Tuesday, October 26, 2010

কবিতার বিষয় ও চঞ্চল আশরাফের কবিতার জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট বিষয়োপাদান

কবিতার কি নির্দিষ্ট কোনো থিম বা বিষয় হয়? এর জবাব যুগপৎ ‘হয়’ এবং ‘হয় না’। মোটাঅর্থে সব কবিতারই কোনো-না-কোনো বিষয় শনাক্ত করা যায়, চাইলে। কোনো-কোনো কবিতা আক্ষরিকভাবেই নির্দিষ্ট একটা বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে, কোনোটার-বা একটা কোনো বিষয়কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ওসবে বিভিন্ন বিষয়ের চূর্ণ-চূর্ণ রেণু এসে মিশে থাকে আলগোছে, অবলীলায়। সব মিলিয়ে এমন এক জটিল বিষয়ভাবনার ওগুলো জন্ম দেয় বা এমন একটা বিষয়রূপ ওসব কবিতা ধারণ করে, যাকে ওই-ওই খণ্ড উপাদানের নামে আর ডাকা যায় না। ডাকতে-চিনতে হয় অন্য কোনো নামে; দুই অণু হাইড্রোজেন এক অণু অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে গেলে যেমন তাকে হাইড্রোজেন বা অক্সিজেন না-বলে পানি নামে ডাকতে হয়। এরকম প্রেক্ষিতে কবিতার কোনো বিষয় হয় না বলাও একভাবে সত্য বলাই; যদিও কবিতা বিষয়নির্দিষ্ট, এই মতটিই সর্বাপেক্ষা চর্চিত। চঞ্চল আশরাফ নিজেও এরকম করে ভাবেন বলে জানি (‘কিভাবে লিখছি-র পাশাপাশি কী লিখছিও বড় কথা’ : চাবিশব্দই যখন কবিতার প্রধান সহায়)।

আমরা দেখি, ভাষাগত উপাদানসহযোগে কবিতা অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়, স্বপ্নকে ভাষা দেয়, মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে মত দেয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়, পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে, গল্প বলে। ইত্যাকার কাজবাজের এই অসম্পূর্ণ তালিকাটি কবির দিক থেকে। পাঠকের দিক থেকে দেখলে এ কাজগুলোর একটি বা কোনো-কোনেটির প্রভাবে পাঠকের মধ্যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ যে ক্রিয়া-বিক্রিয়া সংঘটিত হয়, তা-ও কবিতারই দ্বিতীয় ধাপের কাজ। আনন্দ পাওয়া বা তাড়িত, উদ্বুদ্ধ, বিষাদগ্রস্ত ও বিরক্ত হওয়া ইত্যাদি এ পর্যায়ে সংঘটিত কাজ। এটা পাঠকের ওপরে কবিতার তাৎক্ষণিক বা সরাসরি প্রভাব। তৃতীয় একটা ধাপও আছে কবিতার কাজের, যেটা ধীরগতিতে সম্পন্ন হয়। কবিতার দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়িত্বশীল প্রভাব বলা যায় একে। ব্যক্তিপাঠককে ছাড়িয়ে যখন আমরা বৃহত্তর সমাজে কোনো-কোনো মহৎ কবির কর্ম ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব দেখি, তখন এ পর্যায়ের কাজ ঠিকঠাক বুঝতে পারা যায়। এরকম ক্ষেত্রে আমরা নাম করতে পারি সমাজসদস্যদের মানসগঠন, রুচিগঠন, বাচনসৌন্দর্য সৃজন, প্রবাদসত্য হিসেবে পথ দেখানো ইত্যাদির। তিন ধাপে এই যত কাজকাজ এখানে চিহ্নি‎ত হলো কবিতার, কবিতা যদি সম্পূর্ণভাবে বিষয়রিক্ত বা রহিত হতো, তাহলে এর কোনোটাই প্রায় সম্ভব হতো না বলা যায়।

