Sunday, August 16, 2009

বালখিল্যকথন

কবিতা হলো কবির জীবনের একটা পরিস্রাবিত দ্রবণ, পরিপার্শ্বের তাপে গলা, যে-দ্রবণে মিশে এসে সমুদয় ভালোমন্দ অর্জনের ভাঁপ, ক্লেদ-গ্লাণিসহ। এসবের ভিতর দিয়ে যাওয়া, ডান-বাম দেখে, পাশ দিয়ে কে যায় না-যায় তার তল্লাশ জারি রেখে। যেসব জিনিসকে মানুষ উপেক্ষা করে আসে, যেসবকে রেখে আসে পরে কাজে দেবে ভেবে, সেসবের দূরাভাও থাকে। প্রান্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পানির মতো প্রয়োজনীয়তা সকল, সেসবকে যথাসম্মান দিয়েও বর্জ্যপ্রায় পরিত্যাজ্য বস্তু ও বস্তুভাবনার চরাচর চুঁইয়ে নেমে আসা অবিরল জলের দিকেও মাঝেসাঝে তাকাতে হয় ফিরে। কাকে নিতে হবে কাকে রাখতে হবে এসব ঠিক করে দেয় মেজাজ, যেটা সমাজঘটনা দিয়ে মোড়া। যে সুবিধা, যে অসুবিধা বিরাজ করে ভূয়ে, যখন যাপন করেন কবি, কবিতায় তার নিঃশ্বাসধ্বনিটাই বাজে। মানুষ দেখে দেখে শেখা মহাকালবোধ, এইখানে চুপিসারে এসে মেশে।

ভয়ের রক্তচক্ষুকে যুক্তির আঙুল দেখিয়ে থামিয়ে রাখা, অথচ ভেসে থাকা গোপন এক ভীতিভাবে। সভ্যতার নিঠুরাবেশে যতসব হুংকার দিকপাশে বাজে, নাতিদূরে ঘোরঘাটে খেলে ওঠে যতসব সন্তরণ লীলা, এসবেরও আঁচ রাখতে হয়, কোথায় কোথায় ভীতি সেই কথা সামনে না-এনে। ঘোর সেই পাললিক পরিসর নেচে ওঠে ধ্যানমগ্নতায়। পাঠককে গ্রস্ত করে ঘোর, আনে সম্মোহন। শুকনো পাতার সাথে উড়ে উড়ে ঝরে পড়ে পালকের আগে। মেঘসম্ভব গাম্ভীর্য ভেঙে বৃষ্টিধারা বয়।

বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমির বেদনা রোদের আঁচে তাতিয়ে নিয়েও বড়োসড়ো অভিযোগ কাঁধে নেয়া, তার ভার। ঘরের ভয় ও পথের ভয় আলাদা-আলাদা, ওইসব হাতের চউলে নিয়ে দেখা। সামনে তাকিয়ে দেখা কারা কারা পথে নেমে গেছে, লাল-নীল। নানাদিকে হাত উঠিয়ে থাকা। পথ বন্ধ হয়ে থাকে পুরো, বড়ো নির্যাতন সয়ে তবু ওর দিকে যেতে হয়। আমোদে-আহ্লাদে যাওয়া দরকার যেইদিকে, সেদিকের প্রেমকুঁড়ি গাছ, তার ডালপাতা মূলটুল স্থান করে নেয় যথারীতি। সব করে নিতে হয় নিজেই প্রস্তুত। যারা অপেক্ষা করে থাকে যত্নের, কত তারা ধরে মিছে সত্য, তুলে আনতে হয় ওরে ধরে, তারপর শুরু হয় বাগানবিলাস। অধিগত নয় যেটা, তাকে ঘিরে অপচয় বাড়ে, তবে এরও নিগূঢ় আঁচড় থাকে মিলেমিশে, যদিও দরকারি এর থেকে দূরে বাস করা, নিজের মতো করে, ঘাড়টাকে যথারীতি ত্যাড়া করে রূপার কপাটে দিয়ে খিল।

