Tuesday, August 4, 2020

অন্য প্রেম

মানবসমাজে প্রেমানুভূতি চিরন্তন। দাদা-দাদিতে ফুরিয়ে গেলে গজিয়ে ওঠে নাতি-নাতনিতে। জগতে জন্ম-মৃত্যু দুটোই যুগপৎ ক্রিয়াশীল থাকা সত্ত্বেও মানুষ বাড়ছে। সংগত কারণে বাড়ছে প্রেমাধারও। কবিতার কারবার যেহেতু অনুভূতির আধার ওই মানুষকে ঘিরে, প্রেমের কবিতা কাজেই লিখিত-পঠিত হবে মানুষের অস্তিত্ব নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত। আর প্রেমকে যে মূঢ়কুল কেবল নারী-পুরুষের কামজ লক্ষণ হিসেবেই দেখে, তারা জীবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, দেশপ্রেম, বাৎসল্যপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেমসহ তাবৎ প্রেমবৈচিত্র্যের অস্তিত্বকে অস্বীকারের মাধ্যমে জগৎকে খণ্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করবার প্রয়াস পায়। এদের উদ্দেশ্যমূলক অভিপ্রায়কে সন্দেহ করুন!

স্বার্থান্ধ রাজনীতি ও ধর্মান্ধতার কূট ইন্ধনে সম্প্রতি জগৎব্যাপে মানুষের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতা উসকে ওঠায় পৃথিবী ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর এই রোগমুক্তির কার্যকর দাওয়াই হতে পারে অসহিষ্ণুতার নিচে চাপা পড়া মানুষের প্রেমবোধকে উসকে দেওয়া এবং মানুষে-মানুষে ভালোবাসার মহিমাকে উচ্চে তুলে ধরা। এই শুভ ব্রতে প্রেমের কবিতা হোমিওপ্যাথির মতো ধীর কিন্তু টেকসই অবদান রাখলেও রাখতে পারে বলে মনে হয়!

Monday, August 3, 2020

অসমাপ্ত ঘোড়ায় চড়ে তোমার দিকে যাওয়া

তোমার দিকে যাবার পথে আকাশপ্রমাণ বাধা, মেঘ যেমন পর্বতচূড়ায় বাড়ি খেয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে, আমিও তেমনি তোমার আপেলবনের সান্নিধ্যে এসে ঝরে গেছি কুয়াশাপ্রতিম, বামে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্র ও ডানে নরকের খোলা দ্বার, তিন পায়ে দাঁড়ানো আমার জেনসাইকেল চোখ টিপে হাসে, চিন্তামগ্ন আমি ঘাসের উপরে বসে একমনে চিবুতে থাকি এলাচের দানা

তোমার প্রতি আসক্ত অনেকেরই আছে ট্রেকিংয়ের ছল, যেকোনো বিপদ আলগোছে সামলাতে তারা সুসজ্জিত থাকে, আমি প্রায় নাবালক শিশু এক তাদের প্রেক্ষিতে, না আছে শাস্ত্রজ্ঞান না অভিজ্ঞতা, মঞ্জিলে পৌঁছাব এমন প্রতিজ্ঞা আমার শুধু মনোবলজাত

রাত নেমে এলে তাঁবু খাটাই তোমার আপেলবাগানে, জেনসাইকেল আমাকে বন্ধুসঙ্গ দেয়, মন গিয়ে থেমে থাকে সুজিত সরকারে :

‘কিছুই চাওয়ার নেই
কিছুই পাওয়ার নেই

জয় নেই
পরাজয় নেই

শুধু হয়ে-ওঠার আনন্দ
হয়ে-ওঠার আনন্দ’

হয়ে-ওঠার আনন্দ সন্ধানে তাকাই পথের গুরুর মুখে, জেনসাইকেলে, মূর্ত হয় এক সম্পন্ন ইশারা, সেইমতো মনকে নিবিষ্ট করি চিত্তমন্দিরে, ত্রস্ত আঁকতে বসি প্রাণান্ত ঘোড়া, কিন্তু চোখে আনন্দ অনুভূত হয় না, মনোযোগে বুঝতে চাই হয়ে উঠল কি না, দেখি হয় নি, ঝুলে ও থমকে আছে অসমাপ্ত লাফ

যাবার উপায় নেই, বুঝি বিষাদই আমার একাস্ত আপন আজ তীর্থ থেকে দূরে, সমুদ্র পাড়ির হিম্মত নেই জলযান ছাড়া, ডানে পাহাড় রেখে সমুদ্র ডিঙিয়ে তোমার কাছে যাওয়া তাই হবে না আমার, শূন্য সম্ভাবনার ওপরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সাঁতার জানলেই কখনো সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়া যায় না

জানি অপরাধ ও পাপপঙ্কিলতার ভেতর দিয়ে তোমাকে জয় করা সম্ভব, চাইলেই হয়, ডানে হাঁ হয়ে আছে নরকের দ্বার, ওদিক দিয়ে ঢুকলেই সদরপথে বিদ্যমান সঙ্কটের পাহাড়কে উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু আমার মন তেমন চায় না, পাপের মৌচাকে যতই মধু থাক পূর্ণতৃপ্তি নেই, জয়াকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে যেহেতু তুমি

আমার ভরসা কাজেই সোজাপথ, আপেলবনের ভেতর দিয়ে ক্রমোন্নত পাহাড়ের দিকে রথ টেনে নেয়া, বাঘ-ভালুকের বুনোসন্ত্রাসকে গণনার বাইরে রাখা, সাপখোপের ফণাকে দু’পায়ে দুমড়িয়ে যাওয়া, চুতরা পাতার স্পর্শকে অবজ্ঞা করা আর গোলাপকাঁটাকে করা নিতান্ত তুচ্ছজ্ঞান, এই বুঝি অবিকল্প নিদানের পথ

না, জেনসাইকেল পরামর্শ দিলো ঘোড়ার শরণ নিতে

ঘোড়া তো অসমাপ্ত আমার

মনে রেখো যে পাহাড়ও প্রকৃত অর্থে সমাপ্ত নয়, দিনে দিনে ওরও কিছু বাড়ে-কমে, বাড়ে-কমে মানুষের সঙ্কট সম্ভাবনাও

তা বলে অসমাপ্ত ঘোড়ায় দীর্ঘ যাত্রা করতে ভরসা পাই না যে

চলতে শুরু করলেই মানিয়ে নেবার ক্ষমতা অর্জন করে নেবে ঘোড়া, হয়ে-উঠবে ক্রমে, ওটাই ভরসা তোমার

এসব কারণে জেনসাইকেলকে মাঝে মাঝে আমার দার্শনিক গুরু বলে মনে হয়, গুরুবাক্য যথাদ্রুত শিরোধার্য করি আর অসমাপ্ত ঘোড়ায় চড়ে বহুদূর এগিয়ে চলে পথ, আপেলবাগান পেছনে ফেলে ধোপদুরস্ত সবুজ জামা পরা বিচিত্র মুখাকৃতির অজস্রাজস্র গাছপালার সাথে খাতিরার্তি করে নাভিবন পাড়ি দিয়ে পথ ঠেকে গেল খাঁড়ির সমুখে

বড়ো বিপদের সামনে পড়লে ধীরেসুস্থে ভেবে নেয়া ভালো, ধ্যানস্থ পাখিরা যেমন বিরক্ত হলে উড়ে গিয়ে খানিকদূরে নিরাপদে বসে, আমিও তেমনি উঠে তোমার দিকে মুখ করে বসে স্বার্থাস্বার্থ গোছাতে লাগি কাগজে-কলমে, খালি পেটে জল খেয়ে শুরু করি লেখাকাজ, নরকের দ্বার ডানে খোলা থেকে যায়

একে একে আমি গুণতে থাকি বাধা, প্রথমে যার নাম মনে পড়ে তারে কাম বলে চেনে সব কৌতূহলীজন, তার অসংখ্য হাত-পা, সবই কমবেশি কর্মতৎপর, একনিষ্ঠকে তুষ্ট করা সহজে সম্ভব, তার প্রাপ্যতার জ্ঞান আসে একই উৎস থেকে, ওদের দখলে আছে জগৎ দেখার চিরায়ত ভঙ্গি, কিন্তু অজস্র চোখের মালিক এ জগতে কখনো তুষ্ট হয় না, একদিকে ফিতা ফেলে ওরা কোনো মীমাংসা বোঝে না, অজস্রচোখারা চিরকাল অতৃপ্ত, দুঃখী ও অবদমিত

কামকৃষ্ণ হাওয়া যখন বইতে লাগে, পৃথিবীর বিপুলায়ন গাছপালাকে মৃদু কাঁপতে দেখা যায় মানুষের বেদনার প্রতি সংহতির প্রকাশরূপে, জগতে জেনেছি দুঃখবাদীর সংখ্যাই বেশি, গাছেরা পুরোটা আর বৃহদাংশ মানুষ যারা অজস্রচোখা

বাতাসের সাথে যেসব কথা হয় দেবদারু গাছের, তা সব তোমার কানে কখনো পৌঁছাবে কি না জানি না, তবু মনে হয় গাছের গোপন গুহায় নিবেদিত রয়েছে তাহারা, তোমাকে নিবিড় চেয়ে না-পাওয়ার কারণটা আত্মঅধিগত

ঘটিবাটি নিয়ে আমি বসে গেছি জানো বহু আগে, একবার বসে গেলে অধিকাংশই ফিরে আর ওঠে না দেখেছি, ‘ওঠে না’রা উঠতে পারে না, পুরো ধরা খাওয়া, এদের ছাড়াও যারা উঠে আসে তাদেরও জীবনে পোহাতে হয় বিচিত্র ধস, বয়ে যেতে হয় বড়ো শিকলের ভার

এ হলো সংসার, এমন বাঁধনে বাঁধে, যারে তুমি পারবে না ছিঁড়ে যেতে, যাবে যদি আসবেও ফিরে ফিরে, অনেক দরকারি ওকে সাথে রাখা, দরকারি মাঝে মধ্যে খিড়কি বানানো তাতে, আসতে যাতে পারে ঘরে বিপুলা বাতাস, যখন খিড়কি নেই তখন আঁধার সবই, এসময় মনে হয় তুমিই প্রধান বাধা তার কাছে পৌঁছে যাবার

প্রফুল্ল হাওয়ার সাথে তোমার বিরল ভ্রম নাচ করে মিশে যায় জাদুবিদ্যা হয়ে
নিনাভ ঘোরের কাছে মানুষের পৌঁছে না মেকি ইতিহাস
শিরায় রোদের ঘ্রাণ, পাখালিপ্রণীত গান শুনে শুনে তিথিসব পার হই শিল্পরোদনে
শিল্প আর যাতনার রোরুদ্য মিলন আমি গতজন্মের ঝিলপাড়ে এসেছি ফেলিয়া

আমি রুক্মবতী লিখি নি, তরজা বাঁধি নি, জানি না তোটক, আমার যাবার পথে ছন্দ ওঠে স্বতঃমঞ্জুরিয়া
মনোকর্ণের কখনো কোনো হয় না সনদ, তবু সে অনেক শোনে, অনেকটা বোঝাবুঝি খুঁজেখেটে পাঠায় মগজে

সে কারণে মনে পড়া প্রলম্বিত হয় :

‘বিশাল অশ্বত্থ গাছ
পিছনে
মস্ত সাদা বাড়ি

জ্যোৎস্নায়
দেয়ালে
অপরূপ ছায়ার আলপনা

মালিক জানেন না
তিনি ভিতরে থাকেন
পথিক বিভোর হয়ে দেখে’

প্রেম যাকে নিঃস্ব করেছে সে বোঝে প্রেমের গান, সেই গায় সবচেয়ে দরদের সাথে, মাঝে মাঝে মনে হয় প্রেমও এক বাধার প্রাচীর, প্রেমের বায়বযানে চড়া ছাড়া কখনো পৌঁছে না কেউ সাফল্যমঞ্জিলে, অর্থাৎ প্রেমে যে পড়তে হয় এটাই প্রেমের বাধা

সমাজ সর্বদা সামনে দাঁড়ায় তার কাছে পৌঁছার পথে, এ কথায় অতিরঞ্জন নেই, কিছু লোক থেকে যায় তবু সমাজে সমাজে, যারা বল দেয়, প্রশ্রয় উঁচিয়ে রাখে, আঙুল তুলে দেয় সমর্থন, সমাজকে তখন কিছু কঁচুকাটা করা যায়, দরকারও, মানুষের দায় আছে সমাজকে মুচড়িয়ে কিছু প্রথা হাড়মা’স খুলে ছুড়ে ফেলা

অনেক এগোল মানুষ, মাঝে মাঝে তবু মনে হয় এগিয়ে যাওয়ায় কিছু মেকি রয়ে গেছে, কিছু কিছু নমুনায় জগৎকে মনে হয় হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা এক বিন্দুতে

আমি যে ভীষণা নদী প্রতারণা মাঝে মাঝে বুকজুড়ে চৈত্র জাগায় এবং কি ভালোবাসাহীনতার প্রবাহিত করে রাখে অগ্নিউত্তাপও

দূর থেকে কুহুবার্তা আসে অবেলার কোকিল মারফত আমার এই চৈত্রমন্দিরে, সাহস করে খাঁড়িপথে ঝাঁপ দেয় ঘোড়া, পিছলে পড়ে গিয়ে আরো দূর কামখাদে, এখানেও প্রেম এসে হাত বাড়িয়ে তোলে, ফিরিয়ে আনে সূচনাবিন্দুতে

এবারে তীর ঘেঁষে এগোতে চায় ঘোড়া, ওখানে বৃক্ষবিরোধ হয়ে আগলে থাকা সংসার, মূলে যার অনেক উইং

ঘোড়ার বিশ্রাম নেই, লাফিয়ে পার হতে চাইল সে প্রেম, পারল না মায়া রয়ে গেল, পথজুড়ে সমাজের জাল, ছিঁড়ল আধেক তবু সবটুকু ছেঁড়াই হলো না, যতক্ষণ সব জাল ছিঁড়ে নাই, ততক্ষণ ছিঁড়াছিঁড়ি অসমাপ্ত ঘোড়া

মনে হয় পৃথিবীর সকল নদীর জল ঘোলা, সকল ক্ষণই থাকে বিপুলা ক্ষণের ভিড়ে নানারূপ স্মৃতির মাজার হয়ে

একে একে পথ খুঁজে ঘোড়া, একটু একটু করে সম্পূর্ণতা বাড়ে, পায়ে ফুটে নানাবিধ ফুল, পাকে ও চক্রে পড়ে খাঁড়ির সমুখদেশে রাতদিন কাটে, চলা তবু থামে না তাহার

‘কবিতা লিখি
কবিতা লিখে যাই

হয়ে-ওঠার আনন্দ
আহা
হয়ে-ওঠার আনন্দ’

শেষে মনে হয়, অসমাপ্ত একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে তোমার দিকে যে যাত্রা শুরু হলো তার শেষ ইমনকল্যাণে

কবিতা বিষয়ক নোট

ইতিউতি ভাবনার উপজাত অনুভূতিরাজি যখন চিত্তমণ্ডলে লাগাতার ভাঙচুর চালাতে থাকে, তখন মনোপুলিশ লাগিয়ে গুম করে না দিয়ে সেসব অনুভূতিকে কথায়, রঙে বা সুরে মুক্তি দিলে নিদারুণ অস্বস্তি থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। কার্যত আমি রঙান্ধ ও অসুর, তাই কথার আশ্রয়েই তার যথাসাধ্য প্রকাশ ঘটাই। কখনো কখনো দেখি কিয়দংশ প্রকাশে অবলীলায় ভর করে আছে রঙের ছোপছাপ ও সুরের পাখসাট। তখন বিস্ময়াহত আমি ওই প্রকাশবস্তুকে আহ্লাদ করে কবিতা নামে ডাকতে উদ্যত হই, কানা ছেলের নামও যেমন হয় পদ্মলোচন!

কবিতা হিসেবে ওসব হয়ত যথেষ্ট নিম্নমানের। তৎসত্ত্বেও, ষষ্ঠেন্দ্রিয়ধারী ইহবাদী ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমার ওসব অনুভূতিরও একটা সহজ তাৎপর্য আছে, ওখানে মূর্ত সাধ-আহ্লাদেরও একটা স্বপ্নমূল্য আছে। সে কারণে নামায়নের দুঃসাহস-সম্বলিত বিশেষায়িত ওইসব প্রকাশকে আমি সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে নিয়ত প্রশ্রয় দিয়ে চলি। পরিপার্শ্বের গণতন্ত্রহীনতা মনদেশের গণতন্ত্রচর্চায় কোনোই প্রভাব রাখতে পারে না।

তবে মাঝে মাঝে ভাবি, কবিতা লিখতে এসে এত যে তেল-পানি খরচ করেছি, না যদি লিখতাম তো কী হতো ওই অব্যয়িত তেল ও পানিতে? খরচ না হওয়া ওই তেল-পানি কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে একখানে মিশে গিয়ে হয়ত কোনো বিতিকিচ্ছিরি চেহারা পেত, যাদের আলাদা করবার সমুদয় প্রয়াস পর্যবসিত হতো সকরুণ নিষ্ফলতায়। অবশ্য, পানিতে তেল মেশানোর চাইতে লবণ মেশানো যে অধিকতর সুবিধাজনক, এই বোধ, হয়ত কবিতা লিখি বলেই জাগে!

একটা আকামা জিনিসের পেছনে ছুটে জীবনকে তামা তামা করে, কার্যত, যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তার কোনো নগদ অর্থ বা বিনিময়মূল্য এই মরপৃথিবীতে নেই, যেখানে অর্থহীনতাকে এ সমাজ ভালো চোখে কখনো দেখে না। সমাজের সমুদয় বিবেচনা অর্থ ও বিনিময়মূল্যে নির্ধারিত হয়। এরপরও, এই নিরর্থকতা ও অর্থহীনতার পেছনে ছোটার সহজ তাৎপর্য হলো, কিছুমাত্র হলেও আমি সমাজবিরোধী। কবিমাত্রই বোধহয় তাই। সমাজ যখন যেখানে যেভাবে আছে তাকে বরমাল্য প্রদানকারীরা কখনো কবি নয় বা হলেও হাফকবি! এ আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি। বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যের প্রতি পূর্ণ আস্থা সত্ত্বেও এ বাক্যে ইমান আনা যায়। আমার সে ইমান আছে।

সমাজের চোখ হলো কবি বা শিল্পী নয় এমন সব মানুষের চোখ, তারা যেভাবে যা দেখে, কবি কখনো সেভাবে দেখে না। কবির আলাদা করে দেখাটাই তার সমাজবিরোধিতা। এ বিরোধিতা সমাজকে বদলে দেয় না বটে, তবে বিদ্যমান সমাজ্জলে সকারণ কিছু ঢিল ছোড়ে, যার ঢেউ সমাজের কাছে অস্বস্তিকর ঠেকে। ওই বিরোধিতাটা এক ধরনের সফট বিপ্লব, ধীরস্থির, কিন্তু পয়জনাস।

কবিতায় সমাজবিরোধিতার ঘটনাটা শৈল্পিকভাবে ঘটানো যায় ইমাজিনেশনের সহায়তায়; এর আরো উৎকট পন্থা আছে, যা বলা এখানে বাহুল্য। ইমাজিনেশন হলো সংবেদন ও ধারণার মনছবি আঁকবার সামর্থ্য, যার সবটা কোনো বিশেষ মুহূর্তে শ্রবণ-দর্শন বা অন্য কোনো একক ইন্দ্রিয় দ্বারা ধারণযোগ্য নয়। এটি তৈরি হয় বুদ্ধি ও আবেগের সংমিশ্রণে, যার পূর্বশর্ত হলো পূর্ণ স্বাধীনতা। তো, কবিদের এই অবাধ স্বাধীনতা ভোগ কবিতায় কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে কি না সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন। যাকে চরম স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সে সেই স্বাধীনতাটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছে কি না তা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বটে। স্বাধীনতার মানে যে যথেচ্ছাচার নয়, এ শিক্ষার এখতিয়ার কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একার নয়; এটি কবিতাসহ শিল্পপাড়ারও আওতাধীন বিষয়।

দেখি যে, অধুনার কবিদের একাংশ চিত্রমাত্রকেই চিত্রকল্প ভাবছে। আরেকদল কল্পনাকে এতটাই অবাধে চরতে দিচ্ছে যে, কাঁটাতার ডিঙিয়ে তারা পায়ে হেঁটে সাগর পাড়ি দিয়ে ফেলছে। চিত্রকল্পের নামে হাতিগুচ্ছকে তুড়িতে উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে আকাশে, নদীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে মাছের যৌনতাসহ; যেহেতু কাজটা যথার্থেই সংঘটিত হবার দরকার হচ্ছে না, শব্দ-বাক্যের কারসাজিতেই ঘটিয়ে দেওয়া যাচ্ছে সব। এই প্রবণতাকে অনেকটা ফ্রি পেয়ে মাথার বাঁ’পাশে বাড়তি আরেকটা মাথা জুড়ে নেওয়ার মতো ব্যাপার বলে মনে হয়।

পাগলামি অনেক সময় উৎকৃষ্ট মনছবি আঁকতে পারে, তবে সেসব ছবির সিংহভাগ যে অসংলগ্ন চিন্তায় ঠেস দেওয়া থাকে প্রায়শ তার কোনো জাতকুল থাকে না। এসব চিন্তা মানুষের পারসেপশনের আওতার মধ্যেই যেন আর থাকতে চাইছে না। হামেশাই ডিঙিয়ে যাচ্ছে বোধ্যতার সীমা-পরিসীমা। কিন্তু এরও সীমা আছে, থাকা উচিত। তা নইলে কথিত কবিতাকে উপলব্ধিতে নিতে অসমর্থ পাঠককে পশ্চাৎপদ ঠাওরে গালি দিয়েও আখেরে পার পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। যা-ই কল্পনা করি না কেন, মানব ধারণায় তাকে সম্ভব মনে হতে হয়। অন্তত দূরান্বয়ী হলেও একটা সম্পর্কসেতু কোথাও থাকতে হয় আবিষ্কার করে ওঠবার জন্য। তাহলেই কেবল সেখানে সৌন্দর্য ভর করবার ফুরসত পায়, অন্যথায় সৃষ্টি হয় সামঞ্জস্যহীন প্রগলভতা। মনে রাখতে হয় যে, প্রলাপোক্তিসর্বস্বতা কবিতার এক নম্বরের শত্রু।

আমার মনে হয়, উত্তুঙ্গ কল্পনা যাতে কোনোভাবেই প্রলাপে পর্যবসিত হয়ে না যায়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করে উঠতে পারাই আমাদের একাংশ সাম্প্রতিক কবির জন্য এখন বড়ো রকমের চ্যালেঞ্জ।