বিষয়ের এই থাকা না-থাকা, কিংবা যদি বলি দানাবাঁধা স্পষ্ট-সরল বিষয় থাকা বা চূর্ণ-চূর্ণ বিষয়রেণু থাকা-- এসবেরও নানা জাতভেদ ভাবা যেতে পারে। বাকি সব জাতভেদের ভাবনা আপাতত তোলা থাক, এ মুহূর্তে অন্তত এটা বলাই যায় যে, কোনো-কোনো বিষয় হতে পারে সমসাময়িকতা-সর্বস্ব, কোনোটা-বা চিরকালীন; কোনো-কোনোটা হতে পারে নিছক ব্যক্তিক, কোনোটা-বা নৈর্ব্যক্তিক বা সর্বজনীন। স্বীকার্য যে, কবিতার তথা শিল্পের বিষয় হিসেবে এই দুটি ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়োক্তের স্থান সর্বাগ্রগণ্য। এই সেই কারণ, যেজন্য কবিতাকে ব্যক্তিক সীমার বাইরে নিয়ে যাওয়া ও সমসাময়িক অভিজ্ঞতাকে চিরকালীন সাধারণ সত্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবার জন্য সমসাময়িক কোনো ব্যক্তিক ঘটনা থেকে তাড়িত হয়ে রচিত কবিতার কবিকেও চেষ্টা জারি রাখতে হয়। এ না-হলে সে কবিতার গ্রহণযোগ্যতা যেমন প্রশ্নাতীত হয় না, তেমনি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে তা প্রাসঙ্গিকতাও হারিয়ে ফেলে। চঞ্চল আশরাফের কবিতা পড়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, শিল্প তথা কবিতাযাত্রার এই প্রাথমিক পালনীয় শর্তটি তিনি জানেন শুধু নন, চর্চা করবার যোগ্যতাও রাখেন।

জীবজগৎ ও জড়জগৎ উভয়েরই কিছু সাধারণ গতিপ্রকৃতি থাকে, যা হাজার হাজার বছর ধরে অবিকল আছে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষ এসব গতিপ্রকৃতি নিজেদের অভিজ্ঞতায় গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার লব্ধ এই জানাবোঝাকে পর্যবেক্ষণের সীমা থেকে টেনে তুলে পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছে। বিজ্ঞানের এই সত্যগুলোর সাপেক্ষে কবিতা যখন তার নিজ বৈশিষ্ট্যযোগে কবিতার সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তখন সে কবিতার বেঁচে থাকার একটা অন্তত শর্ত পূরণ করা হয়ে যায়। এই শর্ত চঞ্চল আশরাফ প্রায়ই পূরণ করেছেন, তাঁর কবিতায়। এ অর্জনকে শ্রেণীকরণ করতে চাইলে আমরা দেখি তাঁর ঝোঁক জীবজগতের তিনটি বিশেষ পর্যায়েই ক্রিয়াশীল-- জন্মপ্রক্রিয়া, যাপনশৈলীসন্ধান ও বিলয়ঘটনা। আর এর সাথে জড় ও জীবপ্রকৃতির নানা উপাদান মিলেমিশে গেছে, যখন-যেটুকু-যেভাবে তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

