Sunday, August 16, 2009

মৃত্যুর আগে : জীবন খুঁজিয়া ফেরে জীবনের তল

আরো অনেক পরে জীবনানন্দ দাশ ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতায় যে বোধের প্রকাশ করেছিলেন ‘মানুষ মরে গেলে তবুও মানব থেকে যায়’, ধূসর পাণ্ডুলিপির ‘মৃত্যুর আগে’ শেষ হয়েছে মূলত সেই খবর দিয়ে। সবকিছু ফুরিয়ে যাবে কিন্তু রয়ে যাবে মানুষ... তার জন্যে আলোও রয়ে যাবে। রোদকে যদি জীবন বলে ধরে নিই আমাদের, তাদের জন্যে স্থির আলো আছে জীবনধারণের : যা কখনোই যাবে না নিভে।

‘মৃত্যুর আগে’ কাজেই নিশ্চিত মৃত্যুর ভীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখায়। মায়া বেড়ে যায় দেখা সব ছবির প্রতি। যেগুলো আবারও দেখার মতো, বারেবারে যে সৌন্দর্য ছুঁয়ে দেবার মতো। ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়ে রবীন্দ্রনাথ বইটিতে মুদ্রিত ১৭টি কবিতা ব্যাপারে সাধারণ যে মন্তব্য করেছিলেন তার দু’টো ব্যাপ্তিসম্পন্ন শব্দ বা শব্দবন্ধ কারো নজর এড়িয়ে যায় না : ‘চিত্ররূপময়’তা ও ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি এ বইতে।

দূর থেকে কবিতাটির দিকে যদি তাকানো যায় তবে মনে হবে বিশাল এক আটচল্লিশ কুঠুরীর আটতলা, প্রায় সমান খাপে যার শরীর বাঁধা। বাইশ থাম প্রতিটায় বলা যেত, কিন্তু নিচের দিকের তিন অষ্টাংশে শক্তি বাড়িয়ে নিতে প্রতিটিতে ছাব্বিশ থাম-- অথচ অদ্ভুত এই, এ স্থাপত্যে যাহা শেষে নির্মিত তাহাই মূল, যাকে বলে ফাউন্ডেশন-- ইটের তৈরি ভবনের থেকে এর পার্থক্যটা ঠিক এ জায়গায় নির্দিষ্ট।

দ্বিতীয় পাঠ

ইহা কবিতা, ইহা খাপে পুষে রাখে জীবনের গল্পসমুদয়...
ইহা কল্যাণী, আনন্দ-অদ্ভুত রঙে পুড়ে পুড়ে
সংশয়ায়িত স্তব্ধ-ঘুমে
গানেদের দেশে দেশে নির্জলে ওঠে বিকশিয়া

তাকিয়ে দেখার আনন্দ বলে একে
ভরা বাট যেন কোনো ঘোড়দৌড় মাঠ
টইটম্বুর রসে ভরা চিত্রে বিচিত্র
যাতে মাখা আছে রাশি রাশি কল্পব্যঞ্জন

এ-ও তো রূপময় বিদ্যুৎ
ঝিলিকে ঝিলিকে শুধু ঝিলকায়ে চলা
গোটা ঝিলপারে মহাধুম
জ্যোৎস্নায় সবুজের গোধুমের বনে...
ধূসর আজ ধূসরিম আরো ফিকে কুয়াশায়
কলকল গ্লানির জলধি

প্রাণ তবু গতিমান

স্থাপত্যিক নকশা করেও যদি কাজটি শুরু করা হয়ে থাকে (যদিও কবিতা কখনো এইভাবে শুরু হয় না) তবে তাতে থাম বা ইটের ব্যবহার হবার কথা ছিল (২২x৪৮)=১০৫৬টি। কিন্তু ব্যবহৃত হয়েছে সর্বমোট ১০৬৮টি। এরকম হয়েছে তিনটি কুঠুরিতে ৪টি করে ইট বেশি ব্যবহৃত হওয়ায়। এর কারণ আমরা চিহ্নিত করতে পারি কম করেও দুটো। ১. বাইশ ইটে কুঠুরি তিনটি নির্মাণে নির্মাতার অক্ষমতা। ২. কোনো সূক্ষ্ম অর্জনকে সম্ভব করতে নিজের পরিকল্পনাকে অবলীলায় ভেঙে ফেলা।

প্রথমোক্ত সম্ভাবনাটিকে আমরা শুরুতেই বাতিল করে দেব। যার শক্তিমত্তার সামনে আমরা প্রতি-মুহূর্তে থমকে দাঁড়াই; বিস্ময়াঘাতে হই ক্ষতবিক্ষত; তাকে অক্ষম বলে খাটো করাটা ঔদ্ধত্যের শামিল।

স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া তিনটি অবস্থাকে এবার একটু কাছ থেকে নিরিখ যাক--
১. যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল
২. পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর
৩. ধূসর মৃত্যুর মুখ ;-- একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো-- সোনা ছিলো যাহা
তৃতীয় পাঠ

জীবনানন্দের পাঠকমাত্র বুঝবেন যে, এই তিনটি কুঠুরিই ২২ ইটের ব্যবহারে নির্মাণ করা যেত ; এবং তা জীবনানন্দীয় ঢঙ বজায় রেখেই। আর এটা করার যৌক্তিকতাটাও সহজানুমেয়।

আটচল্লিশজনের কাতারে তিনজন বেয়াড়াকে কে আর সুচোখে দেখে। তাহলে? এই স্খলনের ব্যাপারটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় বা করা উচিত? তবে কি সত্যিই আটতলা এই ভবনের নিচের দিককার তিনতলার বিশেষভাবে নির্মিত কুঠুরিত্রয় আলাদা কোনো ব্যঞ্জনা ধারণ করে রেখেছে?

