Monday, June 20, 2011

শূন্যের কবিতার দিকে সকৌতূহলে তাকানো : আবিষ্কারানন্দে ভরা জগৎ

যাঁহারা সারবস্তুকে সার এবং অসারবস্তুকে অসাররূপে জানেন,
সেই সম্যকসংকল্পগোচর ব্যক্তিরা প্রকৃত সারবস্তু লাভ করিতে সমর্থ হন।
যমকবগ্গো ১২, ধম্মপদ

সম্প্রতি আমি আবিষ্কার করেছি যে, অনেক কবিতা আমার মধ্যে দারুণ বিরক্তি উৎপাদন করছে। ফিরে পড়তে ইচ্ছে করছে না। পালিয়ে বাঁচি অবস্থায় উদ্ধার পেতে হচ্ছে। যখন বুঝতে চাচ্ছি যে, কেন এমন হচ্ছে, তার জবাব খুঁজে পেতেও জান বেরিয়ে যাচ্ছে; অথবা পাচ্ছিই না জবাব। যেসব কবিতা আমার বিরক্তি উৎপাদন করছে, ওগুলো ভালো কবিতা হচ্ছে না, এরকম উপসংহারেও পৌঁছা যাচ্ছে না সহজে। কারণ আমার কাছে বিরক্তি উৎপাদনকারী কবিতা খোলা ময়দানে কিছু মানুষের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও আদায় করে নিচ্ছে। এ তথ্যে হয়ত এরকম একটা সিদ্ধান্তে সহজেই পৌঁছা যাচ্ছে যে, মানুষে মানুষে রুচিগত ক্ষেত্রে ভেদ আছে। কিন্তু যাকে আমি রুচিগত ভেদ ঠাওরাচ্ছি, তা কি আসলে তা-ই, নাকি এর মধ্যে অজ্ঞতাও লুকিয়ে আছে? আর এই অজ্ঞতা কার? আমার নাকি আমার সাথে রুচিভেদ ঘটছে যার, তার? দুটোই হতে পারে। তবে কখনো কখনো অন্যরকম সম্পর্ক (গোপন ও সন্দেহমূলক) আবিষ্কার করে যখন দেখি যে রুচিভেদের দোহাই দিয়ে পার-পেয়ে-যাওয়াজনের মধ্যে দূরভিসন্ধির উঁকিঝুঁকি দৃশ্যমান, তখন নিজেকে বোকা ঠাওরাবার আগে খানিক সতর্ক হয়ে যেতে হচ্ছে। আবার ভাবি, এ বিবেচনাটা তো কেবল আমারই একপাক্ষিক, কাজেই আমার পাঠটারও কি পক্ষপাতদুষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই? তখন মনে হয়, আমি আসলে কবিতাকে এখনো ঠিক বুঝেই উঠি নি, অন্যের লেখার ভালোমন্দ যাচাই করবার মতাও আমার এখনো তৈরি হয় নি। অথবা যদি কখনো হয়েও থাকে, তা কোনো কারণে সম্প্রতি হারিয়ে ফেলেছি! কখনো এরকম মতা আমার ছিল সেরকম দাবি জোরগলায় করতে না পারলেও এটা অন্তত মাঝেমধ্যে দেখেছি যে, আমার বলা অন্য আরো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রতিপন্ন হয়েছে। কিন্তু এ দিয়ে আমি কী প্রমাণ করতে চাচ্ছি? আমার মতের সাথে অন্য অনেকের মতের মিল ঘটলেই সেটা সঠিক মত, এ ভাববার মতো দুর্মতি আমি অর্জন করছি কোথা থেকে ও কোন যুক্তিতে? আবার কেউ নিতে না পারলেই সেটা সঠিক মত নয়, এটাই বা বলি কী করে? সাহিত্যমূল্য নির্ধারণের মাপকাঠি তো আর গণতন্ত্রের উঁচানো হাত না। গণতান্ত্রিক বিবেচনা বড়োজোর জনপ্রিয়তা নিরূপণের মাপকাঠি হতে পারে। জনপ্রিয়তা তো ভুল ব্যক্তিকেও রাজা বানিয়ে দেয়। এ কৌশল তো শিল্পকৌশল নয় বস্তুত, হলে হতেও পারে সম্মোহন-কৌশল।

আরো কথা থাকে, একজন ভালো কবি যদি সম্মোহনবিদ্যাটি ভালোভাবে রপ্ত করে ওঠেন, শিল্পকুশলতা অটুট রেখেও যদি তাতে সেই মতার প্রয়োগ ঘটান, তো দোষের কী? কবিতায় কবির ক্ষমতা তো প্রযোজ্য হয় ভাষা মাধ্যমে; যথাযথ শব্দ নির্বাচন, ব্যবহৃত শব্দের অর্থের আওতা বাড়ানো তথা অর্থে নতুন বারান্দা জুড়ে দেওয়া, শব্দ বিন্যাসের অতুলনীয় কারিগরি, বাক্যের বিন্যাস ইত্যাদি দিয়ে যা সাধন করা হয়। কবিতা এর বাইরে আর কী? অর্থবহির্ভূত কোনো শব্দপ্রয়োগ তো কার্যত অসম্ভব। কোনো কোনো নিরর্থক শব্দ সম্ভব, কিন্তু নিরর্থক শব্দ যখন অন্য স্পষ্টার্থক শব্দের পাশে আসন নেয়, তখন তা-ও একটা অর্থ প্রাপ্ত হয়। তো, সব মিলিয়ে শব্দ ও বাক্যপ্রকৌশল যদি নতুনতর একটা রূপ পরিগ্রহ করে, তাহলে তার খাপে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থ জায়গা নিয়ে নেয়। যেহেতু কাঠামো নতুন, ফলে অর্থের গায়েও একটু নতুন মোচড়, ঠমক হয়ত আমরা আবিষ্কার করে উঠি। এহেন ঠমক যেখানে আছে, সেখানে গিয়ে যদি আমি খানিকক্ষণের জন্য দাঁড়াই, তাতেই বা সমস্যা কী?

