Saturday, August 8, 2009

ব্যাজস্তুতির ছলে সত্যের লেজ ধরে টান

ভালো লাগছে, রহস্যপ্রবণ লাগছে
আবুল হাসান

ভালো লাগছে। এতকাল পরে আজো মানুষকে ভালো লাগছে।
রহস্যপ্রবণ লাগছে।
বড় তরতাজা লাগছে। যেমন যুবতী, যেমন জরায়ু, যেমন শিশির

ভালো লাগছে। ফুল ও পূর্ণিমা, পুরাতন ভালোবাসা ভালো লাগছে।
মানুষ এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে ফিরছে। মানুষকে ভালো লাগছে।
মানুষকে মারা আজ কোনো কঠিন ব্যাপার নয়; সব সহজ।

জর্জর সঙ্গম, ফুল, জন্মে জেগে ওঠা মৃত্যু, অন্ধকার। সব সহজ।
কোনোকিছু, আজ আর কোনোকিছু কঠিন ব্যাপার নয়।
ভালো লাগছে। বেরিয়ে আসছে বিষ, ক্ষয়, মৃত্যু ও জরা।
ফুলের মালায় বেরিয়ে আসছে অবেলায় অজগর, ভালো লাগছে।
রহস্যপ্রবণ লাগছে।

সুন্দর ব্যর্থতা ঝরছে দোরগোড়ায়। ভালো লাগছে। মানুষ লিখতে পারছে
কুকুর হইতে সাবধান, বাগানের ফুল ছিঁড়িও না আর নীরবতা আবশ্যক
ভালো লাগছে। এতকাল পরে আজো মানুষকে ভালো লাগছে।
রহস্যপ্রবণ লাগছে।

ফুল ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে ফের বলছে ফুল ছিঁড়িও না।
কুকুরের মধ্যে ফের কুকুর বসিয়ে ফের বলে উঠছে কুকুর হইতে সাবধান!

ভালো লাগছে। মানুষকে ভালো লাগছে। ভালো লাগছে। সারাদিন
ভালো লাগছে। সারাদিন রহস্যপ্রবণ লাগছে, ভালো লাগছে,
ভালো লাগছে না।

(সূত্র : আবুল হাসান রচনা সমগ্র, বিদ্যাপ্রকাশ, চতুর্থ প্রকাশ ২০০৭)

আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫)-এর যেসব কবিতার নামধাম ও পঙক্তি কথায় কথায় কাব্যামোদী পাঠকেরা উৎকলন করে থাকেন, তাঁর ‘ভালো লাগছে, রহস্যপ্রবণ লাগছে’ সেসবের কোনোটিই নয়। চেনা জিনিসকে পুনরায় চিনিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পূর্বচিহ্নিত খ্যাতির তুলনায় কোনো কবিতাকে নিজঅক্ষমতায় হীন করে তোলায় মন সায় দিল না। তারচে’ মনে হলো হঠাৎ করেই স্বচ্ছচোখে চোখ পড়ে যাওয়া অপরিচিতের সাথেই এ বেলায় খানিক কথাবার্তা বলে দেখা যাক; একে তো এতে ঝুঁকি কম, তদুপরি প্রেমময় পারস্পরিকতা সর্বদাই প্রশংসার্হ বলে জানি। সেই চেষ্টারই এটা স্মারক।

যেরকম টানটান উত্তীর্ণ কবিতা লিখবার রেকর্ড স্থাপন করে একের পর এক নিজেই নিজের রেকর্ড ডিঙিয়ে নতুন রেকর্ড স্থাপন করে গেছেন আবুল হাসান, সেরকম নিটোল, নিখুঁত কোনো কবিতা নয় এটি। এমনও মনে হয় যে প্রথম খসড়া হবার পর মুদ্রণের আগে খুব বেশি সময়ও হয়ত দেয়া হয় নি কবিতাটিকে। কবির নিজেরও হয়ত পছন্দের ছিল না কবিতাটি। জীবিতাবস্থায় প্রকাশিত তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ (রাজা যায় রাজা আসে : ১৯৭২, যে তুমি হরণ কর : ১৯৭৪ এবং পৃথক পালঙ্ক : ১৯৭৫)-এর দুটোই প্রকাশিত হয় এ কবিতাটি লিখিত ও মুদ্রিত হবার পরে। কিন্তু দুটোর কোনোটিতেই কবিতাটি গৃহীত হয় নি। মার্চ ১৯৭৪-এ বিচিত্রায় পত্রস্থ এ কবিতাটি পরে গ্রন্থিত হয় ১৯৮৫-এর নভেম্বরে মুহম্মদ নূরুল হুদা, ফখরুল ইসলাম রচি ও জাফর ওয়াজেদ সম্পাদিত আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা নামক সংকলনে। কবিতাটিতে অনেকটা ঢিলেঢালা, শিথিল একটা আয়োজন দ্রষ্টব্য হয়ে আছে। তবে অঢেল স্ফূর্তিমাত্রকে বগলদাবা করে এগিয়ে গিয়ে কবিতাটি আবিষ্কার করে নিয়েছে কিছু প্রবাদোপম সত্যবাক এবং মানবিক প্রবণতার কিছু গলি-ঘুঁপচি, এতে কাঠামোগত যা কিছু শৈথিল্য এ কবিতাটিতে দ্রষ্টব্য, তা গৌণতায় পর্যবসিত হয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে এর প্রকাশ্যার্থ ও অপ্রকাশ্যার্থ বা নিহিতার্থের ঔজ্জ্বল্য। আমার মনে হয়, কবিতাটি পাঠকমাত্রকে তার অর্জিত মন্দাভিজ্ঞতাগুলোর দিকে মনোনিবেশে বাধ্য করতে পারে, ইন্ধন দিতে পারে আত্মসমালোচনায়ও। এবং বলতে কী, তাকে হয়ত ক্ষণিকের জন্য হলেও খানিকটা লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।

মানবজাতির বয়স কত হলো, অন্তত আধুনিক মানুষের ? প্রায় ২ লক্ষ বছর ধরে কথিত বর্বর অবস্থা থেকে উত্তরিত হয়ে সভ্যতার সিঁড়িতে পা রেখে মানুষ আধুনিক হয়েছে সেও প্রায় ১০ হাজার বছরের কথা। বাহারি এই আধুনিকতার ঝলকে মানুষের অন্তরে-বাহিরে যে পরিবর্তন আজ দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে, তাকে আমরা অনেক বড়ো অর্জন হিসেবেই মূল্যায়ন করি। কাজেই এটা সঙ্গত যে, এত এত বছর পেরিয়ে আসার পরও মানুষকে আমাদের কাছে ভালো লাগে, ভালো লেগেছে আবুল হাসানেরও। ভালো লাগতেই পারে। মানুষকে মানুষের ভালো লাগবে এতে আর বিচিত্র কী! কিন্তু এ ভালো লাগা যে আদতেই ভালো লাগা নয়, আয়রনি বা ব্যাজস্তুতিমাত্র, ক্রমশই কবিতাটি তা উন্মোচিত করে এর প্রতি আমাদের কৌতূহলকে উসকে দেয়, তলিয়ে দেখবার।

সভ্যতার যে দান, তা মানুষকে প্রাযুক্তিক অত্যাশ্চর্য সব উন্নতির শিখরে আরোহণে সামর্থ্য এনে দিয়েছে। দিয়েছে মানুষের আচরণগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যও, যার সহজ সাধারণ নাম হয়ত জটিলতা। এই জটিল মনোবৃত্তিই তাকে আড়ালপ্রিয় করেছে, করে তুলেছে রহস্যপ্রবণ। এ অস্ত্র দিয়েই মানুষ সংজ্ঞায়িত করেছে প্রাকৃতিক-নৈসর্গিক-ব্যবহারিক নানা ভালোমন্দের। বলেছে ফুল ভালো কারণ তা সুগন্ধ দেয়, পূর্ণিমা ভালো কারণ তা দেয় নিরুত্তাপ মোহনীয় আলো, যুবতী সতেজ ও তরতাজা কারণ তা একইসঙ্গে ধরে সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা (নারীর চোখে দেখলে এর ব্যাখ্যা হয়ত অন্যরকম হতো), জরায়ু তরতাজা কারণ তার উর্বরতা স্বয়ম্প্রমাণিত, শিশির সতেজ কারণ তা যত ক্ষুদ্রায়ুই হোক, রুক্ষকেও দেয় কমনীয়তা। এইসব ভালো লাগা, সতেজ-কোমল অনুভূতি আজের নয় বা নয় গতকালেরও; তা সভ্যতার চেয়েও বেশি বয়সী।

ভালো লাগছে। এতকাল পরে আজো মানুষকে ভালো লাগছে।
রহস্যপ্রবণ লাগছে
বড় তরতাজা লাগছে। যেমন যুবতী, জরায়ু, শিশির

ভালো লাগছে। ফুল ও পূর্ণিমা, পুরাতন ভালোবাসা ভালো লাগছে।

এসব পঙক্তি পড়ে আমরা চমকাই না বস্তুত। যে কেউই এরকম বলতে পারেন, এটা বলতে আবুল হাসান হওয়া লাগে না। এবং এরকম পটভূমিতে অনেকবারই কেউ বলতে পারেন ভালো লাগছে..., রহস্যপ্রবণ লাগছে...। কিন্তু সারাদিন রহস্যপ্রবণ ও ভালো লেগেও সেই একই মানুষকে আবার হঠাৎই ভালো যে নাও লাগতে পারে, এটা বলতে সবাই পারেন না। সরল বিবেচনায় এই বিবৃতিকে কি খুব স্বাভাবিক লাগে ? না, লাগে না। সে কি আত্মপ্রেম-উৎসারিত ? হয়ত না। ঈর্ষাজাত ? হয়ত না। মনে হয়, এটি সমাজাভ্যন্তরে সৃষ্ট নানা তিক্ত বাস্তবতার কষাঘাতে ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে জন্ম নেয়া নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা, দ্বিচারিতারই অবশ্যম্ভাবী ফল।

মানুষ এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে ফিরছে।...
মানুষকে মারা আজ আর কোনো কঠিন ব্যাপার নয়; সব সহজ।

দেশকালপাত্র নির্বিশেষে আঁতকে ওঠার মতো বিবৃতি নয় এটি ? ১৯৭৪-এ মুদ্রিত হচ্ছে যে কবিতা, যাতে ধরা আছে এরকম ভয়ানক স্পর্শকাতর এক অভিজ্ঞতার বয়ান, তা প্রধানত কোন সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করে ? স্বাধীনতা উত্তরকালের প্রতিই তো! মাত্র ৯ মাসকাল ব্যাপ্ত সর্বাত্মক গণযুদ্ধে রূপ নেয়া আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত কিছু অস্ত্র দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেসামরিক লোকজনের মধ্যে থেকে গিয়েছিল। অথচ এর চেয়ে বেশি সময় ধরে গণযুদ্ধের পরও গণচীন ও ভিয়েতনামে এ ভয়াবহ বাস্তবতার প্রমাণ মেলে না। ব্যর্থতাটা কাজেই আমাদেরই। যাই হোক, সেসব ছুটঅস্ত্রের ব্যবহারও হচ্ছিল তখন সময়ে সময়ে। সঙ্গতভাবেই নানা অস্থিরতা বিরাজ করছিল তখন দেশে। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের তৎপরতা, অন্যদিকে দেশবিরোধীদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ভূমিকা, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব, রক্ষীবাহিনীর নজীরবিহীন অত্যাচার, গুপ্তহত্যা, বিনা বিচারে সাজা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা, লুটতরাজ এসব ছিল তখনকার নৈমিত্তিক বাস্তবতা। এরকম সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়া বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানবাধিকারহারা মানুষের পাশে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে ৩১ মার্চ ১৯৭৪-এ ড. আহমদ শরীফের সভাপ্রধানত্বে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সভায় ‘মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং আইনী সাহায্য প্রদান কমিটি’ নামে সচেতন নাগরিকদের একটি ফোরাম গঠিত হয়। গঠিত ৩৩ সদস্যের এই কমিটির সভাপতি ছিলেন কবি সিকান্দার আবু জাফর। পেশাগতভাবে সংবাদকর্মী হওয়ায় কবি আবুল হাসান এহেন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে দূরবাসী কেউ ছিলেন না। ১৯৬৯ থেকেই তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত দৈনিক গণবাংলা এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত দৈনিক জনপদে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। এ থেকে ধারণা করা যায়, তৎকালীন সমাজ-রাষ্ট্র পরিস্থিতির বিশদ বয়ান তাঁর নখদর্পণেই ছিল।

দলিলপত্রাদি জানান দেয়, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষাবস্থার সূচনা হয় সে বছর মার্চে। বিভিন্ন সূত্রে ওই খাদ্যাভাবের যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয় সেসবের মধ্যে ছিল নবগঠিত সরকারের প্রশাসনের ব্যর্থতা, ভূ-রাজনৈতিক পরাশক্তির ভূমিকা, মজুতদারি-কালোবাজারি ও চোরাচালানির প্রকোপ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রভৃতি, যদিও সেবছরে সংঘটিত ব্যাপক বন্যাকেও এর একটি কারণ হিসেবে দেখানো হয়। সে বছর পহেলা নভেম্বরে পূর্বোল্লিখিত কমিটির আয়োজনে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সিকান্দার আবু জাফরের সভাপ্রধানত্বে অনুষ্ঠিত সকল পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীদের সেসময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সমাবেশে গৃহীত প্রস্তাবে অবশ্য বলা হয়েছিল যে, এই মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতাকেও অতিক্রম করে গেছে এবং এই মন্বন্তর বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট হয় নি বরং শাসকশ্রেণি ও তাদের সহযোগীদের গণবিরোধী নীতিরই এটি প্রত্যক্ষ পরিণতি। সকল দুর্ভিক্ষই মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট, অমর্ত্য সেনের এ মতেও এ বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত হতে দেখি।

বলাই বাহুল্য যে, মন্বন্তর কখনো আকস্মিকভাবে শুরু হতে পারে না। তার কারণসমূহ দানা বাঁধতে থাকে আরো আগে থেকেই। এসব তখন দেশে যে অস্থিরতা তৈরি করেছিল, তার সাথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের যোগ স্বতঃপ্রমাণিত। এখানে ৪ এপ্রিল ১৯৭৪-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে ৭ জন ছাত্রনেতাকে গুলি করে মারা এবং এর জের হিসেবে কিছুদিন পরই শহীদুল্লাহ হলে আরো ৪ জনকে খুনের ঘটনাও উল্লেখ করা যেতে পারে, যা তৎকালীন অস্ত্রবাজির ভয়াবহতাকেই মূর্ত করে।

তৎকালীন এ বাস্তবতা খুব কি বদলেছে এ দেশে ? বরং দিনে দিনে তা আরো সত্যেই পরিণত হচ্ছে যেন। এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আরো সহজলভ্য। বাংলাদেশ এখন ট্রাক ট্রাক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পাচারের গুরুত্বপূর্ণ একটা রুটও বটে। মানুষ মারা এখন আরো সহজ। জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা হামেশাই তার প্রমাণ রেখে চলেছে। আর্জেস গ্রেনেড ছুড়ে মারছে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ। পিছিয়ে নেই সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশেষ এলিট ফোর্স র‌্যাবও। তারাও নিয়মিত গল্প ফাঁদছে ক্রসফায়ারের। প্রতিদিন একই গল্প পড়ে পড়ে মানুষ যতই ক্লান্ত হয়ে পড়ুক, এরপরও মিডিয়ার কল্যাণে তাদের পড়তেই হচ্ছে এইসব অনবদ্য ফিকশন।

মাত্র গত ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া বিডিআর সদরদপ্তরের ঘটনাটির কথা ভাবলে কেমন লাগে ? যে অস্ত্র সীমান্ত রক্ষার জন্য, যে অস্ত্র দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য, সে অস্ত্র কীভাবে ‘রহস্য’রক্ষায় ব্যয়িত হলো! অজস্র প্রাণ গেল, খোয়া গেল সহস্রাধিক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র, যেগুলো আবারো ব্যবহৃত হবে হয়ত মানুষ মারায়ই। এসব ঘটনা কি প্রমাণ করে না যে মানুষ মারা আজো খুব কঠিন কিছু হয়ে যায় নি ? এরকম প্রেক্ষাপট আজো সত্য বলে প্রতিভাত হয় কবিতাটির উৎকলিত পঙক্তি।

জর্জর সঙ্গম, ফুল, জন্মে জেগে ওঠা মৃত্যু, অন্ধকার।...
কোনোকিছু, আজ কোনোকিছু কঠিন ব্যাপার নয়।
... বেরিয়ে আসছে বিষ, ক্ষয়, মৃত্যু ও জরা।
ফুলের মালায় বেরিয়ে আসছে অবেলায় অজগর।

কবিতাটির এ অংশের সাথে একাত্তরের অভিজ্ঞতা যদি মিলিয়ে দেখা হয় তো কী অর্থ দাঁড়ায় ? আমরা সবাই জানি, তৎকালীন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নারীদের প্রতি যে বীভৎস আচরণ করা হয়েছে, তা রীতিমতো রোমহর্ষক। প্রামাণ্য দলিলপত্র এরকম যুদ্ধাহত নারীর সংখ্যা আড়াই লক্ষ বলে দাবি করে। এ কবিতার ‘জর্জর সঙ্গম’কে যদি ওরকম বর্বর আচরণ হিসেবেই দেখা হয়, তা কি খুব ভুল দেখা হবে ? এ সঙ্গমের পরিণতিতে জরায়ুতে যে ফুল বা মানবভ্রূণ জন্মেছে ও জন্মায়, সে ভ্রূণের জন্মমৃত্যু যুগপৎ সংঘটিত হয়েছে ও হয়, বস্তত তাই হয়ত স্বাভাবিক এক্ষেত্রে। একাত্তর পরবর্তী সময়ে শতসহস্রবার শতসহস্র ক্ষেত্রে জন্মের শুভক্ষণে জেগে উঠেছে এমন করুণ মৃত্যু। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই মৃত্যু কেবল ছিল না ভ্রূণের, ছিল ওই ভ্রূণের জন্মদাত্রীরও। এহেন বীভৎস অন্ধকার কেবল একাত্তরের বাস্তবতাই কি, নাকি আজকেরও ? এ অন্ধকার কি আজো ঘিরে রাখে নি আমাদের সমাজকে ? ব্যাপার একই, কেবল যা সংখ্যায় লঘু। এসব তখনো কঠিন ব্যাপার ছিল না, আজো সম্ভবত নয়। নইলে প্রতিদিনই কাগজে এত এত ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির খবর পড়তে হবে কেন আমাদের?

এর সবই হয়ত সমাজের একাংশের পচে যাওয়ার লক্ষণ। আর তারই ক্ষরণ কথিত বিষ, ক্ষয়, মৃত্যু ও জরা। এসব মানুষকে বানিয়েছে প্রতারকও। একজনকে ঠকিয়ে অন্যজনের বেঁচে ওঠা, ফুলেফেঁপে ওঠা। এসব আর কত দেখবে মানুষ, অদ্যাবধি ? এসব দেখতে দেখতেই না ভালোবাসাকেও মানুষ সন্দেহযুক্ত করে দেখে! এখনো কি অনেক ক্ষেত্রেই এমন করে দেখতে হয় না আমাদের ? ফুলের মালাকেও নিছক ফুলের মালা ভাবলে ভুল করা হয় না ? কারণ তাতে নিহিত থাকে সংশয়, ভীতি, মৃত্যুর বীজ, অজগররূপে, প্রায়শ।

এই যে আর্থ-রাজনৈতিক সমাজচিত্র, এ কী কাম্য হতে পারে কারো ? পারে না। যা কাম্য, তা যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে তখন তা ব্যর্থতা বলে গণ্য। এ ব্যর্থতা ব্যক্তির, সমাজের, রাষ্ট্রের। কিন্তু সে ব্যর্থতাকে কবি বলছেন সুন্দর। আদতে যা কোনোভাবেই সুন্দর নয়। এ ব্যাজস্তুতি, কবির, মন্দ বুঝাতেই এখানে ভালো বলা। যদিও এ ব্যর্থতা সবার নয়। সামাজিক-অর্থনৈতিক অসাম্য এখনকার মতো তখনকারও বাস্তবতা। তখনো একদল মানুষ নিজেদের ও নিজেদের সম্পদ নিরাপদ রাখতে কুকুর পুষেছে, ফুলের বাগান সাজিয়েছে, নিভৃতে নিজের ভিতরে চুপ করে থেকেছে। এখনো কি অন্যরকম কিছু ঘটে গেছে দেশে ? না, একদমই না। বাইরে তাদের চোখ নেই। বাইরে কেউ না-খেয়ে আছে, চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে, সেটা তার/তাদের দেখবার সময় নেই, রুচিও নেই। নিজে বাঁচাই তার/তাদের ধর্ম। এ অবস্থার প্রকাশ কবি করছেন এইভাবে যে,

সুন্দর ব্যর্থতা ঝরছে দোরগোড়ায়।...। মানুষ লিখতে পারছে
কুকুর হইতে সাবধান, বাগানের ফুল ছিঁড়িও না আর নীরবতা আবশ্যক

সন্দেহ নেই এ সভ্যতারই শিক্ষা। কিন্তু এও কি তারই, মানে কথিত সভ্যতারই শিক্ষা নয় ?

ফুল ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে ফের বলছে ফুল ছিঁড়িও না।
কুকুরের মধ্যে ফের কুকুর বসিয়ে ফের বলে উঠছে কুকুর হইতে সাবধান।

কবিতাটির এ অংশ একেবারেই নির্মম-নির্দয় প্রহারসম। ঘনিষ্ঠ পাঠমাত্র সপাং চাবুকের আঘাত যেন এসে লাগে পাঠকেরই পিঠে। আত্মসমালোচনায়ও প্রবৃত্ত করে তাকে, পাঠককে। এরকম পরস্পরবিরোধী আচরণ কি আমরা হরহামেশাই করি না, যা বস্তুত দ্বিচারিতারই নামান্তর ? নিয়ত পাপে প্রবৃত্ত থেকে তার সমস্ত আলামত সযত্নে আড়াল করে অন্যকে সেই পাপ না-করবার উপদেশ বিতরণে আমাদের জুড়ি মেলা ভার! মানুষমাত্রেরই বুঝি এই হাল, বিশেষভাবে অসৎ চতুরজনের ?

