Saturday, July 4, 2020

লোক-এর কর্মকাণ্ড ও আমার লোককাণ্ড

এমন নয় যে, শামীমুল হক শামীমের সাহিত্যকর্মের আমি খুব ভক্ত, কিন্তু লোক সম্পাদক অনিকেত শামীমের সাংগঠনিক প্রতিভায় আমার মুগ্ধতার কোনো শেষ নেই। একজন মানুষ সমাজ-সংসার লগ্ন থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে নিজের পড়ালেখার কাজটিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে হলেও অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট লোকজনের পেছনে লেগে থেকে কী করে দিনের পর দিন সম্পাদনার কাজটি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে পারেন, তার কোনো কূল-কিনারা আমি খুঁজে পাই না। শুধু যদি সম্পাদনাসীমার আওতায়ই তাঁর কাজ শেষ হতো তাও একভাবে হিসেবটা মেলানো যেত, কিন্তু তিনি বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনাতিরিক্ত এমন বিশাল সব কর্মযজ্ঞ ফেঁদে বসেছেন যে শুরুতে অনেকটা অসম্ভব মনে হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে যে ঠিকঠাক সাফল্যের সঙ্গেই তা সম্পাদিত হয়ে গেছে। এসব করতে সংগতির পাশাপাশি অপরিমেয় সাহস লাগে, অনিঃশেষ ধৈর্য লাগে, লাগে জনসংযোগ ও জনসমর্থন; যার সবই তাঁর প্রভূত পরিমাণে আছে।

প্রবাদ আছে, বোবা ও নিষ্কর্মার কোনো শত্রু থাকে না। এর মানে হলো, কথক ও কর্মীর থাকে, থাকতে পারে। কথা যত তীর্যক ও আক্রমণাত্মক হয়, কাজ যত দৃশ্যমান ও প্রভাবসঞ্চারী হয়, শত্রুতার মাত্রা হয় তত তীব্র। আমার পর্যবেক্ষণে দেখেছি, কথায়-লেখায় তিনি যথেষ্ট নমনীয়, প্রায় সময়ই অনাক্রমণাত্মক, একজন সফল সংগঠকের কাছে যেটা প্রত্যাশিত। কিন্তু তবু তাঁর কিছু শত্রুপ্রতিম নিন্দুক রয়েছে, মনে হয় এঁরা সশস্ত্র হয়েছে মূলত তাঁর প্রভাবসঞ্চারী দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডের কারণেই। কোনো সংগঠকই সবার মন জয় করতে পারেন না, পারা উচিতও নয়। সংগত কারণে তিনিও পারেন নি। ওই তালাবন্ধ মনওয়ালারাই তাঁর চিহ্নিত নিন্দুক। এঁদের সমস্ত মনপাহাড় ডিঙিয়েই একের পর এক লোক-এর বিপুলোদ্যোগসমূহ গৃহীত ও সম্পন্ন হয়ে চলেছে। হয়ত চলতে থাকবে আরো অনেক দিন, যেহেতু অনিকেত শামীমের মধ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যমের ঘাটতি এখনো তেমনভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে না। যদিও লোক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯-এর পরে আর দেওয়া হবে না বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধমে একটা ঘোষণা আমার চোখে পড়েছে। এটি চালু রাখা বা বন্ধ হওয়া বিষয়ে আমার দিক থেকে কোনো ওকালতি নেই।

আমার জানামতে, অজস্র উদ্যোগের মধ্যে ২০০৯-এ লোক-এর ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রবর্তিত লোক সাহিত্য পুরস্কারই বেশি বিতর্কউসকানিয়া ব্যাপার ছিল। পুরস্কারকে লেখালেখির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয় না আমার। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও দৈশিক প্রেক্ষাপটে পুরস্কারসংস্কৃতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আছে, লোক সাহিত্য পুরস্কার যেগুলোর একটি; যেটি প্রদান করে 'লোক' নামক একটি লিটল ম্যাগাজিন। পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা নির্ভর করে সেটি কারা দিচ্ছে, কাদের দিচ্ছে, কীভাবে দিচ্ছে তার ওপরে। অনেক সময় অবশ্য পুরস্কারের অর্থমূল্যকেও গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। লোক পুরস্কারের বর্তমান অর্থমূল্য তেমন বৃহদাংকের নয়, মাত্র ৫০ হাজার টাকা; কিন্তু এর সবচাইতে মূল্যবান প্রদেয় হচ্ছে ঘোষণার পরের বছর পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর বিশ্লেষণী লেখাপত্র নিয়ে ঢাউস একটি বিশেষ সংখ্যা অবমুক্তকরণ। পৃথিবীতে এরকম আর কোনো পুরস্কার আছে কি না আমার জানা নেই। সুতরাং প্রকাশ্যে এই পুরস্কারটির নিন্দা করা হলেও অনেক লেখকের মধ্যেই এটি পাবার একটা আকাঙ্ক্ষা সুপ্ত থেকে যাওয়া বিস্ময়কর নয়। যাঁরা অনেক চেষ্টা-তদবির করেও সুবিধা করতে পারেন নি, তাঁরা একসময় এর নিষ্ঠাবান নিন্দুকে পরিণত হয়েছেন। মানবচরিত্র এমনই, মহাজনরা বলে গেছেন! তবে পুরস্কারের অর্থমূল্য ও অন্যান্য যা কিছু প্রদেয় তার সবটাই গ্রহণ করে পরে লোক-এর শত্রু বনে গেছেন এবং দিনের পর দিন লোক ও এর কর্মকাণ্ডের প্রতি সার্বিক অসহযোগিতা জারি রেখেছেন যাঁরা, তাঁদের এরকম আচরণের যৌক্তিক ভিত্তি কী তা আমি অবশ্য স্পষ্ট করে জানি না। এ অংশের থেকে পাওয়া বেদনাভারও হয়ত অনিকেত শামীমকে লোক পুরস্কার বন্ধ করে দেবার ঘোষণা প্রচারে প্রণোদিত করে থাকতে পারে।
   
এটা ঠিক যে, পুরস্কার নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা কাণ্ডকাহিনি চলে। নিজে সংগঠন তৈরি করে, নিজেই পুরস্কার ও অনুষ্ঠানের অর্থ জোগান দিয়ে নিজেই সেই পুরস্কার গ্রহণ করে মিডিয়াবাজির মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করবার কাহিনিও এদেশে রয়েছে এন্তার। এগুলো হলো ভুঁইফোড়দের পুরস্কারকাহিনি। আবার রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত কোনো কোনো সাহিত্য পুরস্কারের ক্ষেত্রেও অনেক তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটতে দেখা যায়। বিস্ময়করভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখককে গণনায় না এনে রাজনৈতিক বিবেচনায় গৌণ লেখককে পুরস্কার প্রদানই অনেকটা তাদের সংস্কৃতি। এসব কারণে আজকাল পুরস্কার ব্যাপারটাকেই অনেকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। এভাবে যাঁরা দেখেন তাঁদের দোষও দেওয়া যায় না। কিন্তু আমার জানামতে, লোক পুরস্কার এসব আপত্তিকর প্রবণতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। এমনকি, এজন্য লেখক বা প্রকাশককে লোক দপ্তরে দুই বা পাঁচ কপি বইও জমা দিতে হয় না, কিংবা কোনো বন্ডে স্বাক্ষরও করতে হয় না।

এ যাবৎ যতজন কবি, কথাসাহিত্যিক ও চিন্তককে লোক সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল, যাঁরা এর চাইতে বড় পুরস্কারও ডিজার্ভ করেন। ওই তালিকায় একমাত্র আমিই ব্যতিক্রম, মানে লেখক হিসেবে কমজোর। জানি, আমার এই স্বতঃপ্রকাশ কাউকে কাউকে খুশি করবে! করুক বরং। এই যে এতগুলো মানুষকে এই অবেলায় খুশি করতে পারা গেল, আমার লোককাণ্ডে এটাই সবচাইতে বড় লাভের দিক ভাবি।

লোক-এর সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা এর আঁতুড়ঘর থেকেই। অধুনাবিলুপ্ত গণসাহায্য সংস্থার চাকুরি হারিয়ে তখন আমি প্রায় বছরদুয়েক ধরে ট্যাবলয়েট দৈনিকের সাপ্তাহিক পাতা এডিটিং, বিজ্ঞাপনী সংস্থার কপিরাইটিং, বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার প্রুফরিডারি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বুক ইনভেন্টরির জন্য ইনফরমেশন কালেকশনের মতো খণ্ডকালীন কাজ করে ঢাকা শহরে টিকে-বেঁচে ছিলাম, কিন্তু কোথাও থিতু হতে পারছিলাম না। কাজের ফাঁকে রাতেদিনে অনেকটা করে সময়ই তখন কাটত আজিজ সুপার মার্কেটে, যেটি ছিল আমার দিক থেকে অনেকটা নিউক্লিয়াসের মতো। তখনই একদিন শামীম ভাই (তখনো তিনি অনিকেত শামীম হয়ে ওঠেন নি) প্রস্তাব দেন লোক নামে প্রকল্পিত একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশে সহযোগিতা করবার। শুনেছি আগে তিনি ওই কাজের দায়িত্ব আরো দুজন তরুণ কবিকে দিয়েছিলেন, কিন্তু কেউই কাজটি শেষ করতে পারেন নি। পুরো কাজের আওতাটি বুঝে আমি এর সঙ্গে যুক্ত হতে সাগ্রহে সম্মত হই, কারণ এ ধরনের কাজ আমার কাছে অনেকটাই ডালভাত ছিল। একজন গবেষক কাম প্রাবন্ধিকের সাহিত্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ততদিনে প্রি-প্রেস এবং প্রেসসংক্রান্ত কাজে আমাকে বিস্তর দক্ষতা এনে দিয়েছিল।

আজিজ মার্কেটের দোতলায় তখন টুকটাক প্রি-প্রেস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শামীম ভাইয়ের নিজস্ব অফিস ছিল, এমনকি ছিলেন একজন কম্পোজিটরও। আমি অন্যান্য খণ্ডকালীন কাজ শেষে প্রতিদিন আজিজ মার্কেটে ফিরে আড্ডার সময় খানিকটা কমিয়ে ওই অফিসে বসতে শুরু করি। ক্লান্ত লাগলে বাইরে গিয়ে আড্ডায় শামিল হই, আবার কাজে ফিরি। ততদিন পর্যন্ত লোক-এর জন্য যেসব লেখাপত্র শামীম ভাইয়ের কাছে সংগৃহীত ছিল, সেগুলোর একাংশ কম্পোজ করা থাকলেও বৃহদাংশই ছিল হাতে লেখা কপি। ওসব লেখা কম্পোজ করিয়ে প্রুফ সংশোধন করা, সূচি ও পৃষ্ঠাবিন্যাসের একটি ইউনিক ফরমেট তৈরি করে সে অনুযায়ী রচনাসমূহ বিন্যস্ত করা, বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা লেখা, বিশেষত তরুণ কবিদের কবিতাগ্রন্থের বিজ্ঞাপন তৈরি করা, লোক প্রকাশিত মাহবুব কবির সম্পাদিত নব্বইয়ের কবিতার দীর্ঘ সমালোচনা লেখার কাজ আমি ওখানে বসেই করেছি। এ ছাড়া, অফিস শেষে শামীম ভাই এলে লোক-এর সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এ সংখ্যায় আর কী কী থাকতে পারে, কার কাছ থেকে কী লেখা নেওয়া যায় ইত্যাদি সিদ্ধান্ত গ্রহণেও আমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এমনকি লোক-এর প্রধান ক্যাপশন ‘বাংলা ভাষাভাষীদের পত্রিকা’ নির্ধারণে আমার ভূমিকাও আশা করি শামীম ভাই ভুলে যান নি।

লোক-এর প্রথম সংখ্যার প্রিন্টার্স লাইনে আমার নাম নির্বাহী সম্পাদক হিসেবেই থাকতে পারত, কিন্তু শামীম ভাইয়ের এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে আমার ব্যাপক অনাগ্রহ ছিল। অনাগ্রহের নেপথ্য কারণ ছিল প্রধানত দুটি : এক. অদৃশ্য কর্মকার হিসেবে দূর থেকে নিজের ক্রিয়াকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া দেখতে আমার ভালো লাগে, যেরকম কাজের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আরো কিছু আছে; এবং দুই. এ কাজের জন্য শামীম ভাই তৎকালীন ঊনবেকার মুজিবকে যৎকিঞ্চিৎ পারিশ্রমিকও দিয়েছিলেন, যদিও তা আমার এখনকার মাসিক সিগারেট খরচের অর্ধেকেরও কম হবে। কিন্তু আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সে পরিমাণ অর্থও আমার কাছে তেমন অপ্রতুল ছিল না।

