Thursday, June 26, 2014

একাত্তরের দিনগুলি : মুক্তিযুদ্ধের গায়ের মাপে তৈরি অ্যাপ্রোন

জীবদ্দশায় কবি-সাংবাদিক সাইয়িদ আতিকুল্লাহ সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার মাধ্যমে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, “’৭১-এর ঢাকা শহরের অবস্থা এবং গেরিলা তৎপরতা বুঝবার জন্য এই বইটি অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে। ঢাকায় গেরিলাদের তৎপরতা নিয়ে এত ভাল বই এখন পর্যন্ত আর কেউ লিখেছেন বলে জানিনে। দলিল-প্রমাণাদি সম্পর্কে উদাসীন বাঙালিদের জন্য জাহানারা ইমাম এক অমূল্য দলিল উপহার দিয়েছেন।” তাঁর এই ভাষ্যকে আক্ষরিকভাবে মেনে না নেবার মতো কারণ এখানে এখনো অনুপস্থিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা তৎপরতা বিষয়ে জানা মতে এ গ্রন্থটি আজো অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

দিনলিপি দেখে দিনের চোখে দিন ও রাতকে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতাব্যাপী ব্যাপ্ত তার পরিসরকে। এই তার নৈমিত্তিক শৈলীপনা। কখনো যে এই রীতির ব্যত্যয় ঘটে না, এমন নয়। মাঝে মধ্যে এই নৈমিত্তিকতার সমতলে উড়ে এসে ঢুকে পড়ে অতীত দিনের দুয়েকটা ঝরাপাতা; চাই কী কখনো উঁকি মারে সম্ভাবনামাখা ভবিদিনও, আশঙ্কা বা স্বপ্নপাখি হয়ে। এই দ্বিবিধ ব্যতিক্রমী ডানা ঝাপটানিসহ বাংলাভাষায় রচিত অবিস্মরণীয় দিনলিপি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ মধ্যবয়সে ফের এসে সামনে দাঁড়ায় লোনাগর্জন হয়ে। চোখ বুজে এ গর্জনে কান পেতে চার দশকেরও অধিক প্রাচীন এক রক্তনদীর ছলাচ্ছলের মুখে পড়ে আমি নতুন করে চুরমার হয়ে যেতে থাকি। ফের গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াই। সুউচ্চ একেকটা ঢেউকে এগিয়ে আসতে দেখে বুক পেতে রাখি। ফেনা ও বুদ্বুদসহ বুকের সৈকতে তীব্র শক্তিতে তা আছড়ে পড়ে। এ আঘাত সয়ে সয়ে আরো কোনো প্রকাণ্ড ঢেউয়ের আঘাত সইবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এক-দু’পা করে সামনে এগোই। ভেঙেচুরে ভেসে যাই, আবার উঠে দাঁড়াই আমি সমুদ্রের সমান বয়সি। জানি ক্রমে লীন হয়ে যাব একদিন, তবু সতত প্রবহমান এ রক্তনদীর ছলাচ্ছল কখনো থামবে না বলে ধারণা হয়।

একাত্তরের মার্চের প্রথম দিনে থেকে এ গ্রন্থের শুরু, সমাপ্তি ডিসেম্বরের সতেরোয়। যেন ন’মাস দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের গায়ের মাপে তৈরি এ অ্যাপ্রোন। যেদিক দিয়েই একে উন্মোচন করা যায় সেদিক দিয়েই অগ্নিহল্কা, গেরিলাপ্রয়াসের সাফল্য-ব্যর্থতা, আকণ্ঠ উদ্বেগ। যেদিক দিয়েই তাকানো যায়, সেদিক দিয়েই রক্তক্ষত, স্তব্ধতার আওয়াজ। আশা-নিরাশা-আশঙ্কার দোলাচলে বর্ণিল ভাষানির্মিত এ এক সময়শরীর।

পহেলা মার্চ রেডিওতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালির মনে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে, সে আগুনের হল্কা ছড়ায় ঢাকাসহ গোটা বাংলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পূর্বাণী হোটেল, পল্টন ময়দানের রূপচেহারা মুহূর্তে বদলে যায়। হরতাল-কারফিউর আশঙ্কায় নিত্য প্রয়োজনীয় চাল-ডাল খরিদ করতে দোকানপাটে ভিড় বাড়ে মানুষের। পরিস্থিতির আঁচ লাগে ঘরে ঘরে। সংগত কারণে বদলে যায় ইমাম-পরিবারের স্বাভাবিক নৈমিত্তিকতাও। এই অশান্ত পরিস্থিতির শান্ত বর্ণনা দিয়ে গৃহপ্রবেশ ঘটিয়ে গ্রন্থটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-সাহস-শৌর্য, রক্ত-কান্না-হতাশা-অসহায়ত্বের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে অবিস্মরণীয় বীরত্বগাথা শুনিয়ে বিজয়ের পতাকা হাতে ধরিয়ে পরে পাঠককে নিস্তার দেয়।
   