আমরা দেখি আমাদের সমস্ত জাতীয় ক্রিমিন্যাল, যাঁদের অঙ্গুলি হেলনে জাতিরও অনেক কিছু আসে যায়, তাঁরা নিজেরা যখন ডায়াসে দাঁড়ান তখন তাঁদের মুখে প্রায়শই নীতিবাক্যের খই ফুটতে থাকে। অথচ ট্র্যাজেডি এই, কথিত উচ্চারিত নীতির অনুসারী তাঁরা নিজেরা হলে যাদের উদ্দেশ্যে নীতিবাক্যগুলো আওড়ানো হচ্ছে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কিছু সুফল পেয়ে যেতে পারত। যেহেতু তাঁরাই সেসব শ্রোতা-দর্শকের হর্তাকর্তা বিধাতা।

আমরা আমাদের সরকারগুলোর দিকে যদি তাকাই তো সাদা চোখেই দেখতে পারি যে ফুল ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে তারা ফুল না-ছিঁড়বার পরামর্শ বিতরণে অহর্নিশ কত পেরেশান থাকে। এ খাতে সরকারসমূহকে অনেক বিনিয়োগ করতেও দেখি আমরা। দেখি যে নিজেরা গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে মাটিচাপা দিয়ে তার ওপরে ঘাসের বাগান তৈরি করে বিরোধীদের গণতন্ত্র শেখানোর জন্য যথেচ্ছ টিউটোরিয়াল খুলে বসে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের বিশেষ কোনো কালখণ্ডের নয়, সব সময়ের।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর আরো বড়ো উদাহরণ মেলে। পৃথিবীর যারা হর্তাকর্তা আজকাল, ধরা যাক মাস্তানরাষ্ট্র ব্রিটিশ-আমেরিকার কথাই। গোটা পৃথিবীকে এরা নিজেদের খেতখামার বলে ভাবে। যখন তখন পাঁজন হাতে হাল জুড়ে দেয় যে কারো যেকোনো ক্ষেতে। যথেচ্ছ ফসল ফলায়, অন্যের খোলানে মাড়াই সম্পন্ন করে ফসল নিয়ে ওঠায় নিজেদের গোলায়। যেন ওসব তাদেরই অধিকারের ধন। অন্যেরা যখন বাধ্য হয়েই এসব অপকর্ম ঠেকাতে যায়, তখন তাদের নিষ্ঠুরভাবে প্রতিহত করে। এবং অবাধ্যদের বিপ্লব-বিদ্রোহের গায়ে ছাপ মেরে দেয়া হয় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে। ঘোষণা দেয় যে, এরা মানবতাবিরোধী, এদের মারো, কাটো, নিশ্চিহ্ন করে দাও। দিচ্ছেও। বাড়ছে তাতে সন্ত্রাস, আর ঘটছে মানবাধিকার লঙ্ঘন। লাঠিয়ালই লাঠিয়াল অপবাদ দিয়ে একঘরে করে রাখছে অবাধ্যকে। এই বুঝি তবে কুকুরের (সন্ত্রাসের) মধ্যে কুকুর (সন্ত্রাস) বসানো এবং চ্যাঁচিয়ে বলে চলা যে কুকুর (সন্ত্রাস) হইতে সাবধান। আয়রনি হলো, এরাই পৃথিবীবাসীকে হুঁশিয়ার করে চলেছে যে তোমরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করো না, করবে তো মরবে। এবং সত্যি সত্যি মারা হচ্ছেও। যথেচ্ছ।

কে না জানে, জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাতীয় কথিত স্বাধীন সংস্থাগুলো এদেরই করায়ত্তে ? এসব সংস্থা তাদের কোনো নিয়মনীতিই কথিত মাস্তান রাষ্ট্রসমূহের ওপরে কার্যকর করতে পারে না। তবে সুযোগ একটা রাখা হয়, সেটা হলো, যার মানবাধিকার তাদের দ্বারা লঙ্ঘিত হয়েছে বা হচ্ছে তারা এসব সংস্থায় গিয়ে সখেদে কথা বলতে পারেন, আপিল করতে পারেন, যদিও সংস্থাদ্বয়ের কানা পয়সার ক্ষমতাও নেই যে বিচারপ্রার্থীর হয়ে কিছু করে। নিপীড়িতরা যে তাদের আপিলটা ওখানে করতে পারছে এ নিয়েই তাদের খুশি থাকতে হয়। ওইসব সংস্থা এবং তাদের নিপীড়িতবান্ধব নিয়মনীতি নিপীড়িতের মন খুলে কান্নাকাটি করবারই জায়গা, একবার কোনো এক লেখায় সম্ভবত এরকমটিই বলছিলেন কলিম খান।

কাজেই খুব নির্বিঘ্নে যাতে কান্নাপর্বটা সমাধা হতে পারে সে সুযোগ দেয়াটাই এসব সংস্থার উদারতা, এদের আলটিমেট অর্জনও বস্তুতপক্ষে ওটাই, সান্ত্বনাওষুধ বিতরণ। এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় আমাদের চিরাচরিত এই প্রবচন দিয়েও যে, ওরা যখন তখন আমাদের গরু মেরে যতখুশি জুতা দান কার্যক্রম পরিচালনা করে যায়। এরা বস্তুতপক্ষে ওই কথিত জুতাদানেই নিরত, পৃথিবীব্যাপী। এই পরিস্থিতিকে মূর্ত করা যায় বাংলা লোকগানের এই পঙক্তি দিয়েও যে, তুমি ‘সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো...’। বন্ধু হাসান মোরশেদের থেকে ধার করে এ-ও কি একে বলা যায় না যে, ওরা আছাড় দিয়ে কোমর ভেঙে তারপর বিনামূল্যে ক্র্যাচ প্রদানের বদান্যতাটুকু দেখায় ও বিজ্ঞাপিত করে। এসবকে এখন বাইরে পরিপাটি সভ্যতার গায়ের পুঁজওয়ালা দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষত না-ভেবে আর কী ভাবতে পারি আমরা ?

এই-ই সব। আর এ কারণেই কবিচিত্ত আলটিমেট কথাটা শেষবাক্যে এসে জানান দেন যে, এই চতুর-জটিল মানুষকে সারাদিন রহস্যপ্রবণ লাগলেও, ভালো লাগলেও শেষপর্যন্ত তাদের আর ‘ভালো লাগছে না।’ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, মূর্ত-বিমূর্ত, বাহ্য-অন্তর্গত সমস্ত অর্থানন্দের পাশে এই কন্ট্রাস্টটিই এই কবিতার সৌন্দর্যকে পাঠকের চিন্তা ও নন্দনভাবনার সমান্তরাল উচ্চে উঠিয়ে দেয়। কবির অবজারভেশনটা অনেকটাই সর্বসাময়িক, এরকম মনে করায়। আমাদের বিশ্বাস করায় যে, অপ্রিয় হলেও কিছু সত্যের সাথে একটুখানি দেখাসাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিলেন আমাদের প্রিয় কবি আবুল হাসান, যিনি এক স্বঘোষিত পাথর, যার গায়ে কেবলি লাবণ্য ধরে।

যৌনকর্মীর কর্ম অথবা কে তোরে পতিতা বলে মা!

ধারণা করা হয়, নারীজাতি একসময় স্বাধীন ছিল। নারী-পুরুষ উভয়ে তখন জীবিকার জন্য মিলিতভাবে খাদ্যদ্রব্যের সন্ধান করত এবং যথেচ্ছ ভোগ করত। ভোগে-ত্যাগে উভয়ের অধিকারই তখন ছিল সমান। ক্রমে উৎপাদনের উপায়সমূহ ব্যক্তি মালিকানায় (অবশ্যই পুরুষদের হাতে) চলে যাবার মাধ্যমে সামাজিক শ্রম বিভাজন শুরু হয় এবং তখন থেকেই উৎপাদিত দ্রব্য পণ্য বলে বিবেচিত হতে থাকে। আজ অবধি উৎপাদিত দ্রব্য পণ্য বা কমোডিটি বলেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পণ্যদ্রব্য কেবল ‘প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক প্রয়োজন মেটানো’ হলেও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটা মুনাফার দিকে হেলে পড়া। এ অর্থব্যবস্থায় শ্রমশক্তির উৎপাদনই কেবল পণ্যদ্রব্য পদবাচ্য নয়, এমনকি শ্রমশক্তিও সেখানে পণ্যদ্রব্য। এই সংজ্ঞাভাষ্যের সীমাকেও অতিক্রম করে নারী যখন বাধ্য হয়ে বা স্বেচ্ছায় ভোগ্যা হিসেবে নিজের মহিমা থেকে অবনত, তখন গোটা নারীমানুষটিই পরিণত হয় পণ্যে। এখানে সে শ্রম দিয়েও প্রচলিত অর্থে শ্রমশক্তি হিসেবে স্বীকৃত হয় না, হয় ভোগ্যবস্তুরূপে।1 এই প্রবন্ধে নারীর এরকম ভোগ্যপণ্য হয়ে ওঠার ইতিহাস এবং ভোগবাণিজ্যের বর্তমান গতি-প্রকৃতি অনুসন্ধানেরই চেষ্টা করা হবে।

আমরা জানি, ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার এক নবতর সৃষ্টি হলো বিশ্বায়ন ধারণা। কাভালজিৎ সিংয়ের মতে, বিশ্বায়ন এমন এক বিশ্বের ধারণাকে তুলে ধরে যেখানে জটিল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াগুলির ক্রিয়াশীলতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত বা জাতীয় সীমারেখার কোনো ভূমিকা থাকবে না।2 বিশ্বায়নের আওতা এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যবস্থার প্রধান মনোযোগের কেন্দ্র অর্থনীতি অর্থাৎ মুনাফা। আর তাই এই ব্যবস্থা সবকিছুকেই পণ্যীকরণের দিকে নিয়ে যেতে চায়– বস্তুকে তো বটেই, এমনকি মানুষকেও। বস্তুর নিজের ভালোমন্দ কোনো কিছুই ভাববার-বলবার নেই, কিন্তু মানুষের আছে। মানুষ নিজে পণ্য হবার ব্যাপারে আপত্তি জানাতে পারে এবং পণ্যসংস্কৃতি বা পণ্যীকরণ প্রথাকে প্রতিরোধের লক্ষ্যে আন্দোলনও করতে পারে– কিন্তু কোনো-না-কোনোভাবে পণ্য ব্যবহার ব্যতিরেকে টিকে থাকতে পারে না। মানুষই পণ্যীকরণ প্রথা চালু করেছে ও টিকিয়ে রেখেছে। মানুষই পণ্য সরবরাহকারী এবং মানুষই এর ভোক্তা, যদিও সকল পণ্য সকল মানুষের প্রয়োজনে লাগে না, সকল পণ্যের প্রতি সকলে আকর্ষণ বোধ করে না এবং সকল পণ্যের সুবিধা ভোগে সকলে সক্ষমও হয় না।

আমরা দেখতে পাই, এই পণ্যদুনিয়ায় পণ্য হবার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে বিপ্লব-বিদ্রোহ যেমন জারি করা আছে, তেমনি তার চতুর্গুণ শক্তিতে মানুষ, বিশেষ করে নারীমানুষকে পণ্য করবার নেটওয়ার্কসমূহের জোয়ার সুনামির মতো প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। আর এই সুনামির মূল প্রতিপাদ্য যৌনবাণিজ্য ও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফা। এর তীব্রতা এতই প্রবল যে সেটি গোটা সভ্যতাটিকেই যেন আজ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত।

২.
অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পবিত্র পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হিরোডেটাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪-খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র পতিতাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হতো এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসেবে একজন বিদেশীর সাথে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হতো। একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হতো সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতেও সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও। ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল, যদিও কয়েকজন প্রফেট, যেমন ইজাকেইল, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে পতিতারা ছিল স্বাধীন এবং তারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করা ও কর দেবার ব্যাপারে আদিষ্ট ছিল। গ্রিক হেটায়েরার মতো জাপানে ছিল জেইসার।

পাশ্চাত্য সভ্যতার জতুগৃহ প্রাচীন গ্রিকের এথেনাইয়ের কবি সোলোন (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩০-খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯০), যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসেবে গণ্য হতেন, খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম পতিতালয় স্থাপন করেন। এই পতিতালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে ব্যাপকভাবে পতিতাবৃত্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং পৌরসভার মাধ্যমে পতিতালয়সমূহ পরিচালিত হতে থাকে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর জীবৎকাল নিয়ে পণ্ডিতে-পণ্ডিতে মতদ্বৈধতা আছে। তবে অনেকের মতে কৌটিল্য বেঁচেছিলেন মৌর্য শাসনামলে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, তিনি প্রথম মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কাউন্সেলর ও উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত অর্থশাস্ত্রের মতে, দেহব্যবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপন নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এর অনুমোদন করে এবং সংগঠকের ভূমিকা নেয়। ঋগ্বেদ এবং জাতকেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পণ্ডিতরা। এমনকি কৌটিল্যের সময় দেহব্যবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এ শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন।3

কৌটিল্য জানান যে, তখন দেহব্যবসা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রীক। নগরজীবনের অবশ্যঅঙ্গ ছিল এটি। রাজকোষের আয়ের যে বিভিন্ন উৎস ছিল তার মধ্যে ‘দুর্গ’ নামক বিভাগটিতে বেশ্যা, জুয়াখেলা ও আবগারী বিভাগের পরিদর্শকের কথা বলেছেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রে এমনকি গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে। তাঁর কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করা। পৃথিবীর অনেক দেশ, যাদের প্রধান আয় পর্যটন শিল্প নির্ভর, সেসব দেশে এখনো সরকারি তত্ত্বাবধানেই দেহব্যবসা পরিচালিত হয়। এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রও এখনো এ প্রথাকে অনুমোদন করে যাচ্ছে পতিতাবৃত্তিতে আগ্রহী যেকোনো আঠারো বছর বয়সোত্তীর্ণ নারীকে দেহব্যবসা চালাবার জন্য লাইসেন্স দিয়ে, সারাদেশে ১৪টি পতিতালয় পরিচালনা করে এবং সেখান থেকে ট্যাক্স গ্রহণ করে।4

৩.
প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস প্রথম মৌর্যশাসক চন্দ্রগুপ্তের সময়ে ভারতে এসেছিলেন। তিনি তাঁর রচিত গ্রন্থে এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যারা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের ওপর গণিকাদের সহায়তায় নজর রাখতেন এবং রাজার কাছে গোপন রিপোর্ট দিতেন। স্টার্নবাকের মতে, গণিকা মানে সরকারি কর্মচারী। অন্য যেকোনো সরকারি কর্মীর মতোই এরা। কৌটিল্য এই অর্থেই ব্যবহার করেছেন শব্দটি।5 অর্থশাস্ত্রে গণিকারা ছাড়াও সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যারা দেহব্যবসা করতেন তাদের একটি তালিকা দেয়া আছে– যথা পুংশালী অর্থাৎ সাধারণ দেহব্যবসায়ী, সুরাসুন্দরী অর্থাৎ পানশালার ওয়েটার, বন্ধকী অর্থাৎ ঘটনাচক্রে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়া গৃহবধূ, বেশ্যা অর্থাৎ কারুকুশীলব বা গুপ্তচর, সাধ্বি-ব্যঞ্জনা অর্থাৎ সতীত্বের ভান করে থাকা পুলিশের গুপ্তচর, দেবদাসী অর্থাৎ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র বারাঙ্গনা, পরিব্রাজিকা অর্থাৎ আড়কাঠি বা দালাল। এঁদের সামাজিক মর্যাদা ছিল রাজঅনুগ্রহপুষ্ট গণিকাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। যুদ্ধক্ষেত্রে, শিকারে এবং আরো অনেক সময় রাজার সঙ্গে গণিকাদের থাকবার কথা লিখেছেন গ্রিক লেখকরা। মহাভারতেও গণিকাদের বর্ণময় জীবন ও রাজকীয় জাকজমকের বর্ণনা আছে। যেমন উদ্যোগপর্বে কৌরবপক্ষের বেশ্যাদের কাছে যুধিষ্ঠির শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণ যখন শান্তির জন্যে দৌত্য করতে আসেন তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানান গণিকারা। রামায়ণে দেখা যায়, রাম ভরতকে জিজ্ঞাসা করছেন যে তিনি গণিকা, ঘোড়া ও হাতির ব্যাপারে সন্তুষ্ট কি না। জৈন লেখক হেমচন্দ্রের লেখায় একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ আছে যে, রাজা নন্দ গণিকার গর্ভজাত এক নাপিতের সন্তান। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে বিখ্যাত গণিকা অম্বাপালী, সালাবতী, সামা, সুলমা ছাড়াও এমন অনেকের কথা বলা আছে, যারা বুদ্ধি ও শিল্পীত দক্ষতার গুণে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ তৎকালীন গণিকা নারীরা সমাজে-রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান পেতেন এবং সাধারণ সভ্যসমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়া রাজরাজড়ারাও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। তাদেরকে যখন তখন যে কেউ ভোগার্থে ব্যবহার করতে পারত না কিংবা মন্দ কথা বলতে পারত না। এমনকি গণিকাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিরও অধিকার ছিল। রাজকোষ থেকে বেতন ছাড়াও তাঁরা অলংকার, পোশাক-আশাক, অন্যান্য উপঢৌকন, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি লাভ করতেন। কোনো গণিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে বা তাঁর অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে বলপূর্বক দেহমিলনের চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ আর্থিক সাজা হতো।

৪.
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেশ্যাবৃত্তি হলো স্বামী বা বন্ধুকে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে নগদ অর্থ বা মূল্যবান অন্যকিছুর বিনিময়ে বাছবিচারহীনভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই বেশ্যাবৃত্তি এখন আর শিল্পের পর্যায়ে নেই। তবে নারীর রূপ, যৌবন ও শরীরের বাণিজ্যিক ব্যবহার, যেমন পর্নো ওয়েবসাইট তৈরি, পর্নো সিডি তৈরি, ফ্যাশন শো, অশ্লীল চলচ্চিত্র নির্মাণ, পর্নো ম্যাগাজিন প্রকাশ, বিজ্ঞাপনচিত্রে উদ্ভট ও অশ্লীল কায়দায় নারীমডেল ব্যবহার ইত্যাদি মাধ্যমেও নারীত্ব প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছে, যদিও এগুলো শিল্প নামধেয়। সরাসরি দেহব্যবসা দিয়ে তো বটেই, এমনকি এসব শিল্পমাধ্যমে নারীকে অশ্লীল কায়দায় ব্যবহার করেও বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা করা হচ্ছে। কৌটিল্যের সময় থেকে আমরা প্রায় আড়াই হাজার বছর অতিক্রম করে এসেছি। দাবি করি যে আমরা সভ্যতার চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছি। আর তার নমুনা হলো এই যে, এখন বলপূর্বক গণিকাসঙ্গ করলে কারো কোনো শাস্তি হয় না। আর এ কারণেই সাধারণ-সতীসাধ্বী কোনো অসহায় নারী ধর্ষিত হলেও আদালতে তাঁকে দুষ্টচরিত্রের নারী অর্থাৎ পতিতা প্রমাণ করবার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবী যদি এটি প্রমাণ করতে পারেন, তবে আসামির কোনো শাস্তি হয় না অথবা শাস্তি হলেও তা হয় নামমাত্র। গণিকাধর্ষণ সভ্য সমাজের আদালতে বড়ো কোনো অপরাধ হিসেবেই গণ্য হয় না। বরং উলটো ঘটনা আমরা আমাদের গ্রামসমাজে হামেশাই ঘটতে দেখি যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীকেই প্রধান অপরাধী হিসেবে বিচার করা হয়। বলা হয়, ধর্ষিতা ধর্ষককে প্রলুব্ধ করেছেন। তাই তাঁকে ১০১ দোররা মারা হয়, মাথা মুড়িয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয় কিংবা মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হয়। যারা এসব ফতোয়ায় কাজির দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা অবশ্যই হন পুরুষ, এবং তাঁরা সেরকম পুরুষ, খোঁজ নিলে যাঁদের বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসঙ্গের একাধিক ঘটনার প্রমাণ মিলবে। এমনকি ইতঃপূর্বে যাঁরা হয়ত দুয়েকটা ধর্ষণ ঘটনারও নায়ক ছিলেন। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় সে খোঁজ নেবার অবস্থা সত্যিকারার্থেই এখনো তৈরি হয় নি। কারণ সমাজ সেটার কোনো প্রয়োজনই বোধ করে না। যেহেতু আমাদের সমাজে পুরুষের একাধিক নারীসঙ্গ করাকে কোনো দোষের ব্যাপার বলেই মনে করা হয় না।

এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বাইবেলের একটি গল্প তুলে ধরা যায়– ‘যীশু জৈতুন পর্বতে গেলেন। আর প্রত্যুষে তিনি পুনর্বার ধর্মধামে আসিলেন ; এবং সমুদয় লোক তাঁহার নিকটে আসিল ; আর তিনি বসিয়া তাহাদিগকে উপদেশ দিতে লাগিলেন। তখন অধ্যাপক ও ফরীশীগণ ব্যভিচারে ধৃত একজন স্ত্রীলোককে তাঁহার নিকটে আনিল, ও মধ্যস্থানে দাঁড় করাইয়া তাঁহাকে কহিল, হে গুরু, এই স্ত্রীলোকটি ব্যভিচারে, সেই ক্রিয়াতেই ধরা পড়িয়াছে। ব্যবস্থায় মোশি এই প্রকার লোককে পাথর মারিবার আজ্ঞা আমাদিগকে দিয়াছেন ; তবে আপনি কী বলেন ? তাহারা তাঁহার পরীক্ষাভাবেই এই কথা কহিল, যেন তাঁহার নামে দোষারোপ করিবার সূত্র পাইতে পারে। কিন্তু যীশু হেঁট হইয়া অঙ্গুলি দ্বারা ভূমিতে লিখিতে লাগিলেন। পরে তাহারা যখন পুনঃ পুনঃ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল তিনি মাথা তুলিয়া তাহাদিগকে কহিলেন, তোমাদের মধ্যে যে নিষ্পাপ, সেই প্রথমে ইহাকে পাথর মারুক। পরে তিনি পুনর্বার হেঁট হইয়া অঙ্গুলি দিয়া ভূমিতে লিখিতে লাগিলেন। তখন তাহারা ইহা শুনিয়া, এবং আপন আপন সংবেদ দ্বারা দোষীকৃত হইয়া, একে একে বাহিরে গেল, প্রাচীন লোক অবধি আরম্ভ করিয়া শেষ জন পর্যন্ত গেল, তাহাতে কেবল যীশু অবশিষ্ট থাকিলেন, আর সেই স্ত্রীলোকটি মধ্যস্থানে দাঁড়াইয়াছিল। তখন যীশু মাথা তুলিয়া, স্ত্রীলোক ছাড়া আর কাহাকেই দেখিতে না পাইয়া, তাহাকে কহিলেন, হে নারী, যাহারা তোমার নামে অভিযোগ করিয়াছিল, তাহারা কোথায় ? কেহ কি তোমাকে দোষী করে নাই ? সে কহিল, না, প্রভু, কেহ করে নাই। তখন যীশু তাহাকে বলিলেন, আমিও তোমাকে দোষী করি না ; যাও এখন অবধি আর পাপ করিও না।’6 এই গল্পের মর্মার্থ ব্যাখ্যা করবার দরকার নেই। বাইবেলের যুগের অধ্যাপক ও ফরিশীগণের মতো আমাদের ফতোয়াবাজরাও নিষ্পাপ নন। তাঁদের থেকে এখনকার ফতোয়াবাজদের সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকু এই যে, তাঁরা আপন সংবেদ দ্বারা তাড়িত হলেও এঁরা তা হন না।

৫.
অনেকের মতে বিষ্ণুগুপ্ত, চানক্য, কৌটিল্য একই ব্যক্তি। এমনকি কেউ কেউ বলেন কৌটিল্যই বাৎসায়ন। তা যাহোক, এ ব্যাপারে প্রমাণ হাজির করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বাৎসায়ন রচিত কামশাস্ত্র বা কামসূত্র গ্রন্থের বৈশিকাখ্যং অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘রুচি হইতে যে পুরুষগ্রহণপ্রবৃত্তি তা স্বাভাবিক আর অর্থার্জনার্থ যে প্রবৃত্তি তা কৃত্রিম।’7 বাৎসায়ন বর্ণিত অর্থার্জনার্থ এই কৃত্রিম প্রবৃত্তিই নিন্দার্হ। এ প্রবৃত্তিই বর্তমান বিশ্বে এক নম্বরের বাণিজ্যবিষয়, অনেক দেশের রাজকোষের অর্থের এ প্রবৃত্তিই প্রধান উৎস। তবু বিভিন্ন কারণে দেহব্যবসাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলেন কৌটিল্য। অবৈধ নারীসংসর্গ বোঝাতে তিনি ‘বাহ্যবিহার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ‘বাহ্যবিহার’-এর পক্ষে বা বিপক্ষে স্পষ্ট করে কিছুই বলেন নি তিনি। বাৎসায়ন বলেছেন, গণিকা অথবা বিধবাদের সঙ্গে যৌনমিলন সমর্থন করা হয় না আবার নিষিদ্ধও নয়। লেকির মতে, গণিকাবৃত্তি হলো সমাজের মাত্রাতিরিক্ত যৌনকামনা বেরিয়ে যাওয়ার একটি সেফটিভালভ। তাঁর মতে, নিজে মূর্তিমতি পাপ হলেও পরিণামে পুণ্যের জিম্মাদার এই গণিকা। সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত এরা না থাকলে– নানা মত আসে যায় কিন্তু সমাজের বিষ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠী হয়ে রয়ে যায় মানবিকতার এই পূজারিণীরা। বার্ট্রান্ড রাসেল লেকির মত সম্পর্কে বলেন, নীতিবাগীশরা লেকির মুণ্ডুপাত করেছেন। লেকি তাদের কেন ক্ষেপিয়ে তুলেছেন তাঁরা নিজেরাই তা জানেন না। আবার লেকি যা বলেছেন সেটা অসত্য বলেও তাঁরা প্রমাণ করতে পারেন নি।8

যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা-না-করা প্রশ্নে, পুনর্বাসন প্রশ্নে, নৈতিকতা প্রশ্নে, ধর্মীয় প্রশ্নে, অধিকারের প্রশ্নে আমাদের দেশেও এরকম তর্ক-বিতর্ক আমরা অনেক শুনেছি কয়েকবারের চেষ্টায় কয়েকটি পতিতালয় উচ্ছেদের সময়ে। কিন্তু লক্ষণীয় যে পতিতাবৃত্তি টিকিয়ে রাখবার পক্ষে দেয়া সর্বকালের সকল মতই হলো পুরুষদের। কারণ এ প্রথার ভোক্তা পুরুষরাই। সরাসরি পতিতাবৃত্তির পক্ষে নারীনেত্রীদের সাধারণত মত দিতে দেখা যায় না। তবে এ বিবেচনায় নারীনেত্রীদের মধ্যে দু’টো স্পষ্ট ভাগ আছে। এক ভাগের নেত্রীরা পতিতাবৃত্তিকে পুরোপুরি যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ হিসেবে দেখেন। তাঁরা চান এ প্রথা চিরতরে বন্ধ হোক। এই ভাগের নারীনেত্রীদের চেষ্টায় ১৯৯৯ সালে সুইডেনে একটি আইন করা হয়েছে, যেখানে যৌনতা বিক্রি কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু যৌনতা ক্রয় রীতিমতো অপরাধ। এই আইন ভোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে যৌনসেবা ক্রয়ে। আর ক্রেতা যখন থাকবে না তখন এটি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। আরেক ভাগ এটিকে পতিতাদের অধিকার, নিজস্ব ইচ্ছা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে দেখেন। তাঁরা পতিতাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, যথার্থে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না-করে পতিতালয় উচ্ছেদের বিরোধিতা করেন এবং এই পেশাকে কর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বলেন। দেহব্যবসায়ে নিয়োজিতদের পতিতা, বেশ্যা, গণিকা, খারাপ মেয়েছেলে ইত্যাদি না-বলে যৌনকর্মী এবং তাদের কর্মকে যৌনকর্ম বলার পক্ষে পৃথিবীব্যাপী তাদের আন্দোলনও জারি করা আছে। এই দল জার্মানিতে আইন সংস্কারের জন্য চেষ্টা করার ফলে গত ২০০২-এ সে দেশে যৌনকর্ম একটি নিয়মিত পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও ওই আইনে যৌনকর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত আছে। সারা পৃথিবীতেই এসব দাবিতে আন্দোলন সচল আছে। পশ্চিমবঙ্গের দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি এবং বাংলাদেশের দুর্জয় নারী সংঘও এরকম দাবিতে সক্রিয়।

