Friday, January 10, 2014

মাহবুব কবিরের কবিতার দিকে তাকিয়ে

বিবিধ দূষণ, আচরণের ক্রূরতা-বক্রতা, নিকটজনের তীর্যক বাক্যবাণ, পারস্পরিক অবিশ্বস্ততা, সন্দেহ, প্রভৃতি যখন দারুণভাবে ক্লান্ত-শ্রান্ত করে তুলছে, যখন শ্বাসকষ্ট গেড়ে বসছে ফুসফুসে-মনে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই যখন খুঁজছি গ্রামকে হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে-দেয়া-যায় ধরনের ছোট শহরের আবডাল, তখন অন্তর্গত প্ররোচনাবশত আরো একবার মাহবুব কবিরের কবিতার শুশ্রূষা নিতে গিয়ে শৈশব-কৈশোরকে স্পর্শ করতে পারার আনন্দে যেন নতুনভাবে বেঁচে উঠছিলাম আমি। জানি, ওটি দুধের স্বাদ নিছক ঘোলে মেটানো। তথাপি কবিতার এ মনোসামাজিক গুরুত্বকে নিজের মতো করে উপলব্ধিতে আনতে পেরে ভিতরোৎসারিত অন্যরকম এক আহ্লাদবোধে তাড়িত হচ্ছিলাম। সেটি বছর দশেক আগের কথা, যখন আমি এই ঘোরে সমর্পিত হই। তৎকালে ঘোরটিকে আবিষ্কারের একটা ইচ্ছেও জাগে মনে। এরকম সদিচ্ছা থেকে কৈ ও মেঘের কবিতাসমৃদ্ধ আমার ভাণ্ড পূর্ণ করে তুলি কবিবন্ধু অলকা নন্দিতার সংগ্রহ থেকে ধূলির বল্কল ধার করে এনে। তখনকার ভালোমন্দ লাগাগুলোর দুয়েকটা সূত্রকথার ভার কী-বোর্ডে আঘাতও করেছিল। কিন্তু মাত্র ওই পর্যন্তই। আর এগোনো যায় নি। সাহিত্যদর্শনজাত একটি বৈপরীত্য আমাকে হঠাৎই শাসাতে লাগে। ফলে ঘোরটি ভিন্নদিকে মোড় নিয়ে নেয়। ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য হাজারো কাজে।

ব্যাপার এমন হয় যে, মাহবুব কবিরকে আমরা কম দেখতে থাকি, এমনকি ওর কবিতাকেও। কবিতার জন্যে ওত পেতে থাকা ওর স্বভাবেও খানিক পরিবর্তন আসে। একা হলেই জীবন ওকে বেশ ধমকাতে শুরু করে। এই ধমকের ভয়েই ও সংসারী হবার দিকে তাকায়। আর সম্ভাব্য প্রয়োজনে ওকে গলা বাড়িয়ে দিতে হয় পরাধীনতার যূপকাষ্ঠে। সাপ যেমন মাথার মণিকে নিরাপদ স্থানে রেখে খাদ্যাহরণে যায়, তেমনি মাহবুবও কবিতার ঘোরকে ব্যাগে অথবা অন্য কোথাও রেখে পত্রিকা অফিসে যাতায়াত শুরু করে। স্বর্ণালী পর্বটি ওর সমাপ্ত হয়ে যায়।

২.
২০০৫-এ আমাকে হাওর বিষয়ে একটি ধারণাপত্র তৈরি করবার দায়িত্ব নিতে হয়। এ-বিষয়ক সংশ্লিষ্ট, আধাসংশ্লিষ্ট, ঊনসংশ্লিষ্ট সব সেকেন্ডারি ইনফরমেশনের এক বিশাল ভাণ্ডের নিচে আমি প্রায় চাপা পড়ে যাই। প্রায় তিন মাস সময় নিয়ে ওই স্তূপ থেকে বেরোতে বেরোতে দেখতে পাই যে আমার পরিকল্পিত ধারণাপত্রটি একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপ পরিগ্রহ করেছে। যেটি ওই বছরই ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) একটি গ্রন্থমর্যাদায় হাওর : জলে ভাসা জনপদ নামে প্রকাশ করে। তো, ওটি লিখবার সময় বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতিতে হাওর কীভাবে উপস্থিত তা খুঁজে দেখবারও একটা চেষ্টা চালাই। এজন্য প্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট গ্রন্থগুলোর সঙ্গে আমি আমূল ময়মনসিংহ গীতিকাও চষে ফেলি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হাওরের ছেলে মাহবুব কবিরের কবিতার দিকে তাকাবার কথা তখন আমার একেবারেই মনে পড়ে নি। ওর ‘হিজল-জন্ম’ কবিতায় হাওরকে যে নিবিড়ভাবে আবিষ্কার করা আছে, সেটি তখন স্মরণ করতে না-পারার আমার যে অক্ষমতা, তা গ্রন্থটির প্রকাশপরবর্তীকালে আমার জন্য দারুণভাবে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। অনেক সজ্জন পাঠক বাংলাভাষায় হাওর বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ ও সফল গ্রন্থ হিসেবে ওই পাঁচ ফর্মা পরিসরের প্রকাশনাটিকে গুরুত্ব দিলেও ‘হিজল-জন্ম’-এর পুনর্পাঠে আমি তুলনা করে দেখেছি যে, মাহবুব কবিরের ওই ৯৫ শব্দের কবিতাটি আমার ২৫ হাজার শব্দের গ্রন্থটির চেয়েও সফল। হায় সক্ষমতা!