এই দিনলিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ, বলা যায় প্রধান আলোকেন্দ্র জাহানারা ইমামের তারুণ্যস্পর্ধী বড়ো ছেলে শফি ইমাম রুমী। ততদিনে সে আইএসসি পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে। একইসঙ্গে ভর্তি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে, যেখানে ক্লাস শুরু হবে দোসরা সেপ্টেম্বর। এই ফাঁকে বাবা শরিফ ইমামের প্রতিষ্ঠানে মাঝেমধ্যে ড্রইংয়ের কাজ করে। পাশাপাশি বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিকস বিভাগের ক্লাসে যুক্ত হয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও ভেজে খাওয়া সমাজতান্ত্রিক আদর্শের একজন সৈনিক সে। বিতার্কিক হিসেবেও নিজের দক্ষতা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে। তার এ দক্ষতা প্রকাশ পায় বাসার চায়ের টেবিলেও। এরকম একটি ছেলের পড়াশোনা, খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে মাস্তি করা ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক কাজকর্ম নিয়ে যেভাবে মত্ত থাকবার কথা, দেশের আকাশে যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে আসায় সে জীবনে ব্যত্যয় ঘটেছে। রুটিনে জায়গা নিয়েছে অন্য কিছু, দেশমুক্তির উপায় অনুসন্ধান। তাই পড়ার টেবিলে বা খেলার মাঠে নয়, সময় কাটে মিছিল-মিটিংয়ে, বিক্ষোভে, গোপন যুদ্ধ পরিকল্পনায়, কারফিউপ্রবণ সময়ের আড়ালে প্রয়োজনীয় ফিসফিসানিতে।

বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ ভেঙে নেমে এসেছে পথে, পথে পথে ব্যারিকেড তৈরি হচ্ছে, বিক্ষোভ চলছে। ক্ষুব্ধ জনতাকে দমাতে ওই পক্ষ থেকে প্রতিদিন গুলি চলছে, প্রতিদিন শহীদ হচ্ছে কেউ না কেউ। শহীদদের মরদেহ নিয়ে আবার বিক্ষোভ হচ্ছে। দেশদ্রোহিতার ভয়ে ভীত না হয়ে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবিত পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। বক্তৃতায় স্বাধিকারের দাবি তোলা হচ্ছে। এর মধ্যেই কারফিউ-গুলির পাশাপাশি সামরিক ফরমান জারি করে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্ব পরিপন্থী খবর, মতামত বা চিত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদিকে রেডিওকর্মীদের সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ফরমান বলে ৭ মার্চে রেসকোর্সে দেওয়া শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আসে। প্রতিবাদে কর্মীরা সব ধরনের প্রোগ্রামই বন্ধ করে দেন। পরদিন সকালে এ ভাষণ প্রচার সম্ভব হয়। এরকম পরিস্থিতিতে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে যেখানে একটি মাত্র গুলির ব্যবধান, সেখানে মা হিসেবে জাহানারা ইমাম চান ছেলেকে বুকের কাছে আগলে রাখতে। কিন্তু যার স্বপ্নে জায়গা নিয়েছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, তাকে যুদ্ধের মাঠের পরিবর্তে ঘরে ধরে রাখা অসম্ভব। পারেন নি জাহানারা ইমামও।

স্বাধিকার না স্বাধীনতা এই নিয়ে সর্বত্র তুমুল তর্ক। অনেকেই আশা করেছিলেন, শেখ মুজিব রেসকোর্সে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কিন্তু তিনি স্বাধীনতা প্রশ্নে “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”-এর মতো পরোক্ষ উক্তি করে তাঁর ভাষণ শেষ করেন। তাঁর এই ভূমিকায় অনেকেই নাখোশ। যাঁরা এর পক্ষে তাঁরা মনে করেন এটাই সঠিক ছিল, ওই মুহূর্তে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতো, যেখানে আলোচনা চলমান। এই দ্বিধা-সংশয়ের মধ্যেই মওলানা ভাসানী ৯ মার্চে পল্টনের সভায় সরাসরিই স্বাধীনতার প্রশ্নটি তোলেন, “বর্তমান সরকার যদি ২৫ মার্চের মধ্যে আপসে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা না দেয়, তাহলে ‌'৫২ সালের মত মুজিবের সঙ্গে একযোগে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম শুরু করব।” রুমী ভাসানীর ভূমিকাকেই সমর্থন করে। তার মানে সে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হয়ে গেছে যুদ্ধে যাবার জন্য। বুঝে গেছে, আলোচনা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। আলোচনার অজুহাতে ওরা সময় নিচ্ছে মাত্র। তাই মায়ের সাথে আলাপে তার মত এভাবে প্রকাশ পায় : “ওরা আমাদের স্বাধীনতা দেবে না। স্বাধীনতা আমাদের ছিনিয়ে নিতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম করে।”
  
মায়ের বিবেচনায় রুমীর আচরণ দিনকে দিন রহস্যময় হয়ে উঠতে থাকে। ওর চালচলনে একটা উদভ্রান্ত ভাব জায়গা নিয়ে নেয়। মায়ের চোখ এসব এড়ায় না। অ্যাস্ট্রলজি নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না জেনেও পারিবারিক বন্ধু কথাসাহিত্যিক ও অ্যাস্ট্রলজার অজিত নিয়োগীর কাছে তাঁর কপালে পুত্রশোক আছে কি না সে ব্যাপারে জানতে চান। তিনি ‘রুমীর মঙ্গল খুব প্রবল’ ও ‘মঙ্গল যুদ্ধের রাশি’ জানিয়ে ওকে সাবধানে রাখবার কথা বলেন।

আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে দিনে দিনে ঢাকায় এসে পৌঁছে অজস্র পাক সামরিক অফিসার, সাদা পোশাকে হাজার হাজার সাধারণ সৈনিক। চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে অস্ত্রভর্তি জাহাজ, যদিও বীর চট্টলাবাসী অস্ত্র খালাসের আয়োজন প্রতিহত করে দেয়। এদিকে খোদ প্রেসিডেন্ট ঢাকায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও অফিস-আদালত-ব্যাঙ্ক কার্যত চলতে থাকে মুজিবের নির্দেশে। টিক্কা খানকে কোনো বিচারপতি শপথ পড়াতে রাজি না হওয়ায় তাঁর গভর্নর হওয়া হয় না, বরং মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। সেনাবাহিনীর কাছে কোনো বাঙালি খাবার বিক্রি করছে না, ফলে পাকিস্তান থেকে প্লেনে করে খাবার আনতে হচ্ছে। এরকম অবস্থায় বড়ো ধরনের অপারেশনের নির্দেশ দিয়ে আলোচনা অমীমাংসিত রেখে ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কাউকে না জানিয়ে পাকিস্তানে ফিরে যান। পথে পথে আর্মি নামে। রাতে শুরু হয় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ-- অপারেশন সার্চ লাইট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু এলাকাকে শ্মশানে পরিণত করে ফেলা হয়। কালরাতের এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ও কয়েকদিন ধরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে-শুনে স্বাভাবিকভাবেই রুমীর ভেতরে ভাংচুর শুরু হয়। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পূর্বাহ্নেই ওর এমন কিছু ঘটতে পারে।

যুদ্ধে যাবার ব্যাপারে মায়ের অনুমতি পাবার জন্য সে নিয়মিত বিতর্ক চালিয়ে যেতে থাকে। অনেক ছেলেই বাবা-মাকে না জানিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে গেছে। কিন্তু ওর পারিবারিক শিক্ষাটাই এমন যে, সবকিছুই অভিভাবককে বলেকয়ে করতে হবে। এ কারণেই সে সর্বোচ্চ যুক্তির মারপ্যাঁচ চালায় : “আম্মা শোন, ছাত্রজীবন লেখাপড়া করার সময় এসবই চিরকালীন সত্য; কিন্তু ১৯৭১ সালের এই এপ্রিল মাসে এই চিরকালীন সত্যটা কি মিথ্যা হয়ে যায় নি? চেয়ে দেখ, দেশের কোথায় সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনধারা বজায় আছে? কোথাও নেই। সমস্ত দেশটা পাকিস্তানি মিলিটারি জান্টার টার্গেট প্র্যাকটিসের জায়গা হয়ে উঠেছে। রোমান গ্ল্যাডিয়েটরের চেয়েও আমাদের অবস্থা খারাপ। একটা গ্ল্যাডিয়েটরের তবু কিছুটা আশা থাকত, একটা সিংহের সঙ্গে ঝুটোপুটি করতে করতে সে জিতেও যেতে পারে। কিন্তু এখানে? সেই ঝুটোপুটি করার সুযোগটুকু পর্যন্ত নেই। হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, কট্কট্ করে কতগুলো গুলি ছুটে যাচ্ছে, মুহূর্তে লোকগুলো মরে যাচ্ছে। এই রকম অবস্থার মধ্য থেকে লেখাপড়া করে মানুষ হবার প্রক্রিয়াটা খুব বেশি সেকেলে বলে মনে হচ্ছে না কি?”

মা প্রতিশ্রুতি দেন তাকে কিছুটা আগেভাগেই আমেরিকায় পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু এতে ছেলে খুশি হয় না। বলে : “আম্মা, দেশের এ অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?”

এবার মা যুক্তির কাছে পুরোপুরি পরাস্ত। তিনি ইতোমধ্যে নিশ্চিত যে, তাঁর ছেলে হুজুগে মেতে নয় বরং মনেপ্রাণে প্রয়োজন উপলব্ধি করেই যুদ্ধে যেতে চাইছে। তিনি জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বলেন, “না, তা চাইনে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।”