কিন্তু সবসময় ব্যাপারগুলো একরকম করে ঘটে না। ঘটলে আমার এরকম মনে হতোই না যে, আমি কবিতা ব্যাপারটা সম্পর্কে দিন দিন ভীষণরকম অজ্ঞে পরিণত হয়ে যাচ্ছি। আমার এরকম অভিজ্ঞতা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের কবিতা নিয়ে নয়, প্রায় সব সময়ের কবিতাকে নিয়েই। তবে একটু বয়েসি, যাঁরা মোটামুটি অনেকদিন ধরে কাব্যপাড়ায় চরে ও করে খাচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই বেশি। দীর্ঘদিন এ অঙ্গনে বিচরণ করায় তাঁদের নামের সাথে যে খ্যাতির কুয়াশা লেগে আছে, সেটার একটা প্রভাব আছে। ওখানে সূর্যের আলো পড়লেই ঝিলকে ওঠে। এর বাইরে বিভিন্ন সম্পর্কসূত্রে যাঁরা কবির কাছে বাঁধা, তাঁদের মনের মধ্যে কবির প্রতি একটা পক্ষপাতের শাঁসও জমে উঠে থাকতে পারে। প্রচারিত খ্যাতি ও সম্পর্ক এ দুয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে পাঠক তাঁর/তাঁদের (কবিদের) কবিতাকে পড়তে পারেন না বা প্রভাবটা যে তাঁর/তাঁদের (পাঠকদের) মতের ওপরে খবরদারি করছে, সেটা কোনোভাবে বুঝতেও পারেন না। এ না বোঝা পাঠকের মুখ থেকে কোনো কোনো লেখা এমন সব মত আদায় করে নেয়, যে মত আসলে ওই নির্দিষ্ট লেখা কোনোভাবেই ডিজার্ভ করে না। এর বাইরে আর তাঁদের ক্ষেত্রে এরকমটা লক্ষণীয়, যাঁরা কবিতাকে মাত্র বুঝে উঠতে শুরু করেছেন। পাঠক হিসেবে প্রচুর ভালো কবিতার ভিতর দিয়ে যাবার অনাগ্রহ, একদম নতুন হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা, খ্যাতিলিপ্সা, আচরণের ঔদ্বত্য, আগে কোনো ভালো কবিতা লিখিত হয় নি জাতীয় গৌরব তাঁদের দিয়ে যাচ্ছেতাই কবিতা লিখিয়ে নেয়, হয়ত। সতীর্থ তরুণরা প্রজন্মজোশে তাঁদের পেছনে বাহবা দিয়ে, তালি বাজিয়ে যাচ্ছেতাইয়ের দিকে তাঁদের আরো অনেকদূর এগিয়ে দেন মাত্র।
 
আজকাল কিছু ফোরামে কবিতা বিষয়ে এমনসব মত উৎপাদিত হতে দেখি, যা দিয়ে কার্যত মোটেই বোঝা যায় না যে, এগুলো আদপে ‘বলার জন্য বলা’ কিংবা ‘মুখ চেয়ে বলা’ কিংবা ‘না বললে কী মনে করবেন ভেবে বলা’ কি না। কারণ ‘ভালো লাগল’, ‘চমৎকার’, ‘অসাধারণ’, ‘সুন্দর’, ‘অতুলনীয়’ ইত্যাদি মত একটা বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলানো বা গণতান্ত্রিক মতের একটা সস্তা প্রদর্শন ব্যতিরেকে আর কোনো কাজই করতে পারে না বস্তুত; যা হয়ত এ জাতীয় আরো মতকে উদ্বোধিত করে, অথবা চুপ করিয়ে দেয় কিংবা এমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যা লেখাটি সম্পর্কে কারো মুখ থেকে উলটো কথাটি বলিয়ে নিতে প্ররোচিত করে। কাজেই এই তিনটার কোনোটাই প্রকৃতপক্ষে প্রার্থিত হতে পারে না। এ দিয়ে, আরেকজন, যিনি কবিতাকে বুঝে উঠতে চান, তাঁকে সহযোগিতা তো করা হয়ই না, বরং একটা কানাওলার হাতে সোপর্দ করে দেওয়া হয়। আমি বস্তুত এরকম কানাওলার দখলিস্বত্বে পরিণত হয়েছি আজকাল, মনে হয়। যে ভাবনা আমাকে ‘কবিতা বিষয়ে আমার বস্তুত কোনো মত নেই’, ‘আমি কবিতাজ্ঞ’, ‘আমি কবিতাব্যাখ্যার ক্ষমতা রাখি না’, ‘আমি সারবস্তুকে সার এবং অসারবস্তুকে অসাররূপে আজো চিনতে শিখি নি’ এরকম ভাবনায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এরকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে, আমি, বস্তুতপক্ষে কী বলব একটা সময়ের কবিতার সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে, যাকে আরেকজন মনে করতে পারেন যে, এ বলা একটা অর্থপূর্ণ বলা? কিছুই না। ওই কিছুই না লিখবারই একটা প্রয়াস এখানে আমি করতে যাচ্ছি, বিনীতভাবে।

