Sunday, August 16, 2009

পেকে ওঠা বিষফোঁড়ায় কণ্টকাঘাত : কিছু পুঁজ, কিছু দুর্গন্ধ

বিনয়ভূষণ আর নয়

মানুষ হিসেবে যিনি বেশ বিনয়ী ও সজ্জন-- এই সমাজব্যবস্থায় হঠাৎ করেই তিনি নিজেকে বড়ো ধরনের সমস্যাগ্রস্ত বলে আবিষ্কার করে বসতে পারেন। তখন যারা তাকে এতদিন বিনয়ী বলে প্রশংসা করেছিলেন, তাদেরকেই সমস্ত সর্বনাশের মূল বলে মনে হতে পারে। এসব ইতিউতি প্রশংসার প্রভাবে মানুষের ক্ষেত্রে বিনয় একটি বিরল গুণ মনে করে বেচারা বিনয়ীরা অস্ত্রহীন ঢুকে পড়েন শ্বাপদসংকুল জনারণ্যে। পরে তিনি বুঝতে পারেন, বাহ্য বেশভূষায় একটু আলাদাত্ব থাকলেও ‘জন’ ও ‘শ্বাপদ’ অনেক সময়ই প্রায় অবিকল গুণপনা রাখে; কথা বলে, হাগে-মুতে একই কায়দায়। বানরদেরও যে ময়ুরপুচ্ছ থাকতে পারে, ভালো মানুষ হয়ে সেটা সবসময় বুঝতে পারা যায় না বস্তুত।

এ প্রজাতির বানরেরা, সুযোগ পেলেই জনের ছদ্মাবরণে নিকটে এসে দশাসই পোদ মেরে ফার্লংখানি দূরে দাঁড়িয়ে যেভাবে দাঁত কেলায়, তাতে পোদাঞ্চল প্রতিরোধে সবিশেষ ব্যবস্থা সম্পন্ন করে অস্ত্রভাণ্ডারকে সহজোন্মোচনযোগ্য উপায়ে ঢেকে সদাপ্রস্তুত হয়ে থাকা ছাড়া বেচারা বিনয়ীদের এখন আর কোনো গত্যন্তর নেই-প্রায়। প্রয়োজন হলেই যাতে জিপার টেনে পোদাভীপ্সায় কাতরদের চোখমুখ লক্ষ্য করে জোরসে মুতে নষ্টজলের বান নামিয়ে দেয়া যায়, সেরকম রেডিমেড ব্যবস্থা সম্পন্ন করে রাখাটাই এখন জরুরি। নইলে এ ভবসংসার বেচারাদের কাছে অসহনীয়রকম তিক্ত অভিজ্ঞতায় দীর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

ছোটোকাগজ বিক্রির পয়সা ঠকান যেসব পুস্তক ব্যবসায়ী প্রকৃতপক্ষে তারা সাহিত্যের শত্রু। মনে রাখা জরুরি যে, সাহিত্যকে ভালোবেসে তারা এ ব্যবসায় আসেন নি, তারা এমনকি জুত বুঝলে চামড়ার ব্যবসাও করবেন। লেখকদের মধ্যেও এরকম গোবেচারা আছেন, থাকেন। পুরানো খোলস ঝেড়ে তাদের এখন নতুন করে জেগে ওঠবার কাল আসন্ন। এ না-হলে লেখালেখি করতে এসে নিজে তো বটেই বাপদাদা চৌদ্দগোষ্ঠীসহ ভুল করেছে-- এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে খাতা-কলমের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে এফডিসিতে গিয়ে এক্সট্রা হবার জন্য চেষ্টা করাটাই তাদের শেষোদ্ধারের একমাত্র পথ হয়ে যেতে পারে। যে লেখালেখির জন্য সমতল ও সহজহাঁট্য বহু রাস্তা রেখে বেচারা দীর্ঘদিন বন্ধুর পথে পদচারণা করেছে, যার জন্য নিজের ও নিকটজনের কাড়ি কাড়ি বঞ্চনাকে মাথা পেতে নিতে হয়েছে, তাকে পরিত্যাগ করে কেনই বা একজন হাতে পেরেক ঠুকতে যাবে? পর্বতচূড়ায় উঠে আকাশ না-ছুঁয়ে একজন নামবে কেন-- ও স্থান তো কারো বাপের একার নয়! কেউ কেউ অবশ্য সব স্থানকেই নিজের বা তার বাপের বলে মনে করে। পা ফাঁক করে বেদখল দিয়ে রাখে অন্যের হাঁটবার সমস্ত পথ, কিংবা গোপনে পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখে।

সাহেব কহেন...