Thursday, July 9, 2020

কবিতাযাত্রার ভাবাভাস

জেতা মৎস্য গিলে বকে মনুষ্য খায় বাঘ-ভালুকে
রহস্য বোঝে না লোকে কেবল বলে জয়।
দীন দ্বিজদাস, জনপদাবলি, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত
জীবন মানে কেবল নিয়মিত আহার গ্রহণ, তদসাপেক্ষে বর্জ্যত্যাগ ও নিয়মিত প্রজনন ক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া নয়। এরকম স্থূল জীবনকে মহিমা দিতে রুচিতে বাধে। সূক্ষ্মতার ভিতর দিয়েই জীবন মহিমামণ্ডিত হয়ে ওঠে। যে জীবনে খাওয়া-পরা-ভোগের অধিক মগ্নতা নেই, সে জীবন আমাদের কাম্য নয়। সূক্ষ্মতার দিকে তাক করা এই যে প্রত্যাশিত জীবন, এরও অবশ্য গোপন এক নির্ভরতা আছে খাওয়া ক্রিয়াটার ওপর।

একটা বয়সে, কৈশোরে, যখন প্রথম বুঝতে শিখেছিলাম যে, জীবজগৎ সচল থাকার মূলে রয়ে গেছে নিরবচ্ছিন্ন খাদ্যচক্রের ভিতর দিয়ে শক্তির স্থানান্তর প্রক্রিয়া, তখন হঠাৎই একটা পরিবর্তন টের পেয়েছিলাম দেহে-মনে। কেননা তখনই জানতে পেরেছিলাম যে সমস্ত সূক্ষ্মতাই স্থূলতানির্ভর। কিন্তু বরাবরই খানাপিনারূপ স্থূলতা শিল্পের জগৎ থেকে কম-বেশি নির্বাসিত থেকেছে। এই স্থূলতা নিয়ে একটিও সচেতন বাক্য রচনা করেন নি বা আঁচড় কাটেন নি অনেক লেখক-শিল্পী, যেমন রবীন্দ্রনাথ।

আমরা জানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানির মাধ্যমে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে গাছের সবুজ পাতার ক্লোরোফিল গ্লুকোজ নামক চিনি উৎপাদন করে, যে চিনিশক্তি গাছের খাদ্য। গাছের পাতা-ফুল-ফল খেয়ে সেখান থেকে শক্তি আহরণ করে ক্ষুদ্র পতঙ্গকুল। ওই পতঙ্গ যখন জলের ওপরে ভাসে তখন কোনো ক্ষুদ্র মাছ তাকে টুক করে গিলে নেয়। ক্ষুদ্র মাছকে পরে খায় অপেক্ষাকৃত বড়ো কোনো মাছ। ওই বড়ো মাছ হয়ত পরে খাদ্য হয় কোনো বিশাল আকৃতির জলজীব বা মাছের। কোনো মৎস্যশিকারির মধ্যস্থতায় বিশাল মাছটি ধৃত হয়ে চলে আসে মানুষের খাবার টেবিলে। এই মানুষই আবার কখনো-বা বাঘ-ভালুকের খাদ্য হয় কিংবা কোনো জলজীবের। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তার দেহ মাটিতে মিশে যায়। বেঁচে থাকতে মানুষটি যত শক্তি সঞ্চয় করেছিল সব শুষে নেয় মাটি। শিকড়ের মাধ্যমে ওই শক্তি আবার শুষে নেয় বিভিন্ন গাছপালা। বাঁচার প্রয়োজনে গাছপালার গ্লুকোজ উৎপাদন অব্যাহত থাকে।

এই চক্রটি পুরোপুরি উপলব্ধিতে আসার মাধ্যমে সহসাই আমার বোধবুদ্ধিটা একটা দার্শনিক পরিণতিতে চড়ে বসে যেন। প্রাকৃতিক সবকিছুর পরস্পরনির্ভরতা-বিষয়ক এক গূঢ় সত্যের বিশাল দরজা যেন উন্মুক্ত হয়ে যায় আমার সামনে। ভাবনাচিন্তা বিশেষ একটা ব্যাপ্তি পায়। তাহলে ব্যাপার এই, যে, জীবমাত্রই অন্য কারো খাদ্যে পরিণত হবার জন্য নিজেও খাদ্যসন্ধানে ব্যাপৃত থাকে অহর্নিশি!

এই অতিশয় স্থূল ও চক্রক্রমিক খাদ্যগীতির পাশে সুকুমারবৃত্তি নামধেয় ব্যাপারস্যাপার, তথা শিল্পসাহিত্যসংগীতনৃত্যঅভিনয়— এসব কি ওই খাদ্যকল্পেরই অন্য রূপারূপ তবে? গুহাগাত্রে শিকারছবি এঁকে, বর্ণেশব্দে যাপনবিদ্যার তেলনুনছবি ধরে, কর্মের লাগোয়া সুরধুন তুলে, আহরণমুদ্রায় শরীর বিক্ষেপণ করে, যাপনচর্যার বিবিধার্থক রূপায়ণ ছলে মানুষ আসলে কীসের প্রমাণ রক্ষা ও প্রলম্বিত করে এসেছে যুগ যুগ ধরে? এসব কি এক অর্থে খাদ্য হয়ে ওঠা ও খাদ্য খুঁজে ফেরারই নন্দনতারিফ নয়?

বিজ্ঞানীরা ইকোসিস্টেম বা প্রতিবেশব্যবস্থায় জড়ে-জড়ে, জীবে-জীবে এবং জড়ে-জীবে বা জীবে-জড়ে অত্যাবশ্যক সম্পর্কের আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক সকল কিছুই পরস্পরের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয়। কিন্তু শিল্পসাহিত্যসংগীতনৃত্যঅভিনয় প্রাকৃতিক নয়, মনুষ্যসৃষ্ট। এসবে আশ্রিত যে কলার ধারণা তা জড়ও নয়, জীবও নয়। প্রতিবেশব্যবস্থায় এর স্থান তাহলে কোথায়? এতদিন ধরে এর কোনো জবাবই আমার আয়ত্তে ছিল না। সম্প্রতি এর একটি সম্পর্কসূত্র বা বিহিত আমি খুঁজে পেয়েছি বলে মনে হয়, যখন বুঝতে শিখেছি যে, মানুষ তার বিস্তৃত পরিপার্শ্বে ক্রমশই তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর হয়ে উঠতে থাকে। মানুষের চারপাশের আপাত সীমিত যে পরিসর, যাকে মনে হয় যে এইই শেষ, এর সবটা জানা হলেই জানা হয়ে যাবে গোটাটা, তা আসলে ঠিক নয়। বস্তুত দিন দিনই পরিসরটি প্রসারিত হতে থাকে। যত দ্রুত জানাশোনার প্রসার ঘটে, তার চেয়ে দ্রুত প্রসারিত হয় নতুন নতুন পরিসর। তাতে কেবলই বোধ হতে থাকে যে, আমাদের জানাবোঝা অতিশয় তুচ্ছতর। তো, ওই তুচ্ছ আলোর প্রক্ষেপণে একান্তে যা ধরা পড়ে, তাতে মনে হয়, এই যত কলাকাণ্ড এরও নির্দিষ্ট ভোক্তাশ্রেণি থাকে, যারা এগুলো খায়। গলাধঃকরণ করে না বটে তবে খায়, উপভোগ করে। অন্যদের মতো কলাকার নিজেও একজন কলাভোক্তা। তাদের এগুলো আসকালসন্ধ্যার ভোগে লাগে। সেই আবার খাদ্য খুঁজে ফেরা, খাওয়া। খাওয়ার ভিতর দিয়ে জীবনীশক্তি, শৈলীপ্রণোদনা, জীবনসত্য ও আবিষ্কারোচ্ছ্বাস লাভ, অবলম্বন খুঁজে পেয়ে ঝুলে পড়া।

উলটোভাবে বিচিত্ররূপ কলারাও কলাকারকে খায়। অর্থাৎ কলাকারের নিজস্ব অনেককিছুর নিঃশর্ত সমর্পণের মাধ্যমেই কলা সৃজিত হয়, কলাবিদ্যা অর্জিত হয়। কলা একে একে কলাকারের সময় খায়, ঘুম খায়, স্বস্তি খায়, তৃপ্তি খায়, সম্পর্ক ও সামাজিকতা খায়, শান্তি খায়; সবিশেষ দেহটা খায়, একেবারে খেয়ে ফেলে। যেমন কাব্যকলা খেয়েছে জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান, সাবদার সিদ্দিকী, ফাল্গুনী রায়, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুনীল সাইফুল্লাহ, শামীম কবীর, আপন মাহমুদ প্রমুখকে। কলা ও কলাকারের মধ্যকার এই সম্পর্ক জড়-জীব বা জীব-জড়বোধক। অনেকটা উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড চক্রের মতোই যেন। উদ্ভিদ অক্সিজেন দেবে প্রাণী নেবে, প্রাণী কার্বন-ডাই-অক্সাইড দেবে উদ্ভিদ নেবে। এই দেওয়া-নেওয়াই জীবনবায়ুর উদ্গাতা বোধকরি।

এটুকুই মাত্র আমার বিবেচনা, যে বিবেচনায় আমি বলতে চাই যে কলারও স্থান আছে খাদ্যচক্রে, অতএব ইকোসিস্টেমে। সকল কালের সকল কলার কাজেই অস্তিত্বশীল থাকতে হয়, নতুন নতুন কলাবস্তু ও কলাধারণা সৃজিত হতে হয়। তা না হলে তৈরি হয় ভারসাম্যহীনতার হাহাকার, যে ভারসাম্য কৈলিক ও সাংস্কৃতিক।

এহেন ভারসাম্য রক্ষার্থেই আমি কলাসৃজনে প্রবৃত্ত হই, লিখি— আরো ভেঙে বললে জবাবটি অন্যরকম শোনাবে। সমস্ত বিস্তারণই কেননা আব্রুহীন, সমস্ত স্বচ্ছতাই কেননা রহস্যহীন। আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছি আমি, নানা ছুঁতোয়। দেখেছি যে, জবাব বারবার বদলে গেছে। একই সওয়ালের জবাবে একেক বয়সে দেখেছি একেকরকম উত্তরদান প্রয়াস। এখন মনে হয়— আমার কিছু দৃশ্য, ঘটনা ও কার্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করবার থাকে, যারা কারণসমূহের সাথে মিলিত হবার ইচ্ছেয় বহুকাল ধরে অপেক্ষায় আছে। আমার কিছু আনন্দ-বেদনা-ক্রোধ থাকে, যা সহস্রজনের আনন্দ-বেদনা-ক্রোধের থেকে আলাদা অথবা আলাদা নয়, যেসব বিষয়ে অনেকেই কোনোদিন কিছু ভেবে ওঠেন নি। আমার সবসময়ই কিছু কথা বানিয়ে বলবার থাকে, যা সত্যমিথ্যানিরপেক্ষ, লিখবার পরে প্রায়শ যেগুলোকে সত্যের পড়শির মতো মনে হয়। আমার কিছু তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করবার থাকে, যেদিকে মনোযোগদান প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্যে জরুরি বোধকরি। এ ছাড়াও, যাপনযুদ্ধের বিভিন্ন পর্বে জড়-জড়, জীব-জীব এবং জড়-জীবের অনেক সম্পর্ক আমার কাছে নতুন করে প্রতিভাত হয়। ওই আবিষ্কার চিহ্নগুলো আমি ধরে রাখতে চাই, চিন্তার পরবর্তী পরম্পরার কথা ভেবে। আমার লেখনচেষ্টার নেপথ্যে সুপ্ত মূল কারণের বিভাজিত রূপ মূলত এই।

আমি না করলেও এই কাজগুলো অন্য কেউ তার মতো করে করবে। কিন্তু আমার মতো করে করা কেবল আমার পক্ষেই সম্ভব। দেখার ও লেখার প্রত্যেক লেখকেরই কমবেশি স্বতন্ত্র ভঙ্গি থাকে। থাকাটা জরুরিও। আমি দাবি করি যে, আমারও তা আছে। আর আছে বলেই ওই স্বাতন্ত্র্যটুকু বাংলা লেখন-বৈচিত্র্যের ভাণ্ডারে আমি যুক্ত করে যেতে চাই। তাতে বাংলাসাহিত্যের সমৃদ্ধি না এলেও বাংলা ভাষার সম্ভাবনাটি কিছু দৃষ্টান্ত লাভ করবে, নিঃসন্দেহে।

দুই.

এই মর্মে একটি রুশ প্রবাদ আছে যে, “সে কোনো মুক্ত মানুষই নয়, যে কখনো ‘কিছুই না’ করে না”। এই প্রবাদোক্ত ‘কিছুই না’ করা ব্যাপারটা অত সহজ নয়, যেহেতু জীবন মানুষকে সবসময় কোনো-না-কোনো ‘কিছু’র মধ্যেই থাকতে বাধ্য করতে চায়।

বাংলাদেশসহ অনেক দেশে অবশ্য অর্থকরী কাজ না-করাকেই ‘কিছুই না’ করা ভাবা হয়। গার্হস্থ্য ও প্রজনন কর্মভারে পীড়িত আমাদের নারীসমাজ ওই উদ্দেশ্যমূলক ভাবনার প্রত্যক্ষ শিকার। কিন্তু প্রবাদোক্ত ‘কিছুই না’ করা একেবারেই অন্য জিনিস। প্রস্তাবিত ‘কিছুই না’র সঙ্গে লিঙ্গশোষণমূলক ব্যাপারস্যাপারের কোনো সংস্রব নেই, সংস্রব আছে অন্তর্গত মুক্তি ও পূর্ণাবসরের। এই মুক্তি কেবল বাহ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দায় থেকে নয়, বরং ভেতরগত চিন্তনভার থেকেও। ‘কিছুই না’ কাজেই দেহে-মনে পরম এক শূন্যময়তার আর্তিসমগ্রতায় সমর্পিত হওয়া।

চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়াকে আমার মাঝেসাঝে মূর্তিমান এক অভিশাপ বলে মনে হয়। জন্মাতাম যদি কাঠবিড়ালি কিংবা নিদেনপক্ষে ঝুঁটিশালিক হয়ে, একমনে খাদ্যাহরণ ও কামোদযাপনে পার হয়ে যেতে পারত একটা জীবন। কিন্তু মানুষ হয়ে রীতিমতো ফেঁসে গেছি। অভিশাপদগ্ধ এই মনুষ্যজন্ম আমাকে প্রায়ই ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের ভবিষ্যযাপনচিন্তার গর্তের মুখে ঠেলে দেয়। ক্বচিৎ কখনো উৎফুল্ল হলেও প্রায়শই হতাশায় ডুবে যেতে হয়। এর মধ্যেও সৌন্দর্যলিপ্সা জাগে। রক্তমাংসের তাড়নায় ভুগি। তদুপরি কিছু মানুষের কাণ্ডকীর্তিদৃষ্টে জগৎসাধন ব্যাপারে বিবমিষা জাগে। কখনো-বা ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উঠি। আগাগোড়াই নিষ্ফল যদিও।

এই প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রতিটিই দেহ-মনকে সতত ব্যস্ত রাখে। আর নানারূপ অনুভূতির জন্ম হতে থাকে। তাতে বেজায় ভার বোধ হয়। যাপনস্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে ওই ভার মাথা থেকে নামিয়ে ফেলবার দরকার হয়। নইলে স্বস্তি মেলে না।
আমার কবিতা করা, ভেবে দেখেছি, কণ্টকাকীর্ণ বিচিত্র ওই অনুভূতিভার খালাস করে মস্তিষ্ককে খালি করবার প্রয়াস থেকেই জাত। শুরুতে ফেনা ফেনা গাদ ওঠে। গাদ সরে গেলে একসময় ঝিলকে ওঠে পরম শূন্যের কাছাকাছি অঞ্চলে চরে বেড়ানো নিখাদ মেঘপুঞ্জের মতো শ্বেতশুভ্র হাতি-ঘোড়া, পরাহ্ণমনের আলো ঠিকরে পড়লে যাতে লালাভার উচ্ছ্বাস জাগে। ওই মেঘানুভূতিমালার শব্দ-বাক্যকৃত অনুবাদই আমার কবিতা।

কবিতা না-করে অন্য কোনো নিরর্থকতায় সমর্পিত হয়েও এ বাবদে নির্ভার হওয়া যায় না তেমন নয়। হওয়া যায়। হইও। কিন্তু শূন্যময়তার সন্ধানে ‘কিছুই না’ করার দিকে যাত্রার মাধ্যম হিসেবে কবিতাকেই আমার সবচেয়ে মোক্ষম অবলম্বন বলে মনে হয়।

তিন.

কবিতা বিষয়ে কিছু লেখা বা বলার চেয়ে একটি কবিতা লেখা বরং অনেক নিরাপদ। অবশ্য এরকম কোনো বাক্য এক্ষেত্রে বলা চলেই না যে এটি ওটির চেয়ে সহজ বা কঠিন, কিংবা ওটির চেয়ে এটি। যিনি যখন যেটা লিখেন, তখন তিনিই কেবল সেটার সারল্য-কাঠিন্য আন্দাজ করতে পারেন, অন্য কেউ নন। আমার কাছে দুটোই সহজ, যখন লিখি। লেখা হয়ে গেলে মনে হয় জব্বর জটিল এক সাঁকো পার হয়ে এলাম বুঝি! কী করে সাধন করলাম এই অসাধ্যকে? নিজেকে বেশ সফল মানুষ মনে হয় তখন। যখন সে লেখা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে যাবার প্রসঙ্গ আসে, অর্থাৎ পঠিত বা মুদ্রিত হবার কথা, তখন আবার অন্যরকম লাগে। মনে হয় এটা হয় নি কিছুই আর ওটা হাস্যকররকম বাজে হয়েছে, ইত্যাদি। দাঁড়াল কী তাহলে? এই কি নয় যে কবিতা বিষয়ে আমি যা ভাবি, কবিতাকর্মী হিসেবে প্রায়শই আমি তা করে উঠতে পারি না, কিংবা, আমার নিজস্ব কবিতাধারণাও ফ্রিকোয়েন্টলি বদলে বদলে যায়! অতএব এটা বলা যায় যে, আমার কবিতা সবসময় আমার পুরোপুরি প্রতিনিধিত্ব করে না। সে হিসেবে কবিতা থেকে আমার শত হস্ত দূরে থাকাই স্বাস্থ্যসম্মত! কিন্তু তবু লিখতে বসে যাই অধরা অদৃশ্যকে ধরতে, যা ধরা গেলে বলা যাবে যে এটি বা এগুলো আমার প্রকৃষ্ট প্রতিনিধি। কিন্তু হায়! প্রান্তরজুড়ে যথেচ্ছ দাপাদাপি করেও অধরা শেষপর্যন্ত অধরাই থেকে যায়।

একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে সর্বত্রই আমি স্বাধীনতার চর্চা করতে ভালোবাসি। লেখালেখিতেও। যখনই স্বাধীনেচ্ছা বিঘ্নিত হবার উপক্রম হয়েছে, তখনই আমার গতিমুখ বদলে নিয়েছি। এখনো তাই করি। সৃজনের প্রয়োজনে কারোর এঁকে দেওয়া নকশামতো কিংবা অগ্রজের পদচ্ছাপ দেখে পা ফেলানো আমার পছন্দ নয়। ওই হাঁটায় অনুকারিতা যতটা আছে, আবিষ্কারানন্দ ততটা নেই। এজন্য কেউই আমাকে শিষ্য ভেবে স্বস্তি পান নি, আমিও পাই নি গুরু ভেবে। নিজের মতো করে দিকবিদিক হাঁটি, মানুষ, লভ্য প্রাণীকুল ও উদ্ভিদের সঙ্গে মেলামেশা করি, দেখি ও শিখি। এই বিরল যাত্রাভিজ্ঞতার ফাঁক-ফোকরগুলো, ইমাজিনেশনের নরম পুডিং লাগিয়ে ভরে তুলে তার সাথে সহনীয় মাত্রায় মনের রং মিশিয়ে নিজের ভাষায় যতটা কুলোয় লিখে ফেলতে চেষ্টা করি। এদের কোনো-কোনোটিকে জন্মক্ষণ থেকেই সম্পন্ন হয়ে উঠতে দেখা যায়, কোনোটিকে খুব নিঃস্ব দেখায়। ঝরঝরে হয়ে উঠতে যতদিন লাগে, ততদিন এদের আগলে থাকি। চুল-নোখ কেটে দেই, জামাকাপড় ও কাজল-সুর্মা পরাই, হাগু-মুতু সাফ করি, গোসল দেই। শেষোক্তদের প্রতি মায়াটা একটু বেশিই জন্মে, এজন্য সঙ্গও বেশি পায় তারা, অটিস্টিক শিশুর মতো।

সকল মানুষেরই বিচিত্র যাপনাভিজ্ঞতা আছে, কল্পন-সক্ষমতা আছে। আছে অনুভূতি প্রকাশের ভাষা ও মনে ছড়ানো বিচিত্র রং। অথচ সবাই কবিতা লিখেন না। কেন লিখেন না? কারণ তারা হয়ত কবিতা জিনিসটা পছন্দই করেন না বা লিখে আনন্দ পান না বা লিখতে পারেন না বা এটাকে নিতান্ত পণ্ডশ্রম মনে করেন, ইত্যাদি। স্পষ্ট যে, আমি কবিতা লিখি ঠিক এসবের উলটো কারণে। কবিতা জিনিসটা আমার খুব পছন্দ, এটি লিখে বিস্তর আনন্দ পাই এবং লিখতে পারিও। কবিতা লেখাকে কখনোই আমার কাছে পণ্ডশ্রম মনে হয় না। এই-ই সার। এর বাইরে ‘কবিতা না-লিখলে আমি বাঁচব না’, ‘আমি তো লিখি না, কবিতাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়’ বা ‘আমার কবিতা দূর আকাশ থেকে নাজেল হয়’, ‘লিখি সমাজ বদলের জন্য’; কবিতা লেখা নিয়ে ইত্যাদি কথাবার্তার সর্বৈব ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয় আমার। এই লৌকিক কাজটিকে যারা অতিলৌকিক বা অলৌকিক মহিমা দিতে চান, তাদের প্রতি একটা বড়োসড়ো সন্দেহ জিইয়ে রেখেই অধরাপ্রান্তরে আমার শিকারাভিযান আমি অব্যাহত রেখে চলেছি।

চার. 

