Saturday, August 8, 2009

নগদ নরকের দাহ, লোমশসংস্কৃতি, জেনবাদ ও ইত্যাকার প্রসঙ্গ

শেষ বা চূড়ান্ত কথা উচ্চারণ করার পূর্বে আমরা আজ খুব কমই একের অধিকবার ভাবছি। যেকোনো বিষয়ে সহজেই নিয়ে নিচ্ছি বা দিয়ে দিচ্ছি মহিমা-অন্বিত সিদ্ধান্ত এবং যথাসম্ভব দ্রুত সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করছি এক অথবা লক্ষকোটি মানুষের বিপরীতে। ধুনিয়ে ফেলছি যাকে-যেখানে-যখন-যেভাবে পাচ্ছি। 'আমি'কে বাদ দিয়ে এ জগতে আর যেন কেউ নেই, আমাকে বাদ দিয়ে নেই জগৎসংসার। অর্থবিত্তক্ষমতা আমাদের, আসন আমার। অন্যের মনের ওপর বেপরোয়া খবরদারি করার একচ্ছত্র অধিকারও অতএব 'আমি'রই করায়ত্তে। বাপরে! কীসের এ আলামত ? মূর্খামির নয় তো!

মানে ?

আমরা যে সময়ে বাস করছি, তা নানা কারণেই খুব ফাস্ট। প্রতিদিনই আনকোরা নতুনের সাথে সাক্ষাৎ ঘটছে আমাদের, তা ব্যক্তি ও বিষয়, তথ্য ও ধারণা, মত ও বাদ--- কী নয় ? আশা করা যায় যে, আমরা যারাই বেঁচে থাকার কসরৎ করছি, যাপনচর্চা করছি, এই এখন, বুক-পিঠ অনেকটাই প্রশস্ত আমাদের। খোলা আছে আমাদের মন-মগজ--- কেবল ক্ষুদ্র হ্রদ নয়, ধরে সেখানে বিশাল বারিধিও। অথচ যুক্তিশৃঙ্খলালব্ধ এই সত্য কী ভীষণভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়ে যাচ্ছে আজ! অভিজ্ঞতার ফলিত রূপ যা, তা সাক্ষ্য দেয়, বিল-ঝিলও ওতে ধরে না বস্তুত, নর্দমা ব্যতিরেকে। ক্রমশ আরো সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছি আমরা দিনকে দিন, আরো স্লো। বুকে-পিঠে-মনে কোথাও কোনো স্পেস নেই--- নতুনকে, ভিন্নমতকে, ভিন্ন চিন্তা বা ধর্মকে, বৃত্তি বা ভঙ্গিকে, কর্ম বা কৃতিকে গ্রহণ করবার। প্রবেশদুয়ারে আঁটা আছে যেন পার্মানেন্ট কোনো নিষেধাজ্ঞা। মুক্তবায়ু, মুক্তদ্বার, মুক্তচিন্তা এসব কেবলই কথার কথা--- তত্ত্বের কচকচি, টগবগি।

তো...

প্রায়শই মনে হয়, সমস্ত দ্বন্দ্ব-বিরোধিতা-শত্রুতার মূল বুঝি পরিপুষ্টি পাচ্ছে এখানটায়ই। এই সেই অভিশপ্ত গর্ভ, নিতিদিন যেখান থেকে জন্ম নিচ্ছে টন টন হিংসা-ঈর্ষা-জিঘাংসার অগ্নিতপ্ত লাভা। উদ্গীরিত লাভার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে সমুদয় সবুজ, কাঠবিড়ালী, জলাধার, মানুষী আবেগ, মানবিক বোধ ও সংস্কৃতি। একটা জনপদ থেকে যখন এতকিছু বিয়োজিত হয়, হয়ে যায়, তখন সে গর্দভগৃধিনীকাককুকুরময় ভাগাড়দেশ কী করে সভ্যতার কাফেলায় সামিল হিসেবে নিজেকে জাহির করতে পারে ? এ তো কেবল স্থানিক মরুত্ব নয়, আত্মিক মরুময়তাও। এ ভূমির দশদিকেই এখন খুলে গেছে নরকের তোরণ। প্রতিনিয়ত আমরা পুড়ে চলেছি তার দাহে, প্রতিকারহীন। স্বর্গের কোনো অপশনই যেন অবশিষ্ট নেই কোথাও।

এখানে নরক দেখছেন কোথায় ?

