Friday, July 3, 2020

মেঘে বাড়ি আহোনির ভূমিলগ্ন ডেরা

আকমল হোসেন নিপু (আহোনি)-র ১৯৯৮-এ প্রকাশিত প্রথম প্রকাশনাটি ছিল একটি গল্পগ্রন্থ। এর পাঁচ বছর ছাড়িয়ে আরেকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশেরও পরের বছর ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি’। এর পরে আরো দুটি গল্পগ্রন্থ ও দুটি উপন্যাসগ্রন্থ প্রকাশের পর ২০১৬-এ একটি উপন্যাস ও একটি গল্পগ্রন্থসহ যুগপৎ প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখের কোন প্রতিবেশি নেই’। ২০১৭-এ প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ প্রকাশনাটিও একটি গল্পগ্রন্থ। দেখা যাচ্ছে, প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের সময় থেকে ২০১৭ পর্যন্ত উনিশ বছরে তাঁর গল্পগ্রন্থ সংখ্যা ৬, উপন্যাস ৩ ও কাব্যগ্রন্থ ২। অর্থাৎ, প্রকাশনার সংখ্যাবিচারে তাঁর কথাসাহিত্য ও কবিতাগ্রন্থের অনুপাত ৯:২; যে বহরে কথাসাহিত্যের পাল্লা চতুর্গুণাধিক ভারী।

এতদসূত্রে আমরা কি এই অনুমানে দাঁড়াতে পারি যে, আহোনির ঘর-গেরস্থালি কথাসাহিত্যের সাথে যতটা, কবিতার সাথে ততটা নয়? না বোধহয়। একটিমাত্র সংখ্যাবাচক তথ্য এ ধরনের বিবৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়। কেবলই কবিতা লিখেন এবং জীবনে কখনোই কথাসাহিত্যের চর্চা করেন নি এমন কবিও জগতে রয়েছেন যাঁদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে দ্বিতীয়টি প্রকাশের ফারাক ১২ বছরের চাইতেও বেশি। এমনকি পৃথিবীতে এমন কবিও ছিলেন, জীবনে যাঁদের সবেধন একটিই মাত্র কাব্যগ্রন্থ। তো?

আহোনির প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে অভিমত জানাতে বসে দুই অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত ১৬৫ শব্দে এই যে মুখবন্ধটি আমি লিখে উঠলাম, এ দিয়ে এমন এক নিরর্থক মানচিত্র অঙ্কিত হলো, যার কোথাও কোনো সদর্থক অর্জন নেই। অবশ্য আলোচ্য লেখকের সৃজনঝোঁক ও লেখনপ্রবণতা বিষয়ে এই টেক্সট কিছুটা ধারণা উৎপাদন করলেও করতে পারে, যার ভালোমন্দ আমার পরবর্তী কথাবার্তার মেরিটের ওপরে খানিকটা নির্ভর করবে বলে মনে করা যায়।

পাঠকমহলে আহোনির কথাসাহিত্যিক পরিচয়টি স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। ওই পরিসরে তাঁর কিছু সামাজিক স্বীকৃতিও জুটেছে। কাজেই তাঁর পক্ষে ওই সফলতার রেখা ধরে সামনে এগোনোই মানবস্বভাবানুকূল আচরণ। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে এ যাবৎ বাংলা-কবিতার যত সংকলন হয়েছে, অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিকদের হাতে আশি ও নব্বইয়ের দশকের কবিদের তথাকথিত যত তালিকা প্রণীত হয়েছে, কোথাওই প্রায় তাঁর অন্তর্ভুক্তি নেই। হ্যাঁ, লেখক কেবলই স্বীকৃতির জন্যে লিখেন না; তবে স্বীকৃতিহীনতার ভিত্তিমূলকে পরিসরে আরো বাড়তেও দিতে চান না। পারলে বরং ইতিহাসের হাতে একটা বার্তামাত্র রেখে তা আড়াল করেন। কিন্তু আমরা দেখি যে, তিনি তা বাড়তে দিয়েছেন। ১২ বছর ধরে একে একে জমা করেছেন প্রতিবেশীহীন দুঃখমালা, যার খোঁজখবর নেবার আমরা কমই প্রয়োজন বোধ করেছি।
 
আমাদের কীর্তিমান কথাসাহিত্যিকদের অনেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। পরে তাঁরা কবিতাকে পাশে রেখে অন্যদিকে মনোযোগী হয়েছেন। এক্ষেত্রে আমরা নাম করতে পারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিম আল দীনসহ অনেকের। সংগত কারণে আমরা তাঁদের গল্প-উপন্যাস, কথানাট্য, প্রবন্ধ, প্রভৃতির প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখাই; দুর্বিষহ বেদনার মতো যার এক প্রান্তে পড়ে থাকে তাঁদের কবিতারা। এই বাস্তবতার কথা মনে রেখেও আহোনির কবিতার দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে হয়। কেননা তিনি কথাসাহিত্যের বিপুল-বিস্তৃত প্রান্তর পরিভ্রমণ করবার সময়ও নদীর দিকে, ধানগাছের দিকে সুরাচ্ছন্ন মগ্নতা নিয়ে তাকান এবং ছন্দে-লয়ে সেই মগ্নতাকে এঁকে যাবার প্রয়াস পান।

