Saturday, November 14, 2009

কবিতার গান হয়ে ওঠা

খ. সুরের জগৎ কথার থেকে পৃথক।
গ. তবু এমন কথা আছে যাকে সাজালে সুরের রাজ্যে সহজে যাওয়া যায়।

কথা ও সুর : ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

আধুনিক বাংলা গান বিষয়ে আমি এখানে কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ লিখতে উদ্যত হই নি, কিংবা স্রেফ সাইম রানার গান বিষয়েও কোনো প্রবন্ধ লিখবার কোশেশ এটা নয়। এই লেখার অভিমুখ নিতান্তই অগভীর, কেবল আজকের গীতবৈঠকে গীত হবার জন্য তাঁর দশটি নির্বাচিত কবিতাকে ঘিরেই এর আবর্তন। ফলে এর প্রতি কোনো ধরনের অত্যাশা পোষণ হতাশার কারণ হতে পারে।

এই নিবন্ধকারের জানা আছে যে, সাইম রানা একজন কবি। আমি নিজেও কবিতার প্রতিবেশী বলে বিষয়টা অনেকটা কাছে থেকেই জানা। কিন্তু রানা যে একজন সংগীত সাধকও, সেটা আমি জানি না অথবা খুবই দূর থেকে জানি। কারণ কখনোই তাঁর কণ্ঠে সুরে বাঁধা কোনো কথা শুনবার সৌভাগ্য আমার হয় নি। আজই মাত্র আমার সামনে তেমন একটা সুযোগ অবারিত হতে যাচ্ছে। আমার কৌতূহলটা তাই সেখানেই বেশি। লিরিকগুলো আগে দেখা-পড়া থাকায় হয়ত এই এপিসোডটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য হবে, কেননা প্রায়-ন্যাংটো, উলোঝুলো ও ভাব-বক্তব্যের ভারবাহী কথার শরীরে সুর চাপালে সৌন্দর্য কীভাবে পূর্ণতা পায় বা লুপ্ত হয়, কীভাবে ডানে-বামে মোড় নেয় তা মিলিয়ে নিয়ে নিজের জানাবোঝাটায় কিছু হয়ত যোগ করার সুযোগ তৈরি হবে।

আজকের গীতবৈঠকের সংকলনে মুদ্রিত সাইম রানার কবিতাগুলো আমি বারকয় পড়েছি। এগুলোকে কবিতাই বলছি, কারণ সুর লাগবার আগ পর্যন্ত এগুলো তাই-ই, গান নয়। প্রথমবারের পড়াটা ছিল, যাকে বলে চোখ বুলানো, কোথাও ধাঁধিয়ে যাবার মতো কিছু ঠেকে যায় কি না তার অন্বেষণ। ঠেকে নি। কেমন সব চেনা চেনা শব্দ-বাক্য, চেনা ছবি, চেনা ফ্রেইজ। সপ্তাহখানেক সংকলনটা অবহেলায় পড়ে থাকে। ছুঁই না, ছোঁবার টান অনুভব করি না বলে। শুক্রবার যখন বেশ ঘনিয়ে আসতে থাকে, তখন ভেতর থেকে ক্রমশ নাগরিক হয়ে ওঠা আমার মনটা তাড়া দেয়, সেটা এই বলে যে, তুমি এই মর্মে আয়োজকদের কথা দিয়েছ, কবিতাগুলো সম্পর্কে একটা মিতভাষ্য অন্তত উপস্থাপন করবে। আমি আতঙ্কিত বোধ করি। তবে সেটা সহজেই কাটিয়ে ওঠা যায়। এক রাতে অন্য সব কাজকে লজিক্যালি গৌণ ঠাওরিয়ে সংকলনটা নিয়ে ফের বসা হয়। একটা একটা করে কবিতা পড়ি আর চোখ বন্ধ করে মাথার ভিতর কবিতাটাকে খেলাতে চাই। খেলে তো খেলে না। তারপর আবার পড়ি, কখনো বা আবার। দেখি যে ভিতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম হচ্ছে। এক দুই শব্দে লেখাটার পাশেই ওই প্রতিক্রিয়াগুলো লিখে ফেলি। দশটি লেখাই যখন পড়া শেষ হয়, তখন ভিতরে একটা সমন্বিত চাপ তৈরি হয়, যা দশটি লেখার ভিত্তিতে সামগ্রিক একটা প্রতিক্রিয়াও উগরে দিতে চায়। একটা নোটখাতায় তাও টুকে ফেলি।