কবিতা একইসঙ্গে কবিতাকর্মী ও পাঠকের দিক থেকে একাকিত্ব উদযাপনের অন্যতম ভাষিক শিল্পমাধ্যম। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যেহেতু একা, কাজেই কবিতা অবিকল্প মানব সমাজে।

আবার মানুষ যেহেতু সমাজে বাস করে, কাজেই সে জীব হিসেবে সামাজিক, একজন সামাজিক জীবের প্রয়োজন মোটানোর যোগ্যতায় যে কোনো নিম্নকণ্ঠ ও অন্তর্গত বয়ানঋদ্ধ কবিতাও শেষ বিচারে সামাজিক। এর মানে হলো কবিতামাত্রই সামাজিক কবিতা।

এরূপ বৃহদার্থে কবিতার সামাজিক হওয়া আর সরাসরি সমাজ পরিবর্তনের মানসে লিখিত কবিতার সামাজিক পরিচিতি অবশ্যই আলাদা ব্যাপার; কবিতা দুটোই, কিন্তু সব কবিতা সবার জন্য নয়।

কবিতাকে আমরা দেখেছি নানারকম দায়িত্ব পালন করতে— আত্মসত্তার অনুসন্ধান থেকে শুরু করে জাতীয়তার চেতনা নির্মাণ ও তার মেরামত, সংকট মুহূর্তে সংগ্রামের প্রেরণা ও সাহস সঞ্চারণ, বিপ্লবের ভাষিক প্রণোদনা জোগানো, শত্রুমিত্রজ্ঞান ঝালাইকরণ, লৌকিক পুরাণকে প্রবহমাণ রাখা, অপ্রাপ্তি-বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাণীরূপ প্রণোদনা বিলানো, ভাষাচিন্তার নমুনাগ্রন্থন, বিশৃঙ্খল যাপনের ডায়েরি সংরক্ষণ, মানসপ্রান্তরে সবজিচাষ, পাগলামির ডকুমেন্টেশন, নশ্বরদেহের অধীন অন্তঃকরণের স্বপ্নাদ্য রূপরেখার মমিকরণ, নানামাত্রিক প্রেমের জয়গান ও প্রেমোৎপাদন, প্রকৃতির রূপের নকলনবিশিকরণ, ইত্যাকার কাজবাজ সামলে আমাদের কবিতা ধারণ করেছে বিচিত্র অবয়ব ও বহুবাচনিক মর্মবেদনা।

এসব দায়িত্ব আমাদের নতুন কবিতার জন্য অবশ্যপালনীয় নয়, আমরা হয়ত এর কোনো-কোনোটা করি বা করি না, কোনো-কোনোটা করব বা করব না; কিন্তু স্বীকার করি ও করব যে এর সবকটাই কবিতার কাজ।

অন্য কোনো কোনো শিল্পমাধ্যম এসব দায়িত্বের কোনো-কোনোটা এর চেয়ে ভালোভাবে পালন করতে পারে ও করে, কিন্তু উৎপাদনরীতি ও ব্যবহারে তা আলাদা। কবিতার কায়দা অনেকখানি গেরিলা ধরনের। সমাজচোখকে ফাঁকি দিয়ে এমনসব জায়গায় কবিতা প্রবেশ করে, যেখানে অন্য মাধ্যম যায় না বা যেতে পারে না। কবিতাই আমাদের চিনিয়েছে শিশিরের ঘ্রাণ ও জলের অভিমান, পর্বতের ঋতুস্রাব ও ঘুমের যৌবন, যোনির কূটনীতি ও লিঙ্গনামাজ। এ জানা ভীষণ জানা, এ জ্ঞানকাণ্ডে ভ্রমণ বিষয়সাফল্য দেয় না ঠিক, কিন্তু দেয় সূক্ষ্মতার জগৎমন্দিরে ঢুকে যাপনকে বুঝে নেবার একচ্ছত্র ধ্যানগরিমা।

নিষ্ঠকবির যে শব্দসাধন, যে নৈশঃব্দ্যবাদন, তার উৎপাদন যত তুচ্ছই হোক, কবির কাছে তা অশেষ মূল্যবান; একজীবনে ওই মূল্যমান পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে কখনো উপলব্ধ না-হলেও।

পাঁচ.

আওয়াজবহুল শব্দ দিয়ে নৈঃশব্দ্যকে ধরবার যে কৌশল, যার কোনো বস্তুগত রূপ নেই, তার দিকে ডিঙি বেয়ে যেতে যেতে পথের যেসব বেদনের সাথে দেখা হয়, সেসবের নিরাবয়ব অস্তিত্বের সাথে নিজের বেদনকাশি মিলিয়ে-মিশিয়ে নিলে একটা শান্তি শান্তি অনুভূতি হয়, ওকে পুরোপুরি পাবার জন্যই নিশিবল্কলে একটা নির্ঘুম জীবন ভাব-আঠায় সেঁটে দিয়ে অবিরাম হাল বেয়ে যাওয়া

আশ্চর্য এক প্রাসাদসুখ চূড়ান্তমঞ্জিল ওই ভিখারিপল্লিতে, যারা জানল না অনুভূতিময় ওই যাপনকাহিনি, তাদের দিক থেকে আসা অবজ্ঞার ঢিল গিলে অদৃশ্যকে দৃশ্যের সাথে বাঁধাবাঁধির স্বতোচ্ছল প্রয়াসেই এত সব আয়োজন, যন্ত্রণা-আফিম সেবে ঝিম মেরে থাকা

কী হয় এই বাঁধাবাঁধি দিয়ে, সে প্রশ্নে চোখ কচলালে শত-সহস্র বছর ধরে জীবিত অজস্রাজস্র কথার বাগানে ফোটা ফুলটুল দৃশ্যমানতা পায়, যারা অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে নন্দনশাসন, বিরল সব আবিষ্কার, অবিকল্প সব উপলব্ধি, মিথ্যা দিয়ে লেপাপোছা জীবন ও সমাজসত্য ওই তাকে জড়ো হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে অফুরন্ত বিভা

অত্যাশ্চর্য মনছবি-নির্মিত অনায়াসলব্ধ ওই আনন্দবিতানের সুগন্ধে মগ্ন হয়ে লোভ-মোহ ত্যাগ করে লতাঝাড়ের মতো প্রত্যন্তে বেড়ে ওঠার মোহন মধুরতা আমি টের পেয়ে গেছি, কথার না হবে যদি, কার তবে এসব মহিমা, যেই দিকে ফিরে ফিরে যায় পৃথিবীর বাছাই মানুষ

ছয়.

ব্যক্তিকবির জীবন নিষ্কাশিত হয়ে নেমে আসা অনুভূতিচূর্ণ যদি নানা আভরণের সংস্রবে অথবা সংস্রব বর্জন করে এমন কোনো দশাপ্রাপ্ত হয়, যা কবির অভিজ্ঞতাবাহিত অর্জন ছুঁয়ে বদলে যাওয়া ভাষার সহায়তায় প্রসারিত অর্থের শক্তি নিয়ে মনোহারী সৌন্দর্য অর্জন করে, তবে তাকে আমরা কবিতা বলবার অবকাশ পাই। এই রূপ বা সৌন্দর্যের নতুন হওয়া আবশ্যক হয়, যা অন্য কারো অনুকারবৃত্তির দ্বারা অর্জিত নয়, যা এই প্রথম জন্ম নিল মহাশূন্যতার উদর চিড়ে-ফেড়ে। কবিতা সেই চূড়ান্ত অবস্থা, যা অনুভূতিচূর্ণের মিশেলে অনাস্বাদিতপূর্ব এক আস্বাদআঞ্জাম সংগঠিত করে রাখে, যার নিবিড় সংস্পর্শ পাঠকচিত্তে ঘটায় তীব্র সংক্রমণ, দ্রুত কিংবা ধীরে। এটা আবশ্যিক নয় যে এই সংক্রমণকে সর্বদা মধুরই হতে হয়, তা এমনকি বিষাদ-বেদনা-যন্ত্রণার কিংবা বিস্ময়-স্তব্ধতা-মূর্ছনারও হতে পারে। তবে সবই এর আনন্দপ্রদ।

সন্দেহ কী যে, কবিতা পাঠকমনকে শিক্ষিত করে, সঞ্চারিত করে। কিন্তু এ শিক্ষা কখনোই বেত্রাঘাতোৎপাদিত ও উৎসারিত নয়, বরং স্বতোৎসারিত। এ পরীক্ষা পাসের নিশ্চয়তা দেয় না, এমনকি দেয় না করে-কেটে খাবারও সুযোগ। এ শিক্ষা কেবলই সৌন্দর্য চেনায়, দেয় সৌন্দর্যের ঘোরে বাস করবার গলিঘুপচির সন্ধান। যিনি এ শিক্ষার আস্বাদ জানেন, তিনি বহুপথ হেঁটেও তার কাছে যান, চোখের দিকে চেয়ে চুপটি করে বসে থাকেন, কখনোবা ভাঁজ খুলে দেখেন, চকিতে ওঠেন শব্দ করেও। পাঠকমহান নির্দিষ্ট কবিতার কাছে গিয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন (লোকদেখানো ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিক্রিয়ার কথা আলাদা), তার সম্পূর্ণটা কবিতা বা কবি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তা নির্ধারিত হয় নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থায় নির্দিষ্ট পাঠকের সাথে ওই কবিতার যে যোগাযোগটি স্থাপিত হয়েছে, তাকে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার সাথে কীভাবে মিলিয়ে নিতে পারলেন না-পারলেন তার সাপেক্ষে। এই যোগাযোগটিও আবার নির্ভর করে কোন নির্দিষ্ট ও বিশেষ শ্রেণির শিল্পরূপের প্রতি তাঁর আগ্রহ বা অনাগ্রহ আছে তার ওপর।

প্রশ্নটা তাহলে ঠেকছে গিয়ে সৌন্দর্যে, যা পাঠককে আক্রান্ত করে। সৌন্দর্য ভোক্তার চিত্তাভ্যন্তরভাগে সংঘটিত ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলজাত একটা উপলব্ধি। কোনো শিল্পবস্তু ইন্দ্রিয়-সুখকর হলে এবং বুদ্ধিবৃত্তির খোরাক জোগালে তা ভোক্তার মধ্যে এই উপলব্ধির জন্ম দিতে পারে। সৌন্দর্যের এ ধরনের উপলব্ধি মনোমুগ্ধকর। সৌন্দর্যের অনুভূতিটা জন্মায় এ কারণে যে, এর দ্বারা পাঠক নতুন এক ভাষাসত্যের সামনে দাঁড়ান, যা তাঁকে ভাবায় ও তৃপ্ত করে। এর ফলে ঘটে তাঁর চৈতন্যের বহুস্তরিক উন্মোচন। এ প্রক্রিয়ায় তা আর কেবল আনন্দ থাকে না, ধারণ করে ওঠে আনন্দ ও উপযোগিতার এক সমন্বিত রূপ। যেজন্য মানুষ শিল্পবস্তুর কাছে যায়, বারবার ফিরে ফিরে যায়।

সাত.

কবিতা প্রতিবেদন নয়; প্রতিবেদন তথ্যজ্ঞাপক আর কবিতা অনুভূতিজ্ঞাপক। মহান পাঠক কবির দেওয়া তথ্য নয়, অনুভূতি দ্বারা সঞ্চারিত হন। অর্থাৎ, কবিতায় পাঠক খোঁজেন অনুভূতিজ জাত্যর্থ, নিজে চাঙ্গা হয়ে ওঠবার জন্য। অনুভূতির ভার বহন করাই কাব্যভাষার কাজ, কাব্যভাষার এজন্য প্রতিবেদনের ভাষা থেকে দূরবর্তী হতে হয়। কবিতায় শব্দ নতুন ব্যঞ্জনায় জেগে ওঠে, পাঠমাত্র পাঠকের মনে এর জন্ম হয়। নবজাত এই ব্যঞ্জনার প্রণোদনায়ই অর্থফাটল ভরাট করে নেন পাঠক। ফাটল কেন থাকে? প্রতিবেদনের পরম্পরা অনুসৃত হয় না বলে। এ ভাষায় ব্যক্তি-বস্তু এক পাতে বসে অভেদ রচনা করে, অচিন্তিতভাবে রূপকায়িত হয়ে লাভ করে ধ্বনির আদর আর চিন্তিতভাবে উপমায়িত হয়ে বইয়ে দেয় শুশ্রূষার মতো বাণী। ব্যক্তিগত মূল্যায়নের সরাসরি অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়েই ভাষা সেখানে এরকম রূপ পায়। এটা হয় অনুভূতিরই তাড়ায়। পাঠকের মনে আবার এটি অনুভূতি জাগাবারও দায়িত্ব পালন করে। কখনো কখনো বস্তু ও ধারণায় এমনকি প্রাণসঞ্চারও ঘটে। পাথরও বাউল হয়, ভয় জোরে কেশে ওঠে।

সংবাদপত্রের পাতায় তো আমরা হামেশাই দেখি ব্যাঙের ছাতার মতো মাদ্রাসাকে গজিয়ে উঠতে, বাজারে আগুন লাগতে। এ-ও তো রূপকই। তাহলে রূপকপ্রশ্নে প্রতিবেদন আর কবিতায় পার্থক্য রইল কই? আছে পার্থক্য। যে রূপক মরে যায় নি, সংবাদপত্র সে রূপক ব্যবহার করতে পারে না। সংবাদপত্রের প্রধান দায় বক্তব্যকে সহজে বোধগম্য করা। সংবাদপত্রের ভাষায় তাই ফাটল শোভন নয়, অনুভূতিজ্ঞাপন তার কাজ নয়, তার কাজ তথ্যজ্ঞাপন। কবিতা যে রূপকের জন্ম দেয়, তার কাজ বোধগম্য হওয়া শুধু নয়, বোধকে প্রসারতা দেওয়া ও উসকানি সরবরাহ করা। কবিতার রূপক সার্থক হলে একসময় সেটা মরে যায়। সংবাদপত্রও তখন পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি করে দেখতে পারে। কবিতার রূপক এ প্রক্রিয়ায়ই ক্লিশে হতে হতে মরে গিয়ে সংবাদপত্রের ভাষা হবার যোগ্যতা অর্জন করে। ঠিক এ কারণেই সংবাদপত্র যখন সাহিত্যের দায় সামলায়, তখনো মরা রূপককেই তা মহিমান্বিত করে বেশি।

ব্রাত্যজনের ভাষায় উপমা-রূপকের যথেচ্ছ ব্যবহার আছে। যেসব ভাষাকে আমরা অশ্লীল বলে অভিযুক্ত করি, সেসব ভাষায় শক্তিশালী সব রূপকের উপস্থিতি থাকে। যিনি অকথ্য গালি খান তিনি যে দ্রুত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বা পালটা গালি দেন, এটা প্রমাণ করে যে, ওই নির্দিষ্ট প্রয়োগটা খুব দ্রুত শ্রোতাকে স্পর্শ করেছে এবং তার মনে পালটা অনুভূতির উদ্রেক করেছে। এটা রূপকেরই শক্তি। সাধারণ মানুষের মুখের কথা তাই কবির জন্য ব্যাপক অনুধ্যানের বিষয় হয়ে ওঠে। কবির কেন হবে শুধু? সকল লেখকেরই, সকল ভাষাকর্মীরই হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তীব্র আক্রমণাত্মক রূপকাশ্রয়ী গালাগালির ঘটনাগুলো যখন ঘটে তখন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চারপাশে ভিড় করে ওঠে। কী বলে না-বলে তা তারা মন দিয়ে শোনে। কেন শোনে এসব? কারণ এ ভাষা দারুণভাবে বোধ্য, অর্থময়, নাটকীয় অভিব্যক্তিসম্পন্ন ও দ্রুত সঞ্চারণশীল। মানুষের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা মন্দাগুন এ ঘটনায় চাড়া দিয়ে ওঠে। তাই জন্যে সেটা হয় আনন্দময়, সম্ভবত।

অধুনা বিকশিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলা ভাষায় নোটানোটি শুরু হয়েছে বেশিদিন নয়। তারও আগে শুরু হয়েছে বাংলা ব্লগ। এসব মাধ্যমে ছদ্মনিক নিয়ে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের এমন এক চূড়ান্ত অবস্থা মাঝেমধ্যে দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে যে, তা বস্তির গালিকর্মকেও ছাড়িয়ে যায়। দেখা যায় যে, যেসব পোস্টে এ ধরনের কাণ্ড ঘটে সেসবের পাঠক বেড়ে যায়। হিট সংখ্যা হয় অনেক বেশি। ব্লগে হিট গণনা করা গেলেও ফেসবুকে সেটা করা যায় না। তবে এখানেও যে বিস্তর মানুষের আগমন ঘটে তা কতকটা বোঝা যায় কমেন্টের বহর দেখে। ফেসবুকে এসব ছদ্মনিকের গালিবাজি প্রতিরোধের জন্য একাধিকবার আন্দোলন গড়ে তুলবার চেষ্টা করেও বিশেষ সাফল্য পাওয়া যায় নি। বাকস্বাধীনতা ও স্বরবৈচিত্র্যের পক্ষে ভোট দিয়ে অনেককেই এখানে প্রকাশ্যে বলতে শোনা গেছে যে, তাঁরা নিকদের কথাবার্তা এমনকি পছন্দই করেন। ফলাফল থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা কখনোই যাবে না যে, নিকসমর্থকদের প্রত্যেকেরই গোপনে একাধটা নিক আছে। তাঁদের আকর্ষণের একটা কারণ নিকসমূহের রূপকবহুল ভাষাও। যাঁরা এসব প্রশ্নে চুপ করে থাকেন, ধারণা হয় তাঁদের মনেও হয়ত নিকদের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থনই প্রকাশ পায়। তা নইলে কথিত নিকদের বন্ধুতালিকা থেকে মুছে দেবার ব্যাপারে তাঁরা অনাগ্রহ প্রদর্শন করবেন কেন? এঁদের সবাই তো আর আক্রান্তের শত্রু নন যে, শত্রুর পরাস্ত হওয়া দেখে তাঁরা আনন্দ নেবেন। আনন্দ আসলে তাঁরা নেনই, তবে সে আনন্দটি আসে ভাষা থেকে, রূপকের ব্যবহার থেকে। আমরা আমাদের পাঠক জীবনে এমন অনেক গদ্যরচনার আস্বাদ নিয়েছি, যাকে আমরা বলেছি কাব্যগুণসমৃদ্ধ। এই বিশেষণ প্রয়োগের প্রধান কারণ সে ভাষার পরতে পরতে বস্তুত জেগে উঠেছে সপ্রাণ বাদ্যি, রূপকের ঢাক।
   
আট.

ভালো কবিতার ব্যাখ্যা পরিবর্তনশীল। পাঠকভেদে এর অর্থ তো আলাদা-আলাদাভাবে খোলেই, এমনকি একজন পাঠকের কাছেও উপর্যুপরি পাঠে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ধরা দেয়। যে কবিতার এ সম্ভাবনা আছে সে কবিতা বহুজনকে ছুঁতে পারে। গুমরমুক্ত ও একটিমাত্র সরল অর্থে ধরা দেওয়া একরৈখিক কবিতা হীনপ্রায়। কবিতায় অর্থের এই অস্থিরতা রহস্যময়তা সৃষ্টি করে করা সম্ভব। সময়ের জীবনছন্দ ধরে শব্দকে বাঁধাধরা পরিভাষার আওতা থেকে বের করে এনে দ্ব্যর্থক বা অনেকার্থক মানে জাগিয়ে তুলতে পারলে এ সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে সূচিত হতে পারে। এর জন্য উল্লম্ফন কার্যকর নয়, নন্দনগহ্বর তক বড়োজোর পাঠক নিতে রাজি হন। বাক্যের ওপর নিরর্থকতা বা অনর্থকতার ভার চাপাতে চাইলে ফাঁকি সৃষ্টি হয়, রহস্য নয়। অদূর এমনকি সুদূর চেষ্টায় হলেও শব্দ-বাক্যের নাগাল মিলতে হয়, তা নইলে কবির সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। যাই হোক, এরকম কবিতার মানে কোনো একটি স্থির নির্দিষ্ট পাটাতনে দাঁড়ানো থাকে না, বলাই বাহুল্য।

সাধারণীকৃত বক্তব্যের ক্ষেত্রেও কবিতার মানে নানাদিকে খুলবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। একইসঙ্গে গাছের-মাছের, জীবন্মাত্রের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে সাধারণীকরণ। প্রতীকের ব্যবহারও কবিতাকে অনেকার্থকতা দিতে পারে। প্রতীক বস্তুটি বাইরে একটা মানে ধরলেও ভিতরে আরেক বা অনেক। প্রাথমিক পাঠে এর বহির্বাটির খোঁজ পাওয়া যায়। অগ্রসর পাঠে আস্তে আস্তে নিহিতার্থের দরজা খোলে। এক ধরনের পাঠক বাইরের মানেটা নিয়ে তৃপ্ত থাকে। কিন্তু সবাইকে ওই মানে তৃপ্ত করতে পারে না। গুমর বুনে রাখা গেলে তা অগ্রসর পাঠকের খোরাক হতে পারে। ব্যাজস্তুতি-ব্যাজনিন্দাও এ শ্রেণির পাঠকের আগ্রহের আওতায় স্থান পেতে পারে।

নয়.

কবিতা সময়ের জীবনছন্দ টের পায়। জীবন যে মাপে এগোয়, সময় যেভাবে হাঁটে, কবিতাকেও সেভাবে হাঁটতে হয়। তা নইলে সময়ের কবিতা লিখিত হয় না। একজন কবি সমসময়ে যাপনধর্ম পালন করে পঞ্চাশ বা একশ’ বছর আগের কবিতা লিখুন, তা চান না পাঠক। এটা শুধু বিষয়ের বা শব্দার্থেরও মামলা নয়, মামলা ছন্দেরও। প্রতিদিন কবিতায় যুক্ত হচ্ছে নতুন বিষয়, শব্দে যুক্ত হচ্ছে নতুন মানে, ছন্দ কেন পুরোনোটাই থাকবে? নতুন মোড়কে পুরোনো জিনিস যেমন প্রার্থিত নয়, তেমনি নয় পুরোনো মোড়কে নতুন জিনিসও। কাজেই ভেঙেচুরে ওর বারোটা বাজিয়ে দিতে হয় যে কোনোভাবে।

ছন্দের ব্যাপারে একটা কথা প্রায়ই ওঠে, যে, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দকে ভালো করে জানলেন না বুঝলেন না তিনি ছন্দ ভাঙবার অধিকার পাবেন কোন বিবেচনায়? খুবই সংগত কথা। জেনে ভাঙাই ভালো। কিন্তু যিনি ওটা ভালো করে জানবার-বুঝবার তাড়নাই বোধ করলেন না ভিতর থেকে, ভাবলেন একটা শৃঙ্খল, তাঁকে ব্রাত্য চিহ্নিত করবার অধিকারও কেউ রাখেন না।

প্রয়োগের উদাহরণসহ ভালো করে প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দ শেখা সপ্তাহখানেকের মামলা মাত্র। নিজে প্রয়োগে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠতে মোটমাট আরো তিন মাস। একজন লেখক তাঁর লেখক জীবনে কাড়ি-কাড়ি জটিল বইয়ের এদিক দিয়ে ঢুকে সম্পন্ন হয়ে যদি ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন, তাঁর কাছে এক সপ্তাহের ওই কথিত আয়োজনটা যে গুরুত্বপূর্ণই মনে হলো না, এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখাও জরুরি বৈকি। কবিতা বস্তুত মুক্তি চায়। তা এমনকি বিখ্যাত কবিতাবলিঘনিষ্ঠ কাব্যিক ঐতিহ্য, তার আবহ, শব্দরুচি, বাক্যগঠনশৈলী, বিষয়ভাবনা থেকে শুরু করে তাত্ত্বিক ভার, আভরণের ঘটা, ছন্দ সবকিছু থেকেই। এই মুক্তির মন্ত্রে যিনি বুঝেশুনে দীক্ষা নেন, তাঁর কাছে খোঁয়াড়প্রতিম একটা আয়োজনকে অপ্রয়োজনীয় মনে হতেই পারে।

প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দের নিটোল ব্যবহারে শাসিত অনেক কবিতার দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকালে দমবন্ধকর অনুভূতি হয়। মনে হয় ওখানকার শব্দেরা, বাক্যেরা যেন মাত্রাতিরিক্ত শাসন সয়ে রীতিমতো কাঁচুমাচু হয়ে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছে না। বনসাই বনসাই একটা চেহারা। এ অবস্থা থেকে যত দ্রুত বেরোনো যাবে ততই মঙ্গল।
একটা কথা বলা হয় যে, ছন্দ কবিতাকে স্মৃতিতে রক্ষিত হতে সাহায্য করে। সে তো করেই। কিন্তু এ বিবৃতি কি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক তিন প্রবীণ ছন্দের বেলায়ই প্রযোজ্য? যিনি এই ছন্দগুলোর খড়্গের নিচে গলা বাড়িয়ে রাখেন না, তিনিও কি কবিতা ছন্দেই লিখেন না এক ধরনের? কবিতা হতে হলে টেক্সটের মধ্যে ভাষার যে সামঞ্জস্য তৈরি হতে হয়, গতি অব্যাহত রাখতে হয়, পাঠস্বাচ্ছন্দ্য স্থাপিত হতে হয়, এ কি কোনো ছন্দ তৈরি করে না? জীবনছন্দ কি ছন্দ নয়?

