Tuesday, October 26, 2010

এক যাত্রা একুশ বন্দরে

একুশজন কবির একুশটি কবিতা পড়ে, কবিনামহীন, রীতিমতো ফাঁপরে পড়ে গেছি যেন। আমরা সাধারণত কপালে কবিনামের তিলক পরেই কবিতা পড়ে অভ্যস্ত। সে অভ্যস্ততাটা একটু ঝাঁকি খায় নাম জানা না-থাকলে। অবশ্য এটা না-মেনে উপায় নেই যে, নামপ্রভাবটা পাঠ ও মূল্যায়নের ওপরে যে শাসন জারি রাখে, এ প্রক্রিয়ায় সেটা কাটিয়ে ওঠবার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। চিন্তাটা যে আমার কাছে পুরোপুরি নতুন, তা নয়। আমরা কজন একবার এরকম করে ভেবেছিলাম, ছিয়ানব্বইয়ে। শতাব্দী কাদেরের সম্পাদনায় ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘বিবিধ’-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় কবিনাম ব্যতিরেকে বেশ কয়েকজনের কবিতা ছাপা হয়েছিল, সম্পাদকীয় আভাসসহ। ভাবা ও বলা হয়েছিল যে, পত্রালাপের মাধ্যমে লেখাগুলো সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া প্রাপ্ত হওয়া যাবে তা কবিনামসহ পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হবে। যাতে নামপ্রভাবের ঊর্ধ্বে খাঁটি মতটুকু, প্রতিটি লেখার, হাজির করা যায়। কিন্তু প্রকল্পটা উৎসাহ ও প্রশ্রয় যতটা পেয়েছিল, নিরুৎসাহ ও নিন্দা পেয়েছিল তার চেয়ে ঢের বেশি। তীব্র আক্রমণের মুখেও পড়তে হয়েছিল, মুদ্রিত বর্ষীয়ানদের দ্বারা। তাছাড়া, চিঠিপত্রের ওপরে যতটা ভরসা করা গিয়েছিল, ততটা আশ্বস্ত করে নি তা। জেলাপর্যায়েও ততদিনে পত্রপ্রথায় ভাটা পড়তে লেগেছে। ‘বিবিধ’-এর ওই উদ্যোগেও কাজেই তখনই ভাটা পড়ে। ওর শেষকৃত্যও আর সম্পন্ন করা যায় নি। ‘গোলাঘর’-এর এ সংক্রান্ত আয়োজন সে বিবেচনায় অনেক পরিণত ও স্বস্তিদায়ক। অনিশ্চিত আশ্বাস না-দিয়ে নগদানগদি একটা সংগঠিত মত কবিতাগুলোর সঙ্গে হাজির করবার চেষ্টা আছে এখানে। তদুপরি, আলোচক হিসেবে আমার এই কবিতাগুলো নামহীন পড়তে হলেও পাঠক ও লেখকগণ এখানে নামসহই লেখাগুলো পড়তে পারবেন। তত্ত্বীয়ভাবে তাই ব্যাপারটা আমার কাছে মোটের ওপর মন-সহনীয়। 

কিন্তু ব্যবহারিকভাবে দেখলে এ আয়োজনের মন্দ দিকও শনাক্ত করা যায়। প্রথমত, কবিতাগুলো সম্পর্কে এতে মাত্র একজন পাঠকের বিবেচনারই প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে, যা হাজির করা হবে একটা প্রতিনিধিত্বশীল মত হিসেবে, সম্ভাব্য মতের মেধাগত খামতিটুকুসহ। এক অর্থে এটা উন্মুক্তভাবে কবিতাগুলো উপভোগে বৃহত্তর পাঠকের সামনে একটা বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে; এমনকি কারো কারো বিরক্তিও উৎপাদন করতে পারে। অন্য অর্থে, এটা মোটেই কোনো সমস্যা নয়, বরং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখাগুলোর মেরিট যাচাই করবার ব্যাপারে পাঠকদের এটি প্রণোদিতও করতে পারে। সেটা কবিতাগুলোর জন্যেই ভালো। তাছাড়া, শিল্পমত বস্তুতপক্ষে ব্যক্তিকই হয়। নির্দ্বিধায় এরকম ব্যক্তিক মতপ্রকাশের পক্ষে দাঁড়ানো যায়। কেবল এ কিস্তির আয়োজনে আমার যা একটু সংশয় থেকে যাচ্ছে, সেটা নিজে মতপ্রদানকারীর দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বলে। দুজন হলে কী হতো, তিনজন? দেখা যেত যে, মতগুলো বদলে যাচ্ছে, জনে জনে। এর চেয়ে বেশি সংখ্যক হলেও বদলাতো নিশ্চিত। এই বদলটাই সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যের। প্রতি ক্ষেত্রেই মতপ্রদানকারীর জানাবোঝা, বিষয় সম্পর্কে দখল, শিল্পবস্তু আস্বাদনের (এখানে কবিতা পড়বার) পূর্ব অভিজ্ঞতা, দেখবার ও বলবার দক্ষতা, প্রকাশকৌশল ইত্যাদি একটা বিশেষ মতের জন্ম দিতে পারত, যেটা অতি অবশ্যই হতো অন্যটি থেকে আলাদা। ব্যাপারটা বেশ উত্তেজনাকর, সন্দেহ নেই। পাশাপাশি আমার পক্ষ থেকে উদ্বেগটা এখানে যে, যতই আমাকে কবিতাগুলো কবিনামহীন করে পড়তে দেয়া হোক না কেন, মতপ্রদানকারী হিসেবে আমার বেনামে কথা বলবার কোনো সুযোগ এখানে নেই! বেনামি আলোচকের মতগ্রহণ করবার মতো ঔদার্য্য শিল্পীমাত্রের না-ও থাকতে পারে। কাজেই, বক্তব্যের দায়টা মতপ্রদানকারী হিসেবে পুরোপুরি আমার কাঁধেই বর্তাবে। এটা একটা নিয়ন্ত্রণ কাঠি, নৈরাজ্য ঠেকাবার। যা খুশি বলবার কোনো সুযোগ এখানে নেই, বলবার দরকারও নেই অবশ্য।