বলতে কী, লোক-এর প্রথম সংখ্যা ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। আগস্ট ১৯৯৯-এ প্রথম সংখ্যা প্রকাশের দুই মাসের মাথায়ই এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়, যে সংস্করণে কবি মোহাম্মদ রফিক-এর একটি গদ্য সন্নিবেশিত হয়েছিল। অবশ্য তার পূর্বেই সেপ্টেম্বর ১৯৯৯-এ আমি আমার বর্তমান কর্মস্থলে যোগদান করি, ২০১৯-এ যেখানে আমারও ২০ বছর পূর্তি ঘটল। যাহোক, দিবাভাগে খরচযোগ্য সময় তখন আমার ছিল না বটে, তবু লোক-এর ওই সাফল্যের উষ্ণতা আমি খুব কাছে থেকেই অনুভব করতে পেরেছিলাম।

প্রথম সংখ্যার সাফল্যে শামীম ভাইয়ের লোকোদ্যম বেড়ে যায়। দ্বিতীয় সংখ্যা পরিকল্পিত হয় শক্তিমান কবি বিনয় মজুমদারকে কেন্দ্র করে। সম্ভবত প্রথম সংখ্যায় রাখা আমার ভূমিকার প্রতি তাঁর আস্থা তৈরি হয়ে থাকবে, যে কারণে পরিকল্পিত বিনয় সংখ্যায়ও তিনি আমার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। বাংলাদেশ অংশের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে সে সংখ্যার জন্যও আমি অনেক পরিশ্রম বিনিয়োগ করি। আমার পরিবার তখনো ঢাকায় শিফট করে নি বলে অফিসপরবর্তী আড্ডার সময়ের একাংশ এখানে ব্যয় করবার সুযোগ তখনো অবারিত ছিল। সে সুযোগটা ওখানে কাজে লেগেছিল। পুরো ২০০০ জুড়ে মুদ্রিত-অমুদ্রিত লেখা সংগ্রহ ও প্রি-প্রেস কার্যক্রম শেষে ২০০১-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় প্রায় চারশ পৃষ্ঠায়তনের বিনয় মজুমদার সংখ্যা।

আমাদের এখানে সাধারণত কীর্তিমান লেখক-কবিরা মৃত্যুবরণ করলে তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করবার রেওয়াজ চলে আসছিল। কিন্তু একজন কবির জীবিতাবস্থায়ই তাঁকে নিয়ে বিশেষায়োজনের আইডিয়াটা বেশ চমকপ্রদ ছিল। এদেশে বিনয়ের জনপ্রিয়তা তুমুল। ‘কবিতার শহীদ’ বিনয় এখানে ততদিনে মিথপ্রায়। সেই সুবাদে সংখ্যাটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দুই পাশেই লেখক-পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সঞ্চার করে। ২০০৬-এ বিনয় মজুমদারের মৃত্যুর পর এখানে আরো কোনো কোনো ছোটকাগজ তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে, কিন্তু লোক-এর ওই সংখ্যাটিই ছিল মৃত্যুপূর্বকালে এদেশে বিনয় মজুমদারকে অত বৃহদায়তনে স্মরণ।

লোক এখনো পর্যন্ত কমবেশি সূচনাকালীন ফরমেট ধরেই প্রকাশিত হয়ে আসছে, যদিও পরবর্তী কোনো সংখ্যায়ই আমার পক্ষে আর আগের মতো সময় দেওয়া সম্ভব হয় নি। তবে কখনো কখনো লেখক হিসেবে, কখনো-বা তদতিরিক্ত নেপথ্য সহায়তাকারী হিসেবে এক ধরনের লোকসম্পৃক্ততা আমার এখনো অব্যাহত আছে। নিশ্চয়ই থেকেও যাবে।

মাত্র ২০ বছরে লোক-এর অর্জন বিস্তর। আমার মনে হয়, বিপুল গাম্ভীর্য আছে কিন্তু প্রভাবসঞ্চারী কাজ নেই, শুদ্ধাচারী এমন লিটল ম্যাগাজিনের চাইতে মিশ্রাচারী লোক-এর প্রয়োজন সাহিত্যসমাজে অনেক বেশি। এখানে যে মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ আছে, ওখানে তা নেই। দীর্ঘ ২৫ বছরব্যাপী লিটল ম্যাগাজিন পাড়ায় বসবাসসূত্রে এটা আমার অন্যতম প্রতীতি। এ সংক্রান্ত আমার বাদবাকি প্রতীতিসমূহ অন্য সময়ে অন্যত্র ক্রমপ্রকাশ্য...

লোক-এর দুইযুগ পূর্তি সংখ্যায় প্রকাশিত, ডিসেম্বর ২০১৯

অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অন্যতম স্বর্ণদুয়ার

ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের নিয়মিত পাঠচক্র প্রকল্প বীক্ষণ তার ১৮০০তম অধিবেশনে উপনীত হতে যাচ্ছে, সংবাদ হিসেবে এটা প্রায় সবার জন্যই সচকিত হবার মতো। সংবাদটি আমার জন্য একইসঙ্গে গর্বেরও, যেহেতু ১৯৯২-এর অক্টোবর থেকে ১৯৯৩-এর মার্চ পর্যন্ত ৩৭ ও ৩৮ নম্বর প্রান্তিকে আহ্বায়ক হিসেবে বীক্ষণের হাল ধরে এর সুদীর্ঘ পরম্পরায় আমিও তুচ্ছ অবদান রাখতে পেরেছিলাম। পাশাপাশি সহ-আহ্বায়ক এবং সাধারণ অংশগ্রহণকারী হিসেবেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম আগে-পরে আরো কিছুদিন। পেশাগত প্রয়োজনে দূরবর্তী শহরে অবস্থানের কারণে পরবর্তী প্রায় আড়াই দশকে বীক্ষণে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ কমই ঘটেছে। তবে এটা বলা যায় যে, শারীরিক দূরত্ব সত্ত্বেও বীক্ষণের সঙ্গে কোনো মানসিক দূরত্ব আজ অবধি তৈরি হয় নি। হওয়া সম্ভবও নয়।

সকলেই জানেন এবং মানেন যে, লেখালেখি করবার কাজটি শতভাগ ব্যক্তিগত। কিন্তু তার জন্য সামাজিক হয়ে ওঠবার ব্যাপার আছে। অগ্রজ, সমসাময়িক, অনুজ নির্বিশেষে অন্য লেখকদের সঙ্গে মেলামেশা, পাঠাভিজ্ঞতা ও শিল্পধারণা বিনিময়, বিচিত্র তথ্য আদানপ্রদান, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি সে অবকাশ তৈরি করে দেয়, অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ করে তোলে। অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অসংখ্য মার্গের একটি হলো সামাজিক হওয়া। বলতে কী, এ ধনে যে যত ঋদ্ধ, তার ব্যক্তিগত লেখনযাপন তত সুফলদায়ক।

বীক্ষণ আমাদের জন্য ছিল অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অন্যতম স্বর্ণদুয়ার। অন্য লেখকদের সাথে একজন সাহিত্যকর্মী কীভাবে মিশবেন, ওই মেলামেশা থেকে কিছু আহরণ করবেন নাকি কেবল নিজেকে প্রদর্শন করে বেড়াবেন সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। বীক্ষণ সে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ১৯৮৩ সাল থেকে সবার সামনে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়ে চলেছে। যাত্রার শুরুতেই এরকম একটা প্রস্তুত ক্ষেত্রের সন্ধান লাভ যে কোনো সাহিত্যকর্মীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

বীক্ষণ বিষয়ে প্রসংগত আমি কিছু কথা লিখে উঠেছিলাম ২০০৫-এ প্রকাশিত ইফফাত আরা সম্পাদিত ‘দ্বিতীয় চিন্তা’র ফরিদ আহমদ দুলাল সংখ্যায় পত্রস্থ আমার আঁতুড়ঘরের নকশামালা, খুঁজে-ফিরে দেখার সাধনবিলাস শীর্ষক নাতিদীর্ঘ রচনায়। আমার মনে হয়, একই কথা পুনর্বার লিখবার চেষ্টা না করে ওই রচনাংশটিই এখানে উৎকলন করা যায়, যেহেতু আমাদের বীক্ষণঘনিষ্ঠ সময়টা ওখানে স্ফটিকাকারে হাজির হয়েছিল।
বীক্ষণবার
আপনি জানেন, বীক্ষণময় শুক্রবারগুলো ছিল উৎসবের দিন আমাদের, সচল-অচল সব ধরনের লেখকের। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই প্রস্তুতি চলত, পরদিন কোন কোন লেখা পড়া যায় সে নিয়ে। রাত জেগে নতুন করে কিছু লিখবার চেষ্টা, না হলে পুরোনো খসড়াকে ভাঙা আবেগের তুলি দিয়ে নতুন করে ঘষেমেজে সারিয়ে তোলা।
বীক্ষণ ছিল ময়মনসিংহের নবীন-প্রবীণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক মিলনমেলা, আজও। অনিবার্য কারণে একদিন না আসা গেলে সাংঘাতিক খারাপ লাগত। মনে হতো আমাকে বাদ দিয়ে সাহিত্যের খেয়া হয়ত পৌঁছে যাচ্ছে সিদ্ধির ঠিক ওপারে। মনে এতদবিবেচনা একবার ঠাঁই পাবার পর থেকে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ (মসাস)-এর সর্বাপেক্ষা কার্যকর প্রকল্প বীক্ষণ-এ আমরা ছিলাম খুব নিয়মিত। তখন বীক্ষণ বসত সি. কে. ঘোষ রোডে অবস্থিত অনুগ্রহে পাওয়া প্রেসক্লাবের একটি কক্ষে। এখানে এসে সাহিত্যের জন্যে বিনাশ্রম, সিকিশ্রম, আধাশ্রম, পৌণেশ্রম, পূর্ণশ্রম— সব ধরনের সাহিত্যসংস্রবপুষ্ট লোকজনেরই চেহারা দেখেছি সামনাসামনি। ময়মনসিংহে লভ্য তাবৎ ঘরানার লেখকেরই আনাগোনা ছিল একে ঘিরে, হয়ত এখনো আছে। পূর্বনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কবিতা-গল্প-ছড়া পাঠ শেষে বীক্ষণের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত হলেও তরুণতর আমাদের অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কখনো কখনো পরদিন সকাল পর্যন্তও গড়াত, মনে পড়ে। বিষয় ও ভূগোলে সেসব অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে থামবে আমরা কেউই পূর্ব থেকে জানতাম না কিছু।

প্রেসক্লাব ছেড়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট হয়ে বীক্ষণ ব্রহ্মপুত্র তীরের কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য মহারাজের বাগানবাড়ির তপোবনপ্রায় পুণ্যচ্ছায়ারাশি ঘেঁষা মসাস-এর নিজস্ব ডেরায় স্থানান্তরিত হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই আমাদের দেহমনগাছে নতুন নতুন ডালপাতা ছড়াল। মসাস-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বীক্ষণের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক আপনার বিশেষ নজর থাকত আমাদের প্রতি। সংগঠনের আগামী সময়ের সৈনিক হিসেবে আমাদের তৈরি করবার একটা চেষ্টা আপনার মধ্যে ক্রিয়াশীল দেখেছি বরাবর। আপনার পরামর্শ ও নির্দেশ আমরা মেনে চলতেই চেষ্টা করতাম। এক দু’বার করে আমরা অনেকে আহ্বায়ক হিসেবে বীক্ষণের হালও ধরেছি। কিন্তু নবিশ সংগঠক হিসেবে আমাদের অনেকেরই ব্যর্থতা ছিল, ছিল সংগঠক হবার ব্যাপারে অনাগ্রহও। কারো কারো চাওয়াও ছিল না যে বীক্ষণ ভায়া হয়ে একদিন মসাস-এর বড়ো সংগঠক হব, বরং আমাদের স্বপ্ন ছিল ভালো কিছু লিখবার। কেউ কেউ সংগঠক হয়েও অঢেল লিখতে পারেন, আপনি যেমন। আমাদের কারো কারো মনে হতো, এ কাজটা সবার নয়, আমাদের জন্ম হয়েছে শুধু লিখবারই জন্যে। যে কারণে সংগঠনের নকশা অনুযায়ী পরিচালিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেও ভিতর দিক থেকে আমরা অনেকেই ছিলাম সংগঠনবিরোধী। ফাঁক খুঁজতাম কী করে প্রতিষ্ঠানের মাপ দেয়া সীমার বাইরে পা রাখা যায়, স্বাধীনভাবে সমমনাদের সাথে বেহিসেবী সময় যাপন করা যায়।