হয়ত শোনা গেল ধনচে শিশুর কোলাহল, একপাশে থেকে যেতে পারে কোনো প্রেমময় কথার ঝিলিকও। তাকানো দরকার নেই জেনেও তাকানোর মরশুমে চোখে চোখে গেঁথে নেয়া জিওল ভাবনা। খটখট-ঘটঘট হয়তবা দূরে ঠেলে রেখে যায় সবিশেষ কামভাব, অবদমনের কোনো দমনচেষ্টায় বুঝি থরে থরে সাজানো থাকে এইসব কর্মের ডালা। যে ধ্যানে পৌঁছা যায় না, সে ধ্যানের ভিতর দিয়ে আসা মনে মনে। সেরকম ধ্যানের মায়ায় বুঝি লাল চেলি ভুলে গিয়ে অকুল-আশার গলে মালা দেয়া। অজ্ঞতা ছায়ার মতো লেড়েল্যাপ্টে থাকে, বোধকরি থাকতেও হয়। এই সবকিছু মিলেমিশে বিচিত্র রূপগুণ নিয়ে যেটা আসে, সেটাই কেবল হয় মহাকালমুখী, কোনো-না-কোনোভাবে।

২.

এই-ই সব, যেন এই-ই সব। যদি হয়ও তা, এ ধারার তরল বর্ণনার চেয়ে তা করে ওঠা কঠিন। আর শুধু করে ওঠাই বা বলি কেন? বলাটাই বা সহজ হবে কী প্রকারে, যে বলা প্রকৃত বলা? যদিও প্রকৃতটা বলা এক্ষেত্রে নিতান্তই অসম্ভব, কারণ কবিতা শিল্প। শিল্পের কীভাবে এমন সংজ্ঞা হতে পারে যা সর্বজনীন? স্বপ্রণীত সংজ্ঞাযোগে ধারকাছ দিয়ে হয়ত যাওয়া যায় তার, কিন্তু শতভাগ ঠিক ঠিক জায়গাটা শনাক্ত করা যায় না এর। আমরা তবু চিনতে চাই একে স্ব স্ব অভিজ্ঞতা ও জানাবোঝা দিয়ে। বুঝতে চাই যে, কোনপথে হাঁটলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় ও হাঁটার ভঙ্গিটা ঠিক কী হলে রচিত কবিতায় ভর করে এসে সুন্দর।

স্থান-কাল-পাত্রভেদে সর্ববাদীসম্মত সংজ্ঞাহীন সুন্দরের মান ও মানে বদলে যায়। সুতরাং একজন কেউ যখন সুন্দরকে চিনাতে যান, কবিতার সুন্দর, তখন তা প্রধানত হয় ওই কথকেরই মতো। আর যাঁরা যাঁরা নির্দিষ্ট কথকের মতো করে ভাবেন, বা দেখেন কথকের ভাবনার মধ্যে তাঁর/তাঁদের ভাবনার কোনো খোরাক আছে সামনে এগোবার, বা ধরা যাক এমন কেউ যিনি ঠিক উলটো করে ভাবেন বা ভাবতে চান কথকের চেয়ে; কথককে ছাড়া আর কেবল তাঁর তাঁর কাছে এসব বলাবলির কোনো মানে থাকলে থেকেও যেতে পারে।

৩.

‘ভাষাই বড়ো ব্যর্থতা ব্যর্থ লেখকের’— এ কথায় মনেপ্রাণে আস্থা না-রাখবার কোনো কারণ ঘটে নি এখনো। লক্ষ করলে দেখা যায় যে, কোনো কোনো লেখক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা অনেক অর্থপূর্ণভাবে বলেছেন, কিন্তু ভাষাগত বিশেষত্ব ও বাগসংহতি না-থাকায় তা পাঠককে ছুঁতে পারে না। কবিতায় ভাষার ব্যবহার হতে হয় অব্যর্থ ও যথাযথ। যোগাযোগসহজতা তার একমাত্র বিবেচনা নয়। বিবেচনায় থাকে উচ্চারণসহজতা, প্রত্যাশিত গাম্ভীর্য সৃষ্টির লক্ষ্য ও অর্থ প্রসারণ চেষ্টাও। অবিবেচকের মতো অবান্তর শব্দনিক্ষেপ কবিতাকে সিদ্ধির কূলে পৌঁছতে দেয় না, বরং চরে আটকিয়ে দেয়। পুরো কবিতার শব্দবিন্যাস সামঞ্জস্য ও সংগতিপূর্ণ হওয়া লাগে। তবেই কেবল তা সংগীতের দিকে এগিয়ে যায়।

ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। ভাষার এই পরিবর্তনের গতিটা কোনদিকে সেটা আন্দাজ করা গেলে সবচে’ সুবিধা। যেহেতু একজন কবিতাকর্মী আজকের জন্যই কবিতা লিখেন না, বরং লিখেন আগামীর জন্য, কাজেই আগামীতে ভাষার যে সম্ভাব্য রূপটি দাঁড়াতে যাচ্ছে তা যদি কেউ ঠিকঠাক ধরে উঠতে পারেন, তাহলে তিনিই আগামী সময়ে বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। একজন কবির কবিতা যতদিন প্রাসঙ্গিক ততদিনই তিনি পঠিত হন, এবং ততদিনই তিনি জীবিত। ততদিনই তাঁর লেখার নব নব দরোজা উন্মোচনের সম্ভাবনা থেকে যায়। আর্কাইভড হওয়া একজন লেখকের কোনো চূড়ান্ত সাফল্য নয়, প্রত্যাশাও নয়।

লেখককে প্রাসঙ্গিক রাখে কেবল ভাষা নয়, তাঁর বক্তব্যও। নিহিত বক্তব্যকেও সমকালোত্তরণের স্পর্ধা রাখতে হয়। যা আজ লেখা হলো তা আজ তো সমকালীনই, কিন্তু কাল যদি তা পশ্চাৎপদ বিবেচিত হয়, তবে তা ভাষায় প্রাসঙ্গিক হলেও সার্বিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। আজকের বার্তাকে যদি তাবৎ ক্ষমতাযোগে মহাকালের করে তোলা যায়, তবে সেটা প্রসঙ্গ হয় আগামীদিনের। এজন্য ভাবনাচিন্তায় আধুনিক হতে হয়, বিজ্ঞাননিষ্ঠ হতে হয়, নতুনকে গ্রহণ করবার মানসিকতাসম্পন্ন হতে হয়, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে হয়। এ হলে ছোঁয়া যায় চিরসমকাল। অর্থাৎ কবির মহাকালকে লক্ষ্যে রেখে শব্দচয়ন, শব্দসজ্জা ও বাক্য নির্মাণ করতে হয়। এটা যে যত ভালো করতে পারেন, তিনি তত বেশিদিন বেঁচে থাকেন। এ বাঁচা শারীরিকভাবে নয়, পাঠকের মধ্যে নান্দনিকভাবে বাঁচা।

পাঠকদের একটা অংশের সঙ্গে কবির যে দূরত্ব তৈরি হয়, তার একটা কারণ মহাকালকে অভীষ্ট ভাবা। এটা সংগতও। এ অবস্থা কারো ক্ষেত্রে খুবই প্রকট আকার ধারণ করে, কারো ক্ষেত্রে অপ্রকট। কিন্তু এ কখনো নয় যে, পাঠকঅপ্রিয় কবিমাত্রই মহাকালের সওদাপাতিতে ব্যস্ত। পাঠকঅপ্রিয়দের একটা বড়ো অংশই অল্পপ্রাণ কবি অথবা অকবি। পাঠকপ্রিয়দের মধ্যে এ সংখ্যা আরো বেশি।

৪.