তবু, এ ধরনের বিবেচনার অনেকেই বিরোধিতা করেন। তাঁরা মনে করেন, শিল্পকর্মের সঙ্গে শিল্পীকে (এখানে কবিতার সঙ্গে কবিকে) মিলিয়ে দেখলেই কেবল শিল্পবস্তুর প্রকৃত উৎকর্ষ/অপকর্ষ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। শিল্পীবিহীন শিল্পকর্ম যেহেতু অসম্ভব, কাজেই শিল্পীসম্পর্ক বিচ্যুত করে করা শিল্পালোচনাও সম্পূর্ণাঙ্গ নয়। লোকশিল্পকর্ম বিষয়ক আলোচনায় এ বিষয়ক অনুরক্তি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ধরা যাক কোনো একটা লোকগানের কথা, যার একক স্রষ্টার কথা জানা যায় না। এক্ষেত্রে গোটা একটা জনপদকে, তথা ওই নির্দিষ্ট জনপদের সকল মানুষকেই গানটির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ স্রষ্টা হিসেবে ভাবা হয়। এ মতের মোটকথা হলো স্রষ্টা একজন লাগবে, কাল্পনিক হলেও! নামপ্রভাবের সীমাবদ্ধতাসহই এ মত শিল্পকর্মকে দেখতে চায়। সেরকম করে দেখা অবশ্য মোটেই রহিত হচ্ছে না, একবার নামহীন করে দেখলেও। মুদ্রিত হবার পরে সে সুযোগটা অবারিতই থাকছে। তখনকার প্রেক্ষিতে, প্রথমবার মতপ্রদানকারী হিসেবে আমার বিবেচনাকে যাঁরা পুনর্বিবেচনা করবেন, তাঁদের ও আমার মধ্যকার সুবিধা-অসুবিধার পার্থক্যটা আমলে নেবার মতো। কারণ পরবর্তী বিবেচকগণ এটিসহ সকল লেখাকেই নামযুক্ত অবস্থায় পাবেন। এক্ষেত্রে তাঁদের মতের সাথে যুক্ত হবে লেখকদের নামের ওজন ও তাঁর তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক; নিদেনপক্ষে তাঁদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কিত অর্জিত ধারণা ও মিথ। ফলে তৈরি হবে প্রচুর ভিন্নমত। যদিও প্রতিবারই তা হবে ব্যক্তিরই মত। কিছু মত কিয়দংশে অন্যমতের কাছাকাছি হলেও তা সর্বক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরই মত। শিল্পবস্তুর গুণপনা মাপবার বাটখারা হিসেবে সংখ্যাগুরুর মতকে বিবেচনা করবার রেওয়াজ কোথাও নেই বলেই জানি। এটা মাপকাঠি হতে পারে মাত্র জনপ্রিয়তা মাপবার।  

এইসব ভেবে তাকিয়ে আছি সাদা স্ক্রিনের দিকে। এরকম পরিসরে, কী আমার লিখবার আছে কবিতাগুলো নিয়ে, যা পাঠযোগ্য! আমি কি মিশে যেতে পেরেছি এখানকার সব উচ্চারণের সাথে? আমি কি চিনেছি আলোচ্য কবিতাসমূহে অঙ্কিত সব পথঘাট? চিনি নি। আরো বারকয় হেঁটে এলেও ওপথ ধরে, হয়ত ঠিক পুরোটা চেনা হবে না, বলাই বাহুল্য। এজন্যেও উদাস এই  দৃষ্টিক্ষেপ, সম্ভবত। আবার এ-ও তো ঠিক যে, প্রথম যাত্রায়ই এখানকার কোনো কোনো পঙক্তির পাখসাটে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। ভেতর থেকে জেগে উঠেছে এক অসংজ্ঞায়িত ভালোলাগাবোধ। অচেনা সুন্দরীর প্রতি কি মুগ্ধতা জাগতে নেই? খুবই আছে। কিন্তু মুশকিল হলো, মুগ্ধতা মুগ্ধতাই, মুগ্ধতার প্রকাশ কখনো সমালোচনা নামধেয় নয়। এ খুবই যুক্তিনিরপেক্ষ। সমালোচনাকে হতে হয় যুক্তিপূর্ণ (এবং কমবেশি সর্বজনীন!)। তাছাড়া আমি মুগ্ধতা প্রকাশে নয়, সমালোচনার জন্যেই অনুরোধ্য। ‘ভালো লাগল’, ‘অসাধারণ’, ‘চমৎকার’-- এগুলো মুগ্ধতার ভাষা, সমালোচনার নয়। সমালোচনার প্রশ্নে ভালোলাগা-মন্দলাগাকে সংজ্ঞায়িত করতে হয়, যথাযথভাবে। অন্তত মুগ্ধতা কিংবা বিরক্তি কর্তৃক উৎপাদিত অনুভূতির দিকে তাক করা একটা ‘কেন?’ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে হয়। সন্দেহ নেই, কাজটা বিশেষভাবে কঠিন। পাশাপাশি এক্ষেত্রে নিজের অযোগ্যতাটাও একটা বড়ো বাধা। এটা লুকোবার কোনো সুযোগ নেই, কেননা এ স্বয়ম্প্রকাশিত। কাজেই নির্মোহ ভঙ্গিতে কবিতার সত্য খুঁজে, নিজের জানাবোঝা যদি কিছু থাকে তার সাপেক্ষে কবিতাগুলোর রঙরেখাবলি ও ইঙ্গিতের বোধসঞ্চারণ শক্তির মাত্রা নির্ণয় করে বোধগম্য ছবি আঁকবার প্রয়াস করাই মূল কাজ, এখানে। এ লক্ষ্যে কবিতাগুলোর ভিতর দিয়ে সংজ্ঞা-সন্ধানার্থে সংঘটিতব্য আমার পরবর্তী প্রব্রজ্যাগুলোর গুণ-মানই ঠিক করে দেবে আমার দেখন-লেখন-অঙ্কনের ভালোমন্দ। পাঠক ও লেখকদের মধ্যকার যাঁরা আখেরে আমার এই ইন্টারপ্রিটেশনকে নিতেই পারবেন না, তাঁদের কাছে দশাসই একটা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে কবিতাগুলোর চোখে চোখ রেখে বরং শুরুই করা যাক আমার ভাবনাচিন্তাকথার সংক্ষেপন--

