সবকালে। এ আমার এমনই এক মিশ্রতীর্থ, যাত্রীগণের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধ্যানস্থ থাকা যায় দিন-মাস-বছরের পর বছর। সকলেই জানে সূর্যের কাছে ওই তপ্তগ্রহতীর্থে এখন আর কেউ নেই, থাকলেও জীবিত অন্তত নয়। অথচ ক্রমাগত বলাৎকৃত আমার ভাষার বর্ণমালা জানে, কী প্রাণচাঞ্চল্য নিয়েই না আমি গান গেয়ে চলেছি সৃষ্টির, বোষ্টমি সনে-- এককোষী হাইড্রা থেকে অতিকায় তিমির, প্রতীকী বাংলায়।

প্রথম যৌবনের উত্তুঙ্গ প্রকাশ বেদনাকে বারকয় ছুঁয়ে তা ফুরিয়ে যাবার আগেই আমি সংযমের অমোঘ সুড়ঙপথের সন্ধান পেয়ে যাই। সুড়ঙমুখে জমে থাকা রহস্যান্ধকারটি আলতো করে সরিয়ে দিয়েছিলেন নাট্যকার-কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক ফরিদ আহমদ দুলাল, আপনি নিজে। হয়ত আপনি জানতেন না যে, যে পথ আমাকে দেখাচ্ছেন সে পথই একদিন গলাধঃকরণ করবে নবাগত এই পথিককে। হলো বস্তুতপক্ষে তাই। একসময় আপনি দেখলেন, আপনার দৃষ্টিসীমা থেকে ক্রমাষ্পষ্টতার দিকে যেতে যেতে ভরাপ্রাণ একজন মানুষ একটি রেখা এবং তারও পরে একটি বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার মেঠোপথের একেবারে শেষ প্রান্তের জলাজংলার ভিতর। সন্ধ্যা হয় হয় সময়ের লালাভার ভিতরে দাঁড়িয়ে কি তখন আপনি বুঝেছিলেন যে এ বিচ্ছেদ আদৌ সাময়িক নয়, এর ভিত পোতা হয়ে গেছে অন্য কোনো সারগাথায়, দর্শনে ?

ময়মনসিংহ, দুলাল-কৃষ্ণের চিরকালীন রাধা, আধা রাধা আমারও ছিল এক গোপন প্রেমিকা। জীবিকার ঘোড়া দাবড়িয়ে তার থেকে ভৌগোলিকভাবে দূরেই গেড়ে নিতে হয়েছে আমার অধুনাকার ঘাঁটি। ধরে-ছুঁয়ে তারে পরখের অবকাশ আজ কালেভদ্রে মাত্র ঘটে। জ্ঞাতিবিচ্ছেদের এই বিরহবেদনই সেই মূর্তিমান কারণ, যেজন্যে বেসুরো ও কর্কশ এই ভরা শিবগীত, বাস্তবিক ধানভানা কালে।

২. আবিষ্কারের ঘোর

দু’টি কবিতামতো রচনা, কৈশোরকালীন কাব্যনির্মাণ চেষ্টার স্মারক, সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আপনার হাতেই কোনোরূপ সম্পাদনা ব্যতিরেকে প্রকাশ পেয়েছিল লেটার মেশিনে ছাপা ময়মনসিংহের অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের বাংলাদেশ-এ। কোনো দৈনিক সংবাদপত্রে ওটি আমার প্রথম নাম ছাপা, তা তার ভূগোল যত ছোটই হোক, তা তার সার্কুলেশন যত কমই হোক। এ যে কী এক উচ্ছ্বাসের সাথে আপনি আমার সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন, তা আপনি জানতেন না বলেই ধারণা করি। আমি জেনেছি, এরপর থেকে রৌদ্রের দুপুরগুলোর অন্যরকম সঙ্গ পেয়ে পেয়ে, রাতগুলোকে পেয়ে ঘাসের শয্যায়। খুব বিচ্ছিরি রকম আনন্দকর ছিল ওই অনুভূতি! কাজেই ঘাসপাতাকাদামোড়িত গ্রামীণ শিল্পশালা ফেলে রেখে কোনোভাবে সকালের নাস্তাটা পেটে পুরে বা না পুরে গোটাকয় খুচরো টাকা জুটিয়ে কিলোদশেক দূরের দেওখোলা থেকে নতুনভাবে চেনা শহর ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে বাসে ঝুলে পড়তাম প্রতিদিন। কাজ যাকে বলে তেমন কিছুই থাকত না আমার, তবে কর্ম থাকত রথ-দেখা, কলা-বেচা সমেত। সে ছিল নিতান্ত এক গ্রাম্য কিশোরের শহরাবিষ্কার ও কবিতাদেবীর চরণ খুঁজে বেড়ানো।

গ্রামদেশ দেখা-চেনা-জানা-বোঝা একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছবার পর শহরের রূপমহিমা দেখবার সে ছিল এক দেহধ্বংসী নৈমিত্তিক মহড়া! ভরা রোদে তার নানা গলিঘুপচি, সার্কিটপাড়া, মতিমটর্স, ব্রহ্মপুত্র তীর, জয়নুল সংগ্রহশালা, গোলকিবাড়ি কবরখানা, টাউনহল, মুসলিম ইনস্টিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরি, শ্মশানঘাট, রেলব্রিজ, এগ্রোফার্ম, বোটানিক্যাল গার্ডেন, রেলস্টেশন, ওভারব্রিজ, তাজমহল রেস্তোরাঁ, আলেকজান্ড্রা ক্যাসল, শশী লজ, বুড়াপীরের মাজার, বিপিন পার্ক, কেন্দ্রীয় ডাকঘর, আরএমএস, কোরায়শী প্রাঙ্গণ, আজিজ প্রিন্টার্স, জগদ্বন্ধু আশ্রম প্রভৃতি স্পটগুলো যাত্রাতাঁতে সেলাই করে করে প্রয়োজনীয় মানুষিক ও মানবিক বিরতি সহযোগে ফেরার ছিল সেই কাল। বাঁকে বাঁকে বিচিত্র সব মানুষ, অতিমানুষ এবং তাদের অনন্য সাহচর্য। এক বিস্ময়কর বহুবাচনিকতার সাথে তখন আমার নিত্য মোলাকাত। তাই জন্যে একা হয়েও একা নই। নতুন কোনো স্থানেও মানুষ বেশিদিন একা থাকতে পারে না, সঙ্গী জুটে যায়। আমারও জুটে গিয়েছিল। যদিও সঙ্গলগ্ন হয়েও চূড়ান্ত বিবেচনায় মানুষ মূলত একাই। না, হাসবার কিছু নেই, কবিতা এরূপ সাধনেও মেলে, আমাদের মিলেছে আপনি জানেন, এ বয়সে যদিও আর সম্ভব নয় পাওয়া।

