Sunday, August 16, 2009

খ্যাপা হাওয়ার ঢেউ উঠেছে চিরব্যথার বনে

শুদ্ধাভিযান একটা তপস্যা, প্রার্থনাতুল্য নৈমিত্তিক ক্রিয়া। সদ্যপ্রয়াত সংস্কৃতিসর্বজ্ঞজন ওয়াহিদুল হক আজীবন এই শুদ্ধাভিযানেই ব্রতী ছিলেন। সে অভিযানের উচ্চতা ছিল গান, সুর, উচ্চারণ, আচরণ, ক্রিয়া থেকে শুরু করে মানুষ হওয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত এবং যার ভূগোল ব্যাপ্ত ছিল আপন থেকে পর অবধি। অর্থাৎ নিজে শুদ্ধ হবার সাধনাই শেষ নয়, শুদ্ধ মানুষ বানানোও তাঁর জীবনাভীষ্টের অন্তর্গত ছিল। সারা বাংলার প্রতিটি প্রান্ত ছিল তাঁর সম্ভাব্য মানুষ খোঁজার ক্ষেত্র এবং সেই ক্ষেত্রের সম্ভাবনাময় অঙ্কুরগুলোকে অ্যাকোম্পানিমেন্ট সাপোর্ট বা সহগ সহায়তা দিয়ে, চিটা নয়, ধাপে ধাপে সোনার ফসল বানিয়ে তোলা ছিল তাঁর সাধনা। এহেন জাতশুদ্ধ ভ্রামণিক সাধকজন সম্পর্কে একজন অশুদ্ধাচারী জীবমাত্রের কিছু বলবার চেষ্টাকে তাঁর স্বহস্তে বানানো হাজার হাজার নারী-পুরুষ (মানুষ) কীভাবে গ্রহণ করবেন, তা ভেবে আমি সংশয়ান্বিত। কিন্তু যেহেতু তাঁর বিহনে হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষের মতো আমারও মনের বনে খ্যাপা হাওয়ার চিরব্যথার ঢেউ গেয়ে উঠেছে, তাই কিছু না বলাটা ব্যক্তি আমার জন্যে প্রশান্তিদায়ক নয়। এই সহেতু-প্রচেষ্টা কেবল এজন্যেই।

কিন্তু কী বলব আমি তাঁকে নিয়ে ? এটা, যে, তাঁর নিবিড় সংস্পর্শ পেয়ে এক জীবনে শুদ্ধ হওয়া হলো না আমার ? এটা, যে, তাঁর লেখায়-বলায় অনুভূতি প্রকাশে বাংলাভাষার উচ্চাঙ্গের ক্ষমতা প্রকাশিত ও প্রমাণিত হয়েছে ? এটা, যে, শুধু বেঁচে থেকে নয়, মরেও তিনি মানুষের কাজে লেগেছেন ? কিংবা এটা, যে, তাঁর মৃত্যুর পরের আনুষঙ্গিক ক্রিয়াদি, ‘ইসলাম’ রাষ্ট্রধর্ম ঘোষিত একটি দেশে চরম এক বিপ্লবের প্রতিধ্বনি ?

ঢাকা শহরে, নিকটে অবস্থানসূত্রে, যতটা তাঁর সংস্পর্শে যাওয়া জরুরি ছিল, ততটা যাওয়া আমার হয় নি। কিন্তু যতটা তাঁকে পাওয়া হয়েছে, তার মূল্যও অপরিসীম। যদিও সে পাওয়া, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমার শুদ্ধ হবার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। এক জীবনে এই অপ্রাপ্তি নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে।