১.
সন্ধ্যা ও রাতের মাঝখানে কী আর এমন ফারাক, সময়ের? বিকেল ও সন্ধ্যার মাঝখানটাকে আমরা গোধূলি বলে চিনি, কিন্তু সন্ধ্যা ও রাতের মাঝখানটা এতই অবিশেষ যে, একে আলাদাভাবে নামায়িত পর্যন্ত করা হয় নি বাংলা ভাষায়। তবে আরবি ভাষায় ‘এশা’ নামক একটা ক্ষণ আছে, যা দিয়ে রাত্রির প্রথমভাগকে বোঝায়। অর্থাৎ এশা হলো সন্ধ্যা ও রাতের মাঝখানকার সেই অসংজ্ঞায়িত ক্ষণ, যাকে এ লেখায় বিশেষায়িত করে তোলা হয়েছে। স্বল্পকাল ব্যাপ্ত এক একাকী বেদনার অনুভূতি গভীর মগ্নতার আশ্রয়ে ডালপালা মেলে শোক-শোক একটা বিস্তার আদায় করে নিয়েছে এখানে। এ লেখার মুখ শোকভারাতুর হয়েও অতিশয় দীপ্র, উজ্জ্বল। প্রায়ই চোখ কেড়ে নেয় ক্যামেরার উপযোগী অতি পরিচিত বস্তুগত উপাদান। তৎসত্ত্বেও, এখানে শাসন যদি কোনো কিছুর থেকে থাকে তো তা মনের, চোখের নয়। চোখ এখানে জন্ম দিয়ে গেছে কেবলই ভ্রম, যা কিনা প্রার্থিতই, কবিতায়। আর এ ভ্রমকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে শব্দ ও বাক্যে রচিত পরিবেশ, তার আনুকূল্য। 

২.
কবিতার বিষয় হিসেবে মৃত্যু, মৃত্যুসম্ভাবনা, মৃত্যুচিন্তা, মৃত্যুশোক প্রভৃতি যুগপৎ ক্লিশে ও চিরপ্রাসঙ্গিক। এই দোলাচলের মধ্যেও যুগে যুগে দেশে দেশে এই রঙে রেঙেছে সহস্র কবিতা, রাঙবে আরোও। প্রচুর সম্ভাবনা যুক্ত হয়েও প্রতিবারই এ বিষয়ক কবিতাকে হাঁটতে হয়েছে ও হয় ঝুঁকিসীমায় পা ফেলে-ফেলে। প্রতিদিন প্রাসঙ্গিক বলে প্রতিবারই তাকে গৎ-এর বাইরে নতুনভাবে মূর্ত হতে হয়, বলনকেতা ও শৈলীসৌকর্যে। হলুদ প্রেতছায়াকে এসব বিবেচনায় ঝুঁকি-সন্নিহিত কেবল হা-হুতাশই মনে হতে পারত, যদি না মৃত্যুসন্ধিক্ষণে চিরপথিকের প্রতি জীবিতদের নিষ্ঠুর আচরণের চিরন্তনতাটা এখানে অঙ্কিত হতো। এই বিশেষ কারণে রচনাটি কিছু স্পর্শকাতরতা ধরলেও সামগ্রিক কথাবস্ত্রের মলিনতা একে উজ্জ্বল রচনা হয়ে ওঠবার অবকাশ দেয় নি।

৩.
আপাতসরল, কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে এক বন্ধুর পথে যাত্রা করতে হয় দ্বন্দ্ব-এর পাঠককে। বাঘ ও হরিণের চিরবৈরী একটা সম্পর্কের ফাঁদ পাতা এ ভুবনে ক্ষণে ক্ষণেই বড়ো বড়ো খাদের সামনে গিয়ে দুশ্চিন্তিত হয়ে দাঁড়াতে হয়, যে খাদগুলো হয়ত প্রাকৃতিক (স্বতঃস্ফূর্ত) নয়, বানানো। একটা বিভ্রমে ঠেলে দেবার আনন্দ থেকে উৎসারিত কূটস্পৃহাজাত। প্রথমে মনে হয় লম্ফযোগ্য নৈকট্য আছে, কিন্তু পরক্ষণে বোঝা যায় যে, তা নয়। অথচ লক্ষণীয় যে, একটি খাদ থেকে অন্য খাদের দূরত্ব ঘিরে রচিত যে পথ (বাক্য), তার প্রায় প্রতিটিই সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সুমিত স্বভাব। যেজন্য এই প্রায়অবোধ্য ভ্রমণাভিজ্ঞতা নিয়েও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে এর দিকে কাতর অভিব্যক্তিসহ তাকিয়ে থাকাতেও যেন একটা সুখ-সুখ অনুভূতি হয়।

