Saturday, November 14, 2009

শাদাপৃষ্ঠা ভরাটকরণ প্রকল্পের অধীনে দেয়া কবিতাময় ছিন্ন-সন্তরণ

ক্ষণজন্মা ও স্পর্শকাতর ভাববস্তুর উৎকৃষ্ট অনুবাদ হচ্ছে কবিতা। যখন তখন এ ভাবের উদয় যেমন হয় না, যখন তখন চাইলেই এর অনুবাদও করা যায় না।

হয় না, কারণ, নির্দিষ্ট কবিব্যক্তিটির জৈবনিক নানা স্থূলক্রিয়ায় সময় ক্ষেপণ করতে হয়; কবি তাই অনুভূতির সূক্ষ্মতা সর্বদা বহনসক্ষম হন না। ভোঁতা অনুভূতিযোগে স্পর্শকাতরতা আঁচ করা কীভাবে সম্ভব! এ সময়কালে কবি অনুপস্থিত থাকেন ভাবদেশের স্বতোক্রিয়া নিরীক্ষণের কাজে। আর যায় না, কারণ, কবিতার ভাষা, যাতে সম্পন্ন করতে হয় অনুবাদক্রিয়া; তা সর্বক্ষণ দখলে থাকে না কোনো কবির। যেকোনো ভাষায় ভাবের যেকোনো প্রকাশই যেহেতু কবিতা নয়-- কাজেই কবিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হয় অনুবাদযোগ্য ভাষা। যিনি কবি, সূক্ষ্ম ভাবোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট কবিতাভাষাও এসে ধরা দেয় তাকে। এজন্যে আলাদা কোনো প্রয়াস অদরকারি। একটি কবিতা লিখবার পূর্বশর্ত তাই ক্ষণোদয়া ভাবের মৌলিক বিন্দুটিকে সূক্ষ্ম অনুভূতির জারকরসে সিক্ত করে, ততধিক সূক্ষ্ম যত্নে ভাষার আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারা এবং আনুষঙ্গিক ব্যঞ্জন সহযোগে শব্দসুতোয় তা গেঁথে ফেলবার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠা।

কল্পনা কবিতার শ্বাসযন্ত্র বা ফুসফুস। এর দীনতা হাঁপানি রোগীর মতো অসুস্থ কবিতার জন্ম দেয়। কল্পনার চারুদেহে ভর করেই কবিতা হিসেবে দাঁড়িয়ে ওঠে বলবার কথাবস্তু; যার শিকড় প্রোথিত অকল্পনায়, বাস্তবে। এই অকল্পিত বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশেলটা যত সমসত্ত্ব হয় কবিতার অর্জনমান হয় ততটা উৎকৃষ্টতর। মিশ্রণটি অসমসত্ত্ব হলেও ভালো কবিতা হওয়া সম্ভব, যদি থাকে কবিব্যক্তির উচ্চাঙ্গের পরিমিতি-জ্ঞান।

কল্পনা করবার ক্ষমতা আসে অভিজ্ঞতা থেকে। আর অভিজ্ঞতা আসে দেখা-শোনা-পড়া ইত্যাদির ভিতর দিয়ে। অভিজ্ঞতা হলো এক ধরনের ছাপ, যা মস্তিষ্কে কমবেশি স্থায়ী হয়। তার আলোকেই গড়ে ওঠে নানা কল্পিত ধারণা। কোনো কল্পনাই সুতরাং অভিজ্ঞতার বাইরের কোনো শূন্য জায়গা থেকে বেড়ে ওঠবার ফুরসৎ পায় না। মানুষ ঈশ্বর কল্পনা করেছে তার অভিজ্ঞতা থেকেই। মানবীয় সেই গুণসমূহই ঈশ্বর ধারণার ওপর আরোপ করা হয়েছে, যা উৎকৃষ্ট; যার কোনো কোনোটি মানুষের মধ্যে বর্তমান থাকলে আমরা সেই মানুষকে মহৎ, অসীম ও অলৌকিক গুণসম্পন্ন বলে জ্ঞান করি।

কল্পনা ক্ষমতা যার যত বেশি, তিনি ততবড়ো শিল্পী; আর উৎকৃষ্ট ও বিচিত্র কল্পনা করতে পারেন তিনিই, যিনি বিচিত্র অভিজ্ঞতার অধিকারী। কিন্তু আরো কথা থাকে-- এই যে অভিজ্ঞতা, যা কবির কল্পনা করবার পরিধিকে বাড়িয়ে দেয়, তা কবিতায় প্রযুক্ত হতে পারে কেবল তখন, যখন তা পরিশুদ্ধ হয়ে আসে অনুভূতিদেশ থেকে। এর অন্যথা হলে হয়ত পদ্য সৃজন সম্ভব, কিন্তু কবিতা অবশ্যই নয়।

ছন্দ কবিতার জন্য জরুরি; কিন্তু ধ্বনিময়তা সৃষ্টি হওয়া তার চেয়েও জরুরি। প্রচলিত কোনো ছন্দের ধারে-কাছে না-গিয়েও উৎকৃষ্ট কবিতা সৃজন সম্ভব। আবার ছন্দের সফল প্রয়োগেও একটি কবিতার সৃজন সম্ভব নাও হতে পারে। নেপথ্যে ভূমিকা রাখে এই ধ্বনির কারিশমা, ধ্বনি-আবহ সৃষ্টি হওয়া না-হওয়া। যুগপৎ ছন্দসাফল্য এবং ধ্বনিগত সাম্য সৃষ্টি হলে তা সবচে’ উত্তম। এ রকমটা অত ঘন ঘন হয় না। হওয়া সম্ভবও নয়। কদাচিৎ এমনটি ঘটে, যে কারণে ভালো কবিতা কদাচিৎ লিখিত হয়। যিনি ভালো কবি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন, তাঁর হাতেও সব সময় ভালো কবিতা এজন্যেই লিখিত হয় না। অন্যদিকে কোনোই স্বীকৃতি নেই, এমন কবির হাতেও সৃষ্টি হতে পারে একটি মহৎ কবিতা।

