Friday, July 3, 2020

আসমার ‘প্ররোচনা’র গতিপ্রকৃতি

সে আমাকে প্ররোচিত করে।
মুখাবয়বে মানুষের কী যে স্বাতন্ত্র্য,
তেমন দুর্বলতা কিছুতে দেখা যায় না আর
কেবল ওষ্ঠে চুমু লাল হয়, লালা আসে
প্ররোচনাময়—
ফলে ওষ্ঠের ছায়া হয়ে থাকি,
আর তুমি হাঁটতে থাক, প্ররোচিত কর—
যাবতীয় লোভ, কাম ও স্বপ্নতা নিয়ে।
(প্ররোচনা, আহমেদ স্বপন মাহমুদ)
‘প্ররোচনা’ বা অ্যাবেটমেন্ট সাম্প্রতিককালে ঘোর নেতিবাচকতায় মোড়া একটা শব্দ। আজ আমরা একে ঘোরতর সন্দেহের কাতারে রেখে দেখলেও বরাবর শব্দটি এমন ছিল না। স্ত্রীবাচক বিশেষণ প্ররোচনার কিছু সৎকর্মও আছে। খোঁজ নিলে দেখা যায়, বাংলা ভাববৃত্তে এ যাবৎ শব্দটি প্রীতিকর বোধ জাগিয়েছে, রুচিসম্পাদন করেছে, প্রীতিজনন ঘটিয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতায় ধর্মোন্মাদনার নেপথ্যে শব্দটা বেশি খাপ খেলেও একসময় ধার্মিকতার নেপথ্যেও একে স্বীকার করত মানুষ! ইত্যাকার (ইতি)প্ররোচনা জগতে নিহিত ছিল বলেই মহামহোপাধ্যায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থনাকালে বিদ্যমান পুস্তকাদির কোনাকাঞ্চিতেও এই শব্দের কোনো নেতিবাচক প্রয়োগসূত্র খুঁজে পান নি। তিনি যা পেয়েছেন তার সবই ইতিবাচক। অথচ বিবর্তনের রেখা ধরে এখন শব্দটা নেতির গন্ধে কাবুপ্রায়।

সভ্য আইন প্ররোচনাকে অপরাধ সাব্যস্ত করে তার জন্য শাস্তিও বরাদ্দ করেছে। অবশ্য বলা বাহুল্য নয় যে, এ ক্ষেত্রে শাস্তি বরাদ্দ করে দণ্ডবিধির প্রবক্তাগণ ঠিক কাজটিই করেছেন। কারণ জগদ্বারে সম্প্রতি আমরা এমন সব প্ররোচনার সাক্ষাৎ পাচ্ছি, যা অন্যের ক্ষতিপ্রত্যাশী ও প্রাণবিনাশী, যা প্রভূত বিশৃঙ্খলার মদদ সরবরাহকারী।

আহমেদ স্বপন মাহমুদ (আসমা)-র ‘প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনাম’ গ্রন্থভুক্ত ‘প্ররোচনা’ কবিতাটি পড়তে গিয়ে শব্দটির এই প্রেক্ষাপট মনে পড়ল। তাই জন্য তাঁর এই কবিতাটি ঐতিহ্যিক ‘ইতি’ নাকি সাম্প্রতিক ‘নেতি’র কারবারে মগ্ন সেটা একটু খতিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। এই ক্ষুদ্র তত্ত্ব-তালাশি তারই স্মারক।

নিক্তি হিসেবে এখানে আমরা ভারতীয় দণ্ডবিধির সাহায্য নিতে পারি। এর পঞ্চম অধ্যায়ের ১০৭ থেকে ১২০ ধারা পর্যন্ত প্ররোচনা ব্যাপারটি ব্যাখ্যাত হয়েছে। দণ্ডবিধি মতে, তিনভাবে (নেতি)প্ররোচনা দেওয়া যেতে পারে— ১. কোনো কাজে উসকানি দিয়ে, ২. অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ও ৩. উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কিছু করায় সাহায্য করে।

