Sunday, August 16, 2009

ছোটতুচ্ছ প্রেমগুলো বড়োর বেদনা

আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাব দুটোই করতে পারি
দুঃস্বপ্নের পিচুটি পরিষ্কার আর তৃষ্ণা মেটাবার জন্যে
ব্যবহার করতে পারি জল দু’রকমভাবে-- শোক ও শান্তিতে
ব্যবহার করতে পারি মদ দু’রকমভাবে-- আমি

আমি মানুষ একজন, ফাল্গুনী রায়
প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু আমি লিখি। আমাকে মানে আমার জীবন ও পরিপার্শ্বকে। তোমাকে মানে তোমার জীবন ও পরিপার্শ্বকে। তাকে মানে তার জীবন ও পরিপার্শ্বকে। অর্থাৎ কি না আমার-তোমার ও তার আনন্দ-হতাশা-বিষাদ এবং সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের স্বপ্নমালা, সৌন্দর্যকে আমি যেমনভাবে বুঝি, তেমন শৈলীপ্রণোদনার সযত্ন-প্রলেপ দিয়ে আবছা করে জাগিয়ে তুলি। আমাদের বেঁচে থাকাকে, বেঁচে থাকার সংগ্রামকে আমি মনের আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে যাই। ছুঁয়ে আনন্দ পাই। আপন বোধ করি। এই আমি-তুমি ও তারা মিলিয়ে ছোট ছোট যাদেরকে আমি লিখি, এদের বাইরে যারা থাকে তারা বড়ো। শ্রেণিগতভাবে তারা আমার স্বগোত্রীয় নয়। এদের আনন্দ-হতাশা-বিষাদ বা স্বপ্ন আমার লেখার ছাঁচে এঁটে ওঠে না কিংবা এঁটে ওঠার মতো হলেও আমার অক্ষমতা বা অনাগ্রহের কারণে আঁটানো হয়ে ওঠে না। তারা দৃশ্যত ও অদৃশ্যত আমার পর। জাগ্রত অবস্থায় পর, এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায়ও। তারা আমার দুঃখ বোঝে না বা আনন্দ। আমার অভিমান বোঝে না বা অবসাদ। আমার যৌনতা বোঝে না বা শৃঙ্গারলিপি। এমন না-বোঝাবুঝির মনোদূরত্বে তারা যতই দামি কার্পেট পেতে রাখুক তাদের দুয়ারে যেতে আমি ভরসা পাই না। যতই পিঠ চাপড়ে দিক আহ্লাদে গদগদ হয়ে বর্তে যাই না। সেটা পারি না কারণ সন্দেহ আমার পিছু ছাড়ে না। আশংকা হয়, পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে একসময় ওরা হাত মারবে আমার মধ্যপ্রদেশে। শ্রেণিআক্রোশে গালিয়ে দিবে আমার অণ্ডকোষজোড়া। তাই আমি শত্রুজ্ঞানে ওদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকি। থেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

তো, এই আমার দাঁড়াবার বা বসবার জায়গা কই ? ছোটদের আঙিনা। এই আঙিনার ডালিমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে বা পিঁড়ি পেতে বসে মনোহর্ষে ভালো লাগা কথা বলে সময় পার করে দেয়ায় স্বস্তি আছে। দীর্ঘদিনের চেনাপরিচয় থেকে জেনেছি-বুঝেছি যে এরা আমাকে বসিয়ে রেখে অযথা বগল চুলকায় না কিংবা আমি ওদের। এরা আধাকথা মুখে থাকতে থাকতে মুখ বন্ধ করে দেয় না কিংবা আমি ওদের। শ্রেণিগতভাবে আমরা এক বলে এরা সবিশেষ আমাকে আপন ভাবে, আমিও ওদের। এরা আমাকে আমার মতো করে মূল্য দেয়, সম্মান করে, আমিও ওদের। ছোটদের এ’পাড়ায় এরকম জামাই আদরে ডাগর হতে হতে আমি ও’পাড়ার বড়োদের হেয়জ্ঞান করতে শিখে গেছি। ওরা আমার নাম কেটে দিলে আমার একটা পশমও কাঁপে না। ওরা আমার এদিক-ওদিক বিচরণের ইতিহাস ইরেজ করে দিলেও আমি নেই হয়ে যাই না। ওরা আমার এপিটাফ রচনা করে ফেললেও আদপে আমি মরে যাই না। আমার এই সহ্যক্ষমতাকে ওরা হয়ত ডরায় অথবা ডরায় না। আমার এই টিকে থাকার শক্তিকে ওরা হয়ত সম্মান করে অথবা করে না। আমার পত্রপুষ্পবিকাশ ওরা হয়ত তাকিয়ে দেখে অথবা দেখে না। তবে আমার বর্ধনকে অতিবর্ধন, আমার বলনকে অতিবলন, আমার নির্মাণকে অতিনির্মাণ বলে ওরা হামেশাই গাল পাড়ে। এসব অভিধা মুখস্থ করিয়ে ওরা পাছে ফেউ লাগিয়ে দেয়। আমি শব্দ করে হাসি। হেসে হারানো স্বাস্থ্য উদ্ধার করি।