দেখা যায়, এই তিনের মধ্যে যাপনশৈলীসন্ধানের কাজটিই করেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কবি, সব ভাষায়ই। করেন সংগত কারণেই। কারণ এই পর্যায়টিই সবচেয়ে বেশি ব্যাপ্ত, পরিচিত, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সহজগম্য। কমবেশি জন্মপ্রক্রিয়া ও বিলয়ঘটনাও কারো কারো প্রিয়। এ দুটোর বৈচিত্র্য কম, কিন্তু চিরন্তনতার বৈশিষ্ট্যে এরাই প্রথম সারির। এ দুয়ের মধ্যে আবার বিলয় বা মৃত্যুঘটনার নানামাত্রিক প্রকাশ সামাজিকভাবে যতটা গ্রহণযোগ্য, জন্মপ্রক্রিয়ার প্রকাশ ততটা নয়। অথচ জীবমাত্রের কাছে ওটাই বেশি প্রার্থিত, আর মৃত্যুকে এড়াবার চেষ্টায় তারা সদা তৎপর। জন্ম না-বলে আমরা যখন জন্মপ্রক্রিয়া বা জননপ্রক্রিয়া বা প্রজননপ্রক্রিয়া বলি, তখন তা কেবল জন্মঘটনাটিই নয়, প্রকাশিত হয় এর সঙ্গে সম্পর্কিত ক্রিয়াসমূহও। এর অন্তর্ভুক্ত সমুদয় যৌনকল্পনা, যৌনাভূতি, যৌনক্রিয়া, যৌনানন্দ প্রভৃতি। সভ্যতা কর্তৃক শেখানো আড়ালচারিতা এবং ধর্মবাহিত ও সামাজিক সংস্কারজনিত নৈতিকতা জন্মঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ইত্যাকার বিষয়াদির প্রকাশ এবং এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত জীবাদির সমুদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গোপন বিষয় বলে সাব্যস্ত করেছে। অথচ এটার উল্লেখ বাহুল্য হবে না যে, জীবমাত্র এবং সুনির্দিষ্টভাবে মানুষমাত্র তা সে নারী কিংবা পুরুষ যেই হোক, আনন্দার্থে যৌনাচারকে পছন্দ করে এবং প্রজননার্থে যৌনকর্মকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান করে। যা মানুষ পছন্দ করে, প্রত্যাশা করে, প্রয়োজনীয় জ্ঞান করে অথচ চাহিবামাত্র তার চর্চা করতে পারে না, তখন এই বাস্তবতাটিই সৃষ্টি করে অবদমন। জন্মপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত অবদমনকে আমরা যদি বিশেষভাবে শনাক্ত করতে চাই, তাহলে তাকে আমরা বলতে পারি যৌন অবদমন। এই যৌন অবদমন মানুষের মধ্যে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, তা মানুষভেদে নানারকম ফল দেয়। এই মানুষটি যদি হন কবি, তবে তাঁর কবিতায় এর প্রকাশ থাকবে, অন্তত বলা যায় যে, থাকতে পারে। কবিতা নির্মাণের শৈলীকলা ভালোভাবে আত্মীকৃত না-হলে এসবের কামগন্ধী অশ্লীল অপকৃষ্ট রচনা হয়ে ওঠবার আশঙ্কা থাকে, আর জানা থাকলে তা হতে পারে শৃঙ্গাররসসম্ভূত উৎকৃষ্ট কবিতা।

যৌন অবদমন বা কোনো ধরনের যৌনবিকার চঞ্চল আশরাফকে শাসন করে কি না তা নিশ্চিত করে বলার কোনো সুযোগ নেই। এটা প্রতিপন্ন করা এ বাক্য বিবৃত করার জন্য জরুরিও নয় যে, চঞ্চল আশরাফের কবিতায় আমরা জন্মপ্রক্রিয়ার অধীন বিস্তৃত এলাকার আওতায় পড়ে এমন বিষয়োপাদানের বিস্তর প্রয়োগ দেখতে পাই। বলাই বাহুল্য যে, সবসময় তা মুখ্য বিষয়রূপে নয়, পার্শ্ববিষয় হিসেবে বা বিষয়চূর্ণরূপেও তারা বিরাজমান। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ চোখ নেই দৃশ্য নেই (১৯৯৩) থেকে শুরু করে অসমাপ্ত শিরদাঁড়া (১৯৯৬) এবং ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে (২০০২) হয়ে শেষ কাব্যগ্রন্থ গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো (২০০৮) পর্যন্ত এসবের সমূহ বিস্তার। চঞ্চল আশরাফের কবিতার এ ধরনের বিষয়োপাদানের প্রয়োগগত শ্রেণীকরণ ও তদ্বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের উদ্দেশ্যেই এ লেখা পরিকল্পিত।