আশিক, রোকন, শতাব্দী ও আমি, গ্রাম থেকে আসা আমরা বড়ো বেপরোয়া ছিলাম। ছিলাম খানিকটা আধাখেচড়া অনিকেত, না-গেঁয়ো না-শহুরে। দূরাগত আরো যারা ছিল স্বজাতির, মাসুম, হাদিউল, শামীম-- ওদের কলেজ হোস্টেল ছিল। শহরে নিজেদের অথবা ভাড়া করা বাড়ি ছিল মোস্তাক, মশিউর, স্বাধীনসহ অনেকের। আকুয়ায় পোড়োবাড়ির শ্রী নিয়ে দাঁড়ানো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বাড়ি ছিল বাচ্চু (শামসুল ফয়েজ) ভাইয়েরও। কিন্তু বোহেমিয়ান কবি বাচ্চু ভাইয়ের ঘরে ফেরা ছিল এক বিরল ঘটনা। ঘর থেকেও ঘরহীন এই মানুষটির সঙ্গে সঙ্গত কারণেই আমাদের বনিবনাটা একটু বেশি হয়ে ওঠে। তাঁর সাহচর্যে আমরা তখন ভিতর দিক থেকে তরতর করে বেড়ে উঠছি। নামধাম শুনছি-জানছি ভুবনখ্যাত কবিদের, পঙক্তিও। সিনিয়রদের মধ্যে তাঁকেই কেবল কবি মনে হচ্ছে তখন। বয়সের দূরত্ব কবে ঘুচে গেছে তাঁর সাথে, যা ইচ্ছে বলা-কওয়া যায়, যেখানে যাব ভাবি সঙ্গে পাওয়া যায়। এই একসঙ্গে গাঁজা খাচ্ছি তো এই যৌনকর্মীপরিবৃত স্টেশন প্লাটফরমে বস্তাসদৃশ একশিরাওয়ালা তারালাল সুইপারের সাথে বসে বসে গল্প করছি আর চা পিয়োচ্ছি। হঠাৎ হাসছি, চিৎকার করছি। জোর পায়ে রেলপথ ধরে এগোতে এগোতে গলা ফাটিয়ে গেয়ে উঠছি কোনো গান বা কবিতা। পথে হয়ত দেখা হয়ে গেল আমূল আওলাভাই আওলাদ হোসেন, সদা ঘোরগ্রস্ত মাহমুদ আল মামুন কিংবা বিদিশাগ্রস্ত তপন বর্মণের সাথে। ভর দুপুরে ঘুপচিপথে আপনার সাথে দেখা হওয়ার চান্স ছিল না মোটেই। আপনি চলতেন সদর রাস্তা ধরে, তা-ও যখন তখন নয়। আপনার সাথে দেখা করতে বিশৃঙ্খলার অতল থেকে উঠে, বাতিরকলের মোড়ে, শৃঙ্খলার দিকে কিছুদূর হেঁটে যেতে হতো। মাঝেসাঝে সদলবলে বা একা একা সেদিকেও যেতাম আমরা। বহিরাঙিনার কাঁঠালিচাঁপা, ভিতরাঙিনার সদাশীতল নলকূপ, দোয়েলকূজিত শান্তস্নিগ্ধ ছায়ার টানে, নিষ্ঠ কর্মকর্তা আপনার কর্মস্থলে, ঠিক মধ্যাহ্নবিরতিকালে, রোদেপোড়া আমরা কজন সহসাই হাজির হয়ে যেতাম। আশ্চর্য যে, কখনো উপদ্রব ভাবেন নি মুখের ওপর। মনে মনে ভাবতেন কি না জানি না আমরা। সবসময় যে আপনি সময় দিতে পারতেন তা নয়, কখনো কখনো অপেক্ষার কড়ি গুণতে হতো। এ সময়টা অবশ্য অন্যভাবে মহিমাময় করে তোলা যেত বর্ণে-শব্দে-বাক্যে, বইয়ের গন্ধে। আমরা সেটা করতামও। লাইব্রেরির শান্ত-শীতল কক্ষগুলো সবসময়ই উদার হয়। গ্রন্থের আদর চিরকালই অনন্য উত্তাপে ভরা।

প্রথমে দ্বিতীয় চিন্তায় মুদ্রিত পরে গ্রন্থিত আপনার ‘কাব্যাক্রান্ত কতিপয়’-এর নদী এবং নদীর কাছের ‘হাশেম’, একাকীর ‘সবুজ’, অন্তর্গত সংঘাত-এর ‘কবি’, তবুও সহবাস-এর ‘এক’-- এদের সাথে আমাদের এক দারুণ মিল আবিষ্কার করে আমরা পরবর্তীকালে চমকিত হয়েছি। চরিত্রগুলো সর্বদা আপনার ভিতরে বাস করে অথবা কখনো বাস করেছে, এ কারণেই আমাদের ভিতরকার জ্বালাও-পোড়াও বোধটা বরাবরই স্পর্শ করতে পারতেন আপনি, দিতেন সে বোধের বিকাশের জন্যে যথেচ্ছ পৃষ্ঠপোষকতাও। আমরা কখনোই ভুলতে পারব না মধ্যাহ্ন সাক্ষাতে প্রাপ্ত প্রসাদরাজির কথা। সাক্ষাতের খানিক পরই সালাদসহ গরম গরম পুরি-সিঙারা হতো। নতুন কবিতা হতো-- আপনার, বাচ্চু ভাইয়ের, আশিকের, রোকনের (অবশ্যই) ও আমাদের (যার যার ট্যাঁকে থাকত)। অভ্যাগতরা সংখ্যায় কম হলে বাসা থেকে আপনার একার জন্যে আসা টিফিন ক্যারিয়ারেই চলত যৌথহাতের ওঠানামা। কবিতাপাঠ যেমন তেমন, খাওয়াটা একটা লয়প্রাপ্তি, বুঝেছি কখনো। আলস্য পেয়ে যেত। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, না-খেলেই কাব্যোৎপাদন ভালো হয়। ঘোর ভালো জমে। (দারিদ্র্য মহান করে তোলে একরকম বয়ান কি এই সুপ্ত কারণেও রেখেছিলেন নজরুল?) যেদিন বন্দোবস্ত হতো না, সেদিন দুপুরে আমরা বহিরাগতরা না-খেয়ে না-দেয়ে, পথের ধারের শুধু টিউকল-নির্ভর। তবু গতি থাকত, পায়ের এবং কল্পনার। নিত্য কবিতার ওই দিনগুলিতে ক্ষুৎকাতর আমরা কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের বুনো বেগুনের স্বাদও নিয়েছি।
কাণ্ডটা দেখ পার্কের ট্যাপটার, যেটা ডাস্টবিন ঘেঁষে, হঠাৎই উথলে উঠেছে প্রেমে। আহা টিউকল, বলবি তো জীবিত আছিস, পেটের পুরোটাই তো প্রায় খালি, যাবার আগে হ্যাঁ ঠিক খেয়ে যাব, পচা বেড়ালের যতই গন্ধ আসুক বিটকেলে, কেননা কষ্টেসৃষ্টে হলেও জলটাই মেলে বিনে পয়সায়। (প্রাগুক্ত)
কিংবা
আমাদের যেখানে সাইনবোর্ড হয়েছে একটা, আশেপাশে তার পেকে আছে অজস্র বনবেগুন, মানুষ যেগুলোকে অখাদ্য সাব্যস্ত করেছে। ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে’ বলে বলে হাতে রক্ত ঝরিয়ে হলেও টকটকে লালরঙ বুনোফলে পেট পুরে, ক্ষুধাকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে যে দিলাম, এটা শহরের এখানেই সম্ভব হলো কেবল এই নার্সারিটার কাছে। (প্রাগুক্ত)
কিন্তু কথা অন্যখানে, তখন আপনি আমাদের মন উপচিয়ে ভালোবাসছেন, যখন তখন আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, চেয়ে নিয়ে একের পর এক কবিতা ছাপছেন। এদিকে আমাদের বিস্তর পাখা গজাচ্ছে। আজকের বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আমরা অনেকেই তখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুদ্রিত, দেশের বাইরেও। বিশেষ করে বৃহস্পতি-শুক্রবারগুলো ঢাকাই দৈনিকের নতুন কালির গন্ধমাখা আমাদের তাজা লেখাগুলোর আবেগাবেশে মৌ মৌ হয়ে থাকত। কী দারুণ উষ্ণতা! এভাবে ক্রমশই আমরা কবিতার দিকে গ্রস্ত হয়ে পড়ি। নিজেদের সীমানাকে একটি বিশিষ্টতার আঁচড় দিয়ে দেগে আমরা আমাদেরই বিশেষ ভেবে বসি। একে অহংকারের মতো হয়ত মনে হয় কিন্তু এ সে হয়েও ও না, অন্যকিছু। প্রথম যৌবনের উত্তুঙ্গতা। ভাবুন তো একবার, আমরা উলুকঝুলুক উড়ছি আর আপনার কবিতার ব্যাপারে রীতিমতো নীরব থাকছি অথবা তীব্র উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করছি। একেই বলে যার খাই-পরি, তারেই আবার ল্যাঙ মারি। আপনি হয়ত এর সবই বুঝতেন। বুঝতেন বলেই স্বভাবসুলভ মহত্ত্বে এবং ‘শিল্পজগতের সমসাময়িক বিবেচনাকে গণনায় নিতে নেই’ ধরে নিয়ে এই নীরবতাকে থোরাই কেয়ার করতেন। আবার এ-ও হতে পারে আপনি কখনোই বুঝতেন না। কারণ চারদিক থেকেই আপনার একটা প্রতিষ্ঠা ছিল। প্রতিষ্ঠিতদের চোখের উপরে একটা অদৃশ্য রঙিন চশমা সেঁটে থাকে। এই আবরণের মধ্যস্থতায় প্রায়শ তাঁরা অপ্রতিষ্ঠিতদের মূল্যায়নের সার-অংশ উচ্ছ্বাসের আড়াল থেকে আলাদা করে নিতে পারেন না।

