Tuesday, July 14, 2009

শতাব্দীশেষের কাব্যকৃতি ‘নব্বইয়ের কবিতা’ : বহুবর্ণিল, দেশজ ও দূরলক্ষ্যী আলোর ঘূর্ণিস্রোত

এই রচনাটি গড়ে উঠেছিল ১৯৯৯ সালে 'লোক প্রকাশনা' কর্তৃক প্রকাশিত মাহবুব কবির সম্পাদিত 'নব্বইয়ের কবিতা' নামক সংকলনগ্রন্থটিকে ভিত্তি করে একটি গ্রন্থ সমালোচনা হিসেবে, যেটি অনিকেত শামীম সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘লোক’-এর প্রথম সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছিল। উল্লিখিত সংকলনগ্রন্থটি এই রচনাটির কেন্দ্রীয় বিবেচনা পেলেও রচনাটিতে ইতিউতি ওই সময়ের কবিতার চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য নিয়েও দুচারকথা বলবার প্রয়াস করা গিয়েছিল। এতদিন পরে এটা দাবি করবার কোনো সংগত যুক্তি নেই যে, এতে চিহ্নিত লক্ষণাব্যঞ্জনাসমূহ অপরিবর্তনীয়ভাবে হুবহু উল্লিখিত সময়ের কবিদের কবিতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে এখনো অবশ্যমান্য হিসেবে গৃহীত হবে। তবে চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যসমূহ যে নব্বইয়ের কবিতার অর্জনের সীমার মধ্যেই গণ্য ছিল, সেটা বলায় সম্ভবত কোনো অতিরঞ্জন নেই। যা যা তখন শনাক্ত করা যায় নি এবং যা যা পরবর্তী সময়ে অর্জিত হয়েছে, তা তা নিয়ে নব্বইয়ের কবিতা বিষয়ে বিস্তারিত বলবার অবকাশ থেকে গেছে, কখনো হয়ত তা বলাও যাবে। এতদসত্ত্বেও এই রচনাটিকে কৌতূহলী পাঠকগণ সম্পূর্ণরূপে বাতিল মাল মনে না-ও করতে পারেন ধারণা করে এখানে পুনর্পত্রস্থ হলো। : মুজিব মেহদী


মহৎ শিল্পকর্ম কেবল সৃষ্টিকাল কিংবা সীমিত-ভূগোলের সীমানায় আটকে থাকা কোনো বদ্ধ-উদ্ভাস নয়। মহাকালের মনীষার দ্বারে তা শিল্পীত করাঘাত করে যেতে থাকে, যেতেই থাকে। জাগাতে থাকে শিল্পভোক্তার মনে অপরিসীম আগ্রহ। সে আগ্রহের পরিব্যাপ্ততায় ভোক্তা ক্রমমুগ্ধ হতে হতে আরো আরো আবিষ্কারের নেশায় জানতে চান যে, এই স্রষ্টা, যিনি এত এত কালাতিক্রমণের পরেও প্রাসঙ্গিক অতএব মহান ; তিনি কোন বিশেষ কালিক অবস্থানে থেকে কোন রাষ্ট্রনৈতিক-সমাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর পরিপার্শ্বে আর কারা কারা তখন সৃজনকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। প্রত্যেক মহান শিল্পস্রষ্টাকে নিয়ে মরণোত্তরে এত যে আলোচনা-সমালোচনা-গবেষণা, সেসব উল্লিখিত ভাবনাপ্রক্রিয়া এবং প্রবণতার স্বতঃসিদ্ধতাকেই প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন করে। আজ-যে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে গবেষণা করা ফ্যাশনের পর্যায়ে উপনীত-প্রায়, তা তিনিও মহত্তম স্রষ্টাদের একজন বলেই। তাঁকে উপলব্ধি করবার জন্যে এখন আমাদের জানবার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে তাঁর সময়কালের প্রতিটি উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা, প্রতিটি যাপনঘটনা এবং তাঁর সতীর্থ ও সমান্তরাল পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা অন্যান্য লেখকের মানস-ভূগোল, নিকটজনের মানসিক-চারিত্রিক স্থৈর্য ইত্যাদি।

এসব প্রেক্ষিতেই সমসময়ের ডকুমেন্টারি ধরনের প্রকাশনাগুলোর গুরুত্ব অনুভূত হয়। কেননা এরকম বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে, শতাব্দীর এই অন্ত্যবেলায় আমাদের মধ্যেই বেড়ে উঠছেন এমন কেউ না কেউ (একাধিকও হতে পারেন), যিনি এক সুউচ্চ বাতিঘর হয়ে মহাকালের বিচ্ছিন্নতা আক্রান্ত সময়পরিধিতে মিলনোন্মুখ সত্য-আলো বিলিয়ে যাবেন ভুবনগাঁয়ের প্রতিটি অন্ধকার বাঁকে-কোণে। যাঁকে আমরা হয়ত এখনই শনাক্ত করতে পারছি না। সেটা না-পারা কোনো দোষের ব্যাপারও নয়। কখনোই প্রায় মহানদের সমসময় মহান বলে শনাক্ত করতে পারে নি। অন্তত কিছুকাল অতিবাহিত না-হলে সেই প্রার্থিত দূরত্বটি রচিত হয় না, সুবিশাল কোনো ব্যাপ্তিকে নিরিখ করবার জন্যে ব্যাপ্ত-কাঠামো থেকে যতটা বাইরে গিয়ে দাঁড়াবার প্রয়োজন হয়। মাহবুব কবির সম্পাদিত ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় সেই মহান প্রতিভা/প্রতিভাসমূহের কাব্যকৃতি অন্তর্ভুক্ত হোক বা না-হোক, তাঁকে/তাঁদেরকে বুঝতে চাইলে এই প্রকাশনাটির প্রয়োজনীয়তা তখন অনিবার্য হয়ে উঠবে। কেননা একজন গৌণ লেখকও একজন মুখ্য লেখক তৈরি হবার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। সেটা যতটা না প্রত্যক্ষে, পরোক্ষে তার চেয়েও বেশি। ফলে প্রধানকে বুঝতে চাইলে অপ্রধানদের ক্রিয়াকর্মের দিকেও আতশিকাচের ভিতর দিয়ে তাকাতে হয়।

বিশেষ এই প্রয়োজনটুকু ছাড়া আপাতত নব্বইজন কবি সম্বলিত এই সমন্বয় প্রয়াসের আর কোনো উজ্জ্বলতর মানে নিহিত নেই আমার কাছে। কেননা নব্বই দশকের কবিতা সম্পর্কিত ধারণা পাবার কাজটিকে একজন পাঠকের জন্যে সম্পাদক মোটেই সহজ করে দিতে পারেন নি, যাতে সেই নির্দিষ্ট পাঠক অল্প আয়াসে এই দশকের কবিতার উজ্জ্বলতর দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। একজন সম্পাদকের যে দায়িত্বটা নেবার প্রয়োজন হয় বলে মনে করি। তাছাড়া সব ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত নব্বইজন কবির সে সমস্ত প্রতিনিধিত্বশীল কবিতাও গ্রন্থটির জন্যে নির্বাচিত হয় নি, যা দ্বারা সেই নির্দিষ্ট কবির কাব্যসৃজন ক্ষমতার সর্বোচ্চ মাত্রাটি নির্ণয় করা যায়। সুতরাং এ আলোচক বলতে বাধ্য যে, ‘নব্বইয়ের কবিতা’ সময়ের সেরা কবিদের সেরা কবিতাগুলোর সংকলন প্রয়াস হয়ে উঠতে পারে নি ; এবং এ কারণেই এটিকে এই দশকের সেরা কবিদের উৎকৃষ্ট-কবিতাসমূহের একত্র সন্নিবেশ না-বলে, নব্বই দশকের কবি বলে বিবেচিত নবীন, অতি নবীন ও আপাত-নবীন কবিগণের বর্ণানুক্রমিক কবিনাম এবং প্রত্যেকের কমবেশি দুটি করে নমুনা কবিতার গ্রন্থনা বলা সংগত।

দশক নামের মাৎস্যন্যায়ী মোমের দেয়াল

দশক-টশক নিয়ে অনর্থক বিতর্কে যাওয়া স্রেফ সময়াপচয় ছাড়া আর কিছু নয় বস্তুত। তবু ‘নব্বইয়ের কবিতা’র দশক বিভাজন শৈলী এবং অর্জন সম্পর্কে একাধটু আলোকপাত মূল প্রসঙ্গে প্রবিষ্ট হবার আগেই সেরে নেয়া প্রাসঙ্গিক জ্ঞান করছি, কেননা আলোচ্য গ্রন্থের নামটি উৎসারিত হয়েছে দশক-ধারণা থেকেই। সম্পাদক লিখিত ‘প্রাককথন’-এ তিনি জানাচ্ছেন, ‘...আধুনিক বাংলা কবিতার দশকি হিসেবে একজন কবির উত্থানপর্ব এবং কৃতিপ্রবণতা চিহ্নিত।’ গ্রন্থটিতে মুদ্রিত অতিরিক্ত প্রাককথন হিসেবে মাসুদুল হক-এর গবেষণা-উপম নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটি (নব্বইয়ের কবিতা) থেকে জানা যাচ্ছে, ‘নব্বইয়ের দশক অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত দশ বছর সময়। এই দশ বছরের কবিতাই নব্বইয়ের কবিতা। এই সময় এখনও পূর্ণ হয়নি।’ উল্লিখিত সংজ্ঞা দু’টি থেকে সম্ভবত এই ধারণায় পৌঁছা যায় যে, সে সব তরুণ কবিই কেবল নব্বইয়ের, যাঁরা আশির দশকের শেষার্ধ (ধরে নেয়া যাক ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত পাঁচ বছর প্রস্তুতিকাল) বা নব্বইয়ের শুরু থেকে লেখালেখি শুরু করেছেন এবং ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই বিকশিত হয়েছেন অথবা বিকাশোন্মুখ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। কিন্তু কবি ও কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বদা সে মানদণ্ডটি যে কার্যকর থাকে নি, গ্রন্থটিতে তার একাধিক নিদর্শন রয়েছে। মাসুদুল হক তাঁর প্রবন্ধের অন্যত্র বলছেন যে, ‘দশক বিভাগ একটা গোলমেলে ব্যাপার। দশক শব্দটি বাংলা সাহিত্য আলোচনায় বিশেষত বাংলা কবিতা আলোচনার ক্ষেত্রে বেশ সমস্যার সৃষ্টি করেছে।’ অথচ এটি বেদনাকর যে এ গ্রন্থটি দশক ধারণায় আরো আরো বিভ্রান্তি যোগ করে, বিভ্রান্তিমূলক প্রয়োগের উদাহরণ স্থাপন করে, উল্লিখিত জটিলতাটিকে শেষপর্যন্ত জটিলতম করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ‘নব্বইয়ের কবিতা’র পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্ত সংক্ষিপ্ত ‘কবি তথ্য’ অনুযায়ী নব্বইয়ের কবি হিসেবে বিবেচিত নব্বইজন কবির বয়সের সর্বোচ্চ ফারাক ২১ বছর (মোহাম্মদ আমজাদ আলী, ১৯৫৬। সাদী তাইফ, ১৯৭৭) পর্যন্ত দৃষ্ট হয়। এটা কীভাবে সম্ভব ? একজন কবি ২৯ বছর (ধরি ১৯৮৫-তে) বয়সে কবিতা রচনা শুরু করছেন, এটা বিশ্বাস্য কোনো ধারণা নয়। এ যুক্তিতে এই গ্রন্থে মোহাম্মদ আমজাদ আলী, সিদ্ধার্থ হক (১৯৫৮), কুমার চক্রবর্তী (১৯৬১) প্রমুখগণকে নব্বই দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত না-করাই সংগত ছিল। উল্লিখিত কবিত্রয়ই বা কী সুখে ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় অন্তর্ভুক্ত হতে সম্মত হলেন? এতদিন জানতাম নারীরা তাঁদের বয়স ভারাতে পছন্দ করেন, এবার জানা গেল কবিরাও পছন্দ করেন দশক ভারাতে। এ বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখা গেল, দশক ভারানোর এই ব্যাপারটি এ দশকে নতুন নয়, শুরু হয়েছে আরো আগে থেকেই। আশির দশকের কবি হিসেবে খ্যাত খোন্দকার আশরাফ হোসেনের দশক বেছে নেয়ার শৈলীনৈপুণ্য এর একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে উক্ত হতে পারে। তাঁর নিজের কলমেই ব্যাপারটি বেশ রসালোভাবে বর্ণিত হয়েছে। পাঠকের সঙ্গেও বিষয়টি শেয়ার করা যেতে পারে মনে করে লেখাটির একটি অংশ উদ্ধৃত করছি--