৪.
একদা প্রাণচঞ্চল অধুনা উজাড় হয়ে যাওয়া একটা বসতবাড়ির এক/দুই পুরুষ দীর্ঘ একটি গল্পের আনুপূর্বিক বয়ান ধৃত হয়েছে শূন্য ভিটেয়। খাঁ-খাঁ সেই শূন্যতাকে যে ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে, তা ক্লিশে ও গাদ্যিক। শব্দের অমিতব্যয়-প্রবণতাকে এখানে মাঝেমধ্যেই দাঁত বের করে হাসতে দেখা যায়! এ লেখা না-বলা দিয়ে প্রায় কিছুই বোঝাতে চায় না, যে কারণে শব্দের অধিক কোনো শব্দহীনতা কিংবা নৈঃশব্দ্য এর ভিতরবাড়ি তো দূর অস্ত বাহির বাড়িতেও স্থান পায় নি। কষ্ট বলে কষ্ট বোঝানো যে কবিতা নির্মাণের জন্য কোনো উৎকৃষ্ট পন্থা নয়, এ জানাবোঝার একটা বেআমল এ লেখায় উৎকটভাবে বাঙ্ময়।

৫.
বিপ্লববাসনারঞ্জিত বাংলাদেশ গর্ভবতী হচ্ছে-তে মানুষের চেয়ে মানুষের চুরচুর স্বপ্ন ও সম্ভাবনাই বড়ো হয়ে ওঠে। কবি স্বয়ং একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী হয়ে সশরীরে উপস্থিত এখানে, যিনি মানুষকে কমিউনিকেট করেন বিপ্লব উসকে দেবার মন্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে; যে বিপ্লব, ধারণা করা হয়েছে, দুদিন আগে-পরে নিশ্চিত করবে কথিত সমাজ বদল! বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিদৃষ্টে বাস্তবত এটাকে যত দূরভাষই মনে হোক, অতিশয় নিচুস্বরে লেখাটির শরীর জুড়ে একটা আস্থা রোপণ করে রাখা আছে দেখা যায়। এই সরল আস্থাটি আলোচ্য কবিতার একটা শক্তি হিসেবেই উপস্থিত, যেন। 

৬.
শব্দ অথবা বাক্য নামক রচনাটি কবিতাযজ্ঞ ও তার যজ্ঞাস্ত্র বা উপচার নিয়ে। যজ্ঞাস্ত্র হলেই যে যজ্ঞ হয় না, বরং তার জন্য যে লাগে বিস্তৃত প্রয়োগধারণা ও শাসন, এসব নিয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী এ রচনার সংসার। কবিতায় মিথ্যার (কল্পনার) চিরপ্রবেশাধিকার স্বীকৃত, কিন্তু ওরও মাত্রাগত ব্যাপারস্যাপার নিয়ে কবিকে ভাবিত হতে হয়। ওই ভাবনার একটা রূপরেখাও এ লেখায় ধৃত হয়ে আছে, সতর্কভাবে। একটা চিরক্লিশে দিয়ে শুরু হয়ে ক্রমশ কবিতাটি কবির কাছ থেকে নিজস্ব রূপরং আদায় করে নিয়ে আনন্দপ্রসাদ বিতরণে মেতেছে, দেখা যায়। 

৭.
আত্মসত্তার একটা বিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে শুরু হওয়া সিজোফ্রেনিয়া জানান দেয় যে, তা নতুন সম্ভাবনার দিকেই ধাবিত। ওই ধাবনপর্যায়ে সঠিক পথ নির্বাচনের যোগ্যতা ও চেতনাও রহিত হয় না পথিকের। উল্লিখনের মাধ্যমে যে দার্শনিক সত্যকে হাজির করা হয় এখানে, তা ওই সচেতনতারই পরিচায়ক। এতদসত্ত্বেও, একটা গ্রহণান্ধকার আর দহনছাইয়ের মুখোমুখি হতে হয় তাকে; আর শেষ পরিণতিতে সমীপবর্তী হতে হয় সুফিসুলভ আধ্যাত্মিকতার। এভাবে, একটা অ্যাম্বিগিউয়িটি বা কূটব্যঞ্জনা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এতে, যা রহস্য সৃজন করে লেখাটিকে কবিতার দিকে নিয়ে গেছে আর পাঠকের জন্য রেখে গেছে ছেঁড়া ছেঁড়া ধাঁধার জোগান।

৮.
একটা সমর্পিত ঢঙে ছন্দ ও আঙ্গিক সচেতনতার সুফল নিয়ে বিকশিত হয়েছে তুমি যদি। দেশ, জাতীয় চেতনা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, প্রেম-কাম একাকার হয়ে গেছে ছোট্ট এ লেখাটিতে। এ লেখার ‘তুমি’ কাজেই কোনো গৎ-এর পাল্লায় পড়ে নি, বরং তা ধারণ করেছে বিবিধ ব্যঞ্জনা, যদিও নামটি প্রথমে সে আশঙ্কাই জাগায়। চিত্রময়তা নয়, বরং চিত্রকল্পে ঋদ্ধ এ কবিতাটির সৃজনসৌন্দর্য ও সুমিতি মনোযোগ কাড়ে।