আলোচনার সুবিধার্থে আমরা জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলিকে কয়েক ভাগে ভাগ করে দেখব। ভাগাভাগি বা খণ্ডীকরণ আক্ষরিকভাবেই বৃহদ্ধারণাকে ক্ষুদ্র পরিসরে এনে দাঁড় করায়, কাজেই তা বিষয় সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা দেয় না। এই বিবৃতি যেমন সত্য, তেমনি এ-ও মিথ্যা নয় যে, বিষয়বস্তুকে খণ্ড খণ্ড করে তারপর তাতে দক্ষতার সাথে আলো প্রক্ষেপণ করা গেলে এমন কিছু সূক্ষ্ম ব্যাপার বড়ো হয়ে সামনে চলে আসে যে, ওসব বিষয়বস্তুর পূর্ণ অবয়বের ওপরে আলো ফেললে প্রায় দেখাই যায় না। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেখা-জানা একসঙ্গে করে পরে সামগ্রিক সিদ্ধান্ত টানা যায়। এই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্তে পৌঁছা চিন্তারাজ্যে স্বীকৃতও।

এখানে কথিত জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলিকে আমরা দেখব মোটাদাগে তিনভাগ করে-- ১. জননসত্য, ২. কামসত্য ও ৩. যৌনঅপরাধ হিসেবে। প্রতিপাদ্য বিষয়ের এই তিনটি রূপই চঞ্চল আশরাফের কবিতায় লভ্য, অন্তত আমার চোখে। উদাহরণ দেখা যাক।

১. জননসত্য

ক.
একটি টিকটিকি
ছুটে গেল আরেকটি টিকটিকির দিকে
একটি মোরগ প্রকাশ্য দুপুরে
উপগত হলো আরেক মুরগিশরীরে

একটি পাখির ঠোঁট
সংযুক্ত হলো আরেকটি পাখির ঠোঁটে
একটি কুকুর দুর্দান্ত দুপুরে
দখল করল একটি কুকুরীর গুহ্যদেশ

এক নিঃসঙ্গ বিধবা
এইসব দৃশ্য পাহারা দিতে দিতে
স্বর্গে চলে যায়
(‘বিধবা ও পশুপাখি’, চোখ নেই দৃশ্য নেই)

খ.
মানুষের অসমাপ্ত শিরদাঁড়া বেঁকে যায় শিশ্নক্ষমতা তার যখন বাজায়
শেষ ঘণ্টাধ্বনি
(‘চক্র’, অসমাপ্ত শিরদাঁড়া)

গ.
ঠোঁটে ছিলো স্তন, প্রসবের পরের উষ্ণতা, ও-তো শিশুদেহ
আনন্দের উপজাত প্রাণ, শয্যার মত্ততা থেকে কোন পুরুষ কখনো
তার নারীকে বলেনি : আজ তোর গর্ভদিন, প্রত্যাশিত প্রাণের সূচনা
ঘটে যাক
(‘কবি’, ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে)

ঘ.
উঠোনের কোনে শৌচকর্ম শেষ করে এক নারী
তাকালো আমার দিকে; যেন খুব যৌন-অপরাধ হয়ে গেল--
তার গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা দেখে ফিরে আসি...
(‘সুইসাইড-নোট ৩, গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো)