নয়ত কী ? চারদিকে যা দেখছি তার সবই তো নারকীয়। আচ্ছা হলপ করে বলুন তো, আপনি নিজে কি স্বর্গীয় কিছু দেখছেন বা অনুভব করছেন কোথাও--- কোনো সুগন্ধী মলয় বা শুভবাদী জলের প্রবাহ ? মানুষে-মানুষে, মানুষে-প্রাণীতে, মানুষে-পরিবেশে খুব কমই তো সদ্ভাব দেখছি, হানাহানির অধিক। সর্বপর্যায়েই ভালোবাসা এখন নিছক অচর্চিত এক ধারণা, ক্লিশে। তর্কটা পাশে রাখুন, আসুন আগে পড়ি এবং আবিষ্কার করি স্বর্গ-নরকের এই জেনবাদী মর্মমূর্ছনাটুকু---

নোবুশিগে নামে এক সেপাই হাকুউনের কাছে এলেন। তিনি জানতে চাইলেন : 'স্বর্গ নরক ব'লে সত্যই কী আছে ?'
হাকুউন জিজ্ঞাসা করলেন : 'আপনি কে ?'
সেপাইটি জবাব দিলেন : 'আমি একজন সামুরাই।'
হাকুউন বললেন : 'আপনি সেপাই! আপনি রাজাকে কীভাবে পাহারা দেবেন ? আপনার মুখখানা তো ভিখারির মতো।'
একথা শুনে নোবুশিগে খুব রেগে গিয়ে তাঁর তলোয়ার বার করতে যাবেন এমন সময় হাকুউন বললেন : 'আপনার আবার তলোয়ারও আছে। তবে আপনার তলোয়ারটা বোধহয় ভোঁতা, ওতে আমার মাথা কাটা যাবে না।'
নোবুশিগে যখন তলোয়ার বার করে ফেলেছেন তখন হাকুউন বললেন : 'এই নরকের তোরণ খুলে গেল।'
একথা শুনে সামুরাই জেনগুরু হাকুউনের জোর বুঝতে পারলেন, খোলা তলোয়ার খাপে ভরে ফেলে তাঁকে বিনতি করলেন।
হাকুউন বললেন : 'এই স্বর্গের তোরণ খুলে গেল।'

দেখুন তো, নরকের তোরণ খুলে যাবার যে প্রেক্ষাপট, নাঙ্গা তলোয়ারের যে প্রতীকী ভঙ্গি এই 'তোরণ' নামক জেনগল্পটিতে মূর্ত, আমরা, এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী কি তদতিরিক্ত এক ভীতিকর পরিস্থিতির ভিতরে বসবাস করছি না, এখন ? আপনি আপনার জানা চারপাশের হাজারটা ঘটনাকে এর প্রেক্ষিতে স্থাপন করুন, দেখুন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে সব, দেখুন উপলব্ধিতে এসে ছ্যাঁকা দিয়ে যাচ্ছে অসহনীয় নরক-উত্তাপ। আশঙ্কা হয়, এই উত্তাপকে বোধে নিলে নৈমিত্তিক রমণ-সাধনে উপগত হতেও আপনার ভয় হবে, সন্তান জন্মদানের আপনার লালিত স্বপ্নটা পুনর্বিবেচনার অবকাশ পেতে চাবে ; কারণ, নবজাতককে এক মুহূর্তের নিরাপত্তা দেবার ক্ষমতা আমার-আপনার নেই, এইদেশে, এখন। কখনো কি ছিল !?