বীক্ষণের দ্বিতীয়ার্ধে অনুষ্ঠিত স্বরচিত রচনার পাঠপর্ব আমাদের দারুণভাবে আকর্ষণ করলেও প্রথমভাগের আলোচনা সবসময় ভালো লাগত না ওর প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র এবং বিষয় নির্বাচনজনিত বদ্ধতার কারণে। ওখানে এমনকি ঈদানুষ্ঠানের তাৎপর্য, দুর্গাদেবীর মাহাত্ত্ব্য— এসব বিষয়েও আলোচনা হতো। যতদূর খবর রাখি, আজও হয়। একইসঙ্গে মক্কা-মদিনা-গয়া-কাশী-কপিলাবাস্তু-লুম্বিনী-বেথেলহেম-নাজারেথের ছবি ওখানে আঁকা হতো যতটা প্রতিষ্ঠানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্যে ততটা সাহিত্যিক প্রয়োজনে নয়, আমরা বুঝতাম। এসব আমাদের কখনোই টানত না, আজও তরুণদের টানে না। তার মানে এ নয় যে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি না। আমরা ভিতর দিক থেকে বেড়ে ওঠবার জন্যে আরো প্রাসঙ্গিক, ব্যবহারিক ও গতিশীল আলোচনা করবার ও শুনবার জন্যে সদা মুখিয়ে থাকতাম। সেসব আলোচনার কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপছবি থাকত না, কিন্তু প্রাণমূলে রস থাকত।
আনুষ্ঠানিকতায় আমরা যারা অনেকটাই অপ্রস্তুত ও নীরব, ব্রহ্মপুত্র ধোয়া সাহেব কোয়ার্টার পার্কে গিয়ে বসলে আমরা সেখানে সবাই সরব। আমাদের এই আকর্ষণ সবকিছুকে ছাপিয়ে যেত।

আপনাকে মনেপ্রাণে সদাতরুণ বলেই জানি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও বেশি। তরুণ মসাস কর্মকর্তা গ্রন্থপ্রিয় আহমদ সাইফ, সুনন্দন ইয়াজদানী কোরায়শী, স্বরশিল্পী আমজাদ দোলনও। কিন্তু সর্বোপরি আপনারা ছিলেন মুরব্বি, সাংগঠনিক জন। মাঝে মধ্যে বীক্ষণ শেষে আপনারাও বসতেন পার্কে, কিছুক্ষণ। নদীর জল ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে চুল ওড়াতে ওড়াতে ওখানে চা-সিঙারা, বাদাম-চানাচুর ইত্যাদি হতো। কিন্তু মত্তআড্ডা যাকে বলে সেটা জমত না বস্তুত। আমাদের কাছে আপনারা ছিলেন স্থানীয় অভিভাবক। আমাদের পুরোমাত্রায় খুলে যাওয়া সম্ভব হতো কাজেই আপনারা পিঠটান দেবার পর। তখন ভালো করে ভেবে দেখি নি, কিন্তু এতদিনে ওসব জমায়েতকে রোদে মেঘে কোলাকুলি বলে মনে হয়, মুহূর্ত-স্ফূরিত। 
নব্বইয়ের দশকের শুরুর কয়েক বছরে বীক্ষণে তরুণ ও তরুণতরদের এক অপ্রতিহত জোয়ার ছিল। লেখালেখিতেও বেশি সরব ছিলেন ওই তরুণরাই, সবসময়ই যা হয়। শাহীদা হোসেন রীনা, আশিক আকবর, আহমেদ শফিক, আশিক সালাম, আহমদ শাহাবুদ্দিন, চয়ন বিকাশ ভদ্র, তাসাদ্দুক ফাহিম, অমল রজক, তোফায়েল তফাজ্জল, সালাহউদ্দিন পাঠান, আবদুল মতিন, সরকার আজিজ, পলাশ চৌধুরী, তাসলিমা রহমান, আশরাফ রোকন, দিলীপ সেন, মোস্তাক বিবাগী, মোহাম্মদ ইয়াকুব, নাজমা মমতাজ, রীনা পণ্ডিত, হাদিউল ইসলাম, মাসুম মোকাররম, শামীম পারভেজ, মশিউর রহমান খান, শতাব্দী কাদের, রওশন ঝুনু, মিনহাজ উদ্দিন শপথ, সমুদ্র সেলিম, মামুন মাহবুব, জুয়েল কবীর, ওসমান গণি, মনো জসীম, ধনেশ পণ্ডিত, তন্দ্রা সরকার, রাজিয়া সুলতানা, মার্জিয়া সুলতানা নীলিমা, হিশাম আল মহান্নাভ, ফাতেমা নার্গিস বীণা, রোকসানা বিলকিস, অনিন্দ্য জসীম, স্বাধীন চৌধুরী, মামুন মোয়াজ্জেম, আলী ইউসুফ, শাবিহ মাহমুদ, শাহিন লতিফ, গনী আদম, সফেদ ফরাজী, বিল্লাল মেহদী, অতনু তিয়াস, চন্দন সাহা রায়, সিদ্ধার্থ টিপুসহ আরো অজস্রজন আমরা।

পার্ক বা সংগ্রহশালার বিকল্প-বীক্ষণ শুরু হতো এ তালিকার একটা গুরুঅংশকে নিয়ে। ওখানে আমরা থাকতাম পুরোমাত্রায় ব্যবহারিক, কবিতাকেই ভালো করে চিনবার-জানবার চেষ্টায় মত্ত। নানাজনের মুদ্রিত-অমুদ্রিত কবিতা থেকে পাঠ, তার ভালোমন্দের নিবিড় পর্যালোচনা, বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠের অভিব্যক্তি শেয়ার, ইত্যাদিতে মত্ত থাকতাম আমরা। কবিতা বিষয়ে নানারকম কর্মশালাও হতো ওখানে। পাঁচ-দশজন মিলে বারোয়ারি কবিতাও লিখেছি আমরা। প্রতিজন এক দু’লাইন করে লিখে একটি কবিতার পূর্ণ রূপ দেবার সেসব চেষ্টা যুগপৎ আনন্দদায়ক এবং শিক্ষণীয় ছিল। ক্রমশ কমতে কমতে জমায়েত দু’তিনজনে এসে ঠেকলে আমরা অন্য মঞ্জিলমুখী হতাম। তারও পরে হতাম একা। হায় একা হওয়া আমাদের, বিরল ভাবনা।

উল্লিখিতদের অনেকেই আজ আর লেখালেখির সঙ্গে নেই, অনেকেই ক্রমশ নিভে গেছেন অথবা নিভতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু যুগপূর্বকালে এদের সবার ভিতরেই কমবেশি সৃজন-আগুন ছিল। ওই অন্তর্গত অগ্নির সম্মিলিত উত্তাপ আমরা সকলেই অনুভব করতাম সমভাবে, সংবিধানবিহীন আমাদের সংঘপ্রয়াসে। 
এটা ঠিক যে, ২৫ বছরে অনেকখানি বদলে গেছে ওই জগৎ। আমাদের অনেক অগ্রজ ও সতীর্থ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, যাঁদের সংস্পর্শ আমাদের প্রাণিত করেছিল। বীক্ষণসংশ্লিষ্টদের থেকে ইতোমধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন আহমদ সাঈফ, প্রদীপ কুমার বিশ্বাস, আজাহার সরকার, মোহাম্মদ আবদুল হান্নান, আবদুল মতিন, তাসলিমা রহমান ও শামীম পারভেজ। ১৮০০তম অধিবেশনের এই উৎসবায়োজনে হৃদয়তন্ত্রীতে আজ তাঁদের কথাই বেদনবীণা হয়ে বাজছে বেশি করে।

সেপ্টেম্বর ২০১৮

Friday, July 3, 2020

সবকিছু অবলীলায় সামলে ওঠার জাদুকর

‘ক্রমশ নিভে আসছে আলো...’

এটা রীতিমতো বিস্ময়কর যে, গুম-হত্যা-দুর্ঘটনার আধিক্য ছাড়িয়ে ভেজাল খাদ্যের রমরমা সময়ে পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক নানা উদ্বিগ্নতা সয়ে মানসম্পন্ন চিকিৎসার অপ্রতুলতার মধ্যেও প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। বিষয়টা ভাবতে গেলেই মার্ক টুয়েনের বিখ্যাত এই উক্তিটি মনে পড়ে যে, পৃথিবীতে ‘তিন রকমের মিথ্যা আছে : মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান’। এতদপ্রেক্ষিতে, নিয়ম করে আয়ু বাড়াটা, আমার মনে হয়, রাজনৈতিক পরিসংখ্যানের কারসাজি হলেও হতে পারে। শামীমুল হক শামীম (শাহশা) বিষয়ক ধান ভানতে গিয়ে পরিসংখ্যানবিষয়ক শীবের গীতটি আমি এ সত্যটি সামনে আনার অভিপ্রায়ে গেয়ে উঠলাম যে, তিনি তাঁর জীবৎকালের গুরুভাগ ইতোমধ্যে যাপন করে ফেলেছেন, মানে ৫০ অতিক্রান্ত হয়ে গেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-নির্ধারিত পুরুষ মানুষের ২০১৬ সালের গড় আয়ু অনুযায়ী গড়পরতা তাঁর আর মাত্র ২০ বছর ৩ মাস বেঁচে থাকবার বাকি! দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি নারী নন; নারী হলে কথিত পরিসংখ্যানফল তাঁকে আরো ২ বছর ৬ মাস বেশি বাঁচবার প্রতিশ্রুতি দিত!

উল্লেখযোগ্য কিছু করে হইচই ফেলে দেবার জন্য ২০ বছর ৩ মাস সময়টা খুব কম কিছু না হলেও বাঁচবার জন্য সময়টা অল্পই। যা পঞ্চাশে হয় নি তা বাকি বিশে হয়ে যাবে এরকম আশা করায় কোনো দোষ নেই, কিন্তু সে আশা নিরাশায় পর্যবসিত হবার সম্ভাবনাও সমানে সমান। সুতরাং তাঁর মূল্যায়নের জন্য ভবিষ্যৎ বিশের দিকে না তাকিয়ে অতীত পঞ্চাশের দিকে তাকানোই সংগত বোধ হয়।
   
‘তোমাদের আলোকিত করে আমি থাকি অন্ধকারে’ 

শাহশা কবিতা লিখেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কবিতা লেখার পাশাপাশি তখন থেকেই প্রগতিমনস্ক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে তাঁর যুক্ততার কথা জানা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়-পরবর্তী জীবনে ঘটনাক্রমে কবিতা লিখবার তুলনায় তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতাই প্রধান হয়ে ওঠে। অনিকেত শামীম (অশা) নামে বাংলা ভাষাভাষীদের পত্রিকা ‘লোক’ সম্পাদনা এবং লোকসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে মগ্নতার ফলে ক্রমশ ম্লান হতে থাকে তাঁর সৃজনমূলক তৎপরতা। আর এর বিপরীতে ক্রমে বড়ো হতে থাকে কবি-লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে তাঁর সমবায়ী কায়কারবার।

এ যাবৎ লোক-এর ২০টিরও বেশি সংখ্যা প্রকাশ ছাড়াও ২০০৯ সাল থেকে পত্রিকাটির পক্ষ থেকে লোক সাহিত্য সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে, ২০১৬ পর্যন্ত যার প্রাপক হয়েছেন ৯ জন বাংলাদেশি কবি-সাহিত্যিক। দর্শনীর বিনিময়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন দশকের কবিদের অংশগ্রহণে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ‘ধ্রুপদী কবিতার উত্তরাধিকার’, ‘বৃষ্টিদিনে কাব্যকথা’, ‘বৃষ্টি ও বিরহের কবিতা’, ‘শীতের কবিতা’ এবং বিভিন্ন দশকের কবিদের নিয়ে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ‘বিরুদ্ধ স্রোতে আমি একা’ (প্রথম দশক), ‘রোদ মেলেছে উড়াল ডানা’ (দ্বিতীয় দশক) প্রভৃতির সফল আয়োজন সম্পন্ন করেছেন তিনি। এ ছাড়াও, কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে সেমিনার, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, বক্তৃতা অনুষ্ঠান ও নানা বৈঠকীর আয়োজনও লোক-এর পক্ষে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। জাতীয় লিটল ম্যাগাজিন মেলার পাঁচ-পাঁচটি আয়োজনের অন্যতম আয়োজক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুকে ঘিরে একাধিক বুলেটিনের প্রকাশক এবং মানববন্ধন-মিছিল-সমাবেশের আয়োজক হিসেবেও তাঁর নাম উচ্চার্য।