আমি আমার মতো করে লিখে যাই। লিখতেই থাকি ঘোরের মধ্যে থেকে। স্বজনের গতিবিধিকে সন্দেহ না করে। কিন্তু দিন সবসময় একরকম করে যায় না কারো। দেখি, ছোটদের আঙিনাও আর ছোটদের থাকছে না। পুঁজির আগ্রাসনে ফুলেফেঁপে উঠছে। কাত হয়ে যাচ্ছে বড়োদের দিকে। আঙিনায় বাড়ছে ক্রমশ বড়োদের আনাগোনা। এসব দৃশ্যে অস্বস্তি হতে থাকে। কষ্টে আরো মগ্ন হয়ে যাই। কিছুদিন চোখবন্ধ করে থেকে আবার তাকাই। প্রলয় বন্ধ হয় না। দেখি, মোহের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সব ছোটদের ঘর। বড়ো হবার কাতর স্বপ্ন তাদের চোখেমুখে। অন্তত বড়োবাড়ির সিঁড়ি বাওয়ার শখ, আমূল অন্তঃকরণে। ধামা ধরার প্রাণান্ত চেষ্টা। মনোকষ্টে পালান দিয়ে হাঁটি। দেখি, ছোটদের ভেষজ উদ্যান জুড়ে বড়োদের অ্যাকেশিয়া-ইউক্যালিপটাসের চাষ। দেখি, আঙিনায় ধরে না সাইজের বড়ো এক পালের গোদাকে বাইরে থেকে আমন্ত্রণ করে এনে ওরা সিংহাসনে বসাচ্ছে। তার উপরে ছিটিয়ে দিচ্ছে বাংলার সমস্ত সুগন্ধি ফুল। বাদন সহযোগে নিবেদন করা হচ্ছে স্বভাষার সমুদয় বামপন্থী বিশেষণ। অসবর্ণ সম্পর্কের ওটা জের।

বাণিজ্যএষণা তাদের বড়ো হয়ে ওঠে। ছোটত্বের লেবাসে ওদের আর আনন্দ হয় না। তাই বড়োর পায়ের নিচে সহসা আছড়ে পড়ে। লোল ঝরায়। আমার চোখ এ-ও দেখে যে, বড়োর অট্টালিকাপাশে রাতারাতি ছোটচালা গড়ে উঠছে। যেটা বড়ো ঘরের ছোটঘর, কোনাকাঞ্চিতে। কুলির পানি মুখে নিয়ে বড়োবাড়ি থেকে লোকজন নেমে এসে ফেলছে ওখানে। চালাঘর থেকেও যায় কেউ কেউ। চা-পান খায়, গলা খাঁকারি দেয়, হাগুমুতু করে। দু’য়ে মিলে প্রকৃতই যারা ছোট, তাদের পাছামারার ফন্দিফিকির করে। তালেলয়ে মিলে গেলে মারেও সারেগামা সুর তুলে। আসলে জাত মারে। জাত মেরে নববৈশাখে পান্তা খাওয়ার মতো আনন্দ হয় ওদের। আবার এ-ও দেখি, জাতে ছোট কিন্তু বড়োর মতো কেরদানি করে। চলন-বলনগুলো শিখে নেয় বড়োদের থেকে। ফতোয়ার দোকানদারি শুরু করে। বলে, এভাবে বাঁচা অশৈল্পিক কিংবা ওভাবে মরা। বলে, গজ-ফিতা দিয়ে মেপে লিখে নিয়ে আস কিছু গোবরগোল ফিকশন। আহারে অপ্রতিষ্ঠান! মুক্তহাওয়ার সংকট সম্ভাবনায় ভেন্টিলেশনহীন দালানে ঢুকি না। আর আঙিনায় এসে দেখি, পাইপ দিয়ে মাপা বাতাস আসছে দালানের ভিতর থেকে। দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। নিঃশব্দ আর্তনাদ করতে করতে ফিরে আসি নিজস্ব তাঁবুতে।