এবার রুমী প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যাবার উপায় অনুসন্ধানে রত হয়। কিন্তু সঠিক যোগাযোগের লোক খুঁজে পেতে বিলম্ব হয়। শুরুতে বর্ডার ক্রস করা সহজ ছিল। এতদিনে বেশির ভাগ জায়গায়ই পাকিস্তানি সৈন্যদের কড়া প্রহরা। তবে তেসরা মে মায়ের জন্মদিনে রুমী জানায় যে, ওর ঠিকমতো যোগাযোগ ও যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কবে, কাদের সঙ্গে যাবে, মা জানতে চান। জবাব পাওয়া যায়, “তিন-চারদিনের মধ্যেই। কাদের সঙ্গে-- নাম জানতে চেও না, বলা নিষেধ।” মায়ের মনে হয় “লোহার সাঁড়াশি দিয়ে কেউ যেন পাঁজরের সবগুলো হাড় চেপে ধরেছে।” মা তাঁর অনুভূতির প্রকাশ ঘটান এভাবে : “নিশ্চিদ্র অন্ধকারে, চোখের বাইরে, নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দিতে হবে। জানতে চাওয়াও চলবে না-- কোন পথে যাবে, কাদের সঙ্গে যাবে। রুমী এখন তার নিজের জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তার একান্ত নিজস্ব ভুবন, সেখানে তার জন্ম-দাত্রীরও প্রবেশাধিকার নেই।” তাঁর তখন মনে পড়ে কাহলিল জিবরানের ‘প্রফেট’-এর পঙক্তিরা : ‘তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়’। কার তবে?

‘তারা জীবনের সন্তানসন্ততি
জীবনের জন্যই তাদের আকুতি।
তারা তোমাদের সঙ্গেই আছে
তবু তোমাদের নয়।
তারা তোমাদের ভালোবাসা নিয়েছে
কিন্তু নেয় নি তোমাদের ধ্যান-ধারণা,
কেননা তারা গড়ে নিয়েছে
তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা।
তাদের শরীর তোমাদের আয়ত্তের ভেতর
কিন্তু তাদের আত্মা কখনই নয়
কেননা, তাদের আত্মা বাস করে
ভবিষ্যতের ঘরে,
যে ঘরে তোমরা কখনই পারবে না যেতে
এমনকি তোমাদের স্বপ্নেও না।

তাদেরকে চেয়ো না তোমাদের মত করতে
কারণ তাদের জীবন কখনই ফিরবে না
পেছনের পানে।’

রুমীকে রওয়ানা হতে হবে ৭ মে তারিখে। গোছগাছ করে দেবার জন্য মায়ের প্রস্তুতির যেন শেষ নেই। নিজহাতে রুমীর প্যান্টের কোমরের কাছে ভেতর দিকের মুড়ি খুলে কয়েকটা একশো টাকার নোট সেলাই করে দেন। বাইরে কোথাও থাকলে সার্চ করে রেখে দিতে পারে। কাপড়-জামা রাখার জন্য এয়ারব্যাগ এবং তার মধ্যে দু’সেট কাটা কাপড়, তোয়ালে, সাবান, স্যান্ডেল এবং জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা ও সুকান্ত সমগ্র পুরে দেন।

যাবার আগের দিন রাতে রুমী মায়ের কাছে বেশিক্ষণ চুলে হাত বুলিয়ে দেবার আবদার করে। দুই ছেলের মাথায়ই মা প্রায় প্রতিদিন হাত বুলিয়ে দেন। আজ ছোট ছেলে জামী চাইল না মাকে। মাথার চুল টেনে দেবার সময় ওইদিন রুমী গেয়ে ওঠে, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। নির্দিষ্ট দিন জাহানারা ইমাম নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে রুমীকে যাত্রাবিন্দুতে পৌঁছে দেন। পেছনের সিটে রুমীর সাথে বাবা শরিফ ইমাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী গাড়ি গিয়ে থামে সচিবালয়ের সেকেন্ড গেটে। আলগোছে নেমে যায় রুমী। এখান থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে মিলে গোপনে শুরু হবে ওর যুদ্ধযাত্রা।

অপ্রত্যাশিতভাবে ১১ মে ফিরে আসে রুমী। কামাল লোহানী, প্রতাপ হাজরা, মনু, ইশরাক ও বাফার কয়েকজন কর্মচারী মিলে দলটি ভারতের উদ্দেশ্যে যে পথে যাত্রা করেছিল, সে পথে ঘাপলা হয়েছে। নতুন পথের সন্ধান না-জানা থাকায় ফয়েজ আহমদের পরামর্শে দলটি পরবর্তী অভিযানের পরিকল্পনা করে প্রত্যাবর্তন করে ঢাকায়। ১৪ মে বন্ধু নাদিমসহ পুনর্যাত্রা করে রুমী। মা উদ্বিগ্ন থাকেন। ৩০ জুন প্রথম খবর পান রুমী আগরতলার কাছাকাছি মেলাঘর ক্যাম্পে আছে। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ছেলে রণাঙ্গনে কিন্তু মা-ও বসে নেই। ঢাকা শহরে থেকে প্রতিমুহূর্তে পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে যান তিনি। ছেলের খবর জানবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। মেলাঘর থেকে খবর নিয়ে আসে জিয়া, মনু, দুলু, পারভেজ। ওদের কাছে জানতে পারেন রুমী ভালো আছে, তবে ওদিকে এখন ভয়ানক চোখ-ওঠা রোগ। পাঞ্জাবিরা যাকে ‘জয় বাংলা চোখ-ওঠা’ নামে ডাকে। ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস। পারভেজ বলে, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বেলেডোনা-৬ শুরুতেই খেলে রোগটি আর হয় না। ২০ জুলাই পারভেজ রওয়ানা দেবে মেলাঘরে। মা এবারও সুযোগ নেন। পারভেজের কাছে কয়েক শিশি বেলেডোনা-৬, কয়েকটা নেইল কাটার, তিনটা সানগ্লাস এবং দু’শো টাকা দিয়ে দেন। বলে দেন, একটা নেইল কাটার, একটা সানগ্লাস এবং একশো টাকা রুমীর। একশো টাকা পারভেজের। বাকি জিনিসপত্রগুলো যেটি যার যখন লাগে, তারই। এর পরেও নানাজনের কাছে নানা সময়ে টাকা, সিগারেট, ওষুধ, কাঁচি, ব্লেড ইত্যাদি পাঠান; যেন তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধা ছেলের মা বা মায়েদের প্রতিনিধি।

