Sunday, August 16, 2009

জীবনানন্দের পাঠকপ্রিয়তা প্রসঙ্গে

সময়ের সবাইকে ছাড়িয়ে জীবনানন্দ দাশের যে চূড়াস্পর্শী উত্থান আজ পাঠকমাত্রেরই কাছে স্বীকৃত, সেটা নিজের করে পাওয়া তাঁর জন্যে মোটেই অনায়াসসাধ্য ছিল না বলে মনে করি। অপরিমেয় প্রতিভার রোশনাই ঝলকিত তিনি এমন একজন সৃজনকর্মী, যাঁর হৃদয়ে কল্পনা এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা ছিল এবং তার পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে বয়ে আসা সভ্যতার যাবতীয় সুনন্দনপ্রভা আর তার সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ সাহায্য করেছিল। এর মাধ্যমে যে ধন তিনি আহরণ করেছিলেন তা অবশ্যই শ্রমলব্ধ। কারণ বিগত শতাব্দীর কিংবা সমসময়ের বিশুদ্ধ কাব্যবিকীরণ দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত হতে গেলে উচ্চতর বিচারবোধ-সম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী কারো যে শ্রম সন্নিপাত করতে হয়, তা যেকোনো রকম শ্রমধারণার সাহায্যে ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। অবশ্য এই অব্যাখ্যাত শ্রমযোগ হলে যে-কেউই যে তা পারবে না, তা-ও তো উল্লিখিত আছে তাঁর সুবিখ্যাত প্রবন্ধ ‘কবিতার কথা’তেই। সেজন্য হৃদয়ে থাকতে হবে কল্পনা আর কল্পনার ভিতরে গিয়ে ছাপ ফেলতে হবে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তার। কেবল খটখটে চিন্তার ব্যায়াম কবিতা নয়, জীবনানন্দ তা-ও পরিষ্কার করেই বলে রেখেছেন।

সেটা ছিল এমন এক সময়, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশাল এক মহীরুহের ন্যায় প্রতিভাত হচ্ছিল তরুণ-অতরুণ উভয়তের কাছেই। বিশ্বজয়ী এই রবীমহানের ছায়ায় কোনো প্রশান্তি ছিল না, এটা এখনকার প্রেক্ষিতে যেমন সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় নি; পায় নি তখনো। কিন্তু রবীন্দ্রসাহিত্যের অতলান্তিক বোধোৎসারী বিশালায়তনের যে প্রবাহস্রোত, তার থেকে বাইরে এসে আরো আরো নতুন স্রোতোপথ তখন আবিষ্কৃত হওয়ার দরকার ছিল। কেবলি একমুখে প্রবাহিত হওয়া, একই পথে বারবার, জলের যেমন ধর্ম নয়; নতুন করে কিছু যাঁরা সৃজন করতে আসেন, নয় তাদেরও। নতুন যা আসে, আসে ঝড়ের মতোই। দুমড়ে মুচড়ে দিতে আসে সবকিছুকে। যা অগ্রহণযোগ্য তা তো বটেই, যা গ্রহণযোগ্য তারও গায়ে তখন লেগে যায় এমন কিছু ঝাঁকি; মনে হতে পারে যে এ বুঝি বিশালের প্রতিও এক অশ্রদ্ধা বা অবমাননা। কিন্তু যিনি বিশাল তিনি তাঁর স্ববিশালতা দিয়েই বুঝতে সক্ষম হন যে, এ এমনই এক সত্য, যা তাঁর নিজের জন্যে আপাত অশনিমতো বোধ হলেও, প্রার্থিত এবং ইতিবাচক। নতুনের বচনাচারে যে চমক থাকতে পারে, তাকে তো রবীন্দ্রভাবনাও নবতর প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ফলে তাঁর জন্যে তখন যা করবার ছিল, তা হলো এই নতুনতরদের স্বাগত জানানো এবং নিজের সৃজনক্ষমতার প্রকাশ যথারীতি অব্যাহত রাখা। মহত্তম রবীন্দ্রনাথ তাই করেছেন। সবসময় যে নতুনের সবটাকেই গ্রহণ করেছেন এমন নয়। তেমনটা না-হওয়াই যৌক্তিক।

