Saturday, July 4, 2020

অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অন্যতম স্বর্ণদুয়ার

ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের নিয়মিত পাঠচক্র প্রকল্প বীক্ষণ তার ১৮০০তম অধিবেশনে উপনীত হতে যাচ্ছে, সংবাদ হিসেবে এটা প্রায় সবার জন্যই সচকিত হবার মতো। সংবাদটি আমার জন্য একইসঙ্গে গর্বেরও, যেহেতু ১৯৯২-এর অক্টোবর থেকে ১৯৯৩-এর মার্চ পর্যন্ত ৩৭ ও ৩৮ নম্বর প্রান্তিকে আহ্বায়ক হিসেবে বীক্ষণের হাল ধরে এর সুদীর্ঘ পরম্পরায় আমিও তুচ্ছ অবদান রাখতে পেরেছিলাম। পাশাপাশি সহ-আহ্বায়ক এবং সাধারণ অংশগ্রহণকারী হিসেবেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম আগে-পরে আরো কিছুদিন। পেশাগত প্রয়োজনে দূরবর্তী শহরে অবস্থানের কারণে পরবর্তী প্রায় আড়াই দশকে বীক্ষণে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ কমই ঘটেছে। তবে এটা বলা যায় যে, শারীরিক দূরত্ব সত্ত্বেও বীক্ষণের সঙ্গে কোনো মানসিক দূরত্ব আজ অবধি তৈরি হয় নি। হওয়া সম্ভবও নয়।

সকলেই জানেন এবং মানেন যে, লেখালেখি করবার কাজটি শতভাগ ব্যক্তিগত। কিন্তু তার জন্য সামাজিক হয়ে ওঠবার ব্যাপার আছে। অগ্রজ, সমসাময়িক, অনুজ নির্বিশেষে অন্য লেখকদের সঙ্গে মেলামেশা, পাঠাভিজ্ঞতা ও শিল্পধারণা বিনিময়, বিচিত্র তথ্য আদানপ্রদান, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি সে অবকাশ তৈরি করে দেয়, অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ করে তোলে। অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অসংখ্য মার্গের একটি হলো সামাজিক হওয়া। বলতে কী, এ ধনে যে যত ঋদ্ধ, তার ব্যক্তিগত লেখনযাপন তত সুফলদায়ক।

বীক্ষণ আমাদের জন্য ছিল অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অন্যতম স্বর্ণদুয়ার। অন্য লেখকদের সাথে একজন সাহিত্যকর্মী কীভাবে মিশবেন, ওই মেলামেশা থেকে কিছু আহরণ করবেন নাকি কেবল নিজেকে প্রদর্শন করে বেড়াবেন সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। বীক্ষণ সে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ১৯৮৩ সাল থেকে সবার সামনে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়ে চলেছে। যাত্রার শুরুতেই এরকম একটা প্রস্তুত ক্ষেত্রের সন্ধান লাভ যে কোনো সাহিত্যকর্মীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