৮ আগস্ট রুমী ঢাকায় আসে। সে কী উচ্ছ্বাস মায়ের মনে! দীর্ঘদিন পর ছেলেকে কাছে পাওয়ায় বাড়িতে উৎসব লেগে যায়। সেটা শুধু ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্যেই নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বয়ান শোনা যাবে এ কারণেও। এবার রুমীর ঢাকায় আসা বেড়াবার জন্য নয়। ইতোমধ্যে সে পুরোমাত্রায় প্রশিক্ষিত গেরিলা যোদ্ধা। অপারেশনের প্রয়োজনেই দুই নম্বর সেক্টর থেকে অন্যান্যের সঙ্গে সে প্রেরিত হয়েছে ঢাকায়। মা এখন আর আগের মতো কড়াকড়ি করেন না। বেশিক্ষণ কাছে পাবার জন্য সামনে সিগারেট খাবারও অনুমতি দিয়ে দেন তিনি। তাছাড়া, সঙ্গী গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করবার জন্য বাড়িতেই জায়গা করে দেন, ক্ষণে ক্ষণে নাস্তার জোগান দেন। নিজে কোনো কোনো বৈঠকে উপস্থিতও থাকেন। বৈঠকে অপারেশনের পরিকল্পনা ও তার নকশা তৈরি হয়।

কখনো দু’তিনদিনের জন্যও রুমীকে বাড়ির বাইরে চলে যেতে হয়। মা অপেক্ষা করতে থাকেন কোনো বড়ো ধরনের অপারেশনে সফল করে সবান্ধবে ফিরে আসবে তাঁর রুমী। কখনো-বা অপারেশন শেষে নিজে গিয়ে রুমীকে গাড়ি করে এগিয়ে আনেন। স্টেনগানের ফায়ারের আগুনের আঁচে ঘাড়ে তৈরি হওয়া ফোস্কা ডেটল দিয়ে মুছে দেন, ওষুধ লাগিয়ে দেন। প্রয়োজনে ছেলের সঙ্গে গাড়ি ড্রাইভ করে গিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসেন, রাখেন বাসায় যত্ন করে।

মা-ছেলে মিলে এরকম যৌথ গেরিলা-তৎপরতা চলতে পারত দীর্ঘসময় ধরে। কিন্তু না, যতি পড়ে এই অভিযানে। চড়াও হয় বজ্রের মতো দুঃসময়। ২৯ আগস্ট একদল মিলিটারি এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি ঘেরাও করে। ঘর সার্চ করে এমপিএ হোস্টেলে নিয়ে যায় স্বামী শরিফ ইমাম, ছেলে রুমী-জামী ও ছেলের বন্ধু হাফিজ-মাসুমকে। মায়ের বুক হু হু করে ওঠে।

এক-দেড় ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেবে বলে নিয়ে গেলেও দেড়দিন যায় ওরা কাউকে ছাড়ে না। ফোনে যোগাযোগ করে স্যান্ডউইচ ও জামাকাপড় নিয়ে সশরীরে এমপিএ হোস্টেলে যান তিনি। কিন্তু কারোরই কোনো খোঁজ পান না। ৩১ আগস্ট ফিরে আসে রুমীকে ছাড়া দলের বাকি সবাই। এবার মায়ের উদ্বেগ আরো তীব্র হয়।

২৫ আগস্টের একটি সফল গেরিলা অপারেশনের বিপরীতে ছিল এই জিজ্ঞাসাবাদ। ধানমণ্ডির একটি বাড়ির গেটের ওই অপারেশনে অর্ধডজন পাকসেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় দশম শ্রেণিতে পড়া কিশোর জামীসহ চরম নির্যাতন করা হয় সবাইকে। রুমীর কৃতকর্ম সম্পর্কে পাকসেনারা আগে থেকেই তথ্য পেয়েছিল, ফলে ওর পক্ষে ঘটনা অস্বীকার করবার কোনো জো ছিল না। ওর স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত হয় যে ওকে ছাড়া আর কেউ এ অপারেশনের কিছুই জানে না। সুতরাং অন্যেরা ছাড়া পেলেও রুমী ছাড়া পায় না।