তরুণ কবিদের মধ্যে অল্প কয়েকজন সদস্যসম্বলিত একটি গোষ্ঠী বাংলা প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দ তো বটেই, এমনকি সংস্কৃত ও বৈদিক ছন্দেও কবিতা লিখছেন এবং ছন্দে না-লিখলে কবিতা কবিতা হয়ে উঠবে না বলছেন। এর বিপরীতে অন্য আরেকদল ছন্দকে অপ্রয়োজনীয় বলে সম্পূর্ণ বর্জন করবার পক্ষে উচ্চকিত ভাষণ দিচ্ছেন এবং ছন্দে লিখলে কেবল ছড়ামাত্র হয়ে উঠতে পারে বলে দাবি করছেন। সাময়িক বিরতি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এঁরা প্রায়ই বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক ছাপিয়ে রীতিমতো বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ব্যক্তিগত সম্পর্কে ইতি টানেন। আমার কাছে এই দুই দলের কার্যকলাপকেই আপত্তিকর মনে হয়, দুই দলের সদস্যদের মধ্যেই গোঁড়া মৌলবাদী বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি দেখতে পাই।

জানা কথা যে, শিল্প-সাহিত্যে কোনো সর্বজনীন মত নেই, থাকা সংগতও নয়। ফলে নিজ নিজ শিল্পরুচির অনুকূলে নিজের কাজটি করবার পাশাপাশি অন্যের শিল্পরুচির প্রতি শ্রদ্ধা থাকাটাও আবশ্যক। অনেকরকম লেখায় কবিতাঙ্গন বর্ণিল হয়ে উঠলে কার কেন কীভাবে সমস্যা তৈরি হয় তা বোঝা মুশকিল। ক্ষুদ্র একটি লেখকসমাজের ভাবনাবৈচিত্র্যকে যাঁরা মেনে নিতে পারেন না, তাঁরা বাংলার বহুত্ববাদী সমাজচরিত্রের হাজার বছরের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখায় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে তো মনে হয় না। এসব লেখক দিয়ে আমরা কী করব আখেরে?

সবিশেষ, আমাদের দরকার উৎকৃষ্ট কবিতা। কবিতাটি কোন প্রক্রিয়ায় হয়ে উঠল, শৃঙ্খলের ভিতরে থেকে নাকি বাইরে এসে, সেটার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। কিন্তু শৃঙ্খল ছিল বলে মুক্তির পক্ষে কিংবা মুক্ত ছিল বলে শৃঙ্খলের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তরবারি শানানো অবশ্যই বন্ধ হওয়া দরকার।
   
দশ.

একজন কবিতাকর্মী হিসেবে আমি মৌলিক কবিতাই লিখতে চাই। কিন্তু মৌলিক কবিতা বলতে আমি যা বুঝি, বাস্তবিক অর্থে ওটা একটা ঘোড়ার আণ্ডা! যেদিকেই তাকানো যায়, দেখি কেবল ক্রাফটসম্যানশিপের বাহাদুরি, অন্যের জানালা দিয়ে আকাশ দেখার কেরামতি। যেন এই-ই হতে হয়, যেন এই-ই একমাত্র পথ, অবিকল্প। কেউ ট্রুকপি বানায়, কেউ শব্দ ধরে ঝুলে পড়ে, কেউ ছন্দ ধরে লাফায়। ঝুলতে ঝুলতে, লাফাতে লাফাতে যেখানে গিয়ে পৌঁছায়, তা আসলে অন্য কারো যতনে গড়ে তোলা বাড়ির আঙিনা বা অন্য কারো হাসিল করা চাষভূমি; অকর্ষিত কোনো প্রান্তর নয়।

এই-ই চলছে দিকে দিকে। এই চলার চলনদার যারা, দলেবলে ভারী বলে এরা সদাপট বিচরণ করে। উচ্চকণ্ঠে কথা বলে। বাণীশাসন চালায়। ঘটনাক্রমে এই বাণীবিদরা উজ্জ্বল, চলনে-বলনে ও দেখায়। এদের চেকনাই কাজেই নবাগতকে দুর্দান্ত আকর্ষণ করে। নবাগত হারিয়ে যায় চেনা ও অচেনার মিশ্রণ দিয়ে বানানো আণ্ডার ভোজে। এরা তখন জানপ্রাণ দিয়ে নামে বাণীবিদদের শিখিয়ে-পড়িয়ে দেওয়া কথা প্রচারে।

এই আণ্ডাবাজরা সাহেবি সমাজের লোক, মাটি ও মানুষঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতাহীনতায় নিরক্ত, পাণ্ডুরোগে ভোগা পাঠক। এরা পাঠ করে উপভোগের জন্য নয়, ছাঁচের সন্ধানে। পছন্দসই ছাঁচ পেলে পুরোনো কথা ফেলে নতুন কথা ঠেসে দেয়। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে অচেনা বানাবার, আসলে হয় না। আগের বাড়ির পালানে যেখানে লিচু গাছ ছিল, সেখানে রেইনট্রি গাছ লাগায়; যেখানে ইঁদারা ছিল সেখানে নলকূপ বসায়। এ ছাড়া, নতুন পোশাকের ভিতরে আর সব একই থাকে। যে কারণে পড়তে গেলে নস্টালজিক লাগে, কেমন যেন একটা চেনা স্বাদ, আবার চেনাও নয় অবস্থা। এই চেনা-অচেনার মিশ্রণ ব্যাপারটা মাধুর্যের এক ঘোর তৈরি করে, ওই ঘোরই করে সম্মোহিত। অল্পপ্রাণ পাঠক তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার ওপরে। ভাবে, এটাই হয়ত চিরন্তন মাধুর্যপুরীতে পৌঁছুবার অবিকল্প সিঁড়ি!

মৌলিক কবিতা তত্ত্বীয়ভাবে কবিতা নির্মাণের এহেন সংস্কৃতি থেকে দূরে সদভিজ্ঞতাজাত, নতুন। যে অভিজ্ঞতা কবি নিজে ছুঁয়েছেন, অর্জন করেছেন, তা-ই সে কবিতার ভিত। কবিতা কমবেশি বানানো জিনিস সন্দেহ নেই, কিন্তু এর গভীরে কাজ করা অভিজ্ঞতাটা ধার করা হলে মুশকিল। যখন প্রত্যক্ষ সদভিজ্ঞতা কবিতা রচনার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে, তখন সে কবিতার মৌলিক হয়ে ওঠবার সম্ভাবনা প্রভূত, যদি অন্তত চালাকি করে কোনো ছাঁচ এনে ওর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। এরকম কবিতা পাঠকের কাছে মূলতক অচেনা লাগে, চাই কি অপ্রিয়ও। পাঠকের যাপনের নস্টালজিয়াবোধ জাগিয়ে তুলবার মালমশলা তাতে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সজ্ঞানে সেখানে চাপানো থাকে না পুরোনো কবিতার রূপরসগন্ধ। এসব বৈশিষ্ট্য ধরে বলেই কবিতা মৌলিক হয়ে ওঠে বা ওঠবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

আমাদের যাপনের সাথে যুক্ত জলমাটিহাওয়ার সিংহভাগই এখনো অকর্ষিত, অন্তত কবিতায়। আধুনিক কবিতা নামের বিদেশাগত শৈলী ও শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে কোমরবেঁধে তাকিয়ে না-থাকলে চোখমাত্র খুঁজে পেতে পারে সেই অকর্ষিত অঞ্চল। বর্তমানে জীবনানন্দ পাঠকমাত্রের কাছে প্রিয়তর (তাঁর কবিতা বিদেশি শিল্পচিন্তাপ্রসূত হলেও), তা বলে আমাদের জীবনানন্দ হবার দরকার নেই। জসীমউদদীন আমাদের আত্মীয় (তাঁর কবিতা বাংলার লোকবেদনাপ্রসূত বলেও), তা বলে আমাদের জসীমউদদীন হবারও দরকার নেই। আমরা হবো আমাদের মতো। আধুনিক শিল্পচিন্তা আমাদের শত্রু নিশ্চয়ই নয়, লোকবেদনাও ফেলনা বিষয় নয়। আমাদের দুটোই দরকার। কিন্তু মুখস্থ শিল্পচিন্তাকে থাপ্পড় কষানোরও দরকার আছে, লোকবেদনা বলতে কেবল গ্রামীণ শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের জীবনযন্ত্রণা ভাবাকে ভোলার প্রয়োজন আছে। গ্রাম-শহর সর্বাংশের মানুষই মানুষ, সবাই কবিতা। এইসব কবিতাকে জানতে বুঝতে চাই সউদ্ভাবিত শিল্পচিন্তা, যেটা অন্য কারো নয়, কেবল নিজের। সেটা কেমন হবে, যতক্ষণ করে ওঠা না হবে ততক্ষণ কেউ জানবে না। আগে জেনে শিখে ছাঁচ তৈরি করে করা দরকারি নয় এটা। করতে করতে হবে। কীভাবে হলো তা নথিভুক্ত হবে পরে। এই পথে যেতে যেতে কখনো এমন কোনো প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছা যেতে পারে যেখানে আগে কেউ পৌঁছে নি কবিতা কারণে।

সেজন্য ছন্দ এবং অছন্দেরও নতুন ধরন দরকার। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত : চিরকাল এই তিনটি ছন্দই মাড়াতে হবে তার কোনো মানে নেই। জগতের সবকিছু বদলে যাচ্ছে, ছন্দও বদলানো চাই। ছন্দ বানাতে হবে, মানে ছন্দের নতুন চাল। তা যদি না হয়, তবে কথা বলার আনকোরা নতুন তাল-লয়।

বিষয়টা যতটা লেখকের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার, ততটা অন্যের বলে দেবার ব্যাপার নয়। লেখক নিজেই জানবেন তিনি আসলে কী লিখছেন। কপি করা খাপে কথা ঠেসে দিচ্ছেন নাকি নিজের অবিকল্প অভিজ্ঞতাকে নিজের মতো করে গেঁথে তুলছেন। মৌলিক কবিতা তিনি কখনো লিখেন না, যিনি মনে করেন মৌলিক কবিতা লেখা অসম্ভব। মৌলিক কবিতা তিনি কখনো লিখেন না, যিনি প্রতিনিয়ত হাততালির বাসনায় কাতর হয়ে থাকেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন কবি শতভাগ মৌলিক কবিতা লিখতে পারেন কি না। আমি যে বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি কবি-লেখকদের শত-সহস্র লেখা পড়ছি, দেশি-বিদেশি সিনেমা উপভোগ করছি, চিত্রকর্মে বুঁদ হয়ে থাকছি, নাচ-গান দেখছি-শুনছি, এগুলোর কোনো ভালোমন্দ অভিক্ষেপ কি আমার মধ্যে পড়ে না? যদি পড়ে তবে তার কি কোনো প্রভাব নেই আমার কবিতায়? নিশ্চয়ই আছে। না-থেকে পারেই না, যদি জার্মান নাট্যকার লেসিংয়ের এই বক্তব্যটি সত্য হয় যে, ‘মাসুল না-দিয়ে কেউ পাম গাছের তলায় হাঁটতে পারে না’। গ্যাটে তাঁর ‘ইলেকটিভ এফিনিটিজ’ গ্রন্থে উদ্ধৃতিটি একই অর্থে ব্যবহার করেছিলেন জেনে বাক্যটির নিহিত গুরুত্ব আরো গুরুত্ব লাভ করে। এর মানে হলো, কিছু প্রভাব আছে যেগুলোকে বলা যায় স্বতঃপ্রভাব। এগুলো এড়ানো অসম্ভব।

কবিতার জন্ম হয় নিজস্ব আনন্দ-বেদনার থেকে। এটা যতক্ষণ নিজস্ব ততক্ষণ তা সৎ। ভুল বুঝবার অবকাশ দূর করতে বলা দরকার যে অন্যের আনন্দ-বেদনাও নিজের হতে পারে, দেশের আনন্দ-বেদনাও নিজের হতে পারে, যদি তা কবিকে ভেতর থেকে স্পর্শ করে। যতক্ষণ স্পর্শ করে না, ততক্ষণ অন্যের আনন্দ-বেদনা নিজের আনন্দ-বেদনা হয় না। এরকম অবস্থায় ওই বিষয়ে লেখা কবিতা খুব জলো ও খেলো, ওপরভাসা ও হাস্যকর হয়। দেশের কবিতা, বিশেষ করে অধিকাংশ দেশের গান প্রায়ই হয় ওপরভাসা, মিথ্যা-আবেগে ঠাসা। ওগুলো নীতিকথা হিসেবে, শিক্ষার্থীপাঠ হিসেবে ভালো জিনিস, কিন্তু কবিতা হিসেবে সাধারণত প্রায়ই হয় নিকৃষ্ট। দেশের কবিতা কখনোই সদাবেগ দ্বারা লিখিত হয় না বা লেখা হতে পারে না, তা নয়। ষাটের দশকে, মুক্তিযুদ্ধকালে সেরকম সময় ছিল আমাদের। এখন যেরকম সময় বিরাজ করে ফিলিস্তিনে।

নিজস্ব আনন্দ-বেদনার সৌকর্যময় ভাষিক প্রকাশকেই আমরা কবিতা বলি। এ হয় আত্মাজারিত সদোচ্চারণ। এর প্রকাশবাসনা মানুষের সহজাত। অন্তর্গত একটা তাড়না মানুষকে খোঁচায় প্রকাশসক্ষম হতে। প্রকাশবাসনা থাকলেও প্রকাশসক্ষমতা সবার থাকে না। যার থাকে তিনি কবি হবার দিকে হাঁটেন, যার থাকে না তিনি শুয়ে-বসে থাকেন!
এ আলাপের ভিত আরো মজবুত হতে পারত, যদি কথিত মৌলিক ও অমৌলিক কবিতার উদাহরণ হাজির করে কথা বলা যেত। সেটা করা যেত না তা না, কিন্তু করা হয় নি। করা হয় নি কারণ পাঠকের জন্য সেটাও অন্যজনের স্থাপিত বাতিঘরের দিকে তাকিয়ে জগজ্জীবনকে উপলব্ধি করা হতো। এ আলাপের অভীষ্ট কোনো বিতর্কের মাঠে রণসজ্জায় হাজির হওয়া নয়, বরং ভিতরপ্রদেশে এক সদাকাঙ্ক্ষার জাগরণ, যা খুঁজে দেখবে সম্ভাবনাময় চাষযোগ্য আত্মগত অকর্ষিত ভূমি, যার যে কোনো অবস্থায় মৌলিক হবার সম্ভাবনা শতভাগ। ক্রাফটসম্যানশিপের বর্তমান রমরমা সময়ে যা হয়ে উঠতে পারে মৌলিক কবিতার এক ক্রমাগ্রসরমান বিপ্লবী মিছিল।

মনজুর কাদের সম্পাদিত 'কঙ্কাল'-এ প্রকাশিত, ২০১৯

Saturday, July 4, 2020

লোক-এর কর্মকাণ্ড ও আমার লোককাণ্ড

এমন নয় যে, শামীমুল হক শামীমের সাহিত্যকর্মের আমি খুব ভক্ত, কিন্তু লোক সম্পাদক অনিকেত শামীমের সাংগঠনিক প্রতিভায় আমার মুগ্ধতার কোনো শেষ নেই। একজন মানুষ সমাজ-সংসার লগ্ন থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে নিজের পড়ালেখার কাজটিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে হলেও অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট লোকজনের পেছনে লেগে থেকে কী করে দিনের পর দিন সম্পাদনার কাজটি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে পারেন, তার কোনো কূল-কিনারা আমি খুঁজে পাই না। শুধু যদি সম্পাদনাসীমার আওতায়ই তাঁর কাজ শেষ হতো তাও একভাবে হিসেবটা মেলানো যেত, কিন্তু তিনি বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনাতিরিক্ত এমন বিশাল সব কর্মযজ্ঞ ফেঁদে বসেছেন যে শুরুতে অনেকটা অসম্ভব মনে হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে যে ঠিকঠাক সাফল্যের সঙ্গেই তা সম্পাদিত হয়ে গেছে। এসব করতে সংগতির পাশাপাশি অপরিমেয় সাহস লাগে, অনিঃশেষ ধৈর্য লাগে, লাগে জনসংযোগ ও জনসমর্থন; যার সবই তাঁর প্রভূত পরিমাণে আছে।

প্রবাদ আছে, বোবা ও নিষ্কর্মার কোনো শত্রু থাকে না। এর মানে হলো, কথক ও কর্মীর থাকে, থাকতে পারে। কথা যত তীর্যক ও আক্রমণাত্মক হয়, কাজ যত দৃশ্যমান ও প্রভাবসঞ্চারী হয়, শত্রুতার মাত্রা হয় তত তীব্র। আমার পর্যবেক্ষণে দেখেছি, কথায়-লেখায় তিনি যথেষ্ট নমনীয়, প্রায় সময়ই অনাক্রমণাত্মক, একজন সফল সংগঠকের কাছে যেটা প্রত্যাশিত। কিন্তু তবু তাঁর কিছু শত্রুপ্রতিম নিন্দুক রয়েছে, মনে হয় এঁরা সশস্ত্র হয়েছে মূলত তাঁর প্রভাবসঞ্চারী দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডের কারণেই। কোনো সংগঠকই সবার মন জয় করতে পারেন না, পারা উচিতও নয়। সংগত কারণে তিনিও পারেন নি। ওই তালাবন্ধ মনওয়ালারাই তাঁর চিহ্নিত নিন্দুক। এঁদের সমস্ত মনপাহাড় ডিঙিয়েই একের পর এক লোক-এর বিপুলোদ্যোগসমূহ গৃহীত ও সম্পন্ন হয়ে চলেছে। হয়ত চলতে থাকবে আরো অনেক দিন, যেহেতু অনিকেত শামীমের মধ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যমের ঘাটতি এখনো তেমনভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে না। যদিও লোক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯-এর পরে আর দেওয়া হবে না বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধমে একটা ঘোষণা আমার চোখে পড়েছে। এটি চালু রাখা বা বন্ধ হওয়া বিষয়ে আমার দিক থেকে কোনো ওকালতি নেই।

আমার জানামতে, অজস্র উদ্যোগের মধ্যে ২০০৯-এ লোক-এর ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রবর্তিত লোক সাহিত্য পুরস্কারই বেশি বিতর্কউসকানিয়া ব্যাপার ছিল। পুরস্কারকে লেখালেখির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয় না আমার। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও দৈশিক প্রেক্ষাপটে পুরস্কারসংস্কৃতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আছে, লোক সাহিত্য পুরস্কার যেগুলোর একটি; যেটি প্রদান করে 'লোক' নামক একটি লিটল ম্যাগাজিন। পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা নির্ভর করে সেটি কারা দিচ্ছে, কাদের দিচ্ছে, কীভাবে দিচ্ছে তার ওপরে। অনেক সময় অবশ্য পুরস্কারের অর্থমূল্যকেও গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। লোক পুরস্কারের বর্তমান অর্থমূল্য তেমন বৃহদাংকের নয়, মাত্র ৫০ হাজার টাকা; কিন্তু এর সবচাইতে মূল্যবান প্রদেয় হচ্ছে ঘোষণার পরের বছর পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর বিশ্লেষণী লেখাপত্র নিয়ে ঢাউস একটি বিশেষ সংখ্যা অবমুক্তকরণ। পৃথিবীতে এরকম আর কোনো পুরস্কার আছে কি না আমার জানা নেই। সুতরাং প্রকাশ্যে এই পুরস্কারটির নিন্দা করা হলেও অনেক লেখকের মধ্যেই এটি পাবার একটা আকাঙ্ক্ষা সুপ্ত থেকে যাওয়া বিস্ময়কর নয়। যাঁরা অনেক চেষ্টা-তদবির করেও সুবিধা করতে পারেন নি, তাঁরা একসময় এর নিষ্ঠাবান নিন্দুকে পরিণত হয়েছেন। মানবচরিত্র এমনই, মহাজনরা বলে গেছেন! তবে পুরস্কারের অর্থমূল্য ও অন্যান্য যা কিছু প্রদেয় তার সবটাই গ্রহণ করে পরে লোক-এর শত্রু বনে গেছেন এবং দিনের পর দিন লোক ও এর কর্মকাণ্ডের প্রতি সার্বিক অসহযোগিতা জারি রেখেছেন যাঁরা, তাঁদের এরকম আচরণের যৌক্তিক ভিত্তি কী তা আমি অবশ্য স্পষ্ট করে জানি না। এ অংশের থেকে পাওয়া বেদনাভারও হয়ত অনিকেত শামীমকে লোক পুরস্কার বন্ধ করে দেবার ঘোষণা প্রচারে প্রণোদিত করে থাকতে পারে।
   
এটা ঠিক যে, পুরস্কার নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা কাণ্ডকাহিনি চলে। নিজে সংগঠন তৈরি করে, নিজেই পুরস্কার ও অনুষ্ঠানের অর্থ জোগান দিয়ে নিজেই সেই পুরস্কার গ্রহণ করে মিডিয়াবাজির মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করবার কাহিনিও এদেশে রয়েছে এন্তার। এগুলো হলো ভুঁইফোড়দের পুরস্কারকাহিনি। আবার রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত কোনো কোনো সাহিত্য পুরস্কারের ক্ষেত্রেও অনেক তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটতে দেখা যায়। বিস্ময়করভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখককে গণনায় না এনে রাজনৈতিক বিবেচনায় গৌণ লেখককে পুরস্কার প্রদানই অনেকটা তাদের সংস্কৃতি। এসব কারণে আজকাল পুরস্কার ব্যাপারটাকেই অনেকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন। এভাবে যাঁরা দেখেন তাঁদের দোষও দেওয়া যায় না। কিন্তু আমার জানামতে, লোক পুরস্কার এসব আপত্তিকর প্রবণতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। এমনকি, এজন্য লেখক বা প্রকাশককে লোক দপ্তরে দুই বা পাঁচ কপি বইও জমা দিতে হয় না, কিংবা কোনো বন্ডে স্বাক্ষরও করতে হয় না।