৬.
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বা হতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা যেভাবেই হোক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন। এক দিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এ পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। একটি বড়ো শহরের সবকটি বড়ো বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে শহরে যেরকম দুর্যোগ নামবে, এটিকেও সেভাবেই দেখা দরকার। ১৮৫৩-য় তৈরি এক পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতার তৎকালীন চীফ ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়ট গোটা কলকাতা শহরে ৪০৪৯টি বেশ্যাগৃহ আছে বলে স্বীকার করেন, যাতে বাস করছিলেন মোট ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। অর্থাৎ গৃহপ্রতি যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল ৩ জনেরও অধিক। ১৮৬৭-তে কলকাতার হেলথ অফিসার ফেভার-টোনার যৌনকর্মীর সংখ্যা ৩০,০০০ জন নির্ধারণ করেন। ১৯১১-র আদশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪২৭১ জনে। ১৯২১ এবং ১৯৩১-এর আদমশুমারিতে উল্লিখিত সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০,৮১৪ এবং ৭,৯৭০ জনে। কিন্তু ১৯৩২-এ বেঙ্গল উইমেনস ইউনিয়নের সভানেত্রী দাবি করেন যে পুলিশের হিসেবে কলকাতার যৌনকর্মীর সংখ্যা ২০,০০০ জন।9 ১৯৩২-এর পরে অনেক দিন বয়ে গেছে। এর মধ্যে ভারতবর্ষে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। বিশ্বায়নের থাবায় দিকে দিকে দারিদ্র্য আরো বেড়েছে, বেড়েছে পাচার, বেড়েছে উন্মত্ততা। ফলে বর্তমানে কলকাতা শহরে যৌনকর্মীর সংখ্যা বেড়েছে বৈ তো নয়। দেবাশিস বসুর দেয়া তথ্য মতে, ১৯৯৩-এ অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের মহামারীতত্ত্ব বিভাগ যে জরিপ চালায় তাতে কলকাতা ও হাওড়া শহরে মোট ১৯টি যৌনপল্লি চিহ্নিত হয়। প্রতিটি পল্লিতে যদি গড়ে ২০০ করে গৃহও ধরা হয়, তাহলে মোট গৃহ দাঁড়ায় ৩৮০০টি, এবং গৃহপ্রতি ৩ জন করে ধরলে যৌনকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১,৪০০ জন। ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা যদি ৮,৬০০ ধরা হয় তবে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২০,০০০ জনে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির হিসেবটা ঠিক এরকমই। তাদের মতে, কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে ব্রথেল-বেসড ১২,০০০ জন এবং ফ্লটিং ৮,০০০ জন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই অঙ্কে আবাসিক হোটেল এবং ফ্লাটবাড়িভিত্তিক যৌনকর্মীদের চিত্রটি নেই। এই ভাগে আরো ২০,০০০ জন থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এটি ধরা হলে কলকাতা শহরে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০,০০০ জনে। আমরা অন্য দেশের একটি শহরের হিসেবটি এত নিখুঁতভাবে দেখতে চেষ্টা করছি এ কারণে যে এখানকার যৌনকর্মীদের একটি বড়ো অংশই বাংলাদেশের নারী ও শিশু। রয়টারের একটি সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৩০ হাজার মেয়েশিশু আছে কলকাতার বিভিন্ন পতিতালয়ে এবং ১০ হাজার আছে মুম্বাই এবং গোয়ার পতিতালয়ে।10 এসব নারী ও মেয়েশিশুর সবাই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছেন। এক হিসেবে দেখা যায়, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ২০০,০০০ নারী পাচার হয়েছেন। এছাড়া এসময়ে মোট ৬০০০ মেয়েশিশু পাচার বা অপহৃত হয়েছে কিংবা হারিয়ে গেছে।11 ইন্টার প্রেস সার্ভিস (৮ এপ্রিল ১৯৯৮) সূত্রে জানা যায়, পাচারকৃত এই দু’লক্ষ নারীর সবাই ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে যৌনকাজে ব্যবহৃত হচ্ছেন। একটি বিদেশী সংস্থার বাংলাদেশ সম্পর্কিত কান্ট্রি নেরেটিভ পেপারের ভাষ্য অনুযায়ী, বৈধভাবে যেসব নারী গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করবার জন্য কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদিআরবে যান, প্রায়শ তাঁদেরও অনিচ্ছাকৃত যৌনদাসত্বকে মেনে নিতে হয়। ওই পেপারের মতে, বার্মিজ মেয়েদের পাচারের রুট হিসেবেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খ্যাতি পেয়েছে।

৭.
রয়টারের তথ্য সঠিক হলে কলকাতায় কর্মরত মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা ৪০,০০০ এর বেশি হতে বাধ্য। একটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে সর্বমোট যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি।12 কিন্তু শুধু ঢাকা শহরে কর্মরত মোট যৌনকর্মীর সংখ্যাসূচক কোনো বিশ্বাসযোগ্য হিসেব আমাদের হাতে নেই। জনসংখ্যা, জনঘনত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পেশাবৈচিত্র্যে ঢাকা-কলকাতা প্রায় একইরকম। সে বিবেচনায় ঢাকা শহরের বর্তমান মোট যৌনকর্মীর সংখ্যাও কলকাতার সমান ৪০,০০০ জন হতে পারে। যাদের মাথায় এই তর্ক উসকে উঠছে যে, ঢাকা শহরে বর্তমানে একটিও স্বীকৃত যৌনপল্লি নেই, সুতরাং এ সংখ্যা আরো কম হবে– তাদের উদ্দেশ্যে এই তথ্যটি দেয়া যায় যে, ঢাকা শহরে দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মেয়েশিশুর সংখ্যাই ১৫ থেকে ২০ হাজার, যারা এ কাজ শুরু করেছে তাদের বয়স ১২ বছর হবারও আগে থেকে।13 তাদেরকে অনুরোধ করা যায় যে, স্বীকৃত যৌনপল্লি না-থাকায় সারা ঢাকার পার্কে-উদ্যানে-রাস্তার পাশে-বড়ো বড়ো ইমারতের দেয়াল ঘেঁষে, নির্মাণাধীন ভবনের নিচে, নদীতীরে, রেল ও বাস স্টেশনে রাত্রিবেলা শরীর কেনাবেচার কী জমজমাট হাট বসে একটু খবর লাগিয়ে দেখুন! তাছাড়া কজন জানেন জানি না যে হাতেগোনা দুয়েকটি বাদ দিয়ে ঢাকা শহরের শত শত আবাসিক হোটেলের সবকটিই এখন একেকটি যৌনপল্লি। যৌনপরিষেবা গ্রাহকদের জন্য আবাসিক হোটেল পতিতালয়ের চেয়ে অনেক বেশি সহজগম্য এর গায়ের সঙ্গে পতিতালয় নামটি সাঁটা নেই বলে।14 সে কারণে পতিতালয় ও রাস্তাঘাটের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করেও যৌনপরিষেবা ক্রয়ের জন্য শহরের আবাসিক হোটেলসমূহে ২৪ ঘণ্টা ধরেই কী ভয়ানক চাপ পড়ে তা হঠাৎ হঠাৎ পরিচালিত পুলিশ রেইডে ধরা পড়া যৌনকর্মী ও ক্রেতা-গ্রাহকের সংখ্যার দিকে তাকালেই অনুমান করা যায়। আর ফ্লাটবাড়ির আশ্রয়ে পরিচালিত হওয়া যৌনব্যবসার চিত্রটি আমাদের কাছে আড়ালেই থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে, থেকে যাবে। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অভিযোগ না-উঠলে কিংবা ওসব স্পটে কেউ খুন না-হলে সাধারণত সেগুলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের আড়ালেই থাকে। উল্লেখ্য, এসব স্পটের গ্রাহকরা প্রায়শই হন উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তেরা।

৮.
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে সমাজই যৌনকর্মীদের এ ধরনের নিকৃষ্ট পেশায় ঠেলে দিয়েছে। দেশের অসম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি অংশকে এমনই মানবেতর পর্যায়ের দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে দেয় যে তাদের পেটের ক্ষুধা মেটাবার আশু দাবির কাছে ভালো একটি কাজ করবার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম শিক্ষাটা তাদের আর অর্জন করা হয়ে ওঠে না। এর উপরে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হয়ে জন্মানোর অভিশাপ। শৈশবেই ধর্ষিত হওয়া থেকে শুরু করে বাল্যবিয়ে এবং স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা বা অকাল বিধবা হয়ে শিশু বাচ্চা ও নিজের পেটের আগুন নেভাতে অনন্যোপায় হয়ে এ পথে আসা ; কিংবা যৌতুকের দাবি মেটাতে না-পারায় বিয়েই না-হওয়া এবং প্রেমিকের বেশে আসা কোনো প্রতারকের হাত ধরে বাড়ির বাইরে এসে সাক্ষাৎ নরকে পতিত হওয়া ; কিংবা নিয়মিত উপোসের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে কাজের সন্ধানে শহরমুখী হওয়া এবং ভালো কাজের প্রলোভনে পাচারকারীর পাল্লায় পড়ে ভেড়ার পালের একজন হয়ে বিদেশে বিক্রি হয়ে যাওয়া– এরকমই একেকটি নেপথ্য কাহিনি দিনের পর দিন বয়ে চলছে রেড লাইড এরিয়ার সকল সদস্যনারী।

ইন্টারন্যাশনাল এইডস সোসাইটির ১৫তম আন্তর্জাতিক এইডস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১১-১৬ জুলাই ২০০৪-এ থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। ওই কনফারেন্সে ঢাকা শহরের হোটেলে দেহব্যবসা করে এমন ১৫০ জন যৌনকর্মীর ওপরে পরিচালিত একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, এঁদের ৩৩ শতাংশ অন্যদের দ্বারা ভুলপথে পরিচালিত হয়ে এ পেশায় এসেছেন, ১৩ শতাংশ এসেছেন আরো ভালো জীবনযাপন করবার আশায় এবং ১০ শতাংশ প্রেমিকের দ্বারা ধর্ষিত ও প্রতারিত হয়ে।15 ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’ কলকাতায় আয়োজিত যৌনকর্মীদের প্রথম জাতীয় সম্মেলনে ‘এ-লড়াই আমাদের জিততেই হবে’ নামে যে জবানবন্দি দেয় তাতে মেয়েদের যৌন ব্যবসায় আসার কারণ জানাতে তাঁরা বলেন, ‘অন্য আর পাঁচটা পেশায় মানুষ যে কারণে যায়, সে-ভাবেই যৌন ব্যবসায় অধিকাংশ মেয়েই আসে পেটের তাড়নায়। যে বিহারী মজুর কলকাতায় রিকশা চালায় অথবা যে বাঙালী শ্রমিক বম্বেতে মিলে ঠিকা কাজ করে আমাদের গল্প তার থেকে আলাদা নয়। কেউ কেউ বিক্রি হয়ে চলে আসে। বেশ কিছু বছর মালকিনের দাসী হয়ে শ্রম বিক্রি করে ধীরে ধীরে ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা পায়। আবার বেশ কিছু মেয়ে জীবনের নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এখানে এসে পৌঁছায়– অনেক সময় পুরোপুরি সব না-জেনে, পুরোপুরি নিজের ইচ্ছেতে নয়।’16 অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ৪৯.১০ শতাংশ যৌনকর্মী এ পেশায় এসেছেন সীমাহীন দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে, ২১.৫৬ শতাংশ এসেছেন পারিবারিক ডামাডোলের শিকার হয়ে, ১৫.৫৬ শতাংশ অন্য জীবিকার মিথ্যা আশার হাতছানিতে, ৮.৬৭ শতাংশ জেনেশুনে স্বেচ্ছায় এসেছেন এবং বলপূর্বক ধরে এনে এ ব্যবসায় লাগানো হয়েছে ০.৪৪ শতাংশকে। যারা মনে করেন যৌনকর্মীরা কেবল বংশপরম্পরায়ই এ পেশায় আসে, তাদের জন্য এই তথ্যটি দেয়া যায় যে কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে সে হার মাত্র ৪.৬৭ শতাংশ।17 উল্লিখিত চিত্রে যৌনকর্মীদের এ পেশায় আসার কারণ জানা গেল। পাশাপাশি কৌতূহলী পাঠকদের জন্য এখানে আরেকটি চিত্র তুলে ধরা যায়, যে-চিত্রটি ধারণা দেবে যে এদের এ পেশায় আসার মাধ্যম কারা। এসব যৌনকর্মীর ৬০.৬৭ শতাংশই এ পেশায় এসেছেন বন্ধু ও প্রেমিকের প্রতারণার শিকার হওয়ার মাধ্যমে, ৭.১১ শতাংশ দালালদের মাধ্যমে, ৭.৩৩ শতাংশ দালালদের দ্বারা বিক্রিত হয়ে, ৪ শতাংশ আত্মীয়দের মাধ্যমে, ২.২২ শতাংশ আত্মীয়দের দ্বারা বিক্রিত হয়ে এবং নিরুপায় হয়ে নিজেরাই এ পেশায় আত্মসমর্পণ করেছে ১৮.৬৭ শতাংশ।18

৯.
সত্য যে, এই বিপুল পরিমাণ যৌনকর্মীর অধিকাংশই যৌনদাসত্বের ফাঁদে আটকে গেছেন এবং এ জীবন থেকে তাঁরা যেকোনো মূল্যে ছুটি চান। কিন্তু ছুটি-পরবর্তী জীবনে সম্মানের সাথে টিকে থাকবার নিশ্চয়তা তাঁদের কেউই দেয় না। এমনকি সরকারও না। ‘সমাজের বিষ ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে যাওয়া মানবিকতার পূজারী’ হিসেবে তত্ত্বীয়ভাবে উচ্চস্থান যৌনকর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা হলেও আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি সমাজ এঁদের খুবই খারাপ চোখে দেখে। সমাজের ৯৯ শতাংশ মানুষই এঁদের অস্পৃশ্য জ্ঞান করে। মরলে এঁদের সৎকারে পর্যন্ত সামাজিকভাবে বাধা দেয়া হয়। আমরা দেখেছি কার্যকর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না-করেই ঢাকার ইংলিশ রোড ও নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের পতিতাপল্লি ধ্বংস করে দেয়ায় উচ্ছেদ হওয়া যৌনকর্মীদের ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়তে। এঁদের একটা অংশ দেশের অন্যান্য পতিতালয়ে জায়গা নিয়েছেন, একটা অংশ শহরের বিভিন্ন হোটেলে ও বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ব্যবসা করছেন আর বাদবাকি সবারই পথবেশ্যার মানবেতর জীবন বেছে নিতে হয়েছে। পুনর্বাসনের নামে তখন সরকার যেসব খেলা দেখিয়েছিল তাতে সকলেই বুঝেছে যে পুনর্বাসন শব্দটি ব্যবহার করে সরকার যৌনকর্মীদের সঙ্গে প্রতারণাটিই করেছিল মাত্র। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার পৌর-কর্তৃপক্ষ ১৯৯২-এ শহরের যৌন বিনোদন কেন্দ্রগুলো ভেঙে দেয়ার পরও একইভাবে সেখানকার যৌনকর্মীরা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর থেকে ওদেশে বিভিন্ন ধরনের যৌনরোগ ও এইচআইভির সংক্রমণ অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।

অর্থশাস্ত্র মতে, বাজারে যদি কোনো পণ্যের চাহিদা থাকে তাহলে সে পণ্যের উৎপাদন রহিত করা যায় না। প্রকাশ্যে না-হলেও গোপনে তার উৎপাদন চলতেই থাকে। সমাজে যৌনকর্মী তৈরি হবার যেসব কারণ বিদ্যমান, সেগুলোকে অপনোদন করা না-গেলে এবং যৌনপণ্যের বাজারচাহিদা কমানো না-গেলে চিহ্নিত রেড লাইড এরিয়াগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে দিলেও অন্য কোনো ছদ্মআবরণে এ ব্যবসা চলতেই থাকবে। তাতে মাত্র একদল যাবে, একদল আসবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।

এ গেল যৌনবাণিজ্যের এক দিক। বিশ্বায়নের ছোঁয়া লাগার সাথে সাথে যৌনবাণিজ্যের আরো নানা রূপচেহারা স্পষ্ট হয়েছে। তার বড়ো ক্ষেত্র সেক্সট্যুরিজম এবং পর্নোগ্রাফি। প্রতিদিনই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপরিণত ও পরিণত বয়েসি নারী পাচার হয়ে আন্তর্জাতিক এসব যৌনবাণিজ্যের কবলে পড়ছে। পাচারকারী ও যৌনবাণিজ্যের হর্তাকর্তা শ্রেণির নেটওয়ার্ক এতই বিস্তৃত ও শক্তিশালী যে তাদের শক্তিমত্তার সাথে পেরে ওঠবার চেষ্টা প্রায়ই রাষ্ট্রগুলো করে না, কারণ অনেক রাষ্ট্রের মোটা আয়ই নির্ভর করে এ পেশার ওপরে, বিশেষ করে, সেক্সট্যুরিজম তথা যৌনপর্যটন যেসব রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস।

১০.
উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, সেক্স ট্যুরিজম বা যৌনপর্যটন হলো অর্থের বিনিময়ে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোনো বিশেষ স্থানে ভ্রমণ করা। জাতিসংঘের বিশেষ অ্যাজেন্সি বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, পর্যটন খাত কর্তৃক আয়োজিত অথবা এই খাতের বাইরের কারো আয়োজনে পর্যটন খাতের কাঠামো ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গন্তব্যস্থানের বসবাসস্থলে পর্যটক কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে যৌনসম্পর্ক স্থাপনকেই সেক্স ট্যুরিজম বা যৌনপর্যটন বলে। জাতিসংঘ যৌনপর্যটনকে সমর্থন করে না এ কারণে যে, এর মাধ্যমে পর্যটকের নিজের দেশ ও গন্তব্য দেশ উভয়েরই স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে পর্যটকের নিজের দেশের চেয়ে গন্তব্যদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং পর্যটকের নিজের সাথে ওখানকার মানুষের লৈঙ্গিক-বায়সিক অবস্থার বৈভিন্ন্যই এর জন্য দায়ী। যৌনপর্যটকদের জন্য কখনো কখনো গন্তব্যদেশে স্বল্পমূল্যে যৌনপরিষেবা পাবার আকর্ষণ থাকে। এমনকি সেসব দেশের থাকে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে আইনগত শৈথিল্য এবং শিশু যৌনকর্মী পাবার আকর্ষণও।19
যৌনপর্যটনের জন্য পর্যটকদের প্রথম বাছাই দেশগুলো হলো থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ডমিনিকান রিপাবলিক, কোস্টারিকা, কিউবা, জার্মানি, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস এবং কম্বোডিয়া। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে যাবার পর রাশিয়া, হাঙ্গেরি, ইউক্রেন, পোলান্ড এবং চেক রিপাবলিকের নামও ওই তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে। অবশ্য এসব গন্তব্যের খুব কমসংখ্যক যৌনকর্মীই কেবল যৌনপর্যটকদের সেবা দিয়ে থাকে। ওসব দেশের মোট যৌনকর্মীর সিংগভাগই স্থানীয় পুরুষকুলের চাহিদা মেটায়। নির্দিষ্ট কোনো দেশের কেবল এক বা একাধিক নির্দিষ্ট স্থানই কেবল যৌনপর্যটকদের গন্তব্য হয়। যেমন নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, পাট্টায়া ও পুকেট। আমেরিকায় যেহেতু নেভাদা ছাড়া অন্য সব এলাকায় পতিতাবৃত্তি অবৈধ, তাই ওখানকার স্থানীয়রা নেভাদায় যৌনপর্যটনে যায়। এছাড়া অন্যান্য কিছু শহরে স্থানীয় পর্যটকরা বিশেষ আইনগত অনুমোদন নিয়ে যৌনপর্যটনে বেরোয়। জানা মতে, আমেরিকা ছাড়া তালিকার অন্যান্য দেশগুলির বেশির ভাগেই পতিতাবৃত্তি একটি আইনসম্মত কার্যক্রম।20

এসব পর্যটকের অধিকাংশেরই ঝোঁক থাকে শিশুর প্রতি, যদিও অধিকাংশ দেশেই শিশুদের যৌনকাজে ব্যবহার করা আইনসম্মত নয়। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যৌনপর্যটন ও শিশু যৌনপর্যটনকে আলাদা করে দেখে। সংস্থার মতে, যেসব পর্যটক শিশুদেরকে যৌনকাজে ব্যবহার করে তাঁরা কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড এবং অপশনাল প্রটোকল অন দ্য সেল অব চিলড্রেন, চাইল্ড প্রস্টিটিউশন অ্যান্ড চাইল্ড পর্নোগ্রাফি লংঘন করে। অনেক দেশই ওরস্ট ফর্ম অব চাইল্ড লেবর কনভেনশন, ১৯৯৯-এ স্বাক্ষর করেছে এবং নিজেদের দেশে সেটা বাস্তবায়ন করছে। সিঙ্গাপুরের এরকম কোনো আইন নেই বলে তারা ইতোমধ্যে অনেক নিন্দা অর্জন করেছে। ইন্দোনেশিয়ার বাটামও ওরকম একটি গন্তব্য, যেখানে প্রচুর পরিমাণে কমবয়েসি শিশুকে যৌনকাজে ব্যবহারের জন্যে পাওয়া যায়।

১১.
ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৯৮ ইস্যুতে মুদ্রিত একটি প্রবন্ধে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডের যৌনবাণিজ্যে কী পরিমাণ অর্থাগম ঘটে তার কিছু পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। ওই প্রবন্ধে স্বীকার করা হয় যে, যৌনখাত একটি অর্থনৈতিক খাত হিসেবে অফিসিয়াল পরিসংখ্যান, উন্নয়ন পরিকল্পনা বা সরকারের বাজেটে এখনো স্বীকৃত নয়। কিন্তু এ খাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন ঘটে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌনখাতে এই চারটি দেশে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ নারী যুক্ত আছেন তা পেশাটি অনৈতিক ও গোপন হওয়ার কারণে বলা একেবারেই মুশকিল। তবে ধরে নেয়া যায়, দেশসমূহের মোট নারী জনগোষ্ঠীর ০.২৫ থেকে ১.৫ শতাংশ এ পেশায় যুক্ত। ১৯৯৩-’৯৪ এ তৈরি একটি হিসেব অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ায় যৌনকর্মীর সংখ্যা দেখানো হয় ১৪০,০০০ থেকে ২৩০,০০০ জন। মালয়েশিয়ায় এই সংখ্যা ৪৩,০০০ থেকে ১৪২,০০০ জন, তবে আইএলওর মতে সে সংখ্যা আরো বেশি। ফিলিপাইনে যৌনকর্মীর সংখ্যা জানানো হয় ১০০,০০০ থেকে ৬০০,০০০ জন, তবে ৫০০,০০০ হওয়ার ব্যাপারে অনেকেই একমত বলে জানানো হয়। থাইল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৭-এ করা জরিপ অনুযায়ী যৌনকর্মীর সংখ্যা দেখানো হয় ৬৫,০০০, কিন্তু আনঅফিসিয়াল সূত্র দাবি করে এ সংখ্যা ২০০,০০০ থেকে ৩০০,০০০ জন। এর বাইরে থাই এবং ফিলিপিনো আরো ১০ হাজার নারী, শিশু এবং হিজড়া যৌনকর্মী বিদেশে কর্মরত আছে।

বলা হয়, যৌনতাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিনোদনমূলক স্থাপনা এবং যৌনপর্যটনের সঙ্গে যুক্ত মালিক, ব্যবস্থাপক, দালাল, সহযোগী, ক্যাশিয়ার, নিরাপত্তারক্ষী এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে আরো কয়েক মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবনধারণ করে থাকে। প্রতিবেদনটি বলছে, এই চারটি দেশের জিডিপির ২ থেকে ১৪ শতাংশই আসে যৌনখাত থেকে। সরকারি কর্তৃপক্ষ বৈধ-অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ করও আদায় করে থাকে সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো থেকে। থাইল্যান্ডের শহরে যৌনকর্মে রত গ্রামীণ নারীরা বছরে তাঁদের উপার্জন থেকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গ্রামে তাঁদের পরিবারের কাছে পাঠান। ১৯৯৩-’৯৪ মেয়াদে দেশগুলো যৌনকর্ম বাবদ বছরে ২২.৫ থেকে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে।