আমরা দেখেছি, যত না তিনি লিখতেন, বলতেন তার চে’ অনেক বেশি, বলতে হতো বলে। আর এই বলা এতটাই শুদ্ধ উচ্চারণে এবং মৌলিক কেতায় যে, শ্রোতারা তা অমৃতের মতোই গিলত। আমিও গিলেছি আর ভেবেছি, মানুষ এক জীবনে এমন অজস্র গুণ লাভ করেন কীভাবে ? বাকপটু মানুষ ম্যালাই আছে আমাদের চারপাশে। তাঁরা এমনকি সম্মোহনও জানেন। তবে বলতে একদমই দ্বিধা নেই যে, তাদের অনেকে বাকসর্বস্ব। বাকে অর্থসারত্ব আছে এমন বাকপটু মানুষ আমাদের চারপাশে খুবই কম। ভাবি, অন্তত সারগর্ভ তাঁর সব আনুষ্ঠানিক কথামালারও যদি লৈখিক রূপ থাকত, কালপরম্পরায় উপকৃত হতে পারত বাঙালি জাতি। ৭৪ বছরের কর্মময় জীবনে তাঁর মাত্র তিনটি গ্রন্থ-- গানের ভিতর দিয়ে, চেতনাধারায় এসো এবং সংস্কৃতি জাগরণের প্রথম সূর্য ; এবং একটিমাত্র অ্যালবাম-- সকল কাঁটা ধন্য করে। অথচ তাঁর অর্ধেকমাত্র বয়সে কারো কারো ডজন দুয়েক গ্রন্থেরও রেকর্ড আছে আমাদের দেশে। এত কম লিখতেন কেন তিনি? লেখার চেয়ে বলায় স্বাচ্ছন্দ্য বেশি পেতেন বলে? এ প্রশ্নের প্রকৃত জবাবটি কী তা তাঁর মুখ থেকে জানার সুযোগ আমাদের আর নেই। আমরা এখন ধারণা করতে পারি মাত্র।

দৈনিক জনকণ্ঠ ও ভোরের কাগজে তিনি যে কলামগুলো লিখেছেন, অচিরেই আমরা সেগুলোরও গ্রন্থরূপ হয়ত দেখব-- কিন্তু বলতেই হবে যে, এসবের ভিতর দিয়ে তাঁর জানাশোনার এক রত্তিও আমরা ধরে রাখতে পারি নি ভবিষ্যতের জন্য। আমাদের প্রকাশকরা যদি কেবল ব্যবসায়কেই বড়ো করে না দেখতেন, তবে তাঁকে দিয়ে তাদের মাধ্যমে আরো কিছু লিখিয়ে নেয়া হয়ত সম্ভব ছিল। কোন বিষয়ে তাঁর বিশেষায়িত জ্ঞান না ছিল ? ভাষা (বাংলা ও ইংরেজি), সাহিত্য, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, শিল্পতত্ত্ব, চারুকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, দর্শন, নিসর্গ, রাজনীতি, ইত্যাদি ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয় ; এবং এসব বিষয়ে তাঁর প্রভূত পাণ্ডিত্য ছিল বলে সর্বজনে একটা স্বীকৃতিও আছে। অথচ এই জানাশোনার সিংহভাগই আমরা ২৭ জানুয়ারি ২০০৭-এর অপরাহ্ণ বেলায় চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। তাঁকে আরো প্রয়োজন ছিল বাঙালি সংস্কৃতির, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের, সংগীত ও থিয়েটারের, নির্যাতিত ও নিপীড়িতের, মানুষ-আধামানুষ-ঊনমানুষের। কাজেই এই প্রয়াণ, আমাদের, বাঙালি জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি।

ব্যাপক জানাশোনার ছাপ থাকত তাঁর প্রতিবার বলায়, প্রতিটি লেখায়। বলতেই হবে, ভাষার অতিশয় মজবুত কিন্তু স্বচ্ছ এক নিজস্ব গাঁথুনি আছে তাঁর প্রতিটি গদ্যের। ওই গদ্যের স্তরে স্তরে অর্থ স্থাপন করা। আর অর্থগুণেই বিশেষ মনোযোগ দাবি করে সেসব লেখা। কিন্তু তাঁর লেখা বিষয়ে অলস ও অমনোযোগী পাঠকের অনেক নিন্দামন্দও স্বকর্ণে শুনতে হয়েছে আমার। তাদের অভিযোগের মূল প্রতিপাদ্য হলো বুঝতে না পারা। ওই একই ধরনের অভিযোগ আমার নিজের লেখা নিয়েও অনেকে করে থাকেন। কাজেই আমাকে সেসব অভিযোগের প্রতিবাদ করতে হয়েছে প্রেমবশত যেমন, তেমনি আত্মরক্ষার্থেও। ওয়াহিদুল হকের গদ্যে আমি বরাবরই বিশেষভাবে মুগ্ধ। ওই মুগ্ধতা, আমার চর্চার ঘর-গেরস্থিতেও হয়ত জায়গা করে নিয়েছে। হতে পারে তাঁর গদ্যরচনার বিরল মুন্সিয়ানার কোনো প্রভাব আমার গদ্যশৈলী সঙ্গোপনে ধারণ করে থাকবে।