যাঁরা এলেন নবরূপে, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই কম বেশি সশ্রদ্ধ ছিলেন বিশাল এই মহীরুহের প্রতি। কেউ কেউ একাধটু ইয়ে ধরনের ছিলেন বৈকি! যাঁরা নিজেরা এখন ক্রমশই মলিনতার দিকে ধাবিত। কী নির্মম এক সত্য এ! অথচ বিস্ময়কর মনে হয় যে, যিনি আজ কবিতাপাঠক মাত্রেরই কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রতি সেই জীবনানন্দের শ্রদ্ধার গভীরতা ছিল অন্যদের চেয়ে কিছুমাত্রায় বেশি। স্বতন্ত্র একটা জগৎ গড়বার পাশাপাশি তিনি এই প্রবীণ বটবৃক্ষকে খুব যত্নের সাথেই নিরিখ করছিলেন। তাঁকে নিয়ে লিখছিলেন একের পর এক রচনা। ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে তাঁর রয়েছে ছয়-ছয়টি কবিতা এবং তিন-তিনটি প্রবন্ধ। সংখ্যাটা অনেকের কাছে বেশ বাড়াবাড়ি রকমেরও মনে হতে পারে। কিন্তু এই-ই ছিল সত্য, যেখানে নতুন ও আধুনিকদের প্রধান চেষ্টাটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের ছায়াপ্রভাব থেকে বাইরে বের হয়ে আসা এবং প্রাণভরে শ্বাস নেয়া, নতুন পথ নির্মাণ করা। কিন্তু নতুন পথ নির্মাণ করতে হবে বলেই পুরানো পথ-মাত্রকেই ঘৃণায়-উপেক্ষায় সর্বদা এড়িয়ে যেতে হবে, স্পষ্টতই এর কোনো মানে নেই। খুঁজে পান নি জীবনানন্দ দাশও। নিজের পথ নিজে ঠিকই গড়ে নিচ্ছিলেন এবং পুরানো পথের দিকে তাকিয়েও দেখছিলেন কেমনভাবে সেই এগিয়ে যাওয়া। কেমন সেসব একেকটা চারু-পদচ্ছাপ। কারণ তাঁর নতুন পথের শেষ, আকাশমুখী কোনো অনির্দিষ্ট গন্তব্যে তিনি খুঁজতে চান নি। রবীন্দ্রনাথ নামটিকে আলো-করা যে কাব্যবিকীরণ, নিজে বেড়ে ওঠবার জন্যে তার নৈকট্যও অত্যাবশ্যক জ্ঞান করেছিলেন তিনি। ক্রমশ মানবান্তকরণের সেই যে গভীর থেকে গভীরতর দেশে জীবনানন্দের ক্রমপ্রবেশপ্রেষণা সে কি কোনোভাবে রবীন্দ্রনাথের থেকেই খুঁজে পাওয়া? কবিতা, রবীন্দ্রনাথের, আজো পঠিত হয়। যদিও তাঁর কবিতার পাঠক ক্রমহ্রাসমান অবশ্যই। দূরত্ব তাঁর সঙ্গে আমাদের নানাভাবেই বাড়ছে বৈকি। কিন্তু তবু, তাঁকে, এখনো পাঠকপ্রিয় না-বলে রক্ষে তো নেই। জীবনানন্দের পাঠক ক্রমবর্ধমান। আজ অবস্থাটি এরকম একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, কারো মালিকানায় তাঁর সমগ্র বা সংগ্রহ জাতীয় কিছু না-থাকা লজ্জারই ব্যাপার বলে মনে করা হয়। একজন কারো কবিতা এতবেশি সংখ্যক পাঠক পড়েন, এটা বুঝি এই উত্তর-আধুনিককালে জীবনানন্দই প্রমাণ করলেন। কী দুর্দান্তরকম জনপ্রিয়তা তাঁর, উচ্চতর-নিম্নতর সবরকম কবিতা-পাঠকের কাছে!

সুধীন দত্তকে এখন ক’জন পড়েন, আর ক’জন জীবনানন্দকে? এ সংক্রান্ত একটি তুলনায় গেলে বিশাল এক ফারাক পরিলক্ষিত হবে-- এটা আমরা জানি। সুধীন্দ্রনাথ ভালো কবি নন, এটা প্রমাণ করবার জন্যে আমরা এখানে প্রয়াস করছি না। তাঁর অতি অল্পসংখ্যক নেতিবোধ-জর্জরিত দুর্ভেদ্য-দুর্গ-সদৃশ কবিতার বিরুদ্ধে সমকালে যে কাঠিন্যের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, আজ তাঁকে সেভাবে দেখবার অবকাশ অনেকটাই কমে গেছে। পরবর্তী সময়ে আমরা নতুনতর আরো দুর্ভেদ্য কবিতাকে ভেদ করবার প্রয়াস করে করে এমনতর অভিজ্ঞ হয়েছি যে, ওগুলোকে এখন আহামরিরকম প্রস্তর-কঠিন আর বোধ হয় না। কিন্তু কথা সেখানেও নয়, আমরা বলতে চাই যে মানবান্তকরণের যে জায়গাটি স্পর্শ করলে পাঠকের মনোপরিসরে প্রায় চিরস্থায়ী একটি জায়গা তৈরি হয়ে যায়-- সে স্থানটিকে নিশ্চয়ই সুধীন্দ্রনাথের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ বেশি করে চিনতে পেরেছিলেন। এই যে আত্মীয়তা, এটিকে শনাক্তকরণের জন্যে আমাদের তাকাতে হবে সে কোন সম-সাধারণ গুণপনার দিকে, যা আমরা সুধীন্দ্রনাথ দত্তে বা বুদ্ধদেব বসুতে বা বিষ্ণু দেতে বা অমিয় চক্রবর্তীতে পাই না? আজ এমন একটি প্রশ্নের জায়গায় উপনীত না-হয়ে আমাদের আর চলছে না। আমরা যাঁরা আরো আরো নতুন পথ খুঁজে হন্যে হচ্ছি সামনে এগোবো বলে, এ মিলনবিন্দুটি চেনা থাকলে তা কথিত ওই পথসন্ধানীদের জন্যেই মঙ্গলকর হবে না শুধু, হবে আগামী সময়ের কবিতা-পাঠক এবং কবিতারও। কিন্তু কে এই ভারতীয় কাব্যবেদনের আকুপাংচার-সদৃশ প্রকৃত মৌলবিন্দুটিকে চিহ্নিত করে দেবেন, যে-বিন্দুটিতে নিহিত আছে প্রবলভাবে জনপ্রিয় হবার কারণসমুদয়; যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে আগামী সময়ের কাব্যকার্যমালা? একজন কেউ অন্তত যদি মন থেকে বলতেন যে ‘আমি’, বড়ো আশান্বিত হওয়া যেত।

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...