এই চারটি দেশে পরিচালিত জরিপ তথ্য সাক্ষ্য দেয় যে, নিরক্ষর ও অদক্ষ মেয়েদের পক্ষে যেসব কাজ করা সম্ভব তার মধ্যে যৌনকর্মই সবচেয়ে বেশি অর্থাগম ঘটায়। যেমন মালয়েশিয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে কাজ করে ১৯৯০-এ একজন দক্ষশ্রমিক বছরে উপার্জন করত ২৮৫২ আমেরিকান ডলার এবং অদক্ষ করত ১৭১১ ডলার। বিপরীতে সে সময়ের হিসেবে কোনো নিম্নমানের হোটেলে যৌনপরিষেবা দিয়ে একজন যৌনকর্মী সপ্তাহে মাত্র একদিন বারো ঘণ্টা কাজ করেই বছরে আয় করতে পারত ২০৮০ ডলার।21

১২.
ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে হওয়া সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় আফ্রিকার দরিদ্র দেশ কেনিয়ায় শিশু পতিতাবৃত্তির এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশটির উপকূলীয় এলাকায় যৌনপর্যটন চালু থাকায় সেখানকার অজস্র শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার মেয়েশিশু দেশটির মালিন্দি, মোম্বাসা, কালিফি এবং দিয়ানি উপকূলীয় এলাকায় বাস করে, যারা মাঝে মাঝেই অর্থের বিনিময়ে যৌনকর্ম করে। এছাড়াও ২ থেকে ৩ হাজার শিশু ছেলেমেয়ে অর্থের বিনিময়ে সার্বক্ষণিক যৌনপরিষেবা দিয়ে থাকে। উপকূলীয় যৌনপেশায় কর্মরতদের ৪৫ শতাংশই আসে দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে, যারা পূর্বেই এ কাজে হাতেখড়ি নিয়ে নেয়। অধিকাংশই আগে নিজেদের এলাকার বারে এ কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ও প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, সাজুগুজু করার জিনিসপাতি ও চুলের স্টাইল আধুনিকায়ন করবার জন্য অর্থ উপার্জন করে তারপর পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য আসে। এখানে শিশুদের মধ্যে যৌনকর্মের প্রাদুর্ভাব এমনই বেড়ে গেছে যে, প্রতি দশজন শিশুর একজন এ কাজে যুক্ত হয় তাদের বয়স বারোয় পৌঁছার আগেই। চরম দারিদ্র্যের কারণে কেনিয়ায় এখন এটি সামাজিকভাবেও অনেকাংশে স্বীকৃতি পাচ্ছে। শিশুদের একটা অংশ সাধারণত সেসব পরিবার থেকে আসে যেসব পরিবারে উপাজনক্ষম কেউ নেই, অথবা কম উপার্জন করে কিংবা সেসব শিশু যাদের বাবা মা উভয়েই প্রয়াত হয়েছেন। তবে আগতদের ৫০ শতাংশের মা-বাবাই কর্মজীবী এবং তারা স্কুলেও যায়, তবে তারা চায় হাতখরচের জন্য বাড়তি কিছু টাকা। অবশ্য এরা সতর্ক থাকে যাতে সমাজের বয়েসি কেউ বিষয়টি টের না-পেয়ে যায়। সূত্র জানায়, কেনিয়ার সৈকতে শিশু যৌনপর্যটনে আগতদের ১৮ শতাংশ ইতালিয়ান, ১৪ শতাংশ জার্মান এবং ১২ শতাংশ সুইস। এরপরেই আছেন উগান্ডান, তাঞ্জানিয়ান, ব্রিটিশ এবং সৌদি আরবীয়রা। তবে দেশের ভিতরেও এই শিশুদের গ্রাহক প্রচুর। পর্যটকদের আগমন যে সময়ে কম হয় বা একেবারেই হয় না, তখনো এই শিশুরা একেবারে কর্মহীন থাকে না।22

১৩.
যৌনপর্যটন ও শিশু যৌনপর্যটনের এই ভয়াবহতার পাশাপাশি নারী ও শিশুদেহের বাণিজ্যিক ব্যবহারের আরেক ভয়াবহ রূপ পর্নোগ্রাফি। এর চর্চা আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে গোটা পৃথিবীব্যাপী মহামারীর রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ খাতটিরও অর্থনৈতিক বাজার অনেক বড়ো, অর্থাৎ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। বিশ্বখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ও আইনজীবী ক্যাথরিন ম্যাককিননের মতে, পর্নোগ্রাফি শিল্প হিসেবে হলিউডের চেয়ে অনেক বড়ো। স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যার দ্রুত বিস্তার ঘটেছে।

বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফির উৎপাদন হার ব্যাপক নয়, তবে এর ভোক্তার পরিমাণ অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে কম নয়। প্রতিদিনই চোরাইপথে হাজার হাজার পর্নো সিডি-ডিভিডি, পত্রিকা দেশের ভিতরে ঢুকছে এবং পৌঁছবার পরে সেগুলো থেকে পুনরুৎপাদন হচ্ছে হাজার হাজার কপি। পুনরুৎপাদিত এসব সিডি-ডিভিডি প্রতিনিই পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন বয়েসি মানুষের কাছে ঘরে ঘরে। পর্নো সিডি-ডিভিডির দর্শকদের মধ্যে নারীরাও আছেন, তবে তার হার খুবই কম। এসবের প্রধান সমঝদার মূলত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-যুবক ও কর্মজীবী পৌঢ়রা। সরকার চাইলে এর আমদানি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। কিন্তু দেশের ভেতরে ইতোমধ্যেই যে পরিমাণ পর্নো পৌঁছে গেছে, তা দিয়ে আরো পঞ্চাশ বছর রীতিমতো ব্যবসা করে যেতে পারবে এর সঙ্গে যুক্তরা। তাছাড়া বাইরে থেকে আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেও দেশের ভেতরে পর্নোগ্রাফির প্রবেশ আর কিছুতেই রোধ করা যাবে না। কারণ এখন ঘরে ঘরেই স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেট কানেকশন। সুতরাং পর্নোগ্রাফির স্বাদ নিতে চাইলে যে গ্রাহকদের সবসময় বাইরে থেকে পর্নো সিডি-ডিভিডি-পত্রিকা কিনতেই হবে, তার কোনো মানেই আর অবশিষ্ট নেই। উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে ঘরে ইন্টারনেট কানেকশন এখন আর বিস্ময়কর কিছু না। চাইলেই তারা সেক্স সাইট ব্রাউজ করতে পারছে, ডাউনলোড করে নিতে পারছে যেকোনো পরিমাণ পর্নো ফুটেজ। যাদের ঘরে সে সুবিধে নেই তাদের জন্য রয়েছে অলিতেগলিতে গজিয়ে ওঠা সাইবার ক্যাফে। এক ঘণ্টা ব্রাউজ করবার জন্য ক্যাফেগুলোতে চার্জ নেয়া হয় মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং এর বিনিময়ে একটিমাত্র ক্লিকেই পৌঁছে যাওয়া যায় যৌনতার নরকে। কেউ তা দেখবার-বলবার নেই সেখানে। ব্রাউজারদের জন্য সবরকম আড়ালেরই সেখানে বন্দোবস্ত করা আছে। সুতরাং এ নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবিত হবার আছে। কারণ এটা একটা প্রমাণিত সত্য যে পর্নোগ্রাফি ধর্ষণকে ইন্ধন দেয়। কীভাবে ? তার জবাব ম্যাককিনন দিয়েছেন এভাবে যে, পর্নোগ্রাফি সাধারণ মানুষকে ধর্ষণের মিথকে বিশ্বাস করতে সাহায্য করে। যদি কোনো নারী বলেন, তিনি যৌনসম্পর্কের সময় সম্মতি দেন নি তাহলে মানুষের কল্পলোকে পর্নোগ্রাফি ধর্ষণের মিথ হিসেবে কাজ করে। তারা মনে করে মুখে যাই বলুক না কেন মেয়েটি আসলে সম্মত ছিল। এ বিবেচনায় মেয়েটি ‘না’ বললেও ধরে নেয়া হয় সে ‘হ্যাঁ’ বলেছে। এ ধরনের মিথ নারীর বিরুদ্ধে পুরুষকে আরো আগ্রাসী হতে সাহায্য করে। পুরুষকে পর্নোগ্রাফির গ্রাহক হয়ে উঠতে সাহায্য করে।23

তথ্যসূত্র

1. ‘নারীপণ্য’: মুজিব মেহদী, জেন্ডারকোষ (১ম খণ্ড), সেলিনা হোসেন ও মাসুদুজ্জামান সম্পাদিত, মাওলা ব্রাদার্স ২০০৬
2. বিশ্বায়ন : অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন, কাভালজিৎ সিং (মনোয়ার মোস্তফা অনূদিত), বিএনপিএস ও ইউপিএল, ২০০৫]
3. কৌটিল্য : প্রেম ও নৈতিকতা, ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, ২০০০
4. প্রাগুক্ত
5. প্রাগুক্ত
6. বাংলা ইলেক্ট্রনিক বাইবেল, যোহন, ৮ম অধ্যায়, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ২০০৫
7. বাৎসায়ন-প্রণীত কামসূত্র, পঞ্চানন তর্করত্ন ও মানবেন্দু বন্দোপাধ্যায়, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা, পরিবর্দ্ধিত সংস্করণ, ১৩৯৮
8. কৌটিল্য : প্রেম ও নৈতিকতা, প্রাগুক্ত
9. দেবাশিস বসু, ‘কলকাতার যৌনপল্লী’, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ধ্রুবপদ, বার্ষিক সংকলন ৫, কৃষ্ণনগর, কলকাতা, ২০০১
10. Trafficking Watch Bangladesh, “Human Smuggling from Banglsdesh at alarming level,” Reuters, 26 may 1997
11. Center for Women and Children’s Study report, Zahiduzzaman Faruque, “Women, children trafficking in Bangladesh,” Kyodo, 5 May 1998
12. ”Trafficking and Prostitution in Bangladesh - Contradictions in Law and Practice”, Sigma Huda, The Coalition Against Trafficking in Women, February 1999
13. BNWLA survey, police estimates, Fawzia Karim Firoze & Salma Ali of the Bangladesh National Women Lawyers’ Association,” Bangladesh Country Paper: Law and Legislation”
14. Khairun Nessa, Shama-A Waris, Zafar Sultan, Shirajum Monira, Maqsud Hossain, Shamsun Nahar, Habibur Rahman, Mahbub Alam, Pam Baatsen, and Motiur Rahman : Epidemiology and Etiology of Sexually Transmitted Infection among Hotel-Based Sex Workers in Dhaka, Bangladesh, International Centre for Diarrhoeal Disease Research, Bangladesh, Family Health International, and SRISTI, Khilgaon, Dhaka, Bangladesh, JOURNAL OF CLINICAL MICROBIOLOGY, Feb. 2004, p. 618–62
15. AEGiS-15IAC Factors leading to Hotel based sex work in Bangladesh
16. সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ধ্রুবপদ, প্রাগুক্ত
17. দেবাশিস বসু, প্রাগুক্ত
18. দেবাশিস বসু, প্রাগুক্ত
19. http://en.wikipedia.org/wiki/Sex_tourism
20. http://en.wikipedia.org/wiki/Sex_tourism
21. Sex as a sector: Economic incentives and hardships fuel growth, The Sex Sector: The economic and social bases of prostitution in Southeast Asia edited by Lin Lean Lim, International Labour Office, Geneva, 1998.
22. Extent and Effect of Sex Tourism and Sexual Exploitation of Children on the Kenyan Coast, UNICEF, EMBARGOED, 19 DEC.2006, KENYA
23. ‘আর উওমেন হিউম্যান ?’, ফাহমিদা আখতার, রোকেয়া কবীর সম্পাদিত নারী ও প্রগতি, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৫।

বৃষ্টিভেজা গদ্যকলাপ

এ হমিজ টু দ্য রেইন গডস

বর্ষা মাথায় নিয়ে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সঙ্গে লাইভ পারফর্মেন্সে ইউকের পাম্পরুমে থাকতে পারা, এক অসাধারণ আবেগ জাগানিয়া ঘটনা। সাক্ষাতের শুরুতেই ত্রিশ মিনিট ধরে সনতুরে তিনি বর্ষা আবাহন করেন, পরের বিশ মিনিট ধরে বর্ষাস্তুতি এবং সবশেষে বর্ষানামা আরো বিশ মিনিট ব্যাপে। কল্পনায় হলেও এই শেয়ারযোগ্য অনুভূতিমালার ভার সতত চালিত হতে থাকে সাঁইজির ওই জগৎজিজ্ঞাসার দিকে যে, 'কে গো জানতে পায় রসের রসিক না হলে ?' যেকোনো নিষ্ঠ মেঘমল্লারেই আদপে গুঁড়িয়ে যেতে হয়। কেননা তখন 'পররূপে কাতরতা জাগে মৃদু-মৃদু'। ফোঁটায় ফোঁটায় কোটিধা বিভক্ত হয়ে যাওয়া নিজঅস্তিত্ব জানান দিতে তখন প্রিয়ার সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে যায় মন ও মানস। ওদিকে আকাশের সজলতা কী বাতাসের খ্যাপা প্রবণতা এসে ঘাঁই মারতে থাকে উড্ডয়নরত 'খাঁচা'রূপী ইনফ্রাস্ট্রাকচারে। তখন মাসুদ খানের মতো অনুভূতি হয়। মনে হয় 'বর্ষাই মূল পাঠ্যকৃতি, মূল আখ্যানপাত্র/ আর সব ঋতু পাঠসহায়িকা/ টীকা-টিপ্পনীমাত্র।'

পাম্পরুম থেকে বেরিয়ে ভিজতে ভিজতে আমরা লবণাক্ত ও বিস্বাদ সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকি। লোনাবৃষ্টিতে সঙ্গীর কৃষ্ণকুন্তলঝাড়ের দিকে এগিয়ে যাই। চোখমুখকান ঢেকে যায় কৃষ্ণ আশীষে। এরপর চোখ বুজে মনের মাপে ভিতরদৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাই টিলা-ট্যাঙ্গর, নদী-হ্রদ পেরিয়ে। ক্রমে আনুপূর্ব ঘেমে উঠি। উবু হয়ে বসে পড়ি মোহনার কাছে, সমস্ত লবণ যেখান থেকে পরিবাহিত হয় বন্দরে বন্দরে। ওই বৃষ্টিশীলতার ভিতরে যে উষ্ণ-নুনতা স্বাদ থাকে, কখনো কখনো তা সুমিষ্ট ও সুপেয়ও বটে, আগে তা একদমই জানা ছিল না। নবজ্ঞানের ওই ভারে সৈকতের ভেজা বালিতে আমরা পরস্পর লীন হতে থাকি। সূচনার বৈতালিক লীনগতি ক্রমশ একতাল তিনতাল হয়ে খেমটায় এসে ঠেকে। উত্তরসমুদ্রের ঝাউগাছের ওপারে তখন ধ্বনিত হতে থাকে পণ্ডিত যশোরাজের সুমিষ্ট স্বর 'বরষা ঋতু আয়...ঋতু আয়...'। আর সিমুলটেনিয়াসলি পূর্বপ্রান্তের পাথরগুচ্ছের ধার ঘেঁষে সাজানো হার্ডড্রিঙ্কসের দোকানিরা অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে কাউন্টার দিচ্ছিল 'মেঘমেদুর বরিষায়...' বাজিয়ে। এককেন্দ্রীক অথচ দ্বিমুখী এহেন সুরে বুঁদ বজ্রধর ইন্দ্র স্বীয় পুরীতে বসে তার সহস্রমুখী বজ্রাস্ত্র পৈথানে রেখে নেপথ্যে তখন অনবরত তাল ঠুকে যেতে থাকেন। সুরতালের মহামূর্ছনাজনিত ওই দূষণমধ্যে আমরা তখন লবণজলে পা ভিজানোকে গৌণ ঠাউরিয়ে আকাশঢালা জলের কাছে এমনকি গায়ের টুকরো বস্ত্রতক সঁপে দিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে যাই।

স্ফীতিহীন স্ফীতকার্য

প্রথমে মেঘমালা সঞ্চালিত হয় ও যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে, পরে তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়, তারপর তা একত্রিত ও পুঞ্জীভূত হলে আমরা দেখি বিজলিপ্রভা, শুনি বজ্রধ্বনি, যা ভয় ও ভরসা সঞ্চার করে। পরে প্রকৃতির অনুগ্রহে পরাগ ও বারিবহনকারী বায়ুরাশি প্রেরিত হয়। সুসংবাদবাহী বাতাস ছাড়া পেয়ে পর্বতশৃঙ্গে বিশ্রামরত পুষ্কর মেঘকে চুলের মুঠি ধরে বয়ে নিয়ে আসে নিষ্প্রাণ ভূখণ্ডের দিকে এবং তারপর আকাশ থেকে পরিমিতভাবে বিশুদ্ধ ও উপকারী বারিবর্ষিত হয়। এতে মৃত জমি পুনরায় জীবিত হয় এবং অসংখ্য জীবজন্তু ও মানুষের তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়। তাতে সবরকম গাছের চারা ওঠে। ওতে উদ্গত হয় ঘনসন্নিবিষ্ট উদ্যান ও সবুজ পাতা। সৃষ্টি হয় শস্যদানা, আঙুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, অন্য সবরকম ফল ও গবাদিপশুর খাদ্য। প্রাণী ও ভূমি জীবনের রোমাঞ্চ অনুভব করে ও স্ফীত হয়। আর তাতে জোড়া জোড়া সবরকম সুন্দর জিনিস উৎপাদিত হয়। এই বাণীরূপ যাকে কেবলই স্ফীতিকার্য বলে, কখনো কখনো তা অস্ফীতিঘটনও। যেমন বৃষ্টির দিকে আমার ওই বিকেলগমনটি ছিল বস্তুত স্ফীতিলোপের জন্য। সেদিনের অপরাহ্ণিক সৈকতে সুন্দরী বিজলি ছিল, বজ্রের হুঙ্কার ছিল, তবু একদম টলি নি। আমাদের ঝোঁক ছিল পুরোটাই মেঘমল্লাররূপী শান্তিপূর্ণ বৃষ্টিপাতে, আগুনরূপী দীপক রাগে নয়। তবু বাজিয়ে দেখতে বজ্রসম্ভাবী বাচাল মেঘকে আদর করে কাছে ডাকি, গল্পগুজব করি, বলি যে এ যাত্রা যাহোক একজন অলরাউন্ডার চাই, যদি অন্তত সেরকমটি হও, তাহলে আগুন হলেও চল আমরা খেলি। সে জানায় যে, আক্ষরিকভাবে যাকে অলরাউন্ডার বলে তা সে নয় বস্তুত। প্রথম রাউন্ডে সে বরাবরই খুব নীরব ও চিৎপাত, আকাশ জুড়ে তার শুধু শুয়ে থাকা ও চটুল যত হাকডাক এবং অতি অবশ্যই তা বৃষ্টিপাতহীন। যদি বাতাস এরপরও প্রবাহিত হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে এবং তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে সমর্থ হয়, তাহলেই সে কেবল হ্যারিকেনরূপিণী হয়ে ওঠে। তখন সে ক্ষুধার্ত ঝড়, শুষে নিতে পারে আমূল সাগর এবং সুনামি হয়ে ভাসিয়ে দিতে পারে রাশি রাশি জনপদ। ভয় যদিচ আমার ধাতে নেই, তবু ভয়-ভয় একটা অনুভূতি সহসাই কাঁটা দিয়ে ওঠে মনে। ওরে ব্বাপ! সংলাপ পর্বে ক্ষান্ত দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরাতেই দেখি বৃষ্টিসম্ভাবী নরম কোমল বিচূর্ণ মেঘ। শ্বেতসর্পিণীর মতো তার অবয়ব। বলি, ওগো নুন তুমি বর্ষিত হও! ওগো ধুন তুমি গীত হও! সে শুরু করে খুব নিচে থেকে, ফাল্গুনি বাতাস বয়ে যাবার ঢঙে। কিন্তু তা ছিল ভেজা খুব। মন্ত্রপাঠের মতো নিচুস্বরে বিড়বিড় করতে করতে সে ক্রমে ভিজিয়ে দিতে থাকে, যে অংশ কখনোই কোনো বৃষ্টিতে ভিজে না সে অংশসহ। ক্রমশ সে ঊর্ধ্বমুখী হলে তাকে ত্রাণকর্ত্রীর মতো লাগে। উলটেপালটে তৃপ্তি না মেটা পর্যন্ত ভিজি। মনে হয় বৃষ্টি নয়, শান্তিবর্ষিত হচ্ছে। হঠাৎ লোভ হয় উৎসমূলে তাকাবার। কিন্তু ও বৃষ্টি এমনই গোলবৃষ্টি যে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তার মূল কিংবা চূঁড়া। এই যা, সবখানেই তার আদি, সবখানে অন্ত। শেষ নেই প্রভু তার শেষ নেই, এই নামতা জপতে জপতে গর্ভে শান্তির বীজ নিয়ে এরপর হেলেদুলে কেবলামুখী হই, যে কেবলা খুঁজে পেতে প্রতিবারই আমাকে প্রাণান্ত হতে হয়।

কদমতলায় বৃষ্টিতে

যাত্রামুখে দেখি চোখবড়ো করা কালোমেঘ গায়ে লালাভা মেখে ওঁত পেতে আছে, শিলাপাতের সম্ভাবনা নিয়ে। 'আকাশের শিলাস্তূপ থেকে তিনি বর্ষণ করেন শিলা, আর এ দিয়ে তিনি যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন।' শঙ্কা জাগে মনে, আমার খেতের গর্ভিণী ধানের ছড়া, আমার গাছের আমের যত বোল, আমার খড়ের প্রিয় চালাঘর, এ যাত্রা সর্বনাশের সামনে দাঁড়িয়ে গেল তাহলে! হঠাৎ এ-ও মনে হয়ে যায় যে, '...আর যাকে ইচ্ছা তার উপর থেকে এ অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন'। সহসাই এরকম বিশ্বাস জেগে ওঠে মনে যে, আমার ওপর থেকে তা ফিরে যাবে অন্যদিকে, হ্যাঁ যাবেই ফিরে ইচ্ছাশক্তির বলে। এ বিশ্বাস আমাকে দেন ভারতবর্ষীয় কৃষি ও আবহাওয়াবিদ খনা, তাঁর 'ধলা মেঘে গলা পানি/ কালা মেঘে ছাগল দৌড়ানি' আর্যাযোগে। ঝরঝরে লাগতে থাকে নিজেকে। মেঘের দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং কনিষ্ঠাঙ্গুলি দু'টোই একযোগে তুলে ধরি। বলি যে, দু'টোর যেকোনোটা খুশি ঢুকিয়ে বসে থাক, শান্তি পাবে। বেচারা মেঘের লালচোখ মুহূর্তে নত হয়ে যায়। ব্রেভো। গর্বে আবারো সাঁইজির চরণ জাগে পোড়া মুখে। কেন যে জাগে! 'মানুষে মানুষের বিহার/ মানুষ হলে সিদ্ধ হয় তার/ সে কি বেড়ায় দেশ-দেশান্তর/ যেজন পিড়েয় পেরুর খবর পায় ?' বারকয় চরণটি ভাঁজতে ভাঁজতেই আমার বোরাক এসে পৌঁছায় কদমতলে। এ কদম সেদিন যে সে কদম ছিল না। নিচে তার ছিল যথেচ্ছ প্রশ্রয়, কামনার ইঙ্গিত।

ছাগল দৌড়ানি বৃষ্টির ঝটকা ঝরঝর কদমপাতা চুঁইয়ে নিচ পর্যন্ত আসতে পারে না, বরং কদমফুল বরাবর পতিত যে ফোঁটাগুলো, তারা ওই নির্গন্ধ ফুল থেকেই এক ধরনের মৌতাত ঝেটিয়ে বাইরে বের করে দিতে থাকে। এই আচানক মৌতাতে আমাদের জটলার ত্রিভুজঘরানা দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘ হতে থাকে। ক্লান্ত বিকেল সন্ধ্যার দরজায় এসে কড়া নাড়ছিল যখন, তখন কদমগাছের শাখাপ্রশাখা ছাড়িয়ে পুব আকাশে চোখ পড়তেই দেখা গেল বিজলীর প্রাচীন সুমেরীয় দেবী জারপেনিভকে তাঁর করিৎকর্মা স্বামীকে নিয়ে যুদ্ধে চলেছেন বায়ুরথে চড়ে, দু'হাতে তাঁর দু'গুচ্ছ বজ্রবাণ। ভয়ে আমরা গাছতলা ছেড়ে আলিশান এক বিজলীদণ্ডের আশ্রয়ে আসি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে মনে রেখে। খোদার ওপরে খোদকারী মানুষ হামেশাই করে দেখি, কিন্তু ভরসা পায় না বলে বিজ্ঞানীর ওপরে একদম নয়। তাই আমরা বাজাই না গির্জার ঘণ্টা কিংবা দেই না সুরেলা আজান, বরং একটা রঙধনু দেখবার ইচ্ছায় কুত্তাবিলাই ঝরঝরানির মধ্যেও উত্তরচোখে আঁড় হয়ে থাকি। জানি যে পতন রহিত হলে এহেন ধারাজলের, ক্রমে আকাশমাঠে খেলে উঠবে সপ্তচক্ষু রঙ। ডেকেপেতে ক্লান্ত মিলন শেষে আড়মোড়া ভেঙে দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে উঠবে বেপরোয়া একটা হলুদ পুরুষব্যাঙ, যার নরোম উরুদ্বয়ের রপ্তানি পণ্য হবার দিনকাল আপাতত ফুরিয়ে এসেছে।