আমরা সবাই জানি, তাঁকে ধর্মীয় রীতিতে দাফন করবার সুযোগ তিনি নিজেই রেখে যান নি। চোখ দু’টো মৃত্যুর পরপরই চলে গিয়েছিল সন্ধানীর চক্ষু ব্যাংকে, তাঁর ইচ্ছেমতো। দেহটাও, তাঁরই ইচ্ছেয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে নিবেদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাবতে কেমন লাগে, যে, সদাভ্রাম্যমাণ তাঁর বহুদর্শী চক্ষুদ্বয় অন্য কাউকে আলো বিলাবে, দেখতে পারার ক্ষমতা যার রহিত অথবা রহিত হবার উপক্রম! ওই চোখ কি তাঁর দেখা বাংলাদেশের রূপছায়া ধরে রেখেছে কোথাও? এবং এহেন দেখাদেখির ভিতর দিয়ে দর্শনজাত যে জ্ঞান, তাও কি ওই চক্ষুদ্বয়ে কোনো-না-কোনোভাবে সংস্থিত আছে?

চিকিৎসাবিজ্ঞান এরকম বলে না, কিন্তু কবিকল্পনায় এরকম ভাবতে ভালো লাগে যে, সেই একজন কেউ, অথবা দু’জন, যে বা যারা তাঁর চক্ষু পরবেন, তারা তাঁর মতোই অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবেন। করুন, সেটা বাংলাদেশের জন্যে খুবই দরকারি।

আমরা দেখেছি, মৃতের সৎকারে ধর্মীয় যাবতীয় আচারকে উপেক্ষা করে কেবল কবিতা ও গানে গানে তাঁর প্রতি বিদায়াঞ্জলি নিবেদিত হয়েছে। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম এমন একটি দেশে এটি সত্যিকারার্থেই একটা বিপ্লব। আমাদের জানামতে, এটি এ ধরনের দ্বিতীয় বিপ্লব। ২৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৯৯-এ প্রয়াত প্রগতিশীল প্রাজ্ঞজন ড. আহমদ শরীফের বেলায়ও অনুরূপ ইতিহাস স্থাপিত হয়েছিল। মাত্র গতবছর সংঘটিত একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুঘটনার পরবর্তী ক্রিয়াদিতেও আমরা একটি নীরব বিপ্লব দেখেছিলাম, এই ঢাকায়ই। নারীনেত্রী নাসরীন হকের জানাজায়। তাঁর বেলায় জানাজা হয়েছিল ইসলামি কেতায়, কিন্তু একই জানাজায় পুরুষের পাশাপাশি অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও। বাংলাদেশে এরকম ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলা জানা যায় না। ওয়াহিদুল হকের কোনো জানাজাই হয় নি, যেমন হয় নি আহমদ শরীফের বেলায়। মৃতের শিয়রে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভিনদেশী ভাষায় পারাপারের মন্ত্রপাঠের জন্যে কাউকেই ওখানে ডাকা হয় নি। তার বদলে একের পর এক নিবেদন করা হয়েছে তাঁর প্রিয় যত রবীন্দ্রসংগীত, জাতীয়সংগীত তক এবং কবিতা। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রানুরাগী সংগীতান্তঃপ্রাণ-- একাধারে শিল্পী, শিক্ষক, পরিচালক এবং বিশেষজ্ঞ। তাঁর শবদেহকে ঘিরে এই আয়োজন কাজেই যথোপযুক্ত। তাঁর আত্মা (যদি থেকে থাকে কোথাও) এতেই শান্তি পেয়েছে, ধারণা করি। বিষয়টি এদেশের প্রেক্ষিতে অনেক বড়ো করে দেখবার ও দেখাবার আছে। এ কারণে যে, হাইব্রিড কায়দায় ধর্মান্ধতার বিষ অজস্রাজস্র মানুষকে আক্রান্ত করলেও এদেশে এখনো এরকম মানুষ অনেক আছেন, যাঁরা ধর্মাচারের চেয়ে বড়ো করে জাতিত্বকে দেখেন, দেখে স্বস্তি পান এবং তাকে উচ্চে তুলে ধরেন। বারডেমের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সামনে, ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে, শহীদ মিনারে, প্রেসক্লাবে এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত শোকসভাসমূহে-- সেসব মুখেরই দেখা মিলেছে। এঁরাই একদিন ধর্মীয় মৌলবাদকে ঠেকাবে। ধর্মান্ধতার বিকাশের বিরুদ্ধে এঁরাই সেই শক্ত দেয়াল। বাহ্যিক সাম্প্রদায়িক রূপচেহারাধারী এদেশ যে আদৌ সাম্প্রদায়িকতাসর্বস্ব নয়, এ ঘটনা তারই সাক্ষ্য হয়ে রইল।

