ইতিউতি ভাবনার উপজাত অনুভূতিরাজি যখন চিত্তমণ্ডলে লাগাতার ভাঙচুর চালাতে থাকে, তখন মনোপুলিশ লাগিয়ে গুম করে না দিয়ে সেসব অনুভূতিকে কথায়, রঙে বা সুরে মুক্তি দিলে নিদারুণ অস্বস্তি থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। কার্যত আমি রঙান্ধ ও অসুর, তাই কথার আশ্রয়েই তার যথাসাধ্য প্রকাশ ঘটাই। কখনো কখনো দেখি কিয়দংশ প্রকাশে অবলীলায় ভর করে আছে রঙের ছোপছাপ ও সুরের পাখসাট। তখন বিস্ময়াহত আমি ওই প্রকাশবস্তুকে আহ্লাদ করে কবিতা নামে ডাকতে উদ্যত হই, কানা ছেলের নামও যেমন হয় পদ্মলোচন!
কবিতা হিসেবে ওসব হয়ত যথেষ্ট নিম্নমানের। তৎসত্ত্বেও, ষষ্ঠেন্দ্রিয়ধারী ইহবাদী ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমার ওসব অনুভূতিরও একটা সহজ তাৎপর্য আছে, ওখানে মূর্ত সাধ-আহ্লাদেরও একটা স্বপ্নমূল্য আছে। সে কারণে নামায়নের দুঃসাহস-সম্বলিত বিশেষায়িত ওইসব প্রকাশকে আমি সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে নিয়ত প্রশ্রয় দিয়ে চলি। পরিপার্শ্বের গণতন্ত্রহীনতা মনদেশের গণতন্ত্রচর্চায় কোনোই প্রভাব রাখতে পারে না।
তবে মাঝে মাঝে ভাবি, কবিতা লিখতে এসে এত যে তেল-পানি খরচ করেছি, না যদি লিখতাম তো কী হতো ওই অব্যয়িত তেল ও পানিতে? খরচ না হওয়া ওই তেল-পানি কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে একখানে মিশে গিয়ে হয়ত কোনো বিতিকিচ্ছিরি চেহারা পেত, যাদের আলাদা করবার সমুদয় প্রয়াস পর্যবসিত হতো সকরুণ নিষ্ফলতায়। অবশ্য, পানিতে তেল মেশানোর চাইতে লবণ মেশানো যে অধিকতর সুবিধাজনক, এই বোধ, হয়ত কবিতা লিখি বলেই জাগে!
একটা আকামা জিনিসের পেছনে ছুটে জীবনকে তামা তামা করে, কার্যত, যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তার কোনো নগদ অর্থ বা বিনিময়মূল্য এই মরপৃথিবীতে নেই, যেখানে অর্থহীনতাকে এ সমাজ ভালো চোখে কখনো দেখে না। সমাজের সমুদয় বিবেচনা অর্থ ও বিনিময়মূল্যে নির্ধারিত হয়। এরপরও, এই নিরর্থকতা ও অর্থহীনতার পেছনে ছোটার সহজ তাৎপর্য হলো, কিছুমাত্র হলেও আমি সমাজবিরোধী। কবিমাত্রই বোধহয় তাই। সমাজ যখন যেখানে যেভাবে আছে তাকে বরমাল্য প্রদানকারীরা কখনো কবি নয় বা হলেও হাফকবি! এ আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি। বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যের প্রতি পূর্ণ আস্থা সত্ত্বেও এ বাক্যে ইমান আনা যায়। আমার সে ইমান আছে।
সমাজের চোখ হলো কবি বা শিল্পী নয় এমন সব মানুষের চোখ, তারা যেভাবে যা দেখে, কবি কখনো সেভাবে দেখে না। কবির আলাদা করে দেখাটাই তার সমাজবিরোধিতা। এ বিরোধিতা সমাজকে বদলে দেয় না বটে, তবে বিদ্যমান সমাজ্জলে সকারণ কিছু ঢিল ছোড়ে, যার ঢেউ সমাজের কাছে অস্বস্তিকর ঠেকে। ওই বিরোধিতাটা এক ধরনের সফট বিপ্লব, ধীরস্থির, কিন্তু পয়জনাস।