ব্যাঙের বিয়ের দিন

আহা ব্যাঙ! ('হায় ব্যা' নয়!) বর্ষার সাথে তার সম্পর্কসূত্র আমি ভুলতে পারি না। ঢাকার ভূমিজলে কোনো ব্যাঙ নেই বলেই না আকাশে দেখি তার ছায়া! কী নিঠুর এই বেদনা! ভাবি কত বদলে গেছে আমার নাগরিক বর্ষা, ব্যাঙহীন। স্যুয়ারেজ উপচানো পচা ও দুর্গন্ধ জলের স্রোত টপকে ঘিনঘিনে পথঘাট পেরিয়ে তুমি যেদিকেই যাও বাল্য-কৈশোর-যৌবনের বর্ষা তুমি কোথাও পাবে না। ব্যাঙের বিয়ের কথা বাদই দাও, সোনাব্যাঙের পালটাপালটি কোরাসগীতি শুনতে শুনতে কাদাখেলের আনন্দ তুমি খুঁজবে কোথায়! কোথায় পাবে ব্যাঙের ছাতা! কোথায় তোমার আষাঢ়ে গল্পের পাত্র ও ক্ষণ! তবু রক্ষে যে সংসারসমরে লিপ্ত থেকেও কোনো এক চোরা ভ্যান্টিলেটর পথে সংসার থেকে ছুটি নিয়ে ক্রমবর্ষণ শব্দের মাঝে নিজের সাথেই নিজে আড্ডা জমিয়ে তোলার অবকাশ থেকে গেছে আজো। কিন্তু কতক্ষণ আর! নিজের মুখ, চোখ, অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বর সব খুব পরিচিত ও ক্লিশে বোধ হলে আশ্রয়ার্থে ঘুরে দাঁড়ানো লাগে অন্য কারো দিকে। ধরা যাক সামনে রবীন্দ্রনাথ, ধরা যাক বাতাস এসে খুলে দিয়ে গেছে তাঁর 'বর্ষার চিঠি'র পৃষ্ঠা। হায়, তাঁরও ঠিক অবিকল দশা দেখে ভিতরে কাত হয়ে পড়ে কান্নাকলসি! তাঁরও দেখি একই হাহাকার, ব্যাঙ হারাবার। "কিন্তু আজকাল ব্যাঙ ডাকে না কেন ? আমি কলকাতার কথা বলছি। ছেলেবেলায় মেঘের ঘটা হলেই ব্যাঙের ডাক শুনতুম, কিন্তু আজকাল পাশ্চাত্য সভ্যতা এল, সার্বভৌমিকতা এবং 'ঊনবিংশ শতাব্দী' এল, পোলিটিকল অ্যাজিটেশন, খোলা ভাঁটি এবং স্বায়ত্তশাসন এল, কিন্তু ব্যাঙ গেল কোথায় ? হায় হায়, কোথায় ব্যাস বশিষ্ঠ, কোথায় গৌতম শাক্যসিংহ, কোথায় ব্যাঙের ডাক!" শেষে ভাবি, জগৎসংসারের ঐতিহ্যবাহী হাহাকারসংস্কৃতি বুঝি এতটাই চিরন্তন যে তার চর্চারিক্ত কোনো সভ্যতা নেই, অসভ্যতাও ; মানে বন্যতা ও বর্বরতা। এর বিস্তার যৌনাঙ্গ থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত প্রসারিত এবং সেটা ক্রিয়মান আছে গন্ধম ফল সেবন থেকে টুইন টাওয়ার উড়িয়ে দেয়া অবধি।

একলা পঙক্তির সুখদুঃখ

ছন্দ লিখি না আমি কবিতা করতে বসে, কবিতা করি না আমি বৃষ্টি আঁকতে এসে, কিছুই করি না আমি যখন কবিতা আসে-- আসে মানে কোত্থেকে আসে আমারই ভিতর থেকে, আমারই ভিতর মানে আমারই সঞ্চয় সে, আমারই সঞ্চয় মানে যতটা ছুঁয়েছে আশে। ছুঁয়েছে তো কেমন সে ছোঁয়া, পাথর না হৃদয় সেটা, গোল না লম্বাটে আড় ?

আসলে কি হৃদয়পুরী গোল মহাগোল, পৃথিবীপ্রাচীন ঘন মহাতীর্থ বলে ? তাতেই তো ছাট লাগে এসে বেয়াড়া বৃষ্টির, ভিজে যাচ্ছি ভিজে যাচ্ছি আমুণ্ডু আমূল, তেমন কারো নিজস্ব তোয়ালে হলে সুগন্ধ সমাহৃত, গা-মাথা মুছে ফের কাজে যাওয়া যেত। কাজ মানে কাজ, দোষগুণে ভরা, বিবেচিত হাওয়াই দ্বীপে, ওয়াইয়ালিয়েলে হিলে, কিংবা কাছে মেঘালয় চেরাপুঞ্জি থেকে।

আকাশের বিবেচনা পাতালের উলটোয় স্থির, নদীর গানের সুর মরুভূমি বোঝে না কখনো, এটা সকলেই জানে।

আইতান-কাইতান

প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়িয়ে মাত্র মাধ্যমিকে যাওয়া-আসা শুরু হয়েছে তখন, ক্ষুদ্র একটা জগৎ চোখের সামনে দেখতে না-দেখতে হঠাৎ কেমন বিশাল হয়ে উঠল। বয়স তখনো শৈশবেই স্থিত হলেও মানসিকভাবে আমরা তাড়িত-চালিত সব চুরমার করা এক কৈশোরবোধের দ্বারা। ততদিনে ধূমপানে তালিম নেয়া হয়ে গেছে, যা আজো চলমান এবং ভবিষ্যতেও না-চলবার মতো লক্ষণ স্পষ্ট নয় (ভাবলে এখন খারাপ লাগে। এতটা ইঁচড়ে পাকামো একদম ঠিক হয় নি!)। সঙ্গত কারণে নানারকম ফাঁকিঝুকিও রপ্ত হয়ে গেছে ততদিনে। মেঘগর্জন হয়ত তুঙ্গে কিন্তু বৃষ্টির একদম দেখা নেই, আবার বিনা মেঘেই বহু বহু বজ্রসম্পাত।

স্কুলে আসতে হতো দুই কিলো কাঁচাপথ পায়ে হেঁটে। বনেবাদাড়ে বেড়ে ওঠা গেঁয়োছেলের পক্ষে দুই কিলো পথ হাঁটবার নিমিত্তে কোনো পথই নয়। ওই বয়সে রোদবৃষ্টিও খুব একটা আমলে নিতাম বলে স্মরণ করতে পারি না। যেকোনোভাবে স্কুলে পৌঁছবার একটা মহাতৎপরতা ছিল। স্কুলে যে বান্ধবকুলকে বাগে পেয়েছিলাম, একদিন না-এলে ওদের জন্য বিরহদগ্ধতা বোধ হতো। বৃষ্টির দিনে পিছল পথে বইপত্র নিয়ে আছাড় খেয়ে ওঠবার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই ছিল। তবু ন-পরোয়া। ওরকম হলে বরং বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফুটবলকে ঘিরে মাঠে মেতে থাকবার সুযোগ তৈরি হতো। তাই বৃষ্টির কারণে স্কুলে না-এসে ঘরে বসে থাকা ছিল দারুণ এক ক্ষতিকেই স্বীকার করে নেয়া। এরকম মানসদেশকাঠামোয় এক আশ্বিন শেষে দাদু জানান দিয়েছিলেন, আইতান-কাইতানের কথা। নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এরকম দিনে স্কুলে যাবার দরকার নেই। আইতান-কাইতান কী দাদু ? 'ওরা দু'জন অনাথ ছেলেমেয়ে, ভাইবোন। কাইতান মেয়েটা নিরীহ, ধরে নিয়ে গেছে দস্যুরা। ওর কান্নাই তো ঝরছে পুরো আশ্বিন জুড়ে। আর আইতান খুব রাগী ছেলে। বোনকে দিনের পর দিন খুঁজে ফিরছে পথেঘাটে। গত ক'দিন থেকে যে ঝড়বাতাস দেখছিস ওটা ওরই যাতায়াতের ফল।' আমরা ওদের দেখি না তো ? 'আমরা কি ভূত-প্রেতও দেখি ? দেখি না। কিন্তু বাগে পেলে তো ওরা ঘাড়টা ঠিকই ভেঙে দেয়।' অন্য কোনো কারণে নয়, ঠিক এই ঘাড়ভাঙার ভয়ে সেবার আশ্বিনশেষ-কার্তিকশুরুতে বেশ কদিন স্কুলে অনুপস্থিত থেকে আইতান-কাইতানকে অনেক ভেবে উঠেছিলাম। নিজের ছোট বোনকে কাইতান ভেবে কল্পিত অপহরণকারীদের প্রতি এমন ক্ষ্যাপামো তৈরি হয়েছিল যে মনে হয়েছিল আইতানকে একবার সত্যি সত্যি দেখতে পেলে ওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাইতানকে উদ্ধার করে আনবই এবং অপহরণকারীদের দেব ভয়ানক এক শিক্ষা!

আশ্বিন-কার্তিকের গ্রামপথগুলো অনাথ কাইতান বালিকার ক্রন্দনে আজো প্রতিবারই সিক্ত হয়ে ওঠে, ক্ষ্যাপা বালক আইতানের ক্ষ্যাপামোতে চুরমার হয়ে যায় অনেক ঘরবাড়ি, গাছপালা। অপহৃত বোনকে অন্বেষণ তার ফুরায় নি আজো। এই খোঁজাখুঁজি তার কতদিন ধরে চলবে গো! বুড্ডিস্ট মঙ্কেরা কি জানেন, যারা গোটা 'ভাস্যা'জুড়ে বাড়ি বাড়ি দান আহরণ করে ফিরেন, প্রার্থনার অংশ হিসেবে ?

ড্রিজলিং অ্যান্ড প্রেসিপিটেশন

বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে লাগেজ লিভিং শেষে ডিজঅ্যাম্বারকেশনের জন্য ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মোবাইল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাবার পথে, প্যাসেজে, সহসাই দু'টো সদাহাস্য একা চোখের সাথে দেখা হয়ে যায়, যে দু'টো লাগাতার কথা বলেই চলেছে মনে হলো। জানতে চাই, হয়্যার আর ইউ ফ্রম ? 'বাংলাদেশ।' আর ইউ এলোন ? 'নো, আই এম উইথ মাই ড্যাড অ্যান্ড মম।' ও, আই সি। হয়ার আর দে নাও ? 'ড্যাড ইজ ইন বোর্ডিং পাস কালেক্টিং লাইন অ্যান্ড মম ইজ ইন মানি এক্সচেঞ্জ সেন্টার।' ওকে, নাইস টু মিট ইউ। 'ইটস মাই প্লিজার।' থ্যাঙ্কস। 'উই আর গয়িং টু এরাইভ ইন দ্য সেইম ফাইট, সো, সি ইউ এগেইন।' ইট উইল বি ফাইন।

কাউন্টার থেকে ছাড় পেতে পেতে লাইনে থাকতেই দোতলায় আবার দেখা। অসাধারণ এক হাসিতে অভ্যর্থনা জানাল সে। ওয়েটিং রুমে বৃষ্টিদেবতা আমাদের পাশাপাশি বসবার বন্দোবস্ত করে দিলেন। 'জানেন না তো, আমরা যেতে চেয়েছিলাম হিমালয়ে, কিন্তু শেষপর্যন্ত পোখরা থেকেই ফিরতে হয়েছে। এত বৃষ্টি বাপের জন্মে দেখি নি। সবাই খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল, তাই হেলিকপ্টার ওড়ে নি। অতৃপ্ত হয়ে ফিরছি।' আমিও কম যাই না। বলি, আমার অতৃপ্তি বিস্তৃত হয়ে আছে রামগিরি থেকে অলকা অবধি। রামায়ণের কিষ্কিন্ধাকাণ্ড, কালিদাসের মহাভারত, জয়দেবের গীতগোবিন্দ, বৈষ্ণব কবিতার একটা বড়ো অংশ কিংবা রবীন্দ্রনাথের অজস্রাজস্র কবিতা হাতড়েও তুমি এত হাহাকার পাবে না। যেমনটি বুকে নিয়ে আমি ফিরছি। এমনকি আমার বৃষ্টিও হয় নি দেখা। এ দেশের রাজতন্ত্র ফুরাল, কিন্তু বিরহভাব, কই ফুরায় নি মানুষের। রাজাহীন রাজকীয় হোটেলের ছাদের নিচের দ্বিদিবসিক সেমিনারের হাহাকারই ছিল মূল স্তোত্র। এরকম বাজে ভ্রমণ আর হয় না জানেন। সম্পূর্ণ বাজে অবশ্য বলা যাবে না এখন, আপনার সাথে দেখা হবার পরে। 'আমাকে তুমি বলুন, প্লিজ! মাত্র ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছি।' ও-কে, মনে হচ্ছে যেন কাঞ্চনজঙ্ঘায় ঠেস লেগে গুঁড়িয়ে যাওয়া মেঘের থেকে আসা বৃষ্টিদলের ছোঁয়াটা এই এখন মাত্র বাগে পাচ্ছি তোমার মারফতে। এই যে এখন বন্দর জুড়ে ড্রিজলিং হচ্ছে, ধারণা করি সেটাও ওই তোমারই কল্যাণে। নইলে কাঠমান্ডুতে চারদিনেও বৃষ্টি দেখব না ময়ুরের মৈথুনঋতুতে, এটা কেমন করে হয়! দেখ, তোমার সম্মানে নামা ড্রিজলিং থাই এয়ারওয়েজের সদ্য ল্যান্ড করা বিমানটির আজদাহা শরীরে আদুরে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। 'জানেন, ওই যে বন্দরের চারপাশের পাহাড়গুলো, এই মিষ্টি ড্রিজলিংয়ের ভিতর কেউ একজনের হাত ধরে ওইদিকে হাঁটা দেয়া গেলে দারুণ হতো।' সে তো বটেই, আমার দিক থেকেও দারুণ হতো না কি! গিয়ে হয়ত দেখতাম ঘাসের ওপরে রক্তবর্ণ সব মখমল পোকার উৎসব। কিন্তু সে তবু হবার নয়! বরং চলো ঢাকাতেই কোনো ঘোল খুঁজে নেব খন, এহেন দুধের বদলে। স্প্রাইটের জামা পরা ভ্যালেন্টাইনস স্কচ গলায় ঢেলে মনে মনে ঢাকার ঘোলঘরগুলোই তখন ভাবতে থাকি কেবল। যেন হয়ে উঠি বর্ষার দূত, চাতকপাখি, যার এটা প্রজননঋতু।

কথোপকথনকে ছাড়িয়ে

'আপনি কি লেখক-শিল্পী গোছের কেউ ?' ড্রিজলের মমের প্রশ্নে যাহোক একটা কুল খুঁজে পাওয়া যায় ভাবনাসমুদ্রে, নইলে কোথায় যে তলাতাম গিয়ে। বললাম, হ্যাঁ একাধটু লিখতে চেষ্টা করি। গোটাকয় বই আছে আমার। সব শেষেরটি বিনীথ দ্য রেইনট্রি, সদ্যপ্রসূত। ব্যাগ হাতড়ে দেখি, আছে একটি কপি। লিখে দেই ড্রিজলের নামে। মম উচ্ছ্বসিত হয়ে ডেডের দিকে ফিরে বলেন, 'জানো, লোকটা-না একজন কবি!' ড্যাড কার্ড বাড়িয়ে দেন। আমারটাও দিই তাঁকে। 'আসবেন আমাদের বাসায়, ভালো লাগবে।' জি আচ্ছা। মম গলা বাড়িয়ে বলতে লাগেন, 'আমাদের ফ্যামিলি খুবই সংস্কৃতিমনা। জানেন, ছোটবেলায় আমি খুব অভিনয় পাগল ছিলাম। বাবা যদিও কখনো অভিনয় করতে দেন নি। কিশোরগঞ্জের মতো মফঃস্বলে ভদ্রলোকের মেয়ে নাটক করবে, লোকজন বলবেটা কী! এসব বলেকয়ে বাবা আমাকে নিরস্ত করতেন। এখন দিন অনেক বদলে গেছে। তাছাড়া মফঃস্বল ছেড়ে আমরা এখন স্থায়ী হয়েছি রাজধানীতেই। আমাদের মেয়ে লিখতে, গান গাইতে বা অভিনয় করতে চাইলে আমরা মোটেই বাধ সাধব না।' বাধ সাধাটা উচিত নয় ওকে, এই বয়সে। কেন তা করতে যাবেন। ওর যা ইচ্ছে হবে তাই করবে। 'আপনি অভিনয়ও করেন বুঝি ?' মাঝে মাঝে। 'আপনাদের কোনো নাটক হলে আমাদের জানাবেন, আসবো।' আমি তো কোনো দলে কাজ করি না। বন্ধুদের নাট্যদল আছে, নিজেকে ওদের দলের একজন ভাবি, ওরাও ভাবে আমাকে। এই দল মাঝে মাঝে প্রোডাকশনে যায়। তখন খবর দিতে পারি। 'হ্যাঁ দেবেন, আমরা দেখতে যাব।' জি আচ্ছা।

বিমান যখনই মেঘের ভিতরে সেধে গেল ঘোষিকা জানান দিল যে, 'ক্যাপ্টেন ইজ ফেসিং সাম প্রব্লেম ফর রাফ ওয়েদার, প্লিজ টাইট ইউর সিট বেল্ট।' চোখ ছিল তখন দূরে হিমালয়ের দিকে। শুনে গা হিম হয়ে গেল। ভুলে গেলাম ড্রিজল এবং তার মম-ডেডকে। ভুলে থাকতে থাকতেই ল্যান্ড করি জিয়ায়। নেমে ড্রিজলের মুখের স্থায়ী হাসিটা না-দেখে খুব দমে যাই। ভাবতে থাকি, এটা বুঝি ওই ভুলে থাকারই খেসারত। লাগেজের জন্যে অপেক্ষার সময় পাশে এসে দাঁড়ায় সে। একা। 'বাসায় এলে খুব খুশি হব।' আগে তো ফোন করি, পরে না-হয় কখনো যাওয়া যাবে। 'আমার মোবাইল নাম্বারটা রাখবেন না!' ও হ্যাঁ, রাখা হয় নি তো। আমি আগ্রহী, কিন্তু আমার মোবাইলে চার্জ নেই যে, সেভ করি কীভাবে। 'কাগজেই লিখে নিন না।' হ্যাঁ বল। '০১৭১৭......'। থ্যাঙ্কস। 'মাই প্লিজার!'

এরপর আমরা অজস্রবার ড্রিজলিং ও প্রেসিপিটেশন মাথায় নিয়ে হাতে হাত ধরে হেঁটেছি, স্বর্গ থেকে নরক অবধি। পিচের রাস্তা থেকে মাটির রাস্তা, ঘাসের রাস্তা সব দিয়ে চিত্রকূট পর্বত অবধি। বাস্তবে ও স্বপ্নে। কিন্তু ত্রিভুবন বিমান বন্দর ঘিরে থাকা গাছময় পাহাড়গুলোর ভেজা হাতছানি এখনো মনের মধ্যে রয়েই গেছে। আমরা কি আবার ল্যান্ড করব কখনো, ওই বন্দরে, মাত্র দু'জন! এরই মধ্যে একদিন রাত সোয়া এগারোটা থেকে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল ড্রিজলের সঙ্গপ্রণোদনা, ছিঁড়ে গেল ভিতরগত যোগসূত্র। আমরা চিরকাল যেরকম একা ছিলাম, আবারো হয়ে গেলাম তেমনি নিঃসঙ্গ বেদনাবৃক্ষ।

নিজের কাছে নিজে

পৃথিবীর সর্বপশ্চিমপ্রান্তের অন্যতম পর্বতচূড়া ওয়াইয়ালিয়েলেকে চেরাপুঞ্জিরও আগে স্থান দিতে যাদের মন উশখুশ করে বৃষ্টিসংক্রান্ত অ্যাজেন্ডায়, তাদের জন্য চেরাপুঞ্জির ১১,৪৩০ মিলিমিটারের পাশে বছরে (৩২ বছরের গড় ধরে) ১১,৬৮৫ মিলিমিটার বা ৪৬০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের তথ্য তুলে ধরা চমকে দেবার নামান্তর, যেখানে এই পর্বতচূড়ার মাত্র কয়েক মাইল দূরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের রেকর্ড মাত্র ২৫০ মিলিমিটারে নেমে আসে। এটুকু তথ্যসম্পদ নিয়ে আমি ভেজা একটি পত্র রচনার যে উদ্যোগ নিয়েছি গোপনে গোপনে, তাতে অ্যাসিডবৃষ্টি কিংবা বিপরীতপক্ষে ঘোর খরার সম্ভাবনাই একঅর্থে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। আনাড়ির অস্বাভাবিক এই বৃষ্টিবন্দনা কি শেষপর্যন্ত দাঁড়িয়ে যাবে না বিদ্যমান সব ফ্লোরা ও ফিউনার বিরুদ্ধে ? এ যদি সত্য হয় তবে জোছনারাতে পিচের আদর বুলানো ছাদে ঘন প্রেসিপিটেশনের মধ্যেও যে আমি কোটি কোটি বেলীফুল ছড়িয়ে পড়ার আনন্দ খুঁজে পাই, সেই মিথ্যার লেজ ধরে এরকম একটি নামতা জপে যাওয়া ছাড়া বস্তুতপক্ষে উদ্ধারের আর কোনো জানালাই আমার সামনে খোলা নেই। 'মেঘের মধ্যে মাগো যারা থাকে/ তারা আমায় ডাকে আমায় ডাকে।'

মাসুদ খানের গোধূলিব্যঞ্জন

স্ত্রীবাচক শব্দ 'গোধূলি' সংস্কৃত বংশজাত একটি কাব্যানুকূল বিশেষ্য। বাংলাভাষায় শব্দটি এখনো তৎসম চরিত্র নিয়েই অবিকল টিকে আছে, অর্থাৎ এ যাবৎ এর কোনো তদ্ভব রূপ সৃষ্টি হয় নি। বঙ্গীয় শব্দকোষ জানায়, বহুব্রীহি সমাসনিষ্পন্ন এই পদটির ব্যাসবাক্য হলো 'গোখুরোত্থিত ধূলি যে সময়ে', অর্থাৎ কিনা গোধূলি হলো গো-প্রচারদেশ হতে গোসমূহের গৃহে আগমণকালে খুরোত্থাপিত ধূলিযুক্ত সময়বিশেষ। উল্লিখিত কোষগ্রন্থটি গোধূলির ঋতুনিষ্ঠায় ভরা একটি সংজ্ঞাও সরবরাহ করে। জানা যায়, 'হেমন্তে ও শিশিরে সূর্য্য মৃদুতাপ-পিণ্ডীকৃত হইলে, বসন্তে ও গ্রীষ্মে সূর্য্য অর্দ্ধাস্তমিত হইলে এবং বর্ষায় ও শরতে সূর্য্য অস্তগত হইলে, গোধূলি হয়।' বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুসারে শব্দটির প্রতীকী মানে হলো সন্ধ্যাবেলা, সায়ংকাল, সূর্যাস্তকাল প্রভৃতি। গরুর পাল গৃহে ফেরার সময় তাদের খুড়ের আঘাতে প্রান্তরে যে ধূলি উড়ে, সূর্যের ডুবি-ডুবি সময়ের লালাভ আলোর প্রেক্ষাপটে ওই ধূলি এক বিশেষ বর্ণময়তা সূচিত করে। আমূল ওই ছবিটিকে ধারণ করে বলে কাব্যাঙ্গনে শব্দটির বিশেষ সুখ্যাতি আছে। কালে কালে কবিদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করবার নেপথ্যে হয়ত শব্দটিতে নিহিত ওই অসাধারণ চিত্রময়তাই দায়ী। বাংলাভাষায় বিভিন্নকালে রচিত বিভিন্ন কবির কবিতা থেকে শব্দটি প্রয়োগের বিস্তর উল্লেখ সম্ভব। কোনোরূপ তুলনামূলক আলোচনার উদ্যম এ যাত্রা রহিত বলে এখানে সেসবের কয়েকটির নমুনা-উৎকলন মাত্র করা হলো। কৌতূহলী রসিক পাঠকগণ ইচ্ছে হলে নিজেরাই পরস্পরের মিল-অমিল খুঁজে দেখতে পারেন। আসুন পড়ি, 'গোধূলি সময় বেলি' (বিদ্যাপতি), 'গোধূলি-ধূসর, বিশাল বক্ষস্থল' (জ্ঞানদাস), 'আইলা গোধূলি, আইলা রতন ভালে' (মধুসূদন), 'ঊর্দ্ধপুচ্ছ গাভী ঐ পাইয়া গোধূলি। ধাইতেছে ঘরমুখে উড়াইয়া ধূলি।।' (হেমচন্দ্র), 'মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল, বিদায় গোধূলি আসে ধূলায় ছড়ায়ে ছিন্নদল' (রবীন্দ্রনাথ) এবং 'ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,--- স্বপন ক'দিন রয়! এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,--- এ তবু গোধূলি নয়!' (জীবনানন্দ)।