এ বিপদে জাহানারা ইমামের প্রগতিশীল মনও সংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মিষ্টি নিয়ে হাজির হন পাগলা পিরের দরগায়। শোনা যায়, এই পিরের কাছে যা চাওয়া যায়, তাই মেলে। তাঁর আর্তি ছেলে রুমীকে ফিরে পাওয়ার। না, তিনি একা নন। পিরের দরগায় গিয়ে দেখতে পান রাজশাহীর ডিআইজি মামুন মাহমুদের স্ত্রী মোশফেকা মাহমুদ, রাজশাহীর এসপি শাহ আবদুল মজিদের স্ত্রী নাজমা মজিদ, চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হকের স্ত্রী মাহমুদা হক, ঢাকার আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী ঝিনু মাহমুদসহ আরো অনেকেই। সবারই আর্তি আপনজনকে ফিরে পাওয়ার। কোরান খতম করান। মিলাদ পড়ান। জানের সদকা হিসেবে খাসি কোরবানি দেন। পিরকে বাসা অব্দি নিয়ে আসেন। পাগলা পির রুমীর ঘরে গিয়ে দু’রাকাত নামাজ পড়ে মোনাজাত করে ঘাবড়াতে নিষেধ করে শিগগির ওকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। পরের আশ্বাসের যেমন কমতি নেই, নজরানারও ঘাটতি নেই। প্রতি বৃহস্পতিবার একটি করে পঞ্চাশ টাকার নোট, পাঁচ-সাত সের মিষ্টি, এক কার্টুন ৫৫৫ সিগারেট নজরানা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু না, পিরের পেছনে প্রচুর অর্থ ও সময় অপচয় করে, প্রচুর ধরনা দিয়ে, পায়ে পড়েও কোনো কাজ হয় না। এবার আজিমপুর সলিমুল্লাহ এতিমখানায় গরু কোরবানি দেন। যে যা পরামর্শ দেয়, তাই করেন। প্রিয় পুত্রের জন্য মায়ের প্রত্যাশা যে ফুরাবার নয়।

বিজয়ের দিনকয় আগে ১৩ ডিসেম্বর হার্ট অ্যাটাকের ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শরিফ ইমামকে। ব্ল্যাকআউটের কারণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি চালানো যায় নি। ১৪ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। বিজয়ের দিন কুলখানি। জেনারেল নিয়াজি নব্বই হাজার পাক সেনা নিয়ে বাঙালির বীরত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন; জাহানারা ইমাম আত্মসমর্পণ করেন বর্তমান পরিস্থিতির কাছে, বাকি জীবন একাই সব কষ্ট বহন করবার প্রতিজ্ঞায়।
                         
শরিফ ইমাম ছিলেন রাশভারী স্বপ্লবাক মানুষ। সরকারি চাকুরে, ইঞ্জিনিয়ার। সংসারে তাঁর খবরদারির কোনো প্রমাণ গোটা বইয়ে মেলে না, বরং যেকোনো প্রয়োজনে সহযোগী হিসেবে তাঁর বাড়িয়ে রাখা উদার হাতের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তাঁর হাত অকৃপণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনেও। যখন তখন অর্থ দিয়েছেন যুদ্ধের রসদ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সবচেয়ে বড়ো যে কন্ট্রিবিউশন, সেটা দেশের ৩৫০০টি সেতু ও কালভার্টের তালিকা ও নকশা সরবরাহের। খালেদ মোশাররফ ব্রিজ ও কালভার্টের তথ্য চেয়ে পাঠান, যাতে পাকবাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে ওগুলো এমনভাবে এক্সক্লুসিভ বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া যায় যে, দেশ স্বাধীন হবার পর সহজে মেরামত করা যায়। অনেক ঝুঁকি ডিঙিয়ে শরিফ ইমাম তাঁর সহকর্মীকে নিয়ে সবকটা ব্রিজের তালিকা, বিভিন্ন টাইপের ব্রিজের ড্রইং করে প্রত্যেকটির স্পেসিফিকেশন লিখে দেন। এরকম একজন যোদ্ধার বিজয় দিবসের দুই দিন আগে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করা খুবই বেদনাকর। তিনি কেবল তাঁর পার্টনার জাহানারা ইমাম ও কিশোরপুত্র জামীকে একা করে যান নি, কার্যত যোদ্ধাদেরও হতাশ করে গেছেন।
 
একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থটি কেবল ইমাম পরিবারের ঘটনাবলির ডকুমেন্টেশন নয়, এটা মুক্তিযুদ্ধেরই একাংশের ডকুমেন্টেশন। কারণ বাংলার স্বাধিকারের সপক্ষে হওয়া নানা তৎপরতা ও এর সাথে যুক্তদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য এখানে টুকে রাখা আছে। নমুনা হিসেবে এর কয়েকটি এখানে তুলে ধরা যায়; যেমন ১৪ মার্চের নোট থেকে জানা যায়, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঢাকার কবি-সাহিত্যিকদের ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন করবার কথা। হাসান হাফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, বদরুদ্দিন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রোকনুজ্জামান খান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান, আবদুল গণি হাজারীসহ আরো অনেকে। জানা যাচ্ছে, বেতার-টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সব মাধ্যমের শিল্পীদের সমন্বয়ে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হবার কথাও। আলী মনসুরকে সভাপতি, সৈয়দ আবদুল হাদীকে সম্পাদক ও লায়লা আর্জুমান্দ বানুকে কোষাধ্যক্ষ করে গঠিত পরিষদে সদস্য হিসেবে ছিলেন মোস্তফা জামান আব্বাসী, জাহেদুর রহিম, ফেরদৌসী রহমান, বশির আহমেদ, খান আতাউর রহমান, বারীন মজুমদার, আলতাফ মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা, কামরুল হাসান, অজিত রায়, হাসান ইমাম, কামাল লোহানী, জি. এ মান্নান, আবদুল আহাদ, সমর দাস, গহর জামিল, রাজ্জাক ও আরো অনেকে।