এ যাবৎ যতজন কবি, কথাসাহিত্যিক ও চিন্তককে লোক সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল, যাঁরা এর চাইতে বড় পুরস্কারও ডিজার্ভ করেন। ওই তালিকায় একমাত্র আমিই ব্যতিক্রম, মানে লেখক হিসেবে কমজোর। জানি, আমার এই স্বতঃপ্রকাশ কাউকে কাউকে খুশি করবে! করুক বরং। এই যে এতগুলো মানুষকে এই অবেলায় খুশি করতে পারা গেল, আমার লোককাণ্ডে এটাই সবচাইতে বড় লাভের দিক ভাবি।

লোক-এর সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা এর আঁতুড়ঘর থেকেই। অধুনাবিলুপ্ত গণসাহায্য সংস্থার চাকুরি হারিয়ে তখন আমি প্রায় বছরদুয়েক ধরে ট্যাবলয়েট দৈনিকের সাপ্তাহিক পাতা এডিটিং, বিজ্ঞাপনী সংস্থার কপিরাইটিং, বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার প্রুফরিডারি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বুক ইনভেন্টরির জন্য ইনফরমেশন কালেকশনের মতো খণ্ডকালীন কাজ করে ঢাকা শহরে টিকে-বেঁচে ছিলাম, কিন্তু কোথাও থিতু হতে পারছিলাম না। কাজের ফাঁকে রাতেদিনে অনেকটা করে সময়ই তখন কাটত আজিজ সুপার মার্কেটে, যেটি ছিল আমার দিক থেকে অনেকটা নিউক্লিয়াসের মতো। তখনই একদিন শামীম ভাই (তখনো তিনি অনিকেত শামীম হয়ে ওঠেন নি) প্রস্তাব দেন লোক নামে প্রকল্পিত একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশে সহযোগিতা করবার। শুনেছি আগে তিনি ওই কাজের দায়িত্ব আরো দুজন তরুণ কবিকে দিয়েছিলেন, কিন্তু কেউই কাজটি শেষ করতে পারেন নি। পুরো কাজের আওতাটি বুঝে আমি এর সঙ্গে যুক্ত হতে সাগ্রহে সম্মত হই, কারণ এ ধরনের কাজ আমার কাছে অনেকটাই ডালভাত ছিল। একজন গবেষক কাম প্রাবন্ধিকের সাহিত্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ততদিনে প্রি-প্রেস এবং প্রেসসংক্রান্ত কাজে আমাকে বিস্তর দক্ষতা এনে দিয়েছিল।

আজিজ মার্কেটের দোতলায় তখন টুকটাক প্রি-প্রেস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শামীম ভাইয়ের নিজস্ব অফিস ছিল, এমনকি ছিলেন একজন কম্পোজিটরও। আমি অন্যান্য খণ্ডকালীন কাজ শেষে প্রতিদিন আজিজ মার্কেটে ফিরে আড্ডার সময় খানিকটা কমিয়ে ওই অফিসে বসতে শুরু করি। ক্লান্ত লাগলে বাইরে গিয়ে আড্ডায় শামিল হই, আবার কাজে ফিরি। ততদিন পর্যন্ত লোক-এর জন্য যেসব লেখাপত্র শামীম ভাইয়ের কাছে সংগৃহীত ছিল, সেগুলোর একাংশ কম্পোজ করা থাকলেও বৃহদাংশই ছিল হাতে লেখা কপি। ওসব লেখা কম্পোজ করিয়ে প্রুফ সংশোধন করা, সূচি ও পৃষ্ঠাবিন্যাসের একটি ইউনিক ফরমেট তৈরি করে সে অনুযায়ী রচনাসমূহ বিন্যস্ত করা, বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা লেখা, বিশেষত তরুণ কবিদের কবিতাগ্রন্থের বিজ্ঞাপন তৈরি করা, লোক প্রকাশিত মাহবুব কবির সম্পাদিত নব্বইয়ের কবিতার দীর্ঘ সমালোচনা লেখার কাজ আমি ওখানে বসেই করেছি। এ ছাড়া, অফিস শেষে শামীম ভাই এলে লোক-এর সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এ সংখ্যায় আর কী কী থাকতে পারে, কার কাছ থেকে কী লেখা নেওয়া যায় ইত্যাদি সিদ্ধান্ত গ্রহণেও আমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এমনকি লোক-এর প্রধান ক্যাপশন ‘বাংলা ভাষাভাষীদের পত্রিকা’ নির্ধারণে আমার ভূমিকাও আশা করি শামীম ভাই ভুলে যান নি।

লোক-এর প্রথম সংখ্যার প্রিন্টার্স লাইনে আমার নাম নির্বাহী সম্পাদক হিসেবেই থাকতে পারত, কিন্তু শামীম ভাইয়ের এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে আমার ব্যাপক অনাগ্রহ ছিল। অনাগ্রহের নেপথ্য কারণ ছিল প্রধানত দুটি : এক. অদৃশ্য কর্মকার হিসেবে দূর থেকে নিজের ক্রিয়াকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া দেখতে আমার ভালো লাগে, যেরকম কাজের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আরো কিছু আছে; এবং দুই. এ কাজের জন্য শামীম ভাই তৎকালীন ঊনবেকার মুজিবকে যৎকিঞ্চিৎ পারিশ্রমিকও দিয়েছিলেন, যদিও তা আমার এখনকার মাসিক সিগারেট খরচের অর্ধেকেরও কম হবে। কিন্তু আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সে পরিমাণ অর্থও আমার কাছে তেমন অপ্রতুল ছিল না।

বলতে কী, লোক-এর প্রথম সংখ্যা ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। আগস্ট ১৯৯৯-এ প্রথম সংখ্যা প্রকাশের দুই মাসের মাথায়ই এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়, যে সংস্করণে কবি মোহাম্মদ রফিক-এর একটি গদ্য সন্নিবেশিত হয়েছিল। অবশ্য তার পূর্বেই সেপ্টেম্বর ১৯৯৯-এ আমি আমার বর্তমান কর্মস্থলে যোগদান করি, ২০১৯-এ যেখানে আমারও ২০ বছর পূর্তি ঘটল। যাহোক, দিবাভাগে খরচযোগ্য সময় তখন আমার ছিল না বটে, তবু লোক-এর ওই সাফল্যের উষ্ণতা আমি খুব কাছে থেকেই অনুভব করতে পেরেছিলাম।

প্রথম সংখ্যার সাফল্যে শামীম ভাইয়ের লোকোদ্যম বেড়ে যায়। দ্বিতীয় সংখ্যা পরিকল্পিত হয় শক্তিমান কবি বিনয় মজুমদারকে কেন্দ্র করে। সম্ভবত প্রথম সংখ্যায় রাখা আমার ভূমিকার প্রতি তাঁর আস্থা তৈরি হয়ে থাকবে, যে কারণে পরিকল্পিত বিনয় সংখ্যায়ও তিনি আমার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। বাংলাদেশ অংশের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে সে সংখ্যার জন্যও আমি অনেক পরিশ্রম বিনিয়োগ করি। আমার পরিবার তখনো ঢাকায় শিফট করে নি বলে অফিসপরবর্তী আড্ডার সময়ের একাংশ এখানে ব্যয় করবার সুযোগ তখনো অবারিত ছিল। সে সুযোগটা ওখানে কাজে লেগেছিল। পুরো ২০০০ জুড়ে মুদ্রিত-অমুদ্রিত লেখা সংগ্রহ ও প্রি-প্রেস কার্যক্রম শেষে ২০০১-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় প্রায় চারশ পৃষ্ঠায়তনের বিনয় মজুমদার সংখ্যা।

আমাদের এখানে সাধারণত কীর্তিমান লেখক-কবিরা মৃত্যুবরণ করলে তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করবার রেওয়াজ চলে আসছিল। কিন্তু একজন কবির জীবিতাবস্থায়ই তাঁকে নিয়ে বিশেষায়োজনের আইডিয়াটা বেশ চমকপ্রদ ছিল। এদেশে বিনয়ের জনপ্রিয়তা তুমুল। ‘কবিতার শহীদ’ বিনয় এখানে ততদিনে মিথপ্রায়। সেই সুবাদে সংখ্যাটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দুই পাশেই লেখক-পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সঞ্চার করে। ২০০৬-এ বিনয় মজুমদারের মৃত্যুর পর এখানে আরো কোনো কোনো ছোটকাগজ তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে, কিন্তু লোক-এর ওই সংখ্যাটিই ছিল মৃত্যুপূর্বকালে এদেশে বিনয় মজুমদারকে অত বৃহদায়তনে স্মরণ।

লোক এখনো পর্যন্ত কমবেশি সূচনাকালীন ফরমেট ধরেই প্রকাশিত হয়ে আসছে, যদিও পরবর্তী কোনো সংখ্যায়ই আমার পক্ষে আর আগের মতো সময় দেওয়া সম্ভব হয় নি। তবে কখনো কখনো লেখক হিসেবে, কখনো-বা তদতিরিক্ত নেপথ্য সহায়তাকারী হিসেবে এক ধরনের লোকসম্পৃক্ততা আমার এখনো অব্যাহত আছে। নিশ্চয়ই থেকেও যাবে।

মাত্র ২০ বছরে লোক-এর অর্জন বিস্তর। আমার মনে হয়, বিপুল গাম্ভীর্য আছে কিন্তু প্রভাবসঞ্চারী কাজ নেই, শুদ্ধাচারী এমন লিটল ম্যাগাজিনের চাইতে মিশ্রাচারী লোক-এর প্রয়োজন সাহিত্যসমাজে অনেক বেশি। এখানে যে মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ আছে, ওখানে তা নেই। দীর্ঘ ২৫ বছরব্যাপী লিটল ম্যাগাজিন পাড়ায় বসবাসসূত্রে এটা আমার অন্যতম প্রতীতি। এ সংক্রান্ত আমার বাদবাকি প্রতীতিসমূহ অন্য সময়ে অন্যত্র ক্রমপ্রকাশ্য...

লোক-এর দুইযুগ পূর্তি সংখ্যায় প্রকাশিত, ডিসেম্বর ২০১৯

অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অন্যতম স্বর্ণদুয়ার

ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের নিয়মিত পাঠচক্র প্রকল্প বীক্ষণ তার ১৮০০তম অধিবেশনে উপনীত হতে যাচ্ছে, সংবাদ হিসেবে এটা প্রায় সবার জন্যই সচকিত হবার মতো। সংবাদটি আমার জন্য একইসঙ্গে গর্বেরও, যেহেতু ১৯৯২-এর অক্টোবর থেকে ১৯৯৩-এর মার্চ পর্যন্ত ৩৭ ও ৩৮ নম্বর প্রান্তিকে আহ্বায়ক হিসেবে বীক্ষণের হাল ধরে এর সুদীর্ঘ পরম্পরায় আমিও তুচ্ছ অবদান রাখতে পেরেছিলাম। পাশাপাশি সহ-আহ্বায়ক এবং সাধারণ অংশগ্রহণকারী হিসেবেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম আগে-পরে আরো কিছুদিন। পেশাগত প্রয়োজনে দূরবর্তী শহরে অবস্থানের কারণে পরবর্তী প্রায় আড়াই দশকে বীক্ষণে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ কমই ঘটেছে। তবে এটা বলা যায় যে, শারীরিক দূরত্ব সত্ত্বেও বীক্ষণের সঙ্গে কোনো মানসিক দূরত্ব আজ অবধি তৈরি হয় নি। হওয়া সম্ভবও নয়।

সকলেই জানেন এবং মানেন যে, লেখালেখি করবার কাজটি শতভাগ ব্যক্তিগত। কিন্তু তার জন্য সামাজিক হয়ে ওঠবার ব্যাপার আছে। অগ্রজ, সমসাময়িক, অনুজ নির্বিশেষে অন্য লেখকদের সঙ্গে মেলামেশা, পাঠাভিজ্ঞতা ও শিল্পধারণা বিনিময়, বিচিত্র তথ্য আদানপ্রদান, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি সে অবকাশ তৈরি করে দেয়, অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ করে তোলে। অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অসংখ্য মার্গের একটি হলো সামাজিক হওয়া। বলতে কী, এ ধনে যে যত ঋদ্ধ, তার ব্যক্তিগত লেখনযাপন তত সুফলদায়ক।

বীক্ষণ আমাদের জন্য ছিল অন্তরসম্পদে ঋদ্ধ হবার অন্যতম স্বর্ণদুয়ার। অন্য লেখকদের সাথে একজন সাহিত্যকর্মী কীভাবে মিশবেন, ওই মেলামেশা থেকে কিছু আহরণ করবেন নাকি কেবল নিজেকে প্রদর্শন করে বেড়াবেন সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। বীক্ষণ সে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ১৯৮৩ সাল থেকে সবার সামনে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়ে চলেছে। যাত্রার শুরুতেই এরকম একটা প্রস্তুত ক্ষেত্রের সন্ধান লাভ যে কোনো সাহিত্যকর্মীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

বীক্ষণ বিষয়ে প্রসংগত আমি কিছু কথা লিখে উঠেছিলাম ২০০৫-এ প্রকাশিত ইফফাত আরা সম্পাদিত ‘দ্বিতীয় চিন্তা’র ফরিদ আহমদ দুলাল সংখ্যায় পত্রস্থ আমার আঁতুড়ঘরের নকশামালা, খুঁজে-ফিরে দেখার সাধনবিলাস শীর্ষক নাতিদীর্ঘ রচনায়। আমার মনে হয়, একই কথা পুনর্বার লিখবার চেষ্টা না করে ওই রচনাংশটিই এখানে উৎকলন করা যায়, যেহেতু আমাদের বীক্ষণঘনিষ্ঠ সময়টা ওখানে স্ফটিকাকারে হাজির হয়েছিল।
বীক্ষণবার
আপনি জানেন, বীক্ষণময় শুক্রবারগুলো ছিল উৎসবের দিন আমাদের, সচল-অচল সব ধরনের লেখকের। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই প্রস্তুতি চলত, পরদিন কোন কোন লেখা পড়া যায় সে নিয়ে। রাত জেগে নতুন করে কিছু লিখবার চেষ্টা, না হলে পুরোনো খসড়াকে ভাঙা আবেগের তুলি দিয়ে নতুন করে ঘষেমেজে সারিয়ে তোলা।
বীক্ষণ ছিল ময়মনসিংহের নবীন-প্রবীণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক মিলনমেলা, আজও। অনিবার্য কারণে একদিন না আসা গেলে সাংঘাতিক খারাপ লাগত। মনে হতো আমাকে বাদ দিয়ে সাহিত্যের খেয়া হয়ত পৌঁছে যাচ্ছে সিদ্ধির ঠিক ওপারে। মনে এতদবিবেচনা একবার ঠাঁই পাবার পর থেকে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ (মসাস)-এর সর্বাপেক্ষা কার্যকর প্রকল্প বীক্ষণ-এ আমরা ছিলাম খুব নিয়মিত। তখন বীক্ষণ বসত সি. কে. ঘোষ রোডে অবস্থিত অনুগ্রহে পাওয়া প্রেসক্লাবের একটি কক্ষে। এখানে এসে সাহিত্যের জন্যে বিনাশ্রম, সিকিশ্রম, আধাশ্রম, পৌণেশ্রম, পূর্ণশ্রম— সব ধরনের সাহিত্যসংস্রবপুষ্ট লোকজনেরই চেহারা দেখেছি সামনাসামনি। ময়মনসিংহে লভ্য তাবৎ ঘরানার লেখকেরই আনাগোনা ছিল একে ঘিরে, হয়ত এখনো আছে। পূর্বনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, কবিতা-গল্প-ছড়া পাঠ শেষে বীক্ষণের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত হলেও তরুণতর আমাদের অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কখনো কখনো পরদিন সকাল পর্যন্তও গড়াত, মনে পড়ে। বিষয় ও ভূগোলে সেসব অনানুষ্ঠানিক যাত্রা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে থামবে আমরা কেউই পূর্ব থেকে জানতাম না কিছু।

প্রেসক্লাব ছেড়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট হয়ে বীক্ষণ ব্রহ্মপুত্র তীরের কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য মহারাজের বাগানবাড়ির তপোবনপ্রায় পুণ্যচ্ছায়ারাশি ঘেঁষা মসাস-এর নিজস্ব ডেরায় স্থানান্তরিত হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই আমাদের দেহমনগাছে নতুন নতুন ডালপাতা ছড়াল। মসাস-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বীক্ষণের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক আপনার বিশেষ নজর থাকত আমাদের প্রতি। সংগঠনের আগামী সময়ের সৈনিক হিসেবে আমাদের তৈরি করবার একটা চেষ্টা আপনার মধ্যে ক্রিয়াশীল দেখেছি বরাবর। আপনার পরামর্শ ও নির্দেশ আমরা মেনে চলতেই চেষ্টা করতাম। এক দু’বার করে আমরা অনেকে আহ্বায়ক হিসেবে বীক্ষণের হালও ধরেছি। কিন্তু নবিশ সংগঠক হিসেবে আমাদের অনেকেরই ব্যর্থতা ছিল, ছিল সংগঠক হবার ব্যাপারে অনাগ্রহও। কারো কারো চাওয়াও ছিল না যে বীক্ষণ ভায়া হয়ে একদিন মসাস-এর বড়ো সংগঠক হব, বরং আমাদের স্বপ্ন ছিল ভালো কিছু লিখবার। কেউ কেউ সংগঠক হয়েও অঢেল লিখতে পারেন, আপনি যেমন। আমাদের কারো কারো মনে হতো, এ কাজটা সবার নয়, আমাদের জন্ম হয়েছে শুধু লিখবারই জন্যে। যে কারণে সংগঠনের নকশা অনুযায়ী পরিচালিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেও ভিতর দিক থেকে আমরা অনেকেই ছিলাম সংগঠনবিরোধী। ফাঁক খুঁজতাম কী করে প্রতিষ্ঠানের মাপ দেয়া সীমার বাইরে পা রাখা যায়, স্বাধীনভাবে সমমনাদের সাথে বেহিসেবী সময় যাপন করা যায়।

বীক্ষণের দ্বিতীয়ার্ধে অনুষ্ঠিত স্বরচিত রচনার পাঠপর্ব আমাদের দারুণভাবে আকর্ষণ করলেও প্রথমভাগের আলোচনা সবসময় ভালো লাগত না ওর প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র এবং বিষয় নির্বাচনজনিত বদ্ধতার কারণে। ওখানে এমনকি ঈদানুষ্ঠানের তাৎপর্য, দুর্গাদেবীর মাহাত্ত্ব্য— এসব বিষয়েও আলোচনা হতো। যতদূর খবর রাখি, আজও হয়। একইসঙ্গে মক্কা-মদিনা-গয়া-কাশী-কপিলাবাস্তু-লুম্বিনী-বেথেলহেম-নাজারেথের ছবি ওখানে আঁকা হতো যতটা প্রতিষ্ঠানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্যে ততটা সাহিত্যিক প্রয়োজনে নয়, আমরা বুঝতাম। এসব আমাদের কখনোই টানত না, আজও তরুণদের টানে না। তার মানে এ নয় যে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি না। আমরা ভিতর দিক থেকে বেড়ে ওঠবার জন্যে আরো প্রাসঙ্গিক, ব্যবহারিক ও গতিশীল আলোচনা করবার ও শুনবার জন্যে সদা মুখিয়ে থাকতাম। সেসব আলোচনার কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপছবি থাকত না, কিন্তু প্রাণমূলে রস থাকত।
আনুষ্ঠানিকতায় আমরা যারা অনেকটাই অপ্রস্তুত ও নীরব, ব্রহ্মপুত্র ধোয়া সাহেব কোয়ার্টার পার্কে গিয়ে বসলে আমরা সেখানে সবাই সরব। আমাদের এই আকর্ষণ সবকিছুকে ছাপিয়ে যেত।

আপনাকে মনেপ্রাণে সদাতরুণ বলেই জানি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও বেশি। তরুণ মসাস কর্মকর্তা গ্রন্থপ্রিয় আহমদ সাইফ, সুনন্দন ইয়াজদানী কোরায়শী, স্বরশিল্পী আমজাদ দোলনও। কিন্তু সর্বোপরি আপনারা ছিলেন মুরব্বি, সাংগঠনিক জন। মাঝে মধ্যে বীক্ষণ শেষে আপনারাও বসতেন পার্কে, কিছুক্ষণ। নদীর জল ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে চুল ওড়াতে ওড়াতে ওখানে চা-সিঙারা, বাদাম-চানাচুর ইত্যাদি হতো। কিন্তু মত্তআড্ডা যাকে বলে সেটা জমত না বস্তুত। আমাদের কাছে আপনারা ছিলেন স্থানীয় অভিভাবক। আমাদের পুরোমাত্রায় খুলে যাওয়া সম্ভব হতো কাজেই আপনারা পিঠটান দেবার পর। তখন ভালো করে ভেবে দেখি নি, কিন্তু এতদিনে ওসব জমায়েতকে রোদে মেঘে কোলাকুলি বলে মনে হয়, মুহূর্ত-স্ফূরিত। 
নব্বইয়ের দশকের শুরুর কয়েক বছরে বীক্ষণে তরুণ ও তরুণতরদের এক অপ্রতিহত জোয়ার ছিল। লেখালেখিতেও বেশি সরব ছিলেন ওই তরুণরাই, সবসময়ই যা হয়। শাহীদা হোসেন রীনা, আশিক আকবর, আহমেদ শফিক, আশিক সালাম, আহমদ শাহাবুদ্দিন, চয়ন বিকাশ ভদ্র, তাসাদ্দুক ফাহিম, অমল রজক, তোফায়েল তফাজ্জল, সালাহউদ্দিন পাঠান, আবদুল মতিন, সরকার আজিজ, পলাশ চৌধুরী, তাসলিমা রহমান, আশরাফ রোকন, দিলীপ সেন, মোস্তাক বিবাগী, মোহাম্মদ ইয়াকুব, নাজমা মমতাজ, রীনা পণ্ডিত, হাদিউল ইসলাম, মাসুম মোকাররম, শামীম পারভেজ, মশিউর রহমান খান, শতাব্দী কাদের, রওশন ঝুনু, মিনহাজ উদ্দিন শপথ, সমুদ্র সেলিম, মামুন মাহবুব, জুয়েল কবীর, ওসমান গণি, মনো জসীম, ধনেশ পণ্ডিত, তন্দ্রা সরকার, রাজিয়া সুলতানা, মার্জিয়া সুলতানা নীলিমা, হিশাম আল মহান্নাভ, ফাতেমা নার্গিস বীণা, রোকসানা বিলকিস, অনিন্দ্য জসীম, স্বাধীন চৌধুরী, মামুন মোয়াজ্জেম, আলী ইউসুফ, শাবিহ মাহমুদ, শাহিন লতিফ, গনী আদম, সফেদ ফরাজী, বিল্লাল মেহদী, অতনু তিয়াস, চন্দন সাহা রায়, সিদ্ধার্থ টিপুসহ আরো অজস্রজন আমরা।

পার্ক বা সংগ্রহশালার বিকল্প-বীক্ষণ শুরু হতো এ তালিকার একটা গুরুঅংশকে নিয়ে। ওখানে আমরা থাকতাম পুরোমাত্রায় ব্যবহারিক, কবিতাকেই ভালো করে চিনবার-জানবার চেষ্টায় মত্ত। নানাজনের মুদ্রিত-অমুদ্রিত কবিতা থেকে পাঠ, তার ভালোমন্দের নিবিড় পর্যালোচনা, বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠের অভিব্যক্তি শেয়ার, ইত্যাদিতে মত্ত থাকতাম আমরা। কবিতা বিষয়ে নানারকম কর্মশালাও হতো ওখানে। পাঁচ-দশজন মিলে বারোয়ারি কবিতাও লিখেছি আমরা। প্রতিজন এক দু’লাইন করে লিখে একটি কবিতার পূর্ণ রূপ দেবার সেসব চেষ্টা যুগপৎ আনন্দদায়ক এবং শিক্ষণীয় ছিল। ক্রমশ কমতে কমতে জমায়েত দু’তিনজনে এসে ঠেকলে আমরা অন্য মঞ্জিলমুখী হতাম। তারও পরে হতাম একা। হায় একা হওয়া আমাদের, বিরল ভাবনা।

উল্লিখিতদের অনেকেই আজ আর লেখালেখির সঙ্গে নেই, অনেকেই ক্রমশ নিভে গেছেন অথবা নিভতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু যুগপূর্বকালে এদের সবার ভিতরেই কমবেশি সৃজন-আগুন ছিল। ওই অন্তর্গত অগ্নির সম্মিলিত উত্তাপ আমরা সকলেই অনুভব করতাম সমভাবে, সংবিধানবিহীন আমাদের সংঘপ্রয়াসে। 
এটা ঠিক যে, ২৫ বছরে অনেকখানি বদলে গেছে ওই জগৎ। আমাদের অনেক অগ্রজ ও সতীর্থ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, যাঁদের সংস্পর্শ আমাদের প্রাণিত করেছিল। বীক্ষণসংশ্লিষ্টদের থেকে ইতোমধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন আহমদ সাঈফ, প্রদীপ কুমার বিশ্বাস, আজাহার সরকার, মোহাম্মদ আবদুল হান্নান, আবদুল মতিন, তাসলিমা রহমান ও শামীম পারভেজ। ১৮০০তম অধিবেশনের এই উৎসবায়োজনে হৃদয়তন্ত্রীতে আজ তাঁদের কথাই বেদনবীণা হয়ে বাজছে বেশি করে।

সেপ্টেম্বর ২০১৮

Friday, July 3, 2020

সবকিছু অবলীলায় সামলে ওঠার জাদুকর

‘ক্রমশ নিভে আসছে আলো...’