যা কোনোকিছুই দিচ্ছে না, মানে যার সঙ্গে কোনো বিনিময়ের সম্পর্ক নেই, তার প্রতি দীর্ঘকালীন টান ও আসক্তি অতি অবশ্যই প্রেমনামধেয় বলে কীর্তিত হতে পারে। এই প্রেমই সেই অবস্তুধন, যার দিকে আমরা সমীহ নিয়ে তাকাই, তার গূঢ়ৈষা খুঁজে দেখি। দেখা দরকার বলে মনে হয়। আহোনির মধ্যে কবিতার প্রতি সেই প্রেম সদা জাগ্রত আছে।
বলা দরকার যে, ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি’তে, মানে আহোনির মেঘবাড়িতে বেড়াতে গেলে ভালো লাগে। বাড়িটা নদী-তীরবর্তী আর চাষবাসে সরগরম। ফলে এই মেঘবাড়ির যা কিছু গতিপ্রকৃতি তা নির্ধারিত হয় এ দুয়ের অবাক সম্মিলনে। তাতে তাঁকে মনে হয় কৃষিসমাজের আত্মীয় ও নদীসখা বলে।

নদীলগ্ন অনুভূতি এখানে এত বিচিত্রভাবে হাজির হয়েছে যে ভিজে যেতে হয়। কিন্তু বলে রাখা ভালো যে, পাঠককে খেলাচ্ছলে নিছক ভিজে ওঠার সুখ দেওয়া তাঁর কবিতাকর্মের অভীষ্ট নয়। মানে নদীকে তিনি তার নিখুঁত ফটোগ্রাফিক সৌন্দর্য বর্ণনার উপকরণ হিসেবে বেছে নেন নি এখানে, মূল্য দিয়েছেন কৃষিসহায়ক হিসেবে। ফলে এখানকার এ ভিজে যাওয়া ও শুকিয়ে ওঠার সিংহভাগই শ্রমলগ্ন, চাষগন্ধী ও ঘামবহুল। ‘আমি তো পাহাড় নদীর কাছে/ এখনো দাঁড়াই’ (গন্তব্য), ‘এরকম অনেক বছর তন্বী নদীর কাছে/ হলুদ শস্যক্ষেত পড়ে থাকে’ ((নির্জন বাঁশি) বা ‘শীর্ণ নদীকূলে/ চাষীকন্যা মেলে ধরে রুপালী দুপুর/ দূরে দূরে শঙ্খ সাদা মেঘ’ (কৃষিকথা-৪) ধরনের অজস্র পঙক্তিতে নদী ও কৃষিসমাজের ইমেজ মূর্তিত এই বইয়ের গন্ধ মাটির গন্ধের সহোদর। অতএব তা খুঁতযুক্ত এবং বেদনাপ্লাবী নন-ফটোশপিক চক্ষু, হস্ত ও মস্তিষ্কনির্মিত শিল্পবস্তুর আধার।

আহোনির মেঘবাড়ির কবিতায় যে সুর ধ্বনিত তা পয়ারের দোলা দিলেও আগাগোড়া পয়ারনিষ্ঠ নয়। চালটা তার প্রায়শই মুক্তক অক্ষরবৃত্তের। সুরের মধ্যে থেকে থেকে প্রায়ই অসুরের গহন ইশারায় তাল কেটে দেওয়া হয়েছে তাঁর কবিতা থেকে কবিতায়। তাতে পাঠস্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়। দৃষ্টান্তসহ একটি প্রশ্ন হাজির না করে শেষ করা যাচ্ছে না এই আলাপ : যেমন, ‘সূর্যঘুম’ কবিতার ‘দুহাতে রাখিনি কিছু সবকিছু আকাশে মেলেছি/ হাওয়া অনুকূলে, তাই ভেসে গেছে পালকের সুখ/ নদীর নিঃশ্বাস; কী করে বর্ণনা করি’ যে আমেজ দিলো, চতুর্থ লাইনে এসে ‘বরফকাল, উচ্চারণ করা মাত্র তা ভেঙে গুঁড়িয়ে মিশে গেল চকচক করা এক গদ্যস্রোতে। কেন এমন করেন তিনি? ছন্দ-সুরের ঐতিহ্যকে আঘাত দিয়ে প্রথাশাসনের প্রতি কোনো অনাস্থাকে জানান দিতে? বক্তব্যের দাবিকে ছন্দের দাবির চাইতে গুরুতর বলে হাজির করতে? হতে পারে। তবে এ বইয়ে গ্রথিত তাঁর বক্তব্যবিষয় ও কাঠামোয় প্রথাশাসন ভাঙার কোনো প্রবণতা কোনোভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে নি।