৩. বীক্ষণবার

আপনি জানেন, বীক্ষণময় শুক্রবারগুলো ছিল উৎসবের দিন আমাদের, সচল-অচল সব ধরনের লেখকের। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই প্রস্তুতি চলত, পরদিন কোন কোন লেখা পড়া যায় সে নিয়ে। রাত জেগে নতুন করে কিছু লিখবার চেষ্টা, না-হলে পুরোনো খসড়াকে ভাঙা আবেগের তুলি দিয়ে নতুন করে ঘষেমেজে সারিয়ে তোলা। বীক্ষণ ছিল ময়মনসিংহের নবীন-প্রবীণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক মিলনমেলা, আজও। অনিবার্য কারণে একদিন না-আসা গেলে সাংঘাতিক খারাপ লাগত। মনে হতো আমাকে বাদ দিয়ে সাহিত্যের খেয়া হয়ত পৌঁছে যাচ্ছে সিদ্ধির ঠিক ওপারে। মনে এতদবিবেচনা একবার ঠাঁই পাবার পর থেকে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ (মসাস)-এর সর্বাপেক্ষা কার্যকর প্রকল্প বীক্ষণ-এ আমরা ছিলাম খুব নিয়মিত। তখন বীক্ষণ বসত সি. কে. ঘোষ রোডে অবস্থিত অনুগ্রহে পাওয়া প্রেসক্লাবের একটি কক্ষে। এখানে এসে সাহিত্যের জন্যে বিনাশ্রম, সিকিশ্রম, আধাশ্রম, পৌনেশ্রম, পূর্ণশ্রম-- সব ধরনের সাহিত্যসংস্রবপুষ্ট লোকজনেরই চেহারা দেখেছি সামনাসামনি। ময়মনসিংহে লভ্য তাবৎ ঘরানার লেখকেরই আনাগোনা ছিল একে ঘিরে, হয়ত এখনো আছে। পূর্বনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কবিতা-গল্প-ছড়া পাঠ শেষে বীক্ষণের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত হলেও তরুণতর আমাদের অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কখনো কখনো পরদিন সকাল পর্যন্তও গড়াত, মনে পড়ে। বিষয় ও ভূগোলে সেসব অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে থামবে আমরা কেউই পূর্ব থেকে জানতাম না কিছু। প্রেসক্লাব ছেড়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট হয়ে বীক্ষণ ব্রহ্মপুত্র তীরের কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য মহারাজের বাগানবাড়ির তপোবনপ্রায় পুণ্যচ্ছায়ারাশি ঘেঁষা মসাস-এর নিজস্ব ডেরায় স্থানান্তরিত হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই আমাদের দেহমনগাছে নতুন নতুন ডালপাতা ছড়াল। মসাস-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বীক্ষণের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক আপনার বিশেষ নজর থাকত আমাদের প্রতি। সংগঠনের আগামী সময়ের সৈনিক হিসেবে আমাদের তৈরি করবার একটা চেষ্টা আপনার মধ্যে ক্রিয়াশীল দেখেছি বরাবর। আপনার পরামর্শ ও নির্দেশ আমরা মেনে চলতেই চেষ্টা করতাম। এক দু’বার করে আমরা অনেকে আহ্বায়ক হিসেবে বীক্ষণের হালও ধরেছি। কিন্তু নবিশ সংগঠক হিসেবে আমাদের অনেকেরই ব্যর্থতা ছিল, ছিল সংগঠক হবার ব্যাপারে অনাগ্রহও। কারো কারো চাওয়াও ছিল না যে বীক্ষণ ভায়া হয়ে একদিন মসাস-এর বড়ো সংগঠক হব, বরং আমাদের স্বপ্ন ছিল ভালো কিছু লিখবার। কেউ কেউ সংগঠক হয়েও অঢেল লিখতে পারেন, আপনি যেমন। আমাদের কারো কারো মনে হতো, এ কাজটা সবার নয়, আমাদের জন্ম হয়েছে শুধু লিখবারই জন্যে। যে কারণে সংগঠনের নকশা অনুযায়ী পরিচালিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেও ভিতর দিক থেকে আমরা অনেকেই ছিলাম সংগঠনবিরোধী। ফাঁক খুঁজতাম কী করে প্রতিষ্ঠানের মাপ দেয়া সীমার বাইরে পা রাখা যায়, স্বাধীনভাবে সমমনাদের সাথে বেহিসেবী সময় যাপন করা যায়। বীক্ষণের দ্বিতীয়ার্ধে অনুষ্ঠিত স্বরচিত রচনার পাঠপর্ব আমাদের দারুণভাবে আকর্ষণ করলেও প্রথমভাগের আলোচনা সবসময় ভালো লাগত না ওর প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র এবং বিষয় নির্বাচনজনিত বদ্ধতার কারণে। ওখানে এমনকি ঈদানুষ্ঠানের তাৎপর্য, দুর্গাদেবীর মাহাত্ত্ব্য-- এসব বিষয়েও আলোচনা হতো। যতদূর খবর রাখি আজও হয়। একইসঙ্গে মক্কা-মদিনা-গয়া-কাশী-কপিলাবাস্তু-লুম্বিনী-বেথেলহেম-নাজারেথের ছবি ওখানে আঁকা হতো যতটা প্রতিষ্ঠানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্যে ততটা সাহিত্যিক প্রয়োজনে নয়, আমরা বুঝতাম। এসব আমাদের কখনোই টানত না, আজও তরুণদের টানে না। তার মানে এ নয় যে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি না। আমরা ভিতর দিক থেকে বেড়ে ওঠবার জন্যে আরো প্রাসঙ্গিক, ব্যবহারিক ও গতিশীল আলোচনা করবার ও শুনবার জন্যে সদা মুখিয়ে থাকতাম। সেসব আলোচনার কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপছবি থাকত না, কিন্তু প্রাণমূলে রস থাকত। আনুষ্ঠানিকতায় আমরা যারা অনেকটাই অপ্রস্তুত ও নীরব, ব্রহ্মপুত্র ধোয়া সাহেব কোয়ার্টার পার্কে গিয়ে বসলে আমরা সেখানে সবাই সরব। আমাদের এই আকর্ষণ সবকিছুকে ছাপিয়ে যেত।

