Friday, July 3, 2020

শামীম পারভেজ, বর্ষাস্বপ্নে কাটলো যাহার চৈত্রপোড়াদিন

সেলফোনে প্রথম যখন ভয়াবহ অসুস্থ শামীম পারভেজকে ঢাকার মহাখালীস্থ মেট্রোপলিটন মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করবার খবর পাই, তখন জুনজনিত ব্যস্ততায় ডুবতে ডুবতে শ্রমসাধ্য একটি অ্যাসাইনমেন্ট শেষে তীরে দাঁড়িয়ে কাকতালীয়ভাবে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ক্লিক করে অদূর অতীতে জাপানে সংঘটিত প্রলয়ংকরী সুনামির একটি বিরল ভিডিও ক্লিপ দেখছিলাম। একটা সচল জনপদের সপ্রাণ-নিষ্প্রাণ সমস্ত কিছুকে ক্ষুধার্ত ও রাগী সমুদ্রের মুহূর্তে গ্রাস করে নেবার ভয়াবহতা এবং মানুষের অসহায়তার এমন অবিশ্বাস্য ও করুণ চিত্র আর হয় না। ঘটনার ভয়াবহতায় কেবলই কাঁটা দিয়ে উঠছিল আমার মাঝবয়েসি গা। এমন অবস্থায় ফোনবাহিত হয়ে এল আরেক সুনামির সংবাদ। ক্লিপটিতে চোখ রেখে ঘটনার বিবরণ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল প্রাণান্ত দৌড়েও যে লোকটি রাগী জলের থাবা থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারল না ওই লোকটিই হয়ত শামীম, আর অপেক্ষাকৃত শক্ত ভিতের উপরে নির্মিত তেতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে যে লোকটি মনে করছে যে এ যাত্রায় বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছি অথচ খানিক পরে বাড়ি ধ্বসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে নিজেও জলের পাকে নিখোঁজ হয়ে যাবে সে লোকটি বোধহয় আমি!

ফোন রাখতে না রাখতে আরেকজনের কল পাই, সেও বয়ে আনে ওই একই সংবাদ। বিকেল নাগাদ আরো একজন। কিন্তু না, আটঘণ্টা শ্রম বেচা শেষেও সংসারজনিত ব্যস্ততা বাধ সেধে দাঁড়ালে ওইদিনই আমার মহাখালী যাওয়া সম্ভব হয় নি; দীর্ঘ অদেখার কারণে টানে যদিও ঘাটতি ছিল না কোথাও।

জানা গেল, শামীমের স্ত্রী ক্লিনিকে ওর সঙ্গে আছে। ফোন নম্বরও পাওয়া গেল তাঁর। দেখতে যেতে হলে তাঁর কাছ থেকে ডিটেল জেনে নেয়া দরকার হবে। ভাবলাম, যদিও আজ যেতে পারব না তবু একটা ফোন করে ওর সংবাদটা অন্তত নেয়া যাক। কিন্তু নানারকম ভাবনা হলো। ফোন করে কী শুনতে কী শুনব কে জানে। সইতে পারব তো! তা ছাড়া, ভদ্রমহিলার সঙ্গে আগে কখনো আমার দেখা-কথাও হয় নি। এসব মিলিয়ে প্রয়োজনীয় মনোবল সঞ্চয় করে উঠতে পারলাম না। পারতে পারতে এক দিন দুই রাত গত। পরদিন ফোন করে যা বুঝতে পারলাম তাতে মনে হলো ভদ্রমহিলা শামীমকে সুনামির রাগী জলের তোড়ে হারিয়ে যেতে দিতে শারীরিক-মানসিকভাবে একেবারেই প্রস্তুত নন। ওকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি অন্যান্যের সহায়তায়, যদিও আশঙ্কা পুরোপুরি ছাড়ছে না তাঁকে। কারণ চিকিৎসকরা তেমন আশ্বাসবাণী শোনাতে পারছেন না। যাই হোক, তারও পরদিন সন্ধ্যায় মহাখালী যেতে পারলাম, কিন্তু মানসিকভাবে বলীয়ান মিসেস শামীমকে ওখানে পাওয়া গেল না যে তাঁকে একটা ধন্যবাদ দেবো। অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে আছেন তাঁর ছোটভাই, শামীমের শ্যালক।

সকল ভালো হাসপাতালের মতো ওখানেও প্যাসেন্ট ভিজিট করবার নির্দিষ্ট সময় আছে, আমি যার অনেক আগেই ক্লিনিকে পৌঁছেছি। ফলত অপেক্ষা করতে হলো। শামীমের শ্যালক রিসেপশনে সঙ্গ দিলেন আমায়। এটা-ওটা কথা হচ্ছিল ওর সম্পর্কে। কথার সারাংশ শামীমের নিজের শরীরের প্রতি নানা অনিয়ম-অত্যাচারের বর্ণনায় ভরা। শেষ দিকে চাকুরি-বাকুরি ছেড়ে কিছুটা থিতু হয়েছিল সে, অনিয়মটাও খানিকটা কমিয়ে এনেছিল। কিন্তু ততদিনে ভেতরে স্থায়ী কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। চোরা অসুস্থতা রীতিমতো গেড়ে বসেছে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে সন্ধ্যা সাতটায় মাস্ক ও ইউনিফর্ম পরে এইচডিইউ তথা হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে গিয়ে দেখলাম চার হাত-পা ছড়িয়ে শামীম ঘুমিয়ে আছে। বেশ কিছুদিন শেভ করা নেই। ক্লান্ত বিমর্ষ অভিব্যক্তি। নাকে ও নিম্নাঙ্গে বিবিধ নল। দূর থেকেও শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। জাগিয়ে কথা বলা নিরাপদ নয়। ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। বেড ঘেঁষে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে স্মৃতিতে থাকা ওর প্রাণোচ্ছল মুখটাকে ওই মুখের সাথে মিলিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না আমার।