চিরকাল তাঁবুবাসী আমি, যাযাবর। বসাবসি যত পরের চালার নিচে। কী হবে এবার, ভেবে, জনাকয় মিলে নিজেরাই খাটিয়ে নেই চালা। দারুণ খায়েশে। চার রাতের অধিক জমে না সহবাস। আমার বিরুদ্ধে ওরা পরকীয়ার অভিযোগ তুলে চালা থেকে মাঝরাতে বের করে দেয়। আমি রিঅ্যাক্ট করি। বলি যে, কী করে ফেরত পাব সঞ্চিত ভালোবাসাটুকু ? মুখ ঝামটা মারে রোষে নিজকিয়া। আত্মকলহ ভেবে রণেভঙ্গ দেই। শেষে নাকমুখ বাঁধা লালচোখ কিছু অবদমিত মানুষের সাথে ওরা মজমা জমায়। গানবাজনা করে। আঙিনার আলোয় না দ্বাররুদ্ধ ঘরে। বাইরে কোনো আওয়াজ আসে না। দিনকয় বাদে দেখা যায়, ওরা উন্নতি করেছে। থানইটের জন্ম দিয়েছে এক অশেষ কোশেশে। যাতে গতি নেই, স্থির। এরপর থেকে দেখা-কথা সবই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মড়া সম্পর্কের মুখাগ্নি করে আবার ফিরে আসি সরল তাঁবুয়।

মাঝে মাঝে পথে বেরোই আজো। আলপথ ধরে হাঁটি। আঙিনাওয়ালা ছোট ছোট চালা খুঁজি খেতখামারের পাশে। কখনো চালারাই আমাকে হাত-ইশারা করে ডাকে। আমি সাড়া দেই, বসি। শেয়ার করে বিড়ি খাই। তখন আমার এমন আনন্দ লাগে যে মনে হয় একা হয়ে যাই নি এখনো। তুচ্ছের তুচ্ছ হাঁচি-কাশিকে প্রশ্রয় দেবার মতো তুচ্ছাধার এ জগৎ নিত্যই জন্মিয়ে চলেছে। আমি তো এদেরই ভাই-বেরাদর। কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ। কাঁচা বা পাকা। কিন্তু আমার বহুগামী পুরুষস্বভাব! এ স্বভাব লুকিয়ে রেখে একগামিতার পোশাক পরে ভান-কসরৎ করাটা তো আমারে সাজে না। খুঁজে খুঁজে ফাঁকা স্থানে সহসা আঁচল ধরি গতিপত্রের। বিপুলা বাতাস। পরকীয়ায় মজে যাই তার। চুটিয়ে নতুন লিখি। পুরানোকে করি নতুন করে। করে করে আবিষ্কারানন্দে আমি অঘুমা হয়ে যাই। দেখি অন্য আরেক মজা, তুলতুলে। এখানে শ্বাস-প্রশ্বাস এত মুক্ত যে মাঝে মাঝে ধুলোবালি ঢুকে যায় নাকে, জীবাণুও। কিছুই ভাবি না আমি এতে। জানি যে বাতাসের সাথে কিছু ধুলোময়লা বিল্টইন থাকে।

ছোট ছোট চালা আর আঙিনার প্রেম নিয়ে নাকেমুখে ধুলোর উৎপাত সয়েই আমি যথেচ্ছ বেঁচে যেতে চাই। জানি রে, আমার জীবন যাবে এ হেন তুচ্ছপ্রেমে!

ধানমণ্ডি, ৩ ডিসেম্বর ২০০৭

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...