Thursday, June 26, 2014

একাত্তরের দিনগুলি : মুক্তিযুদ্ধের গায়ের মাপে তৈরি অ্যাপ্রোন

জীবদ্দশায় কবি-সাংবাদিক সাইয়িদ আতিকুল্লাহ সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার মাধ্যমে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, “’৭১-এর ঢাকা শহরের অবস্থা এবং গেরিলা তৎপরতা বুঝবার জন্য এই বইটি অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে। ঢাকায় গেরিলাদের তৎপরতা নিয়ে এত ভাল বই এখন পর্যন্ত আর কেউ লিখেছেন বলে জানিনে। দলিল-প্রমাণাদি সম্পর্কে উদাসীন বাঙালিদের জন্য জাহানারা ইমাম এক অমূল্য দলিল উপহার দিয়েছেন।” তাঁর এই ভাষ্যকে আক্ষরিকভাবে মেনে না নেবার মতো কারণ এখানে এখনো অনুপস্থিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা তৎপরতা বিষয়ে জানা মতে এ গ্রন্থটি আজো অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

দিনলিপি দেখে দিনের চোখে দিন ও রাতকে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতাব্যাপী ব্যাপ্ত তার পরিসরকে। এই তার নৈমিত্তিক শৈলীপনা। কখনো যে এই রীতির ব্যত্যয় ঘটে না, এমন নয়। মাঝে মধ্যে এই নৈমিত্তিকতার সমতলে উড়ে এসে ঢুকে পড়ে অতীত দিনের দুয়েকটা ঝরাপাতা; চাই কী কখনো উঁকি মারে সম্ভাবনামাখা ভবিদিনও, আশঙ্কা বা স্বপ্নপাখি হয়ে। এই দ্বিবিধ ব্যতিক্রমী ডানা ঝাপটানিসহ বাংলাভাষায় রচিত অবিস্মরণীয় দিনলিপি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ মধ্যবয়সে ফের এসে সামনে দাঁড়ায় লোনাগর্জন হয়ে। চোখ বুজে এ গর্জনে কান পেতে চার দশকেরও অধিক প্রাচীন এক রক্তনদীর ছলাচ্ছলের মুখে পড়ে আমি নতুন করে চুরমার হয়ে যেতে থাকি। ফের গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াই। সুউচ্চ একেকটা ঢেউকে এগিয়ে আসতে দেখে বুক পেতে রাখি। ফেনা ও বুদ্বুদসহ বুকের সৈকতে তীব্র শক্তিতে তা আছড়ে পড়ে। এ আঘাত সয়ে সয়ে আরো কোনো প্রকাণ্ড ঢেউয়ের আঘাত সইবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এক-দু’পা করে সামনে এগোই। ভেঙেচুরে ভেসে যাই, আবার উঠে দাঁড়াই আমি সমুদ্রের সমান বয়সি। জানি ক্রমে লীন হয়ে যাব একদিন, তবু সতত প্রবহমান এ রক্তনদীর ছলাচ্ছল কখনো থামবে না বলে ধারণা হয়।

একাত্তরের মার্চের প্রথম দিনে থেকে এ গ্রন্থের শুরু, সমাপ্তি ডিসেম্বরের সতেরোয়। যেন ন’মাস দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের গায়ের মাপে তৈরি এ অ্যাপ্রোন। যেদিক দিয়েই একে উন্মোচন করা যায় সেদিক দিয়েই অগ্নিহল্কা, গেরিলাপ্রয়াসের সাফল্য-ব্যর্থতা, আকণ্ঠ উদ্বেগ। যেদিক দিয়েই তাকানো যায়, সেদিক দিয়েই রক্তক্ষত, স্তব্ধতার আওয়াজ। আশা-নিরাশা-আশঙ্কার দোলাচলে বর্ণিল ভাষানির্মিত এ এক সময়শরীর।

পহেলা মার্চ রেডিওতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালির মনে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে, সে আগুনের হল্কা ছড়ায় ঢাকাসহ গোটা বাংলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পূর্বাণী হোটেল, পল্টন ময়দানের রূপচেহারা মুহূর্তে বদলে যায়। হরতাল-কারফিউর আশঙ্কায় নিত্য প্রয়োজনীয় চাল-ডাল খরিদ করতে দোকানপাটে ভিড় বাড়ে মানুষের। পরিস্থিতির আঁচ লাগে ঘরে ঘরে। সংগত কারণে বদলে যায় ইমাম-পরিবারের স্বাভাবিক নৈমিত্তিকতাও। এই অশান্ত পরিস্থিতির শান্ত বর্ণনা দিয়ে গৃহপ্রবেশ ঘটিয়ে গ্রন্থটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-সাহস-শৌর্য, রক্ত-কান্না-হতাশা-অসহায়ত্বের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে অবিস্মরণীয় বীরত্বগাথা শুনিয়ে বিজয়ের পতাকা হাতে ধরিয়ে পরে পাঠককে নিস্তার দেয়।
   
এই দিনলিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ, বলা যায় প্রধান আলোকেন্দ্র জাহানারা ইমামের তারুণ্যস্পর্ধী বড়ো ছেলে শফি ইমাম রুমী। ততদিনে সে আইএসসি পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে। একইসঙ্গে ভর্তি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে, যেখানে ক্লাস শুরু হবে দোসরা সেপ্টেম্বর। এই ফাঁকে বাবা শরিফ ইমামের প্রতিষ্ঠানে মাঝেমধ্যে ড্রইংয়ের কাজ করে। পাশাপাশি বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিকস বিভাগের ক্লাসে যুক্ত হয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও ভেজে খাওয়া সমাজতান্ত্রিক আদর্শের একজন সৈনিক সে। বিতার্কিক হিসেবেও নিজের দক্ষতা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে। তার এ দক্ষতা প্রকাশ পায় বাসার চায়ের টেবিলেও। এরকম একটি ছেলের পড়াশোনা, খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে মাস্তি করা ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক কাজকর্ম নিয়ে যেভাবে মত্ত থাকবার কথা, দেশের আকাশে যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে আসায় সে জীবনে ব্যত্যয় ঘটেছে। রুটিনে জায়গা নিয়েছে অন্য কিছু, দেশমুক্তির উপায় অনুসন্ধান। তাই পড়ার টেবিলে বা খেলার মাঠে নয়, সময় কাটে মিছিল-মিটিংয়ে, বিক্ষোভে, গোপন যুদ্ধ পরিকল্পনায়, কারফিউপ্রবণ সময়ের আড়ালে প্রয়োজনীয় ফিসফিসানিতে।

বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ ভেঙে নেমে এসেছে পথে, পথে পথে ব্যারিকেড তৈরি হচ্ছে, বিক্ষোভ চলছে। ক্ষুব্ধ জনতাকে দমাতে ওই পক্ষ থেকে প্রতিদিন গুলি চলছে, প্রতিদিন শহীদ হচ্ছে কেউ না কেউ। শহীদদের মরদেহ নিয়ে আবার বিক্ষোভ হচ্ছে। দেশদ্রোহিতার ভয়ে ভীত না হয়ে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবিত পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। বক্তৃতায় স্বাধিকারের দাবি তোলা হচ্ছে। এর মধ্যেই কারফিউ-গুলির পাশাপাশি সামরিক ফরমান জারি করে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্ব পরিপন্থী খবর, মতামত বা চিত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদিকে রেডিওকর্মীদের সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ফরমান বলে ৭ মার্চে রেসকোর্সে দেওয়া শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আসে। প্রতিবাদে কর্মীরা সব ধরনের প্রোগ্রামই বন্ধ করে দেন। পরদিন সকালে এ ভাষণ প্রচার সম্ভব হয়। এরকম পরিস্থিতিতে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে যেখানে একটি মাত্র গুলির ব্যবধান, সেখানে মা হিসেবে জাহানারা ইমাম চান ছেলেকে বুকের কাছে আগলে রাখতে। কিন্তু যার স্বপ্নে জায়গা নিয়েছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, তাকে যুদ্ধের মাঠের পরিবর্তে ঘরে ধরে রাখা অসম্ভব। পারেন নি জাহানারা ইমামও।

স্বাধিকার না স্বাধীনতা এই নিয়ে সর্বত্র তুমুল তর্ক। অনেকেই আশা করেছিলেন, শেখ মুজিব রেসকোর্সে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কিন্তু তিনি স্বাধীনতা প্রশ্নে “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”-এর মতো পরোক্ষ উক্তি করে তাঁর ভাষণ শেষ করেন। তাঁর এই ভূমিকায় অনেকেই নাখোশ। যাঁরা এর পক্ষে তাঁরা মনে করেন এটাই সঠিক ছিল, ওই মুহূর্তে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতো, যেখানে আলোচনা চলমান। এই দ্বিধা-সংশয়ের মধ্যেই মওলানা ভাসানী ৯ মার্চে পল্টনের সভায় সরাসরিই স্বাধীনতার প্রশ্নটি তোলেন, “বর্তমান সরকার যদি ২৫ মার্চের মধ্যে আপসে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা না দেয়, তাহলে ‌'৫২ সালের মত মুজিবের সঙ্গে একযোগে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম শুরু করব।” রুমী ভাসানীর ভূমিকাকেই সমর্থন করে। তার মানে সে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হয়ে গেছে যুদ্ধে যাবার জন্য। বুঝে গেছে, আলোচনা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। আলোচনার অজুহাতে ওরা সময় নিচ্ছে মাত্র। তাই মায়ের সাথে আলাপে তার মত এভাবে প্রকাশ পায় : “ওরা আমাদের স্বাধীনতা দেবে না। স্বাধীনতা আমাদের ছিনিয়ে নিতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম করে।”
  