ছিল না এবং নেইও।

ভাববেন না যে মানবিক বোধশূন্যতার এই ভয়ঙ্কর অগ্নিখাদ তথা নগদ বা সাক্ষাৎ নরক কোনো একক রাজাদর্শে সৃষ্ট বা নির্মিত--- আমরা এরকমটি বোঝাতে চাইছি। সংকীর্ণতায় নিপতিত হয়ে মিথ্যামিথ্যি কারো সাধুত্বের উচ্ছ্বসিত বর্ণনা উপস্থাপন করে আমরা স্বস্তি পাব না। কারণ আমরা শাসিত-ত্রাসিত-দমিত-পীড়িত-দলিত গুরুভাগ নারী-পুরুষেরই দলে, তাদের ভালোবাসারই পক্ষে। মানুষের টুটি চেপে ধরার এই লোমশসংস্কৃতি শুধু আজ-কাল-পরশু চর্চিত কিছু নয়, আমরা মানি। বরাবরই এর আধিপত্য শুভবোধসম্পন্ন মানুষকে ভাবিয়েছে। তবে কিনা চলমান সময়টা ভয়ঙ্করতার এক অর্কেস্ট্রেশন কিংবা জিঘাংসার ঐকতানে প্রকম্পিত। আমাদের আশঙ্কা কেবল তখনই উত্তুঙ্গে, যখন দেখছি যে নরকমুখীনতার প্রতিযোগিতায় আমরা সর্বত্র ভেদজ্ঞানকে প্রশ্রয় দিচ্ছি, যখন সক্রেটিস-বুদ্ধ-কনফুসিয়াস-যিশু-মুহম্মদ-লালন-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ সবার বাণীই আমাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর প্রতিপন্ন হচ্ছে, যখন শিল্পের সৌন্দর্য আমাদের চিত্তকে আর জাগাতে পারছে না, যখন নারীকে ব্যক্তিত্ব হিসেবে নয় দেখছি কামভাণ্ডরূপে, যখন প্রেমচুম্বনে সাড়া দেবার বদলে রক্তে হস্তরঞ্জিত করতে আমাদের ভালো লাগছে, যখন দাম্পত্যধর্মের সুরভিগৃহে লুকিয়ে রাখছি অব্যবস্থিত শবের দুর্গন্ধ।

এই ঘাতক সময়ে, কী দিয়ে খুলব তবে স্বর্গতোরণ ?

সদিচ্ছা দিয়ে, ওটাই মহান চাবি। অন্যকে অনুভবের সীমায় আনতে এজন্য প্রথমে নিষ্ক্রান্ত হতে হবে রিপুর শাসন থেকে, দ্বিতীয়ত নিজের ; এবং এটি কেবল ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সংঘ, দল, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র... সর্বেক্ষেত্রেই। সংঘেরও রিপু ও আমিত্ব আছে, আছে দল, প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রেরও! তারপর সর্বত্র উড়িয়ে দিতে হবে মানবিকতার জয়ধ্বজা। দেখা যাবে, স্বর্গের হাওয়া এসে ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছে কলূষতার সমুদয় অণু-পরমাণু, দিকচক্রবালে ফুটে উঠছে সর্বজনবোধ্য একটিই অমলিন দৃশ্যপ্রতিমা--- ভালোবাসা।

জ্বী হ্যাঁ। জ্বী, তোরণের সামনে এসে হাত ছাড়িয়ে নেবার আগে আপনাকেই বলছি : আসকালসন্ধ্যা 'হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী'র ভিতর, সভ্যতার কান ধরে ব্যাপক টানাটানি শুরু হবার প্রাক্কালে, অনেক বিকল্পের একটি হিসেবে এ প্রস্তাবনা অনন্তর গুরুত্ব পেতে পারে।

প্রথম প্রকাশ : শিরদাঁড়া ২০০৪

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...