অনেকদিন থেকে যিনি কবিতা লিখেন, তিনি কবিতার বহিরাবয়বের এমন একটি ছাঁচ রপ্ত করে ফেলেন যে, চাইলেই তিনি কিছু শব্দকে ওই নির্দিষ্ট ছাঁচের মধ্যে ফেলে একটা অর্থবোধকতা সৃষ্টি করতে পারেন। খেটেখুটে তাকে অলঙ্কৃত করে তুলতে পারেন। হাতুড়ি-বাটালি-কাঠ পেলে যেকোনো কাঠমিস্ত্রি মানসিক যেকোনো অবস্থায় যেমন একটি চেয়ার বা টেবিল বানিয়ে ফেলতে পারেন, এ-ও অনেকটা তেমনি। কখনো কখনো প্রায় কবিমাত্রই এরকম কবিতামতো রচনা লিখে ফেলেন বটে-- কিন্তু সবসময় কবি বুঝতে পারেন না যে সেটি নির্জীব চেয়ার-টেবিল হয়েছে, না কবিতা। সেটা সম্ভব হলে চারপাশে কবিতামতো ব্যর্থ রচনার সংখ্যাধিক্য অবশ্যই চোখে পড়তো না। এটি বুঝতে পারার জন্য যে ধ্যান যোগ হতে হয়, তার অভাব না-ঘটলে চেয়ার-টেবিল নয় কবিতাই সৃজন সম্ভব। যিনি কবি তিনি কখনো কখনো কথিত এই ধ্যানময়তা থেকে চ্যুত হয়ে যান বটে, আবার ধ্যানমগ্নও তিনি হতে পারেন। তবে অকবি ধ্যানস্থের ভান করলেও ধ্যান তাতে ধ্যানস্থ হবার সুযোগ পায় না।

শেষপর্যন্ত একটি কবিতায় কী লিখিত হবে, কবি নিজেও তা জানেন না। একটি শব্দ, একটি বাক্য লিখিত হয়ে যাবার পর সেই শব্দ এবং বাক্যই চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে নিয়ে আসে আরেকটি শব্দ এবং বাক্যকে। এভাবে চলতে চলতে একসময় কবিতাটি সম্পূর্ণতা পায়। তখন শব্দ আরেকটি শব্দকে, বাক্য আরেকটি বাক্যকে ওই কবিতাটিতে আর প্রবিষ্ট হবার সুযোগ দেয় না, প্রয়োজন থাকে না বলে শেষ শব্দটি সম্পূর্ণ প্রবেশ পথ জুড়ে বসে থাকে। খতম হয় কবিতা কবিতা খেলা। এই যে একটি সম্পূর্ণ কবিতার সৃজিত হয়ে যাওয়া, পরিপূর্ণ ধ্যান যোগ হলে কখনো কখনো কবি ঠাহরও করতে পারেন না, কখন কীভাবে তাঁর দ্বারা অসাধ্যটি সাধিত হয়ে গেল। কবিতার এই সৃজিত হবার প্রক্রিয়ায় কবির অবচেতন মন এমনভাবে কাজ করতে থাকে যে, মস্তিষ্কের নির্দেশ পাবার পূর্বেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিখিত হয়ে যায় একেকটি শব্দ বা বাক্য। কখনো বা সম্পূর্ণ কবিতাটিই। অলৌকিকতা বলে কিছু নেই, কিন্তু মনে হয় এটি সংঘটিত হলো কোনো অলৌকিক প্রক্রিয়ায়ই। কবিতার জন্ম মুহূর্তটি এমন বলেই তাতে বাসা বাঁধতে পারে এত এত রহস্যের ঘনঘোর।

যিনি স্বভাষা বা বিভাষা শুদ্ধরূপে পড়তে-লিখতে-বলতে পারেন, তিনিই পাঠক নন। অন্তত কবিতার পাঠক তো ননই। কবিতার পাঠকের চালিত হতে হয় নির্দিষ্ট কবিতাটির সৃজন-প্রক্রিয়ার অধীনে আচ্ছন্নের মতো। যে গুণপনা থাকতে হয় কবির, তা কবিতার পাঠকেরও। যিনি এতসব গুণের অধিকারী, তিনি কবিতা না-লিখলেও কবি। হয়ত তিনি লিখেন না, কিন্তু লিখতে পারতেন। এরকম লোকের সংখ্যা প্রকৃতই কম, যিনি কবি নন অথচ কবিতার পাঠক। শেষপর্যন্ত কবিতার পাঠক কবিরাই। কবিই বাঁচিয়ে রাখেন কবিকে। আসলে একজন কবিতাকর্মীর সারাজীবন কবিতা লেখা, কবিতার পাঠক হয়ে ওঠবারই এক দীর্ঘমেয়াদি কষ্টকর পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারা মানেই কবি হয়ে ওঠা। যিনি কবি হয়ে উঠলেন কিন্তু পাঠক হয়ে উঠলেন না-- তার কোর্স অসম্পূর্ণ। কোর্স সমাপনীর কোনো সনদ তার কখনোই জুটবে না। তিনি সারাজীবন অধমই রয়ে যাবেন। একজন সম্পূর্ণ পাঠক, একজন অসম্পূর্ণ কবির চেয়ে উত্তম।

রচনাকাল : ২০০০

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...