আপনাকে মনেপ্রাণে সদাতরুণ বলেই জানি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও বেশি। তরুণ মসাস কর্মকর্তা গ্রন্থপ্রিয় আহমদ সাইফ, সুনন্দন ইয়াজদানী কোরায়শী, স্বরশিল্পী আমজাদ দোলনও। কিন্তু সর্বোপরি আপনারা ছিলেন মুরুব্বি, সাংগঠনিক জন। মাঝে মধ্যে বীক্ষণ শেষে আপনারাও বসতেন পার্কে, কিছুক্ষণ। নদীর জল ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে চুল ওড়াতে ওড়াতে ওখানে চা-সিঙারা, বাদাম-চানাচুর ইত্যাদি হতো। কিন্তু মত্তআড্ডা যাকে বলে সেটা জমত না বস্তুত। আমাদের কাছে আপনারা ছিলেন স্থানীয় অভিভাবক। আমাদের পুরোমাত্রায় খুলে যাওয়া সম্ভব হতো কাজেই আপনারা পিঠটান দেবার পর। তখন ভালো করে ভেবে দেখি নি, কিন্তু এতদিনে ওসব জমায়েতকে রোদে মেঘে কোলাকুলি বলে মনে হয়, মুহূর্ত-স্ফূরিত।

নব্বইয়ের দশকের শুরুর কয়েক বছরে বীক্ষণে তরুণ ও তরুণতরদের এক অপ্রতিহত জোয়ার ছিল। লেখালেখিতেও বেশি সরব ছিলেন ওই তরুণরাই, সবসময়ই যা হয়। শাহীদা হোসেন রীনা, আশিক আকবর, আহমেদ শফিক, আশিক সালাম, আহমদ শাহাবুদ্দিন, চয়ন বিকাশ ভদ্র, তাসাদ্দুক ফাহিম, অমল রজক, তোফায়েল তফাজ্জল, সালাহউদ্দিন পাঠান, আবদুল মতিন, সরকার আজিজ, পলাশ চৌধুরী, তাসলিমা রহমান, আশরাফ রোকন, দিলীপ সেন, মোস্তাক বিবাগী, মোহাম্মদ ইয়াকুব, নাজমা মমতাজ, রীনা পণ্ডিত, হাদিউল ইসলাম, মাসুম মোকাররম, শামীম পারভেজ, মশিউর রহমান খান, শতাব্দী কাদের, রওশন ঝুনু, মিনহাজ উদ্দিন শপথ, সমুদ্র সেলিম, মামুন মাহবুব, জুয়েল কবীর, ওসমান গণি, মনো জসীম, ধনেশ পণ্ডিত, তন্দ্রা সরকার, রাজিয়া সুলতানা, মার্জিয়া সুলতানা নীলিমা, হিশাম আল মহান্নাভ, ফাতেমা নার্গিস বীণা, রোকসানা বিলকিস, অনিন্দ্য জসীম, স্বাধীন চৌধুরী, মামুন মোয়াজ্জেম, আলী ইউসুফ, শাবিহ মাহমুদ, শাহিন লতিফ, গনী আদম, সফেদ ফরাজী, বিল্লাল মেহদী, অতনু তিয়াস, চন্দন সাহা রায়, সিদ্ধার্থ টিপুসহ আরো অজস্রজন আমরা। পার্ক বা সংগ্রহশালার বিকল্প-বীক্ষণ শুরু হতো এ তালিকার একটা গুরুঅংশকে নিয়ে। ওখানে আমরা থাকতাম পুরোমাত্রায় ব্যবহারিক, কবিতাকেই ভালো করে চিনবার-জানবার চেষ্টায় মত্ত। নানাজনের মুদ্রিত-অমুদ্রিত কবিতা থেকে পাঠ, তার ভালোমন্দের নিবিড় পর্যালোচনা, বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠের অভিব্যক্তি শেয়ার, ইত্যাদিতে মত্ত থাকতাম আমরা। কবিতা বিষয়ে নানারকম কর্মশালাও হতো ওখানে। পাঁচ-দশজন মিলে বারোয়ারি কবিতাও লিখেছি আমরা। প্রতিজন এক দু’লাইন করে লিখে একটি কবিতার পূর্ণ রূপ দেবার সেসব চেষ্টা যুগপৎ আনন্দদায়ক এবং শিক্ষণীয় ছিল। ক্রমশ কমতে কমতে জমায়েত দু’তিনজনে এসে ঠেকলে আমরা অন্য মঞ্জিলমুখী হতাম। তারওপরে হতাম একা। হায় একা হওয়া আমাদের, বিরল ভাবনা।

উল্লিখিতদের অনেকেই আজ আর লেখালেখির সঙ্গে নেই, অনেকেই ক্রমশ নিভে গেছেন অথবা নিভতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু যুগপূর্বকালে এদের সবার ভিতরেই কমবেশি সৃজন-আগুন ছিল। ওই অন্তর্গত অগ্নির সম্মিলিত উত্তাপ আমরা সকলেই অনুভব করতাম সমভাবে, সংবিধানবিহীন আমাদের সংঘপ্রয়াসে।