এসব কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ও বাইরের বাংলা কবিতাপাঠকের মধ্যে তাঁর যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, সেখানে তাঁর শাহশা নামক কবি পরিচয়ের খ্যাতি ছাপিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে অশা নামক সংগঠক পরিচয়।

‘বৃত্ত আঁকতে আঁকতে তোমাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে মহাবৃত্ত’

এটা বেদনাকর যে, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক এতসব কায়কায়বার সত্ত্বেও সাহিত্যমহলে তাঁকে ঘিরে বিশেষায়িত কোনো মুগ্ধতার খবর প্রকাশ্য নয়। তবে কি দীর্ঘদিন ধরে শ্রম-ঘাম-অর্থ-প্রেম বিনিয়োগ করে শাহশা উরফে অশা নানা মাপ ও আয়তনের যেসব বৃত্ত এঁকেছেন, সেগুলো মিলে কোথাও কোনো মহাবৃত্ত তৈরি হয় নি? যতদূর খোঁজ রাখা গেছে, সাহিত্যাঙ্গনে তিনি তাঁর ব্যাপকসংখ্যক নিন্দুক তৈরি হওয়াকে প্রভাবিত ও প্রণোদিত করতে সক্ষম হয়েছেন। যাঁরা তাঁর বন্ধু হয়ে উঠতে পারতেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁরা তা হয়ে ওঠেন নি। বরং হয়ে উঠেছেন শত্রুপ্রতিম, নিদেনপক্ষে নিন্দুক।

পৃথিবীতে আজকাল মত ও পথের এত বেশি বৈচিত্র্য বিদ্যমান যে, কাজ করেন এমন মানুষমাত্রকেই বিরুদ্ধ মত ও পথের অনুসারীদের মোকাবেলা করে এগোতে হয়। এর থেকে দূরে থাকতে পারেন কেবল নিষ্কর্মা ও বোবারা। লক্ষণীয় যে, তাঁর ক্ষেত্রে এই বিরুদ্ধ বলয়ের শক্তি ও সজ্জা স্বাভাবিকের চাইতে খানিক বেশিই বোধহয়। এরকম কেন হলো তা নিয়ে অন্য পরিসরে বিশ্লেষণ চলতে পারে। তবে এখানে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখা যায়। আমার দৃষ্টিতে এর তিনটেমাত্র কারণ :

১. সামাজিক, সাহিত্যিক ও পানশালাসম্পর্কিত পরিচিতির কারণে তাঁর সাথে প্রচুরসংখ্যক মানুষের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। সদাপ্রসন্ন ও আমুদে শাহশা উরফে অশা কিছুমাত্রায় লোকজনকে তাঁর দিকে আকর্ষণও করতে পারেন। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর কাছে আকর্ষিতজনের নানারকম প্রত্যাশাও হয়ত তৈরি হয়। কিন্তু সংগত কারণেই সবার প্রত্যাশা পূরণ করা একজন ব্যক্তি বা একটি সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। পারেন নি তা শাহশা উরফে অশা কিংবা ‘লোক’ও। সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পছন্দাপছন্দ থাকে, থাকতে হয়। তা নইলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তার বিশেষত্ব হারায়। আর বিশেষত্ব ধরে রাখতে চাইলে উপজাত হিসেবে অমুগ্ধজনের আবির্ভাব ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে এটা ঘটতে থাকলে তাদের পরিসর ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে অমুগ্ধ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়, যদি অমুগ্ধতাকে কনভার্ট করে তাদের মুগ্ধ করবার কোনো প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে ক্রিয়াশীল না থাকে। এটা পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত উপায়েই ঘটে।

২. সামাজিক-রাজনৈতিক-সাহিত্যিক সকল ধরনের কাজেই ভিন্নবলয় থেকে যেহেতু প্রতিনিয়ত ভিন্নমত তৈরি হতে থাকে, সেহেতু উপেক্ষা না করে যথাযথ উপায়ে এসব মতের মোকাবেলা করা জরুরি হয়। কাজভেদে মোকাবেলার ধরনও ভিন্ন হয়। তিনি যে ধরনের কাজে যুক্ত, সে কর্মসংশ্লিষ্ট ভিন্নবলয় থেকে উত্থাপিত ভিন্নমতকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা করা শ্রেয়। কিন্তু তিনি সেটা না করে নীরবতাকেই কৌশল হিসেবে শ্রেয়জ্ঞান করে থাকেন। লক্ষণীয় যে, তাঁর হয়ে এ কাজটি অন্যরাও যে করতে পারতেন না তা নয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রায় কেউই নিষ্ঠার সাথে তা করতে এগিয়ে আসেন নি। হয়ত তাঁরা এই সংকটকে নিজের সংকট ভাবতে পারেন না। অন্যেরা তাঁর সংকটকে নিজের সংকট ভাববার মতো পরিসর পান কি না বা তিনি তাদের সে পরিসর দেন কি না সেটাও অবশ্য ভেবে দেখবার বিষয়।   

নির্বিরোধ থাকা যে কৌশল হিসেবে অকার্যকর তা নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। তবে এটি কাজ করে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ফলে সর্বদাই তাঁর প্রতি প্রীত নয় এমন মানুষের স্রোতকে পরিসরে বড়ো মনে হয়। নিয়মানুযায়ী দীর্ঘ সময় পরে এই বিরুদ্ধ বলয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বদলে যেতে পারে। সেরকম ভাবা আচরণবিজ্ঞানসম্মতও।  

৩. শাহশা উরফে অশার ব্যক্তিগত জীবনের বেশ কিছু দেয়াল কিছুটা সুবোধ্য ও অনেকটা অবোধ্য কারণে মাঝেমধ্যে ভেঙে পড়বার আওয়াজ শোনা যায়। তাতে গোপনীয়তার গোপনতা ভীষণভাবে লঙ্ঘিত হয়। কথিত নিন্দুক ও শত্রুপ্রতিমদের কাছে যখন এই লিক হওয়া গোপনতা পৌঁছে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা আরো সশস্ত্র হবার অবকাশ পান। এই সশস্ত্র গোষ্ঠী তখন অবকাশ পান তাঁর বিরুদ্ধে আরো আরো নতুন মানুষকে বিষিয়ে তুলতে।

‘সব ভালোবাসাই ভালোবাসা নয়’ 

দেখা যায়, সামাজিক-সাহিত্যিক ও অন্যবিধ কারণে যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে আসেন তাঁদের একাংশ তো বটেই, যাঁরা আসেন না, উল্লিখিত ত্রিবিধ কারণে তাঁদের একটা অংশও পরবর্তী সময়ে তাঁর নিন্দুকগোষ্ঠীতে নাম লেখান। তদুপরি তাঁর প্রশ্রয়পুষ্টদের মধ্যকার একাংশকে মাঝেমধ্যে নিদারুণভাবে রূপ বদলে ফেলতে দেখা যায়। এ অংশের ভালোবাসার খাঁটিত্ব নিয়ে ম্যালা সন্দেহের অবকাশ আছে। এটা মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠে হয়ত এরকম বলা যায় যে, নিকটে এলে তাঁর প্রতি আকর্ষণটা হয়ত আর ধরে রাখতে পারেন না কেউ কেউ। ফলে সকরুণ নিরুৎসাহের আশপাশে আর কোনো ভালোবাসার স্পেস খুঁজে পান না তাঁরা।

খুব কম মানুষই পূর্বাহ্ণে এটা বুঝতে পারেন যে, পরে কে তার লাঙল-জোয়াল ব্যবহার করে তারই ভিটায় উফশী ঘৃণার আবাদ করবে। বুঝলে কিছুটা অন্তত আত্মরক্ষা করা যায়। অশাও ব্যাপারটা খুব একটা বোঝেন বলে কখনো মনে হয় নি। বুঝলে হয়ত তাঁর ভিটার সবুজ আরো বড়ো পরিসর নিয়ে রং ছড়াতে পারত।

‘বেদনার ক্ষত বুকে নিয়ে কতদূর যাওয়া যায়, বলো?’

এহেন ক্ষতাক্ত দেহমন নিয়েই অশা মাইনপোঁতা পথঘাট মাড়িয়ে জোরকদমে এগিয়ে চলেছেন দেখা যায়। মাঝে মাঝে তাঁকে হতাশ মনে হলেও তা প্রায়ই হয় খুব সাময়িক। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর নেশা কিছু মানুষকে সদাই তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনিও তেমনি একজন। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বাধা, অসহযোগিতা ও নিন্দামন্দকে থোড়াই কেয়ার করে আপাতদৃষ্টে অসাধ্য মনে হওয়া একেকটা উদ্যোগ হাতে নিয়ে তিনি ঠিকই তা সাধন করে ফেলেন। যেন কোনো এক প্রলুব্ধকর দূরাগত ধ্বনি তাঁকে সামনে টেনে নিয়ে যায়।

প্রশ্ন জাগতে পারে, এত সক্ষমতা কোত্থেকে কীভাবে পান অশা? মনে হয়, কোথাও তাঁর একটা বিপুল শক্তির উৎস আছে, অত্যন্ত গোপন, যা তাঁকে ছররা বন্দুক নিয়ে মেশিনগানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবার সাহস জোগায়। এই রহস্য কাছের কেউ কেউ জানলেও আমরা জানি না।

এরকম একটা কথা সমাজে প্রচলিত আছে যে, যে কাজ যত ভালো, সে কাজের তত বাধা; যে যত শক্তিমান, তার তত শত্রু ও নিন্দুক। এই বাক্যের জানালা দিয়ে তাকালে একভাবে বিষয়টার একটা ব্যাখ্যা মেলে বটে। তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষগুলোর দ্বারা তৈরি হওয়া প্রতিবন্ধকতাসমূহ বারেবারে নস্যাৎ হয়ে যাওয়া দেখে তখন এটাকেই সত্য বলে মনে হয় যে, শাহশা উরফে অশার কৃত কাজবাজ মোটের ওপর ভালো এবং তাঁর ধারণ করা সমুদয় শক্তি কেবল অপরাজেয় হতেই জানে।

তখন ‘অভিনন্দন’ বলে বা না বলে বিস্ময়মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বিরুদ্ধবাদীদের কার্যত আর কিছু বলবার-করবার থাকে না।

‘সবখানেই বাসা বেঁধেছে ফণা তোলা বিষাক্ত সাপ’ 

এসব থাক। নিজের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা ও নিন্দুকপরিবৃত অবস্থাকে ভুলে থাকতে অন্যের সম্পর্কে এসব বলাবলি তেমন একটা অর্থ বহন করে না। এমনকি নিজের জীবন তাতে নিষ্কণ্টক ও পুষ্পিতও হয়ে ওঠে না। তাঁর চেয়ে শাহশা উরফে অশার ব্যাপারে এই সত্যটা উচ্চারণ করে রাখা কাজের হতে পারে যে, বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও তার অস্তিত্বের বিপক্ষে যে শক্তি তৎপর, তাদের বিরুদ্ধে তিনি সবিশেষ সক্রিয়। সেটা কবিতায় যেমন তেমনি পথেও। এমনকি ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়িয়ে বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত গোষ্ঠীর ব্যাপারেও তাঁর কণ্ঠ বিশেষভাবে সোচ্চার। তাঁর এ সক্রিয়তাকে, বর্তমান অবিশ্বস্ত সময়ে, প্রায়ই বড়ো প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

‘অন্ধপাতায় জ্যোৎস্নার বিকিরণ’

শাহশা উরফে অশার যাপন ও ক্রিয়াকলাপে মন পাতলে উপলব্ধি করা যায় যে, বহুত্ববাদী সংস্কৃতিঋদ্ধ এক প্রাকৃত পাঠশালা জাগে তাঁর প্রত্যাশার চূড়ায়, যা অধরাপ্রায়, কাছে থেকেও যা সুদূর বিদেশ। স্বপ্নরূপ ওই অধরাই তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে। ওই ডাকে তিনি হয়ত আরো ম্যালাদিন যথারীতি সাড়া দিয়ে যেতে থাকবেন সেরকম মনে হয়।