আমরা যারা নতুনতর, তারা আজকাল রবীন্দ্রনাথকে পড়া-শোনা-দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি অথবা কখনোই আমরা চেষ্টা করি নি আমূল রবীন্দ্রনাথকে জানবার-বুঝবার-- প্রগতিবাদিতার আমাদের নানাবিধ ভান আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কর্মকে চর্চা, আমরা জানি, শেষ বয়সেও তিনি ছাড়েন নি। যতদিন গেছে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তিনি আরো বেশি করে আসক্ত হয়েছেন। তাঁর যে জীবনদৃষ্টি তার অনেকটাই রবীন্দ্রনাথ-উৎসারিত, অনেকে বলেন। রবীন্দ্রনাথের গানকে, গানের মহিমাকে সকল প্রাণে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টার তাঁর অন্ত ছিল না। ছায়ানটের অন্যতম কাণ্ডারি তিনি ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকের রবীন্দ্রবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে অন্য অনেকের সঙ্গে যে লড়াই করেছিলেন, সে লড়াই রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীতের শুদ্ধতার প্রশ্নে, কাজী নজরুল ইসলামকে অবিকৃতভাবে চর্চার প্রশ্নে, বাঙালি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে তিনি জারি রেখেছিলেন আমরণ।

রবীন্দ্রনাথের গান শুদ্ধ করে তিনি নিজে গাইতেন যেমন, চাইতেন অন্য সকলেও তাই করুক। ছায়ানটের মাধ্যমে তো বটেই, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের মাধ্যমেও এই শুদ্ধতার মন্ত্র তিনি ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন দেশময়। আজ জয়পুরহাট তো কাল তিনি ফরিদপুরে, পরশু কুমিল্লায় তো তরশু ময়মনসিংহে। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও তিনি কারো আহ্বান ফেলেন নি কখনো। যেখানেই সম্ভাবনাময় সংগীতানুরাগী পেয়েছেন, সেখানেই তাকে হাত ধরে দীক্ষা দিয়েছেন শুদ্ধতার অভিযানে। এ প্রসঙ্গে তাঁর প্রতি একটি নিন্দাপ্রস্তাব উত্থাপনেরও সুযোগ আছে। সেটি এই যে, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কর্মাদর্শ বিষয়ে তিনি বরাবরই খুব গোঁড়া ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলা ও ভাবাদর্শের কোনো ধরনের নেতিবাচক মূল্যায়ন তিনি একদমই বরদাশত করতেন না বা করতে পারতেন না। কারো কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের নির্দিষ্ট স্বরলিপি অনুযায়ী সুর-তাল-লয়ের কোনো খেলাপ হলে, গায়কীতে অর্থানুগ প্রাণ প্রতিষ্ঠা না পেলে কখনোই তাকে ছেড়ে কথা বলতেন না তিনি। আমাদের চারপাশের প্রতিজন মানুষ আলাদা সময়সংস্কৃতি ও পরিপার্শ্বে বেড়ে ওঠেন। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় তাই মানুষে মানুষে বিশেষ ফারাক থাকে। জনে জনে এজন্য রুচি, বিবেচনা ও সৃজনাভীষ্টও আলাদা। সুতরাং এটি ভাবা একান্তই গোঁড়ামি যে, সবাই বিনাপ্রশ্নে সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে যথাযথভাবে নিতে পারবেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নে সবাই তাঁর মতো করে ভাববেন এটা আশা করা অসঙ্গত। কিন্তু তিনি, ওয়াহিদুল হক, সারাজীবন ধরে রবীন্দ্রনাথকে চর্চা করে, সবটা বুঝে বা না বুঝে, তাঁর জানাটাকেই প্রকৃত জানা ভেবে, সর্বদাই একটি অধিকার বোধ থেকে কথা বলতেন। তর্কে-বিতর্কে কারো মন্তব্য তাঁর থেকে অন্যরকম হলে সবার সামনে না হোক আলাদা ডেকে নিয়ে হলেও তিনি এ মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করতে ছাড়তেন না যে, কতটুকু পড়েছ-শুনেছ তুমি তাঁকে (রবীন্দ্রনাথকে)?