এটা রীতিমতো বিস্ময়কর যে, গুম-হত্যা-দুর্ঘটনার আধিক্য ছাড়িয়ে ভেজাল খাদ্যের রমরমা সময়ে পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক নানা উদ্বিগ্নতা সয়ে মানসম্পন্ন চিকিৎসার অপ্রতুলতার মধ্যেও প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। বিষয়টা ভাবতে গেলেই মার্ক টুয়েনের বিখ্যাত এই উক্তিটি মনে পড়ে যে, পৃথিবীতে ‘তিন রকমের মিথ্যা আছে : মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান’। এতদপ্রেক্ষিতে, নিয়ম করে আয়ু বাড়াটা, আমার মনে হয়, রাজনৈতিক পরিসংখ্যানের কারসাজি হলেও হতে পারে। শামীমুল হক শামীম (শাহশা) বিষয়ক ধান ভানতে গিয়ে পরিসংখ্যানবিষয়ক শীবের গীতটি আমি এ সত্যটি সামনে আনার অভিপ্রায়ে গেয়ে উঠলাম যে, তিনি তাঁর জীবৎকালের গুরুভাগ ইতোমধ্যে যাপন করে ফেলেছেন, মানে ৫০ অতিক্রান্ত হয়ে গেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-নির্ধারিত পুরুষ মানুষের ২০১৬ সালের গড় আয়ু অনুযায়ী গড়পরতা তাঁর আর মাত্র ২০ বছর ৩ মাস বেঁচে থাকবার বাকি! দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি নারী নন; নারী হলে কথিত পরিসংখ্যানফল তাঁকে আরো ২ বছর ৬ মাস বেশি বাঁচবার প্রতিশ্রুতি দিত!

উল্লেখযোগ্য কিছু করে হইচই ফেলে দেবার জন্য ২০ বছর ৩ মাস সময়টা খুব কম কিছু না হলেও বাঁচবার জন্য সময়টা অল্পই। যা পঞ্চাশে হয় নি তা বাকি বিশে হয়ে যাবে এরকম আশা করায় কোনো দোষ নেই, কিন্তু সে আশা নিরাশায় পর্যবসিত হবার সম্ভাবনাও সমানে সমান। সুতরাং তাঁর মূল্যায়নের জন্য ভবিষ্যৎ বিশের দিকে না তাকিয়ে অতীত পঞ্চাশের দিকে তাকানোই সংগত বোধ হয়।
   
‘তোমাদের আলোকিত করে আমি থাকি অন্ধকারে’ 

শাহশা কবিতা লিখেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কবিতা লেখার পাশাপাশি তখন থেকেই প্রগতিমনস্ক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে তাঁর যুক্ততার কথা জানা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়-পরবর্তী জীবনে ঘটনাক্রমে কবিতা লিখবার তুলনায় তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতাই প্রধান হয়ে ওঠে। অনিকেত শামীম (অশা) নামে বাংলা ভাষাভাষীদের পত্রিকা ‘লোক’ সম্পাদনা এবং লোকসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে মগ্নতার ফলে ক্রমশ ম্লান হতে থাকে তাঁর সৃজনমূলক তৎপরতা। আর এর বিপরীতে ক্রমে বড়ো হতে থাকে কবি-লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে তাঁর সমবায়ী কায়কারবার।

এ যাবৎ লোক-এর ২০টিরও বেশি সংখ্যা প্রকাশ ছাড়াও ২০০৯ সাল থেকে পত্রিকাটির পক্ষ থেকে লোক সাহিত্য সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে, ২০১৬ পর্যন্ত যার প্রাপক হয়েছেন ৯ জন বাংলাদেশি কবি-সাহিত্যিক। দর্শনীর বিনিময়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন দশকের কবিদের অংশগ্রহণে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ‘ধ্রুপদী কবিতার উত্তরাধিকার’, ‘বৃষ্টিদিনে কাব্যকথা’, ‘বৃষ্টি ও বিরহের কবিতা’, ‘শীতের কবিতা’ এবং বিভিন্ন দশকের কবিদের নিয়ে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ‘বিরুদ্ধ স্রোতে আমি একা’ (প্রথম দশক), ‘রোদ মেলেছে উড়াল ডানা’ (দ্বিতীয় দশক) প্রভৃতির সফল আয়োজন সম্পন্ন করেছেন তিনি। এ ছাড়াও, কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে সেমিনার, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, বক্তৃতা অনুষ্ঠান ও নানা বৈঠকীর আয়োজনও লোক-এর পক্ষে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। জাতীয় লিটল ম্যাগাজিন মেলার পাঁচ-পাঁচটি আয়োজনের অন্যতম আয়োজক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুকে ঘিরে একাধিক বুলেটিনের প্রকাশক এবং মানববন্ধন-মিছিল-সমাবেশের আয়োজক হিসেবেও তাঁর নাম উচ্চার্য।

এসব কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ ও বাইরের বাংলা কবিতাপাঠকের মধ্যে তাঁর যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, সেখানে তাঁর শাহশা নামক কবি পরিচয়ের খ্যাতি ছাপিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে অশা নামক সংগঠক পরিচয়।

‘বৃত্ত আঁকতে আঁকতে তোমাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে মহাবৃত্ত’

এটা বেদনাকর যে, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক এতসব কায়কায়বার সত্ত্বেও সাহিত্যমহলে তাঁকে ঘিরে বিশেষায়িত কোনো মুগ্ধতার খবর প্রকাশ্য নয়। তবে কি দীর্ঘদিন ধরে শ্রম-ঘাম-অর্থ-প্রেম বিনিয়োগ করে শাহশা উরফে অশা নানা মাপ ও আয়তনের যেসব বৃত্ত এঁকেছেন, সেগুলো মিলে কোথাও কোনো মহাবৃত্ত তৈরি হয় নি? যতদূর খোঁজ রাখা গেছে, সাহিত্যাঙ্গনে তিনি তাঁর ব্যাপকসংখ্যক নিন্দুক তৈরি হওয়াকে প্রভাবিত ও প্রণোদিত করতে সক্ষম হয়েছেন। যাঁরা তাঁর বন্ধু হয়ে উঠতে পারতেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁরা তা হয়ে ওঠেন নি। বরং হয়ে উঠেছেন শত্রুপ্রতিম, নিদেনপক্ষে নিন্দুক।

পৃথিবীতে আজকাল মত ও পথের এত বেশি বৈচিত্র্য বিদ্যমান যে, কাজ করেন এমন মানুষমাত্রকেই বিরুদ্ধ মত ও পথের অনুসারীদের মোকাবেলা করে এগোতে হয়। এর থেকে দূরে থাকতে পারেন কেবল নিষ্কর্মা ও বোবারা। লক্ষণীয় যে, তাঁর ক্ষেত্রে এই বিরুদ্ধ বলয়ের শক্তি ও সজ্জা স্বাভাবিকের চাইতে খানিক বেশিই বোধহয়। এরকম কেন হলো তা নিয়ে অন্য পরিসরে বিশ্লেষণ চলতে পারে। তবে এখানে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখা যায়। আমার দৃষ্টিতে এর তিনটেমাত্র কারণ :

১. সামাজিক, সাহিত্যিক ও পানশালাসম্পর্কিত পরিচিতির কারণে তাঁর সাথে প্রচুরসংখ্যক মানুষের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। সদাপ্রসন্ন ও আমুদে শাহশা উরফে অশা কিছুমাত্রায় লোকজনকে তাঁর দিকে আকর্ষণও করতে পারেন। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর কাছে আকর্ষিতজনের নানারকম প্রত্যাশাও হয়ত তৈরি হয়। কিন্তু সংগত কারণেই সবার প্রত্যাশা পূরণ করা একজন ব্যক্তি বা একটি সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। পারেন নি তা শাহশা উরফে অশা কিংবা ‘লোক’ও। সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পছন্দাপছন্দ থাকে, থাকতে হয়। তা নইলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তার বিশেষত্ব হারায়। আর বিশেষত্ব ধরে রাখতে চাইলে উপজাত হিসেবে অমুগ্ধজনের আবির্ভাব ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে এটা ঘটতে থাকলে তাদের পরিসর ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে অমুগ্ধ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়, যদি অমুগ্ধতাকে কনভার্ট করে তাদের মুগ্ধ করবার কোনো প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে ক্রিয়াশীল না থাকে। এটা পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত উপায়েই ঘটে।

২. সামাজিক-রাজনৈতিক-সাহিত্যিক সকল ধরনের কাজেই ভিন্নবলয় থেকে যেহেতু প্রতিনিয়ত ভিন্নমত তৈরি হতে থাকে, সেহেতু উপেক্ষা না করে যথাযথ উপায়ে এসব মতের মোকাবেলা করা জরুরি হয়। কাজভেদে মোকাবেলার ধরনও ভিন্ন হয়। তিনি যে ধরনের কাজে যুক্ত, সে কর্মসংশ্লিষ্ট ভিন্নবলয় থেকে উত্থাপিত ভিন্নমতকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা করা শ্রেয়। কিন্তু তিনি সেটা না করে নীরবতাকেই কৌশল হিসেবে শ্রেয়জ্ঞান করে থাকেন। লক্ষণীয় যে, তাঁর হয়ে এ কাজটি অন্যরাও যে করতে পারতেন না তা নয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রায় কেউই নিষ্ঠার সাথে তা করতে এগিয়ে আসেন নি। হয়ত তাঁরা এই সংকটকে নিজের সংকট ভাবতে পারেন না। অন্যেরা তাঁর সংকটকে নিজের সংকট ভাববার মতো পরিসর পান কি না বা তিনি তাদের সে পরিসর দেন কি না সেটাও অবশ্য ভেবে দেখবার বিষয়।   

নির্বিরোধ থাকা যে কৌশল হিসেবে অকার্যকর তা নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। তবে এটি কাজ করে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ফলে সর্বদাই তাঁর প্রতি প্রীত নয় এমন মানুষের স্রোতকে পরিসরে বড়ো মনে হয়। নিয়মানুযায়ী দীর্ঘ সময় পরে এই বিরুদ্ধ বলয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বদলে যেতে পারে। সেরকম ভাবা আচরণবিজ্ঞানসম্মতও।  

৩. শাহশা উরফে অশার ব্যক্তিগত জীবনের বেশ কিছু দেয়াল কিছুটা সুবোধ্য ও অনেকটা অবোধ্য কারণে মাঝেমধ্যে ভেঙে পড়বার আওয়াজ শোনা যায়। তাতে গোপনীয়তার গোপনতা ভীষণভাবে লঙ্ঘিত হয়। কথিত নিন্দুক ও শত্রুপ্রতিমদের কাছে যখন এই লিক হওয়া গোপনতা পৌঁছে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা আরো সশস্ত্র হবার অবকাশ পান। এই সশস্ত্র গোষ্ঠী তখন অবকাশ পান তাঁর বিরুদ্ধে আরো আরো নতুন মানুষকে বিষিয়ে তুলতে।

‘সব ভালোবাসাই ভালোবাসা নয়’ 

দেখা যায়, সামাজিক-সাহিত্যিক ও অন্যবিধ কারণে যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে আসেন তাঁদের একাংশ তো বটেই, যাঁরা আসেন না, উল্লিখিত ত্রিবিধ কারণে তাঁদের একটা অংশও পরবর্তী সময়ে তাঁর নিন্দুকগোষ্ঠীতে নাম লেখান। তদুপরি তাঁর প্রশ্রয়পুষ্টদের মধ্যকার একাংশকে মাঝেমধ্যে নিদারুণভাবে রূপ বদলে ফেলতে দেখা যায়। এ অংশের ভালোবাসার খাঁটিত্ব নিয়ে ম্যালা সন্দেহের অবকাশ আছে। এটা মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠে হয়ত এরকম বলা যায় যে, নিকটে এলে তাঁর প্রতি আকর্ষণটা হয়ত আর ধরে রাখতে পারেন না কেউ কেউ। ফলে সকরুণ নিরুৎসাহের আশপাশে আর কোনো ভালোবাসার স্পেস খুঁজে পান না তাঁরা।

খুব কম মানুষই পূর্বাহ্ণে এটা বুঝতে পারেন যে, পরে কে তার লাঙল-জোয়াল ব্যবহার করে তারই ভিটায় উফশী ঘৃণার আবাদ করবে। বুঝলে কিছুটা অন্তত আত্মরক্ষা করা যায়। অশাও ব্যাপারটা খুব একটা বোঝেন বলে কখনো মনে হয় নি। বুঝলে হয়ত তাঁর ভিটার সবুজ আরো বড়ো পরিসর নিয়ে রং ছড়াতে পারত।

‘বেদনার ক্ষত বুকে নিয়ে কতদূর যাওয়া যায়, বলো?’

এহেন ক্ষতাক্ত দেহমন নিয়েই অশা মাইনপোঁতা পথঘাট মাড়িয়ে জোরকদমে এগিয়ে চলেছেন দেখা যায়। মাঝে মাঝে তাঁকে হতাশ মনে হলেও তা প্রায়ই হয় খুব সাময়িক। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর নেশা কিছু মানুষকে সদাই তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনিও তেমনি একজন। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বাধা, অসহযোগিতা ও নিন্দামন্দকে থোড়াই কেয়ার করে আপাতদৃষ্টে অসাধ্য মনে হওয়া একেকটা উদ্যোগ হাতে নিয়ে তিনি ঠিকই তা সাধন করে ফেলেন। যেন কোনো এক প্রলুব্ধকর দূরাগত ধ্বনি তাঁকে সামনে টেনে নিয়ে যায়।

প্রশ্ন জাগতে পারে, এত সক্ষমতা কোত্থেকে কীভাবে পান অশা? মনে হয়, কোথাও তাঁর একটা বিপুল শক্তির উৎস আছে, অত্যন্ত গোপন, যা তাঁকে ছররা বন্দুক নিয়ে মেশিনগানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবার সাহস জোগায়। এই রহস্য কাছের কেউ কেউ জানলেও আমরা জানি না।

এরকম একটা কথা সমাজে প্রচলিত আছে যে, যে কাজ যত ভালো, সে কাজের তত বাধা; যে যত শক্তিমান, তার তত শত্রু ও নিন্দুক। এই বাক্যের জানালা দিয়ে তাকালে একভাবে বিষয়টার একটা ব্যাখ্যা মেলে বটে। তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষগুলোর দ্বারা তৈরি হওয়া প্রতিবন্ধকতাসমূহ বারেবারে নস্যাৎ হয়ে যাওয়া দেখে তখন এটাকেই সত্য বলে মনে হয় যে, শাহশা উরফে অশার কৃত কাজবাজ মোটের ওপর ভালো এবং তাঁর ধারণ করা সমুদয় শক্তি কেবল অপরাজেয় হতেই জানে।

তখন ‘অভিনন্দন’ বলে বা না বলে বিস্ময়মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বিরুদ্ধবাদীদের কার্যত আর কিছু বলবার-করবার থাকে না।

‘সবখানেই বাসা বেঁধেছে ফণা তোলা বিষাক্ত সাপ’ 

এসব থাক। নিজের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা ও নিন্দুকপরিবৃত অবস্থাকে ভুলে থাকতে অন্যের সম্পর্কে এসব বলাবলি তেমন একটা অর্থ বহন করে না। এমনকি নিজের জীবন তাতে নিষ্কণ্টক ও পুষ্পিতও হয়ে ওঠে না। তাঁর চেয়ে শাহশা উরফে অশার ব্যাপারে এই সত্যটা উচ্চারণ করে রাখা কাজের হতে পারে যে, বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও তার অস্তিত্বের বিপক্ষে যে শক্তি তৎপর, তাদের বিরুদ্ধে তিনি সবিশেষ সক্রিয়। সেটা কবিতায় যেমন তেমনি পথেও। এমনকি ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়িয়ে বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত গোষ্ঠীর ব্যাপারেও তাঁর কণ্ঠ বিশেষভাবে সোচ্চার। তাঁর এ সক্রিয়তাকে, বর্তমান অবিশ্বস্ত সময়ে, প্রায়ই বড়ো প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

‘অন্ধপাতায় জ্যোৎস্নার বিকিরণ’

শাহশা উরফে অশার যাপন ও ক্রিয়াকলাপে মন পাতলে উপলব্ধি করা যায় যে, বহুত্ববাদী সংস্কৃতিঋদ্ধ এক প্রাকৃত পাঠশালা জাগে তাঁর প্রত্যাশার চূড়ায়, যা অধরাপ্রায়, কাছে থেকেও যা সুদূর বিদেশ। স্বপ্নরূপ ওই অধরাই তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে। ওই ডাকে তিনি হয়ত আরো ম্যালাদিন যথারীতি সাড়া দিয়ে যেতে থাকবেন সেরকম মনে হয়।

কবিতা অনেক রকম। জীবন অনেক রকম। শাহশার কবিতা ও জীবনেরও একটা নিজস্ব রকম আছে। সেই নির্দিষ্ট রকমটি যেন একটি অন্ধপাতায় জ্যোৎস্নার বিকিরণ। তার স্নিগ্ধ ও মৃদু আলো সবাইকে না ছোঁক কাউকে কাউকে নিশ্চিত ছুঁয়েছে, ছোঁয় ও ছোঁবে। এই অবস্থার প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ এই পরিসরে তাঁর সফল একটি দীর্ঘজীবন প্রত্যাশা করা যাক।

দ্রষ্টব্য : এই লেখার উপশিরোনামগুলো শামীমুল হক শামীম (শাহশা)-এর কবিতা থেকে নেওয়া।

জানুয়ারি ২০১৮

মোস্তাক আহমাদ দীনের ‘বিষ’বিদ্যার পরিসর

এত বিষ দেহকাণ্ডে, দেহে
আজ আমি সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
সকলেই একথা বোঝে আমি কভু ডুবি নাই জহরের জলে
দেহকাণ্ডে তবু এত বিষ, ভাবি তাই
প্রাণের মধ্যে কোন সর্প ঢুকে গেছে ঘুমে? 
এ সন্দেহ-মুক্ত হতে বংশকাহিনি যারা পাঠ করে গেল
তারা দেখে, পিতা বা প্রপিতামহ আলস্য করেনি কেউ
                                               মনসাপূজায়
তবে আমি অভিশপ্ত কাহার সন্তান?
দেহকাণ্ডে যত বিষ, তার মর্মে নীল হয়ে যাবে বলে
সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
অথচ দূরবর্তী বন্ধুও বোঝে
গোপন ইচ্ছের জোরে সংলগ্নজনের মনে
                             কত বেশি মগ্ন হতে চাই
(বিষ, মোস্তাক আহমাদ দীন)
অর্থের প্রতি মনোযোগ না-দিয়ে মোস্তাক আহমাদ দীন (মোআদী)-র প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’ভুক্ত ‘বিষ’ কবিতাটি বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার শব্দ করে ও না-করে পড়ে দেখেছি। প্রতিবারই ওর প্রসারিত আলো-ছায়ায় মগ্ন হওয়া গেছে। বিহারের নিমিত্তে পর্যাপ্ত পরিসর আছে বলে এবারও তা হওয়া গেল; অর্থাৎ, ভালো লাগল। প্রকৃতপক্ষে কী এমন ভালো লাগল এর? সুর? অবশ্যই সুর, দোলা। আবার অর্থের চোখে চোখ রেখে যখন পড়া গেল কবিতাটি, কমসেকম তিনরকম ঢেউ এসে লাগল মনে, তিন স্তরের। অন্য কেউ হয়ত অন্যভাবে তাকিয়ে আরো অন্য কোনো রঙের সামনে গিয়ে পড়বেন কবিতাটির। এই ঐশ্বর্যের কারণেই কবিতাটিকে বিশেষভাবে সম্পন্ন বোধ হলো। মনে  হলো, কবিতার মতো দেখতে এ লেখাটি আসলে একটি কবিতাই।