৯.
ভাবছন্দে জীবনাভিজ্ঞতার একটা সরল বয়ানে একজন ক্রীতদাস ও একটি গাধার কাহিনীতে জীবনের তাৎপর্য সন্ধানের প্রয়াস লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। অর্থ, কীর্তি, যশ, সচ্ছলতার অধিক রক্তের ভিতরে যে আরো এক বিপন্ন বিস্ময় খেলা করার কথা বলেছিলেন একদা জীবনানন্দ দাশ, এখানেও যেন সেই আর্তিটি একভাবে ধ্বনিত-রণিত। এ লেখার নায়ক (!) সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে সফল হবার পরও মানসিকভাবে ব্যর্থ হিসেবে চিত্রিত, যা নিয়ে মূর্ত হয়েছে হাহাকার। অতিশয়োক্তির অধিক অলংকারহীন, প্রায়-নিরাভরণ ঢঙে অনেকটা লোকজ্ঞানের স্ফূর্তি নিয়ে অভিজ্ঞতারা উপস্থিত হয়েছে এখানে। জীবনের অনেকটা পথ পেরোবার পর স্বমূল্যায়ন ছলে পেছন ফিরে দেখার এক শিল্পীত দুঃসাহস এটি; যার ভিতর দিয়ে জীবনদর্শনটা স্পষ্ট রূপ পেয়েছে। কবিতাটি একটি অবশ্যম্ভাবী বিষণ্নতার জন্ম দেয়, যা ধারণ করে আছে তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষাও।

১০.
সম্পাদক-এ ব্যঙ্গচ্ছলে শিল্পসাহিত্য জগতে বিদ্যমান গোষ্ঠীবাদী কূট/অপ রাজনীতির আনুপূর্ব তুলে আনা হয়েছে। ক্ষমতার আসন কব্জা করে চাটুকার পরিবৃত হয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে ব্যাঙকে সাপ ও বেড়ালকে বাঘ করে দেখানো, অতি উচ্চম্মন্যতা, অ্যাজেন্সি বিক্রি, সম্মান ও খেতাব আদায় এবং মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা দেবার যে সংস্কৃতি সাহিত্যের আড়তদারদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই, তার একটা ভাষিক ডকুমেন্টেশন এই রচনা। পুরো লেখাটি ১৪ মাত্রার পয়ারে রচিত, তবে দ্বাত্রিংশতিতম লাইনের ‘কী যে’র ২ মাত্রা নিতান্তই অনর্থক ব্যতিক্রম। পুথির সুরে পড়া যায় লেখাটি। যমক অলংকারের একটা অসামান্য ব্যবহার লক্ষণীয় এখানে (এইমতো ভাবে আর ভাবে থাকে খুব)। একাধটা (হ্রী ও সিঁড়ি) বাদ দিয়ে কবিতাটির অন্তঃমিলগুলোর প্রায় সবই উৎরে গেছে।

১১.
একটি ক্ষুরধার সন্দেহকে মিথ্যা করে দিয়ে জন্মপ্রাপ্ত একটি দেশের (এখানে বাংলাদেশ) ইতিহাসের নানা আলো-আঁধারি, উত্থান-পতনের সঙ্গে মিলেমিশে একজন মানুষের জন্ম থেকে শৈশব-কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য যাপনের ক্রমবর্ণনার মাধ্যমে পরিণতি পেয়েছে অঙ্গার। যার মাধ্যমে মানুষটি হয়ে উঠেছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার দ্রষ্টা, ইতিহাসের সাক্ষী। এই একজন মানুষের বিলয় মানে যেন ইতিহাসেরই এক ধরনের প্রয়াণ। এই বোধটিরই দারুণ কাব্যিক উপস্থাপন দিয়ে শেষ হয়েছে কবিতাটি-- ‘আমার মৃত্যু পৃথিবীর শেষতম/সত্যের অঙ্গার...’। এই সরল ও বাহ্য অর্থের পাশাপাশি লেখাটির এই নিহিতার্থ সরবরাহ করবার ক্ষমতাও মনে আসে যে, এখানে উপস্থিত ‘আমি’টি আসলে একজন কোনো মানুষ নয়, বরং দেশই স্বয়ং। এই ব্যঞ্জনা লেখাটির কবিতাত্ব প্রগাঢ় করেছে বলে মনে হয়।

১২.
যমজের দ্বন্দ্ব-সখ্য নামক দ্বিধাময় এই রচনায় জীবন ও মরণ এবং এ দুয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে কবির ভাবনা বিকশিত হয়েছে। রচনাটিতে এ উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে যে, মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ, ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ; কারণ তারা আজঅবধি মৃত্যুর গভীর রহস্যটা উন্মোচন করতে পারে নি। এমনকি প্রকৃতিজগতের আর সব বিস্ময়ও এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। লেখাটির ‘খ’ অংশে এরূপ দার্শনিকতা মূর্ত হয়েছে যে, এই দুই সত্য পরস্পরের মধ্যে একটা সংঘাতপূর্ণ অবস্থানেই টিকে রইল, সমঝোতার দিকে না-এগিয়ে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, জীবন ও মরণের ‘একসঙ্গে তিষ্ঠনোর ইতিহাস’টিই একটি উৎকৃষ্ট সমঝোতা। কিন্তু এ প্রশ্নে একের প্রভাবের কাছে অন্যের পরাভূত হয়ে যাবার মতো ভারসাম্যহীন একটা অবস্থার প্রতিই যেন এ লেখার সমর্থন। সমঝোতা মানে কি এই-ই হওয়া উচিত, কখনো, অন্তত জীবন-মরণ প্রশ্নে? লেখাটি পড়ে প্রসঙ্গত এসব ভাবনা জাগে মনে। লেখাটির বাক্যবিন্যাসে পরীক্ষানিরীক্ষার ছাপ স্পষ্ট, যদিও এর প্রাসঙ্গিকতা মোটমাট অপ্রতীয়মানই থাকে।