নিঃসঙ্গ বিধবার বেদনাকে মূর্ত করতে গিয়ে প্রথম উদ্ধৃতিতে বিভিন্ন প্রাণীর প্রজননদৃশ্য এঁকে চঞ্চল জগতে প্রাণের চিরপ্রবহমানতাকেই চিত্রিত করে ফেলেছেন। দ্বিতীয় উদ্ধৃতির শিশ্নক্ষমতা দিয়ে সকল ধরনের সক্ষমতাকেই বোঝায়, যার মধ্যে জন্মদান-সক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট। এক্ষেত্রে অক্ষমতা, এক অর্থে প্রাণপ্রবাহেরই লয়। সংগত কারণে এই পঙক্তি জননসত্যের অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় উদ্ধৃতিতে চিত্রিত শিশুর মুখে মাতৃস্তন, মা-শিশুর মধ্যকার এক চিরন্তন সত্যছবি, যতই শিশুজন্ম মা-বাবার মধ্যকার আনন্দের উপজাত হোক (শিশুজন্ম কেবল মা-বাবার আনন্দের উপজাত কি না, এ নিয়ে দোসরা বাগবিস্তারের অবকাশ আছে; তবে এ মুহূর্তে তাতে নিরস্ত হওয়া গেল)। শেষ উদ্ধৃতিতে গ্রামবাংলার পয়ঃব্যবস্থার একটা বিশ্বস্ত ছবি ধরা পড়েছে। শৌচকর্মের দৃশ্য দেখা সন্তানসম্ভবা নারীর দৃষ্টিতে যৌন-অপরাধ হোক বা না-হোক, গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনাটি এখানে প্রাণের পক্ষে এক ব্যাপক জয়ধ্বনি। কবিতায় কিংবা অন্য যেকোনো লেখায় জন্মপ্রক্রিয়ার এ ধরনের চিত্রায়ণ চিরসম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়ায়, ধরে সর্বজনীনতার শক্তিও, সম্ভবত। 

২. কামসত্য

ক.
আমি মৃত্যুর সঙ্গে শয্যায় গেলাম
সে তার স্তনের শীর্ষ মুখে পুরে দিয়ে
বিলি কাটল আমার চুলে
গিটারে অভ্যস্ত আমার আঙুল
ঘুরে বেড়ালো তার নিতম্বে ও গ্রীবায়
মৃত্যুর মাংশও বেজে উঠল গিটারের মতো
...
আমার যৌনদৃশ্যে উত্তেজিত সেই নারী
বেশ আগে ব্যস্ত ছিল মসৃণ হস্তমৈথুনে
কী সুন্দর, স্বর্গসম্মত ছবি! 
(‘মৃত্যুমৈথুন, চোখ নেই দৃশ্য নেই)

খ.
আমাদের যৌনান্ধ জাগরণ শেষে হয়ে গেছে : যৌথ লাম্পট্য, মূর্খতা
দিগম্বর হাওয়ায় রেখে শরীরের ভর
...
ঘুমের ভেতর কেন জেগে ওঠে লাল থাম, ছুরি, দাঁত, মৃত্যু
বেশ্যার বিশ্রস্ত পাঠশালা
(‘দাম্পত্য’, অসমাপ্ত শিরদাঁড়া)

গ.
তুমি কি রেখেছ মনে
যৌবনের প্রথম প্রদোষে
এক এলোমেলো উদাসীন অন্ধকারে
দশটি আঙুল
উত্তাপের অলিগলি ঘুরে, হেঁটে হেঁটে
খুঁজেছিল স্তন আর নিতম্বের গোপন উপমা
তোমার শরীরে, সারারাত
(‘বিস্মৃতি’, ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে)

ঘ.
কে ধরেছে কার অঙ্গ, এটা কি মনীষা কৈরালার হাত? মৌলবির
ছেলে রাতে স্বপ্নে দেখেছে তাকে, ঘুম থেকে ছুটি নিয়ে সে ছুটেছে
তারকার দিকে;
...
গোছলের আগে সে বসেছে ওই তারকার ছবি নিয়ে, যার ওমে
ঘুম টুটে গেল তার; আর সুখের বিনিদ্র ফোঁটা ঝকমকিয়ে উঠছে
নীরবতায় রেখে-আসা রাতের আকাশে
(‘মাস্টার্বেশন’, গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো)