এরও তিন ঘণ্টা পরে বসি কম্পিউটারে। পটভূমি রচনার পর থমকে যাই, কীভাবে এগোবো সেটা ভেবে। সহসা সিদ্ধান্ত নেই যেভাবে চিন্তা এগিয়েছে সেভাবেই না হয় হোক লেখাটা। অর্থাৎ, পাঠোত্তরে প্রতিটা কবিতার পাশে প্রথম জন্ম নেয়া যে প্রতিক্রিয়াটি লেখা হয়েছিল তাই-ই একে একে বিন্যস্ত করি। লিখি--
  1. লড়াই-সংগ্রাম ছাপিয়ে ওঠা ক্লিশে এক আশা
  2. এবারও ভোর হয়, কোকিলেরা গেয়ে ওঠে পুরাতন ব্যথা ভুলে
  3. যা কিছুকেই তিনি মহান বলে ভাবেন, মহিমান্বিত করতে চান, তা-সবকেই তিনি বিশালতার উপমায় উপমায়িত করেন
  4. শিশুসুলভ সরল আবেগ উসকে ওঠে, দীর্ঘ জীবনের আকুতি প্রকাশ পায় শিশির প্রতীকে
  5. দুঃখমোচনের সাংগীতিক প্রেসক্রিপশন, যেখানে আবারো উঁকি দেয় আশা নামের ফুলঝুরি
  6. নদী-নৌকায় মাখামাখি ভাঙাগড়ার জীবনচিত্রে মূর্ত বাংলার রূপ
  7. ‘তুমি আসবে বলে’, ‘তুমি হাসবে বলে’-- এই জাতীয় ফ্রেইজ লিখতে অসতর্কতাজনিত একটা সাহস লাগে
  8. (...)। (সেসব কবিতাই গানের জন্য উৎকৃষ্ট, যাকে গদ্যে রূপ দেয়া যায় না।)
  9. অতিকে স্পর্শ করা খোলা কল্পনার উৎকর্ষ
  10. চিরছবির সংকলন। নীরবে কেয়াগাছের পাতা নড়ছে, ঋতু বদলাচ্ছে, এসব ঘটনার বয়স কখনোই বাড়ে না। কিন্তু মানুষের বয়স বাড়ে, আর বয়স বাড়া মানে ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়া-- মৃত্যুতে।   
এবার নোটখাতার দিকে তাকাই। সেখানে লেখা আছে, সাইম রানার এসব কবিতায় নতুন বোধ বা ছবির আবিষ্কার কই? কেবল পৃথিবীর নিয়ম রেখাকে ঘোড়ার ক্ষুরের মতো করে দেখা, কিংবা চোখের ভিতর পায়রার জল খেয়ে আশা মেটানো, কিংবা আয়ুর গ্লাসে মৃত্যু রাখা, কিংবা মেঘের বিছানায় হরিদ্রা কন্যার বেশে প্রভাতের ঘুমিয়ে থাকা, কিংবা জলের তারের কাঁপনে মেঘলা কুমারীর কেশে তান বাজানো-- এমন কয়েকটি জায়গা ছাড়া বাকি সব চিরচর্চিত বিষয়, বলনকেতায়ও যেসব প্রায় অনতুন। অর্থাৎ যেসব ছবি বা ছবিকল্প এখানে আঁকা হয়েছে, সেসব খুবই চেনা, তা সে গ্রামীণ বা নগর যে বাস্তবতা থেকেই নেয়া হোক বা যে বাস্তব ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই কল্পনা করা হোক। লক্ষণীয় যে, গ্রামীণ ছবির উপস্থিতি বেশি হলেও সাইম রানার ভাব মূর্ত করবার ভঙ্গিটা অতিশয় নাগরিক বলে পুরো গ্রামীণ প্রেক্ষাপট ছুঁয়ে থেকেও তাঁর কবিতা লোককবিতা হয়ে ওঠে না বা বলতে পারি লোকগানের আত্মীয় হয়ে ওঠে না।