একটা বহুশ্রুত প্রবাদ আছে আমাদের সংস্কৃতিতে, ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’ বা ‘বউকে মেরে ঝিকে..’,। এই প্রবাদোপরিতলে যে ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, কবিতায় প্রতীক ওই কাজটিই করে। যে বস্তুকে বা যাকে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে তার কথা না-বলে বর্ণিত বস্তু বা ভাব বা ঘটনার বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঠিকঠাক ঘটে এমন কিছু দ্বারা মূলকে প্রতিস্থাপিত করাই প্রতীকায়ন। আড়াল সৃষ্টির জন্য এবং সৌন্দর্য নির্মাণের জন্য এটির দরকার হয়। শিল্পে প্রতীকের ব্যবহার খুব প্রচলিত ঘটনা। সঠিক প্রতীক ব্যবহার করতে পারা বিষয় ও বিষয়সংশ্লিষ্ট জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। প্রতীককে হতে হয় সুপ্রযোজ্য। একটি প্রতীকের অযথার্থ ব্যবহার একটি কবিতাকে মাঠে মেরে ফেলতে পারে। সব পাঠক সব প্রতীককে ঠিকঠাক ধরতে পারবেন সেরকম ভেবে ওঠা অসংগত। কিন্তু নিবিড় পাঠে তা অধিকাংশ অভিজ্ঞ পাঠকের কাছে গ্রাহ্য হয়ে ওঠা উচিত। ব্যবহার যথার্থ হলে তা না-হবারও কারণ খুব থাকে না। অবশ্য কবি যে অর্থে প্রতীকটি ব্যবহার করেছেন ঠিক সেটাই না-বুঝে পাঠক অন্য কিছুকে বুঝলে মহাভারত ক্ষণিকের জন্যও অশুদ্ধ হয় না, যেহেতু পাঠকই কবিতার ‘মানে’কে জন্ম দেন তাঁর তাঁর মতো করে। কবিতার অর্থ পাঠকভেদে বদলে যেতে পারে, এটাই কবিতার শক্তি। এমনকি বলা চলে স্থিত মানের রচনা কোনো কবিতাই নয়। সেটাই কবিতা, যে টেক্সটের মানে পাঠে পাঠে বদলায়। এটা দূর করবার চেষ্টা কবিতার কবিতাত্ব নিয়ে খানিক সংশয়কে বরং উদ্বেলিত করা।

কবির সময়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অনেক কারণ থাকে, যা তাঁকে আড়াল সৃষ্টি করতে বাধ্য করে। এ তাঁর নিজ অস্তিত্ব রক্ষার্থে তো বটেই, শিল্পের কৌমার্য রক্ষার্থেও দরকার। কবির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক নানা ঘটনার দ্রষ্টা হয়ে উঠতে হয়। আর এসবের ভিত্তিতে সামাজিক মানুষ হিসেবে তিনি নানা প্রেরণাও লাভ করেন, আবেগাপ্লুুত হন। কিন্তু খুব সরাসরি তিনি তা বলতে পারেন না। বললে তাঁর উপরে নানা খড়্গ নেমে আসার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া শিল্প হিসেবে কবিতার সব কথা সবভাবে গ্রহণ করবার সক্ষমতা নেই, এটা মনে রাখতে হয়। এত অনর্থক ভার বইতে পারে না কবিতা। যে কারণে কবিকে বক্তব্য আড়াল করতে নানা প্রতীকের আশ্রয় নিতে হয়।

ভাষা সংকেতও আদতে প্রতীক। ভাষার প্রতিটি শব্দ এক বা একাধিক বস্তুর প্রতীক। কলিম খান অবশ্য বলেন, বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডারের সবচে’ বড়ো সম্ভার সংস্কৃত ভাষা ছিল ক্রিয়াভিত্তিক। তৎসম শব্দসমূহের মাধ্যমে এ গুণ বাংলা ভাষায় স্বতঃস্থানান্তরিত। ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এর মূল অর্থ হয় ধাতুর। নির্দিষ্ট ধাতু থেকে উদ্ভূত সমস্ত শব্দের অর্থই নিয়ন্ত্রণ করে ধাতুর অর্থ। শব্দব্যাখ্যান কর্মের যে ছবি সামনে আনে, সেই কর্মের বৈশিষ্ট্যই নির্ধারণ করে শব্দটির গঠন কী হবে। এ মতে শব্দের অর্থ বাইরে থেকে আরোপিত নয়, ভিতর থেকে উৎসারিত। পরে মুনাফালক্ষ্যী বিনিময়কে শব্দার্থজাত ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে অধিক লাভজনক করবার জন্য শব্দকে সুনির্দিষ্ট মানেবাহী করে তুলতে কিছু শব্দের অর্থকে সুনির্দিষ্ট করে ফেলা হয়। যে কারণে কোনো-কোনো শব্দের ধাতুমূলগত অর্থ অজস্র হলেও শোনামাত্র কেবল এক-দুটি প্রাণী, বস্তু বা বিষয়কে বোঝায়। এটা স্বাভাবিকভাবে অজস্র অর্থ হওয়াকে আস্বাভাবিকভাবে সীমিত পরিসরে বেঁধে ফেলানো। এর মানে প্রসারিত অর্থকে সংকুচিত করে ফেলা, যেভাবে আমাদের বাংলা ভাষাও, অন্যসব ভাষার মতো প্রতীকী ভাষা হয়ে উঠেছে। সব ভাষাই সময়ের সাথে বদলে যায়, ভিতরে ও বাইরে। সংকুচিত হয় প্রসারিতও হয়। এর অনেকগুলো কারণ থাকে, কলিম খান মুনাফালক্ষ্যী বহির্দেশিয় বেণিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কারণটিকে নেতিবাচকভাবে দেখেছেন। সংকোচনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন।