বীক্ষণ বিষয়ে প্রসংগত আমি কিছু কথা লিখে উঠেছিলাম ২০০৫-এ প্রকাশিত ইফফাত আরা সম্পাদিত ‘দ্বিতীয় চিন্তা’র ফরিদ আহমদ দুলাল সংখ্যায় পত্রস্থ আমার আঁতুড়ঘরের নকশামালা, খুঁজে-ফিরে দেখার সাধনবিলাস শীর্ষক নাতিদীর্ঘ রচনায়। আমার মনে হয়, একই কথা পুনর্বার লিখবার চেষ্টা না করে ওই রচনাংশটিই এখানে উৎকলন করা যায়, যেহেতু আমাদের বীক্ষণঘনিষ্ঠ সময়টা ওখানে স্ফটিকাকারে হাজির হয়েছিল।
বীক্ষণবার
আপনি জানেন, বীক্ষণময় শুক্রবারগুলো ছিল উৎসবের দিন আমাদের, সচল-অচল সব ধরনের লেখকের। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই প্রস্তুতি চলত, পরদিন কোন কোন লেখা পড়া যায় সে নিয়ে। রাত জেগে নতুন করে কিছু লিখবার চেষ্টা, না হলে পুরোনো খসড়াকে ভাঙা আবেগের তুলি দিয়ে নতুন করে ঘষেমেজে সারিয়ে তোলা।
বীক্ষণ ছিল ময়মনসিংহের নবীন-প্রবীণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক মিলনমেলা, আজও। অনিবার্য কারণে একদিন না আসা গেলে সাংঘাতিক খারাপ লাগত। মনে হতো আমাকে বাদ দিয়ে সাহিত্যের খেয়া হয়ত পৌঁছে যাচ্ছে সিদ্ধির ঠিক ওপারে। মনে এতদবিবেচনা একবার ঠাঁই পাবার পর থেকে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ (মসাস)-এর সর্বাপেক্ষা কার্যকর প্রকল্প বীক্ষণ-এ আমরা ছিলাম খুব নিয়মিত। তখন বীক্ষণ বসত সি. কে. ঘোষ রোডে অবস্থিত অনুগ্রহে পাওয়া প্রেসক্লাবের একটি কক্ষে। এখানে এসে সাহিত্যের জন্যে বিনাশ্রম, সিকিশ্রম, আধাশ্রম, পৌণেশ্রম, পূর্ণশ্রম— সব ধরনের সাহিত্যসংস্রবপুষ্ট লোকজনেরই চেহারা দেখেছি সামনাসামনি। ময়মনসিংহে লভ্য তাবৎ ঘরানার লেখকেরই আনাগোনা ছিল একে ঘিরে, হয়ত এখনো আছে। পূর্বনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কবিতা-গল্প-ছড়া পাঠ শেষে বীক্ষণের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত হলেও তরুণতর আমাদের অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কখনো কখনো পরদিন সকাল পর্যন্তও গড়াত, মনে পড়ে। বিষয় ও ভূগোলে সেসব অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে থামবে আমরা কেউই পূর্ব থেকে জানতাম না কিছু।

প্রেসক্লাব ছেড়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট হয়ে বীক্ষণ ব্রহ্মপুত্র তীরের কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য মহারাজের বাগানবাড়ির তপোবনপ্রায় পুণ্যচ্ছায়ারাশি ঘেঁষা মসাস-এর নিজস্ব ডেরায় স্থানান্তরিত হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই আমাদের দেহমনগাছে নতুন নতুন ডালপাতা ছড়াল। মসাস-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বীক্ষণের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক আপনার বিশেষ নজর থাকত আমাদের প্রতি। সংগঠনের আগামী সময়ের সৈনিক হিসেবে আমাদের তৈরি করবার একটা চেষ্টা আপনার মধ্যে ক্রিয়াশীল দেখেছি বরাবর। আপনার পরামর্শ ও নির্দেশ আমরা মেনে চলতেই চেষ্টা করতাম। এক দু’বার করে আমরা অনেকে আহ্বায়ক হিসেবে বীক্ষণের হালও ধরেছি। কিন্তু নবিশ সংগঠক হিসেবে আমাদের অনেকেরই ব্যর্থতা ছিল, ছিল সংগঠক হবার ব্যাপারে অনাগ্রহও। কারো কারো চাওয়াও ছিল না যে বীক্ষণ ভায়া হয়ে একদিন মসাস-এর বড়ো সংগঠক হব, বরং আমাদের স্বপ্ন ছিল ভালো কিছু লিখবার। কেউ কেউ সংগঠক হয়েও অঢেল লিখতে পারেন, আপনি যেমন। আমাদের কারো কারো মনে হতো, এ কাজটা সবার নয়, আমাদের জন্ম হয়েছে শুধু লিখবারই জন্যে। যে কারণে সংগঠনের নকশা অনুযায়ী পরিচালিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেও ভিতর দিক থেকে আমরা অনেকেই ছিলাম সংগঠনবিরোধী। ফাঁক খুঁজতাম কী করে প্রতিষ্ঠানের মাপ দেয়া সীমার বাইরে পা রাখা যায়, স্বাধীনভাবে সমমনাদের সাথে বেহিসেবী সময় যাপন করা যায়।