অর্থে ডুবে এর তিনরকম যে ঢেউয়ের মুখে আমি পড়েছি, সেটা দেখাতে গিয়ে অত্যাশ্চর্য কোনো স্থাপনার ইট খুলে খুলে তার উপাদানের মান যাচাইয়ের মতো বিধ্বংসী কিছু করতে আমি আগ্রহী নই। কিন্তু লেখাটি যে প্রসারিত অর্থ ধারণ করেছে, তার খোঁজ পেতে হলে একভাবে তো এর অন্দরে তাকানো লাগেই। আলতোভাবে সে চেষ্টাটিই আমি এখানে একবার করে দেখতে চাইছি।

প্রথম ঢেউ

শুরুতেই মোআদীর ‘বিষ’ কবিতাটির যে ঢেউ আঁচ করা যায়, তাতে শরীরের শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়া কথিত বিষকে ক্রোধরূপ একটা তিতা বস্তু হিসেবে অনুমান করতে ইচ্ছে করে, যেখানে সংলগ্নজন হলো নিজেরই অন্য আরেক সত্তা, যে কিনা বিশুদ্ধ, যে কিনা নির্বিরোধী একটা যাপনের পক্ষে অধোবদন। তাকে দূরে যেতে বলা সেক্ষেত্রে সাময়িক এক অবিশুদ্ধ সত্তার সংস্পর্শ থেকে বিশুদ্ধ সত্তাকে রক্ষাপ্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।

বৈষয়িকতার পঙ্কে না-নেমেও এই ক্রোধের অভিষেক হবার নেপথ্যে কী এমন ব্যাপার কাজ করছে? সে কি অজ্ঞাতে ভেতরপ্রাসাদে জন্মানো জলশূন্যতায় ভোগা কোনো মোহের উদ্ভিদ? হবেও-বা।

বংশের পরম্পরা ধরে খোঁজ নিলে দেখা যায়, বিষয়বাসনা থেকে দূরে থাকবার সাধনায় মোআদীর পূর্বমানবের কারো সময়েই কোথাও কোনো অবহেলা ছিল না। সেই ঐতিহ্যচ্যুত হয়ে বিশুদ্ধ সত্তার সংক্রমিত হয়ে পড়বার সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে এক সংগত শঙ্কা থেকে বিচ্ছেদ ভাবকে নিজের করে নিয়েছে মোআদীর ক্রোধকলূষে অবিশুদ্ধ হয়ে পড়া সত্তা।

কিন্তু কে না জানে, সবটুকু ভালোবাসা তার সজ্ঞানে দূরে ঠেলে দেওয়া ওই বিশুদ্ধ সত্তার প্রতিই।

দ্বিতীয় ঢেউ

প্রথম ঢেউটি ছলকাতে থাকতেই উছলে ওঠে অন্য আরেক ঢেউ। ওদিকে তাকাতেই প্রায় শিহরিত হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় কৈশোরোত্তরকালে যৌবনের ঠিক দরজায় দাঁড়ানো বয়সের গোপন বিড়ম্বনার কাছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এত এত বছর পেছনে পৌঁছে দেবার সক্ষমতার জন্য কবিতাটির কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে বসে থাকতে হয়।

মনে হতে থাকে যে, যুক্তিপরম্পরায় আত্মীয়সূত্রে বেড়ে ওঠা শব্দক্রমধারা ‘সর্প’, ‘বিষ (জহর)’, ‘নীল’, ‘মনসাপূজা’ই কবিতাটির চাবিশব্দগুচ্ছ। তবে অবশ্যই ‘দেহকাণ্ড’, ‘সংলগ্নজন’, ‘গোপন ইচ্ছে’— এই তিনটি শব্দবন্ধের শাসনকে মেনে নিয়েই এগোতে হয় কবিতাটির মন জয়ের দিকে।

মনে হয়, নবযৌবনপ্রাপ্ত মোআদীর সদ্যউৎপাদিত স্পার্ম বা বীর্যই এখানে বিষ, সর্প যেখানে লিবিডো বা যৌনতাড়না। এই সূত্র বিবেচনায় নিলে মনসাপূজা অবশ্যই বিয়ে ও সংসার; আর নীল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তখন বীর্যপাতন শেষে গর্ভসঞ্চারজনিত অবস্থার উদ্বেগ।

দূরবর্তীজন হয়েও বুঝতে পারা যায় যে, এখানে সংলগ্নজন মানে সম্ভাব্য যৌনসঙ্গী বা প্রেমিকা। উপচে ওঠা বীর্যের তাড়নাবশে জৈবদেহে স্খলনের যে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত, বয়সজনিত অপরিপক্কতা ও নৈতিকতার চাপেই মূলত তার সংস্পর্শ এড়ানোর এই প্রয়াস।

বলা বাহুল্য নয় যে, এ যাত্রায় সামাজিক অর্থে বৈধ পথ বিয়ে করে সংসারান্দরে প্রবেশ করা। পুরুষপরম্পরায় মোআদীর পরিবারে এ প্রথাই চর্চিত। কিন্তু নবযৌবন সে ধৈর্যধ্যানের পথ থেকে চ্যুত হয়ে বিবাহপূর্ব আকস্মিকতায় বীর্যপাতনের সম্ভাবনার মুখে পড়ে গর্ভসঞ্চারের ভয়ে আঁতকে ওঠে। অথচ কামেচ্ছাসম্মত বয়সে জৈবদেহ ভেতরে ভেতরে যৌনসঙ্গী তথা প্রেমিকার প্রতিই সতত নিমগ্ন।

তৃতীয় ঢেউ

সামাজিক সংস্কারবশত লজ্জা-সংকোচ থেকে দ্বিতীয় ঢেউটি থেকেও যদি চোখ সরিয়ে ফেলানো যায়, তো সাক্ষাৎ মেলে অন্য আরেক ঢেউয়ের। এবারে মনে হয়, এখানে বিষ আসলে ভাব। যেহেতু প্রাণের মধ্যে সর্প তথা বিষবিষয়-বাসনা বা কর্মপ্রেরণা ঢুকে গেছে, কাজেই সৃজনপ্রয়োজনে একাকিত্বের প্রত্যাশা এখানে অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে। যে কারণে সংলগ্নে থাকা কর্মসঙ্গীকে দূরে ঠেলে দিতে চাওয়া।

পিতামহ ও পিতার পরম্পরা বেয়েই এ জৈবদেহ, তাঁরাও তাঁদের মতো নিরলস মনসাকৃত্যে তথা কাজবাজে মগ্ন থেকেছেন। কিন্তু তাঁদের পথ কবিতার দিকে না-গেলেও মোআদী হয়ে উঠেছে কবিতার অভিশাপে দগ্ধ, যার প্রধান কাজ ভাব ভেজে কবিতাফুল ফোটানো।

জাগ্রত কর্মেচ্ছা কর্মসঙ্গীলগ্ন হয়েই থাকতে চায়। কিন্তু তাকেও কাব্যদোষে অনুপ্রাণিত করে নীল করে দেবার বাসনা মোআদীর নেই। সে কারণেই তাকে দূরে ঠেলে দেবার এই বিরহবিলাস, মনে হয়।

বাংলা ভাবের জগতে কর্ম ও কাম একদেহে লীন। নেপথ্যে কাম তথা মদন ক্রিয়াশীল থাকে বলেই মানুষের পক্ষে কাজবাজে মগ্ন থাকা সম্ভব হয়। কাম তথা মদন ভস্ম হয়ে গেলে প্রেমও ভস্ম হয়ে যায়। কাজেই সকাম প্রেমই সেই নিয়ন্তা যে সাফল্যশীর্ষে আরোহণে কলকাঠি নাড়ে। এই প্রেক্ষাপটে মোআদীর ‘বিষ’ কবিতার বিভিন্ন ঢেউ পরস্পর লগ্ন হয়ে যেতে চায়। কোথাও না কোথাও একটা ঢেউ অংশত আরেকটা ঢেউয়ের ভিতরে প্রবিষ্ট হয়ে থাকে মনে হয়। এই ত্রিস্তর ভাববস্তুকে একত্রে মিলিয়ে দেখলে কবিতাটি একইসঙ্গে অনেক রং পেয়ে বর্ণিল হয়ে ওঠে। ওকে তখন চোর থেকে সাধু পর্যন্ত সবার মনের দরজায়ই কড়া নাড়বার উপযোগী কবিতা বলে আবিষ্কার করা যায়।

প্রতীকী ভাষারীতিতে প্রতিটি শব্দই একেকটি বস্তু বা বিষয়ের প্রতীক। কিন্তু প্রধানত সংস্কৃতকন্যারূপী বাংলা ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক চরিত্রের স্মৃতি এখনো আমাদের বেমালুম ভুলে যাবার দুর্মতি হয় নি বলে একটি কোনো শব্দের বিশিষ্ট প্রয়োগে আমরা অনেকার্থকতার সম্ভাবনা উঁকিঝুঁকি দেওয়া দেখি। অনেক সময় তা ঐতিহ্যনিষ্ঠ হয় না বটে; তবে তথ্যনিষ্ঠ বলে অনুমানবশেই আমরা সেই সাবেকী উষ্ণতা অনুভব করে উঠি, উঠতে পারি। এখানে যেমন আমরা এক ‘বিষ’কেই ‘ক্রোধ’, ‘বীর্য’ ও ‘ভাব’ হিসেবে দেখতে পেলাম। ‘সর্প’কে দেখতে পেলাম একইসঙ্গে ‘মোহভঙ্গ’, ‘যৌনতাড়না’ ও ‘কর্মপ্রেরণা’রূপে। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ‘বিষ’ বা ‘সর্প’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক বিন্যাসে উল্লিখিত অর্থসমূহের ভুক্তি দেখায় নি। তবু, আমরা যে দেখতে পেলাম, সেটা শব্দগুলোর প্রয়োগবিশিষ্টতার কারণেই মূলত। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, আমরা মোআদীর ‘বিষ’বিদ্যার আবহে ‘বিষ’ ও ‘সর্প’ ছাড়াও অন্যান্য চাবিশব্দের অর্থপ্রসারণ ঘটতে দেখছি।

কবিতার কবিতাত্ব ঠিক রেখেও যখন কোনো কবি ভাষা-শব্দের বিশিষ্ট প্রয়োগে এভাবে অর্থপ্রসারণ ঘটাতে সক্ষম হন, তখন তার সমুদয় ভাষাসংশ্লিষ্ট কীর্তিকলাপকে একাধিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে হয়। মোআদীর কাজকর্মকেও আমাদের সেভাবে দেখবার দরকার আছে বলে মনে হয়।

নভেম্বর ২০১৭

আসমার ‘প্ররোচনা’র গতিপ্রকৃতি

সে আমাকে প্ররোচিত করে।
মুখাবয়বে মানুষের কী যে স্বাতন্ত্র্য,
তেমন দুর্বলতা কিছুতে দেখা যায় না আর
কেবল ওষ্ঠে চুমু লাল হয়, লালা আসে
প্ররোচনাময়—
ফলে ওষ্ঠের ছায়া হয়ে থাকি,
আর তুমি হাঁটতে থাক, প্ররোচিত কর—
যাবতীয় লোভ, কাম ও স্বপ্নতা নিয়ে।
(প্ররোচনা, আহমেদ স্বপন মাহমুদ)
‘প্ররোচনা’ বা অ্যাবেটমেন্ট সাম্প্রতিককালে ঘোর নেতিবাচকতায় মোড়া একটা শব্দ। আজ আমরা একে ঘোরতর সন্দেহের কাতারে রেখে দেখলেও বরাবর শব্দটি এমন ছিল না। স্ত্রীবাচক বিশেষণ প্ররোচনার কিছু সৎকর্মও আছে। খোঁজ নিলে দেখা যায়, বাংলা ভাববৃত্তে এ যাবৎ শব্দটি প্রীতিকর বোধ জাগিয়েছে, রুচিসম্পাদন করেছে, প্রীতিজনন ঘটিয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতায় ধর্মোন্মাদনার নেপথ্যে শব্দটা বেশি খাপ খেলেও একসময় ধার্মিকতার নেপথ্যেও একে স্বীকার করত মানুষ! ইত্যাকার (ইতি)প্ররোচনা জগতে নিহিত ছিল বলেই মহামহোপাধ্যায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থনাকালে বিদ্যমান পুস্তকাদির কোনাকাঞ্চিতেও এই শব্দের কোনো নেতিবাচক প্রয়োগসূত্র খুঁজে পান নি। তিনি যা পেয়েছেন তার সবই ইতিবাচক। অথচ বিবর্তনের রেখা ধরে এখন শব্দটা নেতির গন্ধে কাবুপ্রায়।

সভ্য আইন প্ররোচনাকে অপরাধ সাব্যস্ত করে তার জন্য শাস্তিও বরাদ্দ করেছে। অবশ্য বলা বাহুল্য নয় যে, এ ক্ষেত্রে শাস্তি বরাদ্দ করে দণ্ডবিধির প্রবক্তাগণ ঠিক কাজটিই করেছেন। কারণ জগদ্বারে সম্প্রতি আমরা এমন সব প্ররোচনার সাক্ষাৎ পাচ্ছি, যা অন্যের ক্ষতিপ্রত্যাশী ও প্রাণবিনাশী, যা প্রভূত বিশৃঙ্খলার মদদ সরবরাহকারী।

আহমেদ স্বপন মাহমুদ (আসমা)-র ‘প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনাম’ গ্রন্থভুক্ত ‘প্ররোচনা’ কবিতাটি পড়তে গিয়ে শব্দটির এই প্রেক্ষাপট মনে পড়ল। তাই জন্য তাঁর এই কবিতাটি ঐতিহ্যিক ‘ইতি’ নাকি সাম্প্রতিক ‘নেতি’র কারবারে মগ্ন সেটা একটু খতিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। এই ক্ষুদ্র তত্ত্ব-তালাশি তারই স্মারক।

নিক্তি হিসেবে এখানে আমরা ভারতীয় দণ্ডবিধির সাহায্য নিতে পারি। এর পঞ্চম অধ্যায়ের ১০৭ থেকে ১২০ ধারা পর্যন্ত প্ররোচনা ব্যাপারটি ব্যাখ্যাত হয়েছে। দণ্ডবিধি মতে, তিনভাবে (নেতি)প্ররোচনা দেওয়া যেতে পারে— ১. কোনো কাজে উসকানি দিয়ে, ২. অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ও ৩. উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কিছু করায় সাহায্য করে।

দণ্ডবিধিতে প্ররোচনাদাতাকে সমাচ্চলিত অর্থেই প্ররোচক বা অ্যাবেটর বলা হয়েছে এবং তার জন্য শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ কোনো অপরাধ সংঘটনের নিমিত্তে কাউকে প্ররোচনা দিলে এবং সেই প্ররোচনার ফলে যদি কাজটি ঘটে তবে ওই কাজে প্ররোচনার জন্যে নির্দিষ্ট দণ্ড না-থাকলে মূল অপরাধটির জন্যে যে শাস্তি বা দণ্ডের বিধান আছে, প্ররোচকের ওপর তা-ই প্রযোজ্য হবে। বিরাট ব্যাপার! নয়?

কিন্তু প্ররোচনা দিয়ে কেউ যখন কাউকে পাঠক বানিয়ে তোলে, বিজ্ঞানচর্চার দিকে ঠেলে দেয়, কাঁধে কবিতার ভূত চাপায়— তখন কি তার জন্য আমরা শাস্তি প্রস্তাব করব? করব না। তবে এই না-করাকে জাস্টিফাই করতে আমাদের বিশেষ ভাষাকায়দা বা ভাষাতরিকার আশ্রয় নিতে হয়। তখন প্ররোচনাকে ‘প্ররোচনা’ না-বলে আমরা ‘প্রণোদনা’ বা মোটিভেশন বলি। পাশে দাঁড়িয়ে সাফাই গাই যে, প্রেরণাকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না। শব্দের এই হেন ব্যাপারস্যাপার শব্দার্থ-রাজনীতির নানা ঘোরপ্যাঁচের ইঙ্গিতবহ। একইরকম পোশাকের এই শব্দ দুটোর মুখাকৃতি প্রায় অবিকল; ওজন এবং মাত্রায়ও উভয়ে সমান। কিন্তু তবু, শব্দ দুটো সামাজিক মর্যাদায় ভীষণভাবে আলাদা। বিভিন্ন ভাষায় এরকম জোড়া জোড়া অবিকল আরো শব্দের খোঁজ নিশ্চয়ই আমাদের প্রায় সবারই জানা আছে।

এখানে প্ররোচনা ও প্রণোদনাকর্মের দুয়েকটা উদাহরণ দেবার চেষ্টা করা যায় : ধরা যাক ক কোনো এক কিশোরীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করল এবং তার সঙ্গলাভের অনুকূলে নানা প্রতিশ্রুতি দিলো। একসময় সঙ্গলাভ নিশ্চিতও হলো। কিছুদিন পর বিশ্বাসঘাতকতা করে মনোকষ্ট দেওয়ায় কিশোরী নিজগৃহে আত্মহত্যা করল। এ ধরনের আত্মহত্যা বাংলাদেশে প্ররোচিত আত্মহত্যা হিসেবে স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে ক প্ররোচনার অপরাধে অপরাধী। কিন্তু ক যদি ওই কিশোরীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তাকে কবিতাচর্চায় আগ্রহী করে তুলত এবং ঘটনাক্রমে সে ভালো একজন কবি হয়ে উঠত, তাহলে ক তাকে প্রণোদিত করায় প্রশংসিত হতে পারত। আবার কিশোরীকে দাবাখেলায় আগ্রহী করে তোলায় সে যদি একসময় দাবায় জাতীয় পুরস্কার লাভ করত, তাহলে প্রণোদনার পুরস্কারটা ক-এরই হতো। কিন্তু ধর্মের অপব্যাখ্যায় প্রলুব্ধ বা ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত করে ওকে আত্মঘাতী হবার দিকে ঠেলে দিলে প্ররোচনার অভিযোগ থেকে ক-কে কেউই রেহাই দিত না।
   
‘প্ররোচনা’ কবিতাটি যদি আমাকে নানা দুর্ভাবনার দিকে ঠেলে দিয়ে অসুস্থ করে তুলত, তাহলে এর লেখক আসমাকে অভিযুক্ত করে বিচার দাবি করতে পারতাম আমরা। কিন্তু তা না-করে এটি আমাকে নামশব্দের মুখের দিকে তাকিয়ে একটি নিবন্ধ রচনার দিকে ঠেলে দিয়ে প্রশংসা অর্জন করেছে। এটি এই কবিতাটির একটি গুণ। মানে বৈষয়িক অর্থেও ‘প্ররোচনা’ একটি ভালো কবিতা। কারণ এর ইতিবাচক প্রভাবসঞ্চারী ভূমিকা রয়েছে।

দেখা যায়, এ কবিতায় প্ররোচক দুজন। একজন ‘সে’, অন্যজন ‘তুমি’। ‘সে’র মুখ অন্যদের থেকে এতই আলাদা যে, আসমা তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। মানুষের মুখাকৃতির বৈচিত্র্য বিষয়ে দার্শনিকতায় মেতে ওঠেন। এই দুর্বলতা কামের দিকে কাত হয়ে আছড়ে পড়ে। ওই আছড়ানো দুর্বলতা একজন ওষ্ঠবিজ্ঞানী হয়ে উঠতে চায়। তার ল্যাবরেটরিতে চালাতে চায় চুমুর পরীক্ষা। কিন্তু জগৎ কারো সব ইচ্ছেকে ইতিবাচক পরিণতিতে পৌঁছুতে দেয় না। ফলে লোহা যেমন গনগনে আগুনের আঁচে ক্রমে লাল হয়ে ওঠে, তেমনি লিবিডোর দাহে কল্পিত চুমুটিও ক্রমে রক্তিম রং ছড়িয়ে ঝুলে থাকে ওষ্ঠের কার্নিশে। পাশাপাশি এনজাইম বা উৎসচেকরূপী লালা নিঃসৃত হয় কল্পিত চুমুটিতে নিহিত আনন্দবোধের আঙুল ছুঁয়ে।

না, এ যাত্রায় আসমার কোনো সাফল্য আসে না, ছায়া হয়ে থাকা ছাড়া। অথচ তাঁর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার সামনে দিয়ে ‘তুমি’ হেঁটে যায়, যে একইসঙ্গে ‘লোভ’, ‘কাম’ ও ‘স্বপ্ন’-এর প্রতীক মানে মোহের ট্রিলজি হয়ে ওঠে। ‘তুমি’ও প্ররোচিত করে ‘সে’র মতো ওষ্ঠচুম্বনে, তা সে লিপস বা লেবিয়া যেখানেই হোক।
 
দেখা যাচ্ছে, আসমার ‘প্ররোচনা’ কবিতার ‘সে’ এবং ‘তুমি’র কেউই প্ররোচনার অপরাধে অপরাধী নয়। কবিতাভাষ্যে উভয়েই প্ররোচনা করলেও তা পরিণতি লাভ করেছে একটি কবিতা রচনার প্রেরণাসঞ্চারী হিসেবে, যা বস্তুতপক্ষে উচ্চ মর্যাদার প্রণোদনা। অর্থাৎ, দুয়ের কেউই অ্যাবেটর নয়, বরং মোটিভেটর বা অ্যানকারেজার।

এই লেখাটি কাজেই এভাবে উপসংহৃত হতে পারে যে, প্ররোচকরূপী দুজন প্রণোদকসম্বলিত আসমার ‘প্ররোচনা’ কবিতাটি ইতিবাচক কাজে উসকানি দেয়, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করে না এবং নেতিবাচক কোনো কিছু করায় সাহায্য করে না। এর মানে হলো ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী এ কবিতাটি লেখার জন্য আসমার জন্য কোনো শাস্তি বরাদ্দ করা যায় না। দণ্ডবিধিতে ভালো কাজে প্রণোদনার জন্য কোনো পুরস্কার নির্দিষ্ট নেই বলে আমরা এখানে তাঁকে যৌবনিক অভিনন্দন জানিয়ে পুরস্কৃত করতে পারি।

পারি তো, নাকি?

নভেম্বর ২০১৭

মেঘে বাড়ি আহোনির ভূমিলগ্ন ডেরা

আকমল হোসেন নিপু (আহোনি)-র ১৯৯৮-এ প্রকাশিত প্রথম প্রকাশনাটি ছিল একটি গল্পগ্রন্থ। এর পাঁচ বছর ছাড়িয়ে আরেকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশেরও পরের বছর ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি’। এর পরে আরো দুটি গল্পগ্রন্থ ও দুটি উপন্যাসগ্রন্থ প্রকাশের পর ২০১৬-এ একটি উপন্যাস ও একটি গল্পগ্রন্থসহ যুগপৎ প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখের কোন প্রতিবেশি নেই’। ২০১৭-এ প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ প্রকাশনাটিও একটি গল্পগ্রন্থ। দেখা যাচ্ছে, প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের সময় থেকে ২০১৭ পর্যন্ত উনিশ বছরে তাঁর গল্পগ্রন্থ সংখ্যা ৬, উপন্যাস ৩ ও কাব্যগ্রন্থ ২। অর্থাৎ, প্রকাশনার সংখ্যাবিচারে তাঁর কথাসাহিত্য ও কবিতাগ্রন্থের অনুপাত ৯:২; যে বহরে কথাসাহিত্যের পাল্লা চতুর্গুণাধিক ভারী।

এতদসূত্রে আমরা কি এই অনুমানে দাঁড়াতে পারি যে, আহোনির ঘর-গেরস্থালি কথাসাহিত্যের সাথে যতটা, কবিতার সাথে ততটা নয়? না বোধহয়। একটিমাত্র সংখ্যাবাচক তথ্য এ ধরনের বিবৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়। কেবলই কবিতা লিখেন এবং জীবনে কখনোই কথাসাহিত্যের চর্চা করেন নি এমন কবিও জগতে রয়েছেন যাঁদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে দ্বিতীয়টি প্রকাশের ফারাক ১২ বছরের চাইতেও বেশি। এমনকি পৃথিবীতে এমন কবিও ছিলেন, জীবনে যাঁদের সবেধন একটিই মাত্র কাব্যগ্রন্থ। তো?