ষাট দশকের বাসেই উঠব উঠব করে ভাবছিলাম, দেখি খুব ভীড়, ঠেলাঠেলি, বাসের ভেতরে, ছাদে, পাদানিতে অসংখ্য কবি ; বাস ছেড়ে যেতে যেতে দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন জায়গা নেই। আমার ওঠা হল না। ... তারপর সত্তর দশকের বাস গেল, সেখানেও প্রচুর ভীড়, হৈ চৈ, শ্লোগান, উঠব উঠব করে ওঠা হল না। আশির দশকের বাস দেখি হেলেদুলে আসছে, ফাঁকা, ভীড়-ভাট্রা নেই। উঠে পড়লাম।

আমরা ভেবেছিলাম এমন গিজগিজে ভিড় বুঝি কেবল নব্বইয়েই দৃষ্ট হচ্ছে। কিন্তু খোন্দকার আশরাফ হোসেনের উক্তিটি সাক্ষ্য দিচ্ছে যে এমনটি আগেও ছিল। তবে আশিতেও যে ভিড় ছিল না এরকম তো মনে হয় না আমাদের। বছর বিশেকের চেষ্টায় তাঁর হাতটি বেশ শক্ত সমর্থ ও প্রবীণ হয়ে উঠেছিল বলেই বস্তুত তিনি হেলেদুলে আসা বাসের হ্যান্ডেলটি ধরতে পেরেছিলেন। কারণটি মোটেই ভিড় না-থাকায় নিহিত নেই। নইলে আশির এত কবি নব্বইয়ের লম্বাটে ট্রেনে চেপে গেছেন কেন? নিম্নোক্ত বিবেচনাগুলো ধর্তব্যের মধ্যে আনলে দেখা যাবে যে, অন্তর্ভুক্ত এক ঝাঁক কবির গায়েই আশিজনোচিত গন্ধের প্রকাশ। ব্রাত্য রাইসু (ফরিদ কবির সম্পাদিত ১৯৮৬-তে প্রকাশিত দুই বাংলার প্রেমের কবিতায় অন্তর্ভুক্ত সর্বকনিষ্ঠ কবি), শামীমুল হক শামীম (মজিদ মাহমুদ সম্পাদিত 'আশির দশক : কবি ও কবিতা' নামক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত, 'আবার একটি ঝড় উঠুক' নামে বিপ্লবের কবিতা গ্রন্থ সম্পাদনা করছেন ১৯৮৮-তে), শাহেদ শাফায়েত ('কোরপাটেলিক' নামক কবিতা গ্রন্থিকা প্রকাশ করছেন ১৯৮৯-এ), মাসুদুল হক ('কবিতা সিরিজ' সম্পাদনা করছেন ১৯৯০-এ), শামসুল আরেফিন ('ঈশ্বরের অন্ধ প্রেমিকারা' ছাপছেন ১৯৯০-এ) এবং সরকার আমিন ও শাহনাজ মুন্নী (যৌথভাবে 'রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর' প্রকাশ করছেন ১৯৯০-এ) এ তালিকায় বিবেচ্য। কেননা কবিতার সাথে মাত্র প্রস্তুতিকালীন চার/পাঁচ বছরের সম্পর্কের ফলাফল দিয়ে কেউ বই করেন না সাধারণত। তার মানে এঁরা কবিতার সঙ্গে বসবাস শুরু করেছেন আশির দশকের শুরু থেকেই। ইতোমধ্যেই উত্থানপর্বে আরোহণ না-করে সুকৃতি বৈ কুকৃতি সহযোগে পাঠক সকাশে তাঁর প্রথম গ্রন্থ অন্তত কোনো সৎ ও নিষ্ঠ নবীন কবিতাকর্মী নিবেদন করতে পারেন না। সম্পাদনাগ্রন্থও নয়। অর্থাৎ বলতে চাই, এ সময়পরিধিতেই উল্লিখিতগণ লেখক হিসেবে তৈরি হয়ে গেছেন। তাঁদের একটি কবি পরিচিতিও তখনই গড়ে উঠেছে এবং নানা কাগজে তাঁদের কবিতাকর্ম সম্পর্কে লেখালেখিও হয়েছে। সুতরাং এটা কি সিদ্ধান্ত করা যায় না যে, এঁদের প্রস্তুতিকাল শুরু হয়েছে আশির দশকের প্রারম্ভে এবং বিকাশপর্ব (সম্পাদকের ভাষায় উত্থানপর্ব ও কৃতিপ্রবণতা) চিহ্নিত হয়ে গেছে অন্ত্য-আশিতেই?

আহমেদ নকীব, আদিত্য কবির, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, আশিক আকবর, ঈশান জয়দ্রথ, কবির হুমায়ূন, তাপস গায়েন, দাউদ আল হাফিজ, পাবলো শাহি, পরিমল রায়, ফাহিম ফিরোজ, মিহির মুসাকী, মাহবুব পিয়াল, রওশন ঝুনু, রণক মুহম্মদ রফিক, শামীম ফারুক, শাহীন শওকত ও হেনরী স্বপনসহ আরো কেউ কেউ ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় অন্তর্ভুক্ত কবিদের মধ্যে বয়স এবং চর্চার সময়কাল বিবেচনায় অগ্রজ। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ১৯৬৫-এর জাতক এবং আশির দশকের কবি হিসেবে ওই দশকেই অল্পবিস্তর পরিচিত। ঢালাওভাবে এঁদের নব্বই দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত করবার আগে কিছুটা পুনর্বিবেচনার অবকাশ ছিল বলে মনে করা অসংগত নয়। অন্যদিকে যাঁদের বয়স এখন মাত্র ২২/২৩ (আবু আহসান, আমিনুল বারী শুভ্র, ইমরুল হাসান, মশিউর রহমান খান, মাসুদ আশরাফ, সাদি তাইফ, রবিন আহসান প্রমুখ), পূর্বোল্লিখিত অগ্রজদের পাশে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি একটু বেখাপ্পা বোধহয়। এঁদের কবিতাবাস কাল বড়োজোর ৫/৭ বছরের অধিক তো হতেই পারে না। কবিতার সাথে মাত্র ৫/৭ বছরের সম্পর্কের স্বীকৃতি মাহবুব কবিরের মতো পূর্ববর্তী দশকের কবিতা-সংকলকগণের কেউ দাগিয়ে দেন নি বলেই বুঝি আশির দশকের কবি হিসেবে বিবেচনাযোগ্য প্রায় জনাত্রিশেক কবির সংকলনের ভার ‘নব্বইয়ের কবিতা’র ওপর বর্তে গেল? শেষোক্ত কনিষ্ঠ ক’জনের বয়সের সীমায় অবস্থান করেন, এমন নিয়মিত কবিতাকর্মী (যাঁরা ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় অন্তর্ভুক্ত নন) বাংলাদেশে আরো কম করেও শ’খানেক তো রয়েছেনই। তাঁরাই বা এতে অন্তর্ভুক্ত হলেন না কেন? এক্ষেত্রে এরকম যুক্তি উত্থাপিত হতে পারে যে অন্যদের চাইতে তুলনামূলকভাবে এঁরা এগিয়ে গেছেন পঠন-পাঠন, দৃষ্টিভঙ্গির বিশিষ্টতা এবং রচনাশৈলীতে। একথা স্বীকার করে নিয়েও যুক্তির প্রয়োজনে বলতে চাই যে, এমন আরো একগুচ্ছ নাম উল্লেখ করা সম্ভব, যাঁদের কেউ কেউ শেষোক্তদের চাইতে তাঁদের স্বসৃষ্ট রচনার গুণে-মানে কিংবা পঠন-পাঠনে পিছিয়ে নেই ; এবং যা বলা সংগতও। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ স্তরের কবিদের মধ্যে আছেন সাইদ র’মান, বদরে মুনীর, ফিরোজ এহতেশাম, আহমেদ মুনীর, কাজল কানন, অনিন্দ্য জসীম, শতাব্দী কাদের, সরকার প্রদীপ, সাইমন জাকারিয়া, জ্যোতি পোদ্দার, স্বাধীন চৌধুরী, আহসান আলম, শাহিদ হাসান, সৌমেন ধর, অতনু তিয়াস, বিল্লাল মেহদী, মাহমুদ সীমান্ত, রাজীব আর্জুনি, দীপ্র আজাদ কাজল, সাইম রানা, রৌদ্রী রিপন, মাঈন মজুমদার, জীবন নজরুল, খোকন মাহমুদ, সৈয়দ আহমদ শামীম, তুষার কবির প্রমুখ।