বীক্ষণের দ্বিতীয়ার্ধে অনুষ্ঠিত স্বরচিত রচনার পাঠপর্ব আমাদের দারুণভাবে আকর্ষণ করলেও প্রথমভাগের আলোচনা সবসময় ভালো লাগত না ওর প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র এবং বিষয় নির্বাচনজনিত বদ্ধতার কারণে। ওখানে এমনকি ঈদানুষ্ঠানের তাৎপর্য, দুর্গাদেবীর মাহাত্ত্ব্য— এসব বিষয়েও আলোচনা হতো। যতদূর খবর রাখি, আজও হয়। একইসঙ্গে মক্কা-মদিনা-গয়া-কাশী-কপিলাবাস্তু-লুম্বিনী-বেথেলহেম-নাজারেথের ছবি ওখানে আঁকা হতো যতটা প্রতিষ্ঠানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্যে ততটা সাহিত্যিক প্রয়োজনে নয়, আমরা বুঝতাম। এসব আমাদের কখনোই টানত না, আজও তরুণদের টানে না। তার মানে এ নয় যে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি না। আমরা ভিতর দিক থেকে বেড়ে ওঠবার জন্যে আরো প্রাসঙ্গিক, ব্যবহারিক ও গতিশীল আলোচনা করবার ও শুনবার জন্যে সদা মুখিয়ে থাকতাম। সেসব আলোচনার কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপছবি থাকত না, কিন্তু প্রাণমূলে রস থাকত।
আনুষ্ঠানিকতায় আমরা যারা অনেকটাই অপ্রস্তুত ও নীরব, ব্রহ্মপুত্র ধোয়া সাহেব কোয়ার্টার পার্কে গিয়ে বসলে আমরা সেখানে সবাই সরব। আমাদের এই আকর্ষণ সবকিছুকে ছাপিয়ে যেত।

আপনাকে মনেপ্রাণে সদাতরুণ বলেই জানি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও বেশি। তরুণ মসাস কর্মকর্তা গ্রন্থপ্রিয় আহমদ সাইফ, সুনন্দন ইয়াজদানী কোরায়শী, স্বরশিল্পী আমজাদ দোলনও। কিন্তু সর্বোপরি আপনারা ছিলেন মুরব্বি, সাংগঠনিক জন। মাঝে মধ্যে বীক্ষণ শেষে আপনারাও বসতেন পার্কে, কিছুক্ষণ। নদীর জল ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে চুল ওড়াতে ওড়াতে ওখানে চা-সিঙারা, বাদাম-চানাচুর ইত্যাদি হতো। কিন্তু মত্তআড্ডা যাকে বলে সেটা জমত না বস্তুত। আমাদের কাছে আপনারা ছিলেন স্থানীয় অভিভাবক। আমাদের পুরোমাত্রায় খুলে যাওয়া সম্ভব হতো কাজেই আপনারা পিঠটান দেবার পর। তখন ভালো করে ভেবে দেখি নি, কিন্তু এতদিনে ওসব জমায়েতকে রোদে মেঘে কোলাকুলি বলে মনে হয়, মুহূর্ত-স্ফূরিত। 
নব্বইয়ের দশকের শুরুর কয়েক বছরে বীক্ষণে তরুণ ও তরুণতরদের এক অপ্রতিহত জোয়ার ছিল। লেখালেখিতেও বেশি সরব ছিলেন ওই তরুণরাই, সবসময়ই যা হয়। শাহীদা হোসেন রীনা, আশিক আকবর, আহমেদ শফিক, আশিক সালাম, আহমদ শাহাবুদ্দিন, চয়ন বিকাশ ভদ্র, তাসাদ্দুক ফাহিম, অমল রজক, তোফায়েল তফাজ্জল, সালাহউদ্দিন পাঠান, আবদুল মতিন, সরকার আজিজ, পলাশ চৌধুরী, তাসলিমা রহমান, আশরাফ রোকন, দিলীপ সেন, মোস্তাক বিবাগী, মোহাম্মদ ইয়াকুব, নাজমা মমতাজ, রীনা পণ্ডিত, হাদিউল ইসলাম, মাসুম মোকাররম, শামীম পারভেজ, মশিউর রহমান খান, শতাব্দী কাদের, রওশন ঝুনু, মিনহাজ উদ্দিন শপথ, সমুদ্র সেলিম, মামুন মাহবুব, জুয়েল কবীর, ওসমান গণি, মনো জসীম, ধনেশ পণ্ডিত, তন্দ্রা সরকার, রাজিয়া সুলতানা, মার্জিয়া সুলতানা নীলিমা, হিশাম আল মহান্নাভ, ফাতেমা নার্গিস বীণা, রোকসানা বিলকিস, অনিন্দ্য জসীম, স্বাধীন চৌধুরী, মামুন মোয়াজ্জেম, আলী ইউসুফ, শাবিহ মাহমুদ, শাহিন লতিফ, গনী আদম, সফেদ ফরাজী, বিল্লাল মেহদী, অতনু তিয়াস, চন্দন সাহা রায়, সিদ্ধার্থ টিপুসহ আরো অজস্রজন আমরা।