কবিতা অনেক রকম। জীবন অনেক রকম। শাহশার কবিতা ও জীবনেরও একটা নিজস্ব রকম আছে। সেই নির্দিষ্ট রকমটি যেন একটি অন্ধপাতায় জ্যোৎস্নার বিকিরণ। তার স্নিগ্ধ ও মৃদু আলো সবাইকে না ছোঁক কাউকে কাউকে নিশ্চিত ছুঁয়েছে, ছোঁয় ও ছোঁবে। এই অবস্থার প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ এই পরিসরে তাঁর সফল একটি দীর্ঘজীবন প্রত্যাশা করা যাক।

দ্রষ্টব্য : এই লেখার উপশিরোনামগুলো শামীমুল হক শামীম (শাহশা)-এর কবিতা থেকে নেওয়া।

জানুয়ারি ২০১৮

মোস্তাক আহমাদ দীনের ‘বিষ’বিদ্যার পরিসর

এত বিষ দেহকাণ্ডে, দেহে
আজ আমি সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
সকলেই একথা বোঝে আমি কভু ডুবি নাই জহরের জলে
দেহকাণ্ডে তবু এত বিষ, ভাবি তাই
প্রাণের মধ্যে কোন সর্প ঢুকে গেছে ঘুমে? 
এ সন্দেহ-মুক্ত হতে বংশকাহিনি যারা পাঠ করে গেল
তারা দেখে, পিতা বা প্রপিতামহ আলস্য করেনি কেউ
                                               মনসাপূজায়
তবে আমি অভিশপ্ত কাহার সন্তান?
দেহকাণ্ডে যত বিষ, তার মর্মে নীল হয়ে যাবে বলে
সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
অথচ দূরবর্তী বন্ধুও বোঝে
গোপন ইচ্ছের জোরে সংলগ্নজনের মনে
                             কত বেশি মগ্ন হতে চাই
(বিষ, মোস্তাক আহমাদ দীন)
অর্থের প্রতি মনোযোগ না-দিয়ে মোস্তাক আহমাদ দীন (মোআদী)-র প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’ভুক্ত ‘বিষ’ কবিতাটি বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার শব্দ করে ও না-করে পড়ে দেখেছি। প্রতিবারই ওর প্রসারিত আলো-ছায়ায় মগ্ন হওয়া গেছে। বিহারের নিমিত্তে পর্যাপ্ত পরিসর আছে বলে এবারও তা হওয়া গেল; অর্থাৎ, ভালো লাগল। প্রকৃতপক্ষে কী এমন ভালো লাগল এর? সুর? অবশ্যই সুর, দোলা। আবার অর্থের চোখে চোখ রেখে যখন পড়া গেল কবিতাটি, কমসেকম তিনরকম ঢেউ এসে লাগল মনে, তিন স্তরের। অন্য কেউ হয়ত অন্যভাবে তাকিয়ে আরো অন্য কোনো রঙের সামনে গিয়ে পড়বেন কবিতাটির। এই ঐশ্বর্যের কারণেই কবিতাটিকে বিশেষভাবে সম্পন্ন বোধ হলো। মনে  হলো, কবিতার মতো দেখতে এ লেখাটি আসলে একটি কবিতাই।

অর্থে ডুবে এর তিনরকম যে ঢেউয়ের মুখে আমি পড়েছি, সেটা দেখাতে গিয়ে অত্যাশ্চর্য কোনো স্থাপনার ইট খুলে খুলে তার উপাদানের মান যাচাইয়ের মতো বিধ্বংসী কিছু করতে আমি আগ্রহী নই। কিন্তু লেখাটি যে প্রসারিত অর্থ ধারণ করেছে, তার খোঁজ পেতে হলে একভাবে তো এর অন্দরে তাকানো লাগেই। আলতোভাবে সে চেষ্টাটিই আমি এখানে একবার করে দেখতে চাইছি।

প্রথম ঢেউ

শুরুতেই মোআদীর ‘বিষ’ কবিতাটির যে ঢেউ আঁচ করা যায়, তাতে শরীরের শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়া কথিত বিষকে ক্রোধরূপ একটা তিতা বস্তু হিসেবে অনুমান করতে ইচ্ছে করে, যেখানে সংলগ্নজন হলো নিজেরই অন্য আরেক সত্তা, যে কিনা বিশুদ্ধ, যে কিনা নির্বিরোধী একটা যাপনের পক্ষে অধোবদন। তাকে দূরে যেতে বলা সেক্ষেত্রে সাময়িক এক অবিশুদ্ধ সত্তার সংস্পর্শ থেকে বিশুদ্ধ সত্তাকে রক্ষাপ্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।

বৈষয়িকতার পঙ্কে না-নেমেও এই ক্রোধের অভিষেক হবার নেপথ্যে কী এমন ব্যাপার কাজ করছে? সে কি অজ্ঞাতে ভেতরপ্রাসাদে জন্মানো জলশূন্যতায় ভোগা কোনো মোহের উদ্ভিদ? হবেও-বা।

বংশের পরম্পরা ধরে খোঁজ নিলে দেখা যায়, বিষয়বাসনা থেকে দূরে থাকবার সাধনায় মোআদীর পূর্বমানবের কারো সময়েই কোথাও কোনো অবহেলা ছিল না। সেই ঐতিহ্যচ্যুত হয়ে বিশুদ্ধ সত্তার সংক্রমিত হয়ে পড়বার সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে এক সংগত শঙ্কা থেকে বিচ্ছেদ ভাবকে নিজের করে নিয়েছে মোআদীর ক্রোধকলূষে অবিশুদ্ধ হয়ে পড়া সত্তা।

কিন্তু কে না জানে, সবটুকু ভালোবাসা তার সজ্ঞানে দূরে ঠেলে দেওয়া ওই বিশুদ্ধ সত্তার প্রতিই।

দ্বিতীয় ঢেউ

প্রথম ঢেউটি ছলকাতে থাকতেই উছলে ওঠে অন্য আরেক ঢেউ। ওদিকে তাকাতেই প্রায় শিহরিত হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় কৈশোরোত্তরকালে যৌবনের ঠিক দরজায় দাঁড়ানো বয়সের গোপন বিড়ম্বনার কাছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এত এত বছর পেছনে পৌঁছে দেবার সক্ষমতার জন্য কবিতাটির কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে বসে থাকতে হয়।

মনে হতে থাকে যে, যুক্তিপরম্পরায় আত্মীয়সূত্রে বেড়ে ওঠা শব্দক্রমধারা ‘সর্প’, ‘বিষ (জহর)’, ‘নীল’, ‘মনসাপূজা’ই কবিতাটির চাবিশব্দগুচ্ছ। তবে অবশ্যই ‘দেহকাণ্ড’, ‘সংলগ্নজন’, ‘গোপন ইচ্ছে’— এই তিনটি শব্দবন্ধের শাসনকে মেনে নিয়েই এগোতে হয় কবিতাটির মন জয়ের দিকে।

মনে হয়, নবযৌবনপ্রাপ্ত মোআদীর সদ্যউৎপাদিত স্পার্ম বা বীর্যই এখানে বিষ, সর্প যেখানে লিবিডো বা যৌনতাড়না। এই সূত্র বিবেচনায় নিলে মনসাপূজা অবশ্যই বিয়ে ও সংসার; আর নীল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তখন বীর্যপাতন শেষে গর্ভসঞ্চারজনিত অবস্থার উদ্বেগ।

দূরবর্তীজন হয়েও বুঝতে পারা যায় যে, এখানে সংলগ্নজন মানে সম্ভাব্য যৌনসঙ্গী বা প্রেমিকা। উপচে ওঠা বীর্যের তাড়নাবশে জৈবদেহে স্খলনের যে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত, বয়সজনিত অপরিপক্কতা ও নৈতিকতার চাপেই মূলত তার সংস্পর্শ এড়ানোর এই প্রয়াস।

বলা বাহুল্য নয় যে, এ যাত্রায় সামাজিক অর্থে বৈধ পথ বিয়ে করে সংসারান্দরে প্রবেশ করা। পুরুষপরম্পরায় মোআদীর পরিবারে এ প্রথাই চর্চিত। কিন্তু নবযৌবন সে ধৈর্যধ্যানের পথ থেকে চ্যুত হয়ে বিবাহপূর্ব আকস্মিকতায় বীর্যপাতনের সম্ভাবনার মুখে পড়ে গর্ভসঞ্চারের ভয়ে আঁতকে ওঠে। অথচ কামেচ্ছাসম্মত বয়সে জৈবদেহ ভেতরে ভেতরে যৌনসঙ্গী তথা প্রেমিকার প্রতিই সতত নিমগ্ন।

তৃতীয় ঢেউ

সামাজিক সংস্কারবশত লজ্জা-সংকোচ থেকে দ্বিতীয় ঢেউটি থেকেও যদি চোখ সরিয়ে ফেলানো যায়, তো সাক্ষাৎ মেলে অন্য আরেক ঢেউয়ের। এবারে মনে হয়, এখানে বিষ আসলে ভাব। যেহেতু প্রাণের মধ্যে সর্প তথা বিষবিষয়-বাসনা বা কর্মপ্রেরণা ঢুকে গেছে, কাজেই সৃজনপ্রয়োজনে একাকিত্বের প্রত্যাশা এখানে অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে। যে কারণে সংলগ্নে থাকা কর্মসঙ্গীকে দূরে ঠেলে দিতে চাওয়া।

পিতামহ ও পিতার পরম্পরা বেয়েই এ জৈবদেহ, তাঁরাও তাঁদের মতো নিরলস মনসাকৃত্যে তথা কাজবাজে মগ্ন থেকেছেন। কিন্তু তাঁদের পথ কবিতার দিকে না-গেলেও মোআদী হয়ে উঠেছে কবিতার অভিশাপে দগ্ধ, যার প্রধান কাজ ভাব ভেজে কবিতাফুল ফোটানো।

জাগ্রত কর্মেচ্ছা কর্মসঙ্গীলগ্ন হয়েই থাকতে চায়। কিন্তু তাকেও কাব্যদোষে অনুপ্রাণিত করে নীল করে দেবার বাসনা মোআদীর নেই। সে কারণেই তাকে দূরে ঠেলে দেবার এই বিরহবিলাস, মনে হয়।

বাংলা ভাবের জগতে কর্ম ও কাম একদেহে লীন। নেপথ্যে কাম তথা মদন ক্রিয়াশীল থাকে বলেই মানুষের পক্ষে কাজবাজে মগ্ন থাকা সম্ভব হয়। কাম তথা মদন ভস্ম হয়ে গেলে প্রেমও ভস্ম হয়ে যায়। কাজেই সকাম প্রেমই সেই নিয়ন্তা যে সাফল্যশীর্ষে আরোহণে কলকাঠি নাড়ে। এই প্রেক্ষাপটে মোআদীর ‘বিষ’ কবিতার বিভিন্ন ঢেউ পরস্পর লগ্ন হয়ে যেতে চায়। কোথাও না কোথাও একটা ঢেউ অংশত আরেকটা ঢেউয়ের ভিতরে প্রবিষ্ট হয়ে থাকে মনে হয়। এই ত্রিস্তর ভাববস্তুকে একত্রে মিলিয়ে দেখলে কবিতাটি একইসঙ্গে অনেক রং পেয়ে বর্ণিল হয়ে ওঠে। ওকে তখন চোর থেকে সাধু পর্যন্ত সবার মনের দরজায়ই কড়া নাড়বার উপযোগী কবিতা বলে আবিষ্কার করা যায়।

প্রতীকী ভাষারীতিতে প্রতিটি শব্দই একেকটি বস্তু বা বিষয়ের প্রতীক। কিন্তু প্রধানত সংস্কৃতকন্যারূপী বাংলা ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক চরিত্রের স্মৃতি এখনো আমাদের বেমালুম ভুলে যাবার দুর্মতি হয় নি বলে একটি কোনো শব্দের বিশিষ্ট প্রয়োগে আমরা অনেকার্থকতার সম্ভাবনা উঁকিঝুঁকি দেওয়া দেখি। অনেক সময় তা ঐতিহ্যনিষ্ঠ হয় না বটে; তবে তথ্যনিষ্ঠ বলে অনুমানবশেই আমরা সেই সাবেকী উষ্ণতা অনুভব করে উঠি, উঠতে পারি। এখানে যেমন আমরা এক ‘বিষ’কেই ‘ক্রোধ’, ‘বীর্য’ ও ‘ভাব’ হিসেবে দেখতে পেলাম। ‘সর্প’কে দেখতে পেলাম একইসঙ্গে ‘মোহভঙ্গ’, ‘যৌনতাড়না’ ও ‘কর্মপ্রেরণা’রূপে। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ‘বিষ’ বা ‘সর্প’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক বিন্যাসে উল্লিখিত অর্থসমূহের ভুক্তি দেখায় নি। তবু, আমরা যে দেখতে পেলাম, সেটা শব্দগুলোর প্রয়োগবিশিষ্টতার কারণেই মূলত। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, আমরা মোআদীর ‘বিষ’বিদ্যার আবহে ‘বিষ’ ও ‘সর্প’ ছাড়াও অন্যান্য চাবিশব্দের অর্থপ্রসারণ ঘটতে দেখছি।