বাংলাদেশে যৌনকর্মীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন আছে, আছে ভিখিরির-- নেই কেবল লেখকের। সেজন্য যারা সাহিত্যের খেদমত করে খান-দান, তারা বনে গেছেন দেবতাস্য দেবতা। তাদের যখন যা ইচ্ছে, তারা তা-ই করেন। করেন, করতে পারেন বলেই। ট্রেড ইউনিয়ন না-থাকলে কারখানাভ্যন্তরে শ্রমিকগণ যেভাবে মালিক-কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ব্যবহৃত হতে বাধ্য হন, লেখদের শক্তসমর্থ মেরুদণ্ড কিংবা ঐক্য কিংবা আন্দোলন কোনোটাই না-থাকায় তারাও দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক ও তথাকথিত ছোটোকাগজের সম্পাদক কর্তৃক যখন-তখন যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহৃত হন। কোনো কোনো লেখকের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় যে এভাবে ব্যবহৃত হতে পারায় তারা বরং পুলকই অনুভব করেন। যেন ব্যবহৃত হবার জন্যেই তাদের জন্ম ও যাত্রা। যেন চোখেমুখে মোসাহেবি একটা ভাব ঝুলিয়ে দেহরক্ষীর মতো সর্বক্ষণ সাহিত্য সম্পাদকের লেজে ঝুলে থাকাটাই লেখক জীবনের চরম ও পরম সার্থকতা।

এবার একটু খুলে দেখি চলুন

অনেক আগে (৩০ মে ১৯৯৭) লেখা চেয়ে দ্রোণাচার্য সম্পাদকের পাঠানো এক চিঠির জবাবে একটি কবিতার খসড়া করেছিলাম, শেষপর্যন্ত সেটি ডাকে দেয়া হয় নি। পরবর্তী সময়েও কোনো কাগজে ওটি ছাপার কথা ভাবি নি। লেখাটি লিখতে পেরেই মনের ঝাল অনেকখানি মিটে গিয়েছিল। সুতরাং চুপ মেরে গিয়েছিলাম। ঘন ঘন যখন একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে এবং যখন এ বিষয় নিয়ে একটি লেখা লিখব বলেই মনস্থির করেছি, তখন মনে হচ্ছে চলতি প্রেক্ষিতের সাথে সম্পর্কসূত্র বিবেচনা করে ওই লেখাটিকে এখানে অস্ত্র হিসেবে ছুড়ে দেয়াও যেতে পারে।
একটি ঠোঁটকাটা কবিতা কিংবা শিমুল আজাদের কাছে খোলা চিঠি

শিমুল আজাদ আপনাকে জবাবি লিখছি
শিমুল আজাদ আপনাকে কুশল জানাচ্ছি
শিমুল আজাদ দ্রোনাচার্যে লেখা পাঠাচ্ছি

শিমুল
আজাদ
লেখালেখিতে আপনার চরিত্র কী
দ্রোনাচার্যের উদ্দেশ্য কী
রক্তাক্ত প্রজন্মের মেনিফেস্টোটা কী
এসব আমাদের
(আমার
অন্যদের
দ্রোনাচার্যের লেখকদের...)
জানা থাকা দরকার
জানাবেন

দ্রোণাচার্য আমার ভালো লাগে না
--উহা লাল কালিতে ছাপা হয়
--উহা বিজ্ঞাপনের ব্যবসা করে
--উহা বাজারিদের লেখা ছাপে
(আশিক-মোস্তাক-শুভঙ্কর এরা কী ভাবেন)

শিমুল
আজাদ
আপনি গ্রাফিত্তিতে যান আবার টিভিতেও
আপনি লিটল ম্যাগে যান আবার দৈনিকেও
আপনি টুপি পরেন আবার পৈতাও

যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা আপনি
যেদিকে স্বার্থ সেদিকে ঝোল আপনি
যেদিকে প্রসাদ সেদিকে পুরোহিত আপনি
আপনার কাগজে আমি পুষ্পিত হতে চাই না

আপনি বিবরের লেখা নিয়ে দ্রোনাচার্যে ছাপেন
লেখকগণ তা জানেন না
আপনি দ্রোণাচার্যকে প্রজন্মের মুখপত্র বানান
লেখকগণ তা জানেন না
আপনি লেখকগণকে ব্যবহার করেন
তারা তা জানেন না

আমি নিয়মিত লিখে থাকি
তবু দ্রোণাচার্যের জন্য আমার কোনো লেখা নেই
আমার প্রচুর অপ্রকাশিত লেখা আছে
তবু দ্রোণাচার্যের জন্য আমার কোনো লেখা নেই
অপ্রকাশের ভার আমি সইতে পারি না
তবু দ্রোণাচার্যের জন্য আমার কোনো লেখা নেই