পার্ক বা সংগ্রহশালার বিকল্প-বীক্ষণ শুরু হতো এ তালিকার একটা গুরুঅংশকে নিয়ে। ওখানে আমরা থাকতাম পুরোমাত্রায় ব্যবহারিক, কবিতাকেই ভালো করে চিনবার-জানবার চেষ্টায় মত্ত। নানাজনের মুদ্রিত-অমুদ্রিত কবিতা থেকে পাঠ, তার ভালোমন্দের নিবিড় পর্যালোচনা, বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠের অভিব্যক্তি শেয়ার, ইত্যাদিতে মত্ত থাকতাম আমরা। কবিতা বিষয়ে নানারকম কর্মশালাও হতো ওখানে। পাঁচ-দশজন মিলে বারোয়ারি কবিতাও লিখেছি আমরা। প্রতিজন এক দু’লাইন করে লিখে একটি কবিতার পূর্ণ রূপ দেবার সেসব চেষ্টা যুগপৎ আনন্দদায়ক এবং শিক্ষণীয় ছিল। ক্রমশ কমতে কমতে জমায়েত দু’তিনজনে এসে ঠেকলে আমরা অন্য মঞ্জিলমুখী হতাম। তারও পরে হতাম একা। হায় একা হওয়া আমাদের, বিরল ভাবনা।

উল্লিখিতদের অনেকেই আজ আর লেখালেখির সঙ্গে নেই, অনেকেই ক্রমশ নিভে গেছেন অথবা নিভতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু যুগপূর্বকালে এদের সবার ভিতরেই কমবেশি সৃজন-আগুন ছিল। ওই অন্তর্গত অগ্নির সম্মিলিত উত্তাপ আমরা সকলেই অনুভব করতাম সমভাবে, সংবিধানবিহীন আমাদের সংঘপ্রয়াসে। 
এটা ঠিক যে, ২৫ বছরে অনেকখানি বদলে গেছে ওই জগৎ। আমাদের অনেক অগ্রজ ও সতীর্থ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, যাঁদের সংস্পর্শ আমাদের প্রাণিত করেছিল। বীক্ষণসংশ্লিষ্টদের থেকে ইতোমধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন আহমদ সাঈফ, প্রদীপ কুমার বিশ্বাস, আজাহার সরকার, মোহাম্মদ আবদুল হান্নান, আবদুল মতিন, তাসলিমা রহমান ও শামীম পারভেজ। ১৮০০তম অধিবেশনের এই উৎসবায়োজনে হৃদয়তন্ত্রীতে আজ তাঁদের কথাই বেদনবীণা হয়ে বাজছে বেশি করে।

সেপ্টেম্বর ২০১৮

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...