মায়ের বিবেচনায় রুমীর আচরণ দিনকে দিন রহস্যময় হয়ে উঠতে থাকে। ওর চালচলনে একটা উদভ্রান্ত ভাব জায়গা নিয়ে নেয়। মায়ের চোখ এসব এড়ায় না। অ্যাস্ট্রলজি নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না জেনেও পারিবারিক বন্ধু কথাসাহিত্যিক ও অ্যাস্ট্রলজার অজিত নিয়োগীর কাছে তাঁর কপালে পুত্রশোক আছে কি না সে ব্যাপারে জানতে চান। তিনি ‘রুমীর মঙ্গল খুব প্রবল’ ও ‘মঙ্গল যুদ্ধের রাশি’ জানিয়ে ওকে সাবধানে রাখবার কথা বলেন।

আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে দিনে দিনে ঢাকায় এসে পৌঁছে অজস্র পাক সামরিক অফিসার, সাদা পোশাকে হাজার হাজার সাধারণ সৈনিক। চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে অস্ত্রভর্তি জাহাজ, যদিও বীর চট্টলাবাসী অস্ত্র খালাসের আয়োজন প্রতিহত করে দেয়। এদিকে খোদ প্রেসিডেন্ট ঢাকায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও অফিস-আদালত-ব্যাঙ্ক কার্যত চলতে থাকে মুজিবের নির্দেশে। টিক্কা খানকে কোনো বিচারপতি শপথ পড়াতে রাজি না হওয়ায় তাঁর গভর্নর হওয়া হয় না, বরং মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। সেনাবাহিনীর কাছে কোনো বাঙালি খাবার বিক্রি করছে না, ফলে পাকিস্তান থেকে প্লেনে করে খাবার আনতে হচ্ছে। এরকম অবস্থায় বড়ো ধরনের অপারেশনের নির্দেশ দিয়ে আলোচনা অমীমাংসিত রেখে ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কাউকে না জানিয়ে পাকিস্তানে ফিরে যান। পথে পথে আর্মি নামে। রাতে শুরু হয় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ-- অপারেশন সার্চ লাইট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু এলাকাকে শ্মশানে পরিণত করে ফেলা হয়। কালরাতের এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ও কয়েকদিন ধরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে-শুনে স্বাভাবিকভাবেই রুমীর ভেতরে ভাংচুর শুরু হয়। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পূর্বাহ্নেই ওর এমন কিছু ঘটতে পারে।

যুদ্ধে যাবার ব্যাপারে মায়ের অনুমতি পাবার জন্য সে নিয়মিত বিতর্ক চালিয়ে যেতে থাকে। অনেক ছেলেই বাবা-মাকে না জানিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে গেছে। কিন্তু ওর পারিবারিক শিক্ষাটাই এমন যে, সবকিছুই অভিভাবককে বলেকয়ে করতে হবে। এ কারণেই সে সর্বোচ্চ যুক্তির মারপ্যাঁচ চালায় : “আম্মা শোন, ছাত্রজীবন লেখাপড়া করার সময় এসবই চিরকালীন সত্য; কিন্তু ১৯৭১ সালের এই এপ্রিল মাসে এই চিরকালীন সত্যটা কি মিথ্যা হয়ে যায় নি? চেয়ে দেখ, দেশের কোথায় সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনধারা বজায় আছে? কোথাও নেই। সমস্ত দেশটা পাকিস্তানি মিলিটারি জান্টার টার্গেট প্র্যাকটিসের জায়গা হয়ে উঠেছে। রোমান গ্ল্যাডিয়েটরের চেয়েও আমাদের অবস্থা খারাপ। একটা গ্ল্যাডিয়েটরের তবু কিছুটা আশা থাকত, একটা সিংহের সঙ্গে ঝুটোপুটি করতে করতে সে জিতেও যেতে পারে। কিন্তু এখানে? সেই ঝুটোপুটি করার সুযোগটুকু পর্যন্ত নেই। হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, কট্কট্ করে কতগুলো গুলি ছুটে যাচ্ছে, মুহূর্তে লোকগুলো মরে যাচ্ছে। এই রকম অবস্থার মধ্য থেকে লেখাপড়া করে মানুষ হবার প্রক্রিয়াটা খুব বেশি সেকেলে বলে মনে হচ্ছে না কি?”

মা প্রতিশ্রুতি দেন তাকে কিছুটা আগেভাগেই আমেরিকায় পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু এতে ছেলে খুশি হয় না। বলে : “আম্মা, দেশের এ অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?”

এবার মা যুক্তির কাছে পুরোপুরি পরাস্ত। তিনি ইতোমধ্যে নিশ্চিত যে, তাঁর ছেলে হুজুগে মেতে নয় বরং মনেপ্রাণে প্রয়োজন উপলব্ধি করেই যুদ্ধে যেতে চাইছে। তিনি জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বলেন, “না, তা চাইনে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।”

এবার রুমী প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যাবার উপায় অনুসন্ধানে রত হয়। কিন্তু সঠিক যোগাযোগের লোক খুঁজে পেতে বিলম্ব হয়। শুরুতে বর্ডার ক্রস করা সহজ ছিল। এতদিনে বেশির ভাগ জায়গায়ই পাকিস্তানি সৈন্যদের কড়া প্রহরা। তবে তেসরা মে মায়ের জন্মদিনে রুমী জানায় যে, ওর ঠিকমতো যোগাযোগ ও যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কবে, কাদের সঙ্গে যাবে, মা জানতে চান। জবাব পাওয়া যায়, “তিন-চারদিনের মধ্যেই। কাদের সঙ্গে-- নাম জানতে চেও না, বলা নিষেধ।” মায়ের মনে হয় “লোহার সাঁড়াশি দিয়ে কেউ যেন পাঁজরের সবগুলো হাড় চেপে ধরেছে।” মা তাঁর অনুভূতির প্রকাশ ঘটান এভাবে : “নিশ্চিদ্র অন্ধকারে, চোখের বাইরে, নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দিতে হবে। জানতে চাওয়াও চলবে না-- কোন পথে যাবে, কাদের সঙ্গে যাবে। রুমী এখন তার নিজের জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তার একান্ত নিজস্ব ভুবন, সেখানে তার জন্ম-দাত্রীরও প্রবেশাধিকার নেই।” তাঁর তখন মনে পড়ে কাহলিল জিবরানের ‘প্রফেট’-এর পঙক্তিরা : ‘তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়’। কার তবে?

‘তারা জীবনের সন্তানসন্ততি
জীবনের জন্যই তাদের আকুতি।
তারা তোমাদের সঙ্গেই আছে
তবু তোমাদের নয়।
তারা তোমাদের ভালোবাসা নিয়েছে
কিন্তু নেয় নি তোমাদের ধ্যান-ধারণা,
কেননা তারা গড়ে নিয়েছে
তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা।
তাদের শরীর তোমাদের আয়ত্তের ভেতর
কিন্তু তাদের আত্মা কখনই নয়
কেননা, তাদের আত্মা বাস করে
ভবিষ্যতের ঘরে,
যে ঘরে তোমরা কখনই পারবে না যেতে
এমনকি তোমাদের স্বপ্নেও না।

তাদেরকে চেয়ো না তোমাদের মত করতে
কারণ তাদের জীবন কখনই ফিরবে না
পেছনের পানে।’

রুমীকে রওয়ানা হতে হবে ৭ মে তারিখে। গোছগাছ করে দেবার জন্য মায়ের প্রস্তুতির যেন শেষ নেই। নিজহাতে রুমীর প্যান্টের কোমরের কাছে ভেতর দিকের মুড়ি খুলে কয়েকটা একশো টাকার নোট সেলাই করে দেন। বাইরে কোথাও থাকলে সার্চ করে রেখে দিতে পারে। কাপড়-জামা রাখার জন্য এয়ারব্যাগ এবং তার মধ্যে দু’সেট কাটা কাপড়, তোয়ালে, সাবান, স্যান্ডেল এবং জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা ও সুকান্ত সমগ্র পুরে দেন।

যাবার আগের দিন রাতে রুমী মায়ের কাছে বেশিক্ষণ চুলে হাত বুলিয়ে দেবার আবদার করে। দুই ছেলের মাথায়ই মা প্রায় প্রতিদিন হাত বুলিয়ে দেন। আজ ছোট ছেলে জামী চাইল না মাকে। মাথার চুল টেনে দেবার সময় ওইদিন রুমী গেয়ে ওঠে, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। নির্দিষ্ট দিন জাহানারা ইমাম নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে রুমীকে যাত্রাবিন্দুতে পৌঁছে দেন। পেছনের সিটে রুমীর সাথে বাবা শরিফ ইমাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী গাড়ি গিয়ে থামে সচিবালয়ের সেকেন্ড গেটে। আলগোছে নেমে যায় রুমী। এখান থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে মিলে গোপনে শুরু হবে ওর যুদ্ধযাত্রা।