দণ্ডবিধিতে প্ররোচনাদাতাকে সমাচ্চলিত অর্থেই প্ররোচক বা অ্যাবেটর বলা হয়েছে এবং তার জন্য শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ কোনো অপরাধ সংঘটনের নিমিত্তে কাউকে প্ররোচনা দিলে এবং সেই প্ররোচনার ফলে যদি কাজটি ঘটে তবে ওই কাজে প্ররোচনার জন্যে নির্দিষ্ট দণ্ড না-থাকলে মূল অপরাধটির জন্যে যে শাস্তি বা দণ্ডের বিধান আছে, প্ররোচকের ওপর তা-ই প্রযোজ্য হবে। বিরাট ব্যাপার! নয়?

কিন্তু প্ররোচনা দিয়ে কেউ যখন কাউকে পাঠক বানিয়ে তোলে, বিজ্ঞানচর্চার দিকে ঠেলে দেয়, কাঁধে কবিতার ভূত চাপায়— তখন কি তার জন্য আমরা শাস্তি প্রস্তাব করব? করব না। তবে এই না-করাকে জাস্টিফাই করতে আমাদের বিশেষ ভাষাকায়দা বা ভাষাতরিকার আশ্রয় নিতে হয়। তখন প্ররোচনাকে ‘প্ররোচনা’ না-বলে আমরা ‘প্রণোদনা’ বা মোটিভেশন বলি। পাশে দাঁড়িয়ে সাফাই গাই যে, প্রেরণাকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না। শব্দের এই হেন ব্যাপারস্যাপার শব্দার্থ-রাজনীতির নানা ঘোরপ্যাঁচের ইঙ্গিতবহ। একইরকম পোশাকের এই শব্দ দুটোর মুখাকৃতি প্রায় অবিকল; ওজন এবং মাত্রায়ও উভয়ে সমান। কিন্তু তবু, শব্দ দুটো সামাজিক মর্যাদায় ভীষণভাবে আলাদা। বিভিন্ন ভাষায় এরকম জোড়া জোড়া অবিকল আরো শব্দের খোঁজ নিশ্চয়ই আমাদের প্রায় সবারই জানা আছে।

এখানে প্ররোচনা ও প্রণোদনাকর্মের দুয়েকটা উদাহরণ দেবার চেষ্টা করা যায় : ধরা যাক ক কোনো এক কিশোরীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করল এবং তার সঙ্গলাভের অনুকূলে নানা প্রতিশ্রুতি দিলো। একসময় সঙ্গলাভ নিশ্চিতও হলো। কিছুদিন পর বিশ্বাসঘাতকতা করে মনোকষ্ট দেওয়ায় কিশোরী নিজগৃহে আত্মহত্যা করল। এ ধরনের আত্মহত্যা বাংলাদেশে প্ররোচিত আত্মহত্যা হিসেবে স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে ক প্ররোচনার অপরাধে অপরাধী। কিন্তু ক যদি ওই কিশোরীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তাকে কবিতাচর্চায় আগ্রহী করে তুলত এবং ঘটনাক্রমে সে ভালো একজন কবি হয়ে উঠত, তাহলে ক তাকে প্রণোদিত করায় প্রশংসিত হতে পারত। আবার কিশোরীকে দাবাখেলায় আগ্রহী করে তোলায় সে যদি একসময় দাবায় জাতীয় পুরস্কার লাভ করত, তাহলে প্রণোদনার পুরস্কারটা ক-এরই হতো। কিন্তু ধর্মের অপব্যাখ্যায় প্রলুব্ধ বা ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত করে ওকে আত্মঘাতী হবার দিকে ঠেলে দিলে প্ররোচনার অভিযোগ থেকে ক-কে কেউই রেহাই দিত না।
   