এখানে আরো দুটি তালিকা উপস্থাপন করা যেতে পারে। (এক) যাঁরা এ গ্রন্থের সাধারণ বিবেচনা অনুযায়ীই নব্বই দশকের কবিতাকর্মী হিসেবে কল্কে পেতে পারতেন, যথা : আনন্দ রোজারিও, জফির সেতু, মাহবুব লীলেন, দিলীপ সেন, ফখরুল আহসান, শিমুল আজাদ, ফজলুর রহমান বাবুল, শৈবাল আদিত্য, মামুন মাহবুব, রাজু আলীম, বাশিরা ইসলাম, শান্তা মারিয়া (তালিকাটি আরো দীর্ঘ হতে পারে) ; এ গ্রন্থে কোনো কারণে অনুপস্থিত। যদিও এঁদের প্রত্যেকেরই বিবেচনাযোগ্য কবিতা নানা ছোটকাগজ ও সাহিত্য সাময়িকীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। (দুই) প্রকাশিত কোনো কাব্যগ্রন্থও নেই কিংবা অন্তত কমপক্ষে ২০টি কবিতা নানাদিকে প্রকাশিতও হয় নি, এমন কারো কারো উপস্থিতিও এ গ্রন্থে দৃষ্ট হয়েছে। যেমন : অদিতি ফাল্গুনী (বাংলা ছোটগল্পে এক নতুন কণ্ঠ হিসেবে ইতোমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছেন। গত একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ‘ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ’ পাঠকমহলে প্রশংসিত হয়েছে), লীসা অতন্দ্রিলা প্রমুখ।

তাহলে যাঁরা ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাঁরা কোনো এক অনুল্লেখ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, আর যাঁরা হন নি তাঁরা পিছিয়ে পড়া, এটাকেই কি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চাচ্ছেন সম্পাদক? না, সম্পাদকের এই স্বীকারোক্তি তা প্রতিষ্ঠিত হতে দিচ্ছে না যে, ‘সূচিভুক্ত কবিরা সকলেই নিপুণ সিদ্ধির বিবেচনায় শ্রেষ্ঠত্বের ট্রেডমার্কধারী নন, নন কোনো অবিকল্প প্রতিনিধি-- মার্গপ্রাপ্ত।’ অর্থাৎ অনেকেরই হয়ত বিকল্প খুঁজে নেয়া যেত। কেননা ‘নব্বইয়ে-- দশক ব্যাপ্তির আঙিনায় জড়ো হওয়া গ্রন্থভুক্ত নব্বইজন কবিকণ্ঠ ব্যতীত নিশ্চিতভাবেই আরো ভালো বা গড়পরতা মানের কবিকৃতি রয়েছে, যা আমরা কম্যুনিকেট করতে পারিনি।’ তার মানে ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় যেটুকু অর্জন সম্ভব হয়েছে, সম্পাদকের লক্ষ্য ছিল অর্জনের এই সীমাকে ছাড়িয়ে আরো কোনো দূরতম উচ্চাসনে গ্রন্থটিকে অধিষ্ঠিত করা। ‘কারো ঠিকানা হদিশ না করতে পারা, কারো নিরুদ্দেশ প্রবণতা, কারো অহম ও ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য, কারো প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, কারো বা নীরব ভর্ৎসনা’ ইত্যাদি তাঁকে সে লক্ষ্যে পৌঁছুতে দেয় নি। যুক্তি হিসেবে এগুলো প্রায়-অখণ্ডনযোগ্য, সন্দেহ নেই।

মহজ্জনের সন্ধানে গুণি অঙ্গুলি

কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্র বাদ দিয়ে ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় সাধারণত প্রত্যেক কবিরই দুটি করে কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশেষ এই ক্ষেত্রসমূহে সম্ভবত নিম্নোক্ত দুটি ভিন্ন বিবেচনা কাজ করে থাকবে। (এক) যাঁদের দুটির অধিক কবিতা ছাপা হয়েছে, তাঁরা কবি হিসেবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং (দুই) যাঁদের দুটির চেয়ে কম অর্থাৎ একটি, তাঁরা গড়পরতা মানে অগুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে যে সম্পাদক একই দশকে ঢালাওভাবে ৯০ জন কবিতাকর্মীকে সাধারণ স্বীকৃতি দিলেও তাঁর দৃষ্টিতে প্রধান-অপ্রধান এবং মধ্যম মানের কবিদের চিহ্নিত করবার দায়টি এড়িয়ে যান নি। প্রধান-অপ্রধান বিবেচনায় তাঁর মতের সাথে সব ক্ষেত্রেই একমত না-হতে পারা গেলেও, সম্পাদক হিসেবে তিনি যে এই ঝুঁকিটুকু নিচ্ছেন, এজন্যে তাঁকে সাধুবাদ জানিয়ে রাখা যায়। এখানকার কোনো প্রধান বলে চিহ্নিত কবি হয়ত কালের বিচারে গৌণ বলে প্রতিভাত হতে পারেন, আবার উলটোভাবে গৌণ বলে চিহ্নিত কেউ হয়ত অন্যতম প্রধান বলে সম্মানিত হতে পারেন। চিহ্নিতকরণের এরকম সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও নিষ্পন্ন কর্মটি জরুরিই। বিশেষ তালিকা দুটির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। সম্পাদকের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়া কবিগণ হচ্ছেন আহমেদ নকীব (মুদ্রিত কবিতার সংখ্যা : ৫টি), আদিত্য কবির (৩টি), আহমেদ স্বপন মাহমুদ (৩টি), আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ (৪টি), আশরাফ রোকন (৩টি), ঈশান জয়দ্রথ (৪টি), কামরুজ্জামান কামু (৫টি), চঞ্চল আশরাফ (৫টি), জ্যাকি ইসলাম (৩টি), টোকন ঠাকুর (৪টি), তুষার গায়েন (৪টি), ব্রাত্য রাইসু (৪টি), বায়তুল্লাহ কাদেরী (৩টি), বায়েজীদ মাহবুব (৬টি), মাহবুব কবির (৬টি), মাহবুব পিয়াল (৩টি), মারজুক রাসেল (৪টি), মুজিব ইরম (৬টি), মোহাম্মদ আমজাদ আলী (৩টি), লীসা অতন্দ্রিলা (৩টি), শামীমুল হক শামীম (৪টি), শোয়াইব জিবরান (৬টি), শামীম কবির (৫টি), শিবলি মোকতাদির (৪টি), শামীম ফারুক (৫টি), সিদ্ধার্থ হক (৪টি), সরকার আমিন (৪টি), সৈকত হাবিব (৩টি), সৌমিত্র দেব (৩টি), সাহেদ কায়েস (৩টি), হেনরী স্বপন (৩টি) ও হাদিউল ইসলাম (৩টি) ; এবং একটি করে কবিতা রয়েছে এমন গৌণ (মনে করা যেতে পারে যে এঁদেরকে গৌণভাবে বিবেচনা করা হয়েছে) কবিগণ হচ্ছেন অদিতি ফাল্গুনী, আশিক আকবর, পাবলো শাহি, পাঁশু প্রাপণ, মাসুদ আশরাফ, মজনু শাহ্, রায়হান রাইন, রণক মুহম্মদ রফিক, শামীম রেজা, সামীম আরা ও হামিদ রায়হান।

উজানমুখী কবিতাভ্রমণ

তরুণ কবিগণ প্রতি দশকেই তাঁদের লেখালেখির শুরুর সময়ে ছোটকাগজ (সংজ্ঞাটা অতটা স্পষ্ট ও সর্বজনীন নয়) বা উজানপত্রমুখী হন। হন, কেননা তাঁরা সজ্ঞানে এবং অজ্ঞানে মনে করতে থাকেন যে আমি ঠিক প্রচলিত ঘরানার লেখনচর্চা করি না। লিখি একটু অন্যরকম, কাজেই আমার প্রকাশের জন্যও দরকার একটু অন্যরকম কাগজ। কারণ অন্যরকম কোনোকিছুকেই ব্যবসায়িক-প্রতিষ্ঠান-প্রযোজিত কাগজ প্রকাশ করতে সাহসী হয় না। তাঁরা অন্তত আর যাই হোক, পৈতৃক সাহিত্যস্রোতটি পুরানো রেখা ফেলে কোনো নতুন ও প্রতিষ্ঠানের জন্যে হুমকিস্বরূপ চিন্তনপ্রবাহে সওয়ার হোক এটা চান না। ফলে বদ্ধ জলাশয়ের মতো ওই মৌলবাদী-পঙ্কপুকুরে নতুন বর্ণগন্ধসমেত কোনো জলের প্রবেশ যাতে না ঘটতে পারে এ ব্যাপারে তারা সদা-সচেষ্ট থাকে। ফলে কেউ কেউ দীর্ঘ লেখনঋতুর বড়ো অংশটাই অতিবাহিত করেন স্পর্ধিত ছোটজগতে। কেউ কেউ একসময় অধৈর্য হয়ে পড়েন এবং বড়ো কোনো প্রয়োজনে সামিল হোন বড়োদলে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করা এই রচনাটির উদ্দেশ্য নয়। বলতে চাই, এই ছোটকাগজমুখীনতার, নতুন কিছু করা হচ্ছে এই ঘোষণার আদৌ কি কোনো ভিত্তিবস্তু রয়েছে, নাকি নিজেদেরকে আলাদা গ্রহচারী হিসেবে প্রমাণ করবার জন্যই নতুনত্বের এই ঘোষণাটি দেয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজবার জন্যে ‘নব্বইয়ের কবিতা’কে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ এই সংকলনটিতে অন্তর্ভুক্ত নব্বইজনের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ কবিই বিকশিত হয়েছেন ছোটকাগজে। যাঁদের একটি ক্ষুদ্র অংশ এখনো ছোটকাগজের বাইরে লিখেন না। কেউ কেউ গাছের-তলার উভয়স্থলেরটাই কুড়ান, বাকিরা (একটা লঘিষ্ঠ অংশ) আগাগোড়াই বেড়ে উঠেছেন ব্যবসায়িক-প্রতিষ্ঠানের কাগজে, এখনো ওসব প্রতিষ্ঠান-প্রযোজিত সাময়িকীরই শোভাবর্ধন করে চলেছেন।

আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনাবলি রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর যে প্রভাব ফেলে, একজন কবিও সে প্রভাবের বাইরে থাকেন না ; যেহেতু তিনিও নির্দিষ্ট রাষ্ট্রেরই একটি ক্ষুদ্রতম অংশ। কাজেই একজন কবিতাকর্মী, তিনি ব্যবসায়িক-অব্যবসায়িক যে কোনো কাগজেই লিখুন না কেন, সময় যে পরিবর্তনটি ব্যবহার্য ভাষায় এবং নৈমিত্তিক যাপন-আচরণে নিয়ে আসে, তার প্রভাব সে সময়কার একজন নিয়মিত লেখকের লেখায় পড়তে বাধ্য। তাহলে ছোটকাগজের লেখকগণ যখন নতুনত্বের কথা বলেন, তখন নিশ্চয়ই এই সাধারণ পরিবর্তন, যা সব মাধ্যমের লেখকগণের মধ্যেই পড়ে ; তাকে বোঝাতে চান না। বোঝাতে চান অন্য আরো কিছুকে। কিন্তু সেই ‘আরো কিছু’টা কী তা খুঁজে বের করে আনতে পারলে সত্যি সত্যিই একটা কাজের কাজ হতো। তা নইলে নতুনের এই ডাকনাম, তার বিদঘুটে রহস্যময় এসেন্স পাঠককে কেবলই তাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকবে দূরাধিক কুয়াশায়।

এই ‘আরো কিছু’কে শনাক্ত করবার কাজটি অতটা সহজ নয়-- এটা জানি। কেননা এ গ্রন্থটির সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো দূরত্বই প্রায় নেই। যে প্রয়োজনীয় দূরত্বটির কথা মুখবন্ধে বলবার প্রয়াস করেছি। আমি নিজেও এ গৃহেরই বাসিন্দা এক। তাছাড়া এজন্যে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের বিস্তৃত মানচিত্রে ফলে যাওয়া শস্য সম্পর্কে যে ভাসা ভাসা খড়কুটো পরিমাণ ধারণা অন্তত মস্তিষ্কের ধারণাবলয়ের মধ্যে থাকা দরকার, দুঃখজনক যে সে-স্থানটিতেও আমি হতদরিদ্র। সুতরাং অল্প প্রজ্ঞাসম্মত দৃষ্টি দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের ভিতরে বাস করে সেই পরিমণ্ডলের ব্যাপারে কিছু বলবার চেষ্টা যতটা সফল হতে পারে, এ রচয়িতাও তার চেয়ে বেশি কোনো সাফল্যের জায়গায় উপনীত হতে পারবে না। তবু এটা করতে প্রবৃত্ত হচ্ছি এ কারণে যে, অন্য কেউ, যিনি এ কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করবার ক্ষমতা রাখেন ; আমার এহেন অক্ষমতাদৃষ্টে কৌতূহলবশত হয়ত তাঁর প্রজ্ঞাবয়ানে প্রণোদিত হতে পারেন।

কী দেখে বুঝি যে তুমি আমার?

এখানে প্রথমে চিহ্নিত করা যাক সেই বৈশিষ্ট্যসমূহ, প্রধানত যা ‘নব্বইয়ের কবিতা’রই বৈশিষ্ট্য। এর ভিতর থেকে তারপর আলাদা করে নেবার চেষ্টা করা যাবে সেইসব বৈশিষ্ট্যকে, যা নতুন (যদি আদৌ তা থেকে থাকে) এবং এই দশকেই কেবল প্রকট আকার ধারণ করেছে ; যার মূল ইতঃপূর্বেকার কোনো কাল-পরিমণ্ডলে হয়ত নিহিত আছে অথবা নেই। লেখা বাহুল্য, এখানে ‘নব্বইয়ের কবিতা’র বিভিন্ন চিহ্নিত প্রবণতার সমর্থনে তুলে আনা হবে নির্বাচিত কাব্যাংশ। এ কথা জেনেই যে, অংশত উদ্ধৃতি কখনো সম্পূর্ণ কবিতার আস্বাদ দিতে পারে না এবং তা গর্হিত কাজ বলে বিবেচিত হবারও অবকাশ থাকে। এছাড়া আপাতত আমার গত্যন্তর নেই। উল্লেখ্য, যাঁদের কবিতাংশ এখানে উদ্ধৃত হলো, তাঁদের বাইরেও আর কারো কবিতায় নির্দিষ্ট প্রবণতার উপস্থিতি নেই, এ তালিকাটি তা প্রমাণ করে না কিংবা উদ্ধৃতিসমূহ এ-ও প্রমাণ করে না যে নির্দিষ্ট কবিতাটি সামগ্রিক বিবেচনায় একটি উৎকৃষ্ট কবিতা। এ পর্যায়ে গ্রন্থভুক্ত সকল কবিতার দিকেই সমান যত্নে তাকানো হবে। কবিতা কবিতা হয়ে উঠলে তা হয়ে ওঠে সব দশকেরই। দশকের কিংবা ব্যক্তিগত কু-সম্পর্কের চাকু দিয়ে উৎরে যাওয়া কোনো কবিতাকে কেটে ফেলানো যে শিল্পপাপ, সেই পাপে পাপী হবার বিন্দুমাত্র খায়েশ এ নিবন্ধকারের নেই।

এখানে দুটি কৈফিয়ত দিয়ে রাখা জরুরি ; প্রথমত, নব্বইয়ের কবিদের প্রচুর সংখ্যক কবিতা পড়ে এতদিন কোনো নির্দিষ্ট কবিকে যেভাবে চিনে এসেছি-- এ লেখাটিতে তাঁকে অন্যরূপে চিহ্নিত করতে হতে পারে। কারণ নির্দিষ্ট কোনো কবির কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য যাই থাকুক না কেনো, এখানে সেই কবির যে কবিতাটি বা কবিতাগুলি মুদ্রিত হয়েছে, সেটি বা সেগুলি তাঁর লিখিত বিচ্ছিন্ন কবিতা হলেও, তাঁকে সেভাবে বিবেচনা না-করে উপায়ান্তর নেই। কারণ এই লেখাটির বিস্তার নব্বই দশকের কবিতা পর্যন্ত ব্যাপ্ত নয় বরং ‘নব্বইয়ের কবিতা’ নামক গ্রন্থ পরিসরে সীমিত।

দ্বিতীয়ত, ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় গ্রন্থস্থ কিছু কবির কবিতা, আলোচনার জন্যে আমার তৈরি নির্ধারিত ছাঁচের ভিতরে ধারণ করা সম্ভব হয় নি। অন্য কোনো ছাঁচে ফেলে আলোচনাটি এগিয়ে নিলে হয়ত এঁদের কবিতার প্রকৃত চরিত্রটি ধরা যেত। তাতে ধরা গেছে এমন কোনো কোনোটিকে আবার ধরা যেতও না। সকল পন্থারই কিছু না-কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। সুতরাং অন্য পন্থা অবলম্বনের চিন্তা আপাতত বাদ দেয়াই সংগত। হতে পারে যে, দুর্ভেদ্য কবিতাগুলিতে এমন বৈশিষ্ট্যসমূহ সমুপস্থিত, যা চিহ্নিত করা সম্ভব হলে প্রকারান্তরে ‘নব্বইয়ের কবিতা’র প্রাচুর্যই চিহ্নিত হতো।

১. প্রত্নখনির সন্ধান স্পৃহা

প্রাকৃতজনের মননশীল ও সৃজনশীল তাবৎ-কৃতিকে পূর্বপুরুষের সম্পদ বিবেচনা করে উত্তরাধিকারের দাবিতে নিজেদের সৃজনকর্মে তার যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রবণতা এ সময়ের কবিতায় বহুলদৃষ্ট। এক্ষেত্রে কেউ কেউ সেসব কৃতির কেবল উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন, কেউ বা আরো গভীর গভীরতর আন্তর্বয়নের মাধ্যমে উপনিষদ, বেদ-পুরান-কোরান, রামায়ণ-মহাভারত, লৌকিক পুরাণ, লোকবিশ্বাস, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা, লোককাহিনি, রূপকথা ইত্যাদিকে সাম্প্রতিক প্রেক্ষায় প্রাসঙ্গিক করে তুলছেন। এ লক্ষণের প্রচুর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে ‘নব্বইয়ের কবিতা’য়।

১. ... কৃষাণীর কোলে মাথা রেখো যুবরাজ, নাম দেবো তার ডালিমকুমার, যদি ডালিমের দানা ঝরে ... (শিকড়গুচ্ছ, শাহেদ শাফায়েত)

২. কলা বিক্রেতার কাছে শুনেছি কর্ণের কথা-- শেষ দৃশ্যে কর্ণের চে’ রথ, আহা কী যে দর্শনীয় ... (কুরুক্ষেত্রে - ১, বায়েজীদ মাহবুব)

৩. ... কবেকার গন্ধময় জৈগুন বিবির কিচ্ছাতে শুকাতে দিয়ে বরেন্দ্রর ঘাসে ফিরোনি পত্তুর তুমি ভাবুক, দ্রাবিড়, ... (অনার্য মাদুলী, বায়তুল্লাহ কাদেরী)

৪. ঘুমের ভেতর কে পরালো স্বর্ণের অঙ্গুরি ? মধুমালা! মধুমালা! বেআকুল মদন। সজাগ কুমার তুমি অঙ্গুরি খোয়া গেছে বোয়ালের পেটে। (রূপকথা ১, মুজিব ইরম)

৫. লালনের কণ্ঠ সাধে বনের উপান্তে শীষনাগের কুণ্ডলীতে আমরা ঘুমিয়ে আছি ... (চংক্রানুক্রমণ, পুলক পাল)

৬. ... তবু সেই বায়ু বর্জ্য হয়ে বয়ে যায় অব্যক্ত অপান ... ... মাংসের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে তার নাম ব্যান ... তবু সেই বায়ু সমতা বিধান করে হয়েছে সমান ... আর যে উদান, সুখে ও দুঃখে ভরা হৃদয়ের সে আমার সকল গান ; ... (বায়ুবন্ধ, খলিল মজিদ)

২. শাশ্বত বাঙালি-জীবনঘনিষ্ঠতা

বাঙালির শাশ্বত জীবনপ্রবাহ, সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে তার যেভাবে বেঁচে থাকা জৈবনিক হাজারো অনুষঙ্গ-প্রতিষঙ্গসহ ; তার মধ্যকার তাৎপর্যপূর্ণ (ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক) বিষয় ও ঘটনার অনুকৃতি আমাদের কবিতায় বরাবরই ছিল। যা না-থাকলে দেশের মাটি থেকে শিল্প-সাহিত্যের মূলোচ্ছেদ হয়ে যেত সেই কবে। বাঙালির যা কিছুই নিজস্ব ও উজ্জ্বল, বারেবারে তা পরবর্তী প্রজন্মের সামনে নিয়ে আসাকে নব্বইয়ের কবিগণ ব্রতজ্ঞান করছেন। ধর্মীয় ভেদ এক্ষেত্রে কোনোই গুরুত্ব পাচ্ছে না।