৩.
যন্ত্রকঠিন নিষ্ঠুরতার অকুস্থল এ চোখধাঁধানো আপাতউজ্জ্বল নগর বারবারই মনে করিয়ে দেয় যে, এ স্থান অন্তত আমার জন্য নয়, যার মনোমূল ছড়িয়ে রয়েছে গ্রামদেশে। প্রতিদিনই তাই ভালোবাসার পাল্লাটা হেলে যাচ্ছে পিছে ফেলে আসা গ্রামসীমানার দিকে। সুখজাগানিয়া স্মৃতিবোধ মুচড়ে উঠছে তার মাঠ-মধ্যিখানে থাকা পক্ষীকূজনিত একলাএকা গাছকে নিয়ে, ঘাসকার্পেটে মোড়িত মাছরাঙারঙিন পুকুরপাড়কে নিয়ে, শাপলাসুন্দর বিলহাওরের অনিন্দ্যসুন্দর ইশারাকে নিয়ে, খলবল লাফিয়ে ওঠা ছোট-বড়ো মোলা-ডানকিনে মাছকে নিয়ে, ধুলোওড়া দিনের খেজুরগাছের সীমানা আঁকা উলুঝুলু কাঁচারাস্তাকে নিয়ে, কুয়াশাজর্জর রাত্রি-লেপে-দেয়া অন্ধকারে অস্তিত্বময় লণ্ঠনের আলোয় দেখা পালাগানের নায়িকাকে নিয়ে। এই সবকিছু এবং এর বোনবেরাদর সহযোগে গড়ে ওঠা গ্রামসংস্কৃতির যে বিস্তৃত পাঠশালা, তার অনেক টুলবেঞ্চিপাঁচিলধারাপাতই খুঁজে পাওয়া যায় মাহবুব কবিরের কবিতায়। এ মন্তব্যের বিশ্বস্ত সাক্ষ্য বহন করে ওর ফৃ প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ কৈ ও মেঘের কবিতা। গ্রন্থটি বাংলা কবিতার বিচিত্রলক্ষ্যী বহুস্বরব্যঞ্জিতঘোরকালসীমানায় একটি ঘাড়-কাত-করা হিজলগাছের মতো হাওরদেশের আলোহাওয়াজল গায়ে মেখে ধ্যানস্থ নিতান্ত সহজ-সরল এক নালায়েক মেধাবী তরুণের চকিত উত্থানের বিন্দুবিসর্গ অঙ্গে ধারণ করে মহীয়ান হয়ে আছে।

৪.
একজন পাঠক কবিতার কাছে যান কীসের অন্বেষণে? মাহবুব কবিরের কবিতায় যা সহজলভ্য সেসবের অন্বেষণেই কি? এর উত্তরে বলা যায়, হ্যাঁ সেসবও, তবে অবশ্যই সেসবই নয়। আরো অনেক কিছুই কবিতার কাছে প্রত্যাশার থাকতে পারে, থাকেও। আমরা যখন অন্যভাষায় রচিত কবিতা পড়ি, পড়তে যাই, তখন তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকে একরকম, আর যখন বাংলাভাষায় রচিত কবিতা পড়ি তখন আরেকরকম। কোনো কবিতা যে-ভাষায় রচিত সে-ভাষাসংস্কৃতির একটি আন্তর্স্বর সে কবিতায় থাকাই সংগত। মাহবুব বাংলায় লিখে থাকে, ওর কাছে আমাদের প্রত্যাশা কাজেই বঙ্গভূমির-বঙ্গবাসীর আনন্দবেদনাউন্মাদনার ভাষিক অভিঘাত। আমাদের সে প্রত্যাশা মাহবুব পূরণ করে অনেকাংশে। যে ধন ওর কবিতামালার আনাচেকানাচে গচ্ছিত সে ধন বাংলা কবিতার চিরকেলে মৌলসম্পদ। বহমান বাঙালি সংস্কৃতির এ রূপগুণরেখাবলির ছাপ আমরা বাংলা কবিতার কাছে অবশ্যই প্রত্যাশা করি।

কিন্তু কোনো কবিতার সর্বস্ব যদি হয়ে ওঠে গ্রামবাংলার বিশ্বস্ত ফটোগ্রাফ, তখন কি সে কবিতার প্রতি আমরা একটু সন্দেহের চোখে তাকাই না? মুখটাকে আলগোছে একটু এদিক-সেদিক বাঁকাই না? সে-জাতের কবিতার প্রতি আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারি না, যা বস্তুত প্রদর্শন করে ক্যামেরার শৈলীচারিতা। পারি না, কারণ কবিতার কাছে আমরা যাই ক্যামেরার পারদর্শিতা দেখতে নয়। দেখতে যাই ফটোগ্রাফকে ছাড়িয়ে সৃজিত এমন এক পুঞ্জীভূত রূপ, যা কল্পনারঙিন অন্তরাকাশের শাদাকালো মেঘাবরণীমোড়িত, যা চিন্তনের ওইপারে চরের মতো জেগে ওঠা আবেগের ধ্রুপদী বদ্বীপ; যেই অভীপ্সারাশি পাঠককে দেয় নেচে ওঠবার মন্ত্রণা, সাঁতারস্বস্তিপ্রদ মৃদুকম্প জলের অনুকম্পা, নস্টালজিক ঝিনুক কুড়োবার তাৎকালিক ফুরসত। এসব লক্ষণসম্পৃক্ত প্রশ্নের সদুত্তরও যদি মাহবুবের কবিতা করুণা করতে সক্ষম হয়, তবে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারব যে, ঈদৃশ মাহবুব কবিরীয় স্বরন্যাস বাংলা কবিতায় খুব প্রয়োজনীয় কিছু করতে উপগত। আশার কথা কৈ ও মেঘের কবিতার পাতা উলটে আমরা সে দাবির সপক্ষে দাঁড়াতে-পারে-ধরনের তথ্যউপাত্তকে সগৌরবে সমুপস্থিত দেখতে পাই।