১৩.
খুব নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, তোবড়ানো কাগজটির মধ্যে কী এমন বস্তু ছিল, যাকে ডেন্টিস্টের চেম্বারে নামক রচনার মূলরহস্য হিসেবে দানাবাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। সে কি একটি বিকল আধভাঙা দাঁত? একটি ভুল প্রেসক্রিপশন? কিন্তু যা কিছুই হোক, তার সঙ্গে মেয়েটির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। কারণ মেয়েটি এখানে নার্ভাস, যে নোখে দাঁত খুটছে (দাঁতের ডাক্তারের সামনে দাঁতের এহেন অপব্যবহারটা কৌতূহলোদ্দীপক; যদিও এটা স্পষ্ট যে, ছবিটা ব্যবহৃত হয়েছে উদ্বেগ বোঝাতে)। কিন্তু এ দুটো সম্ভাবনার কোনোটির ক্ষেত্রেই মেয়েটির নার্ভাস হবার কথা নয়। কিংবা কালো কাকেরও এজন্য বিপন্ন হবার কোনো কারণ নেই, যদি কালো কাককে ডেন্টিস্টের প্রতীক ভেবে নেই। এসব আলামত শেষপর্যন্ত ‘আমি’ প্রতীকে উপস্থিত সামাজিক মানুষটির দৃষ্টিতে ওখানে একটি অপকর্ম (!) সংঘটনেরই ইঙ্গিত পাওয়া যায়; যে রহস্য তোবড়ানো কাগজটিতে একটি ব্যবহৃত ‘...’-এর অস্তিত্ব কল্পনা করতে প্ররোচিত করে। কিন্তু কবিতার রহস্যোদ্ঘাটনের প্রশ্নে একজন যাকে স্পষ্ট সমাধান ভাবেন, অন্যজনের তা ভাবা মোটেই বাধ্যতামূলক কিছু নয়। এই যে নিরাময়হীন একটি জটিল সমস্যা তৈরি হয়েছে কবিতাটিতে, সেটি এর অন্যতম শক্তি। অবশ্য এ শক্তি কতটা মানবসহায়, কল্যাণবোধ-উসকানিয়া, শিল্পবোধ-জাগরুক; সে বিবেচনা বাকিই থেকে যায়।

১৪.
বৃষ্টি বন্দনা অথবা তার চোখে জল রচনাটিকে একটি প্রেমের কবিতা লিখবার প্রয়াস হিসেবে পাঠ করা যায়। একটা বিশেষ বৃষ্টির বর্ণনা আছে লেখাটিতে, যা নির্দিষ্ট প্রেমিকার হাত ভিজিয়ে দিয়েছে। লেখাসূত্রে প্রকাশ পায় যে, সে বৃষ্টি এমনকি শহরে বান পর্যন্ত ডেকে এনেছে। এটিকে শেষপর্যন্ত একটি অতিবয়ান হিসেবেই পাঠ করতে হয়, যেহেতু শেষ বিকেলের সবুজ ঘাস আনন্দেরই কারণ হয়েছে। এখানে হাত ভিজানোর কাজটি কি অশ্র“র নাকি প্রকৃতই বৃষ্টির, আর বৃষ্টির হলে ওই বৃষ্টি প্রেমিকার চোখের জল মুছে দিয়েছিল কি না-- এই অবিশেষ প্রশ্নরহস্য সৃজন পর্যন্ত এ লেখার দৌড়, যা বিশেষ কোনো সম্পন্ন বোধের সামনে নিয়ে পাঠককে দাঁড় করায় না। খুব ছোট আয়তনের এ লেখায় ছয়-ছয়টি বাক্যের শেষে ‘ছিল’ ক্রিয়ার বিশেষত্বহীন সাধারণ প্রয়োগ লেখাটির একটি উল্লেখযোগ্যরকম দুর্বল দিক।  

১৫.
বাংলাদেশে এটিএম বুথ ব্যাপারটা একটা সাম্প্রতিক প্রপঞ্চ। তবে ইতোমধ্যে এটিএম কার্ডকে স্ট্যাটাস সিম্বল বা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে চিনে নিয়েছে সবাই, অন্তত শিক্ষিত শহুরেজন। লেখাটিতে এটিএম বুথকে বহুগামী বারবণিতার মতো করে আঁকা হয়েছে, যাতে বস্তুতে সঞ্চারিত হয়েছে উচ্ছল এক প্রাণ। যার সক্ষমতা আছে (এখানে সক্ষমতা মানে কার্ড থাকা, আর কার্ড থাকা মানে অর্থের নিশ্চয়তা থাকা), এটিএম বুথ বাছবিচারহীনভাবে তার সাথেই শোয়! কাজেই ‘কারো কোনো স্পর্শে তার নেই অসম্মতি’ খুবই যথার্থ চিত্রায়ণ। কিন্তু একই লেখায় একই বস্তুকে লেখক উলটো চরিত্রটিও দিয়েছেন : ‘স্পর্শে হয়ত দেন অনেক তবে মুখ চিনে-চিনে’। স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধিতা এটি। কবি কি এখানে ‘মুখ থাকে না ছিনে...’র মতো অন্তঃমিলের প্ররোচনার শিকার হয়েছেন? হবেনও বা।