১. ... এবারও তো হবে গান তিন নিশি তিনকাল হবে পান মথুরার মদির সলিল মৃদঙ্গের শব্দে আসে জোনাকির স্বর সুচক্রদণ্ডী গ্রাম আমাদের ঘর ... (কীর্তনীয়া, জাফর আহমদ রাশেদ)

২. ... অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছাইভস্ম উড়িয়ে বাতাসে প্রান্তরের অবিরাম হরিবোল শববাহকেরা সব ফিরে গেছে লোকালয়ে ... (লৌকিক স্তোত্র, আহমেদ বাদল)

৩. বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তিনিষ্ঠা

সবকিছুতেই বিজ্ঞান সমুপস্থিত। একজন সাধারণ মানুষও এখন আর বিজ্ঞানের বাইরে বাস করেন না। যুক্তিপূর্ণ যেকোনো বাক্যই বিজ্ঞাননিষ্ঠতা মেনে চলে, সুতরাং প্রত্যেক কবিই প্রায়শ বিজ্ঞাননিষ্ঠ। কিন্তু কেউ কেউ এরও অধিক বিজ্ঞানশাস্ত্রকে তাঁদের কবিতার প্রধানবিষয় কিংবা প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছেন। নব্বইয়ের কবিতায় এ লক্ষণ অনেকটাই প্রকট।

১. এখানে হেলে যাওয়া মাধ্যাকর্ষণে অজাতক অণুমেঘ শূন্যগর্ভদিনে জীবন-কাঠামো থেকে জাগে-- ঠিক অজানা রেডিও স্টেশনের রহস্যময় ঈথার-সঙ্কেতের মতো (গুপ্তদিন, কুমার চক্রবর্তী)

২. ... স্পেস ধরে রাখে এমন শূন্য শূন্য ধারণ করে এমন শূন্যলোক বিন্দুকে ধারণ করে এমন বৃত্ত বৃত্ত ধরে রাখে এমন গোলক লোকলোকান্তর ধরে রাখে এমন লোক এমন চক্র ... (আনাবাস-২.১, দাউদ আল হাফিজ)

৩. অসংখ্য পরমাণু বৃত্তের ভেতর ঘুরছে প্রতিনিয়ত রঞ্জনরশ্মি আলো ছড়িয়ে পড়ে বিন্দু বিন্দু টসটসে ঘামে ... (বিন্দুবৃত্ত, শামীমুল হক শামীম)

৪. পাতার বিন্যাস নিয়ে জাগ্রত পৃথিবী অসম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে বিভাজিত হতে থাকে ... (পদ্যসমুচ্চয়, তাপস গায়েন)

৫. ... যে বলয় চতুর্বৃত্তে উদ্ধৃত্ত রশ্মির মতো স্বর্ণনাভ, আর-- ঘন সন্নিবিষ্ট বর্গে তৃণাঙ্কুর রেখে আনে ষষ্ঠি অসূয়া’র। ... (অমিয় উপাত্ত-কৃতি, পাঁশু প্রাপণ)

৬. ডিসেকশন টেবিলে একটা পাখি হাতের ফরসেপ কেড়ে নেয়, নাইফ সিজর এবং যাবতীয় কিছু তারপর উড়তে থাকে দিগন্ত থেকে দিগন্তে টেবিলে পড়ে থাকে এ্যাপ্রোন শাদা একটা পালক (স্মৃতিগ্রহের বরষাত/উত্তর কৈশোর বিভাগ, সাহেদ কায়েস)

৭. ... কয়েকটা পাকা কাকরোল ঝুলে থাকে ইলেক্ট্রিকের তারে ভাবি-- ওরা কি জ্বলে উঠবে ইলেক্ট্রন-ফিলামেন্টে ? ... ... ক্লোরফিল বাকলে ইলেক্ট্রন উৎসাহে ওরা কি জ্বলে উঠবে ? (শহরের ল্যাম্পপোস্টে পাকা কাকরোল, আবু আহসান)

৪. আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের জীবনচিত্রণ

নিজস্ব জাতিসত্তা বিষয়ে আদিবাসীগণ ইতোমধ্যে সজাগ হয়ে উঠেছেন। যার পরিণতি এসেছে পার্বত্যাঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে। আদিবাসী ও উপজাতিদের মধ্যকার একাধিক সম্প্রদায় এখন আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায়ও আগ্রহী হয়ে উঠছে। যুগ যুগ ধরে উপেক্ষিত এসব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এখন ছড়িয়ে পড়ছে নানা সেক্টরে। যাপনপ্রণালিতে আসছে বৈভিন্ন্য। ফলে ঐতিহ্য-বিচ্যুতির একটি হুমকিরও মোকাবেলা করতে হচ্ছে এদের। জেগে উঠছে অন্তর্বেদনা। ফলে ওদের মধ্য থেকেও বেরিয়ে আসছে একাধিক কবিতাকর্মী। যদিও ব্যাপক পাঠকসমাজে তাঁরা এখনো নিজেদেরকে পরিচিত করে তুলতে পারেন নি। পাশাপাশি বাঙালি কবিগণও আদিবাসীদের জীবনাচার, তাঁদের সুখ-দুঃখ নিয়ে কবিতা লেখবার প্রয়োজন অনুভব করছেন। লক্ষণীয় যে, এক্ষেত্রে কবিগণ দূর থেকে কেবল তাঁদের ব্যবহার্য সামগ্রী কিংবা তাঁদের ব্যবহৃত উপভাষার শব্দাদির উল্লেখেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, মিশে যাচ্ছেন তাঁদের ভাবনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে এবং উঠিয়ে আনছেন তাঁদের অন্তর্গত বেদনার চিত্রটিকেই। ‘নব্বইয়ের কবিতা’য় এরকম আন্তরিকতাপূর্ণ, হার্দ্য উচ্চারণ চোখে পড়ছে সুপ্রচুর।

১. ... দূর পাহাড়ের গ্রামে বাড়ে গারো মেয়ে ; পরকীয়া জানে! টিলার ওপারে তার পাতক নাগর ... চৈত্রের দুপুরে বন পোড়ে, উচ্চগ্রামে গারো যুবতীর পরকীয়া মন পোড়ে (পরকীয়া, পরিমল রায়)

২. পিননের ভাঁজে ভাঁজে জুম্ববি নাচে স্বাপ্নিক গলে পরে গুঞ্জার মালা আকণ্ঠ নিমগ্ন দো-চোয়ানি জ্বালা বৃষ্টি রৌদ্রে ভিজে মরে আর বাঁচে ... (পিনন, অলকা নন্দিতা)

৩. ... ক্ষয়ে গেছে এপিটাফে খোদাই করা নাম আমি জোসেফ র‌্যামা কংস নদীর পাড়ে লাঙ্গলজোড়া গ্রামের কবি ... (নির্বাসন, আকরাম খান)

৪. ... সাঁওতালী মহুয়ার মেয়ে নিজ রক্ত ঘামে খোঁজে অহল্যার জরায়ু সলিলে মাখা মৃত্তিকার স্বাদ (উৎসব, আমিনুল বারী শুভ্র)

৫. পরোক্ষ উদ্ধৃতি বা পুনর্নির্মাণপ্রবণতা

ধ্রুপদী সাহিত্যের সেইসব মহান সৃষ্টি, যা পাঠকসমাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল এবং এখনো যার মহিমা অমলিন-- নিজেদের সৃজনের পর্যায়ে অংশত তা যথা-জায়গায় সচেতনভাবে নিজের মতো করে কিংবা হুবহু উঠিয়ে আনার প্রবণতা বাড়ছে। এর ভিতর দিয়ে স্মৃতির ওপরে পড়া মেদুর আবরণ দূর করে অতীত উজ্জ্বলতাকে মনে পড়িয়ে কিংবা সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন আমাদের কবিগণ।

১. এমনি সময়ে তারে বলা যায় এইরূপ বর্ষাকাল ... (অধিবিদ্যার ময়ূর, শিবলি সাদিক)

২. ... তবু কয়জনা ডেকেছে তোমারে-- আয় দুষ্টু ঘরে আয়-- দুধমাখা ভাত কাকে খায়-- (সে ক্যানো আসে না নিতে মোরে, অরূপ রাহী)

৩. কালের যাত্রার ধ্বনি কে রুধিতে পারে? না জানি কেন রে প্রাণের কৃষক ভায়েরা আমার আর ফিরে নাই ঘরে ... (আমাদের ছোট ছোট গ্রামগুলি, জহির হাসান)

৪. এখন না কবো কথা আগে বলি অলসতা কাটা বা না কাটা ... (রোগশয্যার আলোবাদ্য, শামীম কবীর)

৬. স্কিজো-ভাষাচ্ছন্নতা

যে ভাষা আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক ; শব্দবিন্যাসের প্রচলিত যুক্তি শৃঙ্খলাকে যে ভাষা ভেঙে ফেলে, স্বাভাবিক ভাষাজ্ঞানে যার অর্থোদ্ধার করা প্রায়শ অসম্ভব হয়ে ওঠে-- তাই স্কিজো-ভাষা। এমনও মনে করা হয় যে স্কিজো-ভাষাতেই প্রকৃত কবিতার মুক্তি। নব্বইয়ের বাংলা কবিতায় ভাষার এরকম আপাত বিশৃঙ্খল বিন্যাস চোখে পড়ে অনেকের কবিতায়ই। বলা ভালো যে, একজন সতর্ক ও সৎ কবি যখন ভাষার এরকম বিন্যাসে আগ্রহী হন, তখন এমন মনে করবার কোনো কারণ নেই যে, সেই নির্দিষ্ট কবির স্বাভাবিক ও বোধ্য ভাষাজ্ঞানের অভাব রয়েছে। পরাবাস্তব সাহিত্য দর্শনে ভাষার এরূপ আপাত বিশৃঙ্খল বিন্যাসেরও শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যাখ্যা মিলে।

১. ... একটি ঘোড়া দৌড়েছিলো কাল সুতোর ওপরে রোমগুলো তার কাঁপছিলো-- (রেখা, আহমেদ স্বপন মাহমুদ)

২. ... কান কাঁদে। ... কড়মড় চাবিয়ে খাই ইট। ... আমি কবি হয়ে উঠি। ... (আশিক আকবর, প্রথমের সঙ্গীত)

৩. ... অবগাহনের হৈমন্তিক ফোটায় মুদ্রিত তোমার তমসা, শতঘুম। ... (প্রহেলিকা, মজনু শাহ্)

৪. ... যখন গাছের মতন হাওয়া বয় এবং পৃথিবীর রূপ হয় অনেকটা সমতল ঠিক তখনই ডানায় ভর দিয়ে আসা গাঙে মৃতেরা ধূমপান করে। ... (দূরত্ব, লীসা অতন্দ্রিলা)