২.
যেকোনো একটা সময় পরিসরে বাংলাভাষায় কবিতা লিখেন অনেক বাংলাদেশি কবিতাকর্মী। সংখ্যাটা এমনকি ৫০০-ও হতে পারে। এর মধ্যে প্রায় শ’খানেককে ধরা যায় যে, যাঁরা কোনো নির্দিষ্ট দশক পরিসরে নিজেদের প্রাথমিক বিকাশ সূচিত করেছেন। তো, সেই নির্দিষ্ট সময়ের কাব্যপ্রবণতাটা কী সে ব্যাপারে সামগ্রিক মত হাজির করতে চাইলে সবার কবিতার ভিতর দিয়ে যাওয়াই সংগত। কিন্তু কার্যত সেটা সম্ভব নয়। যখন সামগ্রিক মত দেবার বাহানা হাজির করে এটা করা হয় তখনো না। ওক্ষেত্রেও বস্তুত ওপরচালাকিরই জয় হয়। পরিসরের ব্যাপারটা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। এতদ সীমাবদ্ধতাকে আমল দিয়ে বলা যায়, নির্দিষ্ট সময়ের কাব্যপ্রবণতা বিষয়ক ধারণা নিতে চাইলে সবার কবিতা থেকে নমুনা হাজির করে তা করতে হবে-- এ বক্তব্যের কোনো বেইল নেই। অংশত নমুনা হাজির করেও সেটা করা যায়। এই অংশত নমুনার ক্ষেত্রেও কবিতা নির্বাচনে নানারকম ব্যাপার ঘটানো যায়; ১. দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন ও ২. সচেতন নির্বাচন দুটোই এক্ষেত্রে সম্ভব। আবার সচেতন নির্বাচন করা যায় যাঁরা ইতোমধ্যেই স্বযোগ্যতায় অথবা পাঁতানো কৌশলে আলোচিত-সমালোচিত হয়ে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন, তাঁদের কবিতা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে; এবং বিভিন্ন কারণে অনালোচিত ও প্রায়-অনালোচিতদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। যদি প্রশ্ন উঠে যে, কেবল কথিত অনালোচিতদের কবিতা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে করা আলোচনার ভিত্তিতে উপনীত সিদ্ধান্ত সামগ্রিকতার স্বীকৃতি পেতে পারে কি না; তখন পালটা এ প্রশ্নও করা যায় যে, কেবল কথিত আলোচিতদের নমুনার ওপরে প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্তও সামগ্রিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পাত্তা পাবার দাবি করতে পারে কি না। অর্থাৎ দুইয়েই সমান সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু, এরপরও, কথিত অনালোচিতদের থেকে নমুনা সংগ্রহের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে; তা এই যে, ইতোমধ্যে যেসব আলোকপাত করা হয়েছে, গড়ে সেসবে হাতেগোনা কয়েকজনের ওপরই আলো ফেলানো হয়েছে। অর্থাৎ ওখানে কী আছে না আছে তা খুঁজে দেখা হয়েছে (দেখার সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও)। কিন্তু বিপরীতপক্ষে কথিত অনালোচিতদের মধ্যে কী কী বৈশিষ্ট্য লুকানো আছে, তা প্রায়ই খুঁজে দেখা হয় নি। আমাতে নিহিত সীমাবদ্ধতাসহ আমি কথিত অনালোচিতদের কবিতা থেকে নমুনা পঙক্তি হাজির করে আমার আজকের আলাপটা সারবো বলে ভাবছি। উল্লেখ্য, এখানে যাঁদের কবিতা থেকে পঙক্তি হাজির করা হচ্ছে, তাঁরা এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বা অগুরুত্বপূর্ণ কবি, আমি এরকম কিছু বলতে চাচ্ছি না। সেটা তাঁরা হতেও পারেন, না-ও পারেন। কবি হিসেবে একজন কেউ বড়ো কি ছোটো, তা তাঁর এক-দুটো উজ্জ্বল পঙক্তি বা এক-দুটো উজ্জ্বল কবিতার সাপেক্ষে বলে দেয়া শোভন নয়। সেটা কারো অনেকানেক কবিতা পড়ে দায়িত্ব নিয়ে বলবার বিষয়। এ লেখার অভীষ্ট একেবারেই সেরকম কিছু নয়।   

৩.
ক. দিনে অন্তত, একবার কাঁদতে পারলে/ চোখে অত ময়লা জমে না (হিমেল বরকত)

কান্নাকে আমরা চরম দুঃখ ও সুখের একটা উপজাত হিসেবে পাই। যেকোনো ধরনের চরমতার দিকে এ পঙক্তি ঠেলে দিচ্ছে ওরকম মনে করবার কোনো দরকার নেই, বরং আমরা যাপনের একটা শৃঙ্খলা-ধারণার ওপরে একে স্থাপন করে দেখতে পারি। আমাদের প্রায় সকল ধর্মদর্শন ও এর বাইরেরও বিদ্যমান জীবনদর্শনের প্রায়-প্রতিটিই নিজস্ব যাপনকে নিজে নিজে স্বস্তির সাথে মূল্যায়নের কথা বলে থাকে, যা ধ্যানপ্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে সাধনযোগ্য। বলা হয় যে, তুমি ফিরে দেখো তোমার যাপিত দিনমান, তার মূল্যায়ন করো ভালো ও মন্দের নিরিখে, ওর কতটা আত্মকল্যাণ, কতটা জন কি প্রাণকল্যাণে লেগেছে আর কতটা অকল্যাণে; এবং যেটুকু অকল্যাণে গেছে তাকে পরিত্যাজ্য জ্ঞান করো, যাতে পরদিন আর ওরকম যাপনের ভিতর দিয়ে তোমাকে যেতে না হয়। এ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে একজন খুঁজে পেতে পারে এমন এক জীবনপথ, যা তাকে নিয়ে পৌঁছে দিতে পারে বুদ্ধত্বের সীমায়। এতদযুক্তিতে এ পঙক্তির কান্নাকে আমরা সেই আনুষ্ঠানিকতারই প্রতীক হিসেবে পাই, যাকে বলে আত্মসমালোচনা; যার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে নিজের যাপনক্রিয়া এবং যেকোনো পঙ্কিলতার আহ্বান তাকে আর বিভ্রান্ত করতে পারে না, যে পঙ্কিলতা এখানে চোখের ময়লা হিসেবে মূর্তিত। এমন নয় যে, এ পঙক্তির লেখক এই-ই বলতে চেয়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা যে ওই সংগত তীর্থে এর মাধ্যমে আসীন হতে পারছি, সে তো এ পঙক্তিরই বাহাদুরি, নয়?    