শব্দটির ওপর বিস্তর শাসন ছিল জীবনানন্দ দাশের। শুধু 'ঝরাপালক' গ্রন্থেই শব্দটির আছে ডজনখানেক বিশিষ্ট প্রয়োগ। এমনকি তাঁর 'সাতটি তারার তিমির' গ্রন্থে "গোধূলিসন্ধির নৃত্য" এবং 'বেলা অবেলা কালবেলা' গ্রন্থে "মহাগোধূলি" নামেই কবিতা রয়েছে। পরম্পরাবাহিত হয়ে কবি মাসুদ খানের কবিতায়ও শব্দটি জায়গা খুঁজে নিয়েছে। আমাদের মনে হয় শব্দটি দ্বারা তিনি বিমোহিত। আক্রান্তও কি বলা যায় ? পূর্বাহ্ণেই জানিয়ে রাখি, ব্যাখ্যাত এক কৌতূহলে জরিপ চালিয়ে তাঁর এ যাবৎ প্রকাশিত তাঁর তিনটি গ্রন্থের আটটি কবিতায় এগারোবার 'গোধূলি' অথবা গোধূলিজাত সঙ্কর শব্দ আবিষ্কার করা গেছে। তিনটি গ্রন্থ মিলে কোনো শব্দের এগারোসংখ্যক উপস্থিতির এ তথ্যটি মোটেই চমকে দেবার মতো নয়, যেমন চমক দেয় এ তথ্য দু'টি যে কেবল 'মানস সুন্দরী' কবিতাটিতেই রবীন্দ্রনাথ বিভিন্নরকম চুরাশিটি উপমা ব্যবহার করেছিলেন, কিংবা কালিদাস তাঁর সমুদয় কাব্যে উপমার ব্যবহার করেছিলেন সাড়ে বারোশটি। যাহোক, একটি কোনো শব্দ ও সেই শব্দের আত্মীয়স্বজন ধরে সংখ্যাগত হিসেবনিকেশ করলে সন্দেহ নেই মাসুদ খানে বর্ষা-মেঘ-বৃষ্টি-জল-নদী-সমুদ্র--- এই ভেজা শব্দগোষ্ঠীরই আধিপত্য লক্ষণীয় হবে। সেক্ষেত্রে মাত্র এগারোটি স্বল্পালোমণ্ডিত 'গোধূলি'র আবিষ্কার এমন কী তাৎপর্য বয়ে আনে ? এ প্রশ্নের জবাব এরকম যে, খানকে যিনি মোটামুটি অধ্যয়ন করেছেন তিনিও তাঁকে বৃষ্টি বা বর্ষাসম্মোহিত বলে চিনতে পারেন। বর্ষার খাঁটি প্রেমিক এই কবির হাতে অজস্র উত্তীর্ণ মেঘমল্লার (!) রচিত হয়েছে (দৈনিক কাগজগুলোর সাময়িকীতে প্রতি বর্ষায় 'বর্ষার পদাবলি' ছাপা হয় বলে জোর করে এগুলো লিখিত নয় বলেই জানি)। তাই বর্ষা-মেঘ-বৃষ্টি-জল-নদী-সমুদ্র কিংবা এ বংশলতিকার অন্য শব্দাদির ব্যবহার সেখানে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু খান কখনোই গোধূলিপ্রেমিক বলে স্বীকৃত নন এবং তিনি এ যাবৎ একটিও গোধূলিমল্লার (!) রচেন নি। কাজেই এরকম একটি আপাত পরকীয়ার খবর নিতে আমরা এখানে এ আশায় উদগ্রীব হয়েছি যে, বিষয়টি নিয়ে গপসপ হলে একসময় এটিও তাঁর নিজকীয় এলাকা বলে পরিগণিত হবার অবকাশ তৈরি করতে পারে।

মাসুদ খান কর্তৃক প্রয়োগকৃত গোধূলি এবং গোধূলিজাত শব্দে লক্ষ করা যায় গোধূলির অধিক গো-ধূলিব্যঞ্জনা, যা অভিধানের সীমাকে প্রায়শ টপকে-মুচড়ে প্রসারিত করে দিয়েছে নবতর সম্ভাবনার দিকে। সৃজনশীল লেখকের (প্রধানত কবিদের) হাতে-যে শিল্প নির্মিত হওয়ার অধিক বিভিন্ন শব্দের নতুন অর্থপ্রাপ্তির ভিতর দিয়ে ভাষাও সমৃদ্ধ হয়, এসব গোধূলি-উদাহরণ এখানে তার কিছু প্রমাণ স্থাপন করবে বলে মনে করা যায়।

'পাখিতীর্থদিনে', 'নদীকূলে করি বাস' এবং 'সরাইখানা ও হারানো মানুষ'--- এই তিনটি গ্রন্থের তিনটি কবিতায় মাসুদ খান একবার করে সরাসরি 'গোধূলি' শব্দটির প্রয়োগ করেছেন। 'পাখিতীর্থদিন'এর 'স্রোত' কবিতার ১১তম পর্বে তিনি শব্দটিকে 'অতীত'-এর একটি রূপান্তর হিসেবে দেখেছেন এবং যে রূপান্তরটি ঘটিয়েছে অতি অবশ্যই অঘটনঘটনপটিয়সী বৃষ্টি। এই দেখাটি সেখানে এতই অসাধারণ হয়ে উঠেছে যে ওই বৃষ্টিরই সঙ্গে তাঁর পিতার বহুচূর্ণ হাসিরেখার ঝাপসা ঝলক লেগে থাকাকে, যতই অসম্ভব বোধ হোক, অন্তশ্চক্ষে দিব্য করা যায়। পড়া যাক--- 'অতীতকে গোধূলি বানিয়ে, সঙ্গে নিয়ে, বৃষ্টি আসে/ আর আচম্বিতে এক ঝলক ঝাপসা হাসিরেখা, পিতার,/ বহুচূর্ণ।' পাঠক নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছেন যে এখানে শব্দটি আভিধানিক অর্থের সীমাকে কতদূর পর্যন্ত টপকে গেছে।

'নদীকূলে করি বাস'-এর 'মা' কবিতার গোধূলিকে আপাতভাবে সায়ংকাল ধরনের আভিধানিক অর্থসদৃশ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে শব্দটির ইলাস্ট্রিসিটি দীর্ঘ যন্ত্রণান্তে সংঘটিত প্রত্যাশিত বিলয় পর্যন্ত প্রসারিত। অপরাহ্ণকালীন দিগন্তের ধোঁয়া-ধোঁয়া আবহাওয়ার মধ্যে অক্সিজেন নল, স্যালাইন, ক্যাথেটার প্রভৃতি প্লাস্টিক-পলিথিনের লতা-গুল্মে মায়ের জড়িয়ে পড়ার পর কবির 'মনে হলো, বহুকাল পরে যেন গোধূলি নামছে।' শব্দটি যে অবসান-আনন্দ ধরে রেখেছে, তাতে তার পাশে ক্রন্দন নয়, 'উচ্ছল প্রগলভতা', 'অর্বাচীন সুরবোধ' এবং 'অস্পষ্ট বিলাপরীতি'ই কেবল মানায়।

"সভ্যতা বিষয়ে আরো কয়েক পঙক্তি" কবিতাটি 'সরাইখানা ও হারানো মানুষ'এর "সভ্যতা" নামধেয় কবিতাটিরই প্রলম্বন ("সভ্যতা" নামে 'নদীকূলে করি বাস'-এও একখানি কবিতা আছে)। আলোচ্য কবিতার "সভ্যতা : ঝাপসা ইতিহাসপর্ব"-এ ইতিহাসের গায়ে ভূগোল পোড়ার তীব্র গন্ধের বিকট এক ঝাপটা মারার কথা বলা হচ্ছে, যার ফলে ইতিহাসের গা থেকে উড়তে লেগেছে ব্যাপক ধোঁয়া এবং ধূলি। এরকম প্রেক্ষাপট সৃষ্টির পরই আবির্ভাব তাঁর গোধূলিভাবনের। 'এত ধোঁয়া ও ধূলি যে, গোধূলি বলে আর থাকবে না কিছুই এই গ্রহে!/ দিন ও রাত্রি সব ভাগ-ভাগ হয়ে যাবে একদম!'। এ আবার কেমন কথা গো! দিন ও রাত্রি তো ভাগ-ভাগ হয়েই আছে চিরকাল। দিনের ভিতরে রাত কিংবা রাতের ভিতরে দিনও কোথাও আছে নাকি ? অবশ্য কখনো কখনো এরকম মনে-হওয়া আছে বৈকি। তুমুল কুয়াশাকালে প্রলম্বিত রাত্রির বেড়াজাল ভাঙছে-না বলে বিছানা ছাড়ার প্রয়োজনকে পিছিয়ে দিচ্ছি কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত, কার-না এমন অভিজ্ঞতা আছে ; কিংবা ভরাজোছনায় দিনের আমেজ ফুরোচ্ছে না বলে তাকে রাতই ভাবছি না! অনেকেরই মনে পড়তে পারে যে 'মিডনাইট সান' বলে একটা টার্মের বহুল ব্যবহার আছে দেশে ও বিদেশে, এমনকি ঢাকায় এ নামে একটি রেস্তোঁরাও আছে। যাহোক, আপাতভাবে সময়বাচক ওই গোধূলিহীনতার আশংকাটি পাঠক হিসেবে আমাদের খুব ছুঁয়ে যায়। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু নেই হয়ে যাবার আর্তিতে স্যাঁতসেতে হয়ে যায় মন।

আভিধানিক প্রতীকী অর্থে 'গোধূলিবেলায়' শব্দটির ব্যবহার রয়েছে 'নদীকূলে করি বাস'-এর "আতাফল" কবিতায়। 'একদিন গোধূলিবেলায়, পিতামহ, ঘুম থেকে সহসাই জেগে উঠে, অনেকটা রহস্যের নায়কের মতো গেলেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ভিটায়। হাওয়ায় আন্দোলিত পোড়ো ভিটা।' এখানে শব্দটি স্রেফ অপরাহ্ণ বা সন্ধ্যা বা সূর্যাস্তকাল হিসেবেই ব্যবহৃত। কিন্তু যেখানে বলা হচ্ছে 'বিদেশী অরণ্য আজ আতায় গ্রেনেডে তোলপাড় এই গোধূলিবেলায়।' সেখানে এর অর্থকে প্রথমোক্তের চেয়ে ব্যাপ্ত ও প্রসারিত বলে মনে হয়। এই 'গোধূলিবেলায়' মানে সংকটকালে, কারণ ওইসব বিদেশী অরণ্যে (শুধু কি বিদেশেই ?) আজ আতার মতো বিধ্বংসী মারণাস্ত্র গ্রেনেডও ফলছে। আতা যদি বেহেশতি মেওয়াফল গ্রেনেড তবে ইহফল, মাসুদ খান জানাচ্ছেন। এই অস্তমাখা কাতর গ্রেনেডফল বা ইহফলকে তিনি বলছেন মিরাকল, যা 'রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু রৌদ্রছায়াময় দেশে দেশে'। ডানহাতে মেওয়াফল আতা, বাঁ'হাতে ইহফল গ্রেনেড ও মাঝখানে হৃদপিণ্ড নিয়ে স্বর্গসড়কের মহাবিপজ্জনক সাঁকো পেরোচ্ছে অনেক কিশোর সন্ত্রাসী। স্বর্গোন্মাদনাগ্রস্ত এসব কিশোর সন্ত্রাসীদের তথাকথিত বিপ্লবী তৎপরতায় দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে বিপন্নতা বোধ ক্রিয়াশীল, সে সংক্রান্ত সঙ্গত উদ্বেগটিই ধ্বনিত হয়েছে এই কবিতায় এবং 'গোধূলিবেলায়' শব্দটি জঙ্গিকণ্টকিত আমাদের ওই বিপন্ন বর্তমানকেই মূর্ত করেছে।

একই কবিতার 'পিতামহের বিরল-বসন্ত-চিহ্নিত ফর্সা অবয়ব আর লম্বা-লম্বা গোধূলিরঙের দাড়ি, আমাকে, আমার শিহরণগুলোকে আচ্ছাদিত করে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল একটানা প্রবল হাওয়ার ভেতর'-এর দাড়ির 'গোধূলিরঙের' বিশেষণটি লক্ষণীয়। হতে পারে গোধূলিরঙ বলতে গোধূলির কনে-দেখা-আলোর গোলাপি আভা বা মেহেদী পরা দাড়িকে বোঝানো হচ্ছে। অথবা পুরো জীবনকে একটি দিনের সমান ভেবে গোধূলিবেলাকে জীবনের সায়ংকাল ধরে বর্ষীয়ান মানুষের দাড়ির স্বাভাবিক রঙ শাদাও গোধূলিরঙের প্রতিপাদ্য হতে পারে। ঠিক এই একই অর্থে 'সরাইখানা ও হারানো মানুষ'-এর "ছক" কবিতায় আরেক বর্ষীয়ানকে চিত্রিত করেছেন মাসুদ খান। 'একবার গোধূলিরঙের লম্বা-লম্বা চুলদাড়িঅলা এক বুড়ো পথিক ক্ষণিকের জন্যে থামালেন তার পথচলা।' কিন্তু 'নদীকূলে করি বাস'-এর "বাজার" কবিতার গোধূলিরঙ মেহেদী বা শাদারঙ নয় মোটেই, পূর্বকথিত মেহেদী বা শাদা এখানে বদলে গেছে নিষ্প্রভতার দিকে। এই গোধূলিরঙের অর্থ মলিন, দুর্বল, অক্ষম ইত্যাদি। পড়া যাক, 'এবং এদিকে খুব উত্তেজিত রাত্রিরঙা টাকাগুলো সারা রাত/ তাড়া করে ফিরছে যত গোধূলিরঙের টাকাদের/ পূর্ব থেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে ক্রমশ পশ্চিমে...'। ডলারের তাড়া খেয়ে আমাদের মলিন টাকার এই পশ্চিমমুখীনতা দরিদ্র দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিণতিকেই মূর্ত করে বলে মনে হয়।

'সরাইখানা ও হারানো মানুষ'-এর "জাদুপুস্তক" কবিতার দুটি 'গোধূলি'প্রয়োগই অসাধারণ--- 'তবে তুমি যেখানটাতেই থাকো না কেন পুঁথিটার, থেকে যাও/ স্পষ্ট-অস্পষ্টের মাঝামাঝি, আকার ও নিরাকার আর/ লেখ্য ও কথ্যের গোধূলিসংকটে।' এই গোধূলিসংকট একটি অস্থির পরিসরের প্রতি ইঙ্গিত করে, যেটি সতত দোলায়মান। এই পরিসর দ্বারা না-স্পষ্ট না-অস্পষ্ট, না-আকার না-নিরাকার, না-লেখ্য না-কথ্য এরূপ এক অমীমাংসিত অবস্থা চিত্রিত হয়। দিন ও রাত্রির মাঝখানকার প্রাকৃতিক গোধূলিবেলা বিষয়ে একটি অভিজ্ঞতাজনিত স্পষ্টতা আমাদের সবারই কমবেশি আছে। কিন্তু স্পষ্ট ও অস্পষ্ট, আকার ও নিরাকার এবং লেখ্য ও কথ্যের মাঝখানকার দর্শনসম্মত গোধূলিধারণায় আমাদের মধ্যে অনভিজ্ঞতাজনিত অস্পষ্টতা বিদ্যমান। সে কারণেই এ গোধূলি 'গোধূলিসংকট'। আবার 'লিখিত বা অলিখিত, কথিত বা অকথিত হয়ে থাকছ, বেশ থেকে যাচ্ছ,/ স্রেফ গোধূলিভাষায়...'-এর গোধূলিভাষাকে দূরাবিষ্কার্য এক সান্ধ্যভাষার প্রতিকল্প ছাড়া আমরা আর কী ভাবব! কারণ ওটি 'ব্রাহ্মী, নাগরি, নাকি হায়ারোগ্লিফিক্স' আমরা তা জানি না বস্তুত।

একই বইয়ের "সেতু ও সম্পর্ক" কবিতার 'গোধূলি-অঞ্চল' এক রহস্যময় ব্যাখ্যা-অযোগ্য স্থান, সময় প্রভৃতিকে বোঝায় হয়ত। এ 'গোধূলি-অঞ্চল' কত নটিক্যাল মাইল বা কত মিলিমিটার কিংবা কত যুগ বা কত সেকেন্ড দীর্ঘ সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। আমরা অনুধাবন করতে পারি যে এ দুয়ের মাঝখানে একটা দূরত্ব থাকা সঙ্গত, যা হবে অবশ্যই 'কুয়াশাবিধূর', 'পারাপারাতীত' ও 'প্রহেলীধূসর'। পড়া যাক, 'প্রাণ আর অপ্রাণের মাঝখানে যেইটুকু গোধূলি-অঞ্চল/ জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে যেটুকু ধূসর ব্যবধান/ সেইটুকু এক নদী, আমাদের মাঝখানে---।' যতদিন সেতু না তৈরি হচ্ছে, ততদিন যথেচ্ছ সাঁতরানো ছাড়া এখানে আমাদের আর কী করণীয় আছে!

কৈফিয়ত
কবিতা নিবিড় অভিনিবেশে যতখুশি উলটেপালটে আস্বাদনের বস্তু, বড়জোর ইনিয়ে বিনিয়ে ধ্বনিসহযোগে পাঠ করে অন্যকেও আস্বাদনে সহযোগিতা করবার। এর রহস্য তাতে যদি খানিকটা খুলে তো খুলল, না খুললে নাই। নাটবল্টু খুলে এর আলাদা-আলাদা উপায়-উপকরণের দিকে তাকাবার চেষ্টা কখনো কখনো খুব অশ্লীল বোধ হয়। সাধারণত এসব আমি করি না, নীরব নির্জন পাঠেই আমার স্বস্তি। বৈয়াকরণিক রীতিশৃঙ্খলা মেনে অধ্যাপকীয় ঢঙে আলোচনা করবার কায়দাকানুনও আমার বিশেষ রপ্ত করা নেই। শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন ইজমনিষ্ঠ গ্রন্থাদি উলটেপালটে দেখেছি, অপ্রয়োজনীয় ঠেকেছে খুব, পাঠ্য মনে হয় নি। কাব্যালোচনায় বাক্যে বাক্যে এসব ইজম ও তার প্রবক্তাদের নামধাম উচ্চারণ করা না-গেলে, তথা অনেকানেক জেনেশুনে লিখতে বসেছি এরকম ফুটানি না-দেখানো গেলে ওই লেখার দিকে বিশেষ সমীহ নিয়ে না-তাকাবার রেওয়াজ শিল্পাতেলেকচুয়ালদের মধ্যে তুমুলভাবেই আছে। এসব জ্ঞানপনাকে আমার খুব ভয়ও লাগে, যেজন্য এমনকি আড্ডায়ও, ভারী ভারী শিল্পপরিভাষা উচ্চারিত হতে থাকলে আলগোছে কেটে পড়ি। বিভিন্ন ইজমঘনিষ্ঠ অভিধায় চমকিত হয়ে কতক কবিতা পড়তে গিয়ে এক জীবনে অনেক বমনদশাও হয়েছে আমার। কবিতা পাঠের মজাটাই তাতে নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছি। আগে একবার দেখেছেন এমন কারো পাশে বসে ফিল্ম দেখবার মতো অতিষ্টকর এই অভিজ্ঞতা। আমি এসবে মোটেই স্বচ্ছন্দ নই। বিশ্বাস ও চর্চা অনুযায়ী আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে কাজেই এই লেখাটি লিখতে শুরু করবারও আগে। মাসুদ খানের কবিতার গোধূলিপ্রবণতা বিষয়ে এই লেখাটি কাজেই আমি লিখি নি, লিখেছে কবি মাসুদ খানের প্রতি জন্ম নেয়া আমার ভিতরকার এক যুগবয়েসি মুগ্ধতা। লেখাটি আপাতত শেষ করে আনার জন্য ওই মুগ্ধতাকে জানাই গোধূলিপ্রণাম।

কৈলিক-সাংস্কৃতিক ভারসাম্য ও আমার লেখনপ্রয়াস

জেতা মৎস্য গিলে বকে মনুষ্য খায় বাঘ-ভালুকে
রহস্য বোঝে না লোকে কেবল বলে জয়।

দীন দ্বিজদাস, জনপদাবলি, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত

জীবন মানে কেবল নিয়মিত আহার গ্রহণ, তদসাপেক্ষে বর্জ্যত্যাগ ও নিয়মিত প্রজনন ক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া নয়। এরকম স্থূল জীবনকে মহিমা দিতে রুচিতে বাধে। সূক্ষ্মতার ভিতর দিয়েই জীবন মহিমামণ্ডিত হয়ে ওঠে। যে জীবনে খাওয়া-পরা-ভোগের অধিক মগ্নতা নেই, সে জীবন আমাদের কাম্য নয়। সূক্ষ্মতার দিকে তাক করা এই যে প্রত্যাশিত জীবন, এরও অবশ্য গোপন এক নির্ভরতা আছে খাওয়া ক্রিয়াটার ওপর। একটা বয়সে, কৈশোরে, যখন প্রথম বুঝতে শিখেছিলাম যে, জীবজগৎ সচল থাকার মূলে রয়ে গেছে নিরবচ্ছিন্ন খাদ্যচক্রের ভিতর দিয়ে শক্তির স্থানান্তর প্রক্রিয়া, তখন হঠাৎই একটা পরিবর্তন টের পেয়েছিলাম দেহে-মনে। কেননা তখনই জানতে পেরেছিলাম যে সমস্ত সূক্ষ্মতাই স্থূলতা নির্ভর। কিন্তু বরাবরই খানাপিনারূপ স্থূলতা শিল্পের জগৎ থেকে কমবেশি নির্বাসিত থেকেছে। এই স্থূলতা নিয়ে একটিও সচেতন বাক্য রচনা করেন নি বা আঁচড় কাটেন নি অনেক লেখক-শিল্পী, যেমন রবীন্দ্রনাথ।

আমরা জানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানির মাধ্যমে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে গাছের সবুজ পাতার কোরোফিল গ্লুকোজ নামক চিনি উৎপাদন করে, যে চিনিশক্তি গাছের খাদ্য। গাছের পাতা খেয়ে সেখান থেকে শক্তি আহরণ করে ক্ষুদ্র পতঙ্গকুল। ওই পতঙ্গ যখন জলের উপরে ভাসে তখন কোনো ক্ষুদ্র মাছ তাকে টপ করে গিলে নেয়। ক্ষুদ্র মাছকে পরে খায় কোনো অপেক্ষাকৃত বড়ো মাছ। ওই বড়ো মাছ হয়ত পরে খাদ্য হয় কোনো বিশাল আকৃতির মাছের। কোনো মৎস্যশিকারির মধ্যস্থতায় বিশাল মাছটি ধৃত হয়ে চলে আসে মানুষের খাবার টেবিলে। এই মানুষই কখনোবা বাঘ-ভালুকের খাদ্য হয় কিংবা মাছের। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তার দেহটি মাটিতে মিশে যায়। বেঁচে থাকতে মানুষটি যত শক্তি সঞ্চয় করেছিল সব শুষে নেয় মাটি। শিকড়ের মাধ্যমে ওই শক্তি আবার শুষে নেয় বিভিন্ন গাছপালা। বাঁচার প্রয়োজনে গাছপালাও আবার যথারীতি গ্লুকোজ উৎপাদন করে।

এই চক্রটি পুরোপুরি উপলব্ধিতে আসার মাধ্যমে সহসাই আমার বোধবুদ্ধিটা একটা দার্শনিক পরিণতিতে চড়ে বসে যেন। প্রাকৃতিক সবকিছুর পরস্পর নির্ভরতা বিষয়ক এক গূঢ় সত্যের বিশাল দরজা যেন উন্মুক্ত হয়ে যায় আমার সামনে। ভাবনাচিন্তা বিশেষ একটা ব্যাপ্তি পায়। তাহলে ব্যাপার এই, যে, জীবমাত্রই অন্য কারো খাদ্যে পরিণত হবার জন্য নিজেও খাদ্যসন্ধানে ব্যাপৃত থাকে অহর্নিশি! সন্দেহ নেই যে, শুনতে অতিশয় স্থূল লাগে চক্রক্রমিক এই খাদ্যগীতি। এর পাশাপাশি সুকুমারবৃত্তি নামধেয় ব্যাপারস্যাপার, তথা শিল্পসাহিত্যসংগীতনৃত্যঅভিনয়-- এসব কি ওই খাদ্যকল্পেরই অন্য রূপারূপ তবে? গুহাগাত্রে শিকারছবি এঁকে, বর্ণেশব্দে যাপনবিদ্যার তেলনুনছবি ধরে, কর্মের লাগোয়া সুরধুন তুলে, আহরণ মুদ্রায় শরীর বিক্ষেপণ করে, যাপনচর্যার বিবিধার্থক রূপায়ণ ছলে মানুষ আসলে কীসের প্রমাণ রক্ষা ও প্রলম্বিত করে এসেছে যুগ যুগ ধরে ? এসব কি এক অর্থে খাদ্য হয়ে ওঠা ও খাদ্য খুঁজে ফেরারই নন্দনতারিফ নয়?