কবিতায় সমাজবিরোধিতার ঘটনাটা শৈল্পিকভাবে ঘটানো যায় ইমাজিনেশনের সহায়তায়; এর আরো উৎকট পন্থা আছে, যা বলা এখানে বাহুল্য। ইমাজিনেশন হলো সংবেদন ও ধারণার মনছবি আঁকবার সামর্থ্য, যার সবটা কোনো বিশেষ মুহূর্তে শ্রবণ-দর্শন বা অন্য কোনো একক ইন্দ্রিয় দ্বারা ধারণযোগ্য নয়। এটি তৈরি হয় বুদ্ধি ও আবেগের সংমিশ্রণে, যার পূর্বশর্ত হলো পূর্ণ স্বাধীনতা। তো, কবিদের এই অবাধ স্বাধীনতা ভোগ কবিতায় কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে কি না সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন। যাকে চরম স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সে সেই স্বাধীনতাটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছে কি না তা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বটে। স্বাধীনতার মানে যে যথেচ্ছাচার নয়, এ শিক্ষার এখতিয়ার কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একার নয়; এটি কবিতাসহ শিল্পপাড়ারও আওতাধীন বিষয়।
দেখি যে, অধুনার কবিদের একাংশ চিত্রমাত্রকেই চিত্রকল্প ভাবছে। আরেকদল কল্পনাকে এতটাই অবাধে চরতে দিচ্ছে যে, কাঁটাতার ডিঙিয়ে তারা পায়ে হেঁটে সাগর পাড়ি দিয়ে ফেলছে। চিত্রকল্পের নামে হাতিগুচ্ছকে তুড়িতে উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে আকাশে, নদীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে মাছের যৌনতাসহ; যেহেতু কাজটা যথার্থেই সংঘটিত হবার দরকার হচ্ছে না, শব্দ-বাক্যের কারসাজিতেই ঘটিয়ে দেওয়া যাচ্ছে সব। এই প্রবণতাকে অনেকটা ফ্রি পেয়ে মাথার বাঁ’পাশে বাড়তি আরেকটা মাথা জুড়ে নেওয়ার মতো ব্যাপার বলে মনে হয়।
পাগলামি অনেক সময় উৎকৃষ্ট মনছবি আঁকতে পারে, তবে সেসব ছবির সিংহভাগ যে অসংলগ্ন চিন্তায় ঠেস দেওয়া থাকে প্রায়শ তার কোনো জাতকুল থাকে না। এসব চিন্তা মানুষের পারসেপশনের আওতার মধ্যেই যেন আর থাকতে চাইছে না। হামেশাই ডিঙিয়ে যাচ্ছে বোধ্যতার সীমা-পরিসীমা। কিন্তু এরও সীমা আছে, থাকা উচিত। তা নইলে কথিত কবিতাকে উপলব্ধিতে নিতে অসমর্থ পাঠককে পশ্চাৎপদ ঠাওরে গালি দিয়েও আখেরে পার পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। যা-ই কল্পনা করি না কেন, মানব ধারণায় তাকে সম্ভব মনে হতে হয়। অন্তত দূরান্বয়ী হলেও একটা সম্পর্কসেতু কোথাও থাকতে হয় আবিষ্কার করে ওঠবার জন্য। তাহলেই কেবল সেখানে সৌন্দর্য ভর করবার ফুরসত পায়, অন্যথায় সৃষ্টি হয় সামঞ্জস্যহীন প্রগলভতা। মনে রাখতে হয় যে, প্রলাপোক্তিসর্বস্বতা কবিতার এক নম্বরের শত্রু।
আমার মনে হয়, উত্তুঙ্গ কল্পনা যাতে কোনোভাবেই প্রলাপে পর্যবসিত হয়ে না যায়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করে উঠতে পারাই আমাদের একাংশ সাম্প্রতিক কবির জন্য এখন বড়ো রকমের চ্যালেঞ্জ।
No comments:
Post a Comment