৪. নটনটীকলা

নামত ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের প্রকল্প সংখ্যা ছিল অনেক, চর্মচক্ষে যার বেশ কটিরই আমরা কোনো কার্যক্রম দেখি নি। বীক্ষণের পর সক্রিয় প্রকল্পকটির আরেকটি ছিল নাট্যপ্রকল্প। এই প্রকল্প আমার অন্য আরেক নেশা ও অভ্যস্ততাকে অর্থময়তা দিয়েছে। এসেছি সাহিত্য করতে, সাহিত্যের পাশাপাশি অভিনয়ে যুক্ত হতে পারা এক ভ্রমণে দুই সওদা। বীক্ষণের যারা, তারা সবাই এ প্রকল্পকে অওন করে নি। না-করতেই পারে। আগ্রহ ও দক্ষতা যার যেমন, তার তেমনই ভালোমন্দ লাগা, আপনপর ভেদ। প্রয়োজনেই এখানে অন্য সেট-আপ। আপনার মাধ্যমে অভিনয় ও অন্যান্য নাট্যকলাকৌশলের সাথে দীর্ঘদিন থেকে যুক্ত অনেকেই এ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। আমাদের সময়ে আমরা পেয়েছি নাট্যঅন্তপ্রাণ এমএম ফেরদৌসী, সালেহউদ্দিন আহমেদ, এলআর বাবুল, ফেরদৌস হীরা, শাহাদাত হোসেন খান, মোতাহার হোসেন বাচ্চু, সারোয়ার চৌধুরী প্রমুখকে। এঁদের মতো বিশিষ্টদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে পারা, সে এক বড়ো প্রাপ্তি ছিল আমার।

এখানেই সংস্পর্শে আসি আনোয়ারা সুলতানা, নাজনীন পাপ্পু, সাইফুল এহসান জহির, আকলিমা রহমান, শবনম জামান, শম্পাসহ আরো অনেকের। রহস্যময় আলো-আঁধারিতে স্বচ্ছন্দ নটনটীদের এ একেবারেই অন্য আরেক জগৎ। কলেজ ক্যাম্পাস ও উপজেলার অডিয়েন্সের সাথে আগে অল্পবিস্তর পরিচয় থাকলেও জেলা শহরের অডিয়েন্সের সামনে নট হিসেবে মঞ্চে অবতীর্ণ হবার অভিজ্ঞতা আমার আপনারই দেয়া। এ হয়েছিল বলেই যেকোনো অডিয়েন্সকেই আমার ভয় পেতে হয় নি পরে। প্রকল্পটি নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তর কথা হতো হলের ভিতরে ও বাইরে। এর একটি কারণ এরকম ছিল যে, মসাস-এর নাট্যপ্রকল্পে আপনার নাটক ছাড়া আর কারো নাটক কখনো অভিনীত হতো না। আমার অভিজ্ঞতায় অন্তত তা নেই। যদিও নির্দেশক হিসেবে অন্যদের অংশগ্রহণকে ওখানে স্বাগতই জানানো হতো। অনেকে বলতেন, প্রকল্পটি আছে কেবল নাট্যকার ফরিদ আহমদ দুলালের নাটকের ল্যাবরেটরি হবার জন্যে। স্পষ্ট ও সঙ্গত এই মন্তব্যের সাথে আমিও সহমত পোষণ করতে বাধ্য হতাম, কিন্তু কাজও করতাম। ভালো লাগত বলে।

পরবর্তী সময়ে নাট্যকর্মের সাথে পেশা ও নেশাগত কারণে ঘটা অবিপুল সংস্রবের মাধ্যমে ক্রমশ বুঝেছি মসাস-এর নাট্যক্রিয়া ছিল বড়ো ছকে বাঁধা, পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে খানিক দূরে। দৃশ্যকাব্যের আরিস্টটল প্রদত্ত তত্ত্বের এক ঢিলেঢালা অনুসরণ প্রচেষ্টা ছিল ওর আদি-মধ্য-অন্ত জুড়ে। ভরত কথিত আঙ্গিক, বাচিক, আহার্য ও স্বাত্ত্বিক অভিনয়ের সীমাকে খানিক বাঁকা-সোজা করে ওর পথচলা। ঘোষণা দিয়ে না-হলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এ সীমা অতিক্রম করাকে ওখানে যেন এক শিল্পপাপ বলে ভাবা হতো। অথচ শিল্প বরাবর তাদেরই দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে বলে জানি, যারা বেচারীর পেছন দিক দিয়ে যুগ্ম-আঙুল চালায়। শিল্পদেবী গৎ পছন্দ করে না, একদম না। নিত্য নতুনের আকাঙ্ক্ষায় তার ধ্রুপদী সংজ্ঞাকে যে যথেচ্ছ বলাৎকার করতে পারে, মাঝে মধ্যে তার দিকে দাঁত কিড়মিড় করে তাকালেও বস্তুতপক্ষে তার শয্যাপাশই শিল্পদেবীর সবচেয়ে বেশি কাম্য। এ বিবৃতি সকল শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দেবীর সুবিস্তৃত জীবনীর অংশত ঘেঁটে সাধারণীকরণের মাধ্যমে পাওয়া এই সারই পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে আমার শিল্পদর্শন।

যাহোক, সেবার আপনার ‘কোঁচ’ নাটকের মহড়া চলছিল। ওরই এক বানগ্রস্ত চরিত্র রূপায়ণের ছবক নিচ্ছিলাম আমি। মহড়া শেষে আপনি আমার হাতে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত কিছু লিটল ম্যাগাজিন ধরিয়ে দিয়ে সংক্ষেপে সেসবের ওপর আলোচনা লিখে মসাস-এর তৎকালীন সহ-সভাপ্রধানদের একজন ও দ্বিতীয় চিন্তার সম্পাদক জনাব ইফফাত আরার কাছে পৌঁছাতে বলেছিলেন। সম্পাদক মহোদয় ওগুলো রিভিউ করিয়ে দেবার জন্যে আপনাকে অনুরোধ করেছিলেন। আপনি নতুন কাউকে এ কাজের জন্যে তৈরি করতে চাচ্ছিলেন। আপনি সাংগঠনিক গুরুজন, আমার প্রথম সম্পাদক, অতএব আপনার আদেশ শিরোধার্য এটা মনে করে যতটা না, তার চেয়ে বেশি ওই কাগজগুলোর ভিতরে সুপ্ত আগুনের উত্তাপ আহরণের স্বাভাবিক কৌতূহলেই দায়িত্বটি মাথা পেতে নেই। কালক্রমে মাথার ভার ওই বস্তুরাজির ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিই আমূল মাথাটিই। জনান্তিকে বলি, এটি ছিল পূর্বকথিত সেই সুড়ঙ, যাতে প্রবিষ্ট হয়ে খুঁজে পাই অন্য এক তীব্র আলোর জগৎ। যা আমাকে সাহিত্যপাড়ার এক ইঁচড়ে পাকায় পরিণত করে তবে ছাড়ে অথবা আজও যা ছাড়ে নি। এই জানালা দিয়ে আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখবার একটি ফুটো পেয়ে যাই, যে ফুটো পথে পেঁচা-প্রান্ত-সংবেদের সংস্রবপুষ্ট ক্যাম্বিসধারী আশিকের ছোলা মাথার পাশে ওরকম আরো আরো মুখাবয়ব ভেসে ওঠে। আশিককে প্রথমবার দেখেই মনে হয়েছিল, এঁর সংস্রবে যাওয়া গেলে আখেরে কোথাও ভরদুপুরে অথবা অপরাহ্ণে কবিতার সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। অবশ্য পরে সেটা হয়েওছিল নিরুদ্দেশ ভ্রমণকালে। সেটা বিনা টিকিটে, ফাঁকা পকেটে, মেইল ট্রেনে চড়ে জামালপুর ভ্রমণের তিনদিনের অভিজ্ঞতা অর্জনের সময়, যদিও যাত্রাপথে পিয়ারপুরের এক শটিবনের কাছে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া প্রেমের ঠিকানা।