আমাকে মাফ করবেন আর এ কবিতাটা দ্রোণাচার্যে ছাপবেন
আমাকে মাফ করবেন আর এ কবিতাটা দ্রোণাচার্যে ছাপবেন

লক্ষ করুন

লেখাটির যেখানে যেখানে শিমুল আজাদ নামটি আছে সেখানে সেখানে শহিদুল ইসলাম কিংবা শামীম রেজা কিংবা জামিল আকতার বীনু কিংবা অন্য কোনো নাম এবং যেখানে যেখানে দ্রোণাচার্য আছে সেখানে সেখানে দৈনিক যুগান্তরের শুক্রবারের সাময়িকী কিংবা দৈনিক আজকের কাগজের সুবর্ণরেখা কিংবা কথকতা কিংবা অন্য কোনো পত্রিকার নাম পড়লে প্রতিক্ষেত্রেই এটি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। এই লেখাটির প্রাসঙ্গিকতাকে আমরা উসকে দিতে চাই দিকে দিকে, আমাদের এবং অন্যদের জন্য।

নিজের দিকে ঝোল টানা

মানুষের জীবনটা হলো ক্রমশুদ্ধাভিযান। যারা গোড়া মতাদর্শ নিয়ে বিশুদ্ধ ছোটোকাগজের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে লেখালেখি শুরু করেছেন এবং সময়-সুযোগে ফাল দিয়ে বড়োকাগজের ডালে ডালে বাদুড় হয়ে ঝুলে পড়েছেন, তাদের থেকে কারো কারো গমনপথটা ঠিক বিপরীত দিকে প্রসারিত। এরা যেখান থেকে চ্যুত হয়েছেন, অন্য একজন সেখানে আসীন হবার চেষ্টাটাই চালিয়ে যেতে পারেন দেহেমনে। একের পরিত্যক্তটা অন্যের কাম্য হতেও পারে। এখানে কোনো অপমান লুকিয়ে আছে মনে করার কারণ নেই। এটা মনে হয় শুদ্ধাশুদ্ধি ধারণায় পার্থক্যের কারণে। আমাদের এবং আমাদের যৎপরোনাস্তি লেখালেখির জন্য স্বল্পায়োজনের এ দীর্ঘ যাত্রাপথটিই যথোপযুক্ত ও সঠিক। আপাতক্ষুদ্র এ টেকসই পথপরিসরে ব্যাপক স্বাধীনৌজ্জ্বল্য জ্বলজ্বলায়মান। নির্মোহতায় ব্যাপ্ত যে শুদ্ধিসম্ভাবনা, মোহগ্রস্ততায় হতে পারে তার বিপুল বিনাশ।

যারা দমবন্ধকর বিশাল প্রান্তর থেকে শ্বাসস্বস্তিপ্রদ ছোট্ট আঙিনায় এসে দাঁড়ান বা দাঁড়াতে চান, যারা ঝকমারির বিপরীতে ভালোবেসে সৃষ্টি করে নেন স্বয়ম্ভূ আড়াল-- উভয় মতাদর্শীয়রাই তাদেরকে জানতে-বুঝতে বরাবর ভুল করেন। তারা প্রায়শই অন্যদের স্বজন হিসেবে পরিগণিত হন না কিংবা অন্যরা তাদের, যদিও একই ধরনের চাষবাসে নিমগ্ন বলে আনেকের সাথেই মোলাকাত হয় পথেপ্রান্তরে। সমসময়ের লেখক হয়েও অন্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হয় যে কারণে টক-ঝাল-মিষ্টি, ‘পথে হলো দেখা’ জাতীয়।