কবিতার কবিতাত্ব ঠিক রেখেও যখন কোনো কবি ভাষা-শব্দের বিশিষ্ট প্রয়োগে এভাবে অর্থপ্রসারণ ঘটাতে সক্ষম হন, তখন তার সমুদয় ভাষাসংশ্লিষ্ট কীর্তিকলাপকে একাধিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে হয়। মোআদীর কাজকর্মকেও আমাদের সেভাবে দেখবার দরকার আছে বলে মনে হয়।

নভেম্বর ২০১৭

আসমার ‘প্ররোচনা’র গতিপ্রকৃতি

সে আমাকে প্ররোচিত করে।
মুখাবয়বে মানুষের কী যে স্বাতন্ত্র্য,
তেমন দুর্বলতা কিছুতে দেখা যায় না আর
কেবল ওষ্ঠে চুমু লাল হয়, লালা আসে
প্ররোচনাময়—
ফলে ওষ্ঠের ছায়া হয়ে থাকি,
আর তুমি হাঁটতে থাক, প্ররোচিত কর—
যাবতীয় লোভ, কাম ও স্বপ্নতা নিয়ে।
(প্ররোচনা, আহমেদ স্বপন মাহমুদ)
‘প্ররোচনা’ বা অ্যাবেটমেন্ট সাম্প্রতিককালে ঘোর নেতিবাচকতায় মোড়া একটা শব্দ। আজ আমরা একে ঘোরতর সন্দেহের কাতারে রেখে দেখলেও বরাবর শব্দটি এমন ছিল না। স্ত্রীবাচক বিশেষণ প্ররোচনার কিছু সৎকর্মও আছে। খোঁজ নিলে দেখা যায়, বাংলা ভাববৃত্তে এ যাবৎ শব্দটি প্রীতিকর বোধ জাগিয়েছে, রুচিসম্পাদন করেছে, প্রীতিজনন ঘটিয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতায় ধর্মোন্মাদনার নেপথ্যে শব্দটা বেশি খাপ খেলেও একসময় ধার্মিকতার নেপথ্যেও একে স্বীকার করত মানুষ! ইত্যাকার (ইতি)প্ররোচনা জগতে নিহিত ছিল বলেই মহামহোপাধ্যায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থনাকালে বিদ্যমান পুস্তকাদির কোনাকাঞ্চিতেও এই শব্দের কোনো নেতিবাচক প্রয়োগসূত্র খুঁজে পান নি। তিনি যা পেয়েছেন তার সবই ইতিবাচক। অথচ বিবর্তনের রেখা ধরে এখন শব্দটা নেতির গন্ধে কাবুপ্রায়।

সভ্য আইন প্ররোচনাকে অপরাধ সাব্যস্ত করে তার জন্য শাস্তিও বরাদ্দ করেছে। অবশ্য বলা বাহুল্য নয় যে, এ ক্ষেত্রে শাস্তি বরাদ্দ করে দণ্ডবিধির প্রবক্তাগণ ঠিক কাজটিই করেছেন। কারণ জগদ্বারে সম্প্রতি আমরা এমন সব প্ররোচনার সাক্ষাৎ পাচ্ছি, যা অন্যের ক্ষতিপ্রত্যাশী ও প্রাণবিনাশী, যা প্রভূত বিশৃঙ্খলার মদদ সরবরাহকারী।

আহমেদ স্বপন মাহমুদ (আসমা)-র ‘প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনাম’ গ্রন্থভুক্ত ‘প্ররোচনা’ কবিতাটি পড়তে গিয়ে শব্দটির এই প্রেক্ষাপট মনে পড়ল। তাই জন্য তাঁর এই কবিতাটি ঐতিহ্যিক ‘ইতি’ নাকি সাম্প্রতিক ‘নেতি’র কারবারে মগ্ন সেটা একটু খতিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। এই ক্ষুদ্র তত্ত্ব-তালাশি তারই স্মারক।

নিক্তি হিসেবে এখানে আমরা ভারতীয় দণ্ডবিধির সাহায্য নিতে পারি। এর পঞ্চম অধ্যায়ের ১০৭ থেকে ১২০ ধারা পর্যন্ত প্ররোচনা ব্যাপারটি ব্যাখ্যাত হয়েছে। দণ্ডবিধি মতে, তিনভাবে (নেতি)প্ররোচনা দেওয়া যেতে পারে— ১. কোনো কাজে উসকানি দিয়ে, ২. অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ও ৩. উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কিছু করায় সাহায্য করে।

দণ্ডবিধিতে প্ররোচনাদাতাকে সমাচ্চলিত অর্থেই প্ররোচক বা অ্যাবেটর বলা হয়েছে এবং তার জন্য শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ কোনো অপরাধ সংঘটনের নিমিত্তে কাউকে প্ররোচনা দিলে এবং সেই প্ররোচনার ফলে যদি কাজটি ঘটে তবে ওই কাজে প্ররোচনার জন্যে নির্দিষ্ট দণ্ড না-থাকলে মূল অপরাধটির জন্যে যে শাস্তি বা দণ্ডের বিধান আছে, প্ররোচকের ওপর তা-ই প্রযোজ্য হবে। বিরাট ব্যাপার! নয়?

কিন্তু প্ররোচনা দিয়ে কেউ যখন কাউকে পাঠক বানিয়ে তোলে, বিজ্ঞানচর্চার দিকে ঠেলে দেয়, কাঁধে কবিতার ভূত চাপায়— তখন কি তার জন্য আমরা শাস্তি প্রস্তাব করব? করব না। তবে এই না-করাকে জাস্টিফাই করতে আমাদের বিশেষ ভাষাকায়দা বা ভাষাতরিকার আশ্রয় নিতে হয়। তখন প্ররোচনাকে ‘প্ররোচনা’ না-বলে আমরা ‘প্রণোদনা’ বা মোটিভেশন বলি। পাশে দাঁড়িয়ে সাফাই গাই যে, প্রেরণাকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না। শব্দের এই হেন ব্যাপারস্যাপার শব্দার্থ-রাজনীতির নানা ঘোরপ্যাঁচের ইঙ্গিতবহ। একইরকম পোশাকের এই শব্দ দুটোর মুখাকৃতি প্রায় অবিকল; ওজন এবং মাত্রায়ও উভয়ে সমান। কিন্তু তবু, শব্দ দুটো সামাজিক মর্যাদায় ভীষণভাবে আলাদা। বিভিন্ন ভাষায় এরকম জোড়া জোড়া অবিকল আরো শব্দের খোঁজ নিশ্চয়ই আমাদের প্রায় সবারই জানা আছে।

এখানে প্ররোচনা ও প্রণোদনাকর্মের দুয়েকটা উদাহরণ দেবার চেষ্টা করা যায় : ধরা যাক ক কোনো এক কিশোরীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করল এবং তার সঙ্গলাভের অনুকূলে নানা প্রতিশ্রুতি দিলো। একসময় সঙ্গলাভ নিশ্চিতও হলো। কিছুদিন পর বিশ্বাসঘাতকতা করে মনোকষ্ট দেওয়ায় কিশোরী নিজগৃহে আত্মহত্যা করল। এ ধরনের আত্মহত্যা বাংলাদেশে প্ররোচিত আত্মহত্যা হিসেবে স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে ক প্ররোচনার অপরাধে অপরাধী। কিন্তু ক যদি ওই কিশোরীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তাকে কবিতাচর্চায় আগ্রহী করে তুলত এবং ঘটনাক্রমে সে ভালো একজন কবি হয়ে উঠত, তাহলে ক তাকে প্রণোদিত করায় প্রশংসিত হতে পারত। আবার কিশোরীকে দাবাখেলায় আগ্রহী করে তোলায় সে যদি একসময় দাবায় জাতীয় পুরস্কার লাভ করত, তাহলে প্রণোদনার পুরস্কারটা ক-এরই হতো। কিন্তু ধর্মের অপব্যাখ্যায় প্রলুব্ধ বা ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত করে ওকে আত্মঘাতী হবার দিকে ঠেলে দিলে প্ররোচনার অভিযোগ থেকে ক-কে কেউই রেহাই দিত না।
   
‘প্ররোচনা’ কবিতাটি যদি আমাকে নানা দুর্ভাবনার দিকে ঠেলে দিয়ে অসুস্থ করে তুলত, তাহলে এর লেখক আসমাকে অভিযুক্ত করে বিচার দাবি করতে পারতাম আমরা। কিন্তু তা না-করে এটি আমাকে নামশব্দের মুখের দিকে তাকিয়ে একটি নিবন্ধ রচনার দিকে ঠেলে দিয়ে প্রশংসা অর্জন করেছে। এটি এই কবিতাটির একটি গুণ। মানে বৈষয়িক অর্থেও ‘প্ররোচনা’ একটি ভালো কবিতা। কারণ এর ইতিবাচক প্রভাবসঞ্চারী ভূমিকা রয়েছে।

দেখা যায়, এ কবিতায় প্ররোচক দুজন। একজন ‘সে’, অন্যজন ‘তুমি’। ‘সে’র মুখ অন্যদের থেকে এতই আলাদা যে, আসমা তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। মানুষের মুখাকৃতির বৈচিত্র্য বিষয়ে দার্শনিকতায় মেতে ওঠেন। এই দুর্বলতা কামের দিকে কাত হয়ে আছড়ে পড়ে। ওই আছড়ানো দুর্বলতা একজন ওষ্ঠবিজ্ঞানী হয়ে উঠতে চায়। তার ল্যাবরেটরিতে চালাতে চায় চুমুর পরীক্ষা। কিন্তু জগৎ কারো সব ইচ্ছেকে ইতিবাচক পরিণতিতে পৌঁছুতে দেয় না। ফলে লোহা যেমন গনগনে আগুনের আঁচে ক্রমে লাল হয়ে ওঠে, তেমনি লিবিডোর দাহে কল্পিত চুমুটিও ক্রমে রক্তিম রং ছড়িয়ে ঝুলে থাকে ওষ্ঠের কার্নিশে। পাশাপাশি এনজাইম বা উৎসচেকরূপী লালা নিঃসৃত হয় কল্পিত চুমুটিতে নিহিত আনন্দবোধের আঙুল ছুঁয়ে।

না, এ যাত্রায় আসমার কোনো সাফল্য আসে না, ছায়া হয়ে থাকা ছাড়া। অথচ তাঁর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার সামনে দিয়ে ‘তুমি’ হেঁটে যায়, যে একইসঙ্গে ‘লোভ’, ‘কাম’ ও ‘স্বপ্ন’-এর প্রতীক মানে মোহের ট্রিলজি হয়ে ওঠে। ‘তুমি’ও প্ররোচিত করে ‘সে’র মতো ওষ্ঠচুম্বনে, তা সে লিপস বা লেবিয়া যেখানেই হোক।
 
দেখা যাচ্ছে, আসমার ‘প্ররোচনা’ কবিতার ‘সে’ এবং ‘তুমি’র কেউই প্ররোচনার অপরাধে অপরাধী নয়। কবিতাভাষ্যে উভয়েই প্ররোচনা করলেও তা পরিণতি লাভ করেছে একটি কবিতা রচনার প্রেরণাসঞ্চারী হিসেবে, যা বস্তুতপক্ষে উচ্চ মর্যাদার প্রণোদনা। অর্থাৎ, দুয়ের কেউই অ্যাবেটর নয়, বরং মোটিভেটর বা অ্যানকারেজার।

এই লেখাটি কাজেই এভাবে উপসংহৃত হতে পারে যে, প্ররোচকরূপী দুজন প্রণোদকসম্বলিত আসমার ‘প্ররোচনা’ কবিতাটি ইতিবাচক কাজে উসকানি দেয়, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করে না এবং নেতিবাচক কোনো কিছু করায় সাহায্য করে না। এর মানে হলো ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী এ কবিতাটি লেখার জন্য আসমার জন্য কোনো শাস্তি বরাদ্দ করা যায় না। দণ্ডবিধিতে ভালো কাজে প্রণোদনার জন্য কোনো পুরস্কার নির্দিষ্ট নেই বলে আমরা এখানে তাঁকে যৌবনিক অভিনন্দন জানিয়ে পুরস্কৃত করতে পারি।

পারি তো, নাকি?

