Friday, July 3, 2020

মোস্তাক আহমাদ দীনের ‘বিষ’বিদ্যার পরিসর

এত বিষ দেহকাণ্ডে, দেহে
আজ আমি সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
সকলেই একথা বোঝে আমি কভু ডুবি নাই জহরের জলে
দেহকাণ্ডে তবু এত বিষ, ভাবি তাই
প্রাণের মধ্যে কোন সর্প ঢুকে গেছে ঘুমে? 
এ সন্দেহ-মুক্ত হতে বংশকাহিনি যারা পাঠ করে গেল
তারা দেখে, পিতা বা প্রপিতামহ আলস্য করেনি কেউ
                                               মনসাপূজায়
তবে আমি অভিশপ্ত কাহার সন্তান?
দেহকাণ্ডে যত বিষ, তার মর্মে নীল হয়ে যাবে বলে
সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
অথচ দূরবর্তী বন্ধুও বোঝে
গোপন ইচ্ছের জোরে সংলগ্নজনের মনে
                             কত বেশি মগ্ন হতে চাই
(বিষ, মোস্তাক আহমাদ দীন)
অর্থের প্রতি মনোযোগ না-দিয়ে মোস্তাক আহমাদ দীন (মোআদী)-র প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’ভুক্ত ‘বিষ’ কবিতাটি বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার শব্দ করে ও না-করে পড়ে দেখেছি। প্রতিবারই ওর প্রসারিত আলো-ছায়ায় মগ্ন হওয়া গেছে। বিহারের নিমিত্তে পর্যাপ্ত পরিসর আছে বলে এবারও তা হওয়া গেল; অর্থাৎ, ভালো লাগল। প্রকৃতপক্ষে কী এমন ভালো লাগল এর? সুর? অবশ্যই সুর, দোলা। আবার অর্থের চোখে চোখ রেখে যখন পড়া গেল কবিতাটি, কমসেকম তিনরকম ঢেউ এসে লাগল মনে, তিন স্তরের। অন্য কেউ হয়ত অন্যভাবে তাকিয়ে আরো অন্য কোনো রঙের সামনে গিয়ে পড়বেন কবিতাটির। এই ঐশ্বর্যের কারণেই কবিতাটিকে বিশেষভাবে সম্পন্ন বোধ হলো। মনে  হলো, কবিতার মতো দেখতে এ লেখাটি আসলে একটি কবিতাই।

অর্থে ডুবে এর তিনরকম যে ঢেউয়ের মুখে আমি পড়েছি, সেটা দেখাতে গিয়ে অত্যাশ্চর্য কোনো স্থাপনার ইট খুলে খুলে তার উপাদানের মান যাচাইয়ের মতো বিধ্বংসী কিছু করতে আমি আগ্রহী নই। কিন্তু লেখাটি যে প্রসারিত অর্থ ধারণ করেছে, তার খোঁজ পেতে হলে একভাবে তো এর অন্দরে তাকানো লাগেই। আলতোভাবে সে চেষ্টাটিই আমি এখানে একবার করে দেখতে চাইছি।

প্রথম ঢেউ

শুরুতেই মোআদীর ‘বিষ’ কবিতাটির যে ঢেউ আঁচ করা যায়, তাতে শরীরের শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়া কথিত বিষকে ক্রোধরূপ একটা তিতা বস্তু হিসেবে অনুমান করতে ইচ্ছে করে, যেখানে সংলগ্নজন হলো নিজেরই অন্য আরেক সত্তা, যে কিনা বিশুদ্ধ, যে কিনা নির্বিরোধী একটা যাপনের পক্ষে অধোবদন। তাকে দূরে যেতে বলা সেক্ষেত্রে সাময়িক এক অবিশুদ্ধ সত্তার সংস্পর্শ থেকে বিশুদ্ধ সত্তাকে রক্ষাপ্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।

বৈষয়িকতার পঙ্কে না-নেমেও এই ক্রোধের অভিষেক হবার নেপথ্যে কী এমন ব্যাপার কাজ করছে? সে কি অজ্ঞাতে ভেতরপ্রাসাদে জন্মানো জলশূন্যতায় ভোগা কোনো মোহের উদ্ভিদ? হবেও-বা।