‘প্ররোচনা’ কবিতাটি যদি আমাকে নানা দুর্ভাবনার দিকে ঠেলে দিয়ে অসুস্থ করে তুলত, তাহলে এর লেখক আসমাকে অভিযুক্ত করে বিচার দাবি করতে পারতাম আমরা। কিন্তু তা না-করে এটি আমাকে নামশব্দের মুখের দিকে তাকিয়ে একটি নিবন্ধ রচনার দিকে ঠেলে দিয়ে প্রশংসা অর্জন করেছে। এটি এই কবিতাটির একটি গুণ। মানে বৈষয়িক অর্থেও ‘প্ররোচনা’ একটি ভালো কবিতা। কারণ এর ইতিবাচক প্রভাবসঞ্চারী ভূমিকা রয়েছে।

দেখা যায়, এ কবিতায় প্ররোচক দুজন। একজন ‘সে’, অন্যজন ‘তুমি’। ‘সে’র মুখ অন্যদের থেকে এতই আলাদা যে, আসমা তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। মানুষের মুখাকৃতির বৈচিত্র্য বিষয়ে দার্শনিকতায় মেতে ওঠেন। এই দুর্বলতা কামের দিকে কাত হয়ে আছড়ে পড়ে। ওই আছড়ানো দুর্বলতা একজন ওষ্ঠবিজ্ঞানী হয়ে উঠতে চায়। তার ল্যাবরেটরিতে চালাতে চায় চুমুর পরীক্ষা। কিন্তু জগৎ কারো সব ইচ্ছেকে ইতিবাচক পরিণতিতে পৌঁছুতে দেয় না। ফলে লোহা যেমন গনগনে আগুনের আঁচে ক্রমে লাল হয়ে ওঠে, তেমনি লিবিডোর দাহে কল্পিত চুমুটিও ক্রমে রক্তিম রং ছড়িয়ে ঝুলে থাকে ওষ্ঠের কার্নিশে। পাশাপাশি এনজাইম বা উৎসচেকরূপী লালা নিঃসৃত হয় কল্পিত চুমুটিতে নিহিত আনন্দবোধের আঙুল ছুঁয়ে।

না, এ যাত্রায় আসমার কোনো সাফল্য আসে না, ছায়া হয়ে থাকা ছাড়া। অথচ তাঁর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার সামনে দিয়ে ‘তুমি’ হেঁটে যায়, যে একইসঙ্গে ‘লোভ’, ‘কাম’ ও ‘স্বপ্ন’-এর প্রতীক মানে মোহের ট্রিলজি হয়ে ওঠে। ‘তুমি’ও প্ররোচিত করে ‘সে’র মতো ওষ্ঠচুম্বনে, তা সে লিপস বা লেবিয়া যেখানেই হোক।
 
দেখা যাচ্ছে, আসমার ‘প্ররোচনা’ কবিতার ‘সে’ এবং ‘তুমি’র কেউই প্ররোচনার অপরাধে অপরাধী নয়। কবিতাভাষ্যে উভয়েই প্ররোচনা করলেও তা পরিণতি লাভ করেছে একটি কবিতা রচনার প্রেরণাসঞ্চারী হিসেবে, যা বস্তুতপক্ষে উচ্চ মর্যাদার প্রণোদনা। অর্থাৎ, দুয়ের কেউই অ্যাবেটর নয়, বরং মোটিভেটর বা অ্যানকারেজার।

এই লেখাটি কাজেই এভাবে উপসংহৃত হতে পারে যে, প্ররোচকরূপী দুজন প্রণোদকসম্বলিত আসমার ‘প্ররোচনা’ কবিতাটি ইতিবাচক কাজে উসকানি দেয়, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করে না এবং নেতিবাচক কোনো কিছু করায় সাহায্য করে না। এর মানে হলো ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী এ কবিতাটি লেখার জন্য আসমার জন্য কোনো শাস্তি বরাদ্দ করা যায় না। দণ্ডবিধিতে ভালো কাজে প্রণোদনার জন্য কোনো পুরস্কার নির্দিষ্ট নেই বলে আমরা এখানে তাঁকে যৌবনিক অভিনন্দন জানিয়ে পুরস্কৃত করতে পারি।

পারি তো, নাকি?

নভেম্বর ২০১৭

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...