নভেম্বর ২০১৭

মেঘে বাড়ি আহোনির ভূমিলগ্ন ডেরা

আকমল হোসেন নিপু (আহোনি)-র ১৯৯৮-এ প্রকাশিত প্রথম প্রকাশনাটি ছিল একটি গল্পগ্রন্থ। এর পাঁচ বছর ছাড়িয়ে আরেকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশেরও পরের বছর ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি’। এর পরে আরো দুটি গল্পগ্রন্থ ও দুটি উপন্যাসগ্রন্থ প্রকাশের পর ২০১৬-এ একটি উপন্যাস ও একটি গল্পগ্রন্থসহ যুগপৎ প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখের কোন প্রতিবেশি নেই’। ২০১৭-এ প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ প্রকাশনাটিও একটি গল্পগ্রন্থ। দেখা যাচ্ছে, প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের সময় থেকে ২০১৭ পর্যন্ত উনিশ বছরে তাঁর গল্পগ্রন্থ সংখ্যা ৬, উপন্যাস ৩ ও কাব্যগ্রন্থ ২। অর্থাৎ, প্রকাশনার সংখ্যাবিচারে তাঁর কথাসাহিত্য ও কবিতাগ্রন্থের অনুপাত ৯:২; যে বহরে কথাসাহিত্যের পাল্লা চতুর্গুণাধিক ভারী।

এতদসূত্রে আমরা কি এই অনুমানে দাঁড়াতে পারি যে, আহোনির ঘর-গেরস্থালি কথাসাহিত্যের সাথে যতটা, কবিতার সাথে ততটা নয়? না বোধহয়। একটিমাত্র সংখ্যাবাচক তথ্য এ ধরনের বিবৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়। কেবলই কবিতা লিখেন এবং জীবনে কখনোই কথাসাহিত্যের চর্চা করেন নি এমন কবিও জগতে রয়েছেন যাঁদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে দ্বিতীয়টি প্রকাশের ফারাক ১২ বছরের চাইতেও বেশি। এমনকি পৃথিবীতে এমন কবিও ছিলেন, জীবনে যাঁদের সবেধন একটিই মাত্র কাব্যগ্রন্থ। তো?

আহোনির প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে অভিমত জানাতে বসে দুই অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত ১৬৫ শব্দে এই যে মুখবন্ধটি আমি লিখে উঠলাম, এ দিয়ে এমন এক নিরর্থক মানচিত্র অঙ্কিত হলো, যার কোথাও কোনো সদর্থক অর্জন নেই। অবশ্য আলোচ্য লেখকের সৃজনঝোঁক ও লেখনপ্রবণতা বিষয়ে এই টেক্সট কিছুটা ধারণা উৎপাদন করলেও করতে পারে, যার ভালোমন্দ আমার পরবর্তী কথাবার্তার মেরিটের ওপরে খানিকটা নির্ভর করবে বলে মনে করা যায়।

পাঠকমহলে আহোনির কথাসাহিত্যিক পরিচয়টি স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। ওই পরিসরে তাঁর কিছু সামাজিক স্বীকৃতিও জুটেছে। কাজেই তাঁর পক্ষে ওই সফলতার রেখা ধরে সামনে এগোনোই মানবস্বভাবানুকূল আচরণ। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে এ যাবৎ বাংলা-কবিতার যত সংকলন হয়েছে, অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিকদের হাতে আশি ও নব্বইয়ের দশকের কবিদের তথাকথিত যত তালিকা প্রণীত হয়েছে, কোথাওই প্রায় তাঁর অন্তর্ভুক্তি নেই। হ্যাঁ, লেখক কেবলই স্বীকৃতির জন্যে লিখেন না; তবে স্বীকৃতিহীনতার ভিত্তিমূলকে পরিসরে আরো বাড়তেও দিতে চান না। পারলে বরং ইতিহাসের হাতে একটা বার্তামাত্র রেখে তা আড়াল করেন। কিন্তু আমরা দেখি যে, তিনি তা বাড়তে দিয়েছেন। ১২ বছর ধরে একে একে জমা করেছেন প্রতিবেশীহীন দুঃখমালা, যার খোঁজখবর নেবার আমরা কমই প্রয়োজন বোধ করেছি।
 
আমাদের কীর্তিমান কথাসাহিত্যিকদের অনেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। পরে তাঁরা কবিতাকে পাশে রেখে অন্যদিকে মনোযোগী হয়েছেন। এক্ষেত্রে আমরা নাম করতে পারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিম আল দীনসহ অনেকের। সংগত কারণে আমরা তাঁদের গল্প-উপন্যাস, কথানাট্য, প্রবন্ধ, প্রভৃতির প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখাই; দুর্বিষহ বেদনার মতো যার এক প্রান্তে পড়ে থাকে তাঁদের কবিতারা। এই বাস্তবতার কথা মনে রেখেও আহোনির কবিতার দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে হয়। কেননা তিনি কথাসাহিত্যের বিপুল-বিস্তৃত প্রান্তর পরিভ্রমণ করবার সময়ও নদীর দিকে, ধানগাছের দিকে সুরাচ্ছন্ন মগ্নতা নিয়ে তাকান এবং ছন্দে-লয়ে সেই মগ্নতাকে এঁকে যাবার প্রয়াস পান।

যা কোনোকিছুই দিচ্ছে না, মানে যার সঙ্গে কোনো বিনিময়ের সম্পর্ক নেই, তার প্রতি দীর্ঘকালীন টান ও আসক্তি অতি অবশ্যই প্রেমনামধেয় বলে কীর্তিত হতে পারে। এই প্রেমই সেই অবস্তুধন, যার দিকে আমরা সমীহ নিয়ে তাকাই, তার গূঢ়ৈষা খুঁজে দেখি। দেখা দরকার বলে মনে হয়। আহোনির মধ্যে কবিতার প্রতি সেই প্রেম সদা জাগ্রত আছে।
বলা দরকার যে, ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি’তে, মানে আহোনির মেঘবাড়িতে বেড়াতে গেলে ভালো লাগে। বাড়িটা নদী-তীরবর্তী আর চাষবাসে সরগরম। ফলে এই মেঘবাড়ির যা কিছু গতিপ্রকৃতি তা নির্ধারিত হয় এ দুয়ের অবাক সম্মিলনে। তাতে তাঁকে মনে হয় কৃষিসমাজের আত্মীয় ও নদীসখা বলে।

নদীলগ্ন অনুভূতি এখানে এত বিচিত্রভাবে হাজির হয়েছে যে ভিজে যেতে হয়। কিন্তু বলে রাখা ভালো যে, পাঠককে খেলাচ্ছলে নিছক ভিজে ওঠার সুখ দেওয়া তাঁর কবিতাকর্মের অভীষ্ট নয়। মানে নদীকে তিনি তার নিখুঁত ফটোগ্রাফিক সৌন্দর্য বর্ণনার উপকরণ হিসেবে বেছে নেন নি এখানে, মূল্য দিয়েছেন কৃষিসহায়ক হিসেবে। ফলে এখানকার এ ভিজে যাওয়া ও শুকিয়ে ওঠার সিংহভাগই শ্রমলগ্ন, চাষগন্ধী ও ঘামবহুল। ‘আমি তো পাহাড় নদীর কাছে/ এখনো দাঁড়াই’ (গন্তব্য), ‘এরকম অনেক বছর তন্বী নদীর কাছে/ হলুদ শস্যক্ষেত পড়ে থাকে’ ((নির্জন বাঁশি) বা ‘শীর্ণ নদীকূলে/ চাষীকন্যা মেলে ধরে রুপালী দুপুর/ দূরে দূরে শঙ্খ সাদা মেঘ’ (কৃষিকথা-৪) ধরনের অজস্র পঙক্তিতে নদী ও কৃষিসমাজের ইমেজ মূর্তিত এই বইয়ের গন্ধ মাটির গন্ধের সহোদর। অতএব তা খুঁতযুক্ত এবং বেদনাপ্লাবী নন-ফটোশপিক চক্ষু, হস্ত ও মস্তিষ্কনির্মিত শিল্পবস্তুর আধার।

আহোনির মেঘবাড়ির কবিতায় যে সুর ধ্বনিত তা পয়ারের দোলা দিলেও আগাগোড়া পয়ারনিষ্ঠ নয়। চালটা তার প্রায়শই মুক্তক অক্ষরবৃত্তের। সুরের মধ্যে থেকে থেকে প্রায়ই অসুরের গহন ইশারায় তাল কেটে দেওয়া হয়েছে তাঁর কবিতা থেকে কবিতায়। তাতে পাঠস্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়। দৃষ্টান্তসহ একটি প্রশ্ন হাজির না করে শেষ করা যাচ্ছে না এই আলাপ : যেমন, ‘সূর্যঘুম’ কবিতার ‘দুহাতে রাখিনি কিছু সবকিছু আকাশে মেলেছি/ হাওয়া অনুকূলে, তাই ভেসে গেছে পালকের সুখ/ নদীর নিঃশ্বাস; কী করে বর্ণনা করি’ যে আমেজ দিলো, চতুর্থ লাইনে এসে ‘বরফকাল, উচ্চারণ করা মাত্র তা ভেঙে গুঁড়িয়ে মিশে গেল চকচক করা এক গদ্যস্রোতে। কেন এমন করেন তিনি? ছন্দ-সুরের ঐতিহ্যকে আঘাত দিয়ে প্রথাশাসনের প্রতি কোনো অনাস্থাকে জানান দিতে? বক্তব্যের দাবিকে ছন্দের দাবির চাইতে গুরুতর বলে হাজির করতে? হতে পারে। তবে এ বইয়ে গ্রথিত তাঁর বক্তব্যবিষয় ও কাঠামোয় প্রথাশাসন ভাঙার কোনো প্রবণতা কোনোভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে নি।

কিছু ক্ষেত্রে ‘রাজনীতিবিদ নদী নিয়ে বাণিজ্য করে’, ‘নদী তবে পৌঁছুবে কোথায় চারদিকে বণিকের হাত!’, ‘নারীর/ কোমল বাহু এই ফাঁকে পণ্য হয়ে যায়।’ ধরনের তিক্ত সত্য তিনি উচ্চারণ করেছেন তাঁর এই বইয়ের কবিতায়। শোনা গেছে ‘কেবল প্রার্থনা, মানুষের শত্রু লোপ পাক’ ধরনের চিদাকাঙ্ক্ষাও। এসব তাঁর সাহিত্যপ্রবণতার সঙ্গে খুব যায়। শুভলগ্নের অন্বেষায় ফেরা আহোনির এই যেন প্রকৃত নীড়।
 
আহোনির কবিতাগুলোর সূচনা প্রায়ই চোখ ঝলসানো, কানপাগল করা ও চিত্তচমকানো : ‘ছিলাম সাগর জলে তুমি এনে তুলেছ ডাঙায়’ (জানি না উড়াল মেঘ); ‘রাত্রিই মুগ্ধ করে বেশি, একে একে খুলে ফেলি/ আগুনের খোসা’ (বাতাসনির্ভরতা); ‘আনন্দে লাফাও কন্যা দুধভরা মাটির কলস’ (হরিণচর্চা); ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি জানা হলো বহুদিন পর/ চৈত্রবৃষ্টিতে’ (শস্যসংকেত); ‘রেখেছ মূর্খ করে রণকৌশল কখনো বুঝি না (ঘুঘু চড়ে খায়); ‘কষ্টের দোতরা তুমি নিমকাঠে গড়া’ (নিমকাঠে গড়া); ‘নীরবে দাঁড়াতে দেখে ভেবেছ পাথর—’ (তোমাদের শস্যময় মুহূর্ত); ‘তোমাকে ছুঁয়েছি বলে এই হাত বাঁশি হয়ে গেছে—’ (বাঁশিতত্ত্ব)। এই হেন ঔজ্জ্বল্যের ছন্দ-সুরই প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ হয়ত এসবের নির্ভার মানেযুক্ত যোগাযোগসক্ষমতা। তবে সূচনাপঙক্তি -পরবর্তী হাঁটাহাঁটিতে প্রায়ই দূরত্ব তৈরি হতে দেখা গেলেও সেসব পদক্ষেপকে কখনোই অনাত্মীয় মনে হয় না। পরবর্তী চলনে তিনি সূচনামূলের টান ভুলে যান না। মূলে তাকাতে অনাগ্রহী অনেকেই যেখানে জারজ পঙক্তি দিয়ে কবিতার শরীর ভরে তুলতে তুলতে আজকাল উচ্ছন্নের দিকে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন, তিনি সেখানে বরাবরই মূলনিষ্ঠ, শেকড়বান্ধব।