বিজ্ঞানীরা ইকোসিস্টেম বা প্রতিবেশ ব্যবস্থায় জড়-জড়, জীব-জীব এবং জড়-জীবের মধ্যকার অত্যাবশ্যক সম্পর্কের আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক সকল কিছুই পরস্পরের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয়। কিন্তু শিল্পসাহিত্যসংগীতনৃত্যঅভিনয় প্রাকৃতিক নয়, মনুষ্যসৃষ্ট। এসবে আশ্রিত যে কলার ধারণা তা জড়ও নয়, জীবও নয়। প্রতিবেশ ব্যবস্থায় এর স্থান তাহলে কোথায়? এতদিন ধরে এর কোনো জবাবই আমার আয়ত্তে ছিল না। সম্প্রতি এর একটি সম্পর্কসূত্র বা বিহিত আমি খুঁজে পেয়েছি বলে মনে হয়, যখন বুঝতে শিখেছি যে, মানুষ তার বিস্তৃত পরিপার্শ্বে ক্রমশই তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর হয়ে উঠতে থাকে। মানুষের চারপাশের আপাত সীমিত যে পরিসর, যাকে মনে হয় যে এইই শেষ, এর সবটা জানা হলেই জানা হয়ে যাবে গোটাটা, তা আসলে ঠিক নয়। বস্তুত দিন দিনই পরিসরটি প্রসারিত হতে থাকে। যত দ্রুত জানাশোনার প্রসার ঘটে, তার চেয়ে দ্রুত প্রসারিত হয় নতুন নতুন পরিসর। তাতে কেবলই বোধ হতে থাকে যে, আমার জানাবোঝা অতিশয় তুচ্ছতর। তো, ওই তুচ্ছ আলোর প্রক্ষেপণে একান্ত যা ধরা পড়ে, তাতে মনে হয়, এই যত কলাকাণ্ড-- এরও নির্দিষ্ট ভোক্তাশ্রেণি থাকে, যারা এগুলো খায়। গলাধঃকরণ করে না বটে তবে খায়, উপভোগ করে। অন্যদের মতো কলাকার নিজেও একজন কলাভোক্তা। তাদের এগুলো আসকালসন্ধ্যার ভোগে লাগে। সেই আবার খাদ্য খুঁজে ফেরা, খাওয়া। খাওয়ার ভিতর দিয়ে জীবনীশক্তি, শৈলীপ্রণোদনা, জীবনসত্য ও আবিষ্কারোচ্ছ্বাস লাভ, অবলম্বন খুঁজে পেয়ে ঝুলে পড়া।

উলটোভাবে বিচিত্ররূপ কলারাও কলাকারকে খায়। অর্থাৎ কলাকারের নিজস্ব অনেককিছুর নিঃশর্ত সমর্পণের মাধ্যমেই কলা সৃজিত হয়, কলাবিদ্যা অর্জিত হয়। কলা একে একে কলাকারের সময় খায়, ঘুম খায়, স্বস্তি খায়, তৃপ্তি খায়, সম্পর্ক ও সামাজিকতা খায়, শান্তি খায় ; সবিশেষ দেহটা খায়, একেবারে খেয়ে ফেলে। যেমন কাব্যকলা খেয়েছে জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান, সাবদার সিদ্দিকী, ফাল্গুনী রায়, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, শামীম কবীর প্রমুখকে। কলা ও কলাকারের মধ্যকার এই সম্পর্ক জড়-জীব বা জীব-জড় বোধক। অনেকটা উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড চক্রের মতোই যেন। উদ্ভিদ অক্সিজেন দেবে প্রাণী নেবে, প্রাণী কার্বন-ডাই-অক্সাইড দেবে উদ্ভিদ নেবে। এই দেয়া-নেয়াই জীবনবায়ুর উদ্গাতা বোধকরি।

এটুকুই মাত্র আমার বিবেচনা, যে বিবেচনায় আমি বলতে চাই যে কলারও স্থান আছে খাদ্যচক্রে, অতএব ইকোসিস্টেমে। সকল কালের সকল কলার কাজেই অস্তিত্বশীল থাকতে হয়, নতুন নতুন কলাবস্তু ও কলাধারণা সৃজিত হতে হয়। তা না হলে তৈরি হয় ভারসাম্যহীনতার হাহাকার, যে ভারসাম্য কৈলিক ও সাংস্কৃতিক।

এহেন ভারসাম্য রক্ষার্থেই আমি কলাসৃজনে প্রবৃত্ত হই, লিখি-- আরো ভেঙে বললে জবাবটি অন্যরকম শোনাবে। সমস্ত বিস্তারণই কেননা আব্রুহীন, সমস্ত স্বচ্ছতাই কেননা রহস্যহীন। আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছি আমি, নানা ছুঁতোয়। দেখেছি যে, জবাব বারবার বদলে গেছে। একই সওয়ালের জবাবে একেক বয়সে দেখেছি একেক রকম উত্তরদান প্রয়াস। এখন মনে হয়-- আমার কিছু দৃশ্য, ঘটনা ও কার্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবার থাকে, যারা কারণসমূহের সাথে মিলিত হবার ইচ্ছেয় বহুকাল ধরে অপেক্ষায় আছে। আমার কিছু আনন্দ-বেদনা-ক্রোধ থাকে, যা সহস্রজনের আনন্দ-বেদনা-ক্রোধের থেকে আলাদা অথবা আলাদা নয়। যেসব বিষয়ে অনেকেই কোনোদিন কিছু ভেবে ওঠেন নি। আমার সবসময়ই কিছু কথা বানিয়ে বলবার থাকে, যা সত্যমিথ্যানিরপেক্ষ। লিখবার পরে প্রায়শ যেগুলোকে সত্যের পড়শির মতো মনে হয়। আমার কিছু তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করবার থাকে, যেদিকে মনোযোগদান প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্যে জরুরি বোধকরি। এছাড়াও যাপনযুদ্ধের বিভিন্ন পর্বে জড়-জড়, জীব-জীব এবং জড়-জীবের অনেক সম্পর্ক আমার কাছে নতুন করে প্রতিভাত হয়। ওই আবিষ্কারচিহ্নগুলো আমি ধরে রাখতে চাই, চিন্তার পরবর্তী পরম্পরার কথা ভেবে। আমার লেখনচেষ্টার নেপথ্যে সুপ্ত মূল কারণের বিভাজিত রূপ মূলত এই।

আমি না করলেও এই কাজগুলো অন্য কেউ হয়ত তার মতো করে করবেন। কিন্তু আমার মতো করে করা কেবল আমার পক্ষেই সম্ভব। দেখার ও লেখার প্রত্যেক লেখকেরই কমবেশি স্বতন্ত্র ভঙ্গি থাকে। থাকাটা জরুরিও। আমি দাবি করি যে, আমারও তা আছে। আর আছে বলেই ওই স্বাতন্ত্র্যটুকু বাংলা লেখন-বৈচিত্র্যের ভাণ্ডারে আমি যুক্ত করে যেতে চাই। তাতে বাংলাসাহিত্যের সমৃদ্ধি না এলেও বাংলা ভাষার সম্ভাবনাটি কিছু দৃষ্টান্ত লাভ করবে, নিঃসন্দেহে

২.
কবিতা বিষয়ে কিছু বলার চেয়ে একটি কবিতা লেখা বরং অনেক নিরাপদ। অবশ্য এরকম কোনো বাক্য এক্ষেত্রে বলা চলেই না যে এটি ওটির চেয়ে সহজ বা কঠিন, কিংবা ওটির চেয়ে এটি। যিনি যখন যেটা লেখেন, তখন তিনিই কেবল সেটার সারল্য-কাঠিন্য আন্দাজ করতে পারেন, অন্য কেউ নন। আমার কাছে দুটোই সহজ, যখন লিখি। লেখা হয়ে গেলে মনে হয় জব্বর জটিল এক সাঁকো পার হয়ে এলাম বুঝি! কী করে সাধন করলাম এই অসাধ্যকে? নিজেকে বেশ সফল মানুষ মনে হয় তখন। যখন সে লেখা অন্যের সাথে শেয়ার করতে যাবার প্রসঙ্গ আসে, পঠিত বা মুদ্রিত হবার কথা, তখন আবার অন্যরকম লাগে। মনে হয় এটা হয় নি কিছুই আর ওটা হাস্যকর রকম বাজে হয়েছে, ইত্যাদি। দাঁড়াল কী তাহলে? এই কি নয় যে কবিতা বিষয়ে আমি যা ভাবি, কবি হিসেবে প্রায়শই আমি তা করে উঠতে পারি না, কিংবা, আমার নিজস্ব কবিতাধারণাও ফ্রিকোয়েন্টলি বদলে যায়! অতএব এটা বলা যায় যে, আমার কবিতা সবসময় আমার পুরোপুরি প্রতিনিধিত্ব করে না। কী সাংঘাতিক! তাহলে তো বরং কবিতা থেকে আমার শত হস্ত দূরে থাকাই স্বাস্থ্যসম্মত! কিন্তু তবু লিখতে বসে যাই অধরা অদৃশ্যকে ধরতে, যা ধরা গেলে বলা যাবে যে এটি বা এগুলো আমার প্রকৃষ্ট প্রতিনিধি। কিন্তু হায়! প্রান্তর জুড়ে যথেচ্ছ দাপাদাপি করেও অধরা শেষপর্যন্ত অধরাই থেকে যায়।

একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে সর্বত্রই আমি স্বাধীনতার চর্চা করতে ভালোবাসি। লেখালেখিতেও। যখনই স্বাধীনেচ্ছা বিঘ্নিত হবার উপক্রম হয়েছে, তখনই আমার গতিমুখ বদলে নিয়েছি, এখনো নেই। সৃজনের প্রয়োজনে কারোর এঁকে দেয়া নকশামতো কিংবা অগ্রজের পদচ্ছাপ দেখে পা ফেলানো আমার পছন্দ নয়। ওই হাঁটায় অনুকারিতা যতটা আছে, আবিষ্কারানন্দ ততটা নেই। এজন্য কেউই আমাকে শিষ্য ভেবে স্বস্তি পান নি, আমিও পাই নি গুরু ভেবে। নিজের মতো করে দিকবিদিক হাঁটি, মানুষ-অন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের সঙ্গে মেলামেশা করি, দেখি ও শিখি। এই বিরল যাত্রাভিজ্ঞতার ফাঁক-ফোকরগুলো, ইমাজিনেশনের নরম পুডিং লাগিয়ে ভরে তুলে তার সাথে সহনীয় মাত্রায় মনের রঙ মিশিয়ে নিজের ভাষায় যতটা কুলোয় লিখে ফেলতে চেষ্টা করি। এদের কোনো-কোনোটিকে জন্মক্ষণ থেকেই সম্পন্ন হয়ে উঠতে দেখা যায়, কোনোটিকে খুব নিঃস্ব দেখায়। ঝরঝরে হয়ে উঠতে যতদিন লাগে, ততদিন এদের আগলে থাকি। চুল-নোখ কেটে দেই, জামাকাপড় ও কাজল-সুর্মা পরাই, হাগু-মুতু সাফসুতরো করি, গোসল দেই। শেষোক্তদের প্রতি মায়াটা একটু বেশিই জন্মে, এজন্য সঙ্গও বেশি পায় তারা, অটিস্টিক চাইল্ডের মতো।

সকল মানুষেরই বিচিত্র যাপন অভিজ্ঞতা আছে, কল্পন-সক্ষমতা আছে। আছে অনুভূতি প্রকাশের ভাষা ও মনে ছড়ানো বিচিত্র রঙ। অথচ সবাই কবিতা লিখেন না। কেন লিখেন না? কারণ তারা হয়ত কবিতা জিনিসটা পছন্দই করেন না, বা লিখে আনন্দ পান না, বা লিখতে পারেন না, বা এটাকে নিতান্ত পণ্ডশ্রম মনে করেন, ইত্যাদি। স্পষ্ট যে, আমি কবিতা লিখি ঠিক এসবের উলটো কারণে। কবিতা জিনিসটা আমার খুব পছন্দ, এটি লিখে বিস্তর আনন্দ পাই এবং লিখতে পারিও। কবিতা লেখাকে কখনোই আমার কাছে পণ্ডশ্রম মনে হয় না। এই-ই সার। এর বাইরে 'কবিতা না-লিখলে আমি বাঁচব না', 'আমি তো লিখি না, কবিতাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়' বা 'আমার কবিতা দূর আকাশ থেকে নাজেল হয়' বা 'লিখি সমাজবদলের জন্য'-- কবিতা লেখা নিয়ে ইত্যাদি কথাবার্তার সর্বৈব ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয় আমার। এই লৌকিক কাজটিকে যারা অতিলৌকিক বা অলৌকিক মহিমা দিতে চান, তাদের প্রতি একটা বড়োসড়ো সন্দেহ জিইয়ে রেখেই অধরাপ্রান্তরে আমার শিকারাভিযান আমি অব্যাহত রেখে চলেছি।

কামসূত্র কামশাস্ত্রমাত্র নয়, বরং কর্মশাস্ত্র

কামসূত্রে) অন্যের কর্মীবাহিনী দিয়ে নিজের কার্যোদ্ধার করার উপায় সম্বন্ধে বলা হয়েছে 'পরদারে গমন করিতে হইলে প্রথম এইগুলির পরীক্ষা করিবে-- সাধনের যোগ্য কি না, নিরাপদ কি না, সেটি আয়তিকর (গৌরবজনক) কি না এবং তদ্বারা বৃত্তিলাভ সম্ভব কি না।'--কলিম খান

ভারতবর্ষে 'কাম' ও 'কর্ম' শব্দে একসময় কোনো অর্থভেদ ছিল না। উপমহাদেশের কোনো কোনো ভাষা এখনো এই অর্থসম্পর্ক বহন করে। বাংলাভাষাভাষী কোনো কোনো অঞ্চলের ডায়ালেক্টেও কাম ও কাজ সমঅর্থে ব্যবহৃত হয়। সন্তান উপাদন ও পণ্য উৎপাদনসহ সব ধরনের উৎপাদন ও উৎপাদন সম্পর্ককে একই তত্ত্বের আওতায় এনে বর্ণনা করাই ছিল প্রাচীন ভারতীয় রীতি, যে রীতি থেকে আমরা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। জানাচ্ছেন কলিম খান।

কামশাস্ত্র বা কামসূত্র বলে চিহ্নিত শাস্ত্রগ্রন্থটি আদপে ছিল বিস্তারিত সমাজকর্মব্যাখ্যান, অর্থাৎ পরিপূর্ণ এক ব্যবস্থাপনা শাস্ত্র, অধুনাকার যৌনশাস্ত্র মাত্র নয়। ক্রিয়াভিত্তিক তথা অর্থগতভাবে বহুরৈখিক সংস্কৃত ও তার কন্যা বাংলাভাষা কালক্রমে অধঃপতিত হয়ে একার্থক প্রতীকী ভাষায় পরিণত হবার ফলে বহুঅর্থব্যঞ্জক কামশাস্ত্র অর্থগত ব্যাপ্তি হারাতে হারাতে একার্থক সেক্সোলজিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাতে আদিতে যা ছিল জ্ঞানী-কর্মীর মধ্যকার সম্পর্কের সূত্রাবলি, অন্তিমে একার্থক অনুবাদে-টীকায় তাই পরিণত হয়েছে কেবল মানব-মানবীর সম্পর্কসূত্রে। বস্তুতপক্ষে কামশাস্ত্রের সারকথা, মানব-মানবী, রাজা-প্রজা, পুরুষ-প্রকৃতি, জ্ঞানী-কর্মী, পরিচালক-পরিচালিত সকলের সর্বোৎকৃষ্ট কাম চরিতার্থ করা-- 'যেখানে পরস্পর পরস্পরের সুখের অনুভব করিয়া আনন্দক্রীড়ায় নিমগ্ন হয়, পরস্পর পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহার করিয়া থাকে, সেখানে সেই সম্বন্ধই প্রশস্ত।'

বাংলাঅনুবাদে বর্তমানে প্রাপ্ত সটীক কামশাস্ত্র গ্রন্থগুলোর মধ্যে বাৎসায়ন রচিতটিই প্রধান ও প্রাচীন। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০/৫০০ অব্দে সংকলিত। তবে এতে আদিম সাম্যবাদী ভারত সমাজের শেষপাদের আচার্যদের থেকে শুরু করে বৌদ্ধযুগের সূচনাকাল পর্যন্ত হাজার হাজার বছরের জ্ঞানকাণ্ডের সমাহার ঘটেছিল। বাৎসায়ন-পূর্বকালে ভারতবর্ষে কামশাস্ত্রের ব্যাপক অনুশীলন হয়, পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রগুলিও যার বাইরে নয়। এমনকি মহাভারতও একইসঙ্গে ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও কাম(কর্ম)শাস্ত্র।

বাৎসায়ন কামশাস্ত্রের শানেনযুলে ব্রহ্মাপ্রণীত একলক্ষ অধ্যায়ত্মক ত্রিবর্গসাধন (ধর্ম, অর্থ ও কাম সাধন), নন্দীরচিত সহস্র অধ্যায়ত্মক পৃথক কামশাস্ত্র, শ্বেতকেতু রচিত পাঁচশত অধ্যায় যুক্ত সংকোচন ও বাভ্রব্যরচিত একশত পঞ্চাশ অধ্যায়ে বিভক্ত সপ্তাধিকরণের পরম্পরার কথা বলেন। পরবর্তী সময়ে বাভ্রব্যের এক এক ভাগ নিয়ে আলাদা আলাদা গ্রন্থ সংকলিত হতে থাকায় এই শাস্ত্র ক্রমে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছিল। সুতরাং সম্ভাব্য বিলুপ্তি থেকে একে রক্ষা এবং সম্পূর্ণ শাস্ত্রটি আকারে বিশাল বলে পাঠকষ্ট অপনোদন করতে বাৎসায়ন সাতটি অধিকরণে, ছত্রিশটি অধ্যায়ে ও চৌষট্টি প্রকরণে বাভ্রব্যের শাস্ত্রের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ দেন, যা বাৎসায়নের কামসূত্র বা কামশাস্ত্র নামে পরিচিত। বাৎসায়নের পরেও কামশাস্ত্র চর্চা অব্যাহত ছিল। পরবর্তী রচনাগুলোর মধ্যে দামোদর গুপ্ত রচিত 'কুট্টনীমত', কোক্কোক রচিত 'রতিরহস্য', পদ্মশ্রী রচিত 'নাগরসর্বস্ব', জয়দেব রচিত 'রতিমঞ্জরী', জ্যোতিরিশ রচিত 'পঞ্চসায়ক', কল্যাণমল্ল রচিত 'অনঙ্গরঙ্গ', ক্ষেমেন্দ্র রচিত 'কলাবিলাস', পণ্ডিত অনন্ত রচিত 'কামসমূহ', দেবরাজ রচিত 'রতিরত্ম-প্রদীপিকা', হরিহর রচিত 'শৃঙ্গারদীপিকা' বা 'রতিরহস্য', বীরভদ্র রচিত 'কন্দর্পচূড়ামণি', আলি আকবর শাহ রচিত 'শৃঙ্গারমঞ্জরি' উল্লেখযোগ্য।

পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই যেমন ধর্মপ্রবক্তা কোনো নারীকে খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি ধর্মশাস্ত্র কিংবা কামশাস্ত্র নাজেলের নেপথ্যেও কোনো নারীর অস্তিত্ব ইতিহাসসম্মত নয়। কাজেই কামশাস্ত্রের বহুরৈখিক আদিপাঠ কিংবা একরৈখিক বর্তমান পাঠ উভয়তেই প্রকৃতি-নারী-কর্মী-প্রজা হচ্ছে ব্যাখ্যাত আর পুরুষ-জ্ঞানী-মালিক-রাজা হচ্ছে ব্যাখ্যাতা। এই মৌলহেতুবশত এবং প্রতীকী বাংলার ছিন্নসূত্র পণ্ডিতদের ধকল সয়ে কামশাস্ত্রের নারী-পুরুষ সম্পর্ক কালক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভোগ্যা ও ভোক্তৃরূপে। একরৈখিক ব্যাখ্যায় শাস্ত্রে বর্ণিত নারীর চরিত্রহানি ও সতীত্ব প্রসঙ্গ, পরস্ত্রী/পরনারী/বাঞ্ছিতাকে বশীভূত করবার কৃৎকৌশলের অনুপুঙ্খ বর্ণনা, নারীর ৬৪ কলায় পারদর্শী হয়ে ওঠবার দাওয়াই ইত্যাদিকে রীতিমতো নারীস্বার্থবিরোধী বলেই মনে হয়। অধুনা সর্বত্র এই কামশাস্ত্রেরই জয়জয়কার।

তথ্যসূত্র
১. ভাষার ঔপনিবেশিকতা : প্রাচীন ভারতে ম্যানেজমেন্ট ও বাৎসায়নের কামসূত্র, দিশা থেকে বিদিশায়, কলিম খান, হওয়া ৪৫, কলিকাতা, ১৪০৬
২. বাৎসায়ন-প্রণীত কামসূত্র, পঞ্চানন তর্করত্ন ও মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সংস্কৃত পুস্তক ‌ভান্ডার, কলিকাতা, ১৩৯৮

কবির প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা

সত্যি বলাই শ্রেয় যে শামসুর রাহমান আমার প্রিয়কবিদের মধ্যকার কেউ নন। যে ধরনের তাড়না থেকে আমি কবিতা পড়ি, উলটিয়ে-পালটিয়ে আস্বাদনের জন্য একটি কবিতায় আমি যে ধরনের কাব্যবস্তুর সন্ধান করি, শামসুর রাহমানের কবিতা তার যোগান আমাকে খুব কমই দেয় বা দিতে পারে। এজন্যে কবিতাপাঠের অভিপ্রায়ে প্রায়শই আমার শামসুর রাহমানমুখী হওয়া হয় নি। এ স্বীকারোক্তি আমার জন্যে যেমন মোটেই গৌরবের নয়, তেমনি শামসুর রাহমানের জন্যও নয় অগৌরবের। কবি ও পাঠককুলে ‌'কাব্যরুচি' বলে একটা ক্লিশে কথার ব্যাপক প্রচলন আছে। ওই শব্দবন্ধাভ্যন্তরস্থ অর্থসম্পদই আমাদের মধ্যকার এই বিরহাকুল পটভূমিটি রচনা করে দিয়েছে। বিষয়টি কাজ করে একটি সেতুর মতো। সেতুটি স্থাপিত হলো তো নৈকট্যও স্থাপিত হলো, না হলে দূর-মহাদূর। অর্থাৎ বোঝাতে চাচ্ছি যে, শামসুর রাহমানের কাব্যরুচি আমাকে আকৃষ্ট করে না, কিংবা বলা যায় সাধারণভাবে আমার কাব্যরুচি শামসুর রাহমানের কবিতার প্রতি বিকৃষ্ট হয়।

লেখার সূচনাতেই এরকম নেতিগন্ধী কথা প'ড়ে মনে করবার কারণ নেই যে, কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে এই লেখকের সামগ্রিক মূল্যায়নটিও সমভাবে নেতিভারাক্রান্ত। বরং সেটা এরকম যে, শামসুর রাহমান সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে তাঁর সময়ের অতি প্রয়োজনীয় একজন জন ও রাষ্ট্রসংবেদী কবিব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর অসংখ্য কবিতা যেজন্য দেশ ও জাতির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পেরেছে, আন্তরিকভাবেই যা আমাদের অনেকানেক জাতীয় প্রয়োজন মিটিয়েছে এবং মিটাবে। আমার কাছে এ বিবেচনায় তাঁকে এবং তাঁর কবিতাকে রীতিমতো অবিকল্প মনে হতো, এখনো মনে হয়, ভবিষ্যতেও এরকম মনে না হবার লক্ষণ আপাতত স্পষ্ট নয়। তাঁর 'আসাদের শার্ট', 'তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা', 'স্বাধীনতা তুমি', 'বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়'সহ অজস্র কবিতা এদেশের মানুষ এত অসংখ্যবার পড়েছে এবং কাজে লাগিয়েছে ও লাগাবে যে, বলা যায়, এগুলো লিখিত না হলে স্ব স্ব ক্ষেত্রের প্রয়োজনটি এত যথাযথভাবে মিটবার সুযোগই তৈরি হতো না।