১৬.
পাঠ-এর অনুজ্ঞাজ্ঞাপক বাক্যশাসন যে পাঠপ্রবর্তনের কথা বলে, তা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহের বিবেচনায় ধর্মদ্রোহ, যা মারেফাত বা ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বের দিকে প্রসারিত। সুনির্দিষ্টভাবে ‘আয়নাল হক’ বা ‘আমিই সত্য’ ধারণাটি মরমি সুফি মতাদর্শ এবং ভারতবর্ষীয় সহজিয়া ও বাউল মতবাদ দ্বারা চর্চিত। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ মতাদর্শের বিশেষ কদর আছে। লেখাটি স্বচেষ্টায়, প্রকৃতিপাঠের মাধ্যমে ওই নির্দিষ্ট ভাবনা-বিশ্বাসের দিকে যাত্রায় প্রণোদিত করতে চায়। এটি বলতে চায় যে, প্রকৃতিকে উপর্যুপরি পাঠের ভিতর দিয়ে মানুষের পক্ষে এমন ধারণায় উন্নীত হওয়া সম্ভব, যেদিকে গেলে ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ’না করার দরকারই হয় না। বর্তমান সময়ে মনসুর হাল্লাজের মতো শরিয়তবিরোধী বিপ্লবী সুফির উপস্থিতির প্রাসঙ্গিকতা দেখানো হয়েছে লেখাটিতে, যখন শরিয়তী ভুলব্যাখ্যা ইসলামকে আত্মসত্তা বিকাশের পন্থা হিসেবে দেখবার পরিবর্তে আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে পরিণত করে তুলবার দিকে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। লেখাটির বিষয়গত অভিপ্রায় স্পষ্ট; পাশাপাশি কবিতার দাবি যে এখানে খানিকটা উপেক্ষণীয় থেকেছে তা-ও কমবেশি স্পষ্ট।

১৭.
বলার ধরনে মনে হয় যে, তখনও মানুষ ছিল পৃথিবীতে কোনও জাতিসংঘ ছিল না নামক রচনায় একটা গল্প থেকে গেলেও যেতে পারে; কিন্তু না, থকথকে কোনো গল্প এখানে নেই, আছে কিছু ছিন্নসূত্র মাত্র, মহা থেকে সমকালের। বিষয়গতভাবে লেখাটির বৃহৎ বিস্তার, ভূগোলে ও চিন্তায়। ভিড় করে আছে চূর্ণ চূর্ণ অজস্র চোখ, পুরাণ থেকে সাম্প্রত বেদনা পর্যন্ত। সব মিলিয়ে লেখাটি বিশ্বায়ন, পণ্যায়ন, সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে চায়। ব্যাজস্তুতি বা সূক্ষ্মব্যঙ্গচ্ছলে কবি বলেন যদিও যে, ‘মানবতা নস্যিমাত্র, নাকে গুঁজে নিদ্রা যেতে পার’। আসলে তিনি উলটোটাই বোঝাতে চান, তা নইলে এই লেখনপ্রয়াস দরকারিই হতো না। অক্ষরবৃত্ত চালে এগিয়েছে কবিতাটি, আরো সুনির্দিষ্টভাবে এটির যতি নির্দিষ্ট চৌদ্দ ও আঠার মাত্রার পয়ারে, কিন্তু পঙক্তিবিন্যাসের ঝোঁক মহা-মহাপয়ারের দিকে। এখানে ‘টোডাকন্যা’দের পোশাক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত ‘বসন-প্রহরা’ শব্দবন্ধটা অব্যর্থ, কিন্তু তথ্য হিসেবে দেখলে একটু বিভ্রান্ত হতে হয়। দক্ষিণ ভারতের নীলগিরির বাসিন্দা টোডা নারীরা বরাবরই তাদের শরীর ঢেকে রাখে, এক কাপড়ে যদিও। অবশ্য স্বীকার্য যে, কবিতা বস্তুটা মোটেই তথ্যের জন্যে নয়।

১৮.
উত্তীর্ণ কবিতাগুলো প্রায়ই জন্মায় বিষণ্নতার বাড়ি-- প্রচলিত এই ধারণার দিকে আবারও সমীহের সাথে ফিরে তাকাতে হয় মা কবিতাটি পড়ে। যেরকম ঘোরে গ্রস্ত হলে একটি লেখাকে মগ্নতার শিলালিপি নামে ডাকা যায়, যে বিস্তৃত রহস্য সৃজিত হলে তাকে আবিষ্কারে সে লেখার দিকে বারেবারে ফিরে আসতে হয়, এ লেখা যেন সেরকমই এক শাসন কায়েম করে রেখেছে তার শরীরে। অথচ বিষয়ে এ মৃত্যুবার্তাবাহী, হারানোর মর্মধারী। বিষাদলাগোয়া কবিতাপাগল এক স্বজনের নিতান্ত কবিতাগ্রস্ততার প্রমাণ লভ্য এখানে, যে গ্রস্ততার বলে এখানে পানীয় জল, অশ্রু এমনকি প্রয়াত মা স্বয়ং কবিতারই অন্য নাম হয়ে উঠেছে। লেখাটিতে ব্যবহৃত ‘আলোর ছোবল’, ‘মেঘলিপ্ত সম্ভাবনা’, ‘জলমর্ম’, ‘গার্হস্থ্য-বন’ শব্দবন্ধগুলোর প্রতিটিই যথাযথ ও প্রয়োগসফল। বায়েজিদ বোস্তামির মিথটিও এখানে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। আগাগোড়াই কবিতাটির গতি স্বচ্ছন্দ্য, কেবল ‘এছাড়া স্বীকার করছি... এখানে খারিজ হয়ে যায় নি’ অংশ বাদে। স্রেফ শব্দবিন্যাসগত কারণে এ অংশের গতি শ্লথ, গদ্যের দিকে ঈষৎ হেলানো।