৫. বিকল্প জানালা

আপনার মনে না-ও থাকতে পারে যে, আলোচনাটি লিখবার কাজ দিনকয়ের ব্যবধানে শেষ করে এনে সরাসরি সম্পাদকের দপ্তরে না পৌঁছিয়ে আপনাকে দিলে আপনিই ওটি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। লেখাটি রাইসুল মুসাফির ছদ্মনামে দ্বিতীয় চিন্তার ১৯৯২-এর প্রথম দিকে প্রকাশিত কোনো এক সংখ্যায় ছাপা হয়। ওটি ছিল জীবনের প্রথম কোনো সাহিত্যপত্র, সাহিত্য বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন তথা সাহিত্যকর্ম বিষয়ে প্রকাশোদ্দেশ্যে আলোচনা লিখবার আমার কম্প্রহস্ত প্রয়াস। পরে কপি সংগ্রহের জন্যে সেনবাড়ি রোডে অবস্থিত শান্ত-নির্জন এল প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি ইফফাত ম্যানসনে গেলে এর প্রবীণ সম্পাদক ইফফাত আরার সাথে মুখোমুখি পরিচয় ঘটে। লেখাটির প্রশংসা, উষ্ণ ব্যবহার এবং পরবর্তী সংখ্যার জন্যে লিটল ম্যাগাজিন আলোচনা লিখবার অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়া ছিল রাইসুল মুসাফির এবং প্রকারান্তরে মুজিব মেহদীর জন্যে বড়োসড়ো এক প্রশ্রয়। পরে আরো যাতায়াতে ক্রমশ ওই কাগজটির সঙ্গে আমার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায় মাসিক হাজার টাকা রফায়। একজন বোহেমিয়ান সাহিত্যগৃধ্নুর জন্যে এটি ছিল এক শাপে বর।

যাহোক, সে সময় দ্বিতীয় চিন্তা সম্পাদকের দেশমুদ্রণ নামে কুটিরশিল্পসদৃশ স্বল্পায়োজনের এক লেটারপ্রেস ছিল বাড়ির চৌহদ্দিতেই। এর যা সম্ভাব্য উৎপাদন নিজেদেরই ব্যবহারে লাগত। কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছিল না দেশমুদ্রণের। দ্বিতীয় চিন্তা ছাড়াও বিভিন্ন ফাঁকে-অবসরে এখানে আর যা যা কাজ হতো যেমন অনন্যা সাহিত্য পরিষদের অনিয়মিত প্রকাশনা ‘মৃত্তিকা’, বীক্ষণের নিয়মিত মাসিক ভাঁজপত্র ‘বীক্ষণ’, সাহিত্য সংসদের প্রকাশনা ‘স্বরচিত’ ও অন্যান্য বিভিন্ন অনিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থাদি ; সেসবের মুদ্রণ খরচ বাবদও প্রায়ই কোনো মূল্য পরিশোধের বালাই ছিল না। এককথায় দেশমুদ্রণের পুরো সেট-আপটিই ছিল সাহিত্যের জন্যে নিবেদিত। ছিমছাম দ্বিতল ইফফাত ম্যানসনের প্যাটার্নিক ইংরেজি এল-এর ছোটবাহুর লগ্ন হয়ে বড়োবাহুর সমান্তরাল দৈর্ঘ্য নিয়ে অস্তিত্বশীল টিনের একচালা প্রেসঘরটিই এরপর থেকে হয়ে ওঠে আমার প্রতিদিনকার অফিস। নটা পাঁচটা নয়, যতটা খুশি থেকে যতটা বাসি। ক্রমাগত স্নানে স্নানে স্নাতকোত্তর হবার ইচ্ছেয় তখনো আমার ছাত্রত্ব সচল। কিন্তু প্রেসাফিসের ছোট্ট টেবিলে ক্লাসের বই কখনো প্রবেশাধিকার পায় নি। চৌদিকে মুখ ব্যাদান করা সাহিত্যপ্রয়াস যত, চুরি-ধার-ক্রয় মাধ্যমে আহরিত নতুন-পুরানো বইপত্তর, ও-টেবিলে খোলা হয়, বন্ধ হয়। বিচিত্র সব বইয়ের ঘ্রাণে তখন আমরা দিশেহারা। ওখানকার দায়িত্বের মধ্যে ছিল দ্বিতীয় চিন্তা সম্পাদনায় সহযোগিতা দেয়া-- লেখা সংগ্রহ ও প্রস্তুত করা এবং প্রেসের তিনজন লোককে কাজে লাগিয়ে যথাসম্ভব মুদ্রণবিভ্রাট মুক্ত অবস্থায় দ্বিতীয় চিন্তার প্রকাশ নিশ্চিত করা। এজন্যে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ যথা কাগজ-কালির যোগান দেয়া, লেখক-প্রদায়ক এবং নিয়মিত-অনিয়মিত পাঠকদের উদ্দেশ্যে পত্রিকার বুকপোস্ট প্রেরণ করা ইত্যাদি। সম্পাদক মহোদয় কাগজটির পেছনে যে টাকা ব্যয় করতেন তার এক দশমাংশও ফেরত পেতেন না। মাত্র গোটাকয় সটাক গ্রাহক ছিলেন বলে জানতাম। প্রায় পুরোটাই যেত বিনামূল্যে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন লেখক ও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের দপ্তর হতো এসব বুকপোস্টের অভিমুখ। ফেরত যেটা আসত সেটাও অর্থমূল্যহীন কিন্তু অমূল্য সব লিটল ম্যাগাজিন। অ্যাসাইন্ড ওয়ার্কের আওতায়ই রাইসুল মুসাফিরকে এসব কাগজের আগাগোড়া পড়তে হতো, পরের সংখ্যার জন্যে সমালোচনা লিখতে। রাখাল সর্দারকে নিকট উদ্যানের গল্পসল্প লিখতে বিভিন্ন দিকের খোঁজখবর রাখতে হতো। দ্বিতীয়োক্ত কাজে সচেষ্ট থাকত স্বরিত ইমন (আশরাফ রোকন) ও আকাশ রেহমান (মশিউর রহমান খান)ও। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের চোখ-কান খুলে গেল বিস্তর। বাংলাভাষায় লেখালেখি করেন এমন সিংহভাগ তরুণ-তরুণীর চলন-বলন-কৌশল এবং রাগী-তেজি ও প্রথাকে অস্বীকার করবার স্পর্ধাধারীদের সাথে আন্তরিক এক দহরম-মহরমও তৈরি হয়ে গেল। নিয়মিত পত্রালাপের ভিতর দিয়ে সেসব সম্পর্ক আবেগায়িতও হয়ে উঠল কোনো কোনো দিকে।