‘মৃত্যুমৈথুন’-এ নারীরূপী মৃত্যুর সঙ্গে কামলীলার যে বিবরণ হাজির করা হয়েছে, সেখানে জড়তুল্য মৃত্যুর জীবিতের মতো আচরণ করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু দ্রষ্টব্য নেই। এই পারসনিফিকেশনকে অজাচারের দিকেও খানিকটা অবনত বলে মনে হয়। ‘দাম্পত্য’ বিগত হয়ে যাওয়া যৌনান্ধ জাগরণকালের বর্ণনা করে নিজেও যৌনান্ধ আসলে। ‘বিস্মৃতি’ কামোন্মাদ এক যুবকের কামসর্বস্ব নৈশঘটনার সরাসরি বিবরণ। কৈশোরকালীন এক যৌননিরীক্ষার নাম ‘মাস্টার্বেশন’; এরকম একটি নিরীক্ষাক্রিয়ারই আনুপূর্বিক বয়ান রয়েছে এ নামের কবিতায়। কবিতায় কামসত্যের প্রয়োগ প্রকীতায়িত হলে অনেক শোভন হয়। চঞ্চল মাঝেমধ্যেই প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে কথা বলেন নি তা নয়, তবে সরাসরি বলাতেই তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য লক্ষ করা গেছে বেশি। এ জাতীয় প্রয়োগ তাঁর কবিতায় সবচেয়ে বেশি।   

৩. যৌনঅপরাধ

ক.
বিয়ের আগে তিনি সন্তান চাইলেন;
তার প্রেমিকা গর্ভবতী হলো।
(‘বিলাসিতা’, চোখ নেই দৃশ্য নেই)

খ.
জানালার শিক ধ’রে দাঁড়িয়েছে বিবাহিত নিঃসঙ্গ মেয়েটি
কুয়াশা জানে না
নির্ঘুম শয্যায় ছিলো তার ধর্ষকের অভিষেক, আঙুল ও মাংশময় ছুরি
(‘ঘড়িতে সকাল সাতটা তখন’, অসমাপ্ত শিরদাঁড়া)

গ.
কতকাল রতিক্রিয়া নেই কারো সাথে
পুতুলের মুখোশে সুন্দর মাগিরা
কোথায় গেল? উদ্যান-দরজা থেকে ধরে
নিয়ে এলাম বিশ্বস্ত ঘরে, শাড়ির সমস্ত প্যাঁচ
খুলে দেখি : তার বুক থেকে পালিয়েছে স্তন, সেখানে
রয়েছে ঝুলে মৃত ঠোঁট, বহু পুরুষের
...
মৈথুন অসম্ভব বুঝে ছুটে যাই অরক্ষিত নারীগৃহে
ধর্ষণের কথা ভাবি... 
(‘প্রেক্ষিত’, ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে)

ঘ.
একদিন ছাদে শাড়ি মেলে-দেওয়া বিষণ্ন মহিলাকে
জড়িয়ে ধরেছিলাম স্বপ্নের ভেতর
(‘স্মৃতিচারণ’, গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো)

সামাজিক, নৈতিক ও আইনগত দিক থেকে বিয়ের আগে সন্তান ধারণ আমাদের সমাজে অপরাধ। ‘বিলাসিতা’য় এ অপরাধটি স্বীকৃতি পেয়েছে। বিবাহিত নারী যে তাঁর/তাঁদের স্বামীর হাতেও ধর্ষিত হতে পারেন, ‘ঘড়িতে সকাল সাতটা তখন’ থেকে নেয়া এ উদ্ধৃতি তার স্মারক হয়ে গেছে। একটি বিশিষ্ট যৌনঅপরাধ বিষয়ক এ বর্ণনা এ কবিতার প্রেক্ষিতে যদিও নির্দোষ। বহুগামিতার অপরাধে ভাড়া করা যৌনকর্মীর প্রতি উপেক্ষা দেখানোয় ‘প্রেক্ষিত’ কবিতার পুরুষটি পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে যৌনকর্মী ভাড়া করতে পারে, সে নিজে একগামী তো নয়! কিন্তু একথা সে বেমালুম ভুলে গিয়ে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের জন্য মনে শক্তি সঞ্চয় করে। ছাদে শাড়ি মেলে দেয়ারত নারী বিষণœ হোন কি প্রসন্ন হোন তাঁকে জাপটে ধরা সংগত কর্ম নয়, যতক্ষণ না এ কাজে তাঁর সম্মতি থাকছে। ‘স্মৃতিচারণ’টা স্বপ্নে হলেও কাগজপত্রে ঘটা এই ঘটনাটি অপরাধই। যৌনঘটনার এ ধরনের প্রয়োগ প্রায়ই ঝুঁকিমুক্ত হয় না।