১৯.
চোখ মেলো নামক লেখাটি সামাজিক-লৈঙ্গিক রাজনীতি বিষয়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষ ও নারীর মধ্যকার বাঘ-হরিণমার্কা বিষম সম্পর্কটিই এতে চিত্রিত হয়ে উঠেছে। ভোগলিপ্সায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত পুরুষসমাজ যাপন-পরিসরের সর্বত্র থাবা বিস্তার করে আছে। ভোগপ্রশ্নে তারা সদাই প্রস্তুত। এ এমনই এক প্রস্তুতি যেখানে শিকার ধরায় কোনো বাছবিচার নেই। প্রচলিত সমাজের এ এক ব্যাধি, সকলেই জানে। এখানে দাঁড়িয়ে লেখক নারীসমাজকে ‘ভীতু নারী’ বলে সম্বোধন করে আগের বিবৃতিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। ভয় পাইয়ে দেবার সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখে, যাকে ঘিরে এ ভয়ংকর আয়োজন তাকে ‘ভীত’ ভাবা সত্যের অপলাপ মাত্র। লেখাটি শেষ হয় বক্তৃতামঞ্চের উপদেশের মতো-- ‘সুতরাং আর দেরি নয় জেগে উঠো নারী’ বলে, যার সঙ্গে যুক্ত আছে ‘ঘুমন্ত অগ্নিগিরির মতো’ ক্লিশে উপমা। অবশ্য ‘৭১-এর বাঙালি জাতি’র জেগে ওঠাকে এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও যথাযথ বলে মনে হয়। লেখাটিতে পুরাণের ব্যবহার সুন্দর হয়েছে। 

২০.
নৈমিত্তিক ঘটনাবলি নিয়ে মানুষের মধ্যে সাধারণত বিশেষ কোনো সন্দেহ, সংশয়, প্রশ্ন ইত্যাদি থাকে না। কিন্তু যা দৈবাৎ, মাঝেমধ্যে, কখনোসখনো সংঘটিত হয়, তা নিয়ে মানুষের কৌতূহল সহজাত। মানুষ সর্বদা যদি এই প্রশ্নটিকেই সামনে এনেছে যে, যা অনিয়মিতভাবে ঘটে, তাই-ই যদি নিয়মিত ঘটত তবে কি মানুষ তাকে সন্দেহ করত? আসলে প্রশ্নে থেমে থাকে নি লেখাটি-- জিজ্ঞাসাহীন জোড়াপ্রশ্নে একটা চোরা জবাবের অস্তিত্বও পাঞ্চ করা আছে যে, ‘করত না’। সেক্ষেত্রে এখন যা পাপ বলে চিহ্নি‎ত, তাকে কেউ পাপ বলে মনে করত না, কিংবা পুণ্যকে পুণ্য। এই সত্যটি প্রতিষ্ঠার অধিক এ লেখায় আর কোনো ব্যঞ্জনা সহজলভ্য নয় মনে হলো। মুক্তক অক্ষরবৃত্তে রচিত এ লেখার আভাসাত্মক অলংকারের প্রয়োগ দৃষ্টি কাড়ে।

২১.
উত্তম পুরুষে বর্ণিত বঙ্গোপসাগরের প্রতি রচনার কথক আত্মসমালোচনামুখর ও সমর্পিত, তবে এ সমর্পণ সম্ভবত ঈশ্বরের প্রতি নয়। একটা সরল, নির্বিরোধ, স্বাধীন জীবনের প্রত্যাশা মার খাওয়ায় মায়ের প্রতীক সমুদ্রকে সাক্ষী মেনে মৃত স্বপ্নবৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়েছে এতে। একটা শান্ত, নম্র ও বিষাদাত্মক স্বর দখল করে আছে গোটা লেখাটিকে। উল্লিখন (লোকগান থেকে-- হরি নামে সুর বেঁধে দাও হে একতারায়; পুরাণ থেকে-- সুলেমানী তরবারি, শাঁখা ও সধবার মিথ), ব্যক্তিত্বারোপণ (রোদ এসে জিরোবে তার পত্রপল্লবে), চিত্রকল্প (প্রাণ কেন পড়ে যাচ্ছে মুঠো উছলে), রূপক (তবু কেন স্লেজ টানা কুকুর হয়ে উঠছি) অলংকারের সফল ব্যবহার দেখা যায় কবিতাটিতে।


লজ্জার মাথা খেয়ে বলি, আমার এই আলোকপাত, এখানে, একদমই ভাসা ভাসা। বোকামির নমুনায় ভরা হাস্যকর প্রচেষ্টাও হয়ত বলা যাবে একে। সেক্ষেত্রে একে ওরকমভাবেই গ্রহণ করে সক্ষমতা-উজ্জ্বল আরো এক বা একাধিক ভাষ্য এর পাশে তৈরি হোক। সব মিলিয়ে তখন কবিতাগুলো সম্পর্কে একটা পরিণত পাঠ প্রস্তুত হবার অবকাশই তৈরি হবে। তাই হোক, বরং তাই হোক।

শওকত হোসেন সম্পাদিত গোলাঘর-এ প্রকাশিত

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...