খ. নীরবতা এমন একটা প্রশ্ন-- যার উত্তর আমরা জানি না (সোমেশ্বর অলি)

জেনবাদে নীরবতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক ব্যাপার। এমনকি ওখানে নীরবতাকে মহিমান্বিত করে এমনও বলা হয় যে, ‘মৌনতাই জেন’। মুখে যে শক্তি ফুটে উঠতে পারে কথার রূপে, সে শক্তি তখন ক্রিয়াশীল থাকে অন্তঃকরণে, যা দশাসই একটা জগৎ সৃষ্টি করে নেয় অন্তরধামে। কিন্তু যেহেতু ওই কর্মাকর্ম অপ্রকাশিতই থাকে, কাজেই তা অন্যের সাথে সরাসরি যোগাযোগসক্ষম হয় না। কাজেই সরাসরি জানাও যায় না যে, আসলে ওখানে কী ধরনের অন্তরকম্প ঘটে চলেছে। ‘জেন কী?’ এ প্রশ্নের জবাব এ কারণে নেই। কথা দিয়ে এ বোঝানো যায় না, কিছুটা বোঝানো যায় নানা আচরণে। জেনের বাইরে এসে যখন মানুষের নানা পারস্পরিকতায় আমরা নীরবতা নিয়ে ভাবি, তাতেও একইরকম জবাবই সামনে আসে; যা অধরা, অসংজ্ঞায়িত ও অব্যাখ্যাত থেকে যায় পুরোপুরি। অর্থাৎ তার উত্তর আমরা জানি না। এই অত্যাশ্চর্য রহস্যেরই এক সমূহ বয়ান ধরা পড়েছে সরল সোজা স্থির নিষ্কম্প এই ঋজু বাক্যে।

গ. সিঁদুরে বিলপাড়ে শৈশব হাঁসের পাখনার মতো পড়ে ঘুমিয়ে আছে (সুজাউদ্দৌলা)

মানুষ যখন শৈশব যাপন করে সম্পূর্ণ জীবনের প্রথম পর্যায় হিসেবে, শৈশব সম্পর্কে বিশেষভাবে না জেনেই তারা তা যাপন করে। যখন এর মহিমাকে জানতে-বুঝতে শেখে তখন আর তার নিজের শৈশব ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে না। কিন্তু এ সময়ের কিছু অর্জন পরবর্তী জীবনে উঁকিঝুঁকি দেয় নানা যাপনবাস্তবতায়। এ শিক্ষা কোনো অবস্থায়ই সচেতন শিক্ষা নয়, বরং সবৈব অচেতন শিক্ষা। তবে সচেতন শিক্ষার পর্যায়ে এ পর্বের খড়কুঁটোই অনেক বড়ো মহিমা নিয়ে আবির্ভূত হয় স্মৃতিতে, সজ্ঞায়। এ পঙক্তি উন্মোচন করছে তেমনি এক অধ্যায়ের, যে অধ্যায় গ্রামজীবনের সতত সচল এক প্রাণোচ্ছল বয়ান। বয়সের পরিণতিতে আমরা যেমন হারাই আমাদের শৈশব, তেমনি গ্রামীণ জলমহালে বিচরণরত হাঁসেরা হারায় তাদের পালক (পালকগুলো অবশ্য হারায় পুরো হাঁসকেই!)। ওই হারানোর বেদনাই এ পঙক্তিতে মূর্ত হয়েছে অনিঃশেষ মায়াময় রূপে, যেখানে শৈশব ও হাঁসের পাখনা একাকার হয়ে মিশে গেছে একটা হাহাকার হয়ে। 

ঘ. জোনাকিদের সাথে এক জীবন কাটিয়ে ফিরলাম (সজল সমুদ্র)

এ বয়ান গ্রামজনপদের নিজস্ব একটি রূপমহিমাকে নগ্ন করে দেয় যেন। নিতম্বে সতত নিঃসরিত লুসিফেরিন নিয়ে উড়ে চলা জোনাকির প্রেমে বুঁদ হয় নি যার শৈশব-কৈশোর, তার প্রতি অশেষ করুণা। শৈশবে-কৈশোরে এ যে বিস্ময় উপহার দেয় তার প্রেমে পড়ে কত না ঘণ্টা সময় আমরা উড়ে যেতে দিয়েছি ঝোপে-জঙ্গলে, তার হিসেব কে কবে রেখেছে? উন্নয়নের মহামারিতে কাবু নগরের কৃত্রিম ঔজ্জ্বল্যের ধারকাছ দিয়ে আসে না এই জোনাকিপ্রহরা। এরা ভালোবাসে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক অন্ধকারে আলোর ফুল ফুটিয়ে লুট হয়ে যাওয়া থেকে প্রকৃতির অফুরান সুন্দরকে রক্ষা করে যেতে! কৃত্রিম নগর জনপদ থেকে জোনাকিবহুল এরকম কোনো অনাহত কৌমার্যসম্ভব গ্রামদেশে গিয়ে ফের কৃত্রিমতায় ফিরে আসতে হলে এরকম গৌরবগানমূলক বিবৃতি উথলে উঠতে পারে কবির কলমে। এই স্নিগ্ধতার গান যেন আমাদের সব ধরনের অকৃত্রিমতার দিকেই আহ্বান করে।