১৫ মার্চের এন্ট্রি থেকে জানা যায়, বাঙালি বিশিষ্টজনেরা পাক সরকারের বাংলা ও বাঙালিবিরোধী আচরণে তাদের দেওয়া খেতাব বর্জন করতে শুরু করেছেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বর্জন করেছেন তাঁর ‘হেলালে ইমতিয়াজ’ খেতাব। অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী বর্জন করেছেন ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব। এছাড়াও জাতীয় পরিষদ সদস্য ডাঃ শেখ মোবারক হোসেন, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শেখ মোশারফ হোসেন ও দৈনিক পাকিস্তান সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন বর্জন করেছেন যথাক্রমে ‘তমঘা-এ-পাকিস্তান’, ‘তমঘা-এ কায়েদে আযম’ ও ‘সিতারা ই খিদমত’ খেতাব।
  
১৮ মার্চের এন্ট্রি থেকে জানা যায়, স্বাধিকার চেতনাকে তুঙ্গে তুলে দেবার জন্য ঢাকা টেলিভিশনের অভিনব গানের অনুষ্ঠানের সংবাদ। এই অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রথম সারির নামকরা শিল্পী ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা ইয়াসমীন, শাহনাজ বেগম, আঞ্জুমান আরা বেগম, সৈয়দ আবদুল হাদী, খোন্দকার ফারুক আহমদ, রথীন্দ্রনাথ রায় ও আরো কয়েকজন শিল্পীর উপস্থিতিতে গাওয়া ‘সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম, চলবেই দিনরাত অবিরাম’ গানটিকে যন্ত্রপাতির সৃজনশীল ব্যবহার দিয়ে কয়েক হাজার মুখে গাওয়া গান হিসেবে দেখানো হয়। আয়না ব্যবহার করে এ অসাধ্যটি সাধন করেন মোস্তফা মনোয়ার।

১৯ মার্চের নোটে পাওয়া যায়, পটুয়া কামরুল হাসানকে আহ্বায়ক করে ‘বাংলার পটুয়া সমাজ’ নামে সমিতির গঠনের সংবাদ, যে সমিতির শিল্পীরা কার্টুন, ফেস্টুন, পোস্টার ইত্যাদি তৈরি করে স্বাধিকার আন্দোলনের বাণী-বার্তা বৃহত্তর জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার উদ্যোগ নিয়েছে। শাপলা ফুলকে সংগ্রামী বাংলার প্রতীক হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব এই সমিতির সভাতেই নেওয়া হয়।

২২ মে তারিখের এন্ট্রি থেকে জানা যায়, গ্রামের মানুষের আন্তরিক ভালোবাসার কথা। গ্রামের অনেক বুড়ো মানুষ কিছু পর পর পথের ধারে গুড় আর মটকাভর্তি পানি নিয়ে বসে থেকেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে উদ্বাস্তু বা অন্য যারা ওই পথ দিয়ে যাবেন, তারা যাতে তৃষ্ণা মেটাতে পারেন। তাছাড়া, অনেক বাড়িতে রাত দুপুরে মুরগি জবাই করে খাওয়ানো ও মাঁচায় তুলে রাখা কাঁথা-বালিশ নামিয়ে শরণার্থীদের থাকতে দেওয়া হয়েছে।
   
১৪ অক্টোবরের এন্ট্রিতে মোনেম খাঁকে তাঁর বাসায় গুলি করে মারার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সন্ধ্যার পর মোনেম খাঁ ড্রইংরুমে বসে প্রাক্তন প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন, কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা ও তাঁর জামাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের সাথে কথা বলছিলেন। তখন ড্রইংরুমের দরজা খোলা ছিল। তিনি দরজার দিকে মুখ করে বসে ছিলেন। তখন তাঁকে বাইরে থেকে গুলি করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করেও তাঁকে বাঁচানো যায় নি। মোনেম খাঁর মৃত্যুতে মানুষ এত খুশি হয় যে, উল্লসিত জনতা হৈচৈ করে মিষ্টি কিনে-খেয়ে সব দোকান ফাঁকা করে ফেলে। ২৮ অক্টোবরের এন্ট্রিতে জানা যায়, মোনেম খাঁর লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ফেলানো হয়। এজন্য যে, তাঁর মতো বেঈমানের লাশ এদেশের মাটিতে থাকতে দেওয়া হবে না।