জিজ্ঞাসার জবাবে নিচুস্বরে নার্স জানালেন, হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠেই উনি সিগারেট খেতে চাচ্ছেন। এই বিবরণে আমার নিজের মুখও যেন ভেসে উঠল, যার কাছে সিগারেটই প্রধান স্বজন! সিগারেট শামীমকে খাচ্ছে, খাবে আমাকেও, মনে হলো। হায়, প্রাণসংহারক সিগারেট!

২.
শামীমকে আমরা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ময়মনসিংহে পেয়েছিলাম, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়কার সঙ্গী হিসেবে। বীক্ষণে ও বীক্ষণের বাইরের অন্যান্য সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতায় অনেক সময় একত্রে পার করেছি আমরা। শরীরের উপরে অত্যাচার তার তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনিয়ম-অত্যাচার আমরা সমন্বিতভাবেও করেছি অনেক সময়। কিন্তু ওর সুঠাম শরীরে ওসব কোনো প্রভাব ফেলতে পারে তেমনটা মনে হয় নি তখন। পেশাগত প্রয়োজনে পরে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ বিচ্ছেদের রাত্রি নেমে আসে। শামীম চলে যায় সিএইচটির কোনো জেলায়, রোকন উত্তরবঙ্গে, জুয়েল শেরপুরে, আশিক ও আমি ঢাকায়; মাসুম অবশ্য ময়মনসিংহেই থেকে যায়। এই বিচ্ছেদের কোনো নিরাময় ছিল না। বছর দশেক কাল মাঝেমধ্যে কোনো একটা লিরিকের চার/পাঁচ লাইন টেক্সট মেসেজ আকারে আমাকে পাঠাত শামীম। এগুলো হতো প্রায়শই রাত দুটোয় বা তারও পরে। সেটাই ছিল ওর লিরিক প্রস্তুতকাল। কখনো ওগুলো পড়ে ব্যাক করেছি, কখনো করতে পারি নি বা বিরক্ত হয়েছি। ব্যাক করলে কথা হতো গান লেখা নিয়ে। শামীম তখন চার হাতে গান লিখছে। কাউকে কাউকে দিয়ে ওসব লিরিক গায়নের উদ্যোগ নেবার কথাও জানাত সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব পরিকল্পনার কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে তার কিছুই জানি না।

না, ওর কোনো কবিতা দীর্ঘ দীর্ঘ দিন কোথাও পড়া হয় নি আমার। শেষ সময় সে ময়মনসিংহেই স্থায়ী নিবাস গড়েছিল। ওখানকার সাহিত্যাঙ্গনে সেসময় ওর নৈমিত্তিক উপস্থিতি ছিল বলে শুনেছি, ছবি দেখেছি। কিন্তু এই পর্যায়েও ওর সঙ্গে মোলাকাতের সুযোগ তৈরি হয় নি আমার। এর মধ্যে দু’-চারবার বিভিন্ন কাজে ময়মনসিংহে গেলেও দুর্ভাগ্যক্রমে শামীমের সাথে দেখা হয় নি। ওর সম্পর্কে দীর্ঘ এই অদেখাই আমার সঞ্চয় হিসেবে রয়ে গেল মাত্র।

শামীমের মৃত্যুর পরে ইমেইলে ওর একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি পাই শাহীন লতিফের মাধ্যম। নাম নেই। খুব সময় নিয়ে নিষ্ঠার সাথে পড়তে না পারলেও শ্রদ্ধার সাথে ওর ভেতর দিয়ে গেছি আমি। ওখানে পাতায় পাতায় শামীমের মুখ লুকানো। তবে কবিতাগুলোতে দীর্ঘ অচর্চার ছাপও স্পষ্ট, যার আরো সম্পাদনা দরকার। চোখ আটকে যাওয়া অনেক জায়গা আছে লেখাগুলোয়। ‘ছুটি চাহিয়া’ নামক একটি কবিতায় শামীম বলছে : ‘কফিন সময় কাছে ডাকে বড় বেশী ক্ষমাহীনতায়।/ শেফালী ফুলেরা নিয়েছে ছুটি সেই কোন ভোরে। ছুটি মঞ্জুর কর তবে অন্দরবাসিনী...।’ হ্যাঁ, ওর ছুটি শেষ পর্যন্ত মঞ্জুর হয়েছে। ছুটির এ সময়টা শামীম কীভাবে কাটাবে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কোনো মানে নেই এ কথা বলার, তবু বলা যাক যে, ওর ওখানকার চৈত্রপোড়াদিনগুলোও ‘বর্ষাস্বপ্ন’-এ ভরে উঠুক।

অক্টোবর ২০১৫

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...