ঙ. গাছ বড় হলে ছোট হয়ে যায় পথ (সফেদ ফরাজী)

গাছ পদার্থ, অতএব এ যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই জায়গা দখল করে। যখন তা সতেজ ও সপ্রাণ, তখন তা ক্রমবর্ধমান। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই বেশি জায়গা বুঝে নিতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় পথের পাশে থাকা গাছ এক সময় পথের অনেকাংশ দখল করে নিয়ে পথকে ঠেলে ধাক্কিয়ে ছোটো করে দেয়। এ সরল বাক্য থেকে একটু বাঁকিয়েও অর্থ নিষ্কাশন করে নেয়া যায়। ধরা যাক, একজন মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠার ঘটনার প্রতীকী বয়ান এটা। যত ফুলেফেঁপে ওঠা, তত তার আগ্রাসী আচরণের বিকাশ। তার কাছে পৌঁছার সুযোগ সেক্ষেত্রে লোপ পায় দিনে দিনে। ছোটো (এখানে ছোটো মানে কম অর্থ ও প্রভাবসম্পন্ন) থাকা অবস্থায় যারা তার কাছে হামেশাই যেতে ও কথা বলতে পারত, তারা তখন তার টিকিটিরও স্পর্শ পায় না, হারায় সব ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয়। এই অর্থেও উৎকলিত বাক্য যথোপযুক্ত তাৎপর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। সবিশেষ যাপনসম্পর্কিত এক অভিজ্ঞতাসার যেন এই পঙক্তি, ধরে আছে আলগোছে। 

চ. লালের ভিতর লালই সবচে লাল (শিশির আজম)

অজস্র মাত্রাগত ভেদ নিয়ে থাকা লাল একটা পরিচিত রংয়ের নাম। লাল লাল হয়েও সব সময় লাল নয়, আবার নিলালও কখনো কখনো লাল। আলোর বিজ্ঞান দ্রষ্টার চোখকে যেভাবে অধিকার করে, তার ওপরে যে শাসন স্থায়ী হয়, তা-ই নির্ধারণ করে দেয় লালের ব্যাকরণ, রচনা করে দেয় ব্যবহারিক এক লালাভিধান। অর্থাৎ সব লাল সবার কাছে সমান অর্থবোধক নয়; কোনোটা ঊন, কোনোটা অতি। এসব ভাবনা সামনে আনে বাক্যটি। লালের সাথে রাজনীতিরও একটা পৃথিবীব্যাপ্ত সম্পর্ক আছে, যে ভঙ্গিতে দেখলে লালের অপর নাম হয়ে পড়ে বিপ্লব। আর এভাবে দেখলে বাক্যটিতে যমক অলংকারের সংস্থানও লক্ষ করা যায়। এই ভাবনাব্যাপ্তি মিলিয়ে বাক্যটি এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বিপ্লবী যেন। এই বাক্যের আদলে ‘মানুষের ভিতর মানুষই সবচে মানুষ’ লিখলে ব্যাপারটা সহজে পরিষ্কার হয় হয়ত, যে, এখানে তিনটি ‘মানুষ’প্রয়োগই সমান নয়। বোঝা যায় যে, মানুষ পরিচয়ধারী অজস্র মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানুষই কেবল মানুষ।

ছ. এমন সুন্দর নিরিবিলি/ স্থানে কবর!/ মন বলে মৃত্যুকে ভালোবেসে ফেলি... (শাহিন লতিফ)

জগৎ-কোলাহল জীবনপ্রবাহেরই স্মারক। যেখানে জীবন আছে, সেখানেই কোলাহল আছে, কোলাহলের বাড়াবাড়ি আছে। আর বাড়াবাড়ি আছে বলে কোলাহলাধিক্যকে শব্দদূষণ নাম দিয়ে মানুষ তা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনবিধিও প্রণয়ন করে নিয়েছে। অর্থাৎ কোলাহলাধিক্যকে মানুষ এড়িয়ে চলতে চায়। নানা কারণে মানুষ জীবনে থেকে প্রায়-জীবনবিরোধী (!) নিরিবিলিকে তার আকাঙ্ক্ষার বস্তু করে ভাবে। যাপনের ক্লান্তি, বিষাদ-বেদনা, ধ্যানস্থ হবার মতো পরিবেশ সৃষ্টির বাসনা হয়ত এই আকাঙ্ক্ষার নেপথ্যে কাজ করে থাকে। যে কারণেই হোক, এই বাস্তবাকাঙ্ক্ষাটাই ধরা পড়েছে এই পঙক্তিতে, যা এমনকি মৃত্যুকেও কাম্যবস্তু বলে ভাবতে প্রস্তুত; কেননা আকাঙ্ক্ষা সর্বাবস্থায়ই দুঃখউৎপাদী! মৃতদের আবাসস্থল নির্দিষ্ট করা হয় সাধারণত মানুষের বসবাস থেকে দূরবর্তী নির্জনে। গাছলতাপাতামণ্ডিত হয়ে ওই স্থানগুলো ক্রমশ এমন এক অক্ষত প্রাকৃতিক রূপ পরিগ্রহ করে পক্ষীকুজনিত হয়ে ওঠে যে, মনে হয় এখানেই যেন প্রকৃত শান্তি। ওই শান্তির প্রতি এক নীরব সমর্থন এখানে ধ্বনিত হতে শোনা যায়।