উপরদিককার পাঁচতলায় এত সরলভাবে ইট বিছানো হয়েছে যে, সাধারণ একজন আবাসিকের পক্ষেও তার গতি প্রকৃতি বোঝা সম্ভব। কিন্তু নিম্নদিকের তিনতলা, যে তিনটিতে তিনটি বিশেষ কুঠুরি সন্নিবেশিত, সেখানকার ইটের শয্যা অতটা সবুজ সহজ নয়; যেকোনো চোখের-দেখার হাত সেই মায়াবীর প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে জানবে না। উত্তর খুঁজবে, কিন্তু পাবে না। তখন তাকে নিরুত্তরেই খুঁজে নিতে হবে শান্তি।

মৃত্যুর ঠিক আগে মুমূর্ষু, মৃতপ্রায়, মরমর একটা অবস্থা থাকলেও বস্তুতপক্ষে জীবনই থাকে। জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’র ও আ-পাদ (উড়ে গেছে কাক) মস্তক (আমরা হেঁটেছি যারা) চিত্রময় জীবন। এবং তা স্তব্ধ নয়, স্থির নয়-- অস্থির এবং গতিশীল। চঞ্চল। যেন জীবন খুঁজিয়া ফেরে জীবনের তল। এমনকি বাস্তবত যার প্রাণ নেই-- তার ভেতরেও এখানে প্রাণানুভূতি বাঙ্ময় হয়ে আছে।
১. ... যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ...
...মাঠ, চাঁদ কারোরই তো আমরা প্রাণ জানি না কিন্তু এ বাক্য প্রাণ দিয়েছে দুয়েরেই।
২. খড়ের চালের’ পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার ;--
কার? তা আমরা জানতে চাই না। আমরা বরং দিব্যানুমান করি যে ইহা খড়ের চালেরই ডানা।
৩. হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা
--কে ভাবতে পারে যে এখানে আলোও জীবন্ত নয়?
৪. চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দুবেলা--
--কী বিস্ময়কর প্রাণই না ঝলকাচ্ছে এখানে জলতরঙ্গে; এবং তার সাথে সাথে চালে, যার গন্ধ (তাও আবার ধূসর, গন্ধেরও বর্ণ বিভাজন জীবনান্দকে ছাড়া কে কবে করেছে এমন?) জলকে তরঙ্গায়িত করে দিনে দু’বেলা।
৫. মিনারের মতো মেঘ সোনালী চিলেরে তার জানালায় ডাকে--
--মেঘ যেখানে বিশেষ্য, ক্রিয়া সেখানে ডাক; অথচ এ বজ্রপাতরূপী হুঙ্কার নয়, ভালোবাসার ইশারা-- যা কেবল প্রাণেই শোভন।
৬. নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বারবার তীরটিরে মাখে
অথবা
নির্জন মাঠের ভীড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে ;
--যেখানে কোনো জনই নেই, সেখানে কেমন দেখাও হচ্ছে মাখাও হচ্ছে। যেন কোনো টিনেজারের প্রসাধনপর্ব। অদ্ভুত সব প্রাণময়তা, অপ্রাণে।

চতুর্থ পাঠ

এটি যদি একটি নির্মাণ, ভবন বা বাড়ি যাই বলি, তবে তার নিচের তিন অষ্টাংশের আঠারোটি কক্ষ দখলে রেখেছে বাড়িওয়ালা, যেখানে গোটা ভবনের সব মেইন সুইচ-- তা সে পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ যা কিছুরই হোক। উপরের পাঁচতলার ত্রিশটি কক্ষে নীরিহ ভদ্রলোক ভাড়াটিয়ারা থাকে। সবার উপরে চিলেকোঠা মতো একটা জায়গা, যা ভবনটির অতি নির্মাণ, অন্য দশটি বাড়ির ভিড়ে আলাদা হবার চিহ্ন; যাকে কখনো আলাদা একটি তলা হিসেবে গণ্যই করা যায় না-- ঠিক সেখানেই চুপিসারে বাস করে মৃত্যু, ম্রিয়মাণ অতি। যার চোখ ও মুখের আকৃতি দেখেই বোঝা যায়-- এ তল্লাটে সে বেশ সুবিধে করতে পারছে না। এখানের ভাড়াটিয়ারা যতটা জীবনবাদী তাতে মৃত্যুর চিলেকোঠাবাস বন্ধই হয়ে যেত-- যদি না বাড়িওয়ালার ছেলেপুলেদের সাথে তার অল্পবিস্তর বন্ধুত্ব থাকত।

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...