অভিজ্ঞতা, আতংক এবং সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ

একজন নিষ্কলূষ কিশোরীকে পতিতা বানাবার জন্য আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘৃণ্যপ্রয়াস যেরকম বিরামহীন, মুক্তবাণিজ্যের যুগে সবাইকে বাজারি লেখক বানাবার জন্যও কতিপয় সম্পাদকের সেরকম চেষ্টার কমতি নেই, লক্ষ করি। পূর্বাদর্শচ্যুতদেরও গোপনে এতে ইন্ধন ও সহযোগিতা থাকে। কে না জানে এসব অন্যায়। নারীর অধিকার যেমন মানবাধিকার, লেখকাধিকারও তেমনি। অথচ অনেক লেখকই সে অধিকার লঙ্ঘনের শিকার। এখন এসব অধিকারলঙ্ঘনৈতিহ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোটা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেটা এজন্যে যে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করবার মানসিকতাসম্পন্ন সম্পাদকের চ্যালারা এরপর এমনকি নিজেরাই একখানা যাচ্ছেতাই লেখা লিখে অন্য কারো নামে ছাপিয়ে রাখবে বাজারমাৎ কোনো কাগজে। পাঠকগণ একদিন হয়ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করবেন যে গল্পকার সেলিম মোরশেদ কিংবা কাজল শাহনেওয়াজ কিংবা তপন বড়ুয়া কিংবা কামরুল হুদা পথিক কিংবা সরকার আশরাফ কিংবা রোকন রহমান কিংবা রবিউল করিম কিংবা শেখ লুৎফরের নামে কোনো গল্প অথবা ফারুক সিদ্দিকী কিংবা শোয়েব শাহরিয়ার কিংবা আহমাদ মিনহাজের নামে কোনো প্রবন্ধ হাজারটা ভুল বাক্যে সমাচ্ছন্ন হয়ে আজকের কাগজের অপরিচ্ছন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে ফুটে রয়েছে। অথবা হয়ত দেখা যাবে যে শান্তনু চৌধুরী কিংবা স্বদেশ বন্ধু সরকার কিংবা শোয়েব শাদাব কিংবা বিষ্ণু বিশ্বাস কিংবা শরিফ শাহরিয়ার কিংবা আহমেদ নকীব কিংবা শাহেদ শাফায়েত কিংবা ঈশান জয়দ্রথ কিংবা আশিক আকবর কিংবা মজনু শাহ কিংবা মোস্তাক আহমাদ দীন কিংবা জ্যাকি ইসলাম কিংবা মাসুদ আশরাফ কিংবা সুহৃদ শহীদুল্লাহর নামে কোনো কবিতামতো লেখা আনন্দ নগর, একদিন প্রতিদিন, ইসলাম ও জীবন এবং অজস্র বিজ্ঞাপনে ল্যাপ্টানো যুগান্তর সাময়িকীতে মুদ্রণপ্রমাদসহ শোভা পাচ্ছে। এমনকি এ-ও অবিশ্বাস্য নয় যে এরা প্রয়াত কবি সাবদার সিদ্দিকী কিংবা শামীম কবীরের ভাবমূর্তিকেও বাজারকাষ্ঠে বলি দিয়ে বসতে পারেন। এ আতংক এখন রাত পোহাতে একবার, দিন ফুরাতে আরেকবার জাগে। কারণ উল্লিখিতগণ শ্রেণীতে সংখ্যালঘু। বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিতে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বসেছে বলেই এ ভীতিটা এখন বেশি করে পাত্তা পাচ্ছে।

লেখকের অনুমোদন ব্যতিরেকে তার কোনো রচনা ছেপে দেবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদটা এখন আমরা লিখেই জানাচ্ছি, পরে প্রয়োজনে চিৎকার করে জানাব। এ ইস্যুতে সমর্থন থাকলে অন্যেরাও আমাদের এ চ্যাঁচনযজ্ঞে শামিল হবেন, না থাকলে হবেন না। সেক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প নীতিপন্থা ‘একলা চলো রে’।

আরো একটি গণবেদনা

কাগজের নাম উত্তরপুরুষ। সম্পাদক হামিদ রায়হান। জানুয়ারি ২০০২-এ প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছে। প্রত্যেকেই মানবেন যে শুধু কবিতা বিষয়ক গদ্য কাগজের বিশেষ প্রয়োজন আছে, যেরকম কাগজের সংখ্যা আমাদের দেশে শূন্যের কোঠায় পরিগণিত। কবিতা বিষয়ক গদ্যের কাগজ করবার কথা নিজে অনেক ভেবেছি, করতে পারি নি। শেষপর্যন্ত অন্যের হাতে যদিও বা হলো-- আশান্বিত হবার কোনো কারণ ঘটে নি। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, এ কাগজটি কোনো জাতেই পড়ে না।

এটি বাদ দিয়ে কাগজটিতে কোনো শিক্ষণীয় ছিল না যে, কোনো আলোচনায় লেখকের বিনানুমতিতে তার কোনো রচনা অংশত বা সম্পূর্ণত উদ্ধৃত করার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা জরুরি। যারা বইয়ে এরকম ঘোষণা যুক্ত করে দেন তারা ভালোই করেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতাটি এক্ষেত্রে খুব তিক্ত।