জ. হন্তারক জলের মাঝরেখায় হারিয়ে যাওয়া এক অবোধ্য পুরুষজন্মের পাপ, গ্লানি ও সমাগত মৃত্যুর কোনো তেজস্বী স্বাদের দিকে পলানো পায়ের শব্দ ছাড়া আমার মনের অন্য কোনো গন্তব্যই নেই! (শাবিহ মাহমুদ)

মানবাকাঙ্ক্ষা নিষিদ্ধ আনন্দ লাগি নিশি জাগে। যেদিকে নিষেধাজ্ঞা, সেদিকেই ধাবিত হতে চায় সব বাধা উপেক্ষা করে। কখনো ন্যায়পথের উজানেও সমাজ বাধার প্রাচীর উঁচিয়ে ধরে না তা নয়, তবে সাধারণত অন্যায়কেই সমাজবিধান মন্দ বলে চেনায়; যেদিকে রিপুসমূহের অবাধ মুক্তির সম্ভাবনা উন্মোচিত। আর কে না জানে যে, সমাজবিধানের প্রায় ৮০ শতাংশই ধর্মবিধান। সহজাতভাবেই মানবেন্দ্রিয় তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয় অত্যজ্জ্বল নিষিদ্ধ পুরীর দিকে। যথেষ্ট পরিমাণে সমাজানুগত নয় এমন স্বাধীন মানুষ, বিশেষত শিল্প-সাহিত্য বলয়ের নিষ্ঠকর্মীদের মাঝে প্রায়শ সমাজশৃঙ্খলা ভেঙে ফেলবার তাড়না লক্ষ করা যায়। আবিষ্কারের নেশায় নিষেধাজ্ঞার দেয়াল ডিঙানোর একটা তীব্র বাসনা জন্ম নেয় তাঁদের মধ্যে। বাসনার বাস্তবিক চরিতার্থতা কখনোসখানো ঘটে বটে, তবে এর সবচেয়ে বেশি চরিতার্থতা ঘটে মানসিকভাবে। এই পঙক্তিতে সমাজবিধানানুসারে মন্দ বলে নির্ধারিত নিষিদ্ধ আনন্দের দিকে সচল এক মানসিক বিহারাকাঙ্ক্ষার স্ফূর্ত বয়ান মূর্ত হয়ে রয়েছে। 

ঝ. ওরে গান বিনে আজান তুমি পাইবা কোন কোনাচে॥ (শফিক মনজু)

কোনো কোনো ধর্মদৃষ্টি গানকে ভালো চোখে দেখে না, যদিও সুরকে নানা আঙ্গিকে ধর্মও তার এলাকাভুক্ত করে নিয়েছে। যে গান বিনোদনলক্ষ্যী, কিংবা যেখানে স্রষ্টা ছাড়া আর্তি ধ্বনিত হয় অন্য কোনো অভীষ্ট মঞ্জিলের দিকে, সেখানেই ধর্মের সমূহ আপত্তি ধ্বনিত, যে আপত্তির প্রতি এ পঙক্তিতে পুনরাপত্তি ব্যক্ত হয়েছে। দুটোকে এখানে একাকার করে দেখা হয়েছে, কেননা দুটোই মগ্নতা বা ধ্যানজাত এবং দুটোরই ভিত্তিভূমি সুর। উদ্দেশ্যদৃষ্টেও অনেক গানে ও আজানে দূরত্ব নেই। মরমি সংগীতসমূহও একার্থে স্রষ্টার প্রতিই নিবেদিত (যদিও এ স্রষ্টা সে স্রষ্টা নয়), অথবা স্রষ্টার দিদার লাভের পন্থা অনুসন্ধানে রত। কখনো কখনো ওসব গানকে অন্যের প্রতি নিবেদিত মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টারই সন্ধান করা হয় ওসবে। আর যদি অন্যকে নিবেদন করা হয়ও, তবু তা ধর্মবিরোধী হয় না এক বিচারে। কারণ ধর্মানুশাসন অনুসারে সৃষ্টির বন্দনা করাও প্রকারান্তরে স্রষ্টারই বন্দনা। এমনকি প্রকৃতিও যদি স্রষ্টারই সৃষ্টি হয়, তাহলে প্রকৃতির গুণগানও শেষ বিচারে স্রষ্টারই গুণগান। সংকট মূলত দেখার রাজনীতির মধ্যে।

ঞ. আহা, ঝরাপাতা, ঝরাপাতা গো, ভুলেই গেলে তুমি পাখি (রাশেদুজ্জামান)

উদ্ভিদের প্রাণ আছে, সংগত কারণে আছে পাতারও, যা উদ্ভিদকে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্যসংগ্রহে সহায়তা করে। কিন্তু ঝরাপাতা হলো মরাপাতা, যা বিগতপ্রাণ, একা। এই বিগতপ্রাণ পাতা বাতাসের সাহচর্যে পাখিরূপ প্রাণীর আচরণ করে বা করতে পারে। যখন বাতাস নেই, তখন তা একান্তই জড়। জড়ের নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। মনে রাখা নেই, ভুলে যাওয়াও নেই। বাতাস নেই বলে ঝরাপাতা হয়ত না-ওড়ে ভূমিলগ্ন, কিন্তু তার মধ্যে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত নিরুদ্যমতা আবিষ্কার করে জড়ভরত পাতার প্রতি কবির অভিমান মূর্ত হয়েছে এ বাক্যে। যেহেতু ঝরাপাতা অভিমানের অর্থ অনুধাবন করতে জানে না, কাজেই তাকে পাখির রূপে দেখা, এই প্রাণারোপ। ওই বিশেষ পারসনিফিকেশনটি এখানে উথলানো আবেগটিকে সংজ্ঞায়িত করে।