সাকুল্যে আমার পর্যবেক্ষণ এটুকুই। কিন্তু গীত হবার জন্য লিখিত কোনো কবিতাগুচ্ছ, অর্থাৎ লিরিক বা গীতিকবিতা সম্পর্কে এই-ই কি কখনো শেষ কথা হতে পারে, না হওয়া উচিত? যেখানে বলা হয় যে ‘সুরের জগৎ কথার থেকে পৃথক’, সেখানে এসব কথা তো শেষপর্যন্ত গীতঘনিষ্ঠ, সংগীতবান্ধব কোনো সম্ভাবনার কথা শোনায় না। এই টেক্সট কি সেসব সম্ভাবনা রহিত? অবশ্যই নয়। বরং সেদিক থেকে দেখলে এ ধরনের টেক্সটই প্রার্থিত। কীভাবে? আমাদের সংগীতচিন্তায় সামনের সারিতে বিবেচ্য বিশিষ্টজন ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কথা ও সুর’ প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ‘শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতায় দুর্বোধ্য কথার বদলে পুরাতন ও পরিচিত কথারই প্রয়োগ দেখা যায়।’ কেন এমন হয় বা হতে হয়? কারণ কবিতা বুঝতেই যদি বেগ পেতে হয়, তবে সেটা উৎকৃষ্ট গীতিকবিতা হবার যোগ্যতা হারায়। এক্ষেত্রে তাঁর চূড়ান্ত কথা হলো, ‘যে শব্দ যত পরিমাণে অর্থ কিংবা বস্তুকে অতিক্রম করবার শক্তি ধারণ করে সেই শব্দ তত পরিমাণে গীতে সহায়ক, এবং সেইপ্রকার শব্দবাহী, শব্দবিন্যস্ত কবিতাই ততটা পরিমাণে সুর রচনার উপযুক্ত বাহন।’ কবিতাগুলো আমাদের পড়া আছে বলে আমরা কিছুটা জানি আবার সুরের সহযোগ পেয়ে কবিতার কথাগুলো কীভাবে এক্ষেত্রে উতরেছে তা আমরা এখনো জানি না বলে আপাতত এরকম একটি সিদ্ধান্তে দাঁড়ানোই সংগত যে, রানা হয়ত এই কবিতাগুলোর কথা এমনভাবেই সাজিয়েছেন, যার ভিতর দিয়ে সুরের রাজ্যে সহজে যাওয়া যায়।

সাইম রানা তাঁর সংগীতকর্মে সব্যসাচী। নিজেই তিনি গীতিকার-সুরকার এবং গায়ক। ফলে তাঁর সুরারোপের কৌশলকে, তাঁর গায়কীকে আলোচ্য গীতিকবিতাসমূহের পাশে রেখে কথা না বলে কেবল লিরিক নিয়ে শব্দে শব্দে আমরা যত কথাই সাজাই না কেন, তা সর্বার্থে অসম্পূর্ণতাকেই মূর্ত করে তুলবে। সুতরাং একটি অবশ্য-অসম্পূর্ণতাকে বেশিক্ষণ জাপটে ধরে না থেকে বরং কান পাতা যাক সেই কোনো জাদুতে, যা ব্যবহারিক জীবনের ভাবগুলির তুলনায় স্বভাবগতভাবেই অস্পষ্ট অথচ জীবনকে ছাপিয়ে থাকার ধর্মে যা আচ্ছন্ন।

৭ মার্চ ২০০৮
গীতবৈঠক, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...