'কবি দায়বদ্ধ কবিতার কাছে' (কবিতার দায়)--- কবির দায়বদ্ধতার এরকম একটি নিজকৃত সংজ্ঞায়নের পরও জীবনের শেষদিকে শামসুর রাহমান যেসব কবিতা লিখছিলেন, সেসব নিয়ে নব্য কবিতাকর্মীদের মনে ক্রমাগত সংশয় জন্ম নিচ্ছিল। 'যদি বাঁচি চার দশকের বেশি/লিখবো।/.../যদি বেঁচে যাই একদিন আরো/লিখবো।' তাঁর এই 'ইচ্ছা'র, আমরা দেখেছি, পূর্ণ বাস্তবায়নই করে যেতে পেরেছেন তিনি, প্রতিদিন লিখে। সাধারণত তাঁর কবিতার রক্তমাংসসহ শারীরিক কাঠামোটি এত নরম-কোমল ও পেলব হতো যে, দেখে মনে হতো কবিতা লেখাটা আসলে কোনো ব্যাপারই না, যেকোনো সময়, শারীরিক-মানসিক যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো বিষয় নিয়ে অবলীলায় লিখে ফেলা যায় একেকটি কবিতা। তবে এরকম ক্ষেত্রে সামাজিক দায় মিটলেও, সত্যিকারার্থে কবিতার দায় ঠিকঠাক মেটে কি না, সেসব নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন জাগত আমাদের মনে। অনেকেই আমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলাম ওই সমস্ত লেখার দিক থেকে। শাস্ত্রলাভের জন্য কবিদের ভিন্ন ভিন্ন পথে যাত্রা সূচিত হলেও শাস্ত্রটা মেলে শেষপর্যন্ত একস্থানেই ; মঞ্জিল মূলত একটাই, কবিতামঞ্জিল, অরূপসাগর তীরে--- আমরা জানতাম, তবু ওই অবলীলাবির্ভূত রচনামালার গুরুভাগকে সংশয়হীনভাবে গ্রহণ করা ও তার দিকে ফিরে ফিরেই তাকানো কিছুতেই আর হয়ে উঠত না আমাদের।
কিন্তু আমরা যখন তাঁর পুরানো কবিতা থেকে পড়ি--- 'গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।', (আসাদের শার্ট) তখন দু'টো দায়ই মিটে যায় বলে মনে হয়। যেজন্য আসাদের শার্টকে তখন আমাদের প্রাণের পতাকা করে নিতে বাধে না আর। এ জাতীয় কবিতাই, আমার ধারণা, শামসুর রাহমানকে বাংলার 'প্রয়োজনীয় কবি' হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। শামসুর রাহমানের কবিতাভুবন এরকম বিস্তর উদাহরণে ঠাসা।

জীবৎকালে সংঘটিত বাংলার-বাঙালির ছোটবড়ো প্রায় সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কাব্যিক গ্রন্থনা শামসুর রাহমানের হাতেই সফলভাবে ঘটেছে। আরো পড়া যাক কিছু--- 'তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।' (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা) ; কিংবা 'আমরা ক'জন শ্বাসজীবী/ ঠায় বসে আছি/ সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের/ শানিত চিৎকার/ কানে আসে, যাই জানালার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই/ পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ/ একটি জিপের দিকে, জিপে/ সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি/ অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর।' (পথের কুকুর) ; কিংবা 'দেখে সে/ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায় ; মুক্তিযুদ্ধ/ হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।' (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ)। অথবা যদি পড়ি--- 'হে পরওয়ার দিগার, হে-বিশ্বপালক,/ আপনি আমাকে লহমায়/ একজন তুখোড় রাজাকার ক'রে দিন। তা'হলেই আমি/ দ্বীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়/ তেল ঢালতে পারবো অবিরল,/ গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর/ মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে/ ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগ্বিদিক আর সবার নাকের তলায়/ একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ/ কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো, অব-কাঠামো।' (একটি মোনাজাতের খসড়া) ; বা 'উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে/ রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,/ বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ/ শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা/ নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়/ ফুটো করে দেয় ; বাংলাদেশ/ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার/ বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।' (বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়)। উদাহরণদৃষ্টে মনে হয় যে, এসবের জুড়ি আমরা কোথাও হয়ত খুঁজে পাব না আর বাংলা কবিতায় ?

ব্যক্তি ও সামাজিক মানুষ হিসেবে তিনি তুলনারহিত ছিলেন। 'না' বলতে জানতেনই না তিনি প্রায়। কিছু এলোমেলো শব্দের একটি স্তূপকে গ্রন্থের মোড়কে সাজিয়ে অথবা সাজাবার বাসনাটি অন্তত বগলদাবা করে তাঁর সামনে আর্জিটা পেশ করা গেলেই হলো, পাঠককে উদ্দেশ্য করে লেখাগুলো পড়ে দেখবার অনুরোধযুক্ত একটি ফ্ল্যাপ কিংবা ভূমিকা তিনি লিখে দিতেনই, তা আর্জিপেশকারী যেই হোক না কেন। এমনকি সম্পর্কের ফাঁসে জড়িয়ে অনেকে তাঁকে দিয়ে সাক্ষাৎকারের নামে নানা কিছু বলিয়ে নিতেও সক্ষম হতেন, এমনিতে যা হয়ত তিনি কখনোই বলতেন না। এই ভালোমানুষী সবসময় যে দেশ-জাতি, সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য মঙ্গলকর হতো না বলাই বাহুল্য। তবে কারো কারো প্রয়োজন তাতে অবশ্যই মিটত।

দেশের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও মানবিক দর্শন তাঁকে সবসময় মিত্র হিসেবে পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবাধিকারের পক্ষে তিনি তাঁর গোটা জীবনই সরব ছিলেন। এই সরবতা সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁকে এমন প্রয়োজনীয় করে তুলেছিল যে জীবনের শেষ সময়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতাকেও অনেকে মার্জনীয় বলে গণ্য করতে চাইত না। যেজন্য শারীরিকভাবে অক্ষম হয়েও বাধ্য হয়ে তাঁকে 'সভাপ্রধান', 'উদ্বোধক', 'প্রধান অতিথি' ইত্যাদি চরিত্রে রূপদান করতে হতো। তাঁর 'কবিতার দায়' প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, 'একজন মর্যাদাসম্পন্ন কবি বিশেষ কোনও দল, সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানের রীতিনীতি পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু তা'বলে সেই দল কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারেন না।' 'না' উচ্চারণ করতে পারার তাঁর সহজাত অক্ষমতা এবং অন্তিম সময়ে শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবার কারণে কখনো কখনো তাঁকে ওই পর্যায়েও যে অবনত হতে হয় নি তা নিশ্চিত করে বলা চলে না বস্তুত। অন্য সবার প্রয়োজনে লাগলেও, অনেকে জানেন, এসব ভার নিতে গিয়ে তাঁর শরীরের অনেক ক্ষতিও ডেকে আনা হয়েছিল।

একজন কবির দেশ-জাতি ও মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারা অনেক বড়ো ব্যাপার। কবি শামসুর রাহমান তাঁর মত্যুর বহু আগেই সে স্তরে উন্নীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমার ধারণা, দেশের প্রধান কবি হিসেবে জনসাধারণ্যে তাঁর স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে এটিও একটি বড়ো ভূমিকা রেখেছিল। কবির এরকম প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারার লাভ অনেক, তবে তা কখনোই পুরোপুরি ক্ষতিহীন নয়।

দরজা-জানালা
শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ৩য় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯
শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ, শ্রাবণ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০০১

'নির্মমতার ছকে বাঁধা সৌন্দর্য--- বেজির বালের মতো হাসে'

এই রচনাটি বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত 'অহরকণ্ডল' নামধেয় একটি অসাধারণ টেক্সটকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। পরবর্তীসময়ে এটি কামালউদ্দিন কবিরের নির্দেশনায় 'জন্মসূত্র'-এর প্রথম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চসফল হয়। তবে মঞ্চায়ন বিষয়ে এই রচনায় কোনো মূল্যায়ন করা হয় নি।


প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে, এই টেক্সট, অহরকণ্ডল, আলোচনার জন্য খুব উপাদেয় বস্তু নয়। এর মধ্যে সেই ধরনের বেপরোয়াপনা লক্ষণীয়, যা সৃজনশীল রচনার অ্যাকাডেমিক সীমারেখাকে থোরাই কেয়ার করে, যা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাপল্লির প্রচলিত ডাকনাম--- কবিতা, নাটক, গল্প ইত্যাদি কোনোটি শুনেই ঘাড় কাত করে পুরোপুরি সায় দেয় না বরং নাখোশ হয়েছে এরকম আচরণ করে। না থাকলেও চলত, কিন্তু তবু এর ওপরেও একটি গোত্রনামÑ'দৃশ্যকাব্য', অর্থাৎ দৃশ্যং তত্রাভিনেয়ম, চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ বস্তুপৃথিবীর সকল কিছুরই একটা না একটা গোত্রপরিচয় থাকতে হয়। থাকতে হয় এই অর্থে যে যারা এই গোত্রভেদগুলো করে, অর্থাৎ মানুষ, তারা সুনির্দিষ্ট অশনাক্তকৃত কোনোকিছুকেই খুব একটা সহ্য করতে পারে বলে মনে হয় না। তাই পূর্বতন নারী-পুরুষ কর্তৃক কোনোকিছুর ভেদ-অভেদ স্থির না করা হলে নিজেরাই স্থির করে নেয়। শ্রেণীকরণ করে। কখনো তা যথাযথ হয়, কখনো হয় না। এসব কথা এজন্য বলা যে, 'দৃশ্যকাব্য' শব্দবন্ধটি নতুন নয়, অথচ টেক্সটি নতুন। তাইজন্য এই শ্রেণীকরণ আমাকে নিমরাজি হয়ে মেনে নিতে হয়, অথবা না-মানা রোখটা দাঁতে দাঁত ঠুকে চেপে রাখতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো, আমি নিজেও যেখানে মানুষগোত্রীয় অর্থাৎ শ্রেণীকরণপ্রিয়, সেখানে একটা গোত্রনাম পেয়ে বর্তে না গিয়ে এত রোখারোখি কেন ? সেটা হয়ত নিজে এর একটি গোত্রচিহ্ন আঁকবার স্বাধীনতা না পাওয়ার কারণে। সুযোগ থাকলে আমি হয়ত একে চিহ্নিত করতাম 'না-জাতকল্প রচনা', 'মিথোবাস্তব আখ্যান' বা 'ঘোরকলা' বলে। নাম যদি একান্ত দরকারই হয়, তবে নতুন কিছুর জন্য চাই নতুন নতুন নাম। হায়, নামকরণেচ্ছাটি আমার, ধু-ধু করা বুরুঙ্গিবিলে যেন চামড়াখোলা বিপন্ন গরুর মতো অক্ষমতার সাকুল্য ক্রোধে হট্টিটি পাখি হয়ে ঘুমিয়ে যায়!

সৃজনপীড়নে উজ্জ্বল কিন্তু বিপুল বৈভবের ভারে কাবু অহরকণ্ডল জুড়ে দানিউল, আকমল, বাহার ও উপেন্দ্র চামার (একটিমাত্র দৃশ্যে যার সকরুণ উপস্থিতি) যে ঘোরের ভিতরে তাদের কর্মক্রম সম্পাদন করে চলে সে ঘোরটির আবিষ্কর্তা (ডিসকভারিস্ট) বদরুজ্জামান আলমগীর হলেও এর মৌল উপাদানসমূহ তথা স্মৃতিশ্রুতির উদ্ভাবক (ইনভেন্টর) সুদীর্ঘ ইতিহাস পরম্পরায় টিকে থাকা জনসমাজ। এই স্মৃতিশ্রুতি বা পুরাণকথা (ধর্মপুরাণ, লৌকিক পুরাণ, লোকাচার প্রভৃতি) অহরকণ্ডলে সতত জীবন পেয়েছে। কখনো কখনো মনে হয়, পুনরোন্মোচিত পুরাণকথাই অহরকণ্ডলের প্রধান কাণ্ডারি আর বাস্তবিক রক্তমাংসের মানুষ ও তাদের ক্রাইসিসসমূহ এর অনিবার্য অলঙ্কার মাত্র। অনিবার্য, কেননা তা না হলে এ টেক্সটের দিকে বিষজর্জর ও বিদিশাগ্রস্ত এ সময়ে মনোযোগ দিয়ে তাকাবার কোনো দরকারই হতো না। কেননা এই অলঙ্কারটুকু পরাবার জন্যেই জনসমাজ কর্তৃক সৃজিত বিচিত্রব্যাপ্ত আখ্যান ও ক্রীড়াসমূহের আহরণপ্রয়াস ও তার মালা গাঁথা।

'মনে হওয়া' বিষয়টা আসলে খুব স্বাধীনচারী, কিছুতে ঠেকে না। সেজন্যে বিপরীতভাবে এই 'মনে হওয়া'রও দেখা মেলে যে, পূর্বোক্ত 'মনে হওয়া'টি আসলে অনভ্যস্ততাজনিত। শিল্পপল্লিতে এরকমটি আমরা বরাবর দেখে-শুনে আসি নি। নতুন কিছুর আবির্ভাবেই বেশি পুলকানুভব করলেও মানবেন্দ্রিয়সমূহ মুদ্রাদোষবশত প্রথমেই খোঁজে সাদৃশ্য--- না পেলে থমকে যায় এবং অক্ষম, অসমর্থ ও অগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তাকে গ্রাহ্য করে। প্রবণতা অনুযায়ী গরিষ্ঠভাগ শিল্পভোক্তাই এখানে স্থির থাকে, তবে ভোক্তাদের মধ্যকার লঘিষ্ঠভাগ, যারা প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ও সংজ্ঞার প্রতি অন্ধবিশ্বাসী নয়, তারা অপেক্ষাকৃত নমনীয়ভাবে এর দিকে তাকায় এবং ক্রমশ মুগ্ধতার পানে চমকপ্রদ এক ভ্রমণ মনে করে হাঁটতে লাগে ; এবং শেষাবধি যে স্থানটিতে গিয়ে পৌঁছায়, সেটি পরিশ্রমলব্ধ বলে অতিশয় আনন্দদায়ক লাগে। ধারণা হয়, বাস্তব ঘটনা, স্মৃতিশ্রুতি ও কবিকল্পনার মিশ্রণানুপাতে অপ্রচলিত এক সমীকরণ স্থাপনের জন্যেই অহরকণ্ডল নামধেয় এই টেক্সটি নতুন--- যেজন্যে একটি শিল্পকর্ম হিসেবে এটি বিশেষ শ্রবণ-দর্শন ও বোধন যোগ্যতা দাবি করে বসে।

অহরকণ্ডলের মুখ্যপাত্রত্রয় দানিউল, আকমল ও বাহার রীতিমত আটপৌরে জন, কিন্তু মেথর সুনয়নীর চোলাই মদের ব্যারিস্টারিতে ও অন্যান্য কারণে এ কাব্যে তাদের গতিবিধি ও ক্রিয়াকর্মাদি পুরোমাত্রায় আটপৌরে নয়। দানিউল, বিয়ের রাতে চাইত্যান (ছাইতান) গাছে ঝুলে যার চাচা আত্মহত্যা করে, যার বোন স্বামীর মৃত্যুজনিত কারণে বিয়ের মাত্র দুমাস পরেই পেটে ডিম নিয়ে প্রত্যাবর্তিত, যথেষ্ট বাস্তব হলেও প্রচণ্ড রকম ঘোরগ্রস্ত। সে অগ্নিশিখার ভিতরে হাত-পাহীন, মাথাভর্তি লম্বা চুলওয়ালা মানুষের অবয়ব দেখে, কেলেন্ডারে ঝোলানো ছবিতে বুরাক উড়ে যেতে দেখে, পানিতে বমি করলে নিজের মুখ দেখা যায় বলে পরিকল্পিতভাবে তা বাস্তবায়ন করে। কিংবা দলের মধ্যে থেকেও একা, ৫ বছর বয়সে পিতাহারা আকমলের কথাই ধরা যাক, বিধবা মাকে একবার নগ্ন দেখবার স্মৃতিকে যে কোনোভাবেই ভুলতে পারে না, যার শাড়ির পাড় থেকে উদ্ভুত বাসুকি নাগের ফণা তাকে বড়ো ব্যতিব্যস্ত রাখে, যে দিগন্তলীন মাঠের পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে সৃষ্টিরহস্যে বিভোর হয়ে যায়, বিভ্রমে-বিভ্রমেই দার্শনিকোচিত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে 'কোনো কিছুরই স্থায়ী কোনো অর্থ নেই, সব মিথ্যা কুহক মাত্র।' জাত-ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু হয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে সতীর প্রেমে প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ বাহার যদিও অন্য দুজনের চেয়ে বেশি সপ্রতিভ, সবকিছুতেই যে উৎসাহী, উদবিড়াল দেখে যে বলে ওঠে 'ধর শালাকো', কূয়ার ভিতরে মুখ নামিয়ে যে শিশুর মতো ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উৎপাদন করে, তার কাছে মনে হয় সে হয়ত দেবতা হয়ে গেছে। এরা সবাই এ কাব্যে সবিশেষ 'মনে হওয়া' দ্বারাই চালিত। অবশ্য সর্বদা নয়। অসুস্থ মেয়ের রক্তবমি বন্ধ করতে জ্বিনের বৈঠক বসাবার খরচ যোগাতে সবান্ধব যে উপেন্দ্র চামার বুরুঙ্গির চরে জীবিত গরুর চামড়া ছিলিয়ে ধরা পড়ে ও আত্মদংশনে ভুগে নিজেরই চামড়া খুলে বদলা নিতে বলে, তার কথন এতটাই মর্মভেদী এক আর্তরব হয়ে ওঠে যে ওরা তাকে ক্ষমা করে দেয়। কারণ উপেন্দ্র'র সাথে ওদের পার্থক্য বস্তুতপক্ষে নেই-ই। ঘোরগ্রস্ত হয়েও কখনো কখনো এরা বাস্তব মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তমাংসের মানুষেরই আচরণ করে। দানিউল ছেলা গরুর মাংস কেটে নিতে চায়, আকমল হঠাৎ রণে ভঙ্গ দিয়ে গৃহে ফিরতে চায়, বাহারের বিনা আক্রোশে হত্যাকাণ্ড ঘটানোকে অনৈতিক কাজ বলে মনে হয়।

এ টেক্সটের চিন্তাপ্রক্রিয়া ও তার বর্ণনার যে গতি, চরিত্রসমূহও সেরূপ দ্রুতগতিতে চলে, কোথাও থামে না, থামে না যেমন ঘড়ির কাঁটা, সময়। এই দ্রুতযাত্রাপথের স্মৃতিশ্রুতি ও পুরাণকথার পশ্চাদমুখী টানকে (এটি অন্য আরেক বিতর্কের বিষয়) বিবেচনার বাইরে রাখলে এবং ভাষা ও শৈলীর চমৎকারিত্বকে উপেক্ষা করলে অতিপরিচিত তিনজন মানুষের বিশেষ উদ্দেশ্যে পরিচালিত নৈশাভিযানের যে গল্পটি এখানে পাওয়া যায়, তা খুবই সরল, যা সর্বাংশে ব্যর্থ এবং পাত্রত্রয়ের 'মনে হওয়া' দ্বারা প্রশান্ত ও উপসংহৃত। কিন্ত কাহিনীপ্রধান টেক্সট নয় বলে সেভাবে এটি বিবেচনাযোগ্য নয়। স্রেফ ঘটনার জন্য নিরাভরণ ঘটনার বয়ান অহরকণ্ডলে নেই। এর শক্তি এর ঈর্ষণীয় কাব্যভাষা, চরিত্রত্রয়ের মনস্তাত্ত্বিক ভাঙচুর এবং আরো অজস্র দিন ও রাত্রির নস্টালজিক অভিজ্ঞতার নিপুণ বুননশৈলী। অর্থাৎ এর সঙ্গত বিবেচনা সংশ্লিষ্ট সমস্ত কিছু--- ভাষার কাব্যিকতা, শৈলীনিরীক্ষাসৃজিত ঘোর, বিবিধ পুরাণ আখ্যানের সংমিশ্রণ এবং প্রবাহমানতাকে নিয়েই, যা অহরকণ্ডলকে প্রামাণ্য করে তুলেছে বর্ণিল এক পলিফোনি হিসেবে। এই পলিফোনিক ঘোর সৃষ্টি করতে গিয়ে রচয়িতার নিজেকেও ঘোরের সমীপবর্তী হতে হয়েছে, তাতে কখনো সখনো ভাষার সংলগ্নতার দাবিও হয়ে পড়েছে গৌণ, যার ফলে ভাষা সহসাই উন্নীত বা অবনত হয়েছে স্কিজোভাষায়--- 'বেগুনি, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা, লাল ও আকাশি রঙের প্রবাহে খণ্ডিত ও মুহূর্তকালীন সাপের মাথা, চাঁদের আলো, গজাল মাছ, মৌলভি, ঘোড়ার পা, নৌকার গলুই, টিকটিকির লেজ, মড়াখোলা, কিরিচ, টুপি পরা মুণ্ডু, মাছের দাঁত, মহিষের শিং, সড়ক, তালগাছ, বাঁশঝাড়, ইলেকট্রিকের খাম্বা, চামো পাড়া, ঝগড়ি, জোড়মল্লিকা, সিংহের মাথা, ভেড়ার দৌড়, বেতবুনিয়া, পুকুর ঘাট, ভাঙা দালান, ঘণ্টাধ্বনি, ঢং ঢং ঢং ! ঢং ঢং ঢং!'। অবশ্য ঘটনা ও উপঘটনার যে প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এ ক্যাটালগিংটি তৈরি, মনে করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ভাষাগত এ অসংলগ্নতাটিই সে পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সংলগ্ন।

স্বাভাবিক হয়েও অস্বাভাবিক এই চরিত্রসমূহ যে সমাজব্যবস্থা দ্বারা সৃজিত, সে সমাজেরই উচ্চকোটিভুক্ত একজন শিল্পপতি হামিদের তিনটি চাকরি ও একলাখ টাকার প্রলোভনে সম্মত হয়ে একজন নিরপরাধ মানুষকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার যে নৈশকালীন অভিযানে এরা শামিল এবং যে অভিযানটি একটি 'মনে হওয়া' ধরনের প্রতীকী সাফল্য ও সমবেত ক্রন্দনের ভিতর দিয়ে শেষ হয়, তা এই সমাজের গোপন হিংসাবিষের প্রবণতাসূচক একটি চিহ্নকেই রঙে-রেখায় এঁকে রাখে। এই হামিদদের আমরা চিনি জানি, আবার চিনিও না জানিও না। এরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। প্রতিদিন, প্রতিঘণ্টায় যে দেশে খুন হচ্ছে মানুষ, এমনকি হচ্ছে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়ও, সে দেশে এর নেতিমহিমা কীভাবে প্রতিনিয়ত জনঅসহায়ত্ব সৃষ্টি করে চলেছে তা কার না জানা! আমরা এ-ও জানি, এতজ্জাত খুব কম ঘটনারই সুষ্ঠু প্রতিবিধান হয়। হলেও হামিদকুল, যারা এসব দুর্ঘটের ঘটক, তারা অদৃশ্য ও অশনাক্তকৃতই থেকে যায়। শনাক্ত ও শেষে দৃশ্যমান হয় কেবল দানিউল, আকমল, বাহাররাই, যারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এসব ঘটিয়ে থাকে বা ঘটাতে যায়, নিয়ামুলদের বিরুদ্ধে যারা শরীরে বা শরীরাধিক চৈতন্যের কোথাও ক্রোধের ক্ষুদ্র জীবাণু পর্যন্ত খুঁজে পায় না।

তো, এই টেক্সটের একজন পাঠক হিসেবে বা অভিনেয় এই কাব্যের একজন দর্শক হিসেবে আমি বা আমরা কী মর্মবস্তু আহরণ করব ? যেকোনো শিল্পকর্মে তার ভোক্তাদের জন্য মোটাদাগে কোনো লার্নিং বা শিক্ষা ইনজেক্ট করা থাকা জরুরি--- এটা তর্কাতীত কোনো বিবৃতি নয়। তবু, সামগ্রিকভাবে ভাষাসৌকর্য, বাক্যস্থাপত্য, অভিনয়নৈপুণ্য, ভেতরস্থ খণ্ড উপলব্ধিমালা প্রভৃতির অধিক এক বা একাধিক মর্মকথা কি একটি বড়ো কাজের থেকে আমরা আশা করতে পারি না ? অহরকণ্ডলের সেই সামগ্রিক মর্মকথাটি কী, এর মঞ্চরূপায়ণ হয়ত সে দিকে স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত রাখতে সক্ষম হবে। কেননা অভিনয়ার্থে রচিত হলেও চমৎকার পরিবেশ রচনা ব্যতিরেকে এ কাব্যে অভিনয়ের জন্য অন্য কোনোরূপ সীমাশৃঙ্খল রচয়িতা কর্তৃক আঁকা হয় নি, এর মঞ্চ রূপায়ণের ক্ষেত্রে যা নির্দেশককে দেবে সৃজনব্যাখ্যান এবং পুনঃসৃজনের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা।

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...