এখানে চঞ্চল আশরাফের চারটি কবিতাগ্রন্থ থেকে জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের কিছুমাত্র প্রয়োগের নমুনা তুলে ধরা হলো। বস্তুতপক্ষে এটিকে তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বিষয়োপাদান (বিষয়খণ্ড ও বিষয়চূর্ণকেও ধর্তব্যের মধ্যে এনে) হিসেবেই খুঁজে পাওয়া যায়; এবং অ্যালার্মিং যে, কবি হিসেবে চঞ্চল আশরাফের যতই পরিণতি আসছে, এ প্রবণতা যেন তাঁর মধ্যে ততই বাড়ছে। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থটি প্রায় কণ্টকিত হয়ে আছে এ ধরনের উপাদানে, যা সংখ্যাগত দিক থেকেও আগের তিনটি গ্রন্থ থেকে বেশি বলে মনে হয়। তিনপর্বে উদ্ধৃত তিনটি করে কবিতা ছাড়াও তাঁর প্রতিটি গ্রন্থেই প্রতিপাদ্যের আওতাভুক্ত উপকরণ-সম্বলিত আরো অনেক কবিতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত একটা তালিকার খসড়া করতে চাইলে তা এরকম দাঁড়াতে পারে-- চোখ নেই দৃশ্য নেই গ্রন্থের পঠিত দশটি কবিতার মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের স্বপ্নবৃত্তান্ত; ভয়; রক্তলিপি; বিবাহ; অসমাপ্ত শিরদাঁড়ার ভারতবর্ষ; বিবাহ; বিজনক; বন্ধ্যা নারীর গান; দাহ; বিচ্ছিন্ন শরীরের গান, বিচ্ছিন্ন রাতে; অন্তিমতার গান; শিরোনামহীন কবিতা : মৃত মানুষের ছায়া ও রৌদ্রের রোদনভুক্ত ৫টি কবিতা; ও-মুদ্রা রহস্যে মেশের দৈহিক বৃষ্টিযাপন; নিমজ্জন চিত্র; নিমজ্জন চিত্র-২; আত্মগান, ভ্রমণ কাহিনী; নির্ঘুম; অভিসার; ইতিহাস; অনিদ্রারোগীর গান; পূর্বরাগ; অবৈধ; মুখ; বিপতœীক; কোলাহলে আদিগন্ত ঢেকে যায়; খেলা; চাবুক; সম্পর্কমন্থন; রেললাইন শুধু রেললাইন... এবং গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলোর শিকার; খেলা; স্ট্র্যাপ; ধর্ষণ; ঝুলন্ত খিলান; বিজ্ঞাপন; অভিভাবিকা; প্রাপ্তবয়স্কের ডায়েরি; বৃষ্টিতীর; আষাঢ়ের একটি কবিতা; ছাতার তলা থেকে দু’ছত্র; নারীর ভেতরে কাঁপে; সুইসাইড-নোট; সুইসাইড-নোট ৪, ঘুমন্ত নারীর দিকে; বহুগামিতার বীজ; পাতা; চিঠি নয় ও তুলনার অন্ধকার। তালিকাভুক্ত এসব কবিতায় কোনো-না-কোনোভাবে এরকম বিষয়োপাদানের প্রয়োগ শনাক্ত করা যায়। এ ধরনের কোনো কোনো পঙক্তির প্রতি তাঁর আসক্তি এতই তীব্র যে, একই বইয়ের একাধিক কবিতায়ও প্রায় অবিকল রূপে তা হাজির হয়ে গেছে। যেমন ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে গ্রন্থের ‘অবৈধ’ কবিতার এই পঙক্তি-- ‘সঙ্গমের পর তুমি গোসল করেছ, চুম্বনের পর গেছ বেসিনের দিকে’, একই গ্রন্থের ‘সম্পর্কমন্থন’ কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘তুমি তো সঙ্গমের পর/গোসল করেছ, চুম্বনের পর দৌড়ে গেছ বহুদিন বেসিনের দিকে...’ হিসেবে।