৭. ইতিহাস ঘনিষ্ঠতা

একজন কবি ইতিহাস বিষয়ে সচেতন না-হয়ে পারেন না। সভ্যতার নানা পর্যায়ে বিচিত্ররকম যে উত্থান-পতন, যে সোপান বেয়ে মানুষের এতদূর পথ অতিক্রম করে আসা-- নব্বইয়ের কবিগণ সেসব বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু, এটা আশার কথা। আর কবিতার পাঠকমাত্রেরই জানা আছে যে, কবিতার ইতিহাস-- ইতিহাস শাস্ত্র নয়, ইতিহাসের সুউচ্চ প্রাচীরগাত্রে অলংকৃত গবাক্ষপথের এক বা একাধিক সুতীক্ষ্ণ চাবি। যে চাবির সন্ধানপ্রাপ্তি পাঠককে জানা ইতিহাসের প্রতি অনুরক্ত ও অজানা ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

১. ... মনে পড়ে এক বহ্নুৎসবে, তুমি, তিনখণ্ডে, ছিটকে প’ড়েছিলে ... (ভারতবর্ষ, চঞ্চল আশরাফ)

২. ... মাতা ছিলেন গুহার ভিতর, বৃক্ষপ্রদীপ জ্বেলে। পিতা নিহত হরিণ কাঁধে এলেন যবে, কাঠে বিঁধে মাংসপিণ্ড পোড়া, দেহের ভেতর ঘাম... (জীবতত্ত্ব, শোয়াইব জিবরান)

৩. ... মাটির শরীরে পুড়ে কুমার হাতের তালু... ... আমরা তবু পাথরের গায়ে জ্বেলেছি আলোর ঘর্ষণ ... ... কিছু হাড়-গোড় টেরাকোটা শিলালিপি অগ্নিদেবতার আর আগুন জ্বেলেছিলো গুহার আঁধারে ... (প্রত্নতত্ত্বের ভূমি, আলফ্রেড খোকন)

৪. আমার পূর্ব পিতা নেপাল রাজসভার দায়িত্বে ছিলেন তার সংগ্রহে চর্যাপদ বিজ্ঞান ও অন্যান্য বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থ ছিলো আমি তাই পাহাড়প্রিয় ও বৌদ্ধ গাথার প্রতি দুর্বল ... (আদিপিতার সন্ধানে যাত্রা, মশিউর রহমান খান)

৮. সাইবার সিটিজেনশিপ

ইন্টারনেট বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তিতে সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী সংযোজন। যার ব্যবহার এখন সারাবিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়েবসাইডে ঢুকবার ক্ষমতা এখন প্রায় যে কারো করায়ত্ত। ফলে গোটা পৃথিবীটাই একজন কারো আয়ত্বের মধ্যে চলে আসতে পারছে। এর ভিতর দিয়ে গড়ে উঠছে একদল ‘সাইবার সিটিজেন’। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন কবিরাও। এমনকি নব্বইয়ের কবিদেরও কেউ কেউ কোনো না-কোনোভাবে সভ্যতার এ বাঁক মোচড়ে দীক্ষিত। যার মাধ্যমে নিজেদের মূলটাকে দেশের মাটিতে প্রোথিত রেখেও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করে নিচ্ছেন শিল্পের কাঁচামাল। বিশ্ব হয়ে উঠছে ভুবনগ্রাম। ফলে কারো কারো কবিতায় যেমন উথলে উঠছে এক অনিবার্য ঐক্যচিন্তা, তেমনি কারো কবিতায় বা উঠে আসছে বিশ্বজ্ঞানের আকর।

১. একই জলে স্নান করে দুই ভূগোলের দুটি লোক বিদেশ এতটা নিকটে থাকে! এতখানি শিলাময়! (সীমান্ত, কামরুজ্জামান কামু)

২. ... বালতাজার, ডেকো না তুমি, তোমার সন্তান গেছে ফেনাময় শঙ্খ-উচ্ছ্বাসে, নিরবধি মাছের সংসার কী তিমি, কী অক্টোপাস, আড়াআড়ি সূর্যালোক জাহাজের জেটি থেকে শব্দ ক্ষীয়মাণ ... ইকথিয়ান্ডার (ইকথিয়ান্ডার, তুষার গায়েন)

৩. ... হলোই সে ত’ হালকা সিসিফাস বোঝা? সিসিফাস থলে কাঁধে নিয়ে হে আমি তুচ্ছ শুককীট (গ্রেগর সামসা) ... (টঙ্গী ডাইভারশন রোড, অদিতি ফাল্গুনী)

৯. নিসর্গের নবরূপায়ণেচ্ছা

নিসর্গ কবি মাত্রেরই প্রিয়। সব কালেই কবিগণ নিসর্গের বন্দনাগান গেয়ে গেছেন। কিন্তু এর মহিমা এতই অনিঃশেষ যে তাকে নতুন করে দেখবার, ব্যাখ্যা করবার প্রবণতা কখনোই শেষ হবার নয়। নব্বইয়ের কবিতায়ও তাই অনিবার্যভাবে হচ্ছে নিসর্গসম্পদের অভিনব বিচিত্র ব্যবহার।

১. ... সমুদ্রের সবচেয়ে ছোট মেয়ে এই হাওড় ... (হিজলজন্ম, মাহবুব কবির)

টিলাগুলো আসলে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, পাহাড় টিলাদের মা। ... (পাহাড়ে, ঐ)

২. ... মেঘের সন্তান আমি অগোচরে জলদাস ডাঙায় বসতি ? ... (জলদাস, টোকন ঠাকুর)

৩. এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে তুমি বাতাস আর নক্ষত্রগুলো শীঘ্র ঘরে তোলো আকাশটা ঘরে তোলো ভিজে যাবার আগেই ... (বৃষ্টি নামবে, হাদিউল ইসলাম)

৪. ... সবুজ শুধু উপচে পড়া সবুজ চারিদিকে, যেন কে স্তব্ধতার পাত্র থেকে বেভুল ঢেলে দিলো নিঃশব্দ সবুজের মদ, ... (নারী, জেনিস মাহমুন)

৫. তাহলে রূপকথা চাঁদ এতদিন শুয়েছিল বুঝি জলশঙ্খিনী সাপের খোলশে ... মূলত সে আজ বরফ কাল সাপ (ওসালিয়া - এক, শামীম রেজা)

১০. ব্যাঙ্গপ্রবণতা

এই প্রথম অন্ত্যআশিতে (নব্বই দশকের শুরু থেকে) বাংলা কবিতায় ব্যাঙ্গপ্রবণতা (স্যাটায়ার) ব্যাপকভাবে উপস্থিত হতে শুরু করল। নব্বইয়ের একাধিক কবি সচেতনভাবেই একটি ব্যাঙ্গাত্মক ভাষাকে রপ্ত করে নিয়েছেন কবিতার প্রয়োজনে। এ প্রবণতায় প্রচ্ছন্ন একটি রাজনীতিও কাজ করছে বলে মনে হতে পারে।

১. জোব্বা প্রদর্শনী চলছিলো-- মহাপুরুষের জোব্বা ; তবে সেই একই দশা ; বোঝা গেলো তার একটা হাত লম্বা হয়ে ঢুকে পড়েছে নীতি নির্ধারকের ভূমিকায়... ... আপনারা যে যার সাইজ মতো, টাঙানো জোব্বাগুলোয় আগেভাগে ঢুকে পড়ূন, সময় পিছলে যাচ্ছে, আগে শীত নিবারণ করুন। ... (মহাপুরুষের জোব্বা, আহমেদ নকীব)

২. ... যথেষ্ট ঘাস। গরু চরিতেছে। গরুদেরও অস্তিত্ব-- ... এই আশা-আশাভঙ্গে দুলছেন পাঁচ-চারজন আঁটঘাট মাঠকর্মী-- যারা উপর্যুপরি মার্ক্সিস্ট। আর এনজিও থেকে প্রেরিত। (অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা বিষয়ে মাঠকর্মীদের উদ্বেগ, ব্রাত্য রাইসু)

৪. ওই যে সদ্য এলেন পেকে হাড়ের ডালপালা থেকে তিনি হলেন বিদ্যালয়। ... আর যত মাস্টারনী-গাইনী বেরুচ্ছেন ওইসব, পিপীলিকার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে তারা দলবল বেঁধে। (কলাবিদ্যার সূত্র, আমীর খসরু স্বপন)

১১. আধ্যাত্মিক ও মরমিয়া স্বরন্যাসিকতা

বাংলার মরমিয়া ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করছেন এ সময়ের একাধিক কবি। এঁরা এঁদের কবিতায় বাউল মতবাদের অন্তর্গত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজের তথা প্রাণের অস্তিত্বের সারাৎসার খুঁজে দেখবার প্রয়াস পাচ্ছেন। এঁদের কবিতায় এমন একজন কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, যার অস্তিত্ব প্রশ্নাতীত নয়। প্রায়শ এঁরা এক ধরনের আধিবিদ্যক ধারণায় চালিত হোন।

১. ঐ সাদা মোমবাতিটা আমার শ্রদ্ধেয় পীর দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে নিঃশেষ হতে তার মতো সহজ শর্তে আমি পুড়ে যেতে আগ্রহী। ... (পীর, সরকার আমিন)

২. কায় ভাসিলো পথের ধুলায় আমি ভুলে থাকি আজ গৃহে ফিরিবার দিন ... রহস্য বিভঙ্গ আরো পরে থাকে মেঘের কাপড় আমি গৃহ বাঁধি তার বাড়ি ... (ধুলোপাঠ, মোস্তাক আহমাদ দীন)

১২. ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞাননিষ্ঠা

যে ভাষায় আমরা কবিতা রচনা করি। প্রকৃতপক্ষে তা পরম্পরাবাহিত। পূর্ব-পুরুষদের রেখে যাওয়া ভাষাসূত্রে, তাঁদের চর্চিত পদ-অর্থ-বিজ্ঞান (ব্যাকরণ) সহযোগেই আমরা আমাদের চিন্তন ও আবেগের প্রকাশ করি। কিন্তু সর্বদা পূর্ব-পুরুষদের তৈরি এ ভাষাটি আমাদের চাহিদা মেটাতে পারে না। যে কারণে সৃজনশীল লেখায় হরদম নতুন নতুন শব্দের সাক্ষাৎ মেলে, যা ইতঃপূর্বে কোথাও ব্যবহৃত হয় নি। ‘নব্বইয়ের কবিতা’ থেকে এরকম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নতুন শব্দ ও শব্দবন্ধের উদাহরণ দেয়া যাবে। সে চেষ্টা না-করে এখানে বরং আমাদের কবিদের কবিতায় ভাষাচিন্তার, পদ-অর্থ-বিজ্ঞানের যে ছাপ মুদ্রিত রয়েছে তার উদাহরণ তুলে আনা যেতে পারে।