এখানেও আমি একা নই। একে একে লেখকবন্ধুদের সবারই ডেস্টিনেশন লিস্টে সেনবাড়ি রোড-দেশমুদ্রণ যুক্ত হয়ে গেল। আসতেন আপনিও। প্রধানত দোতলায় সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে হলেও নিচতলায় আমাদের সাক্ষাৎ দিতে ভুলতেন না কখনো। কিছুদিনের মধ্যে অনেক নতুন মুখেরও আনাগোনা শুরু হলো। পরিচিতির সীমা অতিক্রম করে তাদের কেউ কেউ বন্ধুত্বের আসনও দখল করে নিল। সবাই মিলে কাজ সামলাই, আড্ডা দিই, বিড়ি-চুরুট ফুকি, যথেচ্ছ চেঁচাই, প্রেম করি, সাহিত্য মারাই এবং একসময় দলবেঁধে রেলপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বোহেমিয়ানপুরের দিকে মনস্থ হই। জগৎ-জীবন জানবার-বুঝবার ওইসব এলোমেলোমিকে এখন যুগপৎ মহান এবং মহান-নয় বলে মনে হয়। ওই যাপনবিদ্যা পরে অনেক কাজে দিয়েছে, দিয়েছে ক্লান্তিও। ওই কয়েক বছরে লিটল ম্যাগাজিন এবং পত্রমাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সমসাময়িক লেখকদের সাথে যে যোগ তৈরি হয় তারই সাজশে দ্বিতীয় চিন্তায় পত্রস্থ হন বন্ধুজন হাফিজ রশিদ খান, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, হেনরী স্বপন, মোস্তাক আহমাদ দীন, ঈষৎ মৃত্তিক (পরে টোকন ঠাকুর), জফির সেতু, মাহবুব লীলেন, পাঁশু প্রাপণ, আকমল হোসেন নিপু, মারুফুল আলম, সৈকত হাবীব, আহমেদ কায়সার, ফজলুর রহমান বাবুল, সৌমিত্র দেব, রজব বকশী, সৌমিত্র দেব, সাদী তাইফ, মাসুদুল হক, রবিউল করিম, জাফর আহমদ রাশেদ, আহমেদ বাদল প্রমুখ। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখেন দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য, কল্যাণ ভট্টাচার্য্য, মানস কুমার চিনি, তৈমুর খান, সুবীর সরকার, ইমদাদুল হোসেন, রুহুল আমিন প্রমুখ। দ্বিতীয় চিন্তায় কখনো লিখেন নি, কিন্তু কর্ম কিংবা ভ্রমণ সুবাদে ময়মনসিংহ এলে অবশ্যই আমাদের খোঁজখবর করতেন এবং বিকাশলক্ষ্যী প্রণোদনা বিলিয়ে যেতেন সর্বকবি রাজা হাসান, স্বদেশ বন্ধু সরকার, জুয়েল মাজহার, আলমগীর রেজা চৌধুরী প্রমুখ। ক্রমশ আমরা তরুণ লিখিয়ে আড্ডারুরা ছড়িয়ে পড়ি বাংলাভাষাভাষী বিভিন্ন প্রান্তে, দেশ বিদেশের ছোটকাগজের ভূঁই ফুড়ে। সংবাদপত্রে সাহিত্য করা আমাদের ক্রমশ অপছন্দ হতে থাকে। আমাদের অহংকার আরো বাড়ে। যত্রতত্র ফুটতে তখন আমাদের ঘোর আপত্তি। টলটলে (আর্সেনিকমুক্ত) স্বচ্ছজলের নিষ্কলূষ পুষ্করিণী না হলে সে জলে আমাদের পদ্ম হতে রুচি হয় না। সিনিয়রদের মনে হতে থাকে রক্ষণশীল, ঘরকুনো, দূরের দ্বীপ। কিন্তু এ দূরত্ব ছিল নিছক সাহিত্যিক, মানসিক মোটেই নয়। সিনিয়রদের সাহিত্যসংস্পর্শ বর্জিত আমরা ছিলাম না তাই বলে। শোনা-পড়া দুইই চলত। তাঁদের সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নের চেষ্টাও আমরা করেছি নিয়মিত। আপনার ‘লাবণ্য ছুঁয়েছি তোমাকে’ ও ‘জলের গহীনে রোদ’ বিষয়ে লিখেছি আজকের বাংলাদেশ ও দ্বিতীয় চিন্তায়। লিখেছি ময়মনসিংহের কথাসাহিত্যিক হারুন অর রশীদ, কবি সাব্বির রেজা, কবি সোহরাব পাশা, সাহিত্যিক-সম্পাদক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর বই নিয়েও। অবশ্য এসবের পেছনে মূল্যায়ন চেষ্টারও অধিক নিজেকে তৈরি করবার প্রয়োজনটিই কাজ করেছে বেশি। সেসব লেখায় নিজের রুচির সঙ্গে যায় নি বলে অনেক বিরূপ কথাও বলেছি। কিন্তু তা বলে কখনো মুখে কালি ছিটিয়ে দেন নি। এ ধরনের সমর্থনগুলোই একটু একটু করে যুগিয়ে গেছে অমিত সাহস। আমরা যথেচ্ছ চড়ে বেড়িয়েছি সুবিস্তৃত সাহিত্যসংস্কৃতি মাঠে, তাজা ঘাস খাবার ও খাওয়াবার মনোলোভে। আজও আমরা অনেকেই চড়ে বেড়াচ্ছি, সে শক্তি-সাহস-প্রণোদনা অনেকটাই যে প্রথম যৌবনে ময়মনসিংহে লাভ করেছিলাম, সে ব্যাপারে মনে আজ আর সন্দেহমাত্র নেই।