কিছু ক্ষেত্রে ‘রাজনীতিবিদ নদী নিয়ে বাণিজ্য করে’, ‘নদী তবে পৌঁছুবে কোথায় চারদিকে বণিকের হাত!’, ‘নারীর/ কোমল বাহু এই ফাঁকে পণ্য হয়ে যায়।’ ধরনের তিক্ত সত্য তিনি উচ্চারণ করেছেন তাঁর এই বইয়ের কবিতায়। শোনা গেছে ‘কেবল প্রার্থনা, মানুষের শত্রু লোপ পাক’ ধরনের চিদাকাঙ্ক্ষাও। এসব তাঁর সাহিত্যপ্রবণতার সঙ্গে খুব যায়। শুভলগ্নের অন্বেষায় ফেরা আহোনির এই যেন প্রকৃত নীড়।
 
আহোনির কবিতাগুলোর সূচনা প্রায়ই চোখ ঝলসানো, কানপাগল করা ও চিত্তচমকানো : ‘ছিলাম সাগর জলে তুমি এনে তুলেছ ডাঙায়’ (জানি না উড়াল মেঘ); ‘রাত্রিই মুগ্ধ করে বেশি, একে একে খুলে ফেলি/ আগুনের খোসা’ (বাতাসনির্ভরতা); ‘আনন্দে লাফাও কন্যা দুধভরা মাটির কলস’ (হরিণচর্চা); ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি জানা হলো বহুদিন পর/ চৈত্রবৃষ্টিতে’ (শস্যসংকেত); ‘রেখেছ মূর্খ করে রণকৌশল কখনো বুঝি না (ঘুঘু চড়ে খায়); ‘কষ্টের দোতরা তুমি নিমকাঠে গড়া’ (নিমকাঠে গড়া); ‘নীরবে দাঁড়াতে দেখে ভেবেছ পাথর—’ (তোমাদের শস্যময় মুহূর্ত); ‘তোমাকে ছুঁয়েছি বলে এই হাত বাঁশি হয়ে গেছে—’ (বাঁশিতত্ত্ব)। এই হেন ঔজ্জ্বল্যের ছন্দ-সুরই প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ হয়ত এসবের নির্ভার মানেযুক্ত যোগাযোগসক্ষমতা। তবে সূচনাপঙক্তি -পরবর্তী হাঁটাহাঁটিতে প্রায়ই দূরত্ব তৈরি হতে দেখা গেলেও সেসব পদক্ষেপকে কখনোই অনাত্মীয় মনে হয় না। পরবর্তী চলনে তিনি সূচনামূলের টান ভুলে যান না। মূলে তাকাতে অনাগ্রহী অনেকেই যেখানে জারজ পঙক্তি দিয়ে কবিতার শরীর ভরে তুলতে তুলতে আজকাল উচ্ছন্নের দিকে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন, তিনি সেখানে বরাবরই মূলনিষ্ঠ, শেকড়বান্ধব।

শব্দ-বাক্যের মধ্যস্থতায় এ বইয়ে গড়ে উঠেছে যে শস্যগন্ধা নদীসমবায়, তার নাম ধরে ডাকের মধ্যে নদীমাতৃক এ বদ্বীপকে ভালোবেসে যাবার নিবিড় মন্ত্র শিখে ওঠবার আশকারা আছে। ফলে কথাসাহিত্য ও কবিতার মধ্যে কাকে তিনি বুক দেন আর কাকে পিঠ সে প্রশ্ন এইখানে এসে আলগোছে গৌণ হয়ে যায়। শরীরের আয়তন দেখে মানুষের মহত্ব মাপবার ঝোঁক আমাদের মধ্যে তৈরি না হওয়াই স্বাস্থ্যকর।
 
আহোনি যে ধারার কাব্যচাষ করেন তাতে মগ্নতা লাগে। শব্দসাধনকালে তার মধ্যে সেই মগ্নতা অতি অবশ্যই জাগে। প্রয়োজনমতো টুকরাটাকরা হয়ে হলেও সেটা পড়েও তার সব কবিতার ভাগে। মর্জি হলে আমরা পাঠকরা তাতে ভিজতে পারি, শুকাতে পারি। পারি তার শরীরের সাথে শরীর লাগিয়ে মিশে থাকতে। চেনা গন্ধের আবেশে তাতে আরাম লাগে। আত্মীয়সংঘে আছি বলে মনে হয়।

তাঁর কবিতার সাথে এই মিশে থাকা আমাদের, দীর্ঘায়িত হোক।

সেপ্টেম্বর ২০১৭

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...