৫.
আমরা যারা কবি মাহবুব কবিরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি-জানি, ওর কবিতা পড়ে মনে হয় মাহবুব কবিরের পক্ষে এরকম কবিতা লেখাই সম্ভব। মগ্নতার যে পর্যায়ে থাকলে একজন মানুষের কোনো শত্রু উৎপাদিত হয় না (যদি অবশ্য হাঁটাচলার পথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবার ব্যাপারটাকে শত্রু উৎপাদনের কারণ ভাবা না-হয়), একান্তে প্রেম নিবেদন করবার মতো সুযোগও বর্তমান থাকে না কোনো কবিমুগ্ধ তরুণীর, ধ্যান ভেঙে যাবে ভেবে হাত ধরে সাঁকো পার করে দেবার তাড়না বোধ করে না কোনো সঙ্গীপথিক; মাহবুব কবির বলতে গেলে ততখানিই নিমগ্ন। এই মগ্নতা যদি কারো নিজের মধ্যে কেবল নিজেকে নিয়ে হয়, তবে তার সৃষ্টিতে কখনো বেজে উঠতে পারে না পৃথিবী নামক গ্রহে বিরাজিত আপামর জীবনের নিগূঢ় যাপনধ্বনি, যা একদিন মহাকালিক ব্যঞ্জনা লাভে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু মাহবুবের কবিতায় নড়েচড়ে ওঠে বৃহৎঅর্থে বিচিত্ররূপী জীবনেরই খলবলতা, কাজেই গজকাঠি ফেলতে হয় ভিন্ন বিবেচনায়, যে, এ মগ্নতা প্রকৃতঅর্থে নিজের মধ্যে হলেও নিজেকে নিয়ে মন্ময় নয়, বরং বিস্তৃত প্রাণিকুলের সমূহতা নিয়ে তন্ময়।

আমরা জানি, কোনো কোলাহলেই প্রায় ওকে পাওয়া যায় না মধ্যমণিরূপে। স্বার্থদ্বন্দ্বে নিমজ্জিত সাহিত্য-রাজনীতির যে দুর্গন্ধ-কলুষতা প্রতপ্ত সাহিত্যপাড়ার ধুম্রোদ্গারী বিবর্ণ আকাশে দমবন্ধকর ল্যাংমারাখোঁচাখুচিনিন্দার অক্সাইড ছড়িয়ে যাচ্ছে শতকে-শতকে ও দশকে-দশকে, তার থেকে যোজন-যোজন দূরের সরু আলপথ দিয়ে ও পথ হাঁটে। মিডিয়াবাজির মতো নিন্দার্হ বায়ুযানভ্রমণে ও বরাবর অনুৎসাহী এবং অতৎপর। এহেন একজন ভাবুক কবিকে খুঁজেখেটে ওর কবিতার কাছাকাছি থেকে ভালোবেসে যাওয়া ছাড়া উৎকৃষ্ট কর্মটি আর হয় না বলেই মনে করি। যদিও আমরা কেবল ততক্ষণই এটি করে যেতে পারব, যতক্ষণ আমাদের কাছে ওর কবিতাকে প্রয়োজনীয় মনে হবে কোনোরূপ বাহ্য প্ররোচনাহীনভাবে এবং যতদিন স্বস্ব যোগ্যতায় ওর গ্রন্থসমূহ আমাদের সংগ্রহে অচর্চার ধূলিমলিনতামুক্ত থাকতে পারবে।

৬.
১৯৯৬ সালে ওর প্রথম গ্রন্থ কৈ ও মেঘের কবিতা প্রকাশিত হলে পরে যে মুগ্ধবিস্ময় ঝরে পড়েছিল পাঠকের চোখ-মুখ-চিত্ত থেকে, ১৯৯৭-এ প্রকাশিত ওর দ্বিতীয় গ্রন্থ ধূলির বল্কল তার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধিই ঘটাতে পারে নি বস্তুত। কারণ তিনটি কবিতা বাদে আনুপূর্বিক কৈ ও মেঘের কবিতাকলাপই ধূলির বল্কল-এ ধৃত হয়ে নিজস্ব রূপ-চেহারাসমেত আসন গ্রহণ করেছে সামনের সারিতে। পেছনের সারিতে বসা নগরের অনেকটাই নষ্টচতুরতাজ্ঞানমিশ্রিত কবিতাসমূহ যেন জরাগ্রস্ত বৈকল্য নিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে জানান দিচ্ছে যে, আছি বলেই এটা আমাদের একরকম থাকা, না-থেকেও-থাকা বা থাকার মতো থাকাটা আমাদের চরিত্রধাতে নেই। এ কবিতারাজিতেও কৈ ও মেঘের কবিতার মাহবুব কবির বর্তমান, তবে ওর সঙ্গে আছে সেই চতুরতা, সেই নাগরিকতা, চিন্তার সেই সঙ্করতা, যা অনেক কিছুর ব্যানারে হাতে ধরিয়ে দেয় শেষপর্যন্ত ফাঁকির হাওয়াই মিঠাই।

এখানে মাহবুব কবির বউকে মা ডাকার পক্ষে অ্যাডভোকেসি করেছে। বুঝি না, জনসাধারণ্যে কবিতা করে এটা বলা দরকার কেন? কবিতায় বিষয়টা নতুন সন্দেহ নেই। কিন্তু বউকে মা কিংবা স্বামীকে বাবা বললে সমাজপ্রতিষ্ঠান আরোপিত বিবাহসম্পর্কের নেতিশৃঙ্খল থেকে মানুষ নামের জীবেদের উত্তীর্ণ হবার পক্ষে কী এমন বিপ্লব সাধিত হবে তা আপাতত বোধগম্য নয়, যেটির উদ্বোধন মাহবুব ওর ‘মা বাবা’ নামক কবিতায় ঘটিয়েছে। যার কাজ কৌতুক করা, সে করলে তা সবার কাছেই স্বাভাবিক বোধ হয়, কিন্তু আমরা যতটা বুঝি, তাতে মাহবুব কবিরকে মোটেই কৌতুক করবার মতো হালকা স্বভাবের মানুষ মনে হয় না। ওর এ প্রতিপাদ্যে এজন্য আমরা খানিক চমকেই উঠি বস্তুত।