১. ...এ দিয়ে হবে না আমার, বরং নোতুন ধাতুমূল, কৃদন্তপদে সমাসে সন্ধিতে আমি গড়ে নোবো নোতুন শব্দাবলী, অভিধান, নোতুন ভাষা-- যেখানে সুন্দর ও কিম্ভুত মিলেমিশে জগৎময় আমিই প্রকাশমান আলোর অধিক। (আলো, আরো আলো : দাউদ আল হাফিজ)

২. ... যাহা ছাগল, তাহা বিশেষ্য, তাহা সর্বনাম, তাহা বিশেষণ, এবং অব্যয় আর ক্রিয়া। আর তাহার ক্রিয়া, অব্যয়। ... (ছাগল : ব্রাত্য রাইসু)

মোটা দাগে বলা হচ্ছে নব্বইয়ের কবিগণ রাজনীতি বিমুখ। সত্তর ও আশির কবিদের অতিরিক্ত রাজনৈতিক সচেতনতা বাংলা কবিতাকে প্রচুর উচ্চকণ্ঠ স্লোগানে যেভাবে জর্জরিত করে ছেড়েছে, তাতে কবিতায় সরাসরি রাজনৈতিক পঙক্তি রচনা করা এখনকার কবিগণ যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। তাছাড়া দেশে একটি আপাত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় এবং কোনো সর্বজনীন রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি না-হওয়ায় নব্বইয়ের কবিতা থেকে এ লক্ষণ প্রায় বিদেয় নিয়েছে। এ প্রবণতা যে ক্ষতিরও কারণ হচ্ছে, তা আমরা আস্তে-সুস্থে বুঝতে পারবো।

ইতোমধ্যেই কারো কারো লেখায় এ প্রবণতাকে মন্দভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মাসুদুল হক তাঁর প্রবন্ধে এটিকে সম্ভবত ‘আদর্শবোধের উদ্দেশ্যহীনতা’ বলতে চেয়েছেন। অবশ্য যথেষ্ট অভিনিবেশ সহযোগে এ সময়ের কবিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, ক্ষুদ্র দলীয় রাজনীতির গণ্ডিতে আবদ্ধ কবিতা এখনকার কবিগণ না লিখলেও, বড় প্রেক্ষাপটে প্রচ্ছন্নভাবে স্লোগানবিহীন রাজনীতি এঁদের মধ্যে আছে। আহমেদ নকীবের ‘মহাপুরুষের জোব্বা’, ব্রাত্য রাইসুর ‘অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা বিষয়ে মাঠকর্মীদের উদ্বেগ’, কামরুজ্জামান কামু’র ‘সীমান্ত’, চঞ্চল আশরাফের ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি কবিতাকে বৃহদার্থে রাজনৈতিক কবিতার উদাহরণ ভাবা যেতে পারে।

কবিতায় সমাজবাস্তবিক ধারণার প্রকাশ ‘তথাকথিত’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। যেন এখনকার কবিগণ প্রকৃতই কোনো ভিনগ্রহে বাস করছেন-- যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের সবকটিই ঠিক ঠিক বাস্তবায়িত হচ্ছে, কোনো বস্ত্রহীন মানুষই যেন অভুক্ত অবস্থায়, শিক্ষা ও চিকিৎসারহিতভাবে খোলা আকাশের নিচে ধুকে ধুকে মরছে না। যেন দেশে কোনোই বেকারত্ব নেই, রাত পোহাতেই হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারি দেখছেন না যে তাঁর চাকরিটি নেই হয়ে গেছে। যেন কোথাও কোনো মানবাধিকার হরণের ঘটনা ঘটছে না। যেন নারী-পুরুষ সম্পর্কের মধ্যে কোনো নির্যাতনমূলক ঘটনা ঘটছে না কিংবা ঘটছে না ধর্ষণ-অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো কোনো ঘটনাও। এসব পরিপার্শ্ববর্জিত সমাজনিরপেক্ষ কবিতাকে মহাকাল একটা যুগের পলায়নপর মানসিকতার দলিল হিসেবে না-চিহ্নিত করে বসে (পুড়ছে যখন রোম, নিরো তখন মগ্ন বাঁশিতে)। শামীম কবিরের ‘মনে হচ্ছে যাচ্ছে রেল’ সরকার আমিনের ‘গোপন রান্না’ এবং অন্যান্য একাধটি কবিতায় এ প্রবণতার উপস্থিতি অংশত টের পাওয়া গেলেও এরকম বলাই সংগত যে নব্বইয়ের কবিগণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে উদাসীন।

এরকম বলবার কোনো কারণ নেই যে এ সময়কার তরুণ কবিগণ প্রেমবোধরহিত। কিন্তু ‘নব্বইয়ের কবিতা’ দৃষ্টে কেউ এমন ভেবে বসতেও পারেন যে এ দশকের কবিগণের মনে প্রেম বুঝি ফলে না তেমন। কিন্তু এ অভিযোগ কি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া যায়, যেখানে প্রচলিত আছে যে ‘প্রেমে না পড়লে কেউ কবিতার পথ মাড়াতেই আসেন না’? নব্বইয়ের কবিরাই যেহেতু কবিকুলের মধ্যে সবচে’ নবীন, ফলে এঁদের কবিতায় প্রেমের এমন আকাল অবিশ্বাস্য বৈকি। নানা কাগজে মুদ্রিত এ সময়ের কবিদের কবিতাবলিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রেমের কবিতার সাক্ষাৎ মেলে বলেই এ আলোচকের ধারণা। যেসব কবিতা প্রায় নির্বিচারে বর্জিত হয়েছে এ গ্রন্থে। রোকসানা আফরীনের ‘গাছের পাতার কাছে’ ও ‘স্বপ্নদৃশ্য-২’, রওশন ঝুনুর ‘দ্রাক্ষা’ ও ‘সুর পিয়াসী ; দূর পিয়াসী’, সৈকত হাবিবের ‘আমার মাকে’ এবং কবির হুমায়ূনের ‘পরকীয়া সিরিজ-ছয়’কে হয়ত প্রেমের কবিতা বলা যেতে পারে।

নব্বইয়ের একটা বড়ো অর্জন কাব্যভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা। যার ভিতর দিয়ে বেশ কয়েকজন কবিই (পাঁশু প্রাপণ, মোস্তাক আহমাদ দীন, মুজিব ইরম, টোকন ঠাকুর প্রমুখ) তাঁদের কবিতা-ভাষা খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে তাঁদের নিজস্ব স্বরক্রম চিহ্নিত (আলাদা স্বরমাত্রই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে এরকম মনে করবার যদিও কোনো কারণ নেই)। উল্লিখিতগণের যেকোনো নামচিহ্নহীন কবিতাকে নিবিষ্ট পাঠকমাত্রই আলাদাভাবে চিনে নিতে পারবেন বলে মনে হয়। এটা খুবই আশার কথা। এদের ছাড়াও অন্য অনেকের মধ্যেই দেখা যাবে, শব্দের প্রয়োজনে ও বাক্য গঠন প্রকরণে কেউ বা গুরুত্ব দিচ্ছেন লোক-মানুষের মুখের ভাষাকে, কেউ বা সিভিল সমাজের। কেউ বা সাধু বাংলা মিশিয়ে কথা বলতে বেশি সাচ্ছন্দ্য পাচ্ছেন, কেউ বা চলিত ক্রিয়াপদের ছাঁচে মৃত-প্রায় তৎসম শব্দকে ঠেসে দিয়ে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া শব্দকে পুনর্জীবিত করে তুলছেন। কারো বা ফি-বাক্যেই ইংরেজি বা অন্য বিদেশী শব্দ ব্যবহার করবার ঝোঁক। ভালো কবিতা উল্লিখিত যেকোনো ভাষিক-প্রবণতা থেকেই বেরিয়ে আসতে পারে। নির্দিষ্ট কবির বক্তব্য-বিষয়ই ঠিক করে দেয় যে, তাঁর ঠিক কোন ভাষায় কথা বলতে হবে। কবি মাত্রেরই যে কথা জানা আছে।

প্রধানত মুক্তক অক্ষরবৃত্তে কবিতা লিখতেই এখনকার কবিগণ সাচ্ছন্দ্য পাচ্ছেন বেশি। পাশাপাশি সার্থক মাত্রাবৃত্ত ছন্দও কারো কারো হাতে ফলছে। স্বরবৃত্ত কদাচ লক্ষযোগ্য। ঘনবদ্ধ সনেট, পয়ার কারো কারো প্রিয়। তবে কোনোই ছন্দশাসন না-মেনে আবেগকে বাধাবন্ধনহীনভাবে বেড়ে ওঠবার সুযোগ করে দিচ্ছেন অধিকসংখ্যক কবি। এ প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। যার ভিতর দিয়ে অভূতপূর্ব ধ্বনি-আনন্দের সাক্ষাৎ মিলছে। এর ফলে বেরিয়ে আসতেও পারে বাংলায় প্রচলিত ছন্দের নতুন কোনো সম্ভাবনা।

উপমা-উৎপ্রেক্ষায় ‘মতো’ ‘যেনো’র ব্যবহার কমছে। পূর্ণোপমার সাক্ষাৎ যে কারণে কমই মিলছে। ‘মতোকথা’র বদলে শব্দবন্ধ তৈরি করবার দিকেই কবিদের ঝোঁক প্রবল। অর্থাৎ মাটির মতো রঙ না-বলে এখনকার কবিরা ‘মাটিরঙ’ই বেশি বলছেন। অর্থাৎ উপমা থেকে হাঁটছেন রূপকের দিকে। অনুপ্রাস, যমকের ব্যবহারও চোখ এড়িয়ে যাবার মতো নয়। চিত্রকল্পে যথেষ্ট ঋদ্ধ মনে হয় নব্বইয়ের কবিতাকে। যা কবিদের কল্পনাক্ষমতার তীব্রতাকেই ইঙ্গিত করে।

কবিতায় সম্পূর্ণতা সৃষ্টির ব্যাপারে অধিকাংশ কবিই যথেষ্ট পরিমাণে ভাবিত নয় বলে মনে হতে পারে। শিরোনাম থেকে কবিতায় ব্যবহৃত শেষ শব্দটি পর্যন্ত যে সংলগ্নতা দরকারি তারও অভাব দৃশ্যযোগ্য। শব্দধাঁধার ভিতরে কবি কখন নিজেই পথ হারিয়ে ফেলছেন-- তিনি নিজেও টের পাচ্ছেন না। অথবা ইচ্ছে করেই কবি এমন এক অসংলগ্নতা তৈরি করে বসছেন, এমন অপ্রত্যাশিত উল্লম্ফন সাধন করছেন, যার কোনো সংগত মানে তাঁর নিজের কাছেও হয়ত থাকছে না। এরকম হতো কি সবকালেই এবং সেসব কি অভিনবত্ব হিসেবে চিহ্নিতও হতো? সকল নতুনই তো প্রার্থিত হতে পারে না। এটিও বোধকরি নয়।
কোথায় তবে সে স্বর, যা নাকি নতুন ?