উত্তরপুরুষ-এ মুদ্রিত একটি লেখায় আমার রূপকথা নামধেয় একটি কবিতা অংশত উদ্ধৃত হয়েছে (কবিতা-- প্রসঙ্গ কিংবা অনুষঙ্গ, সমকালীন কিংবা দূরকালীন : মাহবুব হাসান), যে কবিতাটি আমার সবেধন গ্রন্থ মমি উপত্যকাভুক্ত। কবিতাটির ওপর ওখানে কী মন্তব্য করা হয়েছে, সে ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। আমার বলার হলো এই যে, ওই উদ্ধৃতাংশের প্রশ্রয়ে ব্যাপক প্রমাদ সংঘটনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কবিতা রূপকথাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়েছে, যে অধিকার কোনো সম্পাদকের থাকতে নেই। উদ্ধৃতিতে কবিতার পঙক্তি ও স্পেসবিন্যাসেও সম্পাদক বেশ সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছেন। প্রমাদ সংঘটনের মাধ্যমে ‘ঘুমমত্ত’কে ‘ঘুমন্ত’ বললে না হয় অর্থগত কোনো বিভ্রাট ঘটে না কিন্তু যদি ‘ঘাসস্থান’কে ‘বাসস্থান’, ‘শুলে’কে ‘শুনে’ এবং ‘রোদন’কে ‘রোপন’ (আসলে হবে রোপণ) লেখা হয়, তখন সে কবিতায় কিছুই থাকে না বস্তুত। বরং কবি শুদ্ধ বাক্য রচনা করতে পারেন কি না এ নিয়েই সংশয় তৈরি হয়। এসবের ভিতর দিয়ে বুঝে-না-বুঝে লেখকের বিশেষ ক্ষতি করা হয় বলেই আমাদের মনে হয়।

মুদ্রিত হবার পর প্রমাদের আধিক্য দেখে কাগজ সামনে নিয়ে কেঁদে ফেলবার ইচ্ছা আমার মতো আরো অনেক লেখকেরই জেগেছে-- আমি জানি। ছররা গুলির মাধ্যমে নির্বিচারে পাখিহত্যা করে শিকারির যেরকম আনন্দ, লেখকদের এভাবে যন্ত্রণা দিয়ে কোনো কোনো সম্পাদক সেরকম আহ্লাদই বোধ করেন মনে হয়। বিপরীতে লেখকগণ কষ্টে জর্জরিত হয়ে গোপনে কাঁইকুঁই করেন। গোপনে করেন এজন্যে যে সমাজে তাদের সাপোর্ট নেই-প্রায়, তারা অনেকের চোখেই না-জাত, কুত্তার বাচ্চা আর সম্পাদকরা তাদের মা-বাপ। এ অবস্থা ঘুচানো যেতে পারে কেবল লেখকদের মধ্যে কোনো চলমান আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা গেলে। প্রয়োজনই যেকোনো আবিষ্কারের নেপথ্য সূচনাবিন্দু। প্রয়োজন যখন দেখা দিয়েছে, আজ-কাল-পরশু সেটা হবে আশা করি।

এ ধরনের ঘটনার শিকার আমরা হামেশাই হই। এখানে ভূতপূর্ব গুণধরের মতো ‘এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না, এবারই প্রথম তুমি’ বলবার কোনোই জো নেই। যে কারণে কোথাও কোনো প্রান্তরে পুষ্পিত হবার অফার এলেই আগে জেনে বুঝে দেখা দরকার-- প্রান্তরটা কেমন প্রশস্ত ও খোলামেলা, মাটিটা কেমন ধাঁচের, চাষীরা কেমন, কেন্দ্রীয় চাষী বপনপ্রণালি ঠিক বোঝে কি না ইত্যাদি। এ তো গেল স্বেচ্ছায় নিজের লেখা ছাপতে দেবার পূর্ব বিবেচনা কিন্তু কেউ কারো লেখা ভুলভাবে উদ্ধৃত করলে সেটা ঠেকানো কী করে? এখানে তো কাগজ সম্পর্কে প্রাক জরিপের কোনো অবকাশই থাকে না। সম্পাদকগণ কি এক্ষেত্রে লেখকদেরকে কোর্টাভিমুখে চালিত করতে চান নাকি? কপিরাইট আইন বলে কি এদেশে কিছুই নেই?

সিকদার আমিনুল হককে একটি উপদেশ

যে কাগজ ভাষার শুদ্ধ ও সঠিক প্রয়োগের ব্যাপারে নিজেরাই শ্রদ্ধাশীল নয় এবং অতি প্রায়শই যেখানে ভুল বাক্যের দেখা মেলে-- সেখানে অন্য কারো লেখা বাক্য ভুল প্রমাণ করতে যাওয়ার ফল হিতে বিপরীত হয়।

শিঁরদাড়ার প্রথম সংখ্যায় মুদ্রিত

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...