৭. 
এই লেখাটুকু বেশ কয়েক বছর আগে মাহবুব কবিরের কবিতা নিয়ে লিখিত আমার একটি দীর্ঘ মুসাবিদার অংশ। সে সময়কার সমস্ত বিবেচনার সঙ্গে হাতে হাত রেখে এখন আর এগোনো যাচ্ছে না। সুতরাং লেখাটা কিছুটা ঝেড়েমুছে নিতে হলো। সেটা মাহবুবের কবিতা এতদিনে খানিকটা বদলে গেছে বলে যতটা, তার চেয়ে বেশি আমার বিবেচনাবোধের বদলে যাওয়ার কারণে। শেষপর্যন্ত যা থাকল, তা কবি মাহবুব কবিরের কবিতাবিষয়ক নোট হিসেবে রীতিমতো অসম্পূর্ণ। এই সেই কারণ, যেজন্য দমবন্ধকর ব্যস্ততার মধ্যেও আরো দু’কলম খুচরো আঁকিবুকির চেষ্টা।

আমরা অবগত যে, ইতোমধ্যে ধূলির বল্কল-এর গ্রন্থমর্যাদা কবি-কর্তৃক প্রত্যাহৃত হওয়া ছাড়াও কৈ ও মেঘের কবিতার পুনর্মুদ্রণ সম্পন্ন হয়েছে। ২০০৯ ও ২০১২-এ বেরিয়েছে যথাক্রমে ওর আরো দুটো কাব্যগ্রন্থ ফুলচাষি মালি যাই বলো এবং বেসরকারি কবিতা। বই দুটি এতদিন পর্যন্ত মাহবুব কবিরের প্রায়-আন্ডারগ্রাউন্ড কবিপরিচিতকে টেনে হ্যাঁচড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জনসমক্ষে। পাঠকের শতধাবিচ্ছিন্ন মনোযোগকে এরা বাধ্য করেছে তাদের দিকে ফোকাসটাকে ঘুরিয়ে দিতে। কিন্তু কী দিয়ে? অত্যাশ্চর্য সারল্য ও দায়বদ্ধতাবোধ দিয়ে, প্রায় নিরলংকার বলনকেতার অনাড়ম্বরতা দিয়ে, কথাকে কবিতা করে তুলবার অনায়াস ভঙ্গি দিয়ে। এসব বৈশিষ্ট্য মাহবুব কবিরের কবিতায় আগেও ছিল। ফুলচাষি মালি যাই বলোর প্রেক্ষাপটও প্রায় অবিকল কৈ ও মেঘের কবিতার অনুরূপ গ্রামীণআবহে মোড়িত। তবে বেসরকারি কবিতার পরিসরে নগর তার শুভপ্রবেশ নিশ্চিত করে নিয়েছে; তবে অবশ্যই চাকচিক্যপূর্ণ অবয়ব নিয়ে নয়, আনাচকানাচের মালিন্য নিয়ে। এই দুই গ্রন্থে ওর কথার ধার আরো বেড়েছে, বোধের আগাটা আরো সুচালো হয়েছে, মানুষ ও সমাজ-সভ্যতা নিয়ে ওর ভাবনাটা আরো স্পষ্টতর হয়েছে।

মাহবুব কবির কবিতায় কথা বরাবরই কম বলে। গল্প করার জন্য গল্প বলে না, কিন্তু প্রায় কবিতায় গল্পচূর্ণ ছড়ানো ছিটানো থাকে ওর বিশেষ কাব্যশৈলীর চাহিদা অনুসারে। ফলে ওর কবিতার ভরা জনপদে খালি চোখে তাকালেও বিপন্নপ্রায় চরিত্রের বিষণ্ন মুখ দেখা যায়। হুমকির শিকার গাছপালা, প্রাণী, প্রান্তিক জনতাকে ঘিরেই প্রধানত ওর ভাবনারা ডালপালা মেলে। যেসব মানুষ ওর কবিতার মূল মনোযোগের কেন্দ্রে তারা সামাজিক মর্যাদায় তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির বা তারও চেয়ে হীন ব্রাত্যজন। বাসনকোসনের ফুটো সারাইকারী, মেথর, দরিদ্র পাখিশিকারি, যৌনকর্মী, ভাগ্যগণনাকারী, কুসংস্কারান্ধ পিরভক্ত, ওঝা, পাঁঠা দেখানেঅলা, মড়া সৎকারকারী ও শ্মশানচণ্ডাল, চোর ও খোঁড়া চোর, পাতকাকুড়ানির ধর্ষিতা মেয়ে, অগ্নিদগ্ধ নির্যাতিত নারী, জুয়াড়ি, হিজড়া, মাদকাসক্ত যুবক, ছিনতাইকারী প্রভৃতি পরিচয়ের নারী-পুরুষের মুখ ওর কবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে অতি ঘনিষ্ঠভাবে চেনা যায়। আছে এদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত মর্যাদার মানুষও-- বিপন্ন আদিবাসী, উদ্বিগ্ন পিতা, মুক্তিপণের দাবিতে অপহৃত, নিষ্কর্মা কল্পনাচারী, চিত্রকরের নগ্নিকা মডেল প্রভৃতি। এমন নয় যে, অন্য কিছু বলতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে এই দুই পর্যায়ের মানুষের কথা ওর কবিতায় উল্লিখিত। বরং এরাই সংশ্লিষ্ট কবিতাগুলোর কেন্দ্রীয় বিন্দু, যে বিন্দুকে কেন্দ্র করে কবিতাময় অন্য কথার বৃত্ত অঙ্কিত হয়েছে। এ যেন অজান্তেই কবিতার বর্ণাবলেপনে নিম্নবর্গের মানুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনা করে যাওয়া।