অপ্রত্যাশিতভাবে ১১ মে ফিরে আসে রুমী। কামাল লোহানী, প্রতাপ হাজরা, মনু, ইশরাক ও বাফার কয়েকজন কর্মচারী মিলে দলটি ভারতের উদ্দেশ্যে যে পথে যাত্রা করেছিল, সে পথে ঘাপলা হয়েছে। নতুন পথের সন্ধান না-জানা থাকায় ফয়েজ আহমদের পরামর্শে দলটি পরবর্তী অভিযানের পরিকল্পনা করে প্রত্যাবর্তন করে ঢাকায়। ১৪ মে বন্ধু নাদিমসহ পুনর্যাত্রা করে রুমী। মা উদ্বিগ্ন থাকেন। ৩০ জুন প্রথম খবর পান রুমী আগরতলার কাছাকাছি মেলাঘর ক্যাম্পে আছে। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ছেলে রণাঙ্গনে কিন্তু মা-ও বসে নেই। ঢাকা শহরে থেকে প্রতিমুহূর্তে পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে যান তিনি। ছেলের খবর জানবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। মেলাঘর থেকে খবর নিয়ে আসে জিয়া, মনু, দুলু, পারভেজ। ওদের কাছে জানতে পারেন রুমী ভালো আছে, তবে ওদিকে এখন ভয়ানক চোখ-ওঠা রোগ। পাঞ্জাবিরা যাকে ‘জয় বাংলা চোখ-ওঠা’ নামে ডাকে। ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস। পারভেজ বলে, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বেলেডোনা-৬ শুরুতেই খেলে রোগটি আর হয় না। ২০ জুলাই পারভেজ রওয়ানা দেবে মেলাঘরে। মা এবারও সুযোগ নেন। পারভেজের কাছে কয়েক শিশি বেলেডোনা-৬, কয়েকটা নেইল কাটার, তিনটা সানগ্লাস এবং দু’শো টাকা দিয়ে দেন। বলে দেন, একটা নেইল কাটার, একটা সানগ্লাস এবং একশো টাকা রুমীর। একশো টাকা পারভেজের। বাকি জিনিসপত্রগুলো যেটি যার যখন লাগে, তারই। এর পরেও নানাজনের কাছে নানা সময়ে টাকা, সিগারেট, ওষুধ, কাঁচি, ব্লেড ইত্যাদি পাঠান; যেন তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধা ছেলের মা বা মায়েদের প্রতিনিধি।

৮ আগস্ট রুমী ঢাকায় আসে। সে কী উচ্ছ্বাস মায়ের মনে! দীর্ঘদিন পর ছেলেকে কাছে পাওয়ায় বাড়িতে উৎসব লেগে যায়। সেটা শুধু ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্যেই নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বয়ান শোনা যাবে এ কারণেও। এবার রুমীর ঢাকায় আসা বেড়াবার জন্য নয়। ইতোমধ্যে সে পুরোমাত্রায় প্রশিক্ষিত গেরিলা যোদ্ধা। অপারেশনের প্রয়োজনেই দুই নম্বর সেক্টর থেকে অন্যান্যের সঙ্গে সে প্রেরিত হয়েছে ঢাকায়। মা এখন আর আগের মতো কড়াকড়ি করেন না। বেশিক্ষণ কাছে পাবার জন্য সামনে সিগারেট খাবারও অনুমতি দিয়ে দেন তিনি। তাছাড়া, সঙ্গী গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করবার জন্য বাড়িতেই জায়গা করে দেন, ক্ষণে ক্ষণে নাস্তার জোগান দেন। নিজে কোনো কোনো বৈঠকে উপস্থিতও থাকেন। বৈঠকে অপারেশনের পরিকল্পনা ও তার নকশা তৈরি হয়।

কখনো দু’তিনদিনের জন্যও রুমীকে বাড়ির বাইরে চলে যেতে হয়। মা অপেক্ষা করতে থাকেন কোনো বড়ো ধরনের অপারেশনে সফল করে সবান্ধবে ফিরে আসবে তাঁর রুমী। কখনো-বা অপারেশন শেষে নিজে গিয়ে রুমীকে গাড়ি করে এগিয়ে আনেন। স্টেনগানের ফায়ারের আগুনের আঁচে ঘাড়ে তৈরি হওয়া ফোস্কা ডেটল দিয়ে মুছে দেন, ওষুধ লাগিয়ে দেন। প্রয়োজনে ছেলের সঙ্গে গাড়ি ড্রাইভ করে গিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসেন, রাখেন বাসায় যত্ন করে।

মা-ছেলে মিলে এরকম যৌথ গেরিলা-তৎপরতা চলতে পারত দীর্ঘসময় ধরে। কিন্তু না, যতি পড়ে এই অভিযানে। চড়াও হয় বজ্রের মতো দুঃসময়। ২৯ আগস্ট একদল মিলিটারি এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি ঘেরাও করে। ঘর সার্চ করে এমপিএ হোস্টেলে নিয়ে যায় স্বামী শরিফ ইমাম, ছেলে রুমী-জামী ও ছেলের বন্ধু হাফিজ-মাসুমকে। মায়ের বুক হু হু করে ওঠে।

এক-দেড় ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেবে বলে নিয়ে গেলেও দেড়দিন যায় ওরা কাউকে ছাড়ে না। ফোনে যোগাযোগ করে স্যান্ডউইচ ও জামাকাপড় নিয়ে সশরীরে এমপিএ হোস্টেলে যান তিনি। কিন্তু কারোরই কোনো খোঁজ পান না। ৩১ আগস্ট ফিরে আসে রুমীকে ছাড়া দলের বাকি সবাই। এবার মায়ের উদ্বেগ আরো তীব্র হয়।

২৫ আগস্টের একটি সফল গেরিলা অপারেশনের বিপরীতে ছিল এই জিজ্ঞাসাবাদ। ধানমণ্ডির একটি বাড়ির গেটের ওই অপারেশনে অর্ধডজন পাকসেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় দশম শ্রেণিতে পড়া কিশোর জামীসহ চরম নির্যাতন করা হয় সবাইকে। রুমীর কৃতকর্ম সম্পর্কে পাকসেনারা আগে থেকেই তথ্য পেয়েছিল, ফলে ওর পক্ষে ঘটনা অস্বীকার করবার কোনো জো ছিল না। ওর স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত হয় যে ওকে ছাড়া আর কেউ এ অপারেশনের কিছুই জানে না। সুতরাং অন্যেরা ছাড়া পেলেও রুমী ছাড়া পায় না।

এ বিপদে জাহানারা ইমামের প্রগতিশীল মনও সংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মিষ্টি নিয়ে হাজির হন পাগলা পিরের দরগায়। শোনা যায়, এই পিরের কাছে যা চাওয়া যায়, তাই মেলে। তাঁর আর্তি ছেলে রুমীকে ফিরে পাওয়ার। না, তিনি একা নন। পিরের দরগায় গিয়ে দেখতে পান রাজশাহীর ডিআইজি মামুন মাহমুদের স্ত্রী মোশফেকা মাহমুদ, রাজশাহীর এসপি শাহ আবদুল মজিদের স্ত্রী নাজমা মজিদ, চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হকের স্ত্রী মাহমুদা হক, ঢাকার আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী ঝিনু মাহমুদসহ আরো অনেকেই। সবারই আর্তি আপনজনকে ফিরে পাওয়ার। কোরান খতম করান। মিলাদ পড়ান। জানের সদকা হিসেবে খাসি কোরবানি দেন। পিরকে বাসা অব্দি নিয়ে আসেন। পাগলা পির রুমীর ঘরে গিয়ে দু’রাকাত নামাজ পড়ে মোনাজাত করে ঘাবড়াতে নিষেধ করে শিগগির ওকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। পরের আশ্বাসের যেমন কমতি নেই, নজরানারও ঘাটতি নেই। প্রতি বৃহস্পতিবার একটি করে পঞ্চাশ টাকার নোট, পাঁচ-সাত সের মিষ্টি, এক কার্টুন ৫৫৫ সিগারেট নজরানা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু না, পিরের পেছনে প্রচুর অর্থ ও সময় অপচয় করে, প্রচুর ধরনা দিয়ে, পায়ে পড়েও কোনো কাজ হয় না। এবার আজিমপুর সলিমুল্লাহ এতিমখানায় গরু কোরবানি দেন। যে যা পরামর্শ দেয়, তাই করেন। প্রিয় পুত্রের জন্য মায়ের প্রত্যাশা যে ফুরাবার নয়।

বিজয়ের দিনকয় আগে ১৩ ডিসেম্বর হার্ট অ্যাটাকের ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শরিফ ইমামকে। ব্ল্যাকআউটের কারণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি চালানো যায় নি। ১৪ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। বিজয়ের দিন কুলখানি। জেনারেল নিয়াজি নব্বই হাজার পাক সেনা নিয়ে বাঙালির বীরত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন; জাহানারা ইমাম আত্মসমর্পণ করেন বর্তমান পরিস্থিতির কাছে, বাকি জীবন একাই সব কষ্ট বহন করবার প্রতিজ্ঞায়।
                         
শরিফ ইমাম ছিলেন রাশভারী স্বপ্লবাক মানুষ। সরকারি চাকুরে, ইঞ্জিনিয়ার। সংসারে তাঁর খবরদারির কোনো প্রমাণ গোটা বইয়ে মেলে না, বরং যেকোনো প্রয়োজনে সহযোগী হিসেবে তাঁর বাড়িয়ে রাখা উদার হাতের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তাঁর হাত অকৃপণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনেও। যখন তখন অর্থ দিয়েছেন যুদ্ধের রসদ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সবচেয়ে বড়ো যে কন্ট্রিবিউশন, সেটা দেশের ৩৫০০টি সেতু ও কালভার্টের তালিকা ও নকশা সরবরাহের। খালেদ মোশাররফ ব্রিজ ও কালভার্টের তথ্য চেয়ে পাঠান, যাতে পাকবাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে ওগুলো এমনভাবে এক্সক্লুসিভ বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া যায় যে, দেশ স্বাধীন হবার পর সহজে মেরামত করা যায়। অনেক ঝুঁকি ডিঙিয়ে শরিফ ইমাম তাঁর সহকর্মীকে নিয়ে সবকটা ব্রিজের তালিকা, বিভিন্ন টাইপের ব্রিজের ড্রইং করে প্রত্যেকটির স্পেসিফিকেশন লিখে দেন। এরকম একজন যোদ্ধার বিজয় দিবসের দুই দিন আগে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করা খুবই বেদনাকর। তিনি কেবল তাঁর পার্টনার জাহানারা ইমাম ও কিশোরপুত্র জামীকে একা করে যান নি, কার্যত যোদ্ধাদেরও হতাশ করে গেছেন।
 
একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থটি কেবল ইমাম পরিবারের ঘটনাবলির ডকুমেন্টেশন নয়, এটা মুক্তিযুদ্ধেরই একাংশের ডকুমেন্টেশন। কারণ বাংলার স্বাধিকারের সপক্ষে হওয়া নানা তৎপরতা ও এর সাথে যুক্তদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য এখানে টুকে রাখা আছে। নমুনা হিসেবে এর কয়েকটি এখানে তুলে ধরা যায়; যেমন ১৪ মার্চের নোট থেকে জানা যায়, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঢাকার কবি-সাহিত্যিকদের ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন করবার কথা। হাসান হাফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, বদরুদ্দিন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রোকনুজ্জামান খান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান, আবদুল গণি হাজারীসহ আরো অনেকে। জানা যাচ্ছে, বেতার-টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সব মাধ্যমের শিল্পীদের সমন্বয়ে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হবার কথাও। আলী মনসুরকে সভাপতি, সৈয়দ আবদুল হাদীকে সম্পাদক ও লায়লা আর্জুমান্দ বানুকে কোষাধ্যক্ষ করে গঠিত পরিষদে সদস্য হিসেবে ছিলেন মোস্তফা জামান আব্বাসী, জাহেদুর রহিম, ফেরদৌসী রহমান, বশির আহমেদ, খান আতাউর রহমান, বারীন মজুমদার, আলতাফ মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা, কামরুল হাসান, অজিত রায়, হাসান ইমাম, কামাল লোহানী, জি. এ মান্নান, আবদুল আহাদ, সমর দাস, গহর জামিল, রাজ্জাক ও আরো অনেকে।

১৫ মার্চের এন্ট্রি থেকে জানা যায়, বাঙালি বিশিষ্টজনেরা পাক সরকারের বাংলা ও বাঙালিবিরোধী আচরণে তাদের দেওয়া খেতাব বর্জন করতে শুরু করেছেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বর্জন করেছেন তাঁর ‘হেলালে ইমতিয়াজ’ খেতাব। অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী বর্জন করেছেন ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব। এছাড়াও জাতীয় পরিষদ সদস্য ডাঃ শেখ মোবারক হোসেন, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শেখ মোশারফ হোসেন ও দৈনিক পাকিস্তান সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন বর্জন করেছেন যথাক্রমে ‘তমঘা-এ-পাকিস্তান’, ‘তমঘা-এ কায়েদে আযম’ ও ‘সিতারা ই খিদমত’ খেতাব।
  
১৮ মার্চের এন্ট্রি থেকে জানা যায়, স্বাধিকার চেতনাকে তুঙ্গে তুলে দেবার জন্য ঢাকা টেলিভিশনের অভিনব গানের অনুষ্ঠানের সংবাদ। এই অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রথম সারির নামকরা শিল্পী ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা ইয়াসমীন, শাহনাজ বেগম, আঞ্জুমান আরা বেগম, সৈয়দ আবদুল হাদী, খোন্দকার ফারুক আহমদ, রথীন্দ্রনাথ রায় ও আরো কয়েকজন শিল্পীর উপস্থিতিতে গাওয়া ‘সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম, চলবেই দিনরাত অবিরাম’ গানটিকে যন্ত্রপাতির সৃজনশীল ব্যবহার দিয়ে কয়েক হাজার মুখে গাওয়া গান হিসেবে দেখানো হয়। আয়না ব্যবহার করে এ অসাধ্যটি সাধন করেন মোস্তফা মনোয়ার।

১৯ মার্চের নোটে পাওয়া যায়, পটুয়া কামরুল হাসানকে আহ্বায়ক করে ‘বাংলার পটুয়া সমাজ’ নামে সমিতির গঠনের সংবাদ, যে সমিতির শিল্পীরা কার্টুন, ফেস্টুন, পোস্টার ইত্যাদি তৈরি করে স্বাধিকার আন্দোলনের বাণী-বার্তা বৃহত্তর জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার উদ্যোগ নিয়েছে। শাপলা ফুলকে সংগ্রামী বাংলার প্রতীক হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব এই সমিতির সভাতেই নেওয়া হয়।

২২ মে তারিখের এন্ট্রি থেকে জানা যায়, গ্রামের মানুষের আন্তরিক ভালোবাসার কথা। গ্রামের অনেক বুড়ো মানুষ কিছু পর পর পথের ধারে গুড় আর মটকাভর্তি পানি নিয়ে বসে থেকেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে উদ্বাস্তু বা অন্য যারা ওই পথ দিয়ে যাবেন, তারা যাতে তৃষ্ণা মেটাতে পারেন। তাছাড়া, অনেক বাড়িতে রাত দুপুরে মুরগি জবাই করে খাওয়ানো ও মাঁচায় তুলে রাখা কাঁথা-বালিশ নামিয়ে শরণার্থীদের থাকতে দেওয়া হয়েছে।
   
১৪ অক্টোবরের এন্ট্রিতে মোনেম খাঁকে তাঁর বাসায় গুলি করে মারার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সন্ধ্যার পর মোনেম খাঁ ড্রইংরুমে বসে প্রাক্তন প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন, কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা ও তাঁর জামাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের সাথে কথা বলছিলেন। তখন ড্রইংরুমের দরজা খোলা ছিল। তিনি দরজার দিকে মুখ করে বসে ছিলেন। তখন তাঁকে বাইরে থেকে গুলি করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করেও তাঁকে বাঁচানো যায় নি। মোনেম খাঁর মৃত্যুতে মানুষ এত খুশি হয় যে, উল্লসিত জনতা হৈচৈ করে মিষ্টি কিনে-খেয়ে সব দোকান ফাঁকা করে ফেলে। ২৮ অক্টোবরের এন্ট্রিতে জানা যায়, মোনেম খাঁর লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ফেলানো হয়। এজন্য যে, তাঁর মতো বেঈমানের লাশ এদেশের মাটিতে থাকতে দেওয়া হবে না।

একইভাবে বইটি পাক কর্তৃপক্ষ ও পাকবাহিনীর অজস্র অপকর্ম ও বিভৎসতার ছবিও ধরে রেখেছে; যেমন ২৯ এপ্রিলের এন্ট্রিতে আছে বিহারীদের বিভৎসতার বর্ণনা; ১ মে-তে আছে আহত পাকবাহিনীর চিকিৎসার জন্য সুস্থ-সবল বাঙালিদের গা থেকে জোর করে রক্ত সংগ্রহ করার ভয়ঙ্কর খবর; ১৭ মে-তে আছে বিখ্যাত ও পদস্থ ব্যক্তিদের জোর করে ধরে নিয়ে রেডিও-টিভিতে প্রোগ্রাম করানো এবং বেয়নেটের ভয় দেখিয়ে স্বাক্ষরকৃত ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর নামে প্রকাশিত ভূয়া বিবৃতির তথ্য; ১৬ জুনে আছে পাক কর্তৃপক্ষের দ্বারা ঢাকার রাস্তার নামের মুসলমানিকরণ ও বই নিষিদ্ধের খবর; ১ জুলাইয়ে আছে গোপালপুর সুগারমিলের হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ; ২ জুলাইয়ে আছে ধর্ষণের বিভৎসতা-সম্পর্কিত বর্ণনা; ৪ সেপ্টেম্বরে আছে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে সম্মানিত ফ্লাইট লেফটন্যান্ট মতিয়ুর রহমানের বীরত্বকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘বিশ্বাসঘাতকের নাম মতিয়ুর রহমান’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের তথ্য। এই তালিকা অশেষ।

দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত ইতিহাসের বড়ো ঘটনাগুলোর বর্ণনামূলক ইতিহাস গ্রন্থ সাধারণত লেখা হয় ঘটনা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে, ঘটনার তীব্রতা থিতিয়ে এলে। তাবৎ ঘটনাকে সামনে নিয়ে আঁকা হয় তার আনুপূর্বিক রূপরেখা। বর্ণনাকারী বিভিন্ন দলিলপত্রের সহায়তায় ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে তার ভিত্তিতে ভাষাকে গতি দেন, বাক্য রচনা করেন। কিন্তু দিনলিপিতে ঘটমান ঘটনার সমস্তটা বিবেচনায় নিয়ে কথা বলবার সুযোগ থাকে না। দিনলিপি লেখকের কাছে তথ্য হিসেবে থাকে স্মৃতিতে সঞ্চিত নিকট অতীত এবং নতুন ঘটনাংশ বা তার একটা খণ্ড ঝলক। এই সুবাদে ঘটনার ব্যাপক বিস্তারণ সম্ভব হয়। যার উৎস হয় স্বচক্ষে দেখা, অন্যের কাছ থেকে শোনা ও গণমাধ্যমবাহিত হয়ে আসা তথ্য। এর মধ্যে বর্ণনাকারীর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা তথ্যই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। যুদ্ধকালীন রটনামালা থাকে নানা গুজবে ভরা, গণমাধ্যমও থাকে অস্থিরতায় আক্রান্ত। এরকম পরিপ্রেক্ষিতে দিনলিপি লেখক ঘটনাকে উপলব্ধি করার সক্ষমতা ও তার কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে গ্রহণ-বর্জন চালিয়ে সত্যকে ছুঁতে পারেন ও ছুঁয়ে থাকেন। আর ভবিষ্যৎ তাদের কাছে ধরা দেয় এসবের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া আশঙ্কা ও স্বপ্ন হয়ে। সংগত কারণে জাহানার ইমামের বর্ণনায়ও কোথাও কোথাও শোনা কথায় ভর করে গুজব জায়গা পেয়েছে। তবে তাঁর সত্যনিষ্ঠার কারণে পরবর্তী কোনো এন্ট্রিতে আবার তার সংশোধনীও উঠে এসেছে। এই লক্ষণদৃষ্টে একাত্তরের দিনগুলিতে সন্নিবেশিত তথ্য ও তথ্যকণাকে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব তথ্যকে সূত্র হিসেবে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালানোর সুযোগ এখানে অপরিসীম।
   