কবিতায় যৌনপ্রসঙ্গের ব্যবহার কমবেশি প্রায় সব কবির লেখায়ই মেলে, যাঁদের কেউ সরাসরি এরূপ প্রসঙ্গের অবতারণা করেন, কেউ-বা রূপকের ছলে ও প্রতীকের ছায়া তৈরি করে পরোক্ষভাবে। কবির মেজাজই ঠিক করে দেয় প্রয়োগটি ঠিক কীরকম হবে বা হওয়া উচিত। কবিতার মৌলাভীষ্টও হয়ত এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আমরা দেখি, কারো কারো কবিতায় এসব উপাদানের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। আমরা আল মাহমুদের কবিতায়, বিশেষ করে নারীদেহ প্রসঙ্গে, এ ধরনের ব্যাপক প্রয়োগ দেখি। যৌনউপাদানের তুলকালাম ব্যবহার পাই হাংরী কবিদের কবিতায়। আমাদের কোনো কোনো গণ্যকবি কবিতায় যৌনতার নানামাত্রিক প্রকাশ নিয়ে আলাদা বই করে বিশিষ্টতার দাবিদার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে নাম করা যায় বিনয় মজুমদার ও নির্মলেন্দু গুণের। বিনয় মজুমদারের বাল্মিকীর কবিতা (১৯৭৬) এবং নির্মলেন্দু গুণের বাৎসায়ন (২০০০) ও কামকানন (২০০৭) এ ধরনের বিশেষায়িত গ্রন্থ। কামকাব্যে এ দুজনের কুশলতা নানা বিতর্কের যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি এসব কাব্য ব্যাপকভাবে পঠিতও হয়েছে। সুতরাং আমি কিছুতেই এরকম কোনো কথা এখানে বলার প্রয়াস করব না যে, যৌনবিষয়াদি নিয়ে কাব্যরচনা করা মন্দ কিছু। যৌনতা জীবজগতের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ, যা না-থাকলে জীবনপ্রবাহ থেমে যেত। এ কারণে কবিতায় যৌনানুষঙ্গের উপস্থিতিও অনিবার্যই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। সুতরাং এর উপস্থিতির যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলার চেয়ে উপস্থিতির ধরন নিয়ে কথা বলাই অধিকতর সংগত। এখানে আনাড়ির মতো করে হলেও কমবেশি সে চেষ্টাটাই শুরু করা হয়েছে। এখানকার এ শ্রেণীকরণ যদি চঞ্চল আশরাফকে তাঁর প্রয়োগকৃত কথিত জন্মপ্রক্রিয়াসংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি অন্যের চোখ দিয়ে দেখবার কোনো সুযোগ করে দিতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে ধারণা করি, তিনি তাঁর পরবর্তী কবিতাযাত্রায় এসব অনুষঙ্গ হাজির করা ও প্রয়োগসাফল্য দেখানোর স্বতরিকায় খানিক পুনর্বিবেচনা আরোপ করবেন-- এই বিবৃতি দূরসীমায় বসবাসরত নৈতিক ও বৈয়াকরণিক খবরদারির লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো অসহিষ্ণু ধর্মবেত্তা বা উজ্জ্বল অ্যাকাডেমিশিয়ানের মূল্যবান উপদেশ নয়, বরং নিকটসীমায় বিহাররত সতীর্থ ও সুলভ এক কবিতাকর্মী-পাঠকের খসড়া ভাবনার উপসংহার মাত্র।

চরৈবেতি!

চরৈবেতি!

অনিকেত শামীম সম্পাদিত লোক-এর চঞ্চল আশরাফ সংখ্যায় প্রকাশিত

No comments:

ভাষাবস্তু অবয়বে ধরে রাখে ভাষাচিন্তারেখা

ধর্মতত্ত্ব, বিবর্তনতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অত্যল্প জানাশোনা আমাকে এরকম একটা গড় ধারণা দেয় যে, মানবপ্রজাতি আদিতে এক গোষ্ঠীভুক্ত ছিল। বি...