৮.
মাহবুব কবির কবিতা করে তুলবার জন্য কোনোরকম বল খাটায় না। শব্দ ও বাক্যের ব্যায়াম করে না। মাহবুব সাধারণ অভিজ্ঞতার বিশেষায়িত পর্যবেক্ষণসমূহ সহজ করে বলে যেতে থাকে মাত্র। ওর মূল কারিগরিটা মনে হয় বলাবলির নিরাভরণ রূপ এবং পরম্পরা বিন্যাসে। সাধারণত মাহবুব যা দেখে তাই বলে। কখনো কখনো এই দেখায় চর্মচক্ষু ছাপিয়ে মনশ্চক্ষুর ভূমিকা বড়ো হয়ে ওঠে; যেমন, ‘আকাশ থেকে আকাশে ছুটে পালাচ্ছে দলে দলে মেঘ/ যেন হরিণের পালের ওপর হামলে পড়েছে বাঘ’ (বৃষ্টি হবে) বা ‘স্বর্গ পুরুষতান্ত্রিক পল্লি’ (স্বর্গে যাবো না)। এরকম উদাহরণ সত্ত্বেও, তাকালে দেখা যায় ফুলচাষি মালি যাই বলোতে চর্মচক্ষুর উজ্জ্বল কীর্তিই পরিমাণে বেশি। তবে আমরা এরকম বলতে চাইছি না যে, এই দেখা একবার এক ঝলক তাকিয়ে পাতার কাঁপন দেখার মতো একমাত্রিক কোনো দেখা। বরং এসব দেখা দীর্ঘদিন ধরে পর্যায়ক্রমে দেখতে দেখতে দেখনক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করে তোলা; যে দেখাকে তাৎপর্যময় করে তোলে পূর্বার্জিত তথ্য ও নিবিড় জ্ঞানযোগে একটি বিন্দুকে আরেকটি বিন্দুর সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভুজ অঙ্কনসাপেক্ষে মিলিয়ে দেবার দক্ষতা। ‘আদিবাসী হদি পরিবাটির সবকিছু আজ ইসলাম’ (সন্ধ্যাকুড়া) বা ‘পৃথিবীতে মানুষ আসলে বেশিদূর এগোয় নি/ মানুষ তো আজো সাম্প্রদায়িক রয়ে গেল’ (সাম্প্রদায়িক) বা ‘আমাদের নদীটি খালের মধ্যে ঢুকে গেছে’ (উন্নয়ন) ধরনের পর্যবেক্ষণসমূহকে জীবন-পরিবেশলগ্ন একেকটা মাইলস্টোন বলে মনে হতে পারে। বেসরকারি কবিতায়ও এমন দৃষ্টান্ত অবিরল। ‘যুবতীর আত্মহত্যার প্রশ্নে যৌনতা ল্যাপ্টে থাকে’ (আত্মহত্যা) বা শরণার্থী শিবির আর মহানগর ঢাকার/ গন্ধ কিন্তু একই’ (গন্ধবিষয়ক) ধরনের পর্যবেক্ষণকে অগভীর সাব্যস্ত করে তাচ্ছিল্য করবার সাহস আমাদের কমই হবে।

আমরা মাহবুব কবিরের কবিতার সারল্যের প্রশংসা করি। করে যাব। পড়ে যাব সারে সারে ওরে। বলে যাব সারল্যের জয় হোক। কিন্তু মাঝে মাঝে নিন্দা করবার শক্তিও যদি আমরা অর্জন করে না উঠি, তাহলে তাকে মনে হবে আত্মপ্রতারণা। আমাদের কাছে মনে হয়, ওর ফুলচাষি মালি যাই বলোর ‘কে প্রথম’ বা বেসরকারি কবিতার ‘নবজাতকের প্রতি’র মতো কবিতার জন্মনিয়ন্ত্রণ কাম্য। অন্যদিকে ওর কৈ ও মেঘের কবিতার ‘পৃথিবী’, ‘হিজল-জন্ম’, ‘কৈ ও মেঘের কবিতা’, ‘হত্যামুখর দিন’ (ঈদুল আজহার দিনের জাতীয় কবিতা) ও ‘আমার মাংস’; ফুলচাষি মালি যাই বলোর ‘মদন সরকার’, ফুলচাষি মালি যাই বলো, ‘সাম্প্রদায়িক’, ‘উন্নয়ন’ ও ‘সস্তা মানুষজন’; বেসরকারি কবিতার ‘হিরালাল’, ‘বেসরকারি কবিতা’, ‘নক্ষত্র’, ‘অভয় পৃথিবী নেই’ ও ‘আমাদের গ্রাম’-এর মতো কবিতার সঙ্গে সহবাস করে অধিকাংশ কবিতা পাঠক পরিপূর্ণ তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে।

অনিকেত শামীম সম্পাদিত 'লোক'-এর নভেম্বর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত

স্বদেশাপ্লুত ভালোবাসার শব্দছবি

খোন্দকার আশরাফ হোসেনের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’-এ আর যাই থাক ঘৃণা নেই, আছে সবিশেষ স্বদেশাপ্লুত ভালোবাসা; কাঁচা-পাকা, হিসেবি-বেহিসেবি, মাত্রাময়-মাত্রাছাড়া। মানবীরূপী একজন কোনো সুন্দরী এখানে উপস্থিত আছে কি না, যার প্রতি নিবেদিত এসব পঙক্তিমালা, তা নিয়েও সংশয় জাগতে পারে। অবশ্য স্বদেশই যদি কথিত সুন্দরী হয়, তবে তা ভালোভাবেই আছে। আর সে কারণেই হবে হয়ত যে, গ্রন্থভুক্ত অনেক কবিতাকে বেজায় কেজো মনে হয়। নিরর্থকতার যে সীমায় অনেক পাঠক কবিতাকে একান্ত নিরলে একা পেতে চান, সেরকমটি এখানে কালেভদ্রে ঘটে। তাতে অমন কবিতানুরাগীরা এ গ্রন্থপাঠে নাখোশ হবার ভাব করলে আমরা তাদের প্রবোধ দেবার অজুহাত খুব কমই খুঁজে পাই। অবশ্য তাদের উদ্দেশে এ কথাটি বলবার সুযোগটুকু আমরা যৌক্তিকভাবেই নিতে পারি যে, ‘কেজোকথা সর্বদা হেলাফেলা করিবার নয়’। বরং দেখা যায় এর নদীতীর ধরে যথেচ্ছ হেঁটে, এর বিষণ্ন প্রাঙ্গণে নিবিড়ভাবে বসে, যে, মাথার ওপর দিয়ে কত কী পাখি উড়ে যায়, মিথের। অতীতের চেনা-অচেনা নানা পৌরাণিক ও লোকচরিত্র, লোকবাচন, নির্বিঘ্নে পাশের গোপাট বেয়ে ধেয়ে যায়, বাংলার পথে। এ সময়ের নানাকিছুর তারা অংশী হয়। কবিতার এটা এক গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি বটে। এটা করে দেখাতে পারা ছেলেখেলা নয় কিংবা নিবিড়ভাবে কাছে থেকে একে দেখতে পারাও কোনোভাবে আকামের নয়।

এর বাইরে আমরা কথা বিশেষ খুঁজে পাই না এ বই নিয়ে বলবার। কিন্তু তবু কথা বলতে হবে। অন্তত হাজার শব্দ তো বটেই। কেউ কেউ কথা ভালোবাসে। কেউ কেউ কথার ওজন নয় পরিমাণ মাপে। কেউ কেউ অর্থ নয় আওয়াজেই কাঁপে।

আমরা অগত্যা গ্রন্থধৃত কতিপয় কবিতার জানালায় উঁকি দেবো বলে ভাবি। পারি তো দরজা ঠেলে ভেতরেও ঢুকে যাব, বসব কতক। গৃহবাসীর সাথে ভাববিনিময় করব। তাতে যদি কিছু কথা রোচে যায়, ওই দিয়ে হয়ত-বা মুখরক্ষা হবে। সবেধন একটাই মুখ, আমাদের, তা যদি হারাই এসে এইখানে খেলা খেলা কথা বলে, কেজোকথার গরমাগরম দিনে লজ্জার একশেষ হবে।

২.
গ্রন্থযাত্রার শুরু ‘বেহুলা বাংলাদেশ’-এ; মিথিক বাস্তবতায় স্বদেশপ্রেমের জোয়ার বইয়ে দিয়ে। সংগতভাবেই বেহুলা বাংলায় লখিন্দর আছে, আছে দুর্বাসা, দ্রৌপদী ও ইন্দ্র। দায়িত্ব পেয়েছেন এখানে অর্ফিয়ুসও। কিন্তু এসব তথ্যে আমাদের মন ভরে না, যতক্ষণ না আমরা ‘আলোর বর্ষণে গর্ভবতী’ হওয়া বা ‘পিপাসার অশ্ব’ ছোটানোর মতো মেটাফরের সামনে পড়ি। বুঝি যে তিনি কবিতাই করতে বসেছেন, দেশগাথা বর্ণনার ছলে। দু'কূল রক্ষার এই সচেষ্টতাই কবিকুলে তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এ কবিতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে স্বরে ও সরগমে আমাদের গায়ে এসে জীবনবাবুর ‘অন্ধকার’-এর আঁচ লাগে। ‘নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না’র অ্যালিউশন হাজির করে আমাদের তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, একটা জগদ্দল পাথরের সামূহিক ক্ষয়ক্ষতির লেজের অন্ধকার বর্ণনা করাই তার এখানকার প্রধান অভীষ্ট।

এই বিষাদময় অন্ধকারই বোধকরি তার চৈতন্যকে শাসন করতে থাকে। তা নইলে কেন সুকান্তের মতো এই পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবার ‘সুশোভন প্রতিশ্রুতি’ না-দিয়ে তিনি তার উলটোটাই করবেন? বৈশ্বানর, কৃষ্ণ, অর্জুন, স্পার্টাকাসকে হাজির-নাজির রেখেও কেন প্রিয় পুত্রকে সাহসী অভিমন্যু করে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দেবেন, যেখানে তার ট্র্যাজিক পরিণতির কথা আমরা জানি? কী এমন সংগত কারণ আছে এই বিষাদবয়ানের? এর জবাবও দেখা যায় তিনি নিজেই দিয়ে রেখেছেন ‘বর্ষা ১৩৯৫’ কবিতায়। বলছেন, ‘এখন উদ্ভটতার ব্যাকরণ হাতে দীর্ঘ আলখাল্লা-পরা অন্ধকার/ আলোর উঠানকে খুব শাসাচ্ছে’। কারণ ‘(ঘোড়সওয়ারেরা চলে গেলে প্রান্তরের ভাওয়া ব্যাঙ-ও/ হানড্রেড মিটার রেসে জিতে নেয় সোনার পদক)’। যেজন্য তাঁর মনে হয় ‘বাংলার বর্ষা বড় মরিচাপ্রবণ’। আশ্চর্য লাগছে তো! লাগবারই কথা। বাংলার কবিকুল মাতোয়ারা থাকেন যে বর্ষায়, তাতেও তিনি মরিচা দেখেন? এমন তাঁর মনে হয় কারণ তাঁর কাছে বর্ষাও দেশনিরপেক্ষ কোনো অস্তিত্ব নয়; কারণ ‘নিরন্নের ভাতের থালায় কানকোতে হেঁটে আসা/ সুরভিত কৈ মাছের রূপকথা’ আজ নির্বাসিত। বইয়ের ‘বৌমাছ’, ‘যাত্রা’, ‘ধানরমণী’সহ অনেকানেক কবিতায় বাঙালিয়ানার সুবাস মাখিয়ে রাখেন তিনি। এসব আয়োজনে আবারো দেখা হয়ে যায় বেহুলার সাথে, খুল্লনা ও লহনার সাথেও। ‘কালপূর্ণিয়া’য় বন্দনা করেন দেশমাতার। ওই ট্র্যাজেডির বয়ানে তাঁর আকাশের চাঁদ হয়ে যায় ‘মর্মমূলে গাঁথা/ সারাসিন চাকু’ ! বটেই তো। তা নইলে রক্তপাতের এমন ভয়াবহতা দেখত কী করে বাংলার মানুষ?

কবিতায় তাঁর এ ধরনের ট্রিটমেন্ট দেখে মনে পড়ে যায় তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশানুরক্তি তাঁর অন্যতম চেতনানির্মাতা। এ বই প্রকাশের সময়কার ২১ বছরের পরিণত বয়সি বাংলার গায়ের নানা ক্ষতস্থানের দিকে চোখ পড়ামাত্র তাঁর প্রাসঙ্গিক প্রতিক্রিয়া ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠাকে আমাদের কাছে কাজেই কোনো আরোপন মনে হয় না। তাঁর কবিচৈতন্যের গঠনপ্রক্রিয়ারও এ এক মৌল উপাদান। কবির সমুদয় সৃজনোল্লাস এই পথ বেয়েই তার গন্তব্যে পৌঁছেছে। ফলত এখানে দেখা হয়ে যায় বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, আইল-বাতর, রূপকথা-লোকাচারের সাথে।

ঈর্ষণীয় সবুজ বিষয়ে তাঁর কিছু বলবার থাকে, বাংলার; বলেনও। কেননা ‘চোখের দৃষ্টির জন্য সবুজের মতো ভালো/ চিকিৎসা নেই’। ‘আমার স্বদেশে সুখ্যাতি আছে সবুজের’ স্বরে আমরা শুনি পূর্বকবির ধ্বনি, তিনিও যেন বাংলার কিংবদন্তীর কথাই বলছেন নিজস্ব ভাষায়। মনে হয়, আবারও সেই দেশগাথা, আবারও কেজোপ্রেম। কিন্তু না, কেজোকে তিনি কেজো করেই রাখেন না, উতরাতে জানেন। সততই মেটাফর খুঁজে ফেরেন তিনি। অদ্ভুত সব চিত্রকল্পের প্রেমে পড়ে যান। একই ছবি এঁকে বসেন একাধিক কবিতায়। একইসঙ্গে ‘তারাদের হলকায়ে জেকের’ দেখেন-শুনেন ‘তাসের খেলা’ ও ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’তে। আবার ওই ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’তে যেমন দেখেন ‘শূন্য/ রাজপথে ফিগার স্কেটিং করে বাদামের খোসা’, তেমনি ‘কবিতা কোলাজ’-এর ‘অদ্ভুত’জুড়ে দেখতে পান ‘প্রান্তরের এপার থেকে ওপারে/ ফিগার-স্কেটিং করছে মেঘ’। কোথায় বাদামের খোসা, আর কোথায় মেঘ। দুইয়েরই এক আচরণ। বারণ নেই। দেখবার চোখটাই এখানে আসল, দেখানোরও। এই ছবি চিরন্তন। আর চিরছবির এই বলনকেতা তাঁর এমনই নিজস্ব যে, বারবার বলে তার নিশান উড়িয়ে রাখা প্রয়োজন মনে করেন। হয়ত না। আসলে বোধহয় মালিকানাবোধ থেকে নয়, বরং ওসব মনোমুগ্ধকর ছবির কাছে যে ধরা খেয়ে থাকে তাঁর আমূল কবিচিত্ত, তারই এ স্বতঃপ্রকাশ।

৩. 
পেশাগতভাবে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঘর করেছেন তিনি। কিন্তু এ সম্পর্ক পেশার গণ্ডিতেই আবদ্ধ রাখেন নি, মাখিয়ে নিয়েছেন আমূল অস্তিত্বের সঙ্গে। এর মাধ্যমে বিশ্বকবিতার যে আঁতের খবর তিনি জেনে ফেলেছিলেন ও জানছিলেন, তা নিয়মিত জানিয়ে গেছেন বাংলা কবিতার পাঠকদেরও। এই পরিসরে তাঁর হাতে যে সোনালি শস্যগুলো রূপ বদলে নিয়েছে বাংলাভাষায়, তা ঋদ্ধ করেছে বাংলা কাব্য ও প্রবন্ধ সাহিত্যকে। এ সংবাদ এখানে প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, প্রত্যক্ষ ওই আয়োজনের গভীরে সহজাতভাবে আরেকটি আয়োজনও সেরে নিয়েছিলেন তিনি, তা হলো, নিজের কবিতাবোধকে দিতে পেরেছিলেন একটি সমীহজাগানিয়া উচ্চতা। ওই উজ্জ্বলতা অনুপস্থিত নয় ‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’-এও। কবিতা তো বটেই, এ বইয়ের কিছু কবিতার নামকরণও অনেক বিখ্যাত বিশ্বকবিতার কথা মনে রেখে করা; যেমন, টি. এস. এলিয়টের ‘দি লাভ সঙ অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রুক’-এর স্মরণে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’, কোলরিজের ‘দি রাইম অব দা অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’ স্মরণে তাঁর ‘বুড়ো নাবিকের প্রেমগীতি’। কবিতায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনের যে বিবেচনা হাজির করেছিলেন টি. এস. এলিয়ট তাঁর ‘ঐতিহ্য ও ব্যক্তিপ্রতিভা’ নামক সুবিখ্যাত প্রবন্ধে, খোন্দকার আশরাফ হোসেন সেই মেলবন্ধন রচনা করেছেন। নিজের কবিতাদেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার অনুরণনও ছড়িয়ে পড়েছে যথাসাধ্য, যে খবর ইতোমধ্যে এ লেখায়ও মূর্ত হয়েছে।

৪.
আলোচ্য বই থেকে কবিতার পর কবিতা হাজির না-করে কম কথায় আলাপ সারবার পরিকল্পনার এ পর্যায়ে এসে মনে হয়, বলবার কথার পুঁজি আমাদের, এবার বুঝি সত্যিই ফুরালো। কৌতূহলী পাঠকের আকাঙ্ক্ষা এ দিয়েই নিবৃত্ত হবে কি না, এরকম ভাবনা যদিও জাগে মনে। তখন মনে হয়, গৌণ হোক তবু আরো কিছু তথ্য হয়ত এখানে উঠিয়ে রাখা যায় বইটি সম্পর্কে; যেমন, দেশবিষাদমণ্ডিত কবিতাভাণ্ডারে সমৃদ্ধ এ কবিতে প্রেমিকসুলভ আত্মবিশ্বাস এবং অহঙ্কারও দ্রষ্টব্য বটে। আর সেটা ‘(লাউডুগি যেমন মিশে থাকে জলঘাসের হৃদয়ে)’, ঠিক তেমন করে। যেহেতু ‘ভালোবাসিয়াছি ভালোবাসিয়াছি ভালোবাসে নাই ভালো’ বা ‘এ শরীর আজ বহু বসন্তের প্রেমের আগুনে পোড়া’, তাই জ্বরাক্রান্তের প্রেমের উত্তাপ নিয়ে শীতলতায় যাবার বাসনা থাকা এ পরিসরে নিতান্ত সংগত। কিন্তু তবু কারো উদ্ভট করুণা না-নেবার দৃঢ়তা তিনি মুহূর্তের জন্যও হারান না। ফলে আমরা একইসঙ্গে দেখি এ বইয়ে কবির ‘হৃদপিণ্ডের শব্দ থেকে গড়িয়ে পড়ছে ভালোবাসার জবাফুল’। কিংবা বলা যায়, এ বইয়ে প্রধানত খোলা অক্ষরবৃত্তেই সেরেছেন তিনি তাঁর কথালাপ। মাঝে মাঝে স্বরবৃত্তের ঘোড়ায় চড়েও পরিকল্পিত ভ্রমণে বের হয়ে গেছেন তিনি ‘ঘৃণার ঘুঙুর’, অংশত ‘চিকিৎসা’ ও ‘কবিতা কোলাজ’-এর ‘পদাবলী’পথে। স্বরবৃত্তে জগতোদ্ধার যাত্রায় তাঁর পথে পথে পালকি দোলা, বনে বনে ময়ালভীতি। এসবে আমরা নেচে উঠি, ফের থামি আত্মতুষ্ট হয়ে। পাশাপাশি এ বইয়ে মাত্রাবৃত্তের সফল প্রয়োগও তাঁর হাতে হয়েছে ‘বুড়ো নাবিকের প্রেমগীতি’র ছলে। বলা যায় এ কথাও যে, মুগ্ধ হতে হয় তাঁর প্রয়োগকৃত সৌন্দর্যময় কিছু শব্দবন্ধের দিকে চেয়ে; যেমন, ‘জলকরঙ্কবাহি’, ‘কণ্টকঝোপাবৃত’; কিংবা এই ভয়ঙ্কর ছবিতে যে, ‘সুর্মা-পরানো আয়ত চোখের কুহকিনী এক নারী/ শিশ্নমুণ্ডে পরিয়ে দিয়েছে অষ্টধাতুর বালা’। এখানে এটা উল্লেখের ইচ্ছে পোষণও হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ‘ধূমশলাকার শ্যামপীরিতি ছাড়তে হবে’র মতো পঙক্তি লিখে তিনি এ পীরিতাঘাতে কাতর সহস্রজনের গোপন আকাঙ্ক্ষাটিও মূর্ত করে রেখেছেন। যদিও তাঁকে কখনোই ধূমশলাকায় বুঁদ হয়ে থাকতে দেখি নি দু’চোখে।

‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’-এ ব্যাপকভাবে পাঠকপ্রিয় হবার মতো মোহটান নেই, প্রকাশিত হবার পরের ২১ বছরজুড়ে তা স্বতঃপ্রমাণিত। তবে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবির নাতিদীর্ঘ যাত্রাপথের এ মধ্যঘাট তাঁর সমুদয় কাব্যবৈশিষ্ট্যের লক্ষণ ধারণ করে বিশিষ্ট হয়ে আছে; যার দিকে ফিরে ফিরে তাকানোয় আমাদের কোনো দায়মুক্তি নেই।

মুহম্মদ মুহসিন সম্পাদিত 'ধানসিড়ি'র অক্টোবর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...