অমুনাফালক্ষ্যী শিল্পসৃজনের প্রয়োজনেও যে শব্দের অর্থ কালে কালে বদলে যায়, এটাকে তিনি সংকোচনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন নি। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ নামক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে অভিধানকে ভিত্তি করে কলিম খানের ক্রিয়াভিত্তিক ভাষাতত্ত্ব দাঁড়িয়েছে, সেটি সংকলনকাল পর্যন্ত বিভিন্ন মুদ্রিত দলিলে যে সমস্ত অর্থে যেভাবে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার একটা যথাসম্ভব ভালো ডকুমেন্টেশন, সেখানে সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের উদাহরণসহ প্রাপ্ত অর্থসমূহ নথিভুক্ত হয়েছে। ভাষাসংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরেই শব্দের মানে বদলায়, নতুন মানে সংস্থাপিত হয়; এবং শুধু লিখিতভাবে নয় এটা হয় মৌখিকভাবেও। সচল ভাষামাত্রেরই ক্ষেত্রে এরকমটা ঘটে। ভাষা যত বিচিত্র কাজে ব্যবহৃত হয়, তত বিচিত্র হয় এর জগৎ, সমৃদ্ধি। সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম সবচে’ বড়ো সেক্টর, যেখানে এই কাজটা হয় সবচে’ বেশি। এখানে প্রতিনিয়ত শব্দের মানে নড়েচড়ে যায়, প্রসারিত হয়। প্রসারণার্থে শব্দের এই প্রয়োগেরও সাহিত্যে প্রতীকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার কথা, যে ধরনের প্রতীকের ব্যবহার রচনাকে কবিতা করে তোলে। একজন কবিতাকর্মী একইসঙ্গে ভাষাকর্মী। তাঁর একটা কাজ এ-ও যে তিনি ভাষাকে সম্প্রসারিত করেন। ভাষার সম্প্রসারণ ব্যবহারিকভাবে ঘটাতে গিয়ে তিনি একটি কবিতা করলেন এরকম নয়, বরং কবিতা করতে-করতে একইসঙ্গে ভাষাকে সম্প্রসারিত করছেন। কবিতাটি যখন শিল্প হয়ে ওঠে, তখন এই ভাষাকৃতিটা উপজাত।

শব্দে নতুন প্রাণসঞ্চারের এই কাজটি কবিতাকর্মীর একটি মুখ্য কাজ। শব্দ যদি নতুনভাবে খেলে ওঠে, অর্থটা যদি একটু মুচড়ে যায়, তাহলে পাঠক নড়েচড়ে বসে। ক্লিশে মানেযুক্ত করে ক্লিশে শব্দের ব্যবহার মৃত রূপকের ব্যবহার, যা আবার প্রতীকও। কবিতায় পাঠক মৃত রূপকের রাশি-রাশি লাশ দেখতে পছন্দ করেন না।