বংশের পরম্পরা ধরে খোঁজ নিলে দেখা যায়, বিষয়বাসনা থেকে দূরে থাকবার সাধনায় মোআদীর পূর্বমানবের কারো সময়েই কোথাও কোনো অবহেলা ছিল না। সেই ঐতিহ্যচ্যুত হয়ে বিশুদ্ধ সত্তার সংক্রমিত হয়ে পড়বার সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে এক সংগত শঙ্কা থেকে বিচ্ছেদ ভাবকে নিজের করে নিয়েছে মোআদীর ক্রোধকলূষে অবিশুদ্ধ হয়ে পড়া সত্তা।

কিন্তু কে না জানে, সবটুকু ভালোবাসা তার সজ্ঞানে দূরে ঠেলে দেওয়া ওই বিশুদ্ধ সত্তার প্রতিই।

দ্বিতীয় ঢেউ

প্রথম ঢেউটি ছলকাতে থাকতেই উছলে ওঠে অন্য আরেক ঢেউ। ওদিকে তাকাতেই প্রায় শিহরিত হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় কৈশোরোত্তরকালে যৌবনের ঠিক দরজায় দাঁড়ানো বয়সের গোপন বিড়ম্বনার কাছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এত এত বছর পেছনে পৌঁছে দেবার সক্ষমতার জন্য কবিতাটির কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে বসে থাকতে হয়।

মনে হতে থাকে যে, যুক্তিপরম্পরায় আত্মীয়সূত্রে বেড়ে ওঠা শব্দক্রমধারা ‘সর্প’, ‘বিষ (জহর)’, ‘নীল’, ‘মনসাপূজা’ই কবিতাটির চাবিশব্দগুচ্ছ। তবে অবশ্যই ‘দেহকাণ্ড’, ‘সংলগ্নজন’, ‘গোপন ইচ্ছে’— এই তিনটি শব্দবন্ধের শাসনকে মেনে নিয়েই এগোতে হয় কবিতাটির মন জয়ের দিকে।

মনে হয়, নবযৌবনপ্রাপ্ত মোআদীর সদ্যউৎপাদিত স্পার্ম বা বীর্যই এখানে বিষ, সর্প যেখানে লিবিডো বা যৌনতাড়না। এই সূত্র বিবেচনায় নিলে মনসাপূজা অবশ্যই বিয়ে ও সংসার; আর নীল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তখন বীর্যপাতন শেষে গর্ভসঞ্চারজনিত অবস্থার উদ্বেগ।

দূরবর্তীজন হয়েও বুঝতে পারা যায় যে, এখানে সংলগ্নজন মানে সম্ভাব্য যৌনসঙ্গী বা প্রেমিকা। উপচে ওঠা বীর্যের তাড়নাবশে জৈবদেহে স্খলনের যে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত, বয়সজনিত অপরিপক্কতা ও নৈতিকতার চাপেই মূলত তার সংস্পর্শ এড়ানোর এই প্রয়াস।

বলা বাহুল্য নয় যে, এ যাত্রায় সামাজিক অর্থে বৈধ পথ বিয়ে করে সংসারান্দরে প্রবেশ করা। পুরুষপরম্পরায় মোআদীর পরিবারে এ প্রথাই চর্চিত। কিন্তু নবযৌবন সে ধৈর্যধ্যানের পথ থেকে চ্যুত হয়ে বিবাহপূর্ব আকস্মিকতায় বীর্যপাতনের সম্ভাবনার মুখে পড়ে গর্ভসঞ্চারের ভয়ে আঁতকে ওঠে। অথচ কামেচ্ছাসম্মত বয়সে জৈবদেহ ভেতরে ভেতরে যৌনসঙ্গী তথা প্রেমিকার প্রতিই সতত নিমগ্ন।

তৃতীয় ঢেউ

সামাজিক সংস্কারবশত লজ্জা-সংকোচ থেকে দ্বিতীয় ঢেউটি থেকেও যদি চোখ সরিয়ে ফেলানো যায়, তো সাক্ষাৎ মেলে অন্য আরেক ঢেউয়ের। এবারে মনে হয়, এখানে বিষ আসলে ভাব। যেহেতু প্রাণের মধ্যে সর্প তথা বিষবিষয়-বাসনা বা কর্মপ্রেরণা ঢুকে গেছে, কাজেই সৃজনপ্রয়োজনে একাকিত্বের প্রত্যাশা এখানে অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে। যে কারণে সংলগ্নে থাকা কর্মসঙ্গীকে দূরে ঠেলে দিতে চাওয়া।