এ গ্রন্থ চেনায় তৎকালীন বাংলার, বিশেষ করে ঢাকার জনসমাজের ওপরে ফেলা মুক্তিযুদ্ধের বিপুলাভার একাংশ আলো-অন্ধকার। এর নানা পৃষ্ঠা থেকে ভেসে আসে ফিসফাস ধ্বনি, পাকবিরোধী গোপন প্রস্তুতি, আকস্মিক বিধ্বংসী আওয়াজ ও অস্ফুট আর্তনাদ। এই বই পাঠে ঢাকার অভিজাত এলাকার বাসিন্দা এক গেরিলা যোদ্ধা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যোদ্ধামায়ের জবানিতে পাঠক হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে সময়ের ভাষিক উত্তাপ। এ উত্তাপে মন তাতিয়ে চিনে নেওয়া যায় নিজেকে, তুলনার গণিতে। এ যাবৎ অজস্র পাঠক এই আলোতে চিনেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও। আগামীতে চিনবেন আরো শতসহস্র জন, না-চিনে উপায় নেই বলে।

মুহাম্মদ শাকেরউল্লাহ সম্পাদিত 'ঊষালোকে'-র 'একাত্তরের দিনগুলি' সংখ্যার জন্য লিখিত

যুগপৎ পাঠকের মন ও চেতনার পড়শি

পৃথিবীর সর্বশেষ কবি
প্রথমগ্রন্থ তিন রমণীর ক্কাসিদার সূচনা কবিতা ‘প্রার্থনায় নম্র হও পাবে’র ছত্রান্তরে খোন্দকার আশরাফ হোসেন একদা ঘোষণা করেছিলেন, ‘পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি, অহংকার আমার কবিতা’। এই উচ্চারণ তাঁর পাঠকেরা মনে রেখেছেন। কিন্তু এই উচ্চকিত ঘোষণার কথা ভুলে ইতোমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন কথিত এই খাতামুন শায়ের; রেখে গেছেন ৯টি কাব্যগ্রন্থজুড়ে তাঁর বিস্তৃত শায়েরি। তাঁকে সর্বশেষ কবি হিসেবে আমাদের মানা না-মানা কোনো জরুরি বিবেচনা নয়, কারণ এ ধরনের কথার আক্ষরিক কোনো ওজন থাকে না, আমরা জানি। তবে ওই পঙক্তিসুপ্ত ইঙ্গিতকে যদি আমরা মান্য করতে চাই, তাহলে যেসব ধারণায় উপনীত হওয়া যায়, তা হলো : ১. তাঁর আগে বাংলা ও অন্য ভাষায় কবি ছিলেন, ২. বাংলা ও অন্য ভাষায় তাঁর পূবসূরি কবিদের অবদান অনস্বীকার্য, ৩. তাঁর কবিতায় সবিশেষ তারুণ্যের স্ফূরণ ঘটেছে, ইত্যাদি।

লক্ষণীয়, নতুনভাবে উত্থান ঘটে যাঁদের, লেখায় বা বলায় তাঁদের কেউ কেউ ঢালাওভাবে পূর্বসূরি কবি ও তাঁদের কাব্য-অবদানকে অস্বীকার করেন। নিদেনপক্ষে তাঁদের সিংহভাগকে হেয় করে দেখেন এবং এই ভিত্তির ওপরে দাঁড় করাতে চান তাঁদের নিজেদের কাব্যকর্মকে। ‘কেন লিখেন’ ধরনের প্রশ্নের মুখেও কারো কারো কণ্ঠে এমন কথা ধ্বনিত হতে আমরা শুনি যে, মৃতপ্রায় কবিতাসম্ভারে নবপ্রাণ সঞ্চার করার প্রয়োজনেই তাঁরা লিখে থাকেন। এটা এক ধরনের অহংকার। নববিকশিত ও বিকাশমানদের কণ্ঠে ধ্বনিত এ ধরনের অহংভাষণকে পাঠকদের একাংশ সহজভাবে মেনে নেন। নিয়ে আশায় থাকেন নতুন সৃষ্টির। তাঁরা সবাই হতাশ করেন তা নয়। সবাই মুখ রাখতে পারেন তা-ও নয়।

এঁদের অবস্থানের থেকে নিরাপদ দূরে এক উলটোপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে খোন্দকার আশরাফ হোসেন যা বলেছেন, সেটাও নিঃসন্দেহে অহংকারই। তবে এ অহংকারে পুরানোমাত্রকে অস্বীকার করা হয় নি, বরং সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। এই প্রকাশে তাঁর কাব্যপ্রবণতারই একটি শর্তের বয়ান নিহিত রয়ে গেছে। প্রাচীন রত্নসম্ভারের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেই তিনি নিজের কবিসত্তাকে গড়ে তুলেছেন। কবিতার ঐতিহ্যপরম্পরাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেজন্য প্রায়ই তাঁর কণ্ঠে বেজে উঠেছেন পূর্বসূরিরা, খণ্ডে ও সর্বাংশে। একে ঘাড় কাত করে নিন্দামন্দ করবার প্রয়াস একটা কাঁচা কাজ। সাহিত্যের ইতিহাসে এই দেওয়া-নেওয়া স্বীকৃত। সেতুসম্ভব এই যাত্রাকেই মূলের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলা বলে ধরা হয়। যেমন সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর শুরুর কবিতা ‘বেহুলা বাংলাদেশ’-এর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে স্বরে ও সরগমে আমাদের গায়ে এসে জীবনবাবুর ‘অন্ধকার’-এর আঁচ লাগতে পারে। ‘সবুজ বিষয়ক’ কবিতার পঙক্তি ‘আমার স্বদেশে সুখ্যাতি আছে সবুজের’ স্বরেও বেজে উঠতে পারে আরেক পূর্বকবির ধ্বনি। ওই স্বরে ইনিও এখানে যেন বাংলার কিংবদন্তীর কথাই বলছেন নিজস্ব ভাষায়।

বিশ্ব কবিতার সুপরিসর শস্যপ্রান্তরে তাঁর বিচরণের একাংশ পেশাতাড়িত, একাংশ নিঃসন্দেহে নেশাতাড়িত। কবি হবেন বলে। ওই বিচরণের ছাপও তাঁর কবিতায় দুর্নিরীক্ষ্য নয়। এ কথার প্রমাণ হাজির করতে তাঁর কবিতাসংগ্রহ ঘেঁটে বিস্তর নজির হাজির করবার দরকার নেই। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য এ প্রবণতার নিন্দা করা নয়। আমরা কেবল দেখাতে চাই যে, বাংলা কবিতার মতো বিশ্বকবিতার প্রাচুর্যময় ঐতিহ্যের প্রতিও তিনি উদ্বাহু ও সশ্রদ্ধ এবং ওই প্রাচুর্যের প্রতি এক ধরনের উত্তরাধিকারবোধও তাঁর ছিল। লক্ষ করলে আমরা দেখব, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর বইয়ের কয়েকটি কবিতার নামকরণও কিছু সুবিখ্যাত বিশ্বকবিতার কথা মনে রেখে করা; যেমন, টি. এস. এলিয়টের ‘দি লাভ সঙ অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রুক’-এর স্মরণে তাঁর ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’, কোলরিজের ‘দি রাইম অব দা অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’ স্মরণে তাঁর ‘বুড়ো নাবিকের প্রেমগীতি’। তিনি কবিতা লিখেছেন শেক্সপিয়ার, কীটস, জীবনানন্দ, প্রমুখকে নিয়ে। এসব তাঁর সর্বব্যাপী বিহার ও পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধারই প্রকাশ।

বিহারের এই আওতা তাঁর কবিতার জগৎকে দিয়েছে অসামান্য ব্যাপ্তি। সৌন্দর্যকে চিনিয়েছে গভীর থেকে, শিখিয়েছে শাসন করবার কলাকৌশল। দখলিস্বত্ব দিয়েছে বাংলা কবিতার একখণ্ড ফসলি ভূমির। বেদনার এই যে, লব্ধ ভূমির পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে ওঠবার আগেই কর্মময় জীবনে সমাপ্তি টানতে হয়েছে বাংলা কবিতার এই সুদক্ষ চাষিকে।

তারুণ্যের সাথে আমরণ সহবাস
এ তো গেল দেশ-বিদেশের পূর্বসূরিদের কথা। সমসাময়িক ও পরবর্তী সময়ের কবিতা ও কবিদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্রটি কেমন ছিল, তাও খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে। এ খোঁজ নেবার আমাদের সহজ উপায় আছে দুটি : ১. তাঁর বিস্তৃত কাব্যসমুদ্রে জাল ফেলা, এবং ২. তারুণ্যগর্বী কবিদের সাথে তাঁর সাহিত্যিক-যোগাযোগের ধরনটি পর্যবেক্ষণ করা। প্রথমটি ক্রমপ্রকাশ্য। শিকারে নামলেই আমরা দেখব তাঁর কাব্যসমুদ্রে কেবল ঝকমক করছে তারামাছ, যা কেবল তারুণ্যকেই মানায়। ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ কুয়াশার মুশায়েরায় পাওয়া যায়, ‘মেলার হট্টগোলের মধ্যে আমি বসে বাজাই আমার এস্রাজ/ তোমার কানেই পৌঁছায় না’ কিংবা ‘আমি পাতার ঠোঙায় ঝরাফুল নিয়ে তোমার পেছনে দৌড়াই/ তুমি ততক্ষণে পেরিয়ে গিয়েছো নক্ষত্রবীথিকা’। এমন প্রেমকাতর পঙক্তি কি ৬৩ বছরের প্রৌঢ়ের মুখে মানায়, যদি না ভেতরবাড়িতে তারুণ্যের জ্বলজ্বলে আগুন থাকে? আমাদের মনে হয়, এমন পঙক্তি তখনই লিখে ওঠা যায়, যখন কবিতারাজ্যের তরুণ থেকে তরুণতর প্রতিনিধির সাম্প্রতিকতম কবিতাটিরও খোঁজ রাখা যায়; যে খোঁজ তিনি রাখতে পেরেছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়।