সারাদেশে বিভিন্ন বয়েসি যে হাজার হাজার শিষ্যসাবুদ ও ছাত্রছাত্রী রয়ে গেছে তাঁর, তাদের মাধ্যমে তিনি অনেকদিন বাঁচবেন। বাঁচবেন ছায়ানট দিয়ে, বাঁচবেন কণ্ঠশীলন, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ব্রতচারী সমিতি, নালন্দা, শিশুতীর্থ, আনন্দধ্বনি, প্রভৃতি সংগঠন দিয়ে। সংগঠন গড়া ও নিবিড় পরিচর্যা দিয়ে তাকে স্বাস্থ্যবান করে তোলার অসাধারণ এক গুণপনা ছিল তাঁর। আর এর মূল লক্ষ্যই ছিল শুদ্ধ মানুষ গড়া। সে চেষ্টা যে তাঁর বৃথা যায় নি, বাঙালি সংস্কৃতি আন্দোলনে ওয়াহিদুল হক সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের তাৎপর্যপূর্ণ অব্যাহত কর্মকাণ্ডই তার সাক্ষ্য দেয়।

নগরজীবনের খাঁচায় বদ্ধ বাঙালি এতদিনে ভুলে যেতে পারত তার সংস্কৃতির অনেককিছুই। এই মহানের কর্মকাণ্ড অতটা ব্যাপ্ত না হলে পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের অবশ্য আয়োজন, বসন্ত উৎসব, বর্ষা উৎসব ইত্যাদি থেকে শুরু করে রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পর্যন্ত যাবতীয় আয়োজনের কী হতো কে জানে! এখানে তাঁর সহকর্মী অন্য কাণ্ডারিদের মোটেই খাটো করে দেখা হচ্ছে না, তাঁরাও সমানভাবে স্মরিত-বরিত। তবে ওয়াহিদুল হকের যুক্ততা এসব কর্মকাণ্ডে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে, সন্দেহ নেই। নাগরিক বাঙালিকে বাংলার রূপ-রস-গন্ধ উপহার দিয়ে তিনি বাঙালিত্বকেই বড়ো করে তুলে ধরতে চেয়েছেন সবার ওপরে। বাঙালি যে সংস্কৃতিহীন দীনমাত্র নয়, তার মূল যে ছড়িয়ে আছে এ ভূমির অনেক গভীরে, তাই যেন প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করে যাচ্ছে এসব কাণ্ডকীর্তি।

আমরা সবাই জানি, মুক্তিযুদ্ধে কালচারাল ফ্রন্টের সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের অন্যতম তিনি। একাত্তরে সেই যে তিনি শত্রু চিনেছিলেন, তাদের আর কখনো মিত্র বলে জানেন নি। চিনতে ভুল করেন নি নব্য শত্রুদেরও। এদের বিরুদ্ধে অক্লান্ত যুদ্ধ করে গেছেন লেখায়-বলায়। যাকে শত্রু বলে জানতেন, তার/তাদের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই খুব কঠোর থেকেছেন। লক্ষণীয় যে, সাংবাদিক-কলামিস্ট ওয়াহিদুল হকের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু যে বা যারা ছিল, আমরা দেখেছি, তারা অতি প্রায়শই দেশ ও দশের শত্রু। অর্থাৎ তাঁর এই কলমযুদ্ধ নিছক মনের ঝাল মেটানো ছিল না, ছিল দেশের জন্য লড়াই।

ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষে তাঁর অবস্থানে তিনি বরাবরই অটল ছিলেন। দেশের যেকোনো স্থানে যখনই কোনো সাম্প্রদায়িক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে কোনো সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ, অচিরেই তিনি তার প্রতিকারের পথ খুঁজেছেন, কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন, অন্যদের সাথে সে স্থানে গিয়ে নির্যাতিতের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এটি কম বড়ো কথা নয়! বিভিন্ন সময়ে এদেশে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে, অমানুষদের সেসব নিন্দনীয় কর্মকে ঠেকাবার জন্যে একদল মানুষ যদি সর্বদাই সক্রিয় না থাকত, তাহলে ধারণা করি, এতদিনে মুসলমানের বাইরে অন্য কোনো জাতি-ধর্মের মানুষ এদেশে নির্বীজ হয়ে যেতে পারত। ভাগ্যিস তাঁরা ছিলেন। আজও তাঁরা আছেন। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একজন ওয়াহিদুল হকের মৃত্যুতে ওই দলের একজন মানুষ মাত্র কমে গেলেন। তাঁর গড়ে তোলা শুদ্ধ-আধাশুদ্ধ-ঊনশুদ্ধ মানুষের সবাই ওই মানবিকজনদের সারিতে যুক্ত হয়ে অমানুষদের কর্মকাণ্ড ঠেকাতে আরো বড়ো দেয়াল গড়ে তুললে গুরু ওয়াহিদুল হকের প্রতি তাদের যথাশ্রদ্ধাই প্রকাশ পাবে বলে মনে করি।

থিয়েটারওয়ালায় মুদ্রিত

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...