৬. চন্দ্রাবতী প্রসঙ্গ

বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার পাতুয়ারি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বাংলাভাষার কবিকুলভুক্ত প্রথম পোড়খাওয়া শিল্পসফল নারী ষোড়শ শতকের চন্দ্রাবতী আমাদের অহংকার। দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকাভুক্ত ‘দস্যু কেনারামের পালা’, ‘মলুয়া’ (মতান্তর আছে) পালার রচয়িতা এই কবি। মনসা-ভাসান (১৫৭৫)-এর লেখক দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চিরকুমারী চন্দ্রাবতী এছাড়াও বাংলা রামায়ণ ও মনসা দেবীর গান রচনা করেছিলেন। তাঁর জীবন-প্রেম-সাধনা নিয়ে মৈমনসিংহ গীতিকায়ই ‘চন্দ্রাবতী’ নামে নয়ানচাঁদ ঘোষ কর্তৃক সতের শতকে রচিত ৩৫৪ ছত্রবিশিষ্ট আরেকটি পালা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই মহজ্জীবন সম্পর্কে কমবেশি জেনে আমরা তরুণরা নিজেদের তাঁর সন্তান ভেবে গৌরব বোধ করলাম। শিবপূজক চন্দ্রাবতীর স্থাপত্যস্মারক ফুলেশ্বরী তীরের মঠ আমাদের অনেকেরই এখনো দেখা বাকি। তবু আমরা ঠিক করলাম, আমাদের গৌরববোধটিরও একটি স্থায়ী ভাষিকস্মারক স্থাপন করা যেতে পারে। এই মর্মে আমরা তরুণ কবিতাকর্মীরা একমত হলাম যে, আমাদের বিভিন্নজনের কবিতাগুচ্ছ সমন্বয়ে একটি প্রকাশনা হবে, যার মোড়কনাম হবে ‘চন্দ্রাবতীর কয়েকজন সন্তান’ অথবা ‘চন্দ্রাবতীর সন্তানেরা’।

দ্বিতীয়োক্ত নামটি নেয়া হলে দাবি করা হয় কেবল আমরাই সেই গৌরবের অংশীদার। তাই আমরা প্রথমোক্ত নামটি নিলাম। সিদ্ধান্ত হলো কবিতাগুচ্ছ ছাড়াও এতে থাকবে গ্রন্থে অন্তর্ভুক্তদের পোর্ট্রেট ও তাঁদের কবিতা বিষয়ক একটি নিবন্ধ। ঠিক হলো চিত্রশিল্পী দিলীপ তালুকদার পোর্ট্রেট আঁকবেন এবং বাচ্চু ভাই নিবন্ধ লিখবেন। আমাদের তাবৎ প্রস্তুতি সম্পন্ন, কিন্তু বাচ্চু ভাই লেখাটা দিচ্ছেন না। তাঁর নিষ্পৃহতায় আমাদের উদ্যোগটি ভেস্তে যেতে বসল। আমরা পরিকল্পনামতো গ্রন্থটি করবার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। তাই বাচ্চু ভাইয়ের আশা ছেড়ে শরণ নিলাম দুলাল ভাই আপনার। আপনি অভয় দিলেন। দিনকয়ের ব্যবধানে ‘বারো কবির কাব্যভুবন : একটি পরিক্রমা’ শিরোনামযুক্ত নাতিদীর্ঘ একটি গদ্য আপনি লিখে উঠলেন। শেষপর্যন্ত ওই লেখাটিসহ ১৯৯৭-এর ফেব্রুয়ারিতে কিশোরগঞ্জের শিল্পী আবদুস সালামের গ্রাফিক্সসম্বলিত হয়ে শাহীদুল ইসলাম বিজুর তত্ত্বাবধানে শাহবাগের বইপাড়া থেকে বারো তরুণের কাব্যপ্রয়াস ‘চন্দ্রাবতীর কয়েকজন সন্তান’ প্রকাশিত হয়। আপনার কাছে আমাদের এরকম ঋণ অজস্র, শোধ করা যাবে না। প্রতিদানের আশায় আপনি সেসব করেনও নি আশা করি।

৭. ভূগোলের যেখানে ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ আপনার শহর, একান্তই আপনার। একথা উপলব্ধিতে আসে আপনার সঙ্গে পথে বেরোলে। সাহিত্য ও এর বাইরের জগতের কত মানুষ যে আপনাকে চিনেন-জানেন, সম্মান-শ্রদ্ধা করেন তার ইয়ত্তা নেই। ধারণা করি, আপনার সম্পূর্ণ পরিচিতিটা ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের কর্মকর্তা, প্রগতিশীল সংস্কৃতি আন্দোলনের কর্মী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কর্মকর্তা, ইত্যাদি অভিধা এবং সাহিত্যকর্মী পরিচয়টির মিশেল দেয়া রূপ। ওই গোটা পরিচিতির কত শতাংশ সাহিত্যকর্মীর (নাট্যকার, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ইত্যাদি) তা মাপবার সহজ সুযোগ নেই, মাপা অবশ্যকরণীয়ও নয়। একজন সক্রিয় সামাজিক মানুষ হয়ে উঠতে হলে কেবল একনিষ্ঠ সাহিত্যকর্মী হলেই চলে না। সমাজ জীবনের আরো নানা প্রয়োজন সামনে এসে দাঁড়ায়, সেসবে সাড়া দিতে হয়, দেন অনেকেই। আপনিও তাদের একজন, সেজন্যে আপনি ধন্যবাদার্হ্য। কিন্তু সবাই জানেন এবং মানেন যে, সাহিত্যকর্মী পরিচয়টিই এর মধ্যে গৌরবে উৎকর্ষপূর্ণ অর্থাৎ সেরা। আপনার বিবেচনাও অন্যরকম হবার কথা নয়। সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে এখানে একটি প্রশ্ন করবার খুব শখ হয় যে, আপনার কি কখনো হিসেব করে দেখতে ইচ্ছে করে না যে নিজের কৃত বিচিত্র ধরনের সাহিত্যপ্রয়াস বাংলাভাষাভাষী সাহিত্যপাঠকের কতভাগের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারা গেছে বা পাঠকের স্বতঃস্ফূর্ত তৎপরতায় আপনা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ? অর্থাৎ আপনার সাহিত্যকর্মী পরিচয়ের ভূগোলটি কতটা প্রসারিত হতে পেরেছে ? মাত্র দেড় দশকের সাহিত্যসংস্রবপুষ্ট আমি, এ প্রশ্ন আমাকে এখনই করতে শুরু করেছি। এর যথার্থ জবাব কখনোই পাওয়া যায় না, কিন্তু প্রশ্নটা নিজের কাছে জারি রাখা গেলে আখেরে বেশ লাভ হয়। আমার মনে হয়, এই কৌতূহলটি আপনার মধ্যে জাগ্রত হলে আপনিও উপকৃত হবেন। প্রকারান্তরে উপকৃত হবে আপনার সাহিত্যকর্মও। এই পথ ধরে ওই সরল জিজ্ঞাসাটিরও যে একটি আপাত সজ্জবাব কখনো মিলে যাবে না, এরকম ধারণা করা আমার কাছে ধ্যানযোগসংঘটনপরিপন্থী বলেই মনে হয়।
পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে নবাববিড়ি টাউন হলের মোড়ে, জানতে চায় কেমন আছ গোল্ডলীফ এবং অতিচেনা শহর ? বেলা দু’টা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা-- এই পরিসরে সড়ক দুর্ঘটনায় এখানে নিহতের সংখ্যা কত ? (প্রাগুক্ত)

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...