একইভাবে বইটি পাক কর্তৃপক্ষ ও পাকবাহিনীর অজস্র অপকর্ম ও বিভৎসতার ছবিও ধরে রেখেছে; যেমন ২৯ এপ্রিলের এন্ট্রিতে আছে বিহারীদের বিভৎসতার বর্ণনা; ১ মে-তে আছে আহত পাকবাহিনীর চিকিৎসার জন্য সুস্থ-সবল বাঙালিদের গা থেকে জোর করে রক্ত সংগ্রহ করার ভয়ঙ্কর খবর; ১৭ মে-তে আছে বিখ্যাত ও পদস্থ ব্যক্তিদের জোর করে ধরে নিয়ে রেডিও-টিভিতে প্রোগ্রাম করানো এবং বেয়নেটের ভয় দেখিয়ে স্বাক্ষরকৃত ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর নামে প্রকাশিত ভূয়া বিবৃতির তথ্য; ১৬ জুনে আছে পাক কর্তৃপক্ষের দ্বারা ঢাকার রাস্তার নামের মুসলমানিকরণ ও বই নিষিদ্ধের খবর; ১ জুলাইয়ে আছে গোপালপুর সুগারমিলের হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ; ২ জুলাইয়ে আছে ধর্ষণের বিভৎসতা-সম্পর্কিত বর্ণনা; ৪ সেপ্টেম্বরে আছে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে সম্মানিত ফ্লাইট লেফটন্যান্ট মতিয়ুর রহমানের বীরত্বকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘বিশ্বাসঘাতকের নাম মতিয়ুর রহমান’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের তথ্য। এই তালিকা অশেষ।

দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত ইতিহাসের বড়ো ঘটনাগুলোর বর্ণনামূলক ইতিহাস গ্রন্থ সাধারণত লেখা হয় ঘটনা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে, ঘটনার তীব্রতা থিতিয়ে এলে। তাবৎ ঘটনাকে সামনে নিয়ে আঁকা হয় তার আনুপূর্বিক রূপরেখা। বর্ণনাকারী বিভিন্ন দলিলপত্রের সহায়তায় ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে তার ভিত্তিতে ভাষাকে গতি দেন, বাক্য রচনা করেন। কিন্তু দিনলিপিতে ঘটমান ঘটনার সমস্তটা বিবেচনায় নিয়ে কথা বলবার সুযোগ থাকে না। দিনলিপি লেখকের কাছে তথ্য হিসেবে থাকে স্মৃতিতে সঞ্চিত নিকট অতীত এবং নতুন ঘটনাংশ বা তার একটা খণ্ড ঝলক। এই সুবাদে ঘটনার ব্যাপক বিস্তারণ সম্ভব হয়। যার উৎস হয় স্বচক্ষে দেখা, অন্যের কাছ থেকে শোনা ও গণমাধ্যমবাহিত হয়ে আসা তথ্য। এর মধ্যে বর্ণনাকারীর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা তথ্যই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। যুদ্ধকালীন রটনামালা থাকে নানা গুজবে ভরা, গণমাধ্যমও থাকে অস্থিরতায় আক্রান্ত। এরকম পরিপ্রেক্ষিতে দিনলিপি লেখক ঘটনাকে উপলব্ধি করার সক্ষমতা ও তার কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে গ্রহণ-বর্জন চালিয়ে সত্যকে ছুঁতে পারেন ও ছুঁয়ে থাকেন। আর ভবিষ্যৎ তাদের কাছে ধরা দেয় এসবের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া আশঙ্কা ও স্বপ্ন হয়ে। সংগত কারণে জাহানার ইমামের বর্ণনায়ও কোথাও কোথাও শোনা কথায় ভর করে গুজব জায়গা পেয়েছে। তবে তাঁর সত্যনিষ্ঠার কারণে পরবর্তী কোনো এন্ট্রিতে আবার তার সংশোধনীও উঠে এসেছে। এই লক্ষণদৃষ্টে একাত্তরের দিনগুলিতে সন্নিবেশিত তথ্য ও তথ্যকণাকে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব তথ্যকে সূত্র হিসেবে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালানোর সুযোগ এখানে অপরিসীম।
   
এ গ্রন্থ চেনায় তৎকালীন বাংলার, বিশেষ করে ঢাকার জনসমাজের ওপরে ফেলা মুক্তিযুদ্ধের বিপুলাভার একাংশ আলো-অন্ধকার। এর নানা পৃষ্ঠা থেকে ভেসে আসে ফিসফাস ধ্বনি, পাকবিরোধী গোপন প্রস্তুতি, আকস্মিক বিধ্বংসী আওয়াজ ও অস্ফুট আর্তনাদ। এই বই পাঠে ঢাকার অভিজাত এলাকার বাসিন্দা এক গেরিলা যোদ্ধা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যোদ্ধামায়ের জবানিতে পাঠক হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে সময়ের ভাষিক উত্তাপ। এ উত্তাপে মন তাতিয়ে চিনে নেওয়া যায় নিজেকে, তুলনার গণিতে। এ যাবৎ অজস্র পাঠক এই আলোতে চিনেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও। আগামীতে চিনবেন আরো শতসহস্র জন, না-চিনে উপায় নেই বলে।

মুহাম্মদ শাকেরউল্লাহ সম্পাদিত 'ঊষালোকে'-র 'একাত্তরের দিনগুলি' সংখ্যার জন্য লিখিত

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...