৪.
দেখারও রকমফের আছে। একটা বস্তুকে ওপর থেকে, নিচ থেকে ও পাশ থেকে দেখা যায়। পাশ থেকে দেখার আবার ভিন্নরীতি হতে পারে, এপাশ থেকে ও ওপাশ থেকে। এর বাইরেও দেখা সম্ভব, কোনাকুনিভাবে আড়চোখে, ছিদ্রপথে খণ্ডিতভাবে। আমার দেখাটাও একটা দেখা। বিবৃত ধরনসমূহের কোনোটিতেই হয়ত সেটা পড়ে। না পড়লে এর অন্য আরেক নাম দরকার। সে নাম নেবার দায় আমার নয়। যাঁরা আমার দেখার সমালোচনা করবেন, সে নাম তাঁরা দেবেন, যদি দরকার মনে করেন।

আমি এই লেখায় একটিও সমগ্র কবিতাকে বিশ্লেষণের আওতায় আনি নি। তা দরকারও মনে করি নি। সংশয়-কারণে আপন সক্ষমতাহীনতার যে কথা বলেছি শুরুতে, তা-ও একটা ফ্যাক্টর এখানে। যাই হোক, কখনো কখনো একটা বাক্য যে কথা বলতে পারে, একটা আমূল কবিতাও তা পারে না। কবিতাকে সমগ্রতা দিয়ে দেখবার দিন ফুরিয়েছে বলা হয় এখন। বহুরৈখিকতার এক তুমুল মহামারি এখন চারপাশে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের বদলে যে কারণে বহুবিধ জ্ঞানকে মূল্য দেয়া হচ্ছে এখন। একটি কাজ খুব ভালো পারেন এমন জনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে, দশটি কাজ মোটামুটি পারেন এমন লোককে মালা পরিয়ে দেয়া হচ্ছে দেদারছে। এ যুক্তিতে বাক্যের জানালা দিয়েই কবির জগৎ দেখবার চেষ্টা করা সংগত মনে হয় আজকাল। আর শূন্যের কবিতাকে এভাবে দেখা দোষের নয়, কারণ বহুরৈখিকতার চর্চা এ সময়ের কবিদের এক ঘোষিত বৈশিষ্ট্যও, সেটা কতটা সফলভাবে নিষ্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না হচ্ছে তা দেখতে হয়ত আরেকটা টার্মস অব রেফারেন্সের ভিতর দিয়ে যেতে হবে আমাকে, দুদিন আগে আর পরে।  

এভাবে, বর্ণিত প্রক্রিয়ায়, চলতি পথপরিক্রমায় আমি যা দেখলাম, তার একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাসরেখা টেনে রাখা ভালো। আমি দেখলাম শূন্যের কবিতা : যাপনশৈলী নিয়ে ভাবছে, দার্শনিকতার বীজ বুনছে, অতীতচারণ করছে, নিখাদাসক্তি দেখাচ্ছে, অভিজ্ঞতাসার বিলাচ্ছে, প্রতীকায়ন ঘটাচ্ছে, শান্তিস্বস্তি খুঁজছে, চিত্তবাঁধন টুটাচ্ছে, সীমানাপ্রাচীর ভাঙছে ও জড়ে প্রাণারোপ করছে। বাংলা কবিতায় এসব আগে ছিল কি ছিল না তা এখানে বলার অধিকার আমার নেই। আমি সব বাংলা কবিতা পড়ি নি। তবে আমার দেখার পরিসর কালক্রমে আরো বাড়বে। শূন্যের কবিতা ধরে পেছন থেকে সামনের দিকে যাবার প্রক্রিয়ায় আরো যেসব নুড়িপাথর কুড়িয়ে পাব, সেসব মিলিয়ে হয়ত পরে আরো কথা বলবার ফুরসৎ মিলবে। এখন কেবল এরকম বলতে স্বস্তি লাগছে যে, শূন্যের অনির্বাচিত কবিতার ভিতর দিয়ে যেতে আজো বেজায় ক্লান্তি লাগে, বিরক্তি উৎপাদিত হয়, হাঁপিয়ে উঠতে হয়, অজস্র ট্র্যাশের ভিতরে হাবুডুবু খেতে হয়। তবে এসবের সুশৃঙ্খলভাবে নির্মিত কোনো নির্বাচিত সরণি বেয়ে যেতে যেতে নানা কিছু শেখা যায়, কৌতূহলী হয়ে ওঠা যায়, মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকা যায়, আবিষ্কারের আনন্দ পাওয়া যায়। পাঠক হিসেবে এটা অনেক বড়ো পাওয়া, সন্দেহ নেই।     

৫.
এ পর্বে শূন্যনামধেয় সময় পরিসরে বেড়ে ওঠা কবিদের কবিতা থেকে গোটাকয় সম্পূর্ণ কবিতা পড়বার আয়োজন করা যেতে পারে, যেগুলোতে সমগ্রতার স্বাদও হয়ত মিলে যাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই কবিতাগুলোর কাছে আমার পাঠরুচি স্যালুটের ভঙ্গিমায় অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কী কারণে এরকমটা হয়েছে, সে কথা বলবার জন্য আমাকে হয়ত সম্যকসংকল্পগোচর হয়ে ওঠবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে আরো কিছুদিন ধরে। সে পর্যন্ত যাঁদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না, তাদের কাছে এ রহস্য যে কখনো উন্মোচিত হতেও পারে, তাতে আর বিচিত্র কী? 