উল্লিখিত প্রবণতার মধ্যে কী এমন নতুন বৈশিষ্ট্য উপস্থিত রয়েছে, যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি? চিহ্নিত প্রবণতাগুলোর ১২টির মধ্যে ১, ২, ৪, ৫, ৭, ৯, ১১ ও ১২ চিহ্নিত ৮টিই ভিন্ন ভিন্ন নামে উত্তর আধুনিকতা বা অধুনান্তিকতা (উত্তরাধুনিকতা নয়) নামক সাহিত্য দর্শনে আলোচিত। আধুনিক কবিদের মধ্যে এসব লক্ষণের কোনো কোনোটি ইতঃপূর্বে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, মোহাম্মদ রফিক, ওমর আলী, সৈয়দ শামসুল হক, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, হাফিজ রশিদ খান প্রমুখের কবিতায় দেখা গেলেও সম্প্রতি তা ব্যাপকতর হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ‘সাম্প্রত’, ‘লাল নক্ষত্র’সহ বিভিন্ন ছোটকাগজ এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘লিরিক’, ‘সুদর্শনচক্র’ এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘একবিংশ’সহ কোনো কোনো ছোটকাগজ এ উত্তর আধুনিকতার প্রচার, প্রসার এবং উত্তর আধুনিক কবিতাকর্মের মূল্যায়নসহ নানা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ‘নব্বইয়ের কবিতা’র বড়োজোর ২০% কবি ‘লিরিক’, ‘সুদর্শনচক্র’, ‘একবিংশ’র কর্মকাণ্ডের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু উল্লিখিত কাগজত্রয়ের সাথে সম্পর্কহীন হয়েও অনেকের মধ্যেই উত্তর আধুনিকতা কথিত এ সমস্ত প্রবণতা গোপনে কাজ করছে। ফলে প্রায় সিদ্ধান্তই করা যায় যে এ দশকের নতুনত্ব ‘উত্তর আধুনিকতা’ সাহিত্যাদর্শের মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যাওয়া। এছাড়া ছোটকাগজের সাথে সম্পর্কের জের, কাব্যবিষয়ে যে নতুন নতুন (সাধারণত অকাব্যিক তুচ্ছ ও নগণ্য বিষয়) অনুষঙ্গ যোগ করেছে, তা এনে দিয়েছে স্বাদ-বৈচিত্র্যও। ছন্দোস্বাধীনতা যদি কোনো শুভ ফল বয়ে এনে থাকে তার জন্যে ছোটকাগজমুখীনতাই দায়ী।

সাইবার সিটিজেনশিপ ব্যাপারটি নতুন অবশ্যই। কিন্তু সাইবার সিটিজেন হবার জন্যে ছোটকাগজ কোনো আলাদা ভূমিকা রাখে না। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকলে যেকোনো মাধ্যমের লেখকই এ সুবিধায় ও অসুবিধায় উত্তীর্ণ অথবা অবনত হতে পারেন। সুতরাং এটি এ দশকের কাব্যে একটি নতুন সংযোজন হলেও এর জন্যে ছোটকাগজ কোনোভাবেই দায়ী নয়।

নিসর্গ চিরায়ত। প্রতি যুগেই শিল্পী-সাহিত্যিকগণ নিসর্গের নব নব মহিমা আবিষ্কারে সচেষ্ট থেকেছেন। নব্বইয়ের কবিগণও নিসর্গের নবমহিমা আবিষ্কার করে তার সাথে নিজের তথা মানবজীবনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য অনুসন্ধান করছেন। এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি নিসর্গকে যেভাবে চিহ্নিত করছে ও কবিতায় তা যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা নতুনতর বোধ হচ্ছে! নতুন কবিতার কাছে যা অবশ্যই প্রার্থিত।

কবিতায় স্যাটায়ার ঈশ্বরগুপ্তের পরে এমন সিরিয়াসভাবে আর চর্চিত হতে দেখা যায় নি (জীবনানন্দ দাশের ‘সমারূঢ়’ এবং আরো কিছু কবিতার কোনো কোনো পঙক্তিকে তাঁর মূল কাব্যপ্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবেই ভাবতে চাই)। সামাজিক ক্লেদাক্ত ঘটনাবলি যখন কবিতার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেই না প্রায়, অথচ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবার মতো ঘটনার বিকাশ ফুলে ফেঁপে উঠতে চাচ্ছে ; তখন বলবার কথাগুলো এরকম একটি শৈলীতে তার প্রকাশময়তা নিশ্চিত করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। আমার সতীর্থ বন্ধুদের অনেকেই জোরের সাথে বলেন ‘স্যাটায়ার কখনো কবিতা নয়’। আমি তাঁদের এ মতের সাথে আপাতত নীরব থেকেই ভিন্নমত পোষণ করে যেতে চাই। কখনো হয়ত এ ব্যাপারে সরব হবার মতো যুক্তিশৃঙ্খলা আমি খুঁজে পাবো। আমার বিশ্বাস এ শৈলীতে কিছু ভালো কবিতা লিখিত হতে পারে, যা লেখককে সমাজের কাছে দায়বদ্ধ হিসেবেই চিহ্নিত করে তুলবে।

প্রিয়দের ডাকনাম মুখস্থ করে রাখি

‘নব্বইয়ের কবিতা’র প্রচুর ভালো সংযোজনের মধ্যে যে কবিতাগুলো আমাকে চরম ও পরম ভালো লাগায় সিক্ত করেছে এবং কবিতাকর্মী মুজিব মেহদীর অক্ষমতাকে চিনিয়ে দিয়েছে ; গর্বের সাথে তার একটা তালিকা আমি উপস্থাপন করতে চাই। গর্বটা এই জন্যে যে, ভালো লাগবার মতো কবিতা আমার সময়ের কবিগণ সত্যিই লিখতে জানেন। হতে পারে যে এগুলোর কোনো-কোনোটি পরবর্তী সময়ে আমাকে কাছে টানবার ক্ষমতা হারাবে। কিন্তু আমার প্রতি যদি আমি সৎ হয়ে থাকি তবে এ সময় পর্যন্ত বলতে পারি যে এগুলোর কাছে আমাকে বারবার ফিরে যেতে হবে। উল্লেখ বাহুল্য যে, এদের একেকটি একেক কারণে আমাকে ছুঁয়ে গেছে। কোনো-কোনোটির ভালো লাগার কারণ আমি নিজেও শনাক্ত করতে পারি না। হয়ত কখনো পারবো অথবা পারবো না। তবু এখানে গ্রন্থস্থ ‘মীনকে’ (আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ), ‘প্রথমের সঙ্গীত’ (আশিক আকবর), ‘শহরের ল্যাম্পপোস্টে পাকা কাকরোল’ (আবু আহসান), ‘হাটের শরীর’ (ঈশান জয়দ্রথ), ‘সীমান্ত’ ও ‘পাখি বিক্রেতা’ (কামরুজ্জামান কামু), ‘বোবাকাহিনী’ ও ‘ভারতবর্ষ’ (চঞ্চল আশরাফ), ‘আকাশের ঘোড়া’ (জাফর আহমদ রাশেদ), ‘অনাবাস’ (দাউদ আল হাফিজ), ‘স্তন’ ও ‘ছাগল’ (ব্রাত্য রাইসু), ‘হিজলজন্ম’ ও ‘পৃথিবী’ (মাহবুব কবির), ‘বিষ’ (মোস্তাক আহমাদ দীন), ‘আদিপিতার সন্ধানে যাত্রা’ (মশিউর রহমান খান), ‘প্রহেলিকা’ (মজনু শাহ্), ‘কবিতা ১০’ (রবিন আহসান), ‘এই যে মানুষ’ (লীসা অতন্দ্রিলা) এবং ‘ক্ষমঃ গো শ্বেতদুগ্ধ’ (শাহনাজ মুন্নী) নিবিড়ভাবে পড়তে পেরে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। এই কবিতাগুলোর কাছে পুনঃ পুনঃ গমন আমাকে নন্দনসীমায় প্রবেশ করবার আরো আরো চাবির সন্ধান দেবে, আমি এরকমই মনে করে রাখছি।

প্রাসঙ্গিকী

সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী বিতর্কিত মনীষী শ্রীনীরদ চন্দ্র চৌধুরী লেখককুলকে মোটাদাগে পাগলজাতীয় ও ছাগলজাতীয় এই দু’ভাগে ভাগ করে দেখিয়েছেন। তাঁর ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’তে এ দু’ভাগের বিস্তারিত সদৃষ্টান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং এখানে তার সংজ্ঞায়নের চেষ্টা না-করে এ তথ্যটি দিতে চাই যে, আগামী সময়ের কবিতা অনেক সামনে এগিয়ে যাবে এ সম্ভাবনা বেশ জোরের সাথে ব্যক্ত করা যায় ‘নব্বইয়ের কবিতা’ দৃষ্টেই। কারণ এ গ্রন্থভুক্ত কবিদের মধ্যে ছাগলজাতীয় লেখকের চেয়ে পাগলজাতীয় লেখকের (নীরদবাবুও নিজেকে পাগলজাতীয় লেখক মনে করতেন) সংখ্যা বেশি। এর উলটোটি সত্য হলে অন্ধকার আগামীর শঙ্কায় তটস্থ থাকবার কারণ হতো। কিন্তু আদৌ তেমন দুরবস্থা আমাদের কবিতায় আপাতত সূচিত হবার সম্ভাবনা মোটেই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যায় যে, অজস্র সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশকে উৎসর্গীকৃত মাহবুব কবির সম্পাদিত নব্বইয়ের কবিতার এই গ্রন্থটি শতাব্দী শেষের বাংলা কবিতার (প্রেক্ষিত : বাংলাদেশ) একটি প্রামাণিক সৎ সমন্বয় প্রয়াস হিসেবে পাঠককুলের কাছে ক্রমে সমাদৃত হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে যার আলামত স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।

রচনাকাল ২০০০

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...