মিথ হিসেবে খ্যাত লৌকিক পুরাণ বা পৌরাণিক লোকশ্র“তিকেও প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। পৌরাণিক একেকটি চরিত্র বা ঘটনা অতীতের একটা চরিত্র বা ঘটনার গল্পকে ছোট শব্দশরীরের মধ্যে ধরে রাখে। গোটা কবিতায় একটি শব্দ হয়ে ব্যবহৃত হলেও ওর অনেক দীর্ঘ অদৃশ্য ফুটনোট থাকে। শব্দটি ওই ফুটনোটের প্রতীক। একজন কবি অবিকল অর্থেই শব্দটি কবিতায় ব্যবহার করলে ধরতে হবে তিনি মৃত রূপক বা ক্লিশে প্রতীক ব্যবহার করলেন। মিথের এরকম ব্যবহার গতিশীল নয়, নয় প্রগতিশীলও। হাজির করতে হয় এর নতুন বয়ান। পুরোপুরি অথবা অংশত, যেটা প্রাসঙ্গিক। ধরা যাক দেবী দুর্গাকে দশ হাতে কাজ করা গার্হস্থ্যকর্মী সক্রিয় নারীর রূপে দেখা হলো। এ প্রয়োগটিকে পাঠক আরো দূর পর্যন্ত কল্পনা করে নিতে পারবেন, যে, এতকিছুর পরও একজন গার্হস্থ্যকর্মী নারী ‘কর্মী’ স্বীকৃতিটা পর্যন্ত অর্জন করতে পারে না এবং এর জন্য কোনো অর্থমূল্য দাবি করতে পারে না। কাজগুলো অনর্থক না-হয়েও না-অর্থক হওয়ার কারণে এই যে পুরুষতান্ত্রিক বঞ্চনা, এটা তখন হয়ে যেতে পারে ওই নির্দিষ্ট প্রয়োগের একটা তাৎপর্যপূর্ণ আলোকপাত। মিথের এই মুক্তিটা কবিতায় প্রার্থিত।

৫.

আবেগ কবিতার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ একটা অদৃশ্য ঘটনা যে একে ছাড়া শিল্পসৃষ্টি, বিশেষ করে কবিতা লেখা অসম্ভবপ্রায়। অবশ্য আবেগ ব্যতিরেকেও কবিতামতো দেখতে রচনা তৈরি করা সম্ভব, যেটা অতি অবশ্যই হয় যান্ত্রিক, অতএব কবিতা নয়। এ ধরনের রচনা তৈরিকে পেশাদার কাঠমিস্ত্রির একের পর এক টেবিল-চেয়ার বানানোর সাথে মিলিয়ে দেখা যায়। যতক্ষণ ব্যবহারোপযোগী কাঠ আছে, হাতুড়ি-বাটালি আছে, বাইস আছে, ততক্ষণ কাঠমিস্ত্রি অবিরাম বা সবিরাম চেয়ার-টেবিল বানিয়ে যেতে পারেন। একটি চেয়ার ও টেবিলের শিল্পকর্ম হয়ে ওঠবারও অবকাশ থাকে, কিন্তু পেশাদারি উন্মাদনায় ভেতরের টান ছাড়া নির্মিত চেয়ার-টেবিল তা হয় না। একইরকমভাবে একজন কবিতাকর্মীকে কাগজ-কলম-পরিসর দিলে যখন-তখনই তিনি ছন্দোবদ্ধ কবিতামতো লেখা তৈরি করতে পারেন, কিন্তু সেটা পেশাদারি উপায়ে তৈরি চেয়ার-টেবিলের মতোই যান্ত্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্যমার্কা একটা ঘটনা হয়ে উঠতে পারে। পেশাদার ঔপন্যাসিকদের হাতে যেরকম ফল ফলতে থাকে অবিরাম। তাঁরা হলেন বারোমাসী ফলগাছ। বছরে হরদিনই সেসব গাছে ফল থাকে।