শব্দ-বাক্যের মধ্যস্থতায় এ বইয়ে গড়ে উঠেছে যে শস্যগন্ধা নদীসমবায়, তার নাম ধরে ডাকের মধ্যে নদীমাতৃক এ বদ্বীপকে ভালোবেসে যাবার নিবিড় মন্ত্র শিখে ওঠবার আশকারা আছে। ফলে কথাসাহিত্য ও কবিতার মধ্যে কাকে তিনি বুক দেন আর কাকে পিঠ সে প্রশ্ন এইখানে এসে আলগোছে গৌণ হয়ে যায়। শরীরের আয়তন দেখে মানুষের মহত্ব মাপবার ঝোঁক আমাদের মধ্যে তৈরি না হওয়াই স্বাস্থ্যকর।
 
আহোনি যে ধারার কাব্যচাষ করেন তাতে মগ্নতা লাগে। শব্দসাধনকালে তার মধ্যে সেই মগ্নতা অতি অবশ্যই জাগে। প্রয়োজনমতো টুকরাটাকরা হয়ে হলেও সেটা পড়েও তার সব কবিতার ভাগে। মর্জি হলে আমরা পাঠকরা তাতে ভিজতে পারি, শুকাতে পারি। পারি তার শরীরের সাথে শরীর লাগিয়ে মিশে থাকতে। চেনা গন্ধের আবেশে তাতে আরাম লাগে। আত্মীয়সংঘে আছি বলে মনে হয়।

তাঁর কবিতার সাথে এই মিশে থাকা আমাদের, দীর্ঘায়িত হোক।

সেপ্টেম্বর ২০১৭

শামীম পারভেজ, বর্ষাস্বপ্নে কাটলো যাহার চৈত্রপোড়াদিন

সেলফোনে প্রথম যখন ভয়াবহ অসুস্থ শামীম পারভেজকে ঢাকার মহাখালীস্থ মেট্রোপলিটন মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করবার খবর পাই, তখন জুনজনিত ব্যস্ততায় ডুবতে ডুবতে শ্রমসাধ্য একটি অ্যাসাইনমেন্ট শেষে তীরে দাঁড়িয়ে কাকতালীয়ভাবে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ক্লিক করে অদূর অতীতে জাপানে সংঘটিত প্রলয়ংকরী সুনামির একটি বিরল ভিডিও ক্লিপ দেখছিলাম। একটা সচল জনপদের সপ্রাণ-নিষ্প্রাণ সমস্ত কিছুকে ক্ষুধার্ত ও রাগী সমুদ্রের মুহূর্তে গ্রাস করে নেবার ভয়াবহতা এবং মানুষের অসহায়তার এমন অবিশ্বাস্য ও করুণ চিত্র আর হয় না। ঘটনার ভয়াবহতায় কেবলই কাঁটা দিয়ে উঠছিল আমার মাঝবয়েসি গা। এমন অবস্থায় ফোনবাহিত হয়ে এল আরেক সুনামির সংবাদ। ক্লিপটিতে চোখ রেখে ঘটনার বিবরণ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল প্রাণান্ত দৌড়েও যে লোকটি রাগী জলের থাবা থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারল না ওই লোকটিই হয়ত শামীম, আর অপেক্ষাকৃত শক্ত ভিতের উপরে নির্মিত তেতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে যে লোকটি মনে করছে যে এ যাত্রায় বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছি অথচ খানিক পরে বাড়ি ধ্বসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে নিজেও জলের পাকে নিখোঁজ হয়ে যাবে সে লোকটি বোধহয় আমি!

ফোন রাখতে না রাখতে আরেকজনের কল পাই, সেও বয়ে আনে ওই একই সংবাদ। বিকেল নাগাদ আরো একজন। কিন্তু না, আটঘণ্টা শ্রম বেচা শেষেও সংসারজনিত ব্যস্ততা বাধ সেধে দাঁড়ালে ওইদিনই আমার মহাখালী যাওয়া সম্ভব হয় নি; দীর্ঘ অদেখার কারণে টানে যদিও ঘাটতি ছিল না কোথাও।

জানা গেল, শামীমের স্ত্রী ক্লিনিকে ওর সঙ্গে আছে। ফোন নম্বরও পাওয়া গেল তাঁর। দেখতে যেতে হলে তাঁর কাছ থেকে ডিটেল জেনে নেয়া দরকার হবে। ভাবলাম, যদিও আজ যেতে পারব না তবু একটা ফোন করে ওর সংবাদটা অন্তত নেয়া যাক। কিন্তু নানারকম ভাবনা হলো। ফোন করে কী শুনতে কী শুনব কে জানে। সইতে পারব তো! তা ছাড়া, ভদ্রমহিলার সঙ্গে আগে কখনো আমার দেখা-কথাও হয় নি। এসব মিলিয়ে প্রয়োজনীয় মনোবল সঞ্চয় করে উঠতে পারলাম না। পারতে পারতে এক দিন দুই রাত গত। পরদিন ফোন করে যা বুঝতে পারলাম তাতে মনে হলো ভদ্রমহিলা শামীমকে সুনামির রাগী জলের তোড়ে হারিয়ে যেতে দিতে শারীরিক-মানসিকভাবে একেবারেই প্রস্তুত নন। ওকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি অন্যান্যের সহায়তায়, যদিও আশঙ্কা পুরোপুরি ছাড়ছে না তাঁকে। কারণ চিকিৎসকরা তেমন আশ্বাসবাণী শোনাতে পারছেন না। যাই হোক, তারও পরদিন সন্ধ্যায় মহাখালী যেতে পারলাম, কিন্তু মানসিকভাবে বলীয়ান মিসেস শামীমকে ওখানে পাওয়া গেল না যে তাঁকে একটা ধন্যবাদ দেবো। অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে আছেন তাঁর ছোটভাই, শামীমের শ্যালক।

সকল ভালো হাসপাতালের মতো ওখানেও প্যাসেন্ট ভিজিট করবার নির্দিষ্ট সময় আছে, আমি যার অনেক আগেই ক্লিনিকে পৌঁছেছি। ফলত অপেক্ষা করতে হলো। শামীমের শ্যালক রিসেপশনে সঙ্গ দিলেন আমায়। এটা-ওটা কথা হচ্ছিল ওর সম্পর্কে। কথার সারাংশ শামীমের নিজের শরীরের প্রতি নানা অনিয়ম-অত্যাচারের বর্ণনায় ভরা। শেষ দিকে চাকুরি-বাকুরি ছেড়ে কিছুটা থিতু হয়েছিল সে, অনিয়মটাও খানিকটা কমিয়ে এনেছিল। কিন্তু ততদিনে ভেতরে স্থায়ী কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। চোরা অসুস্থতা রীতিমতো গেড়ে বসেছে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে সন্ধ্যা সাতটায় মাস্ক ও ইউনিফর্ম পরে এইচডিইউ তথা হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে গিয়ে দেখলাম চার হাত-পা ছড়িয়ে শামীম ঘুমিয়ে আছে। বেশ কিছুদিন শেভ করা নেই। ক্লান্ত বিমর্ষ অভিব্যক্তি। নাকে ও নিম্নাঙ্গে বিবিধ নল। দূর থেকেও শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। জাগিয়ে কথা বলা নিরাপদ নয়। ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। বেড ঘেঁষে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে স্মৃতিতে থাকা ওর প্রাণোচ্ছল মুখটাকে ওই মুখের সাথে মিলিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না আমার।

জিজ্ঞাসার জবাবে নিচুস্বরে নার্স জানালেন, হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠেই উনি সিগারেট খেতে চাচ্ছেন। এই বিবরণে আমার নিজের মুখও যেন ভেসে উঠল, যার কাছে সিগারেটই প্রধান স্বজন! সিগারেট শামীমকে খাচ্ছে, খাবে আমাকেও, মনে হলো। হায়, প্রাণসংহারক সিগারেট!

২.
শামীমকে আমরা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ময়মনসিংহে পেয়েছিলাম, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়কার সঙ্গী হিসেবে। বীক্ষণে ও বীক্ষণের বাইরের অন্যান্য সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতায় অনেক সময় একত্রে পার করেছি আমরা। শরীরের উপরে অত্যাচার তার তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনিয়ম-অত্যাচার আমরা সমন্বিতভাবেও করেছি অনেক সময়। কিন্তু ওর সুঠাম শরীরে ওসব কোনো প্রভাব ফেলতে পারে তেমনটা মনে হয় নি তখন। পেশাগত প্রয়োজনে পরে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ বিচ্ছেদের রাত্রি নেমে আসে। শামীম চলে যায় সিএইচটির কোনো জেলায়, রোকন উত্তরবঙ্গে, জুয়েল শেরপুরে, আশিক ও আমি ঢাকায়; মাসুম অবশ্য ময়মনসিংহেই থেকে যায়। এই বিচ্ছেদের কোনো নিরাময় ছিল না। বছর দশেক কাল মাঝেমধ্যে কোনো একটা লিরিকের চার/পাঁচ লাইন টেক্সট মেসেজ আকারে আমাকে পাঠাত শামীম। এগুলো হতো প্রায়শই রাত দুটোয় বা তারও পরে। সেটাই ছিল ওর লিরিক প্রস্তুতকাল। কখনো ওগুলো পড়ে ব্যাক করেছি, কখনো করতে পারি নি বা বিরক্ত হয়েছি। ব্যাক করলে কথা হতো গান লেখা নিয়ে। শামীম তখন চার হাতে গান লিখছে। কাউকে কাউকে দিয়ে ওসব লিরিক গায়নের উদ্যোগ নেবার কথাও জানাত সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব পরিকল্পনার কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে তার কিছুই জানি না।

না, ওর কোনো কবিতা দীর্ঘ দীর্ঘ দিন কোথাও পড়া হয় নি আমার। শেষ সময় সে ময়মনসিংহেই স্থায়ী নিবাস গড়েছিল। ওখানকার সাহিত্যাঙ্গনে সেসময় ওর নৈমিত্তিক উপস্থিতি ছিল বলে শুনেছি, ছবি দেখেছি। কিন্তু এই পর্যায়েও ওর সঙ্গে মোলাকাতের সুযোগ তৈরি হয় নি আমার। এর মধ্যে দু’-চারবার বিভিন্ন কাজে ময়মনসিংহে গেলেও দুর্ভাগ্যক্রমে শামীমের সাথে দেখা হয় নি। ওর সম্পর্কে দীর্ঘ এই অদেখাই আমার সঞ্চয় হিসেবে রয়ে গেল মাত্র।

শামীমের মৃত্যুর পরে ইমেইলে ওর একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি পাই শাহীন লতিফের মাধ্যম। নাম নেই। খুব সময় নিয়ে নিষ্ঠার সাথে পড়তে না পারলেও শ্রদ্ধার সাথে ওর ভেতর দিয়ে গেছি আমি। ওখানে পাতায় পাতায় শামীমের মুখ লুকানো। তবে কবিতাগুলোতে দীর্ঘ অচর্চার ছাপও স্পষ্ট, যার আরো সম্পাদনা দরকার। চোখ আটকে যাওয়া অনেক জায়গা আছে লেখাগুলোয়। ‘ছুটি চাহিয়া’ নামক একটি কবিতায় শামীম বলছে : ‘কফিন সময় কাছে ডাকে বড় বেশী ক্ষমাহীনতায়।/ শেফালী ফুলেরা নিয়েছে ছুটি সেই কোন ভোরে। ছুটি মঞ্জুর কর তবে অন্দরবাসিনী...।’ হ্যাঁ, ওর ছুটি শেষ পর্যন্ত মঞ্জুর হয়েছে। ছুটির এ সময়টা শামীম কীভাবে কাটাবে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কোনো মানে নেই এ কথা বলার, তবু বলা যাক যে, ওর ওখানকার চৈত্রপোড়াদিনগুলোও ‘বর্ষাস্বপ্ন’-এ ভরে উঠুক।

অক্টোবর ২০১৫

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...