আহোনির প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে অভিমত জানাতে বসে দুই অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত ১৬৫ শব্দে এই যে মুখবন্ধটি আমি লিখে উঠলাম, এ দিয়ে এমন এক নিরর্থক মানচিত্র অঙ্কিত হলো, যার কোথাও কোনো সদর্থক অর্জন নেই। অবশ্য আলোচ্য লেখকের সৃজনঝোঁক ও লেখনপ্রবণতা বিষয়ে এই টেক্সট কিছুটা ধারণা উৎপাদন করলেও করতে পারে, যার ভালোমন্দ আমার পরবর্তী কথাবার্তার মেরিটের ওপরে খানিকটা নির্ভর করবে বলে মনে করা যায়।

পাঠকমহলে আহোনির কথাসাহিত্যিক পরিচয়টি স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। ওই পরিসরে তাঁর কিছু সামাজিক স্বীকৃতিও জুটেছে। কাজেই তাঁর পক্ষে ওই সফলতার রেখা ধরে সামনে এগোনোই মানবস্বভাবানুকূল আচরণ। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে এ যাবৎ বাংলা-কবিতার যত সংকলন হয়েছে, অ্যাকাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিকদের হাতে আশি ও নব্বইয়ের দশকের কবিদের তথাকথিত যত তালিকা প্রণীত হয়েছে, কোথাওই প্রায় তাঁর অন্তর্ভুক্তি নেই। হ্যাঁ, লেখক কেবলই স্বীকৃতির জন্যে লিখেন না; তবে স্বীকৃতিহীনতার ভিত্তিমূলকে পরিসরে আরো বাড়তেও দিতে চান না। পারলে বরং ইতিহাসের হাতে একটা বার্তামাত্র রেখে তা আড়াল করেন। কিন্তু আমরা দেখি যে, তিনি তা বাড়তে দিয়েছেন। ১২ বছর ধরে একে একে জমা করেছেন প্রতিবেশীহীন দুঃখমালা, যার খোঁজখবর নেবার আমরা কমই প্রয়োজন বোধ করেছি।
 
আমাদের কীর্তিমান কথাসাহিত্যিকদের অনেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। পরে তাঁরা কবিতাকে পাশে রেখে অন্যদিকে মনোযোগী হয়েছেন। এক্ষেত্রে আমরা নাম করতে পারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিম আল দীনসহ অনেকের। সংগত কারণে আমরা তাঁদের গল্প-উপন্যাস, কথানাট্য, প্রবন্ধ, প্রভৃতির প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখাই; দুর্বিষহ বেদনার মতো যার এক প্রান্তে পড়ে থাকে তাঁদের কবিতারা। এই বাস্তবতার কথা মনে রেখেও আহোনির কবিতার দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে হয়। কেননা তিনি কথাসাহিত্যের বিপুল-বিস্তৃত প্রান্তর পরিভ্রমণ করবার সময়ও নদীর দিকে, ধানগাছের দিকে সুরাচ্ছন্ন মগ্নতা নিয়ে তাকান এবং ছন্দে-লয়ে সেই মগ্নতাকে এঁকে যাবার প্রয়াস পান।

যা কোনোকিছুই দিচ্ছে না, মানে যার সঙ্গে কোনো বিনিময়ের সম্পর্ক নেই, তার প্রতি দীর্ঘকালীন টান ও আসক্তি অতি অবশ্যই প্রেমনামধেয় বলে কীর্তিত হতে পারে। এই প্রেমই সেই অবস্তুধন, যার দিকে আমরা সমীহ নিয়ে তাকাই, তার গূঢ়ৈষা খুঁজে দেখি। দেখা দরকার বলে মনে হয়। আহোনির মধ্যে কবিতার প্রতি সেই প্রেম সদা জাগ্রত আছে।
বলা দরকার যে, ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি’তে, মানে আহোনির মেঘবাড়িতে বেড়াতে গেলে ভালো লাগে। বাড়িটা নদী-তীরবর্তী আর চাষবাসে সরগরম। ফলে এই মেঘবাড়ির যা কিছু গতিপ্রকৃতি তা নির্ধারিত হয় এ দুয়ের অবাক সম্মিলনে। তাতে তাঁকে মনে হয় কৃষিসমাজের আত্মীয় ও নদীসখা বলে।

নদীলগ্ন অনুভূতি এখানে এত বিচিত্রভাবে হাজির হয়েছে যে ভিজে যেতে হয়। কিন্তু বলে রাখা ভালো যে, পাঠককে খেলাচ্ছলে নিছক ভিজে ওঠার সুখ দেওয়া তাঁর কবিতাকর্মের অভীষ্ট নয়। মানে নদীকে তিনি তার নিখুঁত ফটোগ্রাফিক সৌন্দর্য বর্ণনার উপকরণ হিসেবে বেছে নেন নি এখানে, মূল্য দিয়েছেন কৃষিসহায়ক হিসেবে। ফলে এখানকার এ ভিজে যাওয়া ও শুকিয়ে ওঠার সিংহভাগই শ্রমলগ্ন, চাষগন্ধী ও ঘামবহুল। ‘আমি তো পাহাড় নদীর কাছে/ এখনো দাঁড়াই’ (গন্তব্য), ‘এরকম অনেক বছর তন্বী নদীর কাছে/ হলুদ শস্যক্ষেত পড়ে থাকে’ ((নির্জন বাঁশি) বা ‘শীর্ণ নদীকূলে/ চাষীকন্যা মেলে ধরে রুপালী দুপুর/ দূরে দূরে শঙ্খ সাদা মেঘ’ (কৃষিকথা-৪) ধরনের অজস্র পঙক্তিতে নদী ও কৃষিসমাজের ইমেজ মূর্তিত এই বইয়ের গন্ধ মাটির গন্ধের সহোদর। অতএব তা খুঁতযুক্ত এবং বেদনাপ্লাবী নন-ফটোশপিক চক্ষু, হস্ত ও মস্তিষ্কনির্মিত শিল্পবস্তুর আধার।

আহোনির মেঘবাড়ির কবিতায় যে সুর ধ্বনিত তা পয়ারের দোলা দিলেও আগাগোড়া পয়ারনিষ্ঠ নয়। চালটা তার প্রায়শই মুক্তক অক্ষরবৃত্তের। সুরের মধ্যে থেকে থেকে প্রায়ই অসুরের গহন ইশারায় তাল কেটে দেওয়া হয়েছে তাঁর কবিতা থেকে কবিতায়। তাতে পাঠস্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়। দৃষ্টান্তসহ একটি প্রশ্ন হাজির না করে শেষ করা যাচ্ছে না এই আলাপ : যেমন, ‘সূর্যঘুম’ কবিতার ‘দুহাতে রাখিনি কিছু সবকিছু আকাশে মেলেছি/ হাওয়া অনুকূলে, তাই ভেসে গেছে পালকের সুখ/ নদীর নিঃশ্বাস; কী করে বর্ণনা করি’ যে আমেজ দিলো, চতুর্থ লাইনে এসে ‘বরফকাল, উচ্চারণ করা মাত্র তা ভেঙে গুঁড়িয়ে মিশে গেল চকচক করা এক গদ্যস্রোতে। কেন এমন করেন তিনি? ছন্দ-সুরের ঐতিহ্যকে আঘাত দিয়ে প্রথাশাসনের প্রতি কোনো অনাস্থাকে জানান দিতে? বক্তব্যের দাবিকে ছন্দের দাবির চাইতে গুরুতর বলে হাজির করতে? হতে পারে। তবে এ বইয়ে গ্রথিত তাঁর বক্তব্যবিষয় ও কাঠামোয় প্রথাশাসন ভাঙার কোনো প্রবণতা কোনোভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে নি।

কিছু ক্ষেত্রে ‘রাজনীতিবিদ নদী নিয়ে বাণিজ্য করে’, ‘নদী তবে পৌঁছুবে কোথায় চারদিকে বণিকের হাত!’, ‘নারীর/ কোমল বাহু এই ফাঁকে পণ্য হয়ে যায়।’ ধরনের তিক্ত সত্য তিনি উচ্চারণ করেছেন তাঁর এই বইয়ের কবিতায়। শোনা গেছে ‘কেবল প্রার্থনা, মানুষের শত্রু লোপ পাক’ ধরনের চিদাকাঙ্ক্ষাও। এসব তাঁর সাহিত্যপ্রবণতার সঙ্গে খুব যায়। শুভলগ্নের অন্বেষায় ফেরা আহোনির এই যেন প্রকৃত নীড়।
 
আহোনির কবিতাগুলোর সূচনা প্রায়ই চোখ ঝলসানো, কানপাগল করা ও চিত্তচমকানো : ‘ছিলাম সাগর জলে তুমি এনে তুলেছ ডাঙায়’ (জানি না উড়াল মেঘ); ‘রাত্রিই মুগ্ধ করে বেশি, একে একে খুলে ফেলি/ আগুনের খোসা’ (বাতাসনির্ভরতা); ‘আনন্দে লাফাও কন্যা দুধভরা মাটির কলস’ (হরিণচর্চা); ‘মেঘে যে তোমার বাড়ি জানা হলো বহুদিন পর/ চৈত্রবৃষ্টিতে’ (শস্যসংকেত); ‘রেখেছ মূর্খ করে রণকৌশল কখনো বুঝি না (ঘুঘু চড়ে খায়); ‘কষ্টের দোতরা তুমি নিমকাঠে গড়া’ (নিমকাঠে গড়া); ‘নীরবে দাঁড়াতে দেখে ভেবেছ পাথর—’ (তোমাদের শস্যময় মুহূর্ত); ‘তোমাকে ছুঁয়েছি বলে এই হাত বাঁশি হয়ে গেছে—’ (বাঁশিতত্ত্ব)। এই হেন ঔজ্জ্বল্যের ছন্দ-সুরই প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ হয়ত এসবের নির্ভার মানেযুক্ত যোগাযোগসক্ষমতা। তবে সূচনাপঙক্তি -পরবর্তী হাঁটাহাঁটিতে প্রায়ই দূরত্ব তৈরি হতে দেখা গেলেও সেসব পদক্ষেপকে কখনোই অনাত্মীয় মনে হয় না। পরবর্তী চলনে তিনি সূচনামূলের টান ভুলে যান না। মূলে তাকাতে অনাগ্রহী অনেকেই যেখানে জারজ পঙক্তি দিয়ে কবিতার শরীর ভরে তুলতে তুলতে আজকাল উচ্ছন্নের দিকে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন, তিনি সেখানে বরাবরই মূলনিষ্ঠ, শেকড়বান্ধব।

শব্দ-বাক্যের মধ্যস্থতায় এ বইয়ে গড়ে উঠেছে যে শস্যগন্ধা নদীসমবায়, তার নাম ধরে ডাকের মধ্যে নদীমাতৃক এ বদ্বীপকে ভালোবেসে যাবার নিবিড় মন্ত্র শিখে ওঠবার আশকারা আছে। ফলে কথাসাহিত্য ও কবিতার মধ্যে কাকে তিনি বুক দেন আর কাকে পিঠ সে প্রশ্ন এইখানে এসে আলগোছে গৌণ হয়ে যায়। শরীরের আয়তন দেখে মানুষের মহত্ব মাপবার ঝোঁক আমাদের মধ্যে তৈরি না হওয়াই স্বাস্থ্যকর।
 
আহোনি যে ধারার কাব্যচাষ করেন তাতে মগ্নতা লাগে। শব্দসাধনকালে তার মধ্যে সেই মগ্নতা অতি অবশ্যই জাগে। প্রয়োজনমতো টুকরাটাকরা হয়ে হলেও সেটা পড়েও তার সব কবিতার ভাগে। মর্জি হলে আমরা পাঠকরা তাতে ভিজতে পারি, শুকাতে পারি। পারি তার শরীরের সাথে শরীর লাগিয়ে মিশে থাকতে। চেনা গন্ধের আবেশে তাতে আরাম লাগে। আত্মীয়সংঘে আছি বলে মনে হয়।

তাঁর কবিতার সাথে এই মিশে থাকা আমাদের, দীর্ঘায়িত হোক।

সেপ্টেম্বর ২০১৭

শামীম পারভেজ, বর্ষাস্বপ্নে কাটলো যাহার চৈত্রপোড়াদিন

সেলফোনে প্রথম যখন ভয়াবহ অসুস্থ শামীম পারভেজকে ঢাকার মহাখালীস্থ মেট্রোপলিটন মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করবার খবর পাই, তখন জুনজনিত ব্যস্ততায় ডুবতে ডুবতে শ্রমসাধ্য একটি অ্যাসাইনমেন্ট শেষে তীরে দাঁড়িয়ে কাকতালীয়ভাবে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ক্লিক করে অদূর অতীতে জাপানে সংঘটিত প্রলয়ংকরী সুনামির একটি বিরল ভিডিও ক্লিপ দেখছিলাম। একটা সচল জনপদের সপ্রাণ-নিষ্প্রাণ সমস্ত কিছুকে ক্ষুধার্ত ও রাগী সমুদ্রের মুহূর্তে গ্রাস করে নেবার ভয়াবহতা এবং মানুষের অসহায়তার এমন অবিশ্বাস্য ও করুণ চিত্র আর হয় না। ঘটনার ভয়াবহতায় কেবলই কাঁটা দিয়ে উঠছিল আমার মাঝবয়েসি গা। এমন অবস্থায় ফোনবাহিত হয়ে এল আরেক সুনামির সংবাদ। ক্লিপটিতে চোখ রেখে ঘটনার বিবরণ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল প্রাণান্ত দৌড়েও যে লোকটি রাগী জলের থাবা থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারল না ওই লোকটিই হয়ত শামীম, আর অপেক্ষাকৃত শক্ত ভিতের উপরে নির্মিত তেতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে যে লোকটি মনে করছে যে এ যাত্রায় বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছি অথচ খানিক পরে বাড়ি ধ্বসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে নিজেও জলের পাকে নিখোঁজ হয়ে যাবে সে লোকটি বোধহয় আমি!

ফোন রাখতে না রাখতে আরেকজনের কল পাই, সেও বয়ে আনে ওই একই সংবাদ। বিকেল নাগাদ আরো একজন। কিন্তু না, আটঘণ্টা শ্রম বেচা শেষেও সংসারজনিত ব্যস্ততা বাধ সেধে দাঁড়ালে ওইদিনই আমার মহাখালী যাওয়া সম্ভব হয় নি; দীর্ঘ অদেখার কারণে টানে যদিও ঘাটতি ছিল না কোথাও।

জানা গেল, শামীমের স্ত্রী ক্লিনিকে ওর সঙ্গে আছে। ফোন নম্বরও পাওয়া গেল তাঁর। দেখতে যেতে হলে তাঁর কাছ থেকে ডিটেল জেনে নেয়া দরকার হবে। ভাবলাম, যদিও আজ যেতে পারব না তবু একটা ফোন করে ওর সংবাদটা অন্তত নেয়া যাক। কিন্তু নানারকম ভাবনা হলো। ফোন করে কী শুনতে কী শুনব কে জানে। সইতে পারব তো! তা ছাড়া, ভদ্রমহিলার সঙ্গে আগে কখনো আমার দেখা-কথাও হয় নি। এসব মিলিয়ে প্রয়োজনীয় মনোবল সঞ্চয় করে উঠতে পারলাম না। পারতে পারতে এক দিন দুই রাত গত। পরদিন ফোন করে যা বুঝতে পারলাম তাতে মনে হলো ভদ্রমহিলা শামীমকে সুনামির রাগী জলের তোড়ে হারিয়ে যেতে দিতে শারীরিক-মানসিকভাবে একেবারেই প্রস্তুত নন। ওকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি অন্যান্যের সহায়তায়, যদিও আশঙ্কা পুরোপুরি ছাড়ছে না তাঁকে। কারণ চিকিৎসকরা তেমন আশ্বাসবাণী শোনাতে পারছেন না। যাই হোক, তারও পরদিন সন্ধ্যায় মহাখালী যেতে পারলাম, কিন্তু মানসিকভাবে বলীয়ান মিসেস শামীমকে ওখানে পাওয়া গেল না যে তাঁকে একটা ধন্যবাদ দেবো। অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে আছেন তাঁর ছোটভাই, শামীমের শ্যালক।

সকল ভালো হাসপাতালের মতো ওখানেও প্যাসেন্ট ভিজিট করবার নির্দিষ্ট সময় আছে, আমি যার অনেক আগেই ক্লিনিকে পৌঁছেছি। ফলত অপেক্ষা করতে হলো। শামীমের শ্যালক রিসেপশনে সঙ্গ দিলেন আমায়। এটা-ওটা কথা হচ্ছিল ওর সম্পর্কে। কথার সারাংশ শামীমের নিজের শরীরের প্রতি নানা অনিয়ম-অত্যাচারের বর্ণনায় ভরা। শেষ দিকে চাকুরি-বাকুরি ছেড়ে কিছুটা থিতু হয়েছিল সে, অনিয়মটাও খানিকটা কমিয়ে এনেছিল। কিন্তু ততদিনে ভেতরে স্থায়ী কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। চোরা অসুস্থতা রীতিমতো গেড়ে বসেছে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে সন্ধ্যা সাতটায় মাস্ক ও ইউনিফর্ম পরে এইচডিইউ তথা হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে গিয়ে দেখলাম চার হাত-পা ছড়িয়ে শামীম ঘুমিয়ে আছে। বেশ কিছুদিন শেভ করা নেই। ক্লান্ত বিমর্ষ অভিব্যক্তি। নাকে ও নিম্নাঙ্গে বিবিধ নল। দূর থেকেও শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। জাগিয়ে কথা বলা নিরাপদ নয়। ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। বেড ঘেঁষে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে স্মৃতিতে থাকা ওর প্রাণোচ্ছল মুখটাকে ওই মুখের সাথে মিলিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না আমার।

জিজ্ঞাসার জবাবে নিচুস্বরে নার্স জানালেন, হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠেই উনি সিগারেট খেতে চাচ্ছেন। এই বিবরণে আমার নিজের মুখও যেন ভেসে উঠল, যার কাছে সিগারেটই প্রধান স্বজন! সিগারেট শামীমকে খাচ্ছে, খাবে আমাকেও, মনে হলো। হায়, প্রাণসংহারক সিগারেট!

২.
শামীমকে আমরা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ময়মনসিংহে পেয়েছিলাম, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়কার সঙ্গী হিসেবে। বীক্ষণে ও বীক্ষণের বাইরের অন্যান্য সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতায় অনেক সময় একত্রে পার করেছি আমরা। শরীরের উপরে অত্যাচার তার তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনিয়ম-অত্যাচার আমরা সমন্বিতভাবেও করেছি অনেক সময়। কিন্তু ওর সুঠাম শরীরে ওসব কোনো প্রভাব ফেলতে পারে তেমনটা মনে হয় নি তখন। পেশাগত প্রয়োজনে পরে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ বিচ্ছেদের রাত্রি নেমে আসে। শামীম চলে যায় সিএইচটির কোনো জেলায়, রোকন উত্তরবঙ্গে, জুয়েল শেরপুরে, আশিক ও আমি ঢাকায়; মাসুম অবশ্য ময়মনসিংহেই থেকে যায়। এই বিচ্ছেদের কোনো নিরাময় ছিল না। বছর দশেক কাল মাঝেমধ্যে কোনো একটা লিরিকের চার/পাঁচ লাইন টেক্সট মেসেজ আকারে আমাকে পাঠাত শামীম। এগুলো হতো প্রায়শই রাত দুটোয় বা তারও পরে। সেটাই ছিল ওর লিরিক প্রস্তুতকাল। কখনো ওগুলো পড়ে ব্যাক করেছি, কখনো করতে পারি নি বা বিরক্ত হয়েছি। ব্যাক করলে কথা হতো গান লেখা নিয়ে। শামীম তখন চার হাতে গান লিখছে। কাউকে কাউকে দিয়ে ওসব লিরিক গায়নের উদ্যোগ নেবার কথাও জানাত সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব পরিকল্পনার কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে তার কিছুই জানি না।

না, ওর কোনো কবিতা দীর্ঘ দীর্ঘ দিন কোথাও পড়া হয় নি আমার। শেষ সময় সে ময়মনসিংহেই স্থায়ী নিবাস গড়েছিল। ওখানকার সাহিত্যাঙ্গনে সেসময় ওর নৈমিত্তিক উপস্থিতি ছিল বলে শুনেছি, ছবি দেখেছি। কিন্তু এই পর্যায়েও ওর সঙ্গে মোলাকাতের সুযোগ তৈরি হয় নি আমার। এর মধ্যে দু’-চারবার বিভিন্ন কাজে ময়মনসিংহে গেলেও দুর্ভাগ্যক্রমে শামীমের সাথে দেখা হয় নি। ওর সম্পর্কে দীর্ঘ এই অদেখাই আমার সঞ্চয় হিসেবে রয়ে গেল মাত্র।

শামীমের মৃত্যুর পরে ইমেইলে ওর একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি পাই শাহীন লতিফের মাধ্যম। নাম নেই। খুব সময় নিয়ে নিষ্ঠার সাথে পড়তে না পারলেও শ্রদ্ধার সাথে ওর ভেতর দিয়ে গেছি আমি। ওখানে পাতায় পাতায় শামীমের মুখ লুকানো। তবে কবিতাগুলোতে দীর্ঘ অচর্চার ছাপও স্পষ্ট, যার আরো সম্পাদনা দরকার। চোখ আটকে যাওয়া অনেক জায়গা আছে লেখাগুলোয়। ‘ছুটি চাহিয়া’ নামক একটি কবিতায় শামীম বলছে : ‘কফিন সময় কাছে ডাকে বড় বেশী ক্ষমাহীনতায়।/ শেফালী ফুলেরা নিয়েছে ছুটি সেই কোন ভোরে। ছুটি মঞ্জুর কর তবে অন্দরবাসিনী...।’ হ্যাঁ, ওর ছুটি শেষ পর্যন্ত মঞ্জুর হয়েছে। ছুটির এ সময়টা শামীম কীভাবে কাটাবে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কোনো মানে নেই এ কথা বলার, তবু বলা যাক যে, ওর ওখানকার চৈত্রপোড়াদিনগুলোও ‘বর্ষাস্বপ্ন’-এ ভরে উঠুক।

অক্টোবর ২০১৫

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...