সত্যিকার কবিতা রচিত হতে গেলে তার মধ্যে আবেগের পরিমিত প্রকাশ ঘটতে হয়। এই প্রকাশ ঘটায় আবার ইন্সপিরেশন বা প্রেরণা। দাঁড়ালো তাহলে এই যে, যে-প্রেরণার গুত্তো খেয়ে বিষাদ, ক্রোধ বা আনন্দ জাতীয় আবেগ উসকে উঠবে, তার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সৃজিত মানেযুক্ত রচনার কবিতাবস্তু হয়ে ওঠবার অবকাশ থাকে। অর্থাৎ আবেগ যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনি অত্যাবশ্যক তার সুনিয়ন্ত্রণ। ধরা যাক, কোনো কারণে অত্যধিক ক্রোধ সঞ্চারিত হলো মনে। ঠিক তৎক্ষণাৎ একটি কবিতা রচনায় উপগত হলে এটির কবিতা হয়ে ওঠবার সম্ভাবনা লোপ পায়। ক্রোধটাকে সামগ্রিকতার ওপরে দাঁড়াবার জন্য সময় দিতে হয়, তাতে তা আর ব্যক্তিগত ক্রোধ থাকে না, হয়ে ওঠে সর্বজনীন, সাধারণ। এই সর্বজনীন ক্রোধ যদি কোনো একটি রচনা উৎপাদনের নেপথ্যে ভূমিকা রাখে, তবে তার মাধ্যমে সৃজিত রচনাটি কবিতা হলেও হতে পারে, এমনকি খুলে যেতে পারে তার সর্বজনীন হয়ে ওঠবার সম্ভাবনাও। চীনা একটি প্রবাদ আছে এরকম যে, রাগান্বিত অবস্থায় কখনো চিঠির জবাব দিতে নেই। কেন? ওই একই কারণে। নইলে যাকে জবাব লেখা হচ্ছে, তার প্রতি অবিচার হয়ে যাবার সম্ভাবনা শয়ে প্রায় শ’। রাগ প্রশমিত হয়ে যখন ব্যাপারটা সূক্ষ্ম ক্রোধানুভূতিতে রূপান্তিত হয়, তখন তার পক্ষে সম্ভব সামগ্রিক অবস্থার মূল্যায়ন করা ও মত স্থাপন করা। ওই প্রাবাদিক সত্যটা কাজেই এখানেও নিহিত।

কবিতায় তাৎক্ষণিকতার এই বিপদাপদ সম্পর্কে কবিমাত্রেরই সচেতন থাকা আবশ্যক জ্ঞান হয়। এর মানে কি এই যে সুতীব্র উন্মাদনার ভিতরে আনন্দ, বেদনা বা অন্য কোনো অনুভূতির কথা লেখাই যাবে না? না, তা নয়, একদমই নয়। লেখা যাবে। কারো কারো হাতে এভাবেও উৎকৃষ্ট রচনা বেরিয়ে আসা সম্ভব বৈকি, তবে এতে নিকৃষ্ট রচনা তৈরি হবার ঝুঁকিই বেশি থাকে বলে মনে হয়। সুতীব্র উন্মাদনাজাত রচনার খসড়াকে কবিতায় রূপ দেবার জন্য অনেক কাল ফেলে রাখাই সঙ্গত। এটা কতদিন, তার কোনো সুস্পষ্ট সীমা নেই। তবে এরকম বলা যায়, যতদিন ওই নির্দিষ্ট অনুভূতি, যা নেপথ্য কাণ্ডারি হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল, তা একটা সামগ্রিকতার ওপরে না-দাঁড়ায়, ততদিন। নির্দিষ্ট সময় পর ওই খসড়ার একটা নিরাবেগ সম্পাদনা-শাসন দরকার হয়। ঝেড়ে ফেলতে হয় তাবৎ উৎকট অবস্থা, একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। দেখতে হয়, ওই টেক্সটে কোনো কিছুই যেন ময়লা দাঁত বের করে হাসতে না-থাকে। যেন ভদ্র জনসমাগমের ভিতর দিয়ে নিবস্ত্র হয়ে হাঁটতে শুরু করার মতো কোনো ঘটনার ওটা জন্ম দিয়ে না-বসে। এক্ষেত্রে অবশ্য একটা বিপদসংঘটনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বুদ্ধির সাথে অনুভূতির একটা তুমুল ঝগড়ার মোকাবেলা করতে হতে পারে সম্পাদনাকালে। এই ঝগড়ার মীমাংসাটা কে কীভাবে করবেন তা নির্ভর করে তাঁর কাব্যরুচি, মেজাজ, বিশ্বাস ইত্যাদির ওপর। সবচে’ ভালো সম্ভবত বুদ্ধি বা অনুভূতি কারো একার হাতেই পূর্ণ শাসনভার ছেড়ে না-দিয়ে দুয়ের একটা বিবাহসম্পর্কে আস্থা রাখা।

৬.