ক.
একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে দুঃখ বের হয়েছিলেন নৌ-ভ্রমণে।

দাঁড় টানতে টানতে বিষাদ নামের যুবকটি
কানে গুঁজে রাখা আলস্যে, ঠোঁট ছোঁয়াবার প্রস্তুতি নিতেই--
বেদনা নাম যে-মেয়েটির, খুব স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল :
উঁহু, এখন ওসব চলবে না-- জোরে চলো, জোরে...
কষ্ট খুক্ খুক্ করে কেশে নিয়ে, পরিবেশটা পরিষ্কার করলেন।

অকস্মাৎ, হতাশা নামের ছোট মেয়েটি কেঁদে উঠল আর্তস্বরে,
এক বাটি চোখের জল এনে তার সামনে রাখলেন বিষণ্নতা।
সত্যি, তাদের সবারই খুব তাড়া-- ঘরে ফিরতে হবে।

মানুষের বুক ছাড়া, ওরা সর্বত্রই বড় শ্বাসকষ্টে ভোগে...

(আবাস, হিমেল বরকত)

খ.
একটিবারও হেমন্তের নামোল্লেখ না-করে একটি কবিতা যদিবা লিখে ফেলি
এই শিশিরসিক্ত সকালে-- তবে হেমন্তের কাছে আমার চাওয়ার আর কিছু রবে
কিনা এবং আমার যদ্দূর মনে পড়ে-- কোনো এক শেফালির টোকা বুকে রেখে আজো
আমার আঙুল শিশিরস্পর্শহীন-- কোনোদিন সমুদ্র না-দেখা বালকের ঠোঁটে
ঋতুটির কী যে ঘ্রাণ শেফালির তা কি মনে পড়বে না? একটিবারও শেফালির
নামোল্লেখ না করে একটি হৈমন্তী কবিতা যদি লিখে ফেলি--মেঠো ইঁদুরের কিছু
কি আসবে যাবে! যদি আসে যায় তবে নিশ্চয়ই ধানি জমিতে কীটনাশক সার
প্রয়োগের ফলে কৃষকের প্রতি এরা ত্যক্ত; প্রিয় ইঁদুরেরা আর কীসে পুরোপুরি
মান্ধাতার হতে পারে এই কথা আবডালে ভাবা যাবে-- কিন্তু একটিবারও কোনো
ইঁদুরের নামোল্লেখ না-করে একটি শেফালি কবিতা লেখা যাবে এ ধান ভানার
দ্বি-প্রহরে? যখন আমার চোখে কুয়াশাকে মেকি লাগে-- মরা খড়ের স্তূপের পাশে
জীর্ণ গাভী-- যখন শিশির মরে গেছে, হেমন্তদা দেশে নেই-- শেফালি ধর্ষিত হলো...

(নির্বাচিত হৈ-মালা অথবা থ-গুচ্ছ, সোমেশ্বর অলি)

গ.
আমাদের আদর্শ যেদিন হারিয়ে গেল
সেদিন শুক্রবার। জুমা থেকে ফিরে বাবা
আদর্শ হারিয়ে গেছে শুনে খুব কাঁদলেন
মা-মরা ছোট ছেলেটার জন্য। আমরা ভাইয়েরা
(যেন ইউসুফ নবীর ভাই) আদর্শকে খোঁজার
নাম করে ঘুরে এলাম, কেউ কেউ আড্ডাও দিলাম--
তারপর এক, দুই, তিন করে দিন গেল-- আমরা
যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
বৃদ্ধ পিতা আদর্শের জামা হাতে নিয়ে
এখনো ইয়াকুব নবীর মতো কাঁদেন।

(আদর্শ হারিয়ে গেছে, সুজাউদ্দৌলা)

ঘ.
কখন যে হাঁটি আর কখন যে থামি--
এইসব ভেবে ভেবে পেরিয়ে এসেছি জেলেপাড়া,
                    মাছেদের বাড়ি
মনে নেই হাতঘড়ি; আমার শরীরময় আঁশটে গন্ধ
সবজি বাজারে হেঁটে আমি বুঝে গেছি-- আমার চতুর্দিক
                নীলমাছি ওড়ে;
মাছের বাজারে এসে পেয়েছি অথৈ মশলার ঘ্রাণ
আমি আর কতদূর যাব--

আকাশ দূরের গ্রাম, জানি; পা নিংড়ে দেখি নাই
কতটা দূরের-- সে প্রশ্ন নীলশস্য মাঠে রেখে
আজ বলো-- আমার অভ্যর্থনা সভায় গাছে গাছে
লতা আর কাকেদের হৈচৈ কেন?

(সন্ধ্যা, সজল সমুদ্র)

ঙ.
তোমার জানা উচিত, আমি রোদের গল্প ফেরি করি কুয়াশা শহরে। তোমার যত পয়সা আছে বয়ামে জমানো, তুমি তা মেলে দিতে পারো সমুদ্রের উঠোনে, আমি ডলফিনের মতো লাফিয়ে পড়ে হাতড়ে নেবো তলা থেকে, ঝিনুকের ঠোঁট থেকে কেড়ে আনবো তাদের, বিনিময়ে তোমার শরীরে ছুড়ে দেবো টাটকা রোদ্দুর ও ঝলমলে সকাল

তুমি চাইলে আমার দিকে ছুড়ে দিতে পারো গরম নিঃশ্বাস। আমি ম্যাজিশিয়ানের মতো তাদের নিয়ে খেলা করবো কয়েক মুহূর্ত, ভিক্ষুক সেজে দেখাবো বানরের ঢঙ, তারপর পড়া না পারা ছোট্ট বালকের মতো বোকা সেজে দাঁড়িয়ে থাকবো তোমার বাগান-শরীরে, সুযোগ পেলেই অবিশ্বাস বেয়ে নেমে যাবো শেকড়ে

মুহূর্তেই তুমি মা হয়ে যাবে আমার

(রোদের রাজপুত্র, রুদ্র আরিফ)

সাজজাদ আরেফীন সম্পাদিত প্রতিপদ-এ প্রকাশিতব্য
জুন ২০১১

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...