পিতামহ ও পিতার পরম্পরা বেয়েই এ জৈবদেহ, তাঁরাও তাঁদের মতো নিরলস মনসাকৃত্যে তথা কাজবাজে মগ্ন থেকেছেন। কিন্তু তাঁদের পথ কবিতার দিকে না-গেলেও মোআদী হয়ে উঠেছে কবিতার অভিশাপে দগ্ধ, যার প্রধান কাজ ভাব ভেজে কবিতাফুল ফোটানো।

জাগ্রত কর্মেচ্ছা কর্মসঙ্গীলগ্ন হয়েই থাকতে চায়। কিন্তু তাকেও কাব্যদোষে অনুপ্রাণিত করে নীল করে দেবার বাসনা মোআদীর নেই। সে কারণেই তাকে দূরে ঠেলে দেবার এই বিরহবিলাস, মনে হয়।

বাংলা ভাবের জগতে কর্ম ও কাম একদেহে লীন। নেপথ্যে কাম তথা মদন ক্রিয়াশীল থাকে বলেই মানুষের পক্ষে কাজবাজে মগ্ন থাকা সম্ভব হয়। কাম তথা মদন ভস্ম হয়ে গেলে প্রেমও ভস্ম হয়ে যায়। কাজেই সকাম প্রেমই সেই নিয়ন্তা যে সাফল্যশীর্ষে আরোহণে কলকাঠি নাড়ে। এই প্রেক্ষাপটে মোআদীর ‘বিষ’ কবিতার বিভিন্ন ঢেউ পরস্পর লগ্ন হয়ে যেতে চায়। কোথাও না কোথাও একটা ঢেউ অংশত আরেকটা ঢেউয়ের ভিতরে প্রবিষ্ট হয়ে থাকে মনে হয়। এই ত্রিস্তর ভাববস্তুকে একত্রে মিলিয়ে দেখলে কবিতাটি একইসঙ্গে অনেক রং পেয়ে বর্ণিল হয়ে ওঠে। ওকে তখন চোর থেকে সাধু পর্যন্ত সবার মনের দরজায়ই কড়া নাড়বার উপযোগী কবিতা বলে আবিষ্কার করা যায়।

প্রতীকী ভাষারীতিতে প্রতিটি শব্দই একেকটি বস্তু বা বিষয়ের প্রতীক। কিন্তু প্রধানত সংস্কৃতকন্যারূপী বাংলা ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক চরিত্রের স্মৃতি এখনো আমাদের বেমালুম ভুলে যাবার দুর্মতি হয় নি বলে একটি কোনো শব্দের বিশিষ্ট প্রয়োগে আমরা অনেকার্থকতার সম্ভাবনা উঁকিঝুঁকি দেওয়া দেখি। অনেক সময় তা ঐতিহ্যনিষ্ঠ হয় না বটে; তবে তথ্যনিষ্ঠ বলে অনুমানবশেই আমরা সেই সাবেকী উষ্ণতা অনুভব করে উঠি, উঠতে পারি। এখানে যেমন আমরা এক ‘বিষ’কেই ‘ক্রোধ’, ‘বীর্য’ ও ‘ভাব’ হিসেবে দেখতে পেলাম। ‘সর্প’কে দেখতে পেলাম একইসঙ্গে ‘মোহভঙ্গ’, ‘যৌনতাড়না’ ও ‘কর্মপ্রেরণা’রূপে। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ‘বিষ’ বা ‘সর্প’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক বিন্যাসে উল্লিখিত অর্থসমূহের ভুক্তি দেখায় নি। তবু, আমরা যে দেখতে পেলাম, সেটা শব্দগুলোর প্রয়োগবিশিষ্টতার কারণেই মূলত। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, আমরা মোআদীর ‘বিষ’বিদ্যার আবহে ‘বিষ’ ও ‘সর্প’ ছাড়াও অন্যান্য চাবিশব্দের অর্থপ্রসারণ ঘটতে দেখছি।

কবিতার কবিতাত্ব ঠিক রেখেও যখন কোনো কবি ভাষা-শব্দের বিশিষ্ট প্রয়োগে এভাবে অর্থপ্রসারণ ঘটাতে সক্ষম হন, তখন তার সমুদয় ভাষাসংশ্লিষ্ট কীর্তিকলাপকে একাধিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে হয়। মোআদীর কাজকর্মকেও আমাদের সেভাবে দেখবার দরকার আছে বলে মনে হয়।

নভেম্বর ২০১৭

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...