ইমাজিনেশন হলো সংবেদন ও ধারণার মনছবি আঁকবার সামর্থ্য, যা ওই বিশেষ মুহূর্তে শ্রবণ-দর্শন বা অন্য কোনো ইন্দ্রিয় দ্বারা ধারণযোগ্য নয়। এটি তৈরি হয় বুদ্ধি ও আবেগের সংমিশ্রণে। ছবিমাত্রকেই ছবিকল্প ভাববার একটা রেওয়াজ আছে আমাদের মধ্যে। একটিও দৃশ্য বা শ্র“তিকল্প নেই এমন কবিতাও ইমেজারিতে ঋদ্ধ বলে প্রশংসিত হতে দেখা যায় হামেশা। আমরা এত যে দিলখুশ হই সহজনের প্রতি, ঘেন্না লাগে। আর অন্যদিকে চলতেই থাকে ‘যারে দেখতে নারি’র চলনকে চিরকাল বাঁকা ঠাওরানো দাপুটে বাসনার বজ্জাতি।

মন কীভাবে এসব ছবি তৈরি করে? কল্পনা দিয়ে ভেবে শব্দ দিয়ে ধরাধরির মাধ্যমে। কল্পনার সীমাটা কী? সীমা প্রায় নেই। কারণ যা পূর্বাভিজ্ঞতায় নেই এমন কিছুই মনের চোখ দিয়ে দেখা দরকার হয় ইমেজারি নির্মাণের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে শতভাগ মুক্তি দরকার হয় কল্পনার। অথবা হতে পারে পূর্বে অংশত বা অন্য আঙ্গিকে অভিজ্ঞতায় ছিল। এক্ষেত্রে রকমফের থাকছে মাত্রায়।

তো, এই মাত্রার স্বাধীনতা ভোগ কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে কি না সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। যাঁকে চরম স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে তিনি সেই স্বাধীনতাটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছেন কি না সেটা একটা সংগত বিবেচনা। অবাধ স্বাধীনতা ভোগের অধিকার লাভ করা মাত্র আমি যদি হাতিগুচ্ছকে তুড়িতে উড়িয়ে দেই আকাশে আকাশে, নদীকে পুড়িয়ে দেই মাছের যৌনতাসহ, যেহেতু কাজটা যথার্থেই সংঘটিত হওয়ার দরকার হচ্ছে না, শব্দ-বাক্যের কারসাজিতেই ঘটিয়ে দেয়া যাচ্ছে সব; দোষ কি আছে তাতে? আছে। এটা ফ্রি পেয়ে মাথার বাঁ’পাশে বাড়তি আরেকটা মাথা জুড়ে নেয়ার মতো ব্যাপার। পাঠকচিত্ত কতটা স্বস্তি পাবেন এহেন ভোগচর্চায়? এজন্য মাঝেমাঝে মনে হয়, সীমা বোধকরি এরও আছে কোথাও। যাই কল্পনা করি না কেন মানব ধারণায় তাকে সম্ভব মনে হতে হয়, অন্তত পরোক্ষে, তাহলেই কেবল সেখানে সৌন্দর্য ভর করবার ফুরসৎ পায়, অন্যথায় সৃষ্টি হয় অসামঞ্জস্যতা, যা কবিতার এক নম্বরের শত্রু।

যেখানে মনছবির প্রশ্ন, সেখানে মনই গুরু। যার মন যেরকম ছবির জন্ম দিতে সক্ষম, তিনি তেমনি আঁকবেন। পাগলামি বা উন্মত্ততার ব্যাপারটাও এখানে উল্লেখ্য। পাগলামি অনেক উৎকৃষ্ট মনছবি আঁকতে পারে, আবার এ বৈশিষ্ট্য প্রলাপেও নিপতিত হতে পারে। যিনি পাগল বা উন্মাদ, তাঁর সামনে কোনো সীমারেখা বেঁধে দেয়া যায় না, সেটা সম্ভবও নয়। মনছবি আঁকবার ওই বিশিষ্ট সময়ে তাঁর মন-মস্তিষ্ক যে অবস্থায় বিরাজ করছে, সে অবস্থারই উৎপাদন সামনে আনবেন তিনি। ওটা কদ্দূর মানুষের পারসেপশনের আওতার মধ্যে থাকল না-থাকল, সেটা পরে বিবেচ্য। তবে হ্যাঁ, একটা মাত্রার সূক্ষ্ম উন্মাদনা ভালো মনছবি আঁকবার জন্য খুবই দরকারি বিবেচ্য হতে পারে। এ অবস্থা যুক্তিশৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, স্বাভাবিক অবস্থা যে সুযোগটা মোটেই দিতে চায় না।

ঢাকা, জুন ২০০৯

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...