আমাদের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় উপায়টি অবলম্বনের জন্য প্রায় কোনো পরিশ্রমই দরকার হয় না। কেবল এই তথ্যটি জানলেই চলে যে, সত্তরের কবিতার স্লোগানমুখরতা ডিঙিয়ে আশির তৎকালীন তারুণ্যস্পর্ধী নিরীক্ষাকে স্বাগত জানাতে, তরুণপ্রাণের নবতর কাব্যপ্রয়াস ও কাব্যচিন্তনকে জায়গা করে দিতে তিনি ১৯৮৫-তে ‘একবিংশ’ নামক কবিতা ও নন্দনভাবনার কাগজটি সম্পাদনা করতে লেগেছিলেন। বিংশ শতকের শেষপাদেই কোনো কাগজের নাম ‘একবিংশ’ রাখতে পারেন তো স্বপ্নময় তরুণপ্রাণই! শুরু থেকে একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জারি রেখে কাগজটির ২৭টি সংখ্যার গৌরবদীপ্ত প্রকাশ সুসম্পন্ন করে গেছেন তিনি, যার সর্বশেষ সংখ্যাটি বেরোয় মাত্র ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। নিজের শেষ সময়ে, তাঁর ৬৩ বছর বয়সে, প্রকাশিত সর্বশেষ সংখ্যা ‘একবিংশ’-এও পুষ্পিত হয়েছে অন্য অনেকের সঙ্গে দ্বিতীয় দশকের কবিদের কবিতা, যে বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়েছিল কাগজটির সূচনা সংখ্যাতেই। সূচনা সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, “‘একবিংশ’ কেবল নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকদের জন্য নির্দিষ্ট। যারা অপ্রতিষ্ঠিত, যৌবনাবেগে টলমল, প্রতিভাবান, উদার অভিনিবিষ্ট, শ্রমী এবং নির্ভয়, আমরা তাদের জন্য পাটাতন নির্মাণ করতে চাই। কবিতা, শুধু কবিতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ক প্রবন্ধ, কবিতালোচনা, কাব্যগ্রন্থ ও কাব্য বিষয়কগ্রন্থ সমালোচনা প্রতি সংখ্যা একবিংশ-র সূচীতে থাকবে।”

তাঁর এই তারুণ্যঘনিষ্ঠতা এবং নিজের মধ্যে বাস করা স্পর্ধাকে তিনি সযত্নে লালন করতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত, সর্বশেষ সংখ্যা ‘একবিংশ’-এর সম্পাদকীয় থেকে কয়েক লাইন তুলে দিলেই তা বোধগম্য হবে বলে আশা করা যায় : ‘একবিংশ আবার বের হলো বেশ কিছুকাল গড়িমসি ক’রে। সম্পাদকের এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার কথা, তবু ক্ষমাপ্রার্থনা তাঁর ধর্ম নয়। পাঠকরা আমাদের ভালোবাসার মানুষ, তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দরকার করে না। একবিংশ খেয়ালখুশির রঙধনু; হরেক বর্ষণের পরই রঙধনু আশা করা বৃথা।’

চাইলে আরো পড়া যেতে পারে : ‘আমাদের ঢোল নেই, তাই ক্লান্তিও নেই। ঐ যে খেয়ালখুশি, ওটা যতক্ষণ থাকবে, যতক্ষণ প্রকাশ করার, কবিতাকে সঙ্গ দেয়ার, নতুনদের সঙ্গ পাবার খুশিটা মনে ওম ছড়াবে, ততক্ষণ একবিংশ-র যাত্রা স্তব্ধ হবে না। ... একবিংশ ২৭ বের হলো একঝাঁক তরুণ কবির কবিতা নিয়ে। এই সময়কার কবিতার তরুণতম প্রতিনিধি তাঁরা। তাঁদের উচ্চারণগুলো বুকে ধরতে পেরে একবিংশ গর্বিত।’

শেষ সময় পর্যন্তও যে এই সদাতরুণ ব্যক্তিত্ব নিজের কবিতাকে সতেজ রাখতে পেরেছিলেন, এই হয়ত তার গোপন ধন্বন্তরি!  

দেশ ও মানুষের মুখের দিকে চেয়ে
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ যে, তাঁর নন্দনভাবনাটি গড়ে উঠেছে কেবল ভাষা-শব্দ-ছন্দকে ঘিরে নয়, বরং মানুষ, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার বোধ থেকেও। এ বোধ থেকে তিনি তাঁর গোটা কবিজীবনেও চ্যুত হন নি। এই অবস্থানে থেকে ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও যখনই বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের গায়ে স্বাধীনতা ও দেশবিরোধীদের চক্রান্তের কলুষ লেগেছে, তখনই তিনি জেগে উঠে জানান দিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে তাঁর বিশেষ স্পর্শকাতরতা রয়েছে। তাঁর কবিতায় সে বোধের প্রত্যক্ষ রূপায়ণও ঘটেছে। যেখানে তিনি রোমান্টিক হয়ে উঠেছেন, শব্দ-ছন্দের ঘোড়ায় চড়ে বেড়িয়েছেন, সেখানেও তিনি দেশেরই একজন চেনামানুষ হয়ে থেকেছেন। কবি তাঁর ভেতরে গজিয়ে ওঠা গাছপালাকে লুকাতে পারেন না। নানা আঙ্গিকে সেসবের ডালপালা উঁকি দেয় পঙক্তিতে-পঙক্তিতে, শব্দে-শব্দে এবং শব্দ ও বাক্যের ফাঁকে। ফলত, তাঁর কবিতাভুবনে ভ্রমণে বেরোলে যেকোনো ভ্রামণিক উপলব্ধি করতে পারবেন যে, আপন অনুভবের কলসি কাত করে ঢেলে দিয়েছেন তিনি তাঁর কাব্যসমুদয়ে; এবং তা অবহেলায় নয়, প্রেমে-ভালোবাসায়। দেশের বেদনায় কেঁদেছেন, উদ্বেলিত হয়েছেন, হতাশ্বাস ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কখনোই উল্লসিত হন নি। দেশকে যখন অন্তরে ধারণ করা যায়, তখন তার প্রতি প্রেম বোঝাতে উচ্ছ্বসিত হওয়া লাগে না। সন্তানের মন্দে উদ্বিগ্ন হওয়াই যেমন তাদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ, তেমনি স্বাভাবিক মেজাজে থেকে নন্দনচিন্তা ও নন্দনপ্রয়াসের মত্ততায়ই দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রমাণিত হয়েছে। উদাহরণ-কণ্টকিত করে এ বক্তব্যের প্রমাণ হাজির করা জরুরি নয়। যেখানে তাকালেই নমুনা, সেখান আঙুল উঁচিয়ে বলার দরকার নেই যে, এদিকে বা ওদিকে তাকান। চট করে যেতে চাইলে জীবনের সমান চুমুক-এর ‘স্বাপ্নিকের মৃত্যু’, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘বেহুলা বাংলাদেশ’ ও ‘কালপূর্ণিয়া’, প্রভৃতি কবিতা পড়ে দেখা যেতে পারে। তবে এখানে এটা বলাই যথার্থ হবে যে, এমনকি তাঁর বর্ষাও দেশবিরহিত কিছু নয়।

কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার মতো গৌরবের একজন ভাগিদার। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং তাঁর সতীর্থ যোদ্ধাদের বীরকাহিনির ধারাক্রম বর্ণনা করেও তিনি কিছু কবিতা লিখেছেন, যেগুলো বাংলা কবিতার অমূল্য সম্পদ। পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘বাউসী ব্রীজ ৭১’, ‘সাহেবালি যুদ্ধে গিয়েছিলো’, ‘নোটনের জন্য শোক’; জন্মবাউল-এর ‘বধ্যভূমি থেকে’ এই ধারার কবিতা। তাঁর অন্য অনেক কবিতার মতো এসব কবিতায়ও এক ধরনের গল্পময়তা আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্ণনার গুণে এগুলো কবিতাই। যেমন সাহেবালির বর্ণনায় কবি বলছেন ‘কার চুল চরের ঝাউয়ের মতো অন্ধকারে ওড়ে?’; নোটনের বর্ণনায় পুথিকিতাবের সৌন্দর্য মাখিয়ে লিখছেন, ‘কাশেম ফিরবে বলে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে মেহেন্দি সখিনা’।

যমুনাপর্ব গ্রন্থের ‘নূরজাহান’ সিলেটে পাথর ছুড়ে মারার জঘন্য ফতোয়ার শিকার কৃষককন্যা নূরজাহানকে নিয়ে লেখা কবিতাটি একটি মাইলফলক। এখানে কোনো সাংবাদিকসুলভ ট্রিটমেন্ট লভ্য নয়। বরং বিষয়বস্তুর অন্তর্গূঢ় শক্তির সাথে শব্দপ্রতীকের সুষম মিশ্রণে এখানে তিনি তৈরি করেছেন অনন্য এক স্পর্শকাতরতা। বলেছেন, ‘ঐ মেয়ে একদিন আবাবিল হবে’। প্রকৃতই নূরজাহান তা হোক বা না হোক, তাঁর এই অভিপ্রায়টি পাঠককে এক টুকরো স্বস্তি দেয়, ফতোয়াবাজদের জনপ্রত্যাশিত ভয়ানক পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করে।

এসব বৈশিষ্ট্য পাঠকসমাজে তাঁকে এমন এক কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যিনি মানুষ ও তাদের আপামর সুখ-দুঃখঘেঁষা।

শব্দছবির মহারাজ
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের শব্দছবি আঁকার বাহাদুরি মনোমুগ্ধকর। প্রায়-কবিতায়ই তাঁর এত ছবি এদিক-ওদিক নানা দিক থেকে দেখা ও আঁকা যে, দেখতে দেখতে মনে হয় তিনি শব্দছবির মহারাজ। ছবির, শব্দছবির, কল্পছবির এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার যেন তাঁর কবিতা। এক জীবনে এত কল্পছবি এঁকে ওঠবার সক্ষমতা পাঠকের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। ৬৩ বছরের জীবনটার একটা বড়ো অংশ যে তিনি ব্যস্ত থেকেছেন নন্দনঘোরেই, বিষয়বাসনায় নয়, এসব দক্ষতা তা ভাবতে প্ররোচিত করে।
 
তিন রমণীর ক্কাসিদা-র ‘উন্মথিত নাভিমূলে জেগে ওঠে মেঘনার চর’ (‘দুর্বোধ্য নায়ক’), পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘পড়ে আছি রাজপথে ঈশ্বরের রুগ্ণ বীর্য’ (নুলো ভিখিরির গান); জীবনের সমান চুমুক-এর ‘কে যেন বিপুল ঠ্যাং ফাঁক করে আকাশ উঠোনে/ ছপছপ জলস্রাবে ডুবিয়ে ভাসিয়ে দিল/ প্রান্তর’ (হনন) বা ‘শুকনো বালির কুকুরছানারা এসে চুমু খাচ্ছে গোড়ালিতে’ (বেলাভূমিতে শেষবেলায়) বা ‘একসারি ভল্লুকের মতো ধীর পায়ে এগোচ্ছে কুয়াশা’ (নকটার্নগুচ্ছ ১); যমুনাপর্ব-এর ‘হুইসেল বাজাচ্ছে বাতাস, শালাকো পাকাড় লো--/ দৌড়ুচ্ছে বেদম ঝরাপাতা, প্রেমপত্র ঠোঙার শহর’ (চাদরের স্বৈরাচার); জন্মবাউল-এর ‘সবুজ গদ্যের বিরামচিহ্নের মতো/ জেগে আছে খোড়ো বাস্তুকলা’ (জীবনানন্দের চিল) বা ‘সকাল যখন পুচ্ছ নাচাতে নাচাতে যায় ইশকুলে’ (নীল সোয়েটার)-- আমাদের বিশেষভাবে চমকিত করে। ভাষাকে, ঘটনাকে, ঘটনার বর্ণনাকে কবিতা করে তুলবার এই সুপরিচিত কৌশলটি তিনি বেশ দক্ষতার সাথে রপ্ত করে উঠেছিলেন।

কোনো কোনো শব্দছবি তাঁর এতই ভালোলাগা ও নিজস্ব যে, ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর কবিতা থেকে কবিতায়, বই থেকে বইয়ে; যেমন তিনি যে ‘তারাদের হল্কায়ে জেকের’ শুনেন সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘তাসের খেলা’য়, তাই আবার শোনেন ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’তে। আবার ওই ‘প্রুফ্রকের প্রুফকপি’তে যেমন দেখেন ‘শূন্য/ রাজপথে ফিগার স্কেটিং করে বাদামের খোসা’, তেমনি ‘কবিতা কোলাজ’-এর ‘অদ্ভুত’জুড়েও দেখতে পান ‘প্রান্তরের এপার থেকে ওপারে/ ফিগার-স্কেটিং করছে মেঘ’। হলকায়ে জেকেরের প্রসঙ্গ উঠে আসতে দেখি অন্য গ্রন্থগুলোতেও। যমুনাপর্ব-এ পাই : ‘আলখাল্লায় আবৃত বুজুর্গরা/ ঝিমায় আর অস্ফুট হলকায়ে জেকের গায়’ (হরতাল ৯৬); জন্মবাউল-এ পাই, ‘হলকায়ে জেকের গেয়ে ভরে তোলে কোর্টের প্রাঙ্গণ’ (শেক্সপিয়ারের দস্তানা)। এদিকে একই আলখাল্লাকে তিনি কত ঢঙে কত বিচিত্রভাবেই না ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়! জীবনের সমান চুমুক-এ পাই, ‘মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না/ না নিসর্গ না ঈশ্বরের দিগন্ত-প্রসারী আলখাল্লা/ না নদী না জন্মভূমি’ (মানুষ) বা ‘কেবল তারার উঠোনে/ জমা হচ্ছে দীর্ঘ আলখাল্লা-পরা অন্ধকার, শ্মশ্রুময় পুরুষেরা/ একাকার’ (নকটার্নগুচ্ছ ১)। এই শব্দছবির মহারাজের হাতে কবিতামাত্র রঙচঙে ও বর্ণিল হয়ে উঠেছে, তা যখন তিনি দেশের জন্য কেজো কবিতা লিখেছেন তখনো।

নারী নয়, রমণীখচিত
এটা এক অদ্ভুত আবিষ্কার যে, ‘নারী’ খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায় ব্যাপকভাবে উপস্থিত; তবে তা যতটা ‘নারী’রূপে হাজির, তার চেয়ে কম নয় ‘রমণী’ভঙ্গিতেও। অর্থাৎ তাঁর কবিতাবিশ্ব রমণীখচিত। কেন এমন? আমরা বলতে পারি না। ‘রমণী’ না থেকে যদি ‘নারী’ই উপস্থিত থাকতেন বেশি, তা-ও প্রশ্ন করা যেত, কেন এমন? তার জবাবও হতো হয়ত এই যে, আমরা জানি না। তবে ‘রমণী’স্থলে ‘নারী’ হলে আমরা যেভাবে খুশি হতে পারতাম, ‘নারী’স্থলে ‘রমণী’ থাকায় আমরা সেভাবে খানিক অখুশি। কারণ শব্দগতভাবে ‘রমণী’ ‘নারী’র যে রূপ হাজির করে, তা রমণঘনিষ্ঠ, ভোগলগ্ন। নারীর প্রকৃত মাহাত্ম্য তার রমণগুণে স্পষ্ট হয় না, হয় নারীত্বগুণে। আমরা দেখি, তিন রমণীর ক্কাসিদার ‘এলিয়েন’ কবিতায় তিনি ‘রমণী’র আমাদের জানা সংজ্ঞাই লিখেছেন, ‘রমণযোগ্যা বলে রমণী যার নাম’। তবু তাঁর কবিতা থেকে কবিতায় রমণীর সসন্দেহ উপস্থিতি : ‘দেখেছি রমণীকুল শুভ্রবেশ, করতলে জন্মান্তর-পথ/ বুক জুড়ে ধাপাল সন্তান নয়, সদ্য কেনা শাড়ির মোড়ক/ মধ্যরাত যেই নারী খুলে দেয় কারো কাছে অজানা সড়ক/ দিবাভাগে তার মুখে কি সলজ্জ পবিত্র শপথ!’ (‘সুখ তুমি সঙ্গে যাবে’, তিন রমণীর ক্কাসিদা)। পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘ফেব্রুয়ারিতে জনৈক বাগান মালিক’ কবিতায় পাই ‘আমাদের রমণীরা কোনো কালে ধর্ষিতা হয়েছে কিনা/ তাদের ভ্রূভঙ্গি দেখে হাসির ফোয়ারা দেখে/ ভুলেও পড়ে না মনে’। কেন তিনি আশা করেন যে, জীবনের সমস্ত আনন্দ-হাসি বিসর্জন দিয়ে ধর্ষিতা তার ধর্ষণের লক্ষণকে সারাজীবন কপালে ধারণ করেই ফিরবেন? করেন কারণ তিনি ভাবেন ধর্ষণকে উদযাপন করাও সম্ভব! ‘কেননা মৃত্যু আর ধর্ষণ/ ঠেকাতে না পারা গেলে উদযাপনই ভালো’ (‘আগন্তুক’, যমুনাপর্ব)। পাঠক হিসেবে আমরা বেশ আহতই হই, তাঁর এমন নারীচিত্রণে।

তবে হ্যাঁ, চোখ রাখলে দেখা যায় তাঁর রমণীরা ক্রমশ নারী হয়ে উঠেছে পরের কবিতাগুলোয়। কিন্তু তবু, অক্ষরবৃত্তে তিনমাত্রার যে চাহিদা তাঁর থেকে গিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন কখনো কখনো রমণীর নিকট-আমেজেরই জন্ম দিয়েছে; যেমন যমুনাপর্ব-এর ‘ওড টু জনাব কীটস’-এ তিনি বলছেন, ‘বিয়োবার দেরি নেই যে-সুন্দরীর’। এখানে তিনি প্রসবের কলোক্যুয়াল ‘বিয়ানো’ দিয়ে প্রসবঘটনাকে তাচ্ছিল্য করার পাশাপাশি নারীকে রমণী নয়, একেবারে সুন্দরীতে নিয়ে ঠেকিয়েছেন! এটা ঠিক যে সুন্দরী নারীরাও প্রসব করেন। তবে আমরা কী করে ভুলে যাব যে, প্রসবঘটনা এমন ঘটনা যেখানে সুন্দরী বা অসুন্দরী হওয়া কোনো আলাদা গুরুত্ব বহন করে না?

লোকায়ত বাগভঙ্গিতে ছন্দচিচিত্রা
খোন্দকার আশরাফ হোসেন আমূল বাঙালি কবি। বাংলাকে তাঁর কবিতায় নিবিড়ভাবে পাওয়া যায়। লোকমানসের অন্তরস্পর্শ করবার মতো বিষয় ও ভাষা তাঁর মধ্যে বরাবরই কম-বেশি লক্ষণীয় হলেও সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর থেকে পরের কয়েকটি গ্রন্থে লোকায়ত বাগভঙ্গিটা তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এ সময় থেকে তাঁর মধ্যে সুফি দর্শনের সরল-গভীর রূপটিও জায়গা করে নেয়।
 
তিন রমণীর ক্কাসিদা-র ‘চতুষ্পদ দর্শন’, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘বৌমাছ’, ‘যাত্রা’, ‘ধানরমণী’, যমুনাপর্ব-এর ‘কৈবর্ত্যপুরাণ’সহ অনেকানেক কবিতায় বাংলার মাঠঘাটের বিশ্বস্ত ছবি, বাঙালিয়ানার সুবাস মাখিয়ে রেখেছেন তিনি। গ্রিক ও সেমেটিক পুরাণের পাশাপাশি বাংলার লোকপুরাণেরও ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায় তাঁর কবিতায়। বাংলার লৌকিক পুরাণের অনেক চরিত্র তাঁর কবিতায় স্বরূপে হাজির হয়েছে। যমুনাপর্ব-এর ‘বাসন্তীকথা’, জন্মবাউল-এর ‘সদানন্দের পদাবলী’তে পদাবলীর ঢঙে আধুনিক চিন্তাচেতনতাকে স্থাপন করে তিনি উত্তরাধুনিক সময় যাপনের ছবি এঁকেও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পয়ারের বিভিন্ন দোলা সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে এসব কবিতায়।

তিনি প্রধানত বিচিত্রমাত্রিক অক্ষরবৃত্তেই তাঁর কাব্যালাপ সেরেছেন। তবে অন্যান্য ছন্দে লেখা কবিতাও তাঁর ভাণ্ডারে লভ্য। মাঝে মাঝে স্বরবৃত্তের ঘোড়ায় চড়েও পরিকল্পিত ভ্রমণ সেরেছেন তিনি। যেমন পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘আত্মপক্ষ’, ‘পরকীয়া দুয়ার খোলো’, জীবনের সমান চুমুক-এর ‘ঝাপুই খেলা’, অংশত ‘শ্রাবণযাপন’ সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘ঘৃণার ঘুঙুর’, অংশত ‘চিকিৎসা’, ‘কবিতা কোলাজ’-এর ‘পদাবলী’পথে যেতে আমরা নেচে উঠি, নাচতে নাচতে ফের থামি আত্মতুষ্ট হয়ে। মাত্রাবৃত্তের চমৎকার দোলাও তৈরি করেছেন পার্থ তোমার তীব্র তীর-এর ‘নীল সাবানের প্রেম’, জীবনের সমান চুমুক-এর ‘কসাই’, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর-এর ‘বুড়ো নাবিকের প্রেমগীতি’ প্রভৃতি কবিতায়। কারো কারো কাছে তাঁর এমন ছন্দবিচিত্রাও মনোযোগ দিয়ে কাছ থেকে দেখবার জিনিস বলে মনে হতে পারে।

উপসংহার নয়, যাত্রার শুরু
কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের জীবন ফুরিয়েছে, শুরু হয়েছে তাঁর কবিতার জীবন। কর্মীষ্ঠ মানুষের, তথা শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানীর জীবন কেবল তাঁদের দৈহিক জীবনলগ্ন নয়, কর্মলগ্নও। ফলে তাঁরা চলে গেলেও তাঁরা যে কর্ম রেখে যান, তা যদি মানুষের মধ্যে বাঁচে, তবে তার মাধ্যমে তাঁরা নিজেরাও বেঁচে থাকেন।

আমরা নিশ্চিত করতে পারি না যে, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কাব্যকর্ম পাঠকের মধ্যে বেঁচে থাকবেই। এসব ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। পাঠকের বিবেচনাই এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে যদিও, তবে তার প্রেক্ষাপটে কাজ করে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত। প্রতিকূল প্রেক্ষিতের কারণে যেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী-কবিও সাময়িকভাবে বিস্মৃত হয়ে যেতে পারেন, তেমনি আবার অনুকূল প্রেক্ষিতে দীর্ঘ বিস্মৃতির পরও কেউ কেউ নতুন করে ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে শুরু করতে পারেন। আমরা এর সম্ভাব্যতাকে কিছুটা বাজিয়ে দেখতে পারি মাত্র, যদিও তাঁর এক সম্পন্ন ধমক সয়ে, যে, ‘আমাকে বুঝতে চাও এ সাহস কবে থেকে হলো?’ (‘দুর্বোধ্য নায়ক’, তিন রমণীর ক্কাসিদা)!

আমাদের উপলব্ধি এমন যে, যেসব কবিতা কোনো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত নয়, যেসব কবিতা মানুষের নীরবতাকে, একাকিত্বকে, যাপনবিস্ময়কে শব্দ ও ধ্বনিরূপ দেয় মাত্র, তাদের কাছে পাঠকেরা উদ্দেশ্যহীনভাবে যায়। গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবেই মগ্ন হয়ে থাকে। কিন্তু যেসব কবিতা উদ্দেশ্যতাড়িতভাবে লিখিত হয়, সেসবের কাছে উপলক্ষ নিয়ে যেতে হয়, পাঠকেরা সেভাবেই যান। খোন্দকার আশরাফ হোসেনে সমানভাবে দু’রকম কবিতাই লভ্য, কোনোটাই কম বা বেশি নয়।

যেসব কবিতার কাছে যেতে প্রয়োজনতাড়িত হওয়া লাগে, গিয়ে প্রয়োজন মিটলে সটকে পড়তে হয়। আবার প্রয়োজন অনুভূত হবার আগে আর ও-মুখো হওয়া যেখানে হয়ে ওঠে না, সে ধরনের কবিতা একইসঙ্গে অমূল্য ও মূল্যহীন। যুতসই প্রয়োজনে লাগে এমন বস্তুরাজির ওপর সমাজ অপরিসীম মূল্য আরোপ করে থাকে। বৈষয়িক সমাজ বিষয়ভাবনার বাইরে আর সবকিছুকে অর্থহীন গণ্য করে, ফেলনা ভাবে; এবং তার সমুদয় পক্ষপাত জারি রাখে প্রয়োজনীয় বস্তুর প্রতি। এভাবে কেজো লেখাগুলো অমূল্য হয়ে যায়। আবার জৈবনিক প্রয়োজনে বিষয়ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকা মানুষ মাঝে মাঝে অবৈষয়িক হয়ে উঠতে চায়। মানুষমাত্রের মধ্যেই কমবেশি এ চাওয়া থাকে। যাদের মধ্যে বেশিমাত্রায় থাকে, তাদের মধ্যে যাঁরা কবিতালগ্ন, কবিতাপ্রেমিক, তাঁরা তাঁদের অবৈষয়িকতাকে মহিমান্বিত করা যায় এমন ধারার কবিতা খুঁজে ফেরেন। এ অনুসন্ধানক্রিয়া কখনোই এ ধরনের কবিতার কাছে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। কাজেই তাঁদের কাছে এ ধারার কবিতা একেবারেই মূল্যহীন। সে অনুযায়ী এ ধরনের পাঠকের তাঁর কেজো কবিতার কাছে যাবার কথা নয়। কিন্তু যেহেতু তিনি এ ধারার পাঠকের উপযোগী কেবল শব্দে-ছন্দে ঘোরাচ্ছন্ন কবিতার চর্চাও করেছেন, অর্থাৎ তাঁর ভাণ্ডারে যেহেতু এদের প্রসাদও লভ্য, কাজেই ধারণা করা যায়, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতা, আখেরে, দুই মেরুর মানুষেরই যাতায়াতবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ আমাদের বিবেচনায়, পাঠক পরিসরে তাঁর টিকে থাকার সম্ভাবনা, প্রকটতর।

যাই হোক, কোনোরূপ ভালোমন্দের উদাহরণ হিসেবে নয়, কোনো পাদটীকা যুক্ত না-করেই, এমনি এমনি, তাঁর ছোট্ট একটি কবিতা পড়ে আমরা আমাদের এ কিস্তির কথাবার্তা শেষ করতে চাই। ‘ভূয়োদর্শন’ নামের এই কবিতাটি তাঁর জন্মবাউল বই থেকে নেয়া :

দুঃখ হলো এক গিটার যে বাদকের আঙুল কেটে
নিজের তারের ধার পরীক্ষা করে;
সুখ এমন বাড়িঅলা, ঘর খালি নেই তবু টু লেট
নামায় না; দুঃসময় এমন বিরাট গেট
যার ভেতর দিয়ে দেখা যায় বন্ধুর আসল মুখ;
আর প্রেম হলো এমন বালিশ, মাঝেমধ্যে
যাকে খাওয়াতে হয় রোদের আদর, না হলে
দুর্গন্ধ ছোটে; আর বিরহ একটি ফেলে-যাওয়া সুটকেস
যার চাবি চলে গেছে মালিকের সাথে, ডুপ্লিকেট নেই।

বৌ হলো আপনার পুরনো অ্যাকাউন্ট, প্রতিবার
টাকা উঠাতে ঝামেলা হয়, কেননা স্বাক্ষর মেলে না; আর
আপনার সন্তানেরা? আপনার কবরের দূরত্বমাপক :
এমন পথিকের পায়ের ছাপ যাকে বাঘে নিয়ে গেছে॥

রচনাকাল : অক্টোবর ২০১৩।  সরকার আশরাফ সম্পাদিত 'নিসর্গ'-এর খোন্দকার আশরাফ হোসেন সংখ্যায় ফেব্রুয়ারি ২০১৪-এ প্রকাশিত।

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...