Sunday, July 4, 2021

মাসুদার রহমানের কবিতার পথ ও পাথেয়

কবিতার জঙ্গলে মাংস বিক্রি করতে এসেছেন যে মাসুদার, তাকে চিনে রাখা ভালো। জরুরিও। টেড হিউজকে কাঁদিয়ে সিলভিয়া প্লাথকে নিয়ে একঘরে থাকেন এই আইডিয়া মাস্টার।

এরকম বলা যায়, কবিতায় মাসুদার রহমানের বিকাশ ঘটেছে ঢাকার দিকে পিঠ দিয়ে। সাধারণ্যে একটা ধারণা কাজ করে যে ঢাকামুখী না হলে কবিতার কল্কে পাওয়া যায় না। নানাজন নানা সময়ে এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছেন, করেছেন মাসুদারও; যদিও তারুণ্যে টগবগ সময়ে মধ্য নব্বইয়ে সূচিত বাংলা একাডেমির অর্ধবর্ষ-মেয়াদি তরুণ লেখক প্রকল্পের, সম্ভবত তৃতীয় ব্যাচে, যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। একাডেমি থেকে ‘তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৭’ বাগিয়ে নিয়ে মাসুদার জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার সোনাপাড়া গ্রামে ফিরে গিয়ে সেখানেই থিতু হয়ে ক্রমশ পত্রপল্লব বিস্তার করে ঢাকামুখীনতাকে সগৌরবে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গেছেন। 

শহরে ছিলাম; কয়েকটি বছর মাত্র
তারপর গাঁয়ে ফিরে গেছি
পার্কের বেঞ্চে বসা একাকী চড়ুই

(পার্কের বেঞ্চে চড়ুই)

আমরা দেখেছি, ভৌগোলিক দূরত্বে ঢাকার থেকেও কাছাকাছি অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে তাকে নিয়মিত পত্রস্থ হতে। সেখান থেকে ওই বাংলার প্রায় সমস্ত প্রসিদ্ধ ও উচ্চমার্গীয় লিটলম্যাগীয় ঠেকে সময়ক্রমে মাসুদার সমাদৃত ও প্রিয় হয়ে ওঠেন। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রকাশের পৌনঃপুনিকতায়, পাঠকপ্রিয়তার মাত্রায়, বন্ধু ও অনুরাগীর সংখ্যায় এবং পরিচিতির ব্যাপকতায় তাকে পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণকারী কোনো লেখক বলেই ভ্রম হয়। এই ধারণাকে আরো মজবুত ভিত্তি দেয় পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাওয়া তার বিভিন্ন সাহিত্য সম্মাননাও : অচেনা যাত্রী সম্মাননা (বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা) ২০১৪; শাম্ভবী সম্মান (কলকাতা) ২০১৬ এবং ইতিকথা মৈত্রী সাহিত্য সম্মাননা (কলকাতা) ২০১৭। 

“মাথার উপরে মেঘ, মেঘ খুব অনুকরণ প্রিয়। মেঘেরা কাশের রং নিয়ে ভেসে যাচ্ছে সোনাপাড়া থেকে সোজা কলকাতার দিকে।” (কাশজন্ম) 

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যুম বাস্তবে রূপ লাভ করবার পরে, এখন, গ্রাম-শহর, দেশ-বিদেশ সবই একাকার। কিন্তু একটা সময় তার এই গতিমুখ তাকে বাংলাদেশের উপরভাসা পাঠকদের চোখে প্রায় আড়াল করে রেখেছিল। এভাবে গুম হয়ে থাকার অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল তার বিলম্বিত প্রকাশনা। নব্বইয়ের দশকের কবি হয়েও তার প্রথম বই ‘হাটের কবিতা’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে, যেজন্য তিনি গত দুই দশকে হওয়া এখানকার ভূরি ভূরি সংগ্রহ-সংকলনের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে গেছেন। যদিও এসব উপস্থিতি, কে না জানে, স্থায়ী কোনো অর্থই বহন করে না। 

সে যাকগে, মাসুদার তার গ্রাম-পরিপার্শ্বের সাথে এই মর্মে একটা নিবিড় সমঝোতা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন যে, নিজের কবিতার মালমশলার অধিক্ষেত্র হিসেবে সেটিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করবেন, কিন্তু কেউ কিচ্ছুটি বলবে না! কী লিখতে চান, কী চান না সে ব্যাপারে মাসুদার নিজের মতো করে পরিষ্কার থেকে দখলভুক্ত ওই পরিমণ্ডলকে নিজস্ব গ্রিনরুম বা স্টুডিও হিসেবে কাজে লাগাবার অবাধ অধিকার যারপরনাই অর্জন করে নিয়েছেন। 

মাসুদারের কবিতায় ধেই ধেই করে অবলীলায় যেভাবে গ্রামীণ অনুষঙ্গ এসে ঢুকে পড়ে, বেজায় সন্দেহ জাগে, সোনাপাড়ার পৃথিবীতে এমন কোনো ঠাঁই আছে কি না যা কবিতাবর্জিত। তিনি এমনই এক শৈলী রপ্ত করে নিয়েছেন যে, তার যাপনজুড়ে শুধুই কবিতার উজানিয়া খেলা চলে, বর্ষায় মৎস্যকুলে যেমনটি হয়। কিংবা এভাবেও বলা যায়, কবিতা যেন তার চলার পথে পায়ের কাছে নাছোড় বিড়ালের মতো ঘোরে, যে বিড়াল প্রতি দমে কবিতার গন্ধ ইনহেল করে। 

পল্লিপ্রকৃতির মধ্যস্থতায় মাসুদারের হাতে অবলীলায় কল্পনার সেতুসম্ভব সৌন্দর্য নির্মিত হয়ে চলেছে। আমরা পাঠকরা দেখি, তার কবিতার কোথাও কোনো ভার নেই, চাপ নেই, কেবল সৌন্দর্য আছে। আবার এ সৌন্দর্য তৈরির জন্য কোথাও তার কোনো ধ্বস্তাধস্তিও নেই। কেবল কথা বলে যাওয়া, নির্বাচিত, অন্তর্গত নৈকট্য লক্ষ করে। ফলস্বরূপ সৌন্দর্য আলগোছে এসে বসে পড়ছে পাটি পেতে। 

না পাঠক, গ্রামাবহের কথা শুনে জসীম উদ্দীন বা বন্দে আলী মিয়াকে স্মরণে আনবেন না। মাসুদারের পথ ওইদিকে নয়, বরং তার উলটোমঞ্জিলে।  

১৪ আষাঢ়, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া মেঘ বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি জুড়ে বৃষ্টি ও বজ্রপাত। বাড়ি ভর্তি তুমুল বর্ষাকাল। কাঠের আসবাবগুলো গাছের জীবন পেয়ে ডালপালা মেলছে আবারও 

অঝোর রাত্রি। বউ পালঙ্কে ছাতা মেলে ঘুমোচ্ছে

বুক সেলফ জুড়ে ডাকছে ব্যাঙ

(আাষাঢ়স্য কবিতা)

ছোট নদী। কাগজে ব্রিজ 
এঁকে
ঝুলিয়ে দিয়েছি

নদী পার হয়ে এসো

(পারাপার)

সাত খণ্ডে (রামায়ণ নয়) মাসুদারের একটা কবিতা আছে ‘ডাকবাংলো’ নামে, আলাদা একটা পুস্তিকাও রয়েছে কবিতাটি নিয়ে। মাসুদার কর্তৃক নির্মিত এই কবিতার ভিতর ও বহিরাবয়ব যখন অবলোকন করা যায়, তখন বুনো ঝরনার ছলাচ্ছল বা পক্ষিকূজনেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না, কেবল নৈঃশব্দ্য ছাড়া। বন যেহেতু, তার মধ্যে পাখিদের থাকবারই কথা, তাই আছে কিন্তু তাদের কলরব কানে পশে না। এমনকি মনে হয় কুকুরও ঘেউ ঘেউ না করে রহস্যসন্ধান করছে দূরে তাকিয়ে। বনের গভীর গোপন ক্ষত হয়ে থাকা ডাকবাংলোতে আজ উৎসব, কেয়ারটেকারের চঞ্চলতা কেন শব্দহীন, গাড়ির ধুলোও সেটা জানে। 

“কাঁপছে বাতাসে উঁচু ঘাসবন
সাপের জিভের জেরক্স” (ডাকবাংলো ৭)

গিরগিটি আছে, আছে ঝরনা, কাঠঠোকরা, বিড়াল, মোম ও দেশলাই। আছে মুরগি ও আপেলকাটা ছুরি। একটি মেয়ের খুনের আয়োজন নিয়ে এত কিছু, তার মধ্যে কাক এলেই টেড হিউজ আসে, টেড হিউজ এলেই সিলভিয়া প্লাথ। কালো বিড়াল এলেই অ্যালানপো, রহস্য এলেই শার্লক হোমস। কোনো মহৎ কথা বলবার মতি নেই এখানে, নিষ্ঠার সাথে ছবি এঁকে পরিবেশ রচনা করা মাত্র, যাতে অংশ নিচ্ছে পুরো বন। অ্যালিউশন অলঙ্কারের চমৎকার ব্যবহার আছে কবিতাটিতে। অবশ্য শুধু এই কবিতায় নয়, মাসুদারের কবিতায় অন্যত্রও এ লক্ষণ আছে ভূরি ভূরি।

তাঁর ‘পিঁপড়ে’ কবিতাকে পাওয়া যায় লোকজ্ঞানের সার হিসেবে, ‘গরু হারানো কবিতা’কে লোকপ্রবাদের ফিকশনরূপে। ‘জিওগ্রাফি’তে আছে মনোযৌনতা, ‘কমলালেবু’তে অর্থনীতিজ্ঞান। আবার ‘বেগুনগাছের সাক্ষাৎকার’-এ সাক্ষাৎ পাওয়া যায় সহজিয়া বলবার ভঙ্গির। কবিতাটি কিছু বলছে আবার যেন বলছেও না, দেখিয়ে দিচ্ছে ঘটনাবলি, তার হিতাহিত। ‘সাইকেল’ কবিতাটি এত মোলায়েম যে এর নাম দুপুরও হতে পারত। ‘চলনবিল’-এ যা বোঝাতে চাওয়া হলো তার কিছুই বলা হলো না, কিন্তু ঠিকই বোঝানো গেল। অন্যদিকে ‘কারখানা’য় ছাপ ফেলেছে লে-অফের বিষাদ, হিংস্রতা। একইভাবে ‘মহাজনবাড়ি’তেও একত্রিত হয়েছে নিষ্ঠুরতার চিত্রযূথ, সন্ত্রাসের বরফ। কিন্তু এসব ছোপছাপ সত্ত্বেও মাসুদার কবিতাযোগে সমাজ বদলাবার দায়িত্ব কাঁধে নেন নি। বাস্তবতার দলিল রচনা করে তার অসংগতি দূরীকরণের কোনো প্রেসক্রিপশন তার নেই। বরং তার কবিতায় ইঙ্গিত আছে গভীরে বিহারের, এমনকি যিনি সমাজ বদলাতে চান তার জন্যও।  

টেড হিউজ ছেড়ে যাবার পর সিলভিয়া কাঁদছিল

সাতটি কুকুরে টানা স্লেজগাড়ি খুব সতর্কতার সাথে
সামলিয়ে নিতে হয়
তা না হলে কুকুরেরা নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি করে

পৃথিবীতে এ পর্যন্ত বেশিভাগ রক্তপাত ধর্মবিষয়ে হয়েছে; তুমি বিশ্বাস করো না?
চারপাশে অন্তহীন বরফের বিস্তার; এর নিচে রয়ে গেছে কয়লার বিশাল মজুদ

খনিশ্রমিকের তাঁবু; কাঁদছে শিশুটি

কান্না মূলত অনেক গভীর থেকে উঠে আসা খনিজবিষয়

(খনিজ)

মাসুদারের কবিতায় ক্যামেরার ব্যবহার থাকলেও তাতে অটোম্যুড অফ করা আছে। ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ নিজের হাতে নিয়ে তিনি ছোট ক্যানভাসে বড় ছবি ফুটিয়ে তোলেন। যে কারণে ক্যামেরার আলো-ছায়াকে ছাড়িয়ে সেখানে তুলির ব্যবহারই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে বেশি। রক্ত দেখেও যে কারণে আতঙ্ক না জেগে ‘ওয়াও!’ ধ্বনি জেগে ওঠে। 

কারখানার বন্ধ গেট; তালা নয় ঝুলে আছে
শ্রমিকের কর্তিত মাথা
এ পথে আসেনি কেউ
লোহার শরীর মরিচা হয়ে ঝরে গেছে
এখন বেড়ে ওঠে আগাছার কাল

কলেজ পালানো মালিকের ছেলে
তার গার্লফ্রেন্ডটিকে এখানে এনেছে

ওরা শুয়ে আছে ঘাসে

তার নিচেই থই থই রক্ত ও লাশ

(কারখানা)

মাসুদারের কবিতায় একের পর এক চরিত্র এসে হাজির হয়। স্ত্রী, বান কি মুন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রিয়াংকা চোপড়া, বাড়ির কাজের  ছেলে, গাছ, পাখি, দাদিমা, প্রমুখ। তবে সংগত কারণেই সেখানে টান টান গল্প থাকে না। গল্প ছিঁড়ে গিয়ে কবিতার দিকে হাঁটা দেয়। চরিত্রগুলো তাদের জানা বৈশিষ্ট্য নিয়েই থাকে, বেড়ে উঠতে পারে না। এটিসহ কিছু বিষয়ের একটা পৌনঃপুনিকতা লক্ষ করা যায় মাসুদারের কবিতায়। এই লক্ষণ মনে এমন একটা ধারণা জাগিয়ে দেয় যে, কবিতাটা আগেই একবার পড়েছি। আর আগেরটার স্মৃতি অধিকতর স্পষ্ট থাকলে তখন একঘেয়েমি বোধ হয়। অনেক লিখতে গিয়ে তাকে বিষয়বৈচিত্র্য সৃজনে চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখা দরকার মনে হয়।

যাকগে, কথা শেষ করি। তবে এক্ষণে একটি বিষয়ে না বললে অতৃপ্ত বোধ হচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর ও বিলকুল নতুন সব বাক্য ও বাক্যাংশের সামনে পড়তে হয় মাসুদারের কবিতার পথে হেঁটে গেলে, যার কোনো কোনোটি চমৎকার মেটাফরও : 

“আমার চা খেয়ে নিচ্ছে পাউরুটি” (টি টাইম);

“চাঁদ একটি প্যারাসিটামল” (আমার বাঙলা কবিতা);

“মনে হতো ঢেকিশালে চাঁদ ভানছে কেউ (চাঁদগ্রস্ত);

“পাপোষে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে বর্ষা সংক্রান্ত যোগাসন করছে পুষি” (ক্যাপ্টেন)। 

মাসুদারের চলার পথের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি মুগ্ধ নয়নে, উপর্যুপরি বিস্মিত হবার জন্য। এতদিনে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে, তার কবিতার কোথাও না কোথাও তিনি একটা না একটা কোনো খুঁটি পুঁতবেনই পুঁতবেন, বিস্ময়ঘোর না কাটা